সাওম মাস’য়ালা -৯ (রমজান মাসে কুরআন খতম করা কি জরুরী?)

 

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।

এক:

দলিলসহ মাসয়ালার বিধান জানার আগ্রহের কারণে প্রশ্নকারী ভাইকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কোন সন্দেহ নেই এটাই হওয়া উচিত। প্রত্যেক মুসলমানের সে চেষ্টাই করা উচিত। যাতে করে তিনি কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী হতে পারেন।

ইরশাদুল ফুহুল গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৪৫০-৪৫১) শাওকানী (রহঃ) বলেন:

যখন এই সিদ্ধান্তে আসা গেল যে, একজন সাধারণ মানুষ আলেমকে জিজ্ঞেস করবে এবং একজন অপূর্ণ ব্যক্তি পরিপূর্ণ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবে, এরপর বলতে হয় সে ব্যক্তি  দ্বীনদার ও তাকওয়াবান হিসেবে পরিচিত আলেমকে জিজ্ঞেস করবে- কিতাব ও সুন্নাহর জ্ঞানবান আলেম কে? কোন সে ব্যক্তি যার কাছে কিতাব ও সুন্নাহ বুঝার মতো প্রয়োজনীয় জ্ঞান রয়েছে? যাতে করে তারা তাকে উপযুক্ত ব্যক্তির সন্ধান দিতে পারেন। এরপর সে ব্যক্তি সন্ধানপ্রাপ্ত আলেমের কাছে গিয়ে তার মাসয়ালাটির কিতাব ও সুন্নাহ ভিত্তিক সমাধান চাইবে। এভাবে সে যথাযথ উৎস থেকে হক্ব বা সঠিক বিষয়টি গ্রহণ করবে। বিধানটি যিনি জানেন তার কাছ থেকে জানবে এবং যে আলেমের অভিমত শরিয়ত বিরোধি হওয়ার সম্ভাবনা আছে; সে মত থেকে নিজেকে নিষ্কৃতি দিবে।” সমাপ্ত

আদাবুল মুফতি ওয়াল মুসতাফতি গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১৭১) ইবনুস সালাহ বলেছেন:

সামআনি উল্লেখ করেছেন যে, মুফতির কাছে দলিল তলব করতে কোন বাধা নেই। যাতে করে ফতোয়াপ্রার্থী সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে। মুফতি তাকে দলিল উল্লেখ করতে বাধ্য যদি ফতোয়াপ্রার্থী অকাট্যভাবে সেটা দাবী করে। আর যদি অকাট্যভাবে দাবী না করে তাহলে তিনি বাধ্য নন; কারণ হতে পারে সাধারণ মানুষের বোধ হয়তো সে পর্যায়ে পৌঁছবে না। আল্লাহই ভাল জানেন। সমাপ্ত।

দুই:

হ্যাঁ, রমজান মাসে অধিক পরিমাণ কুরআন তেলাওয়াত করা এবং কুরআন খতম করতে সচেষ্ট থাকা মুস্তাহাব। তবে সেটা ফরজ নয়। অর্থাৎ খতম করতে না পারলে গুনাহ হবে না। তবে অনেক সওয়াব থেকে সে ব্যক্তি বঞ্ছিত হবেন।

এর দলিল হচ্ছে- আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে ইমাম বুখারি (৪৬১৪) বর্ণিত হাদিস: “জিব্রাইল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাই্হি ওয়া সাল্লামের নিকট প্রতিবছর একবার কুরআন পাঠ পেশ করতেন। আর যে বছর তিনি মারা যান সে বছর দুইবার পেশ করেন।”

ইবনে কাছির (রহঃ) ‘আল-জামে ফি গারিবিল হাদিস’ গ্রন্থে (৪/৬৪) বলেন:

অর্থাৎ তিনি তাঁকে যতটুকু কুরআন নাযিল হয়েছে ততটুকু পাঠ করে শুনাতেন। সমাপ্ত

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণে সলফে সালেহিনের আদর্শ ছিল রমজান মাসে কুরআন খতম করা। ইব্রাহিম নাখায়ি বলেন: আসওয়াদ রমজানের প্রতি দুই রাত্রিতে একবার কুরআন খতম করতেন।[আস- সিয়ার, (৪/৫১)]

কাতাদা (রহঃ) সাতদিনে একবার কুরআন খতম করতেন। রমজান মাস এলে প্রতি তিনদিনে একবার কুরআন খতম করতেন। শেষ দশ রাত্রি শুরু হলে প্রতি রাতে একবার কুরআন খতম করতেন।[আস সিয়ার, (৫/২৭৬)]

মুজাহিদ (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রমজানের প্রতি রাত্রিতে কুরআন খতম করতেন।[নববির ‘আত তিবয়ান (পৃষ্ঠা-৭৪)] তিনি বলেন: উক্তিটির সনদ সহিহ।

মুজাহিদ (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আলী আল-আযদি রমজানের প্রতি রাত্রিতে একবার কুরআন খতম করতেন।[তাহযিবুল কামাল (২/৯৮৩)]

রবী’ বিন সুলাইমান বলেন: শাফেয়ী রমজান মাসে ষাটবার কুরআন খতম করতেন।[আস সিয়ার (১০/৩৬)]

কাসেম বিন হাফেয ইবনে আসাকির বলেন: আমার পিতা নিয়মিত জামাতে নামায ও কুরআন তেলাওয়াত করতেন। প্রতি শুক্রবারে কুরআন খতম করতেন। রমজান মাসে প্রতিদিন খতম করতেন।[আস সিয়ার (২০/৫৬২)]

ইমাম নববি কুরআন খতমের সংখ্যা বিষয়ক মাসয়ালার উপর টীকা লিখতে গিয়ে বলেন:

এ বিষয়ে নির্বাচিত অভিমত হচ্ছে- ব্যক্তি বিশেষের ভিন্নতার প্রেক্ষিতে এ মাসয়ালার বিধানও ভিন্ন হবে। যে ব্যক্তি তার সূক্ষ্ম চিন্তা দিয়ে খুঁটিনাটি বিষয় ঊদঘাটন করতে সক্ষম সে ব্যক্তি শুধু ততটুকু পড়বেন যতটুকু পড়ে তিনি এটি ভালভাবে বুঝে নিতে পারেন।  অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ইলম বিতরণে অথবা দ্বীনের অন্য কোন বিশেষ দায়িত্বে অথবা মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছেন তিনিও। সেক্ষেত্রে তিনি ততটুকু পড়বেন যতটুকু পড়তে তার দায়িত্ব অবহেলা না হয়। আর যদি ব্যক্তি এ শ্রেণীর কেউ না হন তাহলে তিনি যত বেশি পড়তে পারেন তত বেশি পড়বেন; তবে যেন বিরক্তি আসার পর্যায়ে না পৌঁছে। সমাপ্ত[আত তিবয়ান (পৃষ্ঠা-৭৬)]

কুরআন তেলাওয়াত ও কুরআন খতম করার এতো তাগিদ ও এত গুরুত্বের পরেও সেটা মুস্তাহাব পর্যায়ে। এটি জরুরী ফরজ পর্যায়ে নয়; যেটা না করলে কোন মুসলমান গুনাহগার হবেন।

শাইখ উছাইমীনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: রোজাদারের উপর কুরআন খতম করা কি ফরজ?

তিনি উত্তরে বলেন: রমজান মাসে রোজাদারের জন্য কুরআন খতম করা ফরজ নয়। তবে ব্যক্তির উচিত রমজানে বেশি বেশি কুরআন পড়া। এটাই ছিল রাসূলের আদর্শ।  গোটা রমজান মাসে জিব্রাইল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কুরআন পাঠ করতেন। সমাপ্ত [মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উছাইমীন (২০/৫১৬)]

আরও জানতে দেখুন 6606326327 নং প্রশ্নোত্তর।

আল্লাহই ভাল জানেন।

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

রমজান মাসে কুরআন মুখস্থ করা উত্তম; নাকি কুরআন তেলাওয়াত করা?

উত্তর :

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।

রমজান মাসে কুরআন তেলাওয়াত করা সবচেয়ে উত্তম ও ভাল আমল। রমজান হচ্ছে- কুরআনের মাস। আল্লাহ তাআলা বলেন: “রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।”[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫]

রমজান মাসে জিব্রাইল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে পরস্পর কুরআন পাঠ করতেন।[সহিহ বুখারি (৫) ও সহিহ মুসলিম (৪২৬৮)]

ইমাম বুখারি (৪৬১৪) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, “জিব্রাইল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রতিবছর একবার কুরআন পেশ করতেন। যে বছর তিনি মারা যান সে বছর দুইবার কুরআন পেশ করেন।”

এ হাদিস থেকে গ্রহণ করা যায় যে, রমজান মাসে অধিক হারে কুরআন তেলাওয়াত করা ও কুরআন অধ্যয়ন করা মুস্তাহাব।

আরও জানতে দেখুন (50781) নং প্রশ্নোত্তর।

এ হাদিস থেকে আরও গ্রহণ করা যায় যে, কুরআন খতম করা মুস্তাহাব। যেহেতু জিব্রাইল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে গোটা কুরআন পেশ করতেন।

দেখুন ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায (১১/৩৩১)

কুরআন মুখস্থ করা ও মুখস্থকৃত অংশ পুনঃ পুনঃ আওড়ানো পাঠ করার পর্যায়ভুক্ত; বরং পাঠ করার চেয়ে বেশি। কারণ মুখস্থ করতে গেলে বা পুনঃ পুনঃ আওড়াতে গেলে তাকেও একটি আয়াত একাধিকবার পড়তে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি হরফ পড়ার জন্য সে ব্যক্তি দশ নেকি করে পাবেন।

এ কারণে মুখস্থ করা ও পুনঃ পুনঃ আওড়ানো উত্তম।

হাদিস থেকে নিম্নোক্ত বিষয়ে দলিল পাওয়া যায়:

১. কুরআন মুখস্থ করার।

২. পারস্পারিক কুরআন পাঠ করার।

৩. কুরআন তেলাওয়াত করার।

পূর্বের হাদিস থেকে এ বিষয়গুলো পাওয়া যায়।

তাই গোটা মাসে অন্তত একবার হলেও কুরআন খতম করা উচিত। এরপর তার জন্য যেটা উপযুক্ত সে সেটা করতে পারে। হয়তো বেশি বেশি তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করে কুরআন খতম করবে অথবা পুনঃ পুনঃ পাঠ করবে অথবা নতুন অংশ মুখস্থ করবে। তার মনের জন্য যেটা অধিক উপযুক্ত সেটা সে করবে। হতে পারে তার মনের জন্য মুখস্থ করা উপযুক্ত হবে অথবা তেলাওয়াত করা অথবা পুনঃ পুনঃ পাঠ করা। উদ্দেশ্য হচ্ছে- কুরআন তেলাওয়াত করা, অনুধাবন করা, এর দ্বারা প্রভাবিত হওয়া এবং কুরআন অনুযায়ী আমল করা।

একজন মুমিনের উচিত তার মনের অবস্থা বুঝে যেটা তার জন্য উপযুক্ত সেটা গ্রহণ করা।

আল্লাহই ভাল জানেন।

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব
 https://www.youtube.com/watch?v=_5NC2-2l7eA