রোগ ও রোগী-ইসলাম কি বলে!-৬

অসুস্থ ব্যক্তির পবিত্রতা অর্জন করার পদ্ধতি

আমাদের সমাজে নেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অসুস্থ ব্যক্তির পবিত্রতা থাকাটা খুব একটা প্রয়োজন মনে করেন না। অসুস্থ অবস্থাতো আল্লাহ দেখছেন, কিছু হবে না ইত্যাদি বিভিন্নভাবে অবহেলা করা হয়। কিন্তু আসলে এই অসুস্থ ব্যক্তিটির আরো বেশী পবিত্রতা প্রয়োজন। অসুস্থ ব্যক্তি নিজে না পারলেও যিনি সাথে থাকছেন দেখা-শুনা করার জন্য, তিনি আন্তরিকভাবে প্রয়োজন উপলব্ধি সহকারে সহযোগীতা করবেন। এই পবিত্রতা একদিকে যেমন অনেক রোগের বিস্তার থেকে বা জটিল হওয়া থেকে রক্ষা করবে তেমনি মানসিক সুস্থতা বজায়ে সহায়ক থেকে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি পাবে ইন শা আল্লাহ।

সম্মানিত শাইখ ইবনু ঊছাইমীন (রহঃ) বলেন,

অসুস্থ ব্যক্তির অবস্থার বিচার করে তার জন্য ইসলামী শরীয়তে কিছু বিধান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা নবী মুহাম্মাদ সা.কে ক্ষমাশীল সর্বোত্তম সঠিক ধর্ম দিয়ে প্রেরণ করেন, যা হচ্ছে সহজ ও সরলতার বৈশিষ্টে অনন্য। আল্লাহ্ এরশাদ করেনঃ

“তিনি তোমাদের জন্য ধর্মে কোন অসুবিধা রাখেননি।” (সূরা হাজ্জ- ৭৮)

তিনি আরো বলেনঃ

“আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজতা চান, তোমরা অসুবিধায় পড় তিনি তা চান না।” (সূরা বাক্বারা- ১৮৫)

আল্লাহ্ আরো বলেনঃ

“তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর কথা শোন ও আনুগত্য কর।” (সূরা তাগাবুন- ১৬)

নবী সা. বলেন, ِ“নিশ্চয় এই ধর্ম অতি সহজ।”

তিনি আরো বলেনঃ

“আমি যখন কোন বিষয়ে তোমাদেরকে আদেশ করি, তখন সাধ্যানুযায়ী তা বাস্তবায়ন কর।”

উল্লেখিত মূলনীতির ভিত্তিতে ওযর বিশিষ্ট লোকদের জন্য আল্লাহ তা’আলা ইবাদতকে সহজ ও হালকা করে দিয়েছেন। যাতে করে তারা কোন অসুবিধা ও কষ্ট ছাড়াই তাঁর ইবাদত সম্পাদন করতে পারে। (আল্ হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন)

অসুস্থ ব্যক্তির পবিত্রতা অর্জনের পদ্ধতি:

১) অসুস্থ ব্যক্তির উপর আবশ্যক হল ছোট নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য পানি দ্বারা অযু করা এবং বড় নাপাকী থেকে পবিত্রতা হাসিলের জন্য পানি দ্বারা গোসল করা।

২) পানি দ্বারা যদি পবিত্রতা অর্জন করতে না পারে অপারগতার কারণে বা রোগ বেড়ে যাবে এই আশংকার কারণে বা ভয় করে সুস্থ হতে দেরী হয়ে যাবে- তবে এহেন পরিস্থিতিতে সে তায়াম্মুম করবে।

৩) তায়াম্মুমের পদ্ধতি হল- হাত দুটিকে পবিত্র মাটিতে একবার মারবে তারপর তা দিয়ে সমস্ত মুখমন্ডল মাসেহ করবে। অতঃপর উভয় হাতকে কব্জি পর্যন্ত মাসেহ করবে। আগে ডান হাত পরে বাম হাত।

মাটি না পেয়ে দেয়ালে বা বিছানায় তায়াম্মুম করলে বিশুদ্ধ হবে কি?

 দেয়াল হচ্ছে পবিত্র মাটির অন্তর্ভূক্ত। দেয়াল যদি পাথর বা মাটির তৈরী ইট দ্বারা নির্মিত হয়, তবে তা দ্বারা তায়াম্মুম করা জায়েয। কিন্তু কাঠ বা পেইন্ট প্রভৃতি দ্বারা যদি দেয়ালকে ঢেকে দেয়া হয়- আর এর উপর ধুলা জমে থাকে, তবে তা দ্বারা তায়াম্মুম করতে কোন অসুবিধা নেই। আর তা মাটিতে তায়াম্মুমের অন্তর্ভূক্ত হবে। কেননা ধুলা মাটিরই অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু উক্ত দেয়ালে যদি কোন ধুলা বা মাটি না থাকে, তবে সেখানে তায়াম্মুম করা যাবে না। কেননা সেখানে তো কোন মাটি নেই।

আর বিছানার ক্ষেত্রে কথা হচ্ছে, যদি তাতে ধুলা থাকে, তবে তা দ্বারা তায়াম্মুম চলবে অন্যথায় নয়। কেননা বিছানা মাটির অন্তর্গত নয়।

৪) রুগী নিজে যদি পবিত্রতা অর্জন করতে অক্ষম হয়, তবে অন্য ব্যক্তি তাকে অযু বা তায়াম্মুম করিয়ে দিবে।

৫) অযু বা গোসলের কোন অঙ্গে যদি যখম থাকে আর পানি দিয়ে ধৌত করলে তাতে ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে, তবে পানি দিয়ে হাতকে ভিজিয়ে সে স্থানকে মুছে দিবে। এভাবে মুছে দেয়াতেও যদি ক্ষতির আশংকা হয়, তবে তার জন্য তায়াম্মুম করে নিবে।

৬) ভাঙ্গা-মচকা ইত্যাদি কারণে যদি শরীরের কোন অঙ্গে পট্টি বা ব্যান্ডেজ থাকে তবে সে স্থান ধৌত করার পরিবর্তে পানির মাধ্যমে তার উপর মাসেহ করে নিবে। এক্ষেত্রে তায়াম্মুম করবে না। কেননা মাসেহ ধোয়ার পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে।

৭) যমিনের উপর হাত রেখে বা দেয়াল থেকে বা যে বস্তুতে ধূলা আছে তা থেকে তায়াম্মুম করা সম্ভব না হয় তবে কোন পাত্র বা রুমালের মধ্যে কিছু মাটি রেখে দিতে পারে। তারপর তা দিয়ে তায়াম্মুম করবে।

৮) এক ওয়াক্তের সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে তায়াম্মুম করার পর যদি তায়াম্মুম অবশিষ্ট থাকে তবে তা দিয়ে আরেক ওয়াক্তের সালাত আদায় করতে পারবে। এক্ষেত্রে পরবর্তী সালাতের জন্য আবার তায়াম্মুম করার দরকার নেই। কেননা সে তো পবিত্রই আছে। আর পবিত্রতা ভঙ্গকারী কোন কারণও ঘটেনি।

এমনিভাবে বড় নাপাকী থেকে যদি তায়াম্মুম করে তবে পরবর্তী বড় নাপাকীতে লিপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আর তায়াম্মুম করতে হবে না। কিন্তু এর মাঝে ছোট নাপাকীতে লিপ্ত হলে তার জন্য তায়াম্মুম করতে হবে।

৯) অসুস্থ ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হল সকল প্রকার নাপাকী থেকে স্বীয় শরীরকে পাক-পবিত্র করা। যদি পাক-পবিত্র হতে সক্ষম না হয়, তবে সংশ্লিষ্ট নাপাকী নিয়েই সালাত আদায় করবে। তার উক্ত সালাত বিশুদ্ধ হবে এবং পুনরায় উক্ত সালাত দোহরাতে হবে না।

১০) পবিত্র কাপড় নিয়ে সালাত আদায় করাও অসুস্থ ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। কাপড় নাপাক হয়ে গেলে তা ধৌত করা অথবা তা বদলিয়ে অন্য কাপড় পরিধান করা ওয়াজিব। কিন্তু এরূপ করা ঐ যদি সাধ্যাতীত হয় তবে সংশ্লিষ্ট নাপাকী নিয়েই সালাত আদায় করবে। উক্ত সালাত বিশুদ্ধ হবে এবং তা আর ফিরিয়ে পড়তে হবে না।

১২) পবিত্র স্থান ও পবিত্র বস্তুর উপর সালাত আদায় করাও রুগীর উপর ওয়াজিব। যদি সালাতের স্থান নাপাক হয়ে যায় তবে তা ধৌত করা বা কোন পবিত্র বস্তু দ্বারা পরিবর্তন করা বা সেখানে কোন পবিত্র বস্তু বিছিয়ে দেয়া ওয়াজিব। যদি এর কোনটাই সম্ভব না হয় তবুও ঐ অবস্থায় সালাত আদায় করবে এবং তার সালাত শুদ্ধ হবে। অন্য সময় তা ফিরিয়ে পড়ারও দরকার হবে না।

১৩) পবিত্রতা হাসিল করতে অপারগতার কারণে কোন রুগীর জন্য সালাত পরিত্যাগ করা বা কাযা করা কোন ক্রমেই বৈধ নয়। সাধ্যানুযায়ী সে পবিত্রতা অর্জন করবে। তারপর সময়ের মধ্যেই সালাত আদায় করে নিবে- যদিও তখন তার শরীরে বা কাপড়ে বা সালাতের স্থানে নাপাকী লেগেই থাকে যা দূরীভূত করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:  তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহ্‌কে ভয় কর। (সূরা তাগাবূন: ১৬)

১৪) কোন মানুষ যদি বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত থাকে,

তবে সে সালাতের ওয়াক্ত আসার আগে যেন অযু না করে। যখন সালাতের ওয়াক্ত আসবে তখন তার লজ্জাস্থান ধৌত করবে, তারপর উক্ত স্থানে পবিত্র কোন বস্তু বেঁধে দিবে যাতে পেশাব কাপড় বা শরীরে ছড়িয়ে না যায়। তারপর অযু করে সালাত আদায় করবে। এরূপ সে প্রত্যেক ফরয সালাতের সময় করবে। এরূপ করা যদি তার উপর অধিক কষ্টকর হয় তবে দু্সালাতকে একত্রে পড়া তার জন্য জায়েয আছে। যোহর এবং আছর একত্রে এবং মাগরিব ও এশা একত্রে আদায় করে নিবে। আর ফরয সালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সুন্নাতের জন্য আলাদা অযু দরকার নাই তবে অন্য কোন নফল সালাত আদায় করতে চাইলে তাকে ফরযের নিয়মে পবিত্রতা অর্জন করতে হবে।

পট্টির উপর মাসেহ করার বিধান কি?

প্রথমত আমাদের জানা উচিত যে, পট্টি কি?

পট্টি বা ব্যান্ডেজ হচ্ছে এমন বস্তু যা ভাঙ্গা-মচকা জোড়া লাগানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। ফিক্বাহবিদদের ভাষায়ঃ “বিশেষ প্রয়োজনে পবিত্রতা অর্জনের অঙ্গে কোন কিছু লাগিয়ে রাখা।” ভেঙ্গে যাওয়া স্থানে বা ফোঁড়ার স্থানে বা পিঠের ব্যাথায় বা অন্য কোন কারণে যে পট্টি বা ব্যান্ডেজ লাগানো হয় এখানে সেটাই উদ্দেশ্য। ধৌত করার পরিবর্তে সেখানে মাসেহ করলেই যথেষ্ট হবে।

যেমন কোন লোকের হাতে ফোঁড়ার কারণে যদি পট্টি বাধা থাকে, তখন অযু করার সময় অন্যান্য স্থান ধৌত করে পট্টির উপর শুধু মাসেহ করবে। তাহলেই তার পবিত্রতা পূর্ণ হয়ে যাবে। যদি তার অযু ভঙ্গ না হয়ে থাকে, তবে পট্টি বা ব্যান্ডেজ খুলে ফেলার কারণে তার পবিত্রতা নষ্ট হবে না।

অযু গোসলের কোন অঙ্গে যদি যখম বা ফোঁড়া বা এরকম কিছু থাকে, তবে তা কয়েকটি স্তরে বিভক্তঃ

প্রথম স্তরঃ যখম বা ফোঁড়ার স্থানটি উম্মুক্ত। ধৌত করলে কোন অসুবিধা হবে না। সুতরাং উহা ধৌত করা ওয়াজিব।

দ্বিতীয় স্তরঃ স্থানটি উম্মুক্ত কিন্তু ধৌত করলে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। তখন সেখানে মাসেহ করা ওয়াজিব।

তৃতীয় স্তরঃ স্থানটি উম্মুক্ত কিন্তু ধৌত বা মাসেহ করলে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। তখন সেখানে তায়াম্মুম করা ওয়াজিব।

চতুর্থ স্তরঃ স্থানটি পট্টি বা ব্যান্ডেজ জাতীয় বস্তু দ্বারা ঢাকা আছে। তখন সেই বস্তুর উপর মাসেহ করবে। ধৌত বা তায়ম্মুম করার দরকার হবে না।

শাইখ ইবনু ঊছাইমীন (রহঃ)

মোজার উপর মাসেহ করার কয়েকটি শর্ত রয়েছেঃ

প্রথম শর্তঃ ছোট বড় সবধরণের নাপাকী থেকে পূর্ণরূপে পবিত্রতা অর্জন করার পর মোজা পরিধান করবে। যদি পবিত্রতা অর্জন না করে মোজা পরিধান করে, তবে তাতে মাসেহ করা বিশুদ্ধ হবে না।

দ্বিতীয় শর্তঃ মাসেহ করার নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে মাসেহ করতে হবে।

তৃতীয় শর্তঃ ছোট নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জন তথা ওযুর ক্ষেত্রে মাসেহ হতে হবে। কিন্তু গোসল ফরয হলে মোজা অবশ্যই খুলতে হবে এবং সমস্ত শরীর ধৌত করতে হবে। এ জন্য জানাবতের ক্ষেত্রে মোজার উপর মাসেহ করা যাবে না।

যেমনটি ছাফওয়ান বিন আস্সাল (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রয়েছেঃ তিনি বলেন, আমরা সফরে থাকলে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে আদেশ করতেন, নাপাক না হলে আমরা যেন তিন দিন তিন রাত মোজা না খুলি।

মোজার উপর মাসেহ করার সময় সীমাঃ     

  মুক্বীম তথা গৃহে অবস্থানকারীর জন্য একদিন একরাত – ২৪ঘন্টা।

আর মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত তথা ৭২ ঘন্টা। নামায কয় ওয়াক্ত হল সেটা বিষয় নয়, আসল কথা হচ্ছে নির্ধারিত সময় পূর্ণ হওয়া।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময় গণনা কখন থেকে শুরু হবে?

এই হিসাব শুরু হবে প্রথম বার মাসেহ করার সময় থেকে। মোজা পরিধান বা ওযু ভঙ্গের সময় থেকে হিসাব শুরু হবে না। কেননা হাদীছে ‘মাসেহ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যখন এই কাজটি হবে তখনই শব্দটির ব্যবহার হবে। “মুক্বীম একদিন একরাত্র মাসেহ করবে এবং মুসাফির তিনদিন তিন রাত মাসেহ করবে।” প্রথমবার মাসেহ করার সময় থেকে হিসাব শুরু হবে। তখন থেকে নিয়ে ২৪ ঘন্টা পূর্ণ হলেই মুক্বীমের নির্দিষ্ট সময় শেষ। আর ৭২ ঘন্টা পূর্ণ হলে মুসাফিরের নির্দিষ্ট সময় শেষ।

বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, ছেঁড়া মোজা এবং বাইরে থেকে চামড়া দেখা যায় এমন পাতলা মোজার উপর মাসেহ করা জায়েয। যে অঙ্গের উপর মাসেহ হবে তাকে পরিপূর্ণরূপে ঢেকে রাখতে হবে এটা উদ্দেশ্য নয়। কেননা পা তো আর সতর নয়। মাসেহ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওযুকারী ব্যক্তির উপর সহজতা ও হাল্কা করা। অর্থাৎ- আমরা প্রত্যেক ওযুর সময় মোজা পরিধানকারীকে মোজা খুলে পা ধৌত করতে বাধ্য করব না। বরং বলব, এর উপর মাসেহ করাই আপনার জন্য যথেষ্ট। আর এই সহজতার উদ্দেশ্যেই মোজার উপর মাসেহ শরীয়ত সম্মত করা হয়েছে। অতএব কোন পার্থক্য নেই চাই মোজা ছেঁড়া হোক বা ভাল হোক, পাতলা হোক বা মোটা হোক। শাইখ ইবনু ঊছাইমীন (রহঃ) বলেন,