যিলহজ্জ মাসের গুরুত্ব ও করণীয়-২

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ তা’আলার নামে

وَالْفَجْرِ ﴿1﴾ وَلَيَالٍ عَشْرٍ

“কসম ফজরের(ঊষার), কসম দশ রাতের…”    সূরা আল ফজর: ১-২

মহান আল্লাহ তা’য়ালা যখন কোন জিনিষের শপথ করেন তখন তার গুরুত্ব ও মর্যাদা বিশেষস্থান লাভ করে থাকে।

সূরা ফজরে উল্লেখিত দশ রাতের কথা বলতে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ রাতের কথা উল্লেখ করে বর্ণনা দিয়েছেন বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস রা., ইবনে যুবাইর রহ. ও মুজাহিদ রহ. সহ আরো অনেক মুফাসসীর। ইবনে কাসীর রহ. এই মতটিকে সঠিক বলেছেন।

সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল স. বলেছেন, যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করার মত প্রিয় আল্লাহর নিকট আর কোন আমল নেই। তারা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল স. আল্লাহর পথে জিহাদ করা কি তার চেয়েও প্রিয় নয়? রাসূল স. বললেন, না আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তির কথা আলাদা যে প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বের হয়ে গেলো অতঃপর তার প্রাণ ও সম্পদের কিছুই ফিরে এলো না।   সহিহ আল বুখারী: ২/৪৫৭

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, এই দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এই সময় তাহলীল(লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর(আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ(আলহামদুলিল্লাহ) বেশী করে পাঠ কর।   আহমাদ: ১৩২

তাহলে দেখা যাচ্ছে বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় যিলহজ্জের এই দশদিনের আমল উত্তম। এমনকি ইবনে কাসীর রহ. বর্ণনায় বলেছেন রামাদানের শেষ দশ দিনের চেয়েও উত্তম তবে রামাদানের শেষ দশ রাত অপেক্ষা নয় কেননা শেষ দশ রাতের মাঝে লাইলাতুল কদর রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।

তাই এই দশ দিনে উত্তম প্রতিফল পাওয়ার আশায় আমাদের সুন্নাহর আলোকে আমল করাটা বুদ্ধিমানের পরিচায়ক হবে।

যে কুরবানী করতে চায় সে কোন কাজ থেকে বিরত থাকবে?

যে ব্যক্তি যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার মাধ্যমে বা জিলকদ মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হওয়ার মাধ্যমে যিলহজ্জ মাসে প্রবেশ করল এবং কুরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করল তার জন্য কুরবানীর পশু জবাই করা পর্যন্ত নখ, চুল বা শরীর থেকে চামড়া উঠানো থেকে বিরত থাকবে।

উম্মু সালামাহ রা. বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করার ইচ্ছে করে সে যেন যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।

ইমাম মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।

তার অন্য একটি বর্ণনায় আছে, সে যেন চুল ও চামড়া থেকে কোন কিছু স্পর্শ না করে। অন্য বর্ণনায় আছে, কুরবানীর পশু যবেহ করার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকবে।

সহিহ মুসলিম: ১৯৭৭, মিশকাত: ১৪৫৯

যিলহজ্জের দশ দিন শুরু হওয়ার পর যদি নিয়ত করে তবে নিয়ত করার সময় থেকেই নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকবে। নিয়্যত করার আগে কেটে থাকলে তাতে গুনাহ হবে না।

এই দিনগুলোতে ফরয ওয়াজিব আমলগুলো আরো বেশী যত্ন ও গুরুত্বের সাথে আদায় করার জন্য সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন, বিশেষ করে সালাত কায়েমের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া। এই দিনগুলোতে অনুশোচনার সহিত তাওবা-ইস্তেগফার করে ভালো কাজে শরীক থাকার চেষ্টা করা এবং মহান আল্লাহর যিকির বা স্মরণ প্রতিটি কাজের সাথে করার সাথে সাথে আরো কিছু আমল করা প্রয়োজন যা নীচে উল্লেখ করা হলো।

১। সওম পালন করাঃ

ভালো আমলের মধ্যে অন্যতম হলো সওম এবং রাসূল স. উৎসাহিত করেছেন প্রথম দশ দিন ভালো কাজ করার জন্য, তাই প্রথম নয় দিন সওম রাখা সুন্নাত।

রাসূল স. প্রথম নয় দিন যিলহজ্জের সওম রেখেছেন। হুনাইদাহ ইবনে খালিদ তার স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল স. এর একজন স্ত্রী বলেছেন, রাসুল স. সাধারনত সওম রাখতেন যিলহজ্জের প্রথম নয় দিন, আশুরার দিন, প্রতি মাসের তিন দিন, মাসের প্রথম সোমবার এবং ২টি বৃহস্পতিবার।  আল নাসায়ী ৪/২০৫, আবু দাউদ ২/৪৬২, সহিহ আল আলবানী

হাদীসে কুদসীতে এসেছে,আদম সন্তানের প্রতিটি আমলই নিজের জন্য কিন্তু সওম শুধুমাত্র আমার জন্য এবং   আমিই এটার পুরস্কার দিবো। সহিহ আল বুখারী: ১৮০৫

সাহাবী আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে রাসূ্লুল্লাহ স., আমাকে এমন একটি আমল করার নির্দেশ দিন যা শুধু আমি আপনার নিকট থেকে পাওয়ার অধিকারী হব। রাসূল স. বলেন, তুমি সওম পালন করবে। আর এর কোন নজির নেই।  সহিহ সূনানে নাসায়ী: ২১০০

সওম যে একটি অতি মর্যাদাপূর্ণ ও আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় আমল তা এই হাদীস থেকে অনুধাবন করা যায়।

অনেকে শুধু মাত্র যিলহজ্জের ৭, ৮ ও ৯ তারিখ নির্দিষ্ট করে নেন সওম রাখার জন্য। এ ধরনের কোন নির্দেশনা আসে নাই। ১-৯ দিনই সওম রাখতে পারেন অথবা এর মাঝে যে কোন দিন সওম রাখতে পারেন। তবে আরাফার দিনের সওমের ব্যপারে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে হাদীসে।

রাসূল স. বলেছেন, আরাফার দিনের সওম আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহন করে থাকেন।   সহিহ মুসলিম: ১১৬৩

তবে যারা হজ্জ উপলক্ষ্যে আরাফার ময়দানে হাজ্জী হিসেবে উপস্থিত আছেন তাদের জন্য সওম রাখার কথা আসে নি।

যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ হলো আরাফার দিন।

ইমাম আহমদ ইকরামা থেকে বর্ণিত। আমি আবু হুরাইরা রা. এর সাথে তার বাড়িতে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞেস করি, আরাফার দিনে (৯ই যিলহজ্জ) আরাফার ময়দানে অবস্থানরত(হাজ্জ পালনে রত) ব্যক্তির সাওম পালনের বিধান কী? তিনি বলেন, রাসূল স. আরাফার দিনে আরাফার ময়দানে অবস্থানকারীকে সওম পালনে নিষেধ করেছেন। মুসনাদে আহমাদ: ২০৪/২

রাসূলে করীম স. আরাফাতের ময়দানে অবস্থানকালে পানাহার করেছেন। তার সাথে অবস্থানরত লোকজন তা দেখেছে। সহিহ মুসলিম: ১১২৩, ১১২৪

২। তাহমীদ, তাহলীল ও তাকবীর পড়াঃ

সকল মুসলিমের জন্য এটা একটি সুন্নাত আমল। পুরুষরা উচ্চস্বরে ও মহিলারা নিম্নস্বরে পাঠ করবে যখন যেখানেই থাকুক না কেন-বাসায়, রাস্তায়, মসজিদে যেখানেই আল্লাহর স্মরনের কথা এসেছে সব জায়গাতে।

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত এই দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এই সময় তাহলীল(লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই) তাকবীর(আল্লাহু আকবার-আল্লাহ বড়) ও তাহমীদ(আলহামদুলিল্লাহ-সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য) বেশী করে পাঠ কর। আহমাদ: ১৩২

…যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে যে সব চতুস্পদ পশু দান করেছেন, তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। সূরা আল হাজ্জ: ২৮

অধিকাংশ উলামাদের বর্ণনা এই নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে যিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিনের কথা বলা হয়েছে, কারণ সাহাবা ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা থেকে অনুরূপ জানা যায়।

আজ আমাদের সমাজে অধিকাংশ মুসলিম নর-নারী এই সুন্নাতকে অবহেলা করে যাচ্ছেন। আবার অনেকে এই সুন্নাত সম্পর্কে অবগতই নন।

রাসূল স.বলেছেন, আমার ইন্তেকালের পর যে সুন্নাতটির মৃত্যু হয়েছে তা যে জীবিত করবে সে ব্যক্তি এই সুন্নাত আমলকারীদের সওয়াবের পরিমান সওয়াব পাবে এবং তাতে আমলকারীদের সওয়াবের কোন অংশ কম হবে না। সহিহ তিরমিযী: ৭/৪৪৩

তাকবীর হলো- “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার,লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহীল হামদ”।

তাকবীর কখন ও কতদিন পড়তে হবে এ ব্যাপারে অনেকগুলো মত রয়েছে। সাধারণভাবে যা বুঝা যায় তা হলো যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ (আরাফার দিন ফজর থেকে) থেকে ১৩ই যিলহজ্জ পর্যন্ত যে কোন সময়ে তাকবীর পড়া যেতে পারে এবং বিশেষভাবে ফরয সালাতের পর(বিশেষ সময়ের তাকবীর) পড়া মুস্তাহাব।

৩। হজ্জ ও উমরাঃ

আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিস থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি হজ্ব আদায় করেন, কিন্তু কোন পাপের কথা বা কাজ করেননি সে ব্যক্তি ঐদিনের মত হয়ে ফিরে আসবে যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল। সহিহ বুখারী: ১৫২১ ও সহিহ মুসলিম ১৩৫০

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন: এক উমরা আরেক উমরার মাঝের গুনাহ মোচনকারী। আর মাবরুর হজ্বের প্রতিদান হচ্ছে- জান্নাত। সহিহ বুখারী: ১৭৭৩ ও সহিহ মুসলিম: ১৩৪৯

৪। ঈদের সালাত আদায় করাঃ

এই আমলটি সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই। অনেকে বলেছেন ওয়াজিব। ঈদ আল্লাহ তা’য়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ভালো কাজ ও শরীয়তের সীমার মাঝে আনন্দ করার দিন। ঈদের সালাতে অংশগ্রহন, খুতবা শুনা ও এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করা প্রতি মুসলিমের কর্তব্য।

আবু দাউদ সাহাবা আবু উমামা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল স.বলেছেন, আরাফার দিবস, কুরবানীর দিন ও আইয়ামে তাশরীক(কুরবানী পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলামের অনুসারীদের জন্য ঈদের দিন। আর এই দিনগুলো খাওয়া-দাওয়ার দিন। সহিহ সূনানে আবু দাউদ: ২১১৪

৫। কুরবানী করাঃ

মহান আল্লাহ বলেছেন, আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কুরবানী করুন।   সূরা আল কাউসার: ০২

সাহাবী ইবনে ওমর রা. বলেছেন, রাসুলে করীম স. দশ বছর মদীনায় ছিলেন, প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন। আহমাদ ও তিরমিযী

মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।

৬। আল্লাহর পথে দাওয়াত বেশী বেশী দেয়া ও যেকোন কল্যান মূলক কাজ করা যা মহান রবের সন্তুষ্টির জন্য হবে।