আসসালামু’আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ
মহান আল্লাহর অলী সম্পর্কে সমাজে বিভিন্নরুপী ধারনা রয়েছে। সঠিক জ্ঞান না থাকার কারনে অনেকেই বিপথগামীতায় পড়ে যান। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। নীচে এই বিষয়টির কিছু সম্মানিত স্কলারদের লেখনী থেকে নেয়া, কিছু তাফসির থেকে নেয়া।
আল্লাহর অলী সম্পর্কে মহান আল্লাহ কুর’আনেই ইরশাদ করেছেন।
১০:৬২ اَلَاۤ اِنَّ اَوۡلِیَآءَ اللّٰهِ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ
৬২. জেনে রাখা আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।
১০:৬৩ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ کَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ
৬৩. যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করত।
১০:৬৪ لَهُمُ الۡبُشۡرٰی فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ فِی الۡاٰخِرَۃِ ؕ لَا تَبۡدِیۡلَ لِکَلِمٰتِ اللّٰهِ ؕ ذٰلِکَ هُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ
৬৪. তাদের জন্যই আছে সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে, আল্লাহর বাণীর কোন পরিবর্তন নেই; সেটাই মহাসাফল্য।
আরবী (الوِلايَة، الوَلايَة بكسرة الواو وفتحها) বিলায়াত, বেলায়াত বা ওয়ালায়াত অর্থ নৈকট্য, বন্ধুত্ব বা অভিভাবকত্ব (closeness, friendship, guardianship)। ‘বেলায়াত’ অর্জনকারীকে ‘ওলী’ বা ‘ওয়ালী’ (الولى) বলা হয়। ওলী অর্থ নিকটবর্তী, বন্ধু, সাহায্যকারী, অভিভাবক ইত্যাদি। বেলায়াত ধাতু থেকে নির্গত ‘ওলী অথের্রই আরেকটি সুপরিচিত শব্দ ‘মাওলা’ (مولى)। ‘মাওলা’ অর্থও অভিভাবক, বন্ধু, সঙ্গী ইত্যাদি (master, protector, friend, companion)।
ইসলামী পরিভাষায় ‘বেলায়াত’ ‘ওলী’ ও ‘মাওলা’ শব্দের বিভিন্ন প্রকারের ব্যবহার রয়েছে। উত্তরাধিকার আইনের পরিভাষায় ও রাজনৈতিক পরিভাষায় এ সকল শব্দ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত। তবে বেলায়াত বা ওলী শব্দদ্বয় সর্বাধিক ব্যবহৃত (ولاية الله) ‘আল্লাহর বন্ধুত্ব’ ও (ولى الله) ‘আল্লাহর বন্ধু’ অর্থে।
(রাহে বেলায়েত বই, ড আবদুল্লাহ জাহাংগীর রহ)
আশ্শাইখ ‘আব্দুর্ রায্যাক্ব ইবনু ‘আব্দিল মুহ্ছিন আল ‘আব্বাদ আল বাদ্র حَفِظَهُ اللهُ আলোচনা থেকেঃ
যে ব্যক্তি ঈমানদার ও মুত্তাক্বী (তাক্বওয়া অবলম্বনকারী) হবেন, তিনিই হবেন আল্লাহ্র অলী। ওয়ালায়াত (বেলায়াত) বা আল্লাহ্র বন্ধুত্ব লাভের মূল উপায় হলো – ঈমান ও তাক্বওয়া।
“ঈমান ও তাক্বওয়া” এ দু’টি বিষয় যখন একই বাক্যে উল্লেখ করা হয়, তখন ঈমান দ্বারা আল্লাহ সুবহানা তায়ালা ও তাঁর রাছূলের সা আনুগত্যমূলক কাজ সম্পাদনকে বুঝায় এবং তাক্বওয়া দ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রাছূলের নিষেধকৃত বিষয়াদী বর্জনকে বুঝায়।
তাই প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহ্র অলী,তারা আল্লাহ ও তাঁর রাছূলের সা আদেশকৃত বিষয়াদী যথাযথভাবে পালন করে থাকেন এবং তাদের নিষেধকৃত বিষয়বস্তু সম্পূর্ণরূপে পরিহার ও বর্জন করে থাকেন।
আল্লাহ্র আদেশকৃত কর্মগুলো হলো-ফার্য বা আবশ্যকীয় এবং মুছ্তাহাব্ব বা পছন্দনীয়, আর আল্লাহ্র নিষেধকৃত কর্মসমূহ হলো – হারাম ও মাকরূহ।
ওয়ালায়াত বা বন্ধুত্বের স্তর হলো— দু’টি। একটি হলো- মুক্বতাসিদূনের স্তর, অপরটি হলো মুক্বার্রাবূন (নৈকট্যশীল) বা ছাবিক্বোন ফিল খাইরাত (কল্যাণের কাজে অগ্রগামীদের) স্তর। আর এই উভয় স্তরের অধিকারীগণই ক্বিয়ামাতের দিন কোনরূপ হিসাব ও শাস্তি ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
১। মুক্বতাসিদ (ইকোনমী বা মধ্যম مُّقْتَصِد) স্তরের অলীঃ
আল্লাহ্র আদেশকৃত বিষয়াদী পালনের ক্ষেত্রে যিনি কেবল ফার্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন, অর্থাৎ যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহ্র নির্দেশিত ফার্য-ওয়াজিব বা আবশ্যকীয় বিধানসমূহ সম্পাদন করবেন, আর আল্লাহ্র নিষিদ্ধ বিষয়াদী বর্জনের ক্ষেত্রে যারা কেবল হারাম বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন, অর্থাৎ শুধুমাত্র হারাম বিষয়বস্তু বর্জন করে চলবেন, তাহলে তাদের সাথে আল্লাহ্র অলীত্ব বা বন্ধুত্বের স্তর হবে মুক্বতাসিদূনের স্তর। অর্থাৎ সে মুক্বতাসিদ (ইকোনমী বা মধ্যম) স্তরের অলী বলে গণ্য হবে।
২। মুক্বার্রাবূন (নৈকট্যশীল) বা ছাবিক্বোন বিল খাইরাত سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ
যিনি ফার্য-ওয়াজিব তথা আল্লাহ্র আদেশকৃত আবশ্যকীয় বিষয়াদী পালনের পর মুছ্তাহাব্ব বা আল্লাহ্র পছন্দনীয় বিষয়াদী পালনের মাধ্যমে এবং হারাম বিষয়াদী বর্জনের পর মাকরূহ বা আল্লাহ্র নিকট অপছন্দনীয় বিষয়াদী বর্জনের মাধ্যমে নিজের অবস্থা আরো উচ্চ স্তরে নিয়ে যাবেন, তাদের সাথে আল্লাহ্র ওয়ালায়াত বা বন্ধুত্বের স্তর হবে ছাবিক্বোন ফিল খাইরাত বা কল্যাণের কাজে অগ্রগামীদের স্তর বা মর্যাদা। আর এটিই হলো বন্ধুত্বের সবচেয়ে মহান ও সর্বোচ্চ স্তর।
দু’টি উচ্চ স্তরের অধিকারীগণের সুস্পষ্ট বিবরণ এসেছে সহীহ্ বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদীছে। আবূ হুরাইরাহ থেকে বর্ণিত এ হাদীছটি ‘উলামায়ে কিরামের নিকট হাদীছে অলী বলেই বহুল পরিচিত।
কেননা এই হাদীছে অলী কারা? তাদের স্তর বা মর্যাদা কী? তাদের জন্য কী ছাওয়াব বা প্রতিদান রয়েছে? এসব বিষয়ের বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। এটি একটি মহান হাদীসে কুদসি, যাতে রাছূলুল্লাহ সা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ বলেছেন:—
অর্থঃ- যে ব্যক্তি আমার অলীর শত্রুতা করবে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম। ফার্য ‘ইবাদাতের চেয়ে আমার নিকট অধিক পছন্দনীয় এমন কোন বস্তু নেই যদ্বারা আমার বান্দাহ আমার নৈকট্য লাভ করে থাকে। আর আমার বান্দাহ সব সময় নাফ্ল ‘ইবাদাতের দ্বারা আমার (অধিক) নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে যে পর্যন্ত না আমি তাকে ভালোবাসি। আর যখন আমি তাকে ভালোবেসে নেব, তখন আমি তার কর্ণ হয়ে যাব যদ্বারা সে শুনতে পাবে, আমি তার চক্ষু হয়ে যাব যদ্বারা সে দেখতে পাবে, আমি তার হাত হয়ে যাব যদ্বারা সে ধরতে পারবে এবং পা হয়ে যাব যদ্বারা সে চলাফেরা করবে। তখন সে যদি আমার নিকট কোন কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে অবশ্যই আমি তাকে তা দান করব, সে যদি আমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে তাহলে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেব।২
৩। মুছলিম যালিম লি—নাফছিহী
আর কেউ যদি ওয়ালায়াতের বা আল্লাহ্র বন্ধুত্ব লাভের এই দুই স্তরের কোন স্তরে উন্নিত হতে না পারে, সে যদি আল্লাহ্র আদেশকৃত অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং আল্লাহ্র নিষেধকৃত অবশ্য বর্জনীয় বিষয়গুলো যথাযথভাবে বর্জন করতে না পারে, তবে তার এইসব ত্রুটি বিচ্যুতি যদি কুফ্রের (আল্লাহ্কে অস্বীকার করার) পর্যায়ে না যায়, তাহলে সে “মুছলিম যালিম লি—নাফছিহী”অর্থাৎ নিজের প্রতি অন্যায়-অত্যাচারকারী মুসলিম বলে গণ্য হবে। ক্বিয়ামাতের দিন তাকে আল্লাহ্র শাস্তির মুখোমুখি করা হবে। তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে কেবল পাপ থেকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ করার জন্য। অতঃপর (শাস্তি ভোগের পর) তার শেষ গন্তব্য হবে জান্নাত; সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
এই তিন প্রকার লোকের কথা আল্লাহ কুরআনে কারীমে একসাথে একটি আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:-
ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِيْنَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ وَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللهِ ذٰلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيْرُ. جَنَّاتُ عَدْنٍ يَّدْخُلُوْنَهَا يُحَلَّوْنَ فِيْهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَّلُؤْلُؤًا وَلِبَاسُهُمْ فِيْهَا حَرِيْرٌ.
অর্থাৎ— অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করেছি তাদেরকে যাদেরকে আমি আমার বান্দাহদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি, তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্র নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথে অগ্রগামী। এটাই হলো বিরাট অনুগ্রহ। তারা প্রবেশ করবে বসবাসের জান্নাতে। তথায় তারা স্বর্ণনির্মিত মোতি খচিত চিরুণী দ্বারা অলংকৃত হবে। সেখানে তাদের পোষাক হবে রেশমের। (সূরা ফাত্বিরঃ ৩২—৩৩)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:—
جَنَّاتُ عَدْنٍ يَّدْخُلُوْنَهَا
অর্থাৎ— বসবাসের জান্নাতে তারা প্রবেশ করবে।
এখানে সাধারণভাবে “তারা”বলতে আয়াতে উল্লেখিত তিন প্রকারের লোককেই বুঝানো হয়েছে। যালিম লি—নাফছিহী, মুক্বতাসিদ এবং ছাবিক্ব ফিল খাইরাত— এই তিন প্রকার লোকই বসবাসের জান্নাতে প্রবেশ করবে। তবে মুক্বতাসিদ এবং ছাবিক্ব বিল খাইরাত— এই দুই প্রকার লোক হিসাব—নিকাশ ছাড়া এবং কোনরূপ শাস্তিভোগ ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করবেন। আর যে ব্যক্তি কুফ্র ব্যতীত আল্লাহ্র নাফরমানী এবং পাপ ও অসৎকর্ম সম্পাদনের দ্বারা নিজের প্রতি অন্যায়—অত্যাচার করবে, তারও শেষ ঠিকানা হবে জান্নাত, তবে এর আগে শাস্তিভোগের মাধ্যমে তাকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ হতে হবে। তাই প্রথমে যদিও তাকে জাহান্নামে যেতে হবে তবে সেখানে তাকে আজীবন থাকতে হবে না, বরং জাহান্নামে শাস্তিভোগের পর যখন সে পাপমুক্ত হয়ে যাবে তখন তাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসা হবে এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর তখন থেকে জান্নাতই হবে তার চিরস্থায়ী আবাসস্থল।
আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর তা হলো, প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যই উচিত- (সে যতই আল্লাহ্র আনুগত্য মূলক কাজকর্ম তথা ‘ইবাদাত – বন্দেগী করুক না কেন) নিজেকে সাধু ও পুতঃপবিত্র দাবি করা থেকে সতর্ক ও সাবধান থাকা। এ সম্পর্কে কুরআনে কারীমে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:-
فَلَا تُزَكُّوا أَنفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَىٰ
অর্থাৎ- তোমরা নিজেরা নিজেদের পবিত্রতা দাবি করো না। তিনিই ভালো জানেন- কে তাক্বওয়া অবলম্বনকারী। আন্নাজ্ম— ৩২
আল্লাহ্র অলী হওয়া বা তাঁর বন্ধুত্ব লাভের বিষয়টি এরূপ কোন বিষয় নয়, যা কেউ নিজে নিজের জন্যে দাবী করতে পারে। যারা একাজটি করে থাকে (অর্থাৎ, যারা নিজে নিজেকে আল্লাহ্র অলী, দরবেশ, বযুর্গ, সূফী-সাধক, পীরে কামিল ইত্যাদি বলে দাবী করে থাকে) তারা মূলত অন্যায় ও বাতিল উপায়ে মানুষের সম্পদ ভক্ষণের নিমিত্ত কিংবা আল্লাহ্র বান্দাহ্দের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের হীন উদ্দেশ্যে অথবা সমাজে কথিত সুনাম ও সাময়িক খ্যাতি লাভের জন্য এরূপ করে থাকে। অতএব সাবধান! (এ ধরনের লোক থেকে এবং এরূপ কর্মকান্ড থেকে)!
মূলত ওয়ালায়াত বা আল্লাহ্র অলী হওয়া- এটি একজন মূমিন বান্দাহ ও আল্লাহ্র মধ্যকার বিষয়। একজন প্রকৃত মূমিন আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভের আশায় আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ ও তাঁর অলী হওয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন। তাই সত্যিকার অর্থে যিনি আল্লাহ্র অলী হয়ে থাকেন তিনি কখনোই নিজেকে আল্লাহ্র অলী বলে দাবি করেন না, বা করতে পারেন না। তিনি বরং সবসময় নিজেকে আল্লাহ্র নিকট পাপী, অপরাধী ও যথাযথভাবে আল্লাহ্র হাক্ব আদায় করতে পারছেন না বলে মনে করে থাকেন।
কুরআনে কারীমে আল্লাহ তার পরিপূর্ণ মু’মিন বান্দাহ্দের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন:—
وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَا آتَوا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلٰى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ
অর্থাৎ— আর যারা যা দেয়ার তা ভীত কম্পিত হৃদয়ে এ কারণে দেয় যে, তারা তাদের পালনকর্তার নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। সূরা মূমিনূন— ৬০
এ আয়াত দ্বারা একথা বুঝানো হয়েছে যে, প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মূমিন; ছাবিক্ব বিল খাইরাত বা কল্যাণের কাজে অগ্রগামী হলেন তারা, যারা আল্লাহ্র আনুগত্যমূলক যা কিছু করার সবকিছুই করে থাকেন অথচ তাদের অন্তর সব সময় এই ভয়ে ভীত থাকে যে, যদি তাদের ‘আমাল সমূহ আল্লাহ ক্বাবূল না করেন। আবুদ্ দারদা রা বলেছেন:-
لَأَنْ أَسْتَيْقِنَ أَنَّ اللهَ تَقَبَّلَ مِنِّيْ صَلَاةً وَاحِدَةً أَحَبُّ إِلَيَّ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا
অর্থ- আমার একটি সালাত আল্লাহ ক্বাবূল করেছেন, নিশ্চিতভাবে একথাটি জানা আমার কাছে সমগ্র দুন্ইয়া এবং তাতে যা কিছু আছে এসব থেকে অধিকতর পছন্দনীয়। (সূরা আল মাইয়েদাহ এর ২৭নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু কাছীর রহ এই আছারটি বর্ণনা করেছেন)
হাছান বসরী র বলেছেন:-
إِنَّ الْمُؤْمِنَ جَمَعَ إِحْسَانًا وَشَفَقَةً ، وَإِنَّ الْمُنَافِقَ جَمَعَ إِسَاءَةً وَأَمْنًا
অর্থ- মূমিনের মধ্যে দু’টি বিষয় একসাথে থাকে। সে ভালো কাজ করে এবং ভয়ে থাকে (এই ভয়ে যে, আল্লাহ তার এই ‘আমাল ক্বাবূল করলেন কি-না)। আর মুনাফিক্বের মধ্যেও দু‘টি বিষয় একসাথে থাকে – সে মন্দ কাজ করে এবং নিশ্চিন্ত থাকে (আল্লাহ্র ‘আযাবের ভয় তার মধ্যে থাকে না)। সূরা আল মূমিনূনের ৫৭—৫৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফছীরু ইবনি কাছীর ও তাফছীরুত ত্বাবারী— ১৭/৬৮ আশ্শাইখ ‘আব্দুর্ রায্যাক্ব ইবনু ‘আব্দিল মুহ্ছিন আল ‘আব্বাদ আল বাদ্র حَفِظَهُ اللهُ) আলোচনা সংগৃহিত।
নিচের অংশটুকু রাহে বেলায়েত( ড আব্দুল্লাহ জাহাংগীর রহ বই থেকে)
কুরআন-সুন্নাহের আলোকে আমরা দেখি যে, বেলায়াতের পথের কর্মগুলির পর্যায়, তথা মুমিন জীবনের সকল কর্মের গুরুত্ব ও পর্যায়গুলি নিম্নরূপ
প্রথমত, ঈমান : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবকিছুর মূল বিশুদ্ধ ঈমান। ঈমানের ক্ষেত্রে ত্রুটিসহ পরবর্তী সকল নেক কর্ম ও ধার্মিকতা পন্ডশ্রম ও বাতুলতা মাত্র।
দ্বিতীয়ত, বৈধ উপার্জন : ঈমানের পরে সর্বপ্রথম দায়িত্ব বৈধভাবে উপার্জিত জীবিকার উপর নির্ভর করা। সুদ, ঘুষ, ফাঁকি, ধোঁকা, জুলুম ইত্যাদি সকল প্রকার উপার্জন অবৈধ। অবৈধ উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির্বাহকারীর ইবাদত আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় নয়।
তৃতীয়ত, বান্দার হক সংশ্লিষ্ট হারাম বর্জন : কর্মের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম ও সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফরয কর্ম। ফরয কর্ম দুই প্রকার: প্রথম প্রকার যা করা ফরয ও দ্বিতীয় প্রকার যা বর্জন করা ফরয, যা “হারাম” নামে অভিহিত। হারাম দুই প্রকার: এক প্রকার পৃথিবীর অন্যান্য মানুষ ও সৃষ্টির অধিকার বা পাওনা নষ্ট বা তাদের কোনো ক্ষতি করা বিষয়ক হারাম। এগুলি বর্জন করা সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ।
চতুর্থত, আল্লাহর অন্যান্য আদেশ নিষেধ বিষয়ক হারাম বর্জন।
পঞ্চমত, ফরয কর্মগুলি পালন।
ষষ্ঠত, মাকরূহ তাহরীমি বর্জন ও সুন্নাতে মু‘আক্কাদা কর্ম পালন।
সপ্তমত, মানুষ ও সৃষ্টির সেবা ও কল্যাণমূলক সুন্নাত-নফল ইবাদত পালন।
অষ্টমত, ব্যক্তিগত সুন্নাত-নফল ইবাদত পালন।
উপরের সাতটি পর্যায়ের কর্ম যদি আমাদের জীবনে না থাকে তাহলে এই অষ্টম পর্যায়ের কর্ম অর্থহীন হতে পারে বা ভন্ডামীতে পরিণত হতে পারে। আমরা অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সাথে লক্ষ্য করি যে, আমাদের সমাজের ধার্মিক মানুষেরা প্রায়শ এই অষ্টম পর্যায়ের কাজগুলিকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দেন, অথচ পূর্ববর্তী বিষয়গুলির প্রকৃত গুরুত্ব আলোচনা বা অনুধাবনে ব্যর্থ হন। মহান রাব্বুল ‘আলামীন ও তাঁর প্রিয়তম রাসূল (সা.) যে কর্মের যতটুকু গুরুত্ব প্রদান করেছেন তাকে তার চেয়ে কম গুরুত্ব প্রদান করা যেমন কঠিন অপরাধ ও তাঁদের শিক্ষার বিরোধিতা, বেশি গুরুত্ব প্রদানও একই প্রকার অপরাধ।
আমরা কিছু শব্দ সম্পর্কে জানার প্রচেষ্টা করি।
এক: ওয়াজিব: যা পালন করার জন্য শরিয়তপ্রণেতা আবশ্যকীয়ভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।
এর উদাহরণ হচ্ছে- পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রমযানের রোযা, যাকাত দেয়ার সামর্থ্যবান হলে যাকাত, হজ্জ করার সামর্থ্য থাকলে হজ্জ।
‘ওয়াজিব’-কে فرض (ফরয), فريضة (আবশ্যকীয়), حتم (অপরিহার্য), لازم (অনিবার্য) ইত্যাদিও বলা হয়। এ ধরণের আমল সম্পাদনকারী সওয়াব পাবেন এবং না করলে শাস্তি পাবে
দুই: মানদুব: যা পালন করার জন্য শরিয়তপ্রণেতা নির্দেশ দিয়েছেন; তবে আবশ্যকীয়ভাবে বা অপরিহার্যরূপে নয়।
এর উদাহরণ হচ্ছে- কিয়ামুল লাইল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথের সুন্নত নামাযগুলো ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের অতিরিক্ত নামাযগুলো, প্রতি মাসে তিনদিন রোযা রাখা, শাওয়াল মাসে ছয় রোযা রাখা, গরীবদেরকে দান-সদকা করা এবং নিয়মিত যিকির-আযকার ও ওযিফাগুলো পড়া।
‘মানদুব’-কে মুস্তাহাব, সুন্নত, মাসনূন, নফল ইত্যাদিও বলা হয়। এ ধরণের আমল পালনকারী সওয়াব পাবেন; তবে বর্জনকারী শাস্তি পাবে না।
তিন: হারাম বা নিষিদ্ধ: যাতে লিপ্ত হওয়া থেকে শরিয়তপ্রণেতা আবশ্যকীয়ভাবে নিষেধ করেছেন। যেমন- ব্যভিচার, মদপান, পিতামাতার অবাধ্যতা, দাঁড়ি না রাখা, নারীদের বেপর্দা চলাফেরা করা।
হারাম কাজ বর্জনকারী সওয়াব পাবেন, আর হারামে লিপ্ত ব্যক্তি শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত হবে।
চার: মাকরুহ: যাতে লিপ্ত হওয়া থেকে শরিয়তপ্রণেতা নিষেধ করেছেন; তবে আবশ্যকীয়ভাবে নয়। যেমন- কোন কিছু বাম হাতে গ্রহণ করা ও বাম হাতে প্রদান করা। নারীদের জন্য মৃতব্যক্তির জানাযার সাথে যাওয়া। এশার নামাযের পর আলাপ-আলোচনা করা, কাঁধ খালি রেখে এক কাপড়ে নামায আদায় করা, ফজরের নামাযের পর সূর্যোদয়ের আগে নফল নামায পড়া এবং আছরের নামাযের পর সূর্যাস্তের আগে নফল নামায পড়া।
মাকরুহ আমল বর্জনকারী সওয়াব পাবেন; কিন্তু মাকরুহ আমলে লিপ্ত হলে শাস্তি দেওয়া হবে না।
পাঁচ: মুবাহ বা হালাল বা জায়েয: যে আমলের সাথে সত্তাগতভাবে কোন আদেশ বা নিষেধ সম্পৃক্ত নয়।
যেমন- পানাহার করা, বেচাকেনা করা, পর্যটনমূলক বা জীবিকার সন্ধানে ভ্রমণ, রযমানের রাতেরবেলা স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা।
মুবাহ –এর সংজ্ঞাতে ‘সত্তাগতভাবে’ কথাটি এ জন্য বলা হয়েছে যেহেতু হতে পারে এর সাথে তৃতীয় কোন একটি বিষয় সম্পৃক্ত হয়ে সেটাকে নির্দেশিত কিংবা নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিণত করবে।
উদাহরণত: ‘পানি খরিদ করা’ মূলত একটি একটি মুবাহ কাজ। কিন্তু, যদি পানি খরিদ করার উপর ফরয নামাযের জন্য ওযু করা আটকে থাকে সেক্ষেত্রে পানি খরিদ করা ওয়াজিব। কেননা যে মাধ্যম ছাড়া কোন ওয়াজিব কর্ম সম্পাদিত হয় না সে মাধ্যমও ওয়াজিব।
আরেকটি উদাহরণ- পর্যটনমূলক ভ্রমণ মূলত একটি মুবাহ কাজ। কিন্তু, এ ভ্রমণ যদি হয় বিধর্মী কোন দেশে যেখানে ফিতনা, পাপাচার ও ব্যভিচার ইত্যাদির সয়লাব; এমন ভ্রমণ হারাম। কেননা এ ভ্রমণ হারাম কর্মে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যম।
এ বিষয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন: ইবনে কুদামার লিখিত ‘রওযাতুন নাযের ওয়া জুন্নাতুল মুনাযির’ (১/১৫০-২১০), যারকাশির লিখিত ‘আল-বাহরুল মুহিত’ (১/১৪০-২৪০) এবং ইবনে উছাইমীনের ‘শারহুল উসুল মিন ইলমিল উসুল’ (৪৬-৬৮)। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ। সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব
আল্লাহর অলীদের সম্পর্কে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ
১. আল্লাহর নবীরা তার সর্বশ্রেষ্ঠ অলী হিসাবে স্বীকৃত। নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন তার রাসূলগণ। রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেনঃ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ তথা নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর সমস্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেনঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
মহান আল্লাহ বলেন,
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ
‘হে নবী! তুমি রাসূলগণের মধ্যে থেকে যারা উলুল আযম বা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সাহসী রাসূল তাদের মত ধৈর্যধারণ কর’ (আহকাফ ৩৫/৩৫)।
মহান আল্লাহ বলেন,
تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ وَآتَيْنَا عِيْسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوْحِ الْقُدُسِ-
‘এই যে রাসূলগণ, এদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। এদের মধ্যে এমনও আছে যাদের সাথে মহান আল্লাহ কথা বলেছেন এবং তাদের কাউকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। ঈসা ইবনু মারিয়ামকে স্পষ্ট প্রমাণ দান করেছি এবং তাকে রুহুল কুদুস (জিব্রীল) দ্বারা সহযোগিতা করেছি’ (বাক্বারাহঃ ২৫৩)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে শুরু করে সকল মুফাসসিরে কুরআন এই বিষয়ে একমত যে, এই উলুল আযম রাসূল হচ্ছেন ৫ জন- মুহাম্মাদ (সা), ইবরাহীম, নূহ, মূসা ও ঈসা (আঃ)। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
خِيَارُ وَلَدِ آدَمَ خَمْسَةٌ نُوْحٌ وإبْراهِيْمُ ومُوْسَى وَعِيْسَى ومُحَمَّدٌ وَخَيْرُهُمْ مُحَمَّد
‘আদম (আঃ)-এর শ্রেষ্ঠ সন্তান হচ্ছেন পাঁচ জন, নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা, ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)। আর তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন মুহাম্মাদ (সা)।মুসনাদে বাযযার, সিলসিলাতুল আছার আছ-ছাহীহাহ হা/৪৬৪, সনদ হাসান, মাজমাঊয যাওয়ায়েদ হা/১৩৯২৯, যঈফুল জামে‘ হা/২৮৭৬ ।
২. এখানে এটা জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর অলীগণ দুশ্রেণীতে বিভক্তঃ
প্রথম শ্রেণীঃ যারা অগ্রবর্তী ও নৈকট্যপ্রাপ্ত।
দ্বিতীয় শ্রেণীঃ যারা ডান ও মধ্যম পন্থী।
আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তাদের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ “যখন যা ঘটা অবশ্যম্ভাবী (কিয়ামত) তা ঘটবে, তখন তার সংঘটনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কেউ থাকবে না। তা কাউকে নীচ করবে, কাউকে সমুন্নত করবে। যখন প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে যমীন। পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়বে। ফলে তা উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পর্যবসিত হবে। এবং তোমরা বিভক্ত হয়ে পড়বে তিন শ্রেনীতে- ডান দিকের দল; ডান দিকের দলের কি মর্যাদা! আর বাম দিকের দল; বাম দিকের দলের কি অসম্মান। আর অগ্রবর্তীগণই তো অগ্রবর্তী। তারাই নৈকট্যপ্রাপ্ত- নেয়ামত পূর্ণ জান্নাতে। [সূরা আল-ওয়াকি’আহঃ ১–১২]
এখানে তিন শ্রেণীর লোকের উল্লেখ করা হয়েছেঃ যাদের একদল জাহান্নামের, তাদেরকে বামদিকের দল বলা হয়েছে।
আর বাকী দু’দল জান্নাতের, তারা হলেনঃ ডানদিকের দল এবং অগ্রবর্তী ও নৈকট্যপ্রাপ্তগণ। তাদেরকে আবার এ সূরা আল ওয়াকি’আরই শেষে আল্লাহ তা’আলা উল্লেখ করে বলেছেন, “তারপর যদি সে নৈকট্যপ্রাপ্তদের একজন হয় তবে তার জন্য রয়েছে আরাম, উত্তম জীবনোপকরণ ও নেয়ামত পূর্ণ জান্নাত। আর যদি সে ডান দিকের একজন হয় তবে তোমার জন্য সালাম ও শান্তি; কারণ সে ডানপন্থীদের মধ্যে”। [সূরা আল-ওয়াকি’আহঃ ৮৮–৯১]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও অলীদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত হাদীসে বলেনঃ “মহান আল্লাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি আমার কোন অলীর সাথে শক্রতা পোষণ করে আমি তার সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম। আমার বান্দার উপর যা আমি ফরয করেছি তা ছাড়া আমার কাছে অন্য কোন প্রিয় বস্তু নেই যার মাধ্যমে সে আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে। আমার বান্দা আমার কাছে নফল কাজসমূহ দ্বারা নৈকট্য অর্জন করতেই থাকে, শেষ পর্যন্ত আমি তাকে ভালবাসি। তারপর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণশক্তি হয়ে যাই যার দ্বারা সে শুনে, তার দৃষ্টি শক্তি হয়ে যাই যার দ্বারা সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই যার দ্বারা সে ধারণ করে আর তার পা হয়ে যাই যার দ্বারা সে চলে। তখন আমার কাছে কিছু চাইলে আমি তাকে তা অবশ্যই দেব, আমার কাছে আশ্রয় চাইলে আমি তাকে অবশ্যই উদ্ধার করব।” [বুখারী: ৬৫০২]
এর মর্ম হলো এই যে, তার কোন গতি-স্থিতি ও অন্য যে কোন কাজ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয় না। বস্তুতঃ এই বিশেষ ওলীত্ব বা নৈকট্যের স্তর অগণিত ও অশেষ। এর সর্বোচ্চ স্তর নবী-রাসূলগণের প্রাপ্য। কারণ, প্রত্যেক নবীরই ওলী হওয়া অপরিহার্য। আর এর সর্বোচ্চ স্তর হলো সাইয়্যেদুল আম্বীয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর। এর পর প্রত্যেক ঈমানদার তার ঈমানের শক্তি ও স্তরের বৃদ্ধি-ঘাটতি অনুসারে বেলায়েতের অধিকারী হবে। সুতরাং নেককার লোকেরা হলোঃ ডান দিকের দল, যারা আল্লাহর কাছে ফরয আদায়ের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ করে। তারা আল্লাহ তাদের উপর যা ফরয করেছেন তা আদায় করে, আর যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ করে। তারা নফল কাজে রত হয় না। কিন্তু যারা অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল তারা আল্লাহর কাছে ফরয আদায়ের পর নফলের মাধ্যমে নৈকট্য লাভে রত হয়।
৩. এখানে আরও একটি বিষয় জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর অলীগণ অন্যান্য মানুষদের থেকে প্রকাশ্যে কোন পোষাক বা বেশ-ভূষা দ্বারা বিশেষভাবে পরিচিত হন না। বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাতের মধ্যে প্রকাশ্য বিদ’আতকারী ও অন্যায়কারী ছাড়া সর্বস্তরে আল্লাহর অলীগণের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তাদের অস্তিত্ব রয়েছে কুরআনের ধারক-বাহকদের মাঝে, জ্ঞানী-আলেমদের মাঝে, জিহাদকারী ও তরবারী-ধারকদের মাঝে, ব্যবসায়ী, কারিগর ও কৃষকের মাঝে।
৪. আল্লাহর অলীগণের মধ্যে নবী-রাসূলগণ ছাড়া আর কেউ নিষ্পাপ নন, তাছাড়া কোন অলীই গায়েব জানেনা, সৃষ্টি বা রিযক প্রদানে তাদের কোন প্রভাবও নেই। তারা নিজেদেরকে সম্মান করতে অথবা কোন ধন-সম্পদ তাদের উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে মানুষদেরকে আহবান করেন না। যদি কেউ এমন কিছু করে তাহলে সে আল্লাহর অলী হতে পারে না, বরং মিথ্যাবাদী, অপবাদ আরোপকারী, শয়তানের আলী হিসাবে বিবেচিত হবে।
৫. আল্লাহর অলী হওয়ার জন্য একটিই উপায় রয়েছে, আর তা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রঙে রঞ্জিত হওয়া, তার সুন্নাতের হুবহু অনুসরণ করা। যারা এ ধরনের অনুসরণ করতে পেরেছেন তাদের মর্যাদাই আলাদা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহর এমন কিছু বান্দা রয়েছে যাদেরকে শহীদরাও ঈর্ষা করবে। বলা হলোঃ হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা? হয়ত তাদের আমরা ভালবাসবো। রাসূল বললেনঃ “তারা কোন সম্পদ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ব্যতীতই একে অপরকে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবেসেছে। নূরের মিম্বরের উপর তাদের চেহারা হবে নূরের। মানুষ যখন ভীত হয় তখন তারা ভীত হয় না। মানুষ যখন পেরেশান ও অস্থির হয় তখন তারা অস্থির হয় না।” তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন। [ইবনে হিব্বানঃ ৫৭৩, আবু দাউদঃ ৩৫২৭]
অন্য বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “বিভিন্ন দিক থেকে মানুষ আসবে এবং বিভিন্ন গোত্র থেকে মানুষ এসে জড়ো হবে, যাদের মাঝে কোন আতীয়তার সম্পর্ক থাকবে না। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একে অপরকে ভালবেসেছে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে স্থাপন করবেন, তারপর তাদেরকে সেগুলোতে বসাবেন। তাদের বৈশিষ্ট হলো মানুষ যখন ভীত হয় তখন তারা ভীত হয় না, মানুষ যখন পেরেশান হয় তখন তারা পেরেশান হয় না। তারা আল্লাহর অলী, তাদের কোন ভয় ও পেরেশানী কিছুই থাকবে না। [মুসনাদে আহমাদ ৫/৩৪৩]। [উসুলুল ঈমান ফী দাওয়িল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং প্রেস থেকে মুদ্রিত, পৃ. ২৮২–২৮৬ (বাংলা সংস্করণ)]
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ঐক্যমতে অলীদের কারামত সত্য। কুরআনুল কারীম ও সহীহ সুন্নাত দ্বারা ইহা প্রমাণিত। বিদআতী, মু‘তাযিলা, জাহমীয়া এবং তাদের অনুসারীরাই কেবল অলীদের কারামত অস্বীকার করে। সুতরাং তারা কুরআন ও সহীহ সুন্নাত দ্বারা একটি সাব্যস্ত বিষয়কেই অস্বীকার করেছে।
কুরআনুল কারীমে আসহাবে কাহাফের ঘটনা, মারইয়াম আলাইহিস সালামের ঘটনাসহ আরো কিছু কারামতের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। সহীহ সুন্নাত দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, উসাইদ ইবনে হুযায়েরের কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করার জন্য অসংখ্য প্রদীপ আকারে মেঘ সদৃশ বস্তুর মধ্যে ফেরেশতা নামার কথা সাব্যস্ত হয়েছে এবং ইমরান ইবনে হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুকে ফেরেশতাগণ সালাম দিয়েছেন। এ রকম উদাহরণ আরো অনেক রয়েছে।
অলীদের কারামত সম্পর্কে যে আরো বেশি জানতে চায়, সে যেন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহর الفرقان بين أولياء الرحمن وأولياء الشيطان ‘‘আল্লাহর অলী ও শয়তানের অলীর মধ্যে পার্থক্য’’ নামক বইটি অধ্যায়ন করে। অলীদের কারামত বিষয়ে মানুষের মাঝে অনেক অস্পষ্ট ধারণা এবং বিরাট বিভ্রান্তি রয়েছে।
আরেক দল লোক কারামত সাব্যস্ত করতে গিয়ে চরম বাড়াবাড়ি করেছে। অজ্ঞ, মূর্খ এবং গোমরাহ আলেমরাই এ শ্রেণীর লোকের অন্তর্ভুক্ত। তারা ফাসেক, পাপিষ্ঠ এবং এমন লোকদের জন্য কারামত সাব্যস্ত করেছে, যারা আল্লাহর অলী নয়; বরং শয়তানের অলী। মিথ্যা বর্ণনা, স্বপ্ন এবং শয়তানী অবস্থার উপর নির্ভর করেই তারা তাদের জন্য কারামত সাব্যস্ত করেছে। শুধু তাই নয়; তারা যাদুকর, ভেলকিবাজ এবং সুফী তরীকার মিথ্যুক শাইখদের জন্যও কারামত সাব্যস্ত করেছে।
কারামতের ব্যাপারে লোকেরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়েছে।
এক শ্রেণীর লোক কারামত অস্বীকার করতে গিয়ে সীমালংঘন করেছে এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত মুত্তাকী অলীদের জন্য কুরআনুল কারীম ও সহীহ সুন্নাত দ্বারা সুসাব্যস্ত কারামতগুলোকে অস্বীকার করেছে।
আরেক শ্রেণীর লোক কারামত সাব্যস্ত করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে এবং যাদু, ভেলকিবাজি এবং মিথ্যাচারকে কারামতের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এগুলোকে তারা শিরকের মাধ্যম বানিয়েছে এবং এগুলোর জীবিত ও মৃত উদ্ভাবনকারীদের ব্যাপারে নিকৃষ্ট আকীদা পোষণ করেছে। এ থেকে শুরু হয়েছে বড় শিরক, কবর পূজা, ব্যক্তি বিশেষের প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনায় বাড়াবাড়ি। কেননা লোকেরা তাদের থেকে কারামত ও অলৌকিক ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার ধারণা করেছে।
আর তৃতীয় শ্রেণী হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। তারা কারামত সাব্যস্ত করার ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছে। তারা এ বিষয়ে কড়াকড়ি অবলম্বন করেনি এবং শৈথিল্য প্রদর্শন করেনি। তারা কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা সাব্যস্ত কারামতগুলোতে বিশ্বাস করেছে এবং যাদের হাতে এগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তাদের প্রশংসায় তারা বাড়াবাড়ি করেনি ও আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে এদের উপর নির্ভরও করেনি।
একটি বিশেষ দিক আলোচনা—
৩৯:৩ اَلَا لِلّٰهِ الدِّیۡنُ الۡخَالِصُ ؕ وَ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِهٖۤ اَوۡلِیَآءَ ۘ مَا نَعۡبُدُهُمۡ اِلَّا لِیُقَرِّبُوۡنَاۤ اِلَی اللّٰهِ زُلۡفٰی ؕ اِنَّ اللّٰهَ یَحۡکُمُ بَیۡنَهُمۡ فِیۡ مَا هُمۡ فِیۡهِ یَخۡتَلِفُوۡنَ ۬ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِیۡ مَنۡ هُوَ کٰذِبٌ کَفَّارٌ
জেনে রাখুন, অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। আর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্ৰহণ করে তারা বলে, আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যে করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে সে ব্যাপারে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না। সূরা যুমারঃ৩
প্রশ্ন: আল্লাহর ওলি কারা?
আল্লাহর ওলিগণ কি কবরে জীবিত?
উত্তর: নিম্নে উক্ত দুটি প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা হল:
◈ ক. আল্লাহর ওলি কারা?
আল্লাহর ওলি অর্থ, আল্লাহর প্রিয়পাত্র বা বন্ধু।
আর তারাই আল্লাহর প্রিয়পাত্র বা বন্ধু, যারা সত্যিকার ভাবে আল্লাহকে ভয় করে জীবন পরিচালনা করে, সৎ আমল করে, তাঁর আদেশগুলো বাস্তবায়ন করে, নিষেধ কৃত বিষয়গুলো থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদিসকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّـهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ- الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ – لَهُمُ الْبُشْرَىٰ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ ۚ-لَا تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللَّـهِ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“মনে রেখো, আল্লাহর ওলি বা বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা দু:শ্চিন্তাগ্রস্থ হবে না। (তারা হল ঐ সকল লোক ) যারা ঈমান এনেছে এবং (আল্লাহকে) ভয় করে। তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হেরফের হয় না। এটাই হল মহা সফলতা।” (সূরা ইউনুস: ৬২, ৬৩ ও ৬৪)
তিনি আরও বলেন:
إِنْ أَوْلِيَاؤُهُ إِلَّا الْمُتَّقُونَ
“তাঁর ওলি বা বন্ধু কেউ নয় একমাত্র মুত্তাকী-পরহেজগার ব্যক্তিগণ ছাড়া।” (সূরা আনফাল: ৩৪)
ইমাম ইবনে কাসির রহঃ উল্লেখিত প্রথম দুটি আয়াতের তাফসিরে বলেন:
“এখানে আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, ঐ সকল লোক তাঁর ওলি (বন্ধু) যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) অবলম্বন করে-যেমনটি আল্লাহ নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সুতরাং যেই তাকওয়াবান হবে সেই আল্লাহর ওলি হবে। কিয়ামতের আসন্ন বিপর্যয় ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে তাদের কোন ভয় ও আশঙ্কা নেই এবং দুনিয়ার ফেলে আসা কোন বিষয়ে তাদের দু:শ্চিন্তার কোনও কারণ নাই।” (তাফসিরুল কুরআনিল আযীম, সূরা সূরা ইউনুস এর ৬৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা)
মোটকথা: উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বেলায়াত বা বন্ধুত্ব পাওয়ার দুটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। যথা:
- ১. ঈমান আনয়ন করা।
- ২. তাকওয়া অবলম্বন করা অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে তাঁর আদেশগুলো মেনে চলা এবং নিষিদ্ধ ও হারাম কর্ম থেকে দূরে থাকা।
সুতরাং এ দুটি শর্ত যার মধ্যে যত বেশি পরিমাণে থাকবে অর্থাৎ যার মধ্যে ঈমানি দৃঢ়তা, তেজস্বিকতা ও প্রখরতা যত বেশি থাকবে এবং তাকওয়া-পরহেজাগরিতা ও আল্লাহর অনুগত্য যত নিখাদ ও গভীর হবে সে তত আল্লাহর বেলায়াত তথা বন্ধুত্ব ও ভালবাসা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
এ সকল গুণাবলী অর্জন করার চেষ্টা করা প্রত্যেক ইমানদার ব্যক্তির কর্তব্য। এটি সকল যুগে সকল স্থানে সর্বশ্রেণীর মুমিন ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য।
কিন্তু সাধারণ মুসলিমদের মাঝে একটা ভুল ধারণা খুব প্রবল যে, আল্লাহর ওলি বলতে বুঝায় বিশেষ একশ্রেণীর মানুষকে, যারা বিভিন্ন কেরামতি বা অলৌকিক ক্ষমতা দেখাতে পারে, যাদের বিশাল খানকা, জাঁকজমকপূর্ণ দরবার এবং অনেক ভক্ত ও মুরিদান আছে। এগুলো কখনো ওলি হওয়ার আলামত নয়। কেননা অনেক সময় যাদু বিদ্যা এবং জিন ও শয়তানের সাহায্যে অদ্ভুত ও মতিভ্রষ্ট করার মত কিছু দেখানো হয়। যেগুলো দেখে সাধারণ মানুষ তাদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা-সেজদা এবং মানত ও পূজা দিতে শুরু করে। অথচ সে সব কথিত আল্লাহর ওলিরা বা নেংটা পীর ও নেকড়া বাবারা শিরক-বিদআত, নানা রকম বেশরিয়তি কাজ ও আল্লাহর নাফরমানীতে হাবুডুবু খায়।
আরেকটি মারাত্মক ভুল কাজ যে, কোন ব্যক্তিরবাহ্যিক চেহারা-সুরাত, আলখেল্লা-পাগড়ী, আর পরহেজগারিতা দেখে তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়া যে, ওমুক ব্যক্তি বা উমুক পীর/বুজুর্গ আল্লাহর ওলি। এটি মোটেও উচিৎ নয়। কারণ, কে কতটুকু ইমানদার ও তাকওয়াবান তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা জনেন। কারো
ভিতরের অবস্থা, অন্তরের তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কারো দ্বারাই সম্ভব নয়। অবশ্য যদি তার দিকে তাকালে অন্তরে আল্লাহর কথা স্বরণ হয় এবং তার বাহ্যিক আচরণ ও ইবাদত-বন্দেগী সুন্নাহ মোতাবেক হয় তাহলে আমরা তার ব্যাপারে অবশ্যই সৎ, দ্বীনদার এবং আল্লাহর ওলি বলে সু ধারণা পোষণ করতে পারি।
আল্লাহ আমাদেরকে তার ওলি বা বন্ধু হওয়ার যে সকল গুণাবলী অর্জন করা প্রয়োজন সেগুলো অর্জন করার তওফিক দান করুন। আমীন
◈ খ. আল্লাহর ওলিগণ কি কবরে জীবিত?
উত্তর:
কবরে জীবিত থাকার ব্যাপারে সংক্ষেপে কথা হল, প্রতিটি মানুষ কবরে জীবিত থাকে- চাই সে মুসলিম হোক অথবা কাফের হোক, নেককার হোক অথবা বদকার হোক কিন্তু সে জীবন হল, বরজখী জীবন-যা দুনিয়ার জীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন যা ইলমে গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। এর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ জানেন। এ জীবনকে পার্থিব জীবনের সাথে সামঞ্জস্য দেয়া বৈধ নয়।
দলিল হল, প্রতিটি মানুষকে ফেরেশতা মণ্ডলী কবরে উঠিয়ে বসাবেন এবং তিনটি প্রশ্ন করবেন। কেউ সঠিক উত্তর দিবে আর কেউ সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হবে। অতঃপর উত্তর দানের উপর ভিত্তি করে হয় সেখানে তারা জান্নাতি সুখ এবং আল্লাহর নিয়ামত-সম্ভারে অবস্থান করবে অথবা সাপ-বিচ্ছুর দংশন, ফেরেশতাদের হাতুড়ি দ্বারা নির্মম প্রহার এবং জাহান্নামের আগুনের বিছানা ও লেলিহান আগুনের শাস্তি মধ্যে থাকবে। এ অবস্থা চলতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। (আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন) তবে আল্লাহর নবী, শহিদ ও আল্লাহর প্রিয়ভাজন ওলিগণ নি:সন্দেহে সেখানে অন্যান্য সাধারণ ইমানদারদের চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ জীবন লাভ করবে।
এ বিষয়টি বিভিন্ন সহিহ হাদিস দ্বারা সুপ্রমাণিত। আল হামদুলিল্লাহ।
সুতরাং এ কথায় কোন সন্দেহ নাই যে, কবরের মধ্যে প্রতিটি মানুষই বরজখী জীবন লাভ করবে। আল্লাহু আলাম।
উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।
সহায়কঃ
রাহে বেলায়েত, তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান