রোগ আমার জীবনের জন্য কেনো?
আমাদের আশে পাশে রোগ বা যে কোন বিপদে বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন রকমভাবে মনের কথা প্রকাশ করে থাকেন। যেমন-
অনেকে বলেন, যারা ধর্ম কর্ম করে না তাদের এতো অসুখ বিপদ আসে না।
আমার জীবনেই শুধু রোগ বালাই থাকে। এতো আল্লাহকে ডাকি, আমার ডাক শুনে না।
জীবনে কি এতো বড় পাপ করলাম যে, আমার জীবনে এতো বড় অসুখ আসলো।
কত আর ধৈর্য্য ধরবো, জীবনে কি ভালো কাজ করি নাই? আর কত পরীক্ষা দিবো?
আমার জানামতে কারো ক্ষতিতো আমি করি নাই, তাহলে কেনো আমার জীবনে বিপদ আসলো?
আল্লাহকে তো কত ডাকি, আল্লাহর পথেইতো চলি তাহলে কেন এতো বড় সমস্যা এলো?
আল্লাহ কি দেখে না, আমার পক্ষে কিভাবে সামাল দেয়া সম্ভব?
গরীবের কপালেই খালি কষ্ট আল্লাহ দেয়, কই ধনীরাতো আরামেই থাকে!
এতো কষ্ট আর ভালো লাগে না, তার চেয়ে আল্লাহ আমাকে নিয়ে যাক!
উপরের কথাগুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কেউ কোন এক অবস্থায় বলে থাকেন বা কারো কাছ থেকে শুনে থাকবেন।
চলুন মহান আল্লাহ আমাদের কি জানিয়েছেন তা জানার চেষ্টা করি। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
‘তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জানেন নি তাদেরকে যারা তোমাদের মধ্য থেকে আল্লাহর পথে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা করেছে এবং জানেন নি ধৈর্যশীলদেরকে।’
সূরা আলে-ইমরান: ১৪২
মহান রবের পথে অটল থাকার জন্য প্রয়োজন ধৈর্যের এবং মহান আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককেই যাঁচাই করবেন কথা ও কাজের সাথে মিল আছে কি না? এই দুনিয়ার জীবনে মহান আল্লাহ শুধুমাত্র খাওয়া দাওয়া ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই পাঠান নি। আমাদের জানতে হবে আমার এই মূল্যবান জীবন কে কোন উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন, আমার করনীয় কি, আমাকে আবার নিয়ে যাওয়া হবে মহান রবের কাছে, সেখানে আমি কি নিয়ে দাড়াবো? ইত্যাদি আমাদের জানতে হবে কুর’আন থেকে। তাহলে যেকোন অবস্থায় সবর নেয়া সহজ হয়ে যাবে।
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো। মুসলিম থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়। আলে ইমরানঃ ১০২
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর দরবারে নৈকট্য লাভের উপায় অনুসন্ধান করো এবং তাঁর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনা করো, সম্ভবত তোমরা সফলকাম হতে পারবে। আল মায়েদাহঃ ৩৫
মহান আল্লাহ সূরা মূলকে ( আয়াত-৩) জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি (আল্লাহ) মৃত্য ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যেন পরীক্ষা করে নিতে পারেন তোমাদের মধ্যে ভালো কাজের দিক দিয়ে উত্তম কে?
আমরা অনেকেই মনে করি সালাত আদায় করছি, মনে হয় আল্লাহকে কত বড় অনুগ্রহ করছি, আস্তাগফিরুল্লাহ। মহান আল্লাহর প্রতি নিজেকে সঁপে দেয়া অর্থ হলো প্রতিটি ক্ষেত্রেই মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিক নির্দেশনা মেনে চলা ও নিষেধগুলো থেকে দূরে থাকা। এই অবস্থা থেকে যখনই কেউ একটু দূরে সরে যান, মহান আল্লাহ বান্দাহকে ভালোবেসে স্মরন করিয়ে দিতে চান, ফিরে আসো সত্যের পথে আনুগত্যের পথে।
রাসূ স. বলেছেন আল্লাহ তায়ালা যখন কোন সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন, তখন তাদেরকে(বিপদ আপদ দিয়ে) পরীক্ষা করেন। যে ব্যক্তি ধৈর্য্যধারন করে সে ধৈর্যের প্রতিদান পায়। আর যে অধৈর্য্য হয়ে যায় সে অধৈর্যের ফল পায়। মুসনাদে আহমাদ: ২৩৬২৩
রাসূল স. আরো বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যাকে কল্যান দান করতে চান বা ভালোবাসেন, তাকে কষ্টে বা মুসীবতে ফেলেন। সহিহ আল বুখারি: ৫২৩৩
তাহলে বুঝাই যাচ্ছে মহান আল্লাহ বান্দাহকে ভালোবাসেন বলেই কোন সমস্যা বা অসুখ দিয়ে থাকেন। মানুষ যেন মহান আল্লাহর ভালোবাসার কাছে ফিরে আসে, মহান রবের দরবারে মাথা নত করে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনকারী হয়ে আরো বেশী আল্লাহর মুখাপেক্ষী হয়, তাঁরই কাছে পূর্ণ তাওয়াক্কুল রেখে প্রার্থনা করে সেটাই চান আমার আপনার রব। আবার বিনিময়েও উত্তম প্রতিফল দুনিয়াতেও দান করেন আর আখেরাতেও ইন শা আল্লাহ পাবে। এইভাবেই ঈমানের মানদণ্ডকে যাচাই করে নেন আল্লাহতায়ালা।
মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূল স. এর জীবনে ছোট বেলা থেকেই এমন কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন করেছিলেন, তা আমরা একটু উপলব্ধি করলেই আমাদের অন্তরে ধৈর্য্য ধরার উৎসাহ বাড়িয়ে দিবে। মহান আল্লাহ নবী স.কে ভালোবাসতেন তারপরও লক্ষ্য করুন, রাসূল স. জীবনে বাবাকে দেখেন নাই, মায়ের আদরে বড় হতেও পারলেন না, আর্থিক অবস্থার জন্য অল্প বয়সেই ব্যবসার কাজে নিয়োজিত হতে হলো। যে রাসূল মহান রবের প্রিয় বন্ধু তিনি মেষ পালক চড়িয়েছেন, তাহলে ভেবে দেখুন কত কঠিন বাস্তবতাকে সামাল দিয়ে আল্লাহর রাসূল স. মহান রবের পথে এগিয়ে গিয়েছেন! আমাদের জীবনে যে রকমই হোক, যতটুকুই হোক কঠিন অবস্থার অর্থ এই নয় যে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসেন না বা আমি খুব গুনাহগার ইত্যাদি।
ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সা.-এর খিদমতে উপস্থিত হলাম। সে সময় তিনি জ্বরে ভুগছিলেন। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার যে প্রচণ্ড জ্বর!’ তিনি বললেন, ‘‘হ্যাঁ! তোমাদের দু’জনের সমান আমার জ্বর আসে।’’ আমি বললাম, ‘তার জন্যই কি আপনার পুরস্কারও দ্বিগুণ?’ তিনি বললেন, ‘‘হ্যাঁ! ব্যাপার তা-ই। (অনুরূপ) যে কোন মুসলিমকে কোন কষ্ট পৌঁছে, কাঁটা লাগে অথবা তার চেয়েও কঠিন কষ্ট হয়, আল্লাহ তা‘আলা এর কারণে তার পাপসমূহকে মোচন করে দেন এবং তার পাপসমূহকে এভাবে ঝরিয়ে দেওয়া হয়; যেভাবে গাছ তার পাতা ঝরিয়ে দেয়।’’ সহীহ বুখারী ৫৬৪৮, ৫৬৪৭, মুসলিম ২৫৭১,
আবার দেখুন মহান আল্লাহ হযরত আইয়ূব আ.কে পরীক্ষা করেছিলেন এবং তিনি ধৈর্য্যের উচ্চতম স্তর দেখিয়েছিলেন। আমাদের জীবনে আমরা সুখ আরাম কত ভোগ করি আর সেই তুলনায় কতদিন অসুস্থ বা কষ্টের মাঝে থাকি একটু ভেবে দেখেছেন কি? আল্লাহ জানিয়েছেন-
আর স্মরণ করো আমার বান্দা আইয়ূবের কথা যখন সে তাঁর রবকে ডাকলো এই বলে যে, শয়তান আমাকে কঠিন যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সূরা সাদ:৪১
সম্ভবত হযরত আইয়ূব কোন কঠিন চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাইবেলও একথাই বলে যে, তাঁর সারা শরীর ফোঁড়ায় ভরে গিয়েছিল। এ রোগে আক্রান্ত হবার পর হযরত আইয়ূবের স্ত্রী ছাড়া আর সবাই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেছিল, এমন কি সন্তানরাও তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
রোগের প্রচণ্ডতা, ধন-সম্পদের বিনাশ এবং আত্মীয়-স্বজনদের মুখ ফিরিয়ে নেবার কারণে তিনি যে কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তার চেয়ে বড় কষ্ট ও যন্ত্রণা ছিল এই জন্য এই যে, শয়তান তার প্ররোচনার মাধ্যমে তাঁকে বিপদগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় শয়তান, আইয়ূব আ.কে মহান রব থেকে হতাশ করার চেষ্টা করে, মহান রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ করাতে চায় এবং তিনি যাতে অধৈর্য্য হয়ে উঠেন সে প্রচেষ্টায় রত থাকে। কিন্তু আইয়ূব আ. শয়তানের প্ররোচনার ফাঁদে পা দেন নি। তিনি নিজের শারিরীক কষ্টের কোন অভিযোগ করেন নি। অবৈধ বা শির্কের পথে পা বাড়াননি।
এখনও শয়তান আমাদের অনেকের জীবনের অসুস্থতা বা বিপদের সুযোগ নিয়ে শির্কের পথে (মাজার, অবৈধ পীর বা তাবিজ, শরীয়ত বিরোধী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে) সহজে নিয়ে যেতে প্রচেষ্টা চালায়। অনেক মুসলিম ভাই বোনেরা অজ্ঞতার কারনে বা অধৈর্যের বশবর্তী হয়ে শয়তানের ফাঁদে পা বাড়িয়ে ফেলেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।
আল্লাহ বলেছেন-
আর (এ একই বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও জ্ঞান) আমি আইয়ুবকে দিয়েছিলাম। স্মরণ করো, যখন সে তাঁর রবকে ডাকলো, “আমি রোগগ্রস্ত হয়ে গেছি এবং তুমি করুণাকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ করুণাকারী।”
আমি তাঁর দোয়া কবুল করেছিলাম, তাঁর যে কষ্ট ছিল তা দূর করে দিয়েছিলাম এবং শুধুমাত্র তাঁর পরিবার-পরিজনই তাঁকে দেইনি বরং এই সাথে এ পরিমাণ আরো দিয়েছিলাম, নিজের বিশেষ করুণা হিসেবে এবং এজন্য যে, এটা একটা শিক্ষা হবে ইবাদাতকারীদের জন্য। সূরা আম্বিয়া:৮৩-৮৪
রাসূল স.বলেছেন-মুসলমান কোনো যাতনা, রোগ কষ্ট, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, নির্যাতন ও শোকগ্রস্থ হলে, এমনকি তার দেহে কাঁটা বিদ্ধ হলেও এর বদলে আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহ মাফ করে দেন। সহিহ বুখারি:৫২৩০
রাসূল স.বলেছেন, আল্লাহর কোন বান্দা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন অথবা ভ্রমনরত অবস্থায় থাকে, তখন তার আমলনামায় সেই পরিমান নেকিই লেখা হয়, যে পরিমান আমল সে সুস্থ থাকাকালে করতো।
সহিহ আল বুখারী :২৭৭৮ ও আবুদাউদ:৩০৭৮
নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা রোগ বা ব্যাধি ও তার নিরাময় উভয়ই নাযিল করেছেন এবং প্রত্যেক রোগেরই ঔষধ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং তোমরা প্রয়োজনে ঔষধ ব্যবহার করো। কিন্তু অবৈ্ধ বা হারাম কোন বস্তু দ্বারা চিকিৎসা করো না। আবু দাউদ:৩৮৩০
রোগে কাতর হয়ে গালি দেয়া নিষেধ বা মৃত্যু কামনা করা নিষেধ। অসুখে সবর করার মাধ্যমেই একমাত্র সকল নিয়ামত পাওয়া যায়। গালি দেয়া মূলত এটা মহান রবের ফয়সালাকে গালি দেয়া বা অসন্তুষ্টি হওয়া।
রাসূল স. বলেছেন, জ্বরকে গালি দিও না, কেননা এটি পাপসমূহকে এমনভাবে দূর করে যেমনিভাবে আগুন লোহার মরিচা বা ময়লা পরিষ্কার করে দেয়। ইবনে মাজাহ:৩৪৬৯
রাসূল স. এইভাবে শিক্ষা দিয়েছেন, তোমাদের কেউ কষ্টের কারনে মৃত্যুর জন্য দোয়া করোনা, বরং একথা বলো,হে আল্লাহ! যতদিন আমার জীবিত থাকা কল্যানকর হয় ততদিন আমাকে জীবিত রাখুন এবং যখন আমার মৃত্যুবরন করা উত্তম হবে তখন আমাকে মৃত্যু দিন। সহিহ আল বুখারি:৫২৬০
মহান রবের কাছ থেকে মুমিনরা কখনোই নিরাশ হতে পারে না। আল্লাহ বলেছেন-
আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায়, ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না। সূরা ইউসুফ:৮৭
রাসূল স. বলেছেন—কোন ব্যক্তি যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন আল্লাহতায়ালা তার নিকট দু’জন ফেরেশতা পাঠিয়ে বলেন, দেখো হে ফেরেশতা! সে তার শুশ্রুষাকারীর সাথে কী কথাবার্তা বলছে। যদি সে অসুস্থ হবার কারনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের গুণকীর্তন করতে থাকে, তবে সে খবর ফেরেশতারা আল্লাহর নিকট নিয়ে যান। যদিও আল্লাহ স্বয়ং সবকিছু জানেন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা ঘোষনা করেন, আমি যদি তাকে মৃত্যুর সংগে আলিংগন করাই তবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। আর যদি তাকে রোগমুক্তি দেই তবে তার খারাপ গোশতকে উত্তম গোশত দ্বা্রা আর দূষিত রক্তকে উত্তম রক্ত দ্বা্রা পরিবর্তন করে দেবো এবং তার পাপরাশিকেও দূর করে দেবো। মুয়াত্তা ইমাম মালিক: ১৭৫০,৩৪৬৫
তাই যেকোন অবস্থায়ই মহান রবের দিকে ফিরে এসে, তাওবা করে আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে এবং আরো বেশী মহান আল্লাহর তাহমিদ তাসবিহ তাহলিল করে তাঁর পথে কাজ করার আশা রাখতে হবে।