সমাজ, রাষ্ট্র বা উম্মাতের কোনো কঠিন বিপদ, রোগব্যাধি বা বিপর্যয়ের সময় ফজরের সালাতে এবং প্রয়োজনে সকল সালাতের শেষ রাকআতের রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানোর পর সমবেত মুসল্লীদের নিয়ে দুআ করাকে কুনুতে নাযেলা বলা হয়। এটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত।
যখন মুসলমানের উপর কোন বিপদ আসে, তখন সকল সালাতে কুনুতে নাযিলা পাঠ মুস্তাহাব হওয়া প্রসঙ্গ
ইবনু আবূ উমর (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কোন সারিয়্যার (বাহিনীর) সম্বন্ধে এত বেশী দুঃখিত হতে দেখিনি। যতখানি দুঃখিত হয়েছিলেন সেই সত্তরজন সাহাবীর জন্য যাদের ‘বির-ই মা’উনা-র দিন শহীদ করা হয়েছিল, তাঁদের ‘কারী’ বলা হতো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হত্যাকারীদের এক মাস ধরে বদদু’আ করতে থাকলেন। সহিহ মুসলিমঃ১৪২৩
মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না (রহঃ) ও ইবন বাশশার (রহঃ) … বারা ইবনু আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর ও মাগরিবে কুনূত পাঠ করতেন। সহিহ মুসলিমঃ১৪২৮।
আবু তাহির ও হারামালা ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ফজরের সালাতে কিরা’আত শেষ করতেন ও তাকবীর বলতেন এবং (রুকু থেকে) মাথা উঠাতেন, তখন “সামি’আল্লাহুলিমান হামিদা” “রাব্বানা ওয়ালাকাল হামদ” বলতেন। পরে দাঁড়ানো অবস্থায় বলতেন, হে আল্লাহ! তুমি ওয়ালীদ ইবনুল ওয়ালীদ, সালামা ইবনু হিশাম এবং আয়্যাশ ইবনু আবু রাবী’আকে মুক্তি দাও এবং অন্যান্য দূর্বল মুমিনদের নাজাত দাও। হে আল্লাহ! মুদার গোত্রের উপর কঠোর শাস্তি অবতীর্ণ কর। তাদের উপর ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর সময়ের দুর্ভিক্ষের বছরগুলোর ন্যায় দুর্ভিক্ষ নাযিল কর। হে আল্লাহ! লা’নত কর লিহয়ান, রি’ল, যাকওয়ানের উপর এবং উসায়্য গোত্রের উপরও, যারা আল্লাহ্ ও রাসুলের অবাধ্যতা করেছে। কিন্তু আমাদের কাছে পরে খবর পৌছেছে যে, কুরআনের এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি লানত করা বাদ দিয়েছেনঃ
لَيْسَ لَكَ مِنَ الأَمْرِ شَىْءٌ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُونَ
“আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন না শাস্তি দিবেন তা আপনার ইখতিয়ারভুক্ত নয়; তারা নিশ্চয়ই যালিম।” সহিহ মুসলিমঃ১৪১৩।
এছাড়াও আমরা যে দুয়া গুলো করতে পারি:
নবী নূহের করা দুআ:
رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا﴾
“হে আমার রব! ভূপৃষ্ঠে বসবাসকারী কাফিরদের একজনকেও তুমি রেহাই দিও না”। (৭১:২৬)
رَبِّ نَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
“হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে যালিম গোষ্ঠী হতে রক্ষা কর”। (২৮:২১)
رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ﴾
“হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্যধারণের শক্তি দান কর এবং আমাদের পদগুলো দৃঢ় রেখ এবং
কাফিরদলের উপর আমাদেরকে জয়যুক্ত কর”। (২:২৫০)
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ﴾
“হে আমাদের রব! আমাদের অপরাধগুলো এবং আমাদের কাজ কর্মে বাড়াবাড়িগুলোকে তুমি ক্ষমা করে দাও,আমাদেরকে দৃঢ়পদ রেখ এবং কাফিরদলের উপর আমাদেরকে সাহায্য কর”। ৩:১৪৭
কুনুতে নাজিলাঃ
‘আল্লাহুম্মাহ দিনা ফিমান হাদাইতা, ওয়া আফিনা ফিমান আফাইতা, ওয়া তাওয়াল্লানা ফিমান তাওয়াল্লাইতা ওয়া বারিক লানা ফিমা আতইতা ওয়াকিনা শাররা মা কাদইতা ফাইন্নাকা তাকদি ওয়ালা ইউকদা-আলাইকা ওয়া ইন্নাহু লা ইয়াজিল্লু মাও ওয়ালাইতা ওয়ালা ইয়াইজ্জুমান আদাইতা তাবারকতা রব্বানা ওয়া তাআলাইতা নাস্তাগফিরুকা ওয়া নাতুবু ইলাইকা আল্লাহুম্মাগফিরলানা ওয়ালিল মুমিনিনা ওয়াল মুমিনাতি ওয়াল মুসলিমিনা ওয়াল মুসলিমাতি ওয়া আল্লিফ বাইনা কুলুবিহিম ওয়া আসলিহ জাতা বাইনিহিম ওয়ানছুরহুম আলা আদুব্বিকা ওয়া আদুব্বিহিম আল্লাহুম্মা লা তুহলিকনা বিআজাবিকা ওয়া আফিনা কবলা জালিকা আল্লাহুম্মাল আনিল কাফারতা ওয়াল মুশরিকিনা ওয়াল মুলহিদিনা ওয়াশশুউঈনা ওয়াল ইয়াহুদা ওয়ান নাসারা-ওয়াল মাজু-সা ওয়াল হিন্দু-সা ওয়াররাওয়াফিদা ওয়াল কাদিইয়ানি ইনাল্লাজিনা ইয়াসুদ্দুনা আন সাবিলিকা ওয়া ইউকাজ্জিবুনা রাসূলাকা ওয়া ইয়কাতিলুনা আওলিয়া-আকা, আল্লাহুম্মাশাততিত্ শামলাহুম ওয়া মাজ্জিক জাময়াহুম ওয়া দাম্মির দিয়ারাহুম ওয়া খালিফ বাইনা কালিমাতিহিম ওয়া জালজিল আকদামাহুম্ ওয়া আনজিল বিহিম বাসাকাল্লাজি লা তারুদ্দুহু আনিল কাওমিল মুজরিমিনা, ওয়া সাল্লাল্লাহু আআন্নাবিয়্যিল কারিম।’ (বাংলা উচ্চারণ শুদ্ধ হয় না, তাই কোন দুআর বই হতে আরবি দেখে পড়ুন)
অর্থ : হে আল্লাহ! হেদায়েত কর আমায়, যাদের তুমি হেদায়েত করেছ তাদের সাথে। শান্তি স্বস্তি দান করো আমায়, যাদের তুমি শান্তি স্বস্তি দান করেছ তাদের সাথে। অভিভাবকত্ব গ্রহণ করো আমার, যাদের তুমি অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছ তাদের সাথে। বরকত দান করো আমায়, যা তুমি দান করেছ আমায় তাতে এবং রক্ষা করো আমায় পর অনিষ্ট হতে, যা তুমি নির্ধারণ করেছ (আমার জন্য)। কেননা তুমি নির্দেশ দান করো, তোমার ওপর নির্দেশদান করা চলে না। বস্তুত সে ব্যক্তি অপমাানিত হয় না যাকে তুমি মিত্র ভেবেছ। আর সম্মানিত হয় না সেই ব্যক্তি, যাকে তুমি শত্রু ভেবেছ। বরকতময় তুমি হে আমাদের প্রতিপালক আর তুমিই সুউচ্চ। আমরা তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তোমার দিকে রুজু হই। হে আল্লাহ! ক্ষমা করো আমাদেরকে এবং মুমিন নর ও মুমিন নারীদেরকে আর মুসলমান নর ও মুসলমান নারীদেরকে তাদের অন্তরসমূহ জুড়িয়ে দাও আর তাদের মাঝে মীমাংসা করে দাও। সাহায্য করো তাদেরকে তোমার শত্রু ও তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে। হে আল্লাহ! লানত বর্ষণ করো কাফেরদের প্রতি, যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তোমার পথে এবং অস্বীকার করে তোমার রাসূলদেরকে আর যুদ্ধবিগ্রহ করে তোমার অলিদের সাথে। হে আল্লাহ! বিভেদ সৃষ্টি করে দাও তাদের কথার মাঝে এবং কম্পন সৃষ্টি করে দাও তাদের পদযুগলে আর নাজিল করো তোমার এমন শাস্তি যা তুমি অপরাধীগণ থেকে অপসারণ করো না।
একাধিক দুআ কুনুত হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে।
«اللَّهُمَّ اهْدِنِي فِيمَنْ هَدَيْتَ، وَعَافِنِي فِيمَنْ عَافَيْتَ، وَتَوَلَّنِي فِيمَنْ تَوَلَّيْتَ، وَبَارِكْ لِي فِيمَا أَعْطَيْتَ، وَقِنِي شَرَّ مَا قَضَيْتَ؛ فَإِنَّكَ تَقْضِي وَلاَ يُقْضَى عَلَيْكَ، إِنَّهُ لاَ يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ، [وَلاَ يَعِزُّ مَنْ عَادَيْتَ]، تَبارَكْتَ رَبَّنا وَتَعَالَيْتَ».
(আল্লা-হুম্মাহদিনী ফীমান হাদাইতা ওয়া ‘আ-ফিনী ফীমান ‘আ-ফাইতা ওয়া তাওয়াল্লানী ফীমান তাওয়াল্লাইতা ওয়াবা-রিক লী ফীমা আ‘ত্বাইতা ওয়াক্বিনী শাররা মা ক্বাদাইতা ফাইন্নাকা তাক্ব্দ্বী ওয়ালা ইউক্ব্দ্বা ‘আলাইকা। ইন্নাহু লা ইয়াযিল্লু মাও ওয়া-লাইতা, [ওয়ালা ইয়া‘ইয্যু মান ‘আ-দাইতা।] তাবা-রক্তা রব্বানা ওয়া তা‘আ-লাইতা)।
“হে আল্লাহ! আপনি যাদেরকে হেদায়াত করেছেন তাদের মধ্যে আমাকেও হেদায়াত দিন, আপনি যাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করেছেন তাদের মধ্যে আমাকেও নিরাপত্তা দিন, আপনি যাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের মধ্যে আমার অভিভাবকত্বও গ্রহণ করুন, আপনি আমাকে যা দিয়েছেন তাতে বরকত দিন। আপনি যা ফয়সালা করেছেন তার অকল্যাণ থেকে আমাকে রক্ষা করুন। কারণ আপনিই চুড়ান্ত ফয়সালা দেন, আপনার বিপরীতে ফয়সালা দেওয়া হয় না। আপনি যার সাথে বন্ধুত্ব করেছেন সে অবশ্যই অপমানিত হয় না [এবং আপনি যার সাথে শত্রুতা করেছেন সে সম্মানিত হয় না।] আপনি বরকতপূর্ণ হে আমাদের রব্ব! আর আপনি সুউচ্চ-সুমহান” (আবূ দাউদ, নং ১৪২৫; তিরমিযী, নং ৪৬৪; নাসাঈ, নং ১৭৪৪; ইবন মাজাহ, নং ১১৭৮)
«اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ، وَبِمُعَافَاتِكَ مِنْ عُقُوبَتِكَ، وَأَعُــــوذُ بِكَ مِنْكَ، لاَ أُحْصِي ثَنَاءً عَلَيْكَ، أَنْتَ كَمَا أَثْنَيْتَ عَلَى نَفْسِكَ».
(আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযুবিরিদ্বা-কা মিন সাখাত্বিকা, ওয়া বিমু‘আ-ফা-তিকা মিন ‘উক্বুবাতিকা, ওয়া আঊযু বিকা মিনকা, লা উহ্সী সানা-আন আলাইকা, আনতা কামা আসনাইতা ‘আলা নাফসিকা)।
“হে আল্লাহ! আমি আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমে অসন্তুষ্টি থেকে, আর আপনার নিরাপত্তার মাধ্যমে আপনার শাস্তি থেকে আশ্রয় চাই। আর আমি আপনার নিকটে আপনার (পাকড়াও) থেকে আশ্রয় চাই। আমি আপনার প্রশংসা গুনতে সক্ষম নই; আপনি সেরূপই, যেরূপ প্রশংসা আপনি নিজের জন্য করেছেন।” আবূ দাউদ, নং ১৪২৭; তিরমিযী, নং ৩৫৬৬;
«اللَّهُمَّ إِيَّاكَ نعْبُدُ، وَلَكَ نُصَلِّي وَنَسْجُدُ، وَإِلَيْكَ نَسْعَى وَنَحْفِدُ، نَرْجُو رَحْمَتَكَ، وَنَخْشَى عَذَابَكَ، إِنَّ عَذَابَكَ بِالكَافِرِينَ مُلْحَقٌ. اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعينُكَ، وَنَسْتَغْفِرُكَ، وَنُثْنِي عَلَيْكَ الْخَيْرَ، وَلاَ نَكْفُرُكَ، وَنُؤْمِنُ بِكَ، وَنَخْضَعُ لَكَ، وَنَخْلَعُ مَنْ يَكْفرُكَ».
(আল্লা-হুম্মা ইয়্যাকা না‘বুদু, ওয়ালাকা নুসাল্লী, ওনাসজুদু, ওয়া ইলাইকা নাস‘আ, ওয়া নাহ্ফিদু, নারজূ রাহ্মাতাকা, ওয়া নাখশা ‘আযা-বাকা, ইন্না ‘আযা-বাকা বিলকাফিরীনা মুলহাক্ব। আল্লা-হুম্মা ইন্না নাসতা‘ঈনুকা ওয়া নাসতাগফিরুকা, ওয়া নুসনী ‘আলাইকাল খাইরা, ওয়ালা- নাকফুরুকা, ওয়ানূ’মিনু বিকা, ওয়া নাখদ্বা‘উ লাকা, ওয়ানাখলা‘উ মাই ইয়াকফুরুকা।)
“হে আল্লাহ! আমরা আপনারই ইবাদত করি; আপনার জন্যই সালাত আদায় করি ও সিজদা করি; আমরা আপনার দিকেই দৌড়াই এবং দ্রুত অগ্রসর হই; আমরা আপনার করুণা লাভের আকাঙ্ক্ষা করি এবং আপনার শাস্তিকে ভয় করি। নিশ্চয় আপনার শাস্তি কাফেরদেরকে পাবে।”
“হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমরা আপনার কাছে সাহায্য চাই, আপনার কাছে ক্ষমা চাই, আপনার উত্তম প্রশংসা করি, আপনার সাথে কুফরি করি না, আপনার উপর ঈমান আনি, আপনার প্রতি অনুগত হই, আর যে আপনার সাথে কুফরি করে আমরা তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করি।”
হাদীসটি বায়হাকী তাঁর ‘আস-সুনানুল কবরা’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন এবং তার সনদ বিশুদ্ধ বলেছেন, ২/২১১। আর শাইখ আলবানী ইরওয়াউল গালীল এর ২/১৭০ এ বলেন, ‘এর সনদ বিশুদ্ধ। আর তা উমর রা. থেকে মওকূফ হাদীসে বর্ণিত।