তাওয়াস্সুল অর্থ : নৈকট্য লাভ করা, আর অসীলা অর্থ : নিকটবর্তী হওয়া।
শরিয়তের ভাষায় তাওয়াস্সুল বা অসীলার অর্থ সম্পর্কে আল কুরআনে দু’টি আয়াত এসেছে।
প্রথমটি — আল্লাহ বলেন :
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱبۡتَغُوٓاْ إِلَيۡهِ ٱلۡوَسِيلَةَ وَجَٰهِدُواْ فِي سَبِيلِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٣٥ ﴾ [المائدة: ٣٥]
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তার নৈকট্য অর্জন করতে সচেষ্ট হও এবং তার পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” [সূরা মায়েদাঃ৩৫]
দ্বিতীয় আয়াত — আল্লাহ বলেন :
﴿ قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِهِۦ فَلَا يَمۡلِكُونَ كَشۡفَ ٱلضُّرِّ عَنكُمۡ وَلَا تَحۡوِيلًا ٥٦ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحۡذُورٗا ٥٧ ﴾ [الاسراء: ٥٦، ٥٧]
“হে নবী আপনি তাদেরকে বলে দিন, আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে কর, তাদেরকে আহ্বান কর, তারা তোমাদের কষ্ট দূর করার ক্ষমতা রাখে না এবং তা পরিবর্তনও করতে পারেনা। যাদেরকে তারা আহ্বান করে তারা নিজেরাই তো তাদের পালন কর্তার নৈকট্য তালাশে ব্যাপ্ত যে, তাদের মধ্যে কে (আল্লাহর) বেশি নৈকট্যশীল (হবে)। তারা তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে, নিশ্চয় আপনার পালনকর্তার শাস্তি ভয়াবহ।” [সূরা ইসরা/ ৫৬-৫৭]
এ দু’টি আয়াতে তাওয়াস্সুলের অর্থ কি ?
প্রথম আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার বাণীতে অসীলার অর্থ হলো: নৈকট্য লাভ করা। আর এটাই হচ্ছে ইবনে আব্বাস, আতা, মুজাহিদ এবং ফার্রা রাদিয়াল্লাহু আনহুম এর মত।
কাতাদাহ বলেন: পছন্দনীয় কাজের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ করা।
আবু উবাইদাহ বলেন: তাওয়াসাসলতু ইলাইহি অর্থাৎ “তার নিকটবর্তী হয়েছি। ইবনে যাইদ বলেছেন: অসীলা অর্থ: মহব্বত, তখন অর্থ হবে, “তারা আল্লাহর প্রিয় হয়েছে।”
বস্তুত: এগুলো কোনো পরস্পর বিরোধী অর্থ নয়, বরং শব্দের পার্থক্য মাত্র, কেননা “আল্লাহর প্রিয় হওয়া তাঁর নৈকট্য লাভেরই একটি প্রকার।”
মোটকথা: আল্লাহর বাণী وابتغوا إليه الوسيلة এর মধ্যকার ‘অসীলা’ শব্দটির অর্থ: তোমরা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ কর।
এ অর্থে মুফাস্সিরিনদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই, যেমন ইবনে কাছীর রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেছেন।
আর দ্বিতীয় আয়াত, আল্লাহর বাণী يبتغون إلى ربهم الوسيلة এর মধ্যকার ‘অসীলা’ শব্দটির অর্থ: ‘তারা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ করে।’ যেমন তাফসীরে জালালাইনসহ ও অন্যান্য তাফসীরে এসেছে।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শরিয়তের পরিভাষায় এবং আরবদের ভাষায় অসীলা হলো: নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্যলাভ করা।
অসীলা দুই প্রকার : বৈধ ও অবৈধ।
বৈধ অসীলা :
বৈধ অসীলা : আমরা জানি যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আমরা যেন একমাত্র তারই ইবাদত করি এবং তার সহিত যেন কাউকে অংশিদার না করি। দো‘আ একটি বড় ইবাদত, যা অন্য কারো জন্য করা জায়েয নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِي سَيَدۡخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ٦٠ ﴾ [غافر: ٦٠]
“এবং আপনার প্রভু বলেন যে, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব, নিশ্চয়ই যারা আমার ইবাদত করা থেকে অহংকার করে তারা অতি সত্তর অপমাণিত লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”
[সূরা গাফেরঃ৬০]
তিনি আরো বলেন:
﴿ وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨]
“সকল মাসজিদ আল্লাহর জন্য, কাজেই তোমরা আল্লাহর সহিত কাউকে ডেকোনা।” [সূরা আল-জিন: ১৮]
তিনি আরো বলেন:
﴿ وَأَنَّهُۥ لَمَّا قَامَ عَبۡدُ ٱللَّهِ يَدۡعُوهُ كَادُواْ يَكُونُونَ عَلَيۡهِ لِبَدٗا ١٩ قُلۡ إِنَّمَآ أَدۡعُواْ رَبِّي وَلَآ أُشۡرِكُ بِهِۦٓ أَحَدٗا ٢٠ ﴾ [الجن: ١٩، ٢٠]
“আর এই যে, যখন আল্লাহর বান্দা তাঁকে ডাকার জন্যে দন্ডায়মান হলো তখন তারা তার নিকট ভিড় জমালো। বলুন, আমি তো কেবল আমার রবকে ডাকি, আমি তো তার সাথে কাউকে শরীক করি না” [সূরা জিন/১৯-২০]
আল্লাহ তা‘আলাকে নিম্নোক্ত কয়েকটি পদ্ধতিতে তাকে ডাকা আমাদের জন্য বৈধ করেছেন:
1- আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর সুন্দর সুন্দর নাম এবং উন্নত গুণাবলীর মাধ্যমে তাঁকে ডাকার জন্য, কাজেই আমরা বলব : হে আল্লাহ ! আমি আপনার কাছে চাই কারণ; আপনি ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই, চীরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক, যেন আপনি আমার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন, অথবা আমার ভার লাঘব করে দিন, অথবা আমার রোগীকে আরোগ্য দিন। …. . .
2- আমাদের কৃত সৎকর্মের মাধ্যমে তাঁকে ডাকার জন্য বৈধ করেছেন। যেমন: হে আল্লাহ তোমার প্রতি আমার ঈমান, তোমার রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যয়ণ, তাঁর অনুসরণ অনুকরণের দ্বারা আমি চাই যেন আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমাকে দয়া করুন, অথবা আমার ভার লাঘব করে দিন, অথবা আমার রোগীকে আরোগ্য দান করুন। …
3- অন্য এক প্রকারে ডাকাও তিনি আমাদের জন্য বৈধ করেছেন, তা হলো: আমরা কোনো জীবিত উপস্থিত সৎ লোকের নিকট এসে বলতে পারি যে, হে অমুক; আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, তিনি যেন আমাদিগকে দৃঢ় রাখেন, ক্ষমা করেন এবং আমাদের রুগীদেরকে ভাল করে দেন, ইত্যাদি।
অবৈধ অসীলা :
প্রতিটি সেই অসীলা কুরআন বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস থেকে যার কোনো দলীল নেই।
অবৈধ অসীলাগুলো যেমন: আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে সৎলোক এবং নবী রাসূলগণের দোহাই দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। যেমন এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ, আমি তোমার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসীলায় বা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর অসীলায় বা অমুক শাইখের অসীলায় বলছি, তুমি আমার পাপগুলো ক্ষমা করে আমাকে অনুগ্রহ কর।
এমনিভাবে কোনো পবিত্র ভূমি এবং কোনো ভালো সময়কে অসীলা করা। যেমন: এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ আমি কা‘বার অসীলায় এবং রমাযান ও কদরের রাত্রির অসীলায় প্রার্থনা করছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও ইত্যাদি।
উল্লেখিত সবগুলো পদ্ধতিই শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম। এবং তা সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিদয়াত। কারণ এর কোনোটাই জায়েয হওয়ার উপর কুরআন হাদীসের দলীল প্রমাণ নেই।
কুরআন হাদীস এবং এ উম্মতের সালাফদের থেকে যত অসীলা এসেছে এর কোনটাতেই এমন কোনো অসীলা নেই, যাতে কোনো সৃষ্টির দোহাই দিয়ে আল্লাহর নিকট চাওয়া হয়েছে। এটি উম্মতের অধিকাংশ উলামার মত।
সংকলন: ডক্টর আব্দুস সালাম বারজাস আল আব্দুল করীম
অনুবাদক: মোহাম্মদ ইদরীস আলী মাদানী