সম্মানিত মাস মুহাররম-৭ (আশুরার সাওমের ফযিলত)

আশুরার সাওমের ফযিলত

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাওম রাখার জন্য এত অধিক আগ্রহী হতে দেখিনি যত দেখেছি এই আশুরার দিন এবং এই মাস অর্থাৎ রামাদান মাসের সাওমের প্রতি। সহিহ আল বুখারি:১৮৬৭

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

আশুরার দিনের সাওমের ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। সহিহ মুসলিম:১৯৭৬

এটি আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর অপার করুণা। তিনি একটি মাত্র দিনের সাওমের মাধ্যমে পূর্ণ এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। সত্যই মহান আল্লাহ পরম দাতা।

বছরের কোন দিনটি আশুরার দিন-

আল্লামা নববি রহ. বলেন, তাসুআ, আশুরা দুটি মদ্দযুক্ত নাম। অভিধানের গ্রন্থাবলীতে এটিই প্রসিদ্ধ। আমাদের সাথীরা বলেছেন, আশুরা হচ্ছে মুহররম মাসের দশম দিন। আর তাসুআ সে মাসের নবম দিন। জমহুর ওলামারাও তা-ই বলেছেন। হাদিসের আপাতরূপ ও শব্দের প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক চাহিদাও তাই। ভাষাবিদদের নিকট এটিই প্রসিদ্ধ। আল-মজমূ

ইবনু কোদামাহ রহ. বলেন, আশুরা মুহররম মাসের দশম দিন। এটি সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব ও হাসান বসরি রহ.-এর মত। কারণ আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণনা করেন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরা-মুহররমের দশম দিনে সাওম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। জামে আত তিরমিযি,হাদিসটি হাসান সহিহ

 

আশুরার সাথে তাসুআর সাওম মুস্তাহাব-

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বর্ণনা করেন,

অর্থাৎ, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার সাওম রাখলেন এবং (অন্যদেরকে) সাওম রাখার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এটিতো এমন দিন, যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা বড় জ্ঞান করে, সম্মান জানায়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আগামী বছর এদিন আসলে, আমরা নবম দিনও সাওম রাখব ইনশাল্লাহ। বর্ণনাকারী বলছেন, আগামী বছর আসার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গিয়েছে।

সহিহ মুসলিম:১৯১৪৬

ইমাম শাফেয়ি ও তাঁর সাথীবৃন্দ, ইমাম আহমাদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ বলেছেন, আশুরার সাওমের ক্ষেত্রে দশম ও নবম উভয় দিনের সাওম মুস্তাহাব। কেননা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশ তারিখ সাওম রেখেছেন এবং নয় তারিখ সাওম রাখার নিয়ত করেছেন।

এরই উপর ভিত্তি করে বলা যায়, আশুরার সাওম কয়েকটি স্তর রয়েছে: সর্ব নিম্ন হচ্ছে কেবল দশ তারিখের সাওম রাখা। আর উচ্চ পর্যায় হচ্ছে তার সাথে নয় তারিখের সাওম রাখা। এমনিভাবে মুহররম মাসে সাওমের সংখ্যা যত বেশি হবে মর্যাদা ও ফযিলতও ততই বাড়তে থাকবে।

তাসুআর সাওম মুস্তাহাব হবার হিকমত–

মাম নববি রহ. বলেন, তাসুআ তথা মুহররমের নয় তারিখ সাওম মুস্তাহাব হবার হিকমত ও উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে প্রাজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন,

এক. এর উদ্দেশ্য হল, ইহুদিদের বিরোধিতা করা। কারণ তারা কেবল একটি অর্থাৎ দশ তারিখ সাওম রাখত।

দুই. আশুরার দিনে কেবলমাত্র একটি সাওম পালনের অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে তার সাথে অন্য একটি সাওমের মাধ্যমে সংযোগ সৃষ্টি করা। যেমনি করে এককভাবে জুমুআর দিন সাওম রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। এটি আল্লামা খাত্তাবি ও অন্যান্যদের মত।

তিন. দশ তারিখের সাওমের ক্ষেত্রে চন্দ্র গণনায় ত্রুটি হয়ে ভুলে পতিত হবার আশংকা থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে। হতে পারে গণনায় নয় তারিখ কিন্তু বাস্তবে তা দশ তারিখ।

এর মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী তাৎপর্য হচ্ছে, আহলে কিতাবের বিরোধিতা করা। শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু হাদিসে আহলে কিতাবদের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে নিষেধ করেছেন। যেমন আশুরা প্রসঙ্গে নবীজী স. বলেছেন,

আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই নয় তারিখ সাওম রাখব। আল-ফতোয়াল কোবরা, খন্ড:৬

আল্লামা ইবন হাজার রহ.

আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই নয় তারিখ সাওম রাখব। হাদিসের তালিকে বলেছেন,

নবীজীর নয় তারিখে সাওম রাখার সংকল্প ব্যক্ত করার উদ্দেশ্য কিন্তু এই নয় যে, তিনি কেবল নয় তারিখে সাওম রাখার সংকল্প করেছেন বরং তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে, দশ তারিখের সাওমের সাথে নয় তারিখের সাওম সংযুক্ত করা। সাবধানতা বশত: কিংবা ইহুদি খ্রিষ্টানদের বিরোধিতার জন্য। এটিই অগ্রাধিকার প্রাপ্ত মত।

সহিহ মুসলিমের কতিপয় বর্ণনা এদিকেই ইংগিত করে। ফাতহুল বারি:৪/২৪৫

শায়খুল ইসলাম বলেন, আশুরার সাওম এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা আর আশুরার একটিমাত্র সাওম মাকরূহ হবে না। আল-ফাতাওয়াল কোবরা: ৫ম খন্ড

কেবলমাত্র জুমুআর দিনকে নফল সাওমের জন্য নির্ধারণ করা মাকরূহ, অনুরূপভাবে ফরয সাওম ব্যতীত শনিবার সাওম রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে নিম্নের যে কোনো পদ্ধতির অনুকূলে রাখা হলে আর মাকরূহ হবে না। যেমন ঐ দুই দিনের সাথে মিলিয়ে আরো একদিন করে সাওম রাখা। দিনটি অনুমোদিত অভ্যাসের অনুকূলে পড়ে যাওয়া যেমন একদিন সাওম রাখা একদিন ইফতার করা। মান্নত কিংবা কাজার সাওম হওয়া। অথবা শরিয়ত সাওম রাখতে উৎসাহিত করেছে এমন তারিখে ঐ দিনদ্বয় পড়ে যাওয়া যেমন আরাফা কিংবা আশুরার দিন…।

তুহফাতুল মুহতাজ, ৩য় খন্ড, বাবু সওমিত তাতাব্বু, মুশকিলুল আছার, ২য় খন্ড, বাবু সওমি য়াওমিস সাবতি

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ফরয সাওম ব্যতীত তোমরা কেবল শনিবার সাওম রাখবে না। আহমাদ ও হাকেম

তাছাড়া শনিবারকে ইহুদিরা খুব সম্মান করে, অনেক বড় করে দেখে, তাই সেদিন সাওম রাখলে তাদের তাশাব্বুহ তথা সাদৃশ্যাবলম্বন হয়ে যাবে…। তবে শুক্র বা শনিবার যদি কোনো ব্যক্তির অনুস্মৃত অভ্যাসের আওতায় পড়ে যায় তাহলে আর মাকরূহ হবে না। যেমন এক ব্যক্তি নিয়মিত আরাফা ও আশুরার সাওম পালন করে আর সেই আরাফা কিংবা আশুরার দিন শনি কিংবা শুক্রবার দিন সংঘটিত হল তাহলে সে ব্যক্তির জন্য উক্ত শুক্র কিংবা শনিবার সাওম রাখা মাকরূহ হবে না। কেননা এসব ক্ষেত্রে অভ্যাসকে বিবেচনায় রাখা হয়…। কাশ্শাফুল কান্না, ২য় খন্ড, বাবু সওমিত তাতাব্বু

আশুরার সাওম কোন ধরনের পাপের জন্য কাফ্ফারা?

ইমাম নববি রহ. বলেন, আশুরার সাওম সকল সগিরা গুনাহের কাফ্ফারা। অর্থাৎ এ সাওমের কারণে মহান আল্লাহ কবিরা নয় বরং (পূর্ববর্তী একবছরের) যাবতীয় সগিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।

 

এর পর তিনি বলেন, আরাফার সাওম দুই বছরের (গুনাহের জন্য) কাফ্ফারা, আশুরার সাওম এক বছরের জন্য কাফ্ফারা, যার আমীন ফেরেশতাদের আমীনের সাথে মিলে যাবে তার পূর্ববর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে… হাদিসে বর্ণিত এসব গুনাহ মাফের অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তির আমলনামায় যদি সগিরা গুনাহ থেকে থাকে তাহলে এসব আমল তার গুনাহের কাফ্ফারা হবে অর্থাৎ আল্লাহ তার সগিরা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর যদি সগিরা-কবিরা কোনো গুনাহই না থাকে তাহলে এসব আমলের কারণে তাকে সাওয়াব দান করা হবে। আর আমলনামায় যদি শুধু কবিরা গুনাহ থাকে সগিরা নয় তাহলে আমরা আশা করতে পারি, এসব আমলের কারণে তার কবিরা গুনাহসমূহ হালকা করা হবে।

আল-মাজমূ শারহুল মুহাযযাব, ষষ্ঠ খন্ড, সওমু য়াওমি আরাফা

শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, পবিত্রতা অর্জন, সালাত, রামাদান, আরাফা ও আশুরার সাওম ইত্যাদি কেবল সগিরা গুনাহসমূহের কাফ্ফারা অর্থাৎ এসব আমলের কারণে কেবল সগিরা গুনাহ ক্ষমা করা হয়।

আল-ফাতাওয়াল কোবরা, ৫ম খন্ড

 

সাওমের সাওয়াব দেখে ভাবনার বিবিধ

আরাফা কিংবা আশুরার সাওমের উপর নির্ভর করে অনেক বিভ্রান্ত লোক ধোঁকায় পড়ে যায়। আত্ম প্রতারিত হয়। এমনকি অনেককে বলতে শোনা যায়, আশুরার সাওমের কারণে পূর্ণ এক বছরের পাপ ক্ষমা হয়ে গিয়েছে। বাকি থাকল আরাফার সাওম, তো সেটি সাওয়াবের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করবে।

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন, এ আত্ম প্রবঞ্চিত-বিভ্রান্ত লোকটি বুঝল না যে, রামাদানের সাওম ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, আরাফা ও আশুরার সাওমের চেয়ে বহু গুণে বড় ও অধিক সাওয়াব যোগ্য ইবাদত। আর এগুলো মধ্যবর্তী গুনাহসমূহের জন্য কাফ্ফারা তখনই হয় যদি কবিরা গুনাহসমূহ থেকে বেঁচে থাকা হয়। সুতরাং এক রামাদান থেকে পরবর্তী রামাদান এবং এক জুমুআ থেকে পরবর্তী জুমুআ, মধ্যবর্তী সময়ে কৃত পাপের জন্য কাফ্ফারা তখনই হবে যখন কবিরা গুনাহ ত্যাগ করা হবে। উভয়বিধ কার্য সম্পাদনের মাধ্যমেই কেবল সগিরা গুনাহ মাফ হবে।

আবার কিছু বিভ্রান্ত লোক আছে, যারা ধারণা করে, তাদের নেক আমল বদ আমল থেকে বেশি। কারণ তারা গুনাহের ভিত্তিতে নিজেদের হিসাব নেয় না। এবং পাপাচার গণনায় আনে না।

যদি কখনো কোনো নেক আমল সম্পাদন করে তখন কেবল তাই সংরক্ষণ করে। এরা সেসব লোকদের ন্যায় যারা মুখে মুখে ইস্তেগফার করে অথবা দিনে একশত বার তাসবিহ পাঠ করে অত:পর মুসলমানদের গীবত ও সম্মান বিনষ্টের কাজে লেগে যায়। সারা দিন আল্লাহর অসন্তুষ্টি মূলক কাজে অতিবাহিত করে। এসব লোক তাসবিহ তাহলিলের ফযিলত সম্বন্ধে খুব ফিকির করে। কিন্তু তার মাধ্যমে সংঘটিত অন্যায় ও পাপকর্মের প্রতি মোটেই দৃষ্টিপাত করে না। এটিতো কেবলই ধোঁকা ও আত্ম প্রতারণা। আল-মওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ, খন্ড ১৩, গুরুর

 প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে, রামাদানের পরপরই বিলম্ব না করে কাযা সম্পন্ন করে নেওয়া। যাতে কোনোরূপ সমস্যা ছাড়াই আরাফা ও আশুরার সাওম পালনের সুযোগ পাওয়া যায়। কেউ যদি আরাফা ও আশুরার সাওমে কাযা আদায়ের নিয়ত করে এবং এ নিয়ত রাত্র হতেই করে- তাহলে সেটি তার জন্য যথেষ্ট হবে। অর্থাৎ তার কাযা আদায় হয়ে যাবে। আল্লাহর করুণা অনেক বিশাল।