সম্মানিত মাস মুহাররম-৬ (ইতিহাসে আশুরা)

ইতিহাসে আশুরা

 

জালিম সাম্রাজ্য যত শক্তিশালী হোক না কেন, যত বর্বর ও পিশাচ হোক না কেন তার পতন হবেই। যদি আমরা সত্যিকারার্থে ঈমানদার হই ও জালেম সাম্রাজ্য ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ধৈর্যের সাথে অটল থাকতে পারি।

আর মুসা আ. ও তার অনুসারীরা মহরমের ১০ তারিখে তো ফেরআউনী সাম্রাজ্যেকে পরাজিত করেছিলেন আল্লাহর সাহায্যে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ

মুসা তার সম্প্রদায়কে বলল, ‘আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর এবং ধৈর্য ধারণ কর; এ পৃথিবীতো আল্লাহরই। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তার উত্তরাধিকারী করেন এবং শেষ ফলাফল তো মুত্তাকীদের পক্ষে। সূরা আরাফ : ১২৮

মহান আল্লাহর সাহায্য ও সত্যের বিজয়—

ফেরআউনের কবল থেকে মুসা আ. ও তার জাতির মুক্তি ছিল আল্লাহ তাআ’লার এক বড় নেয়ামত। আল কুর’আন থেকে জানা যায়-

আর (আল্লাহ বলেন): সেই সময়ের কথা স্মরণ করো যখন আমি ফেরাউনের লোকদের কবল থেকে তোমাদের মুক্তি দিয়েছিলাম, যারা তোমাদেরকে কঠোর শাস্তি দিতো, তোমাদের ছেলেদের হত্যা করতো এবং মেয়েদের জীবিত রাখতো। আর এর মধ্যে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য ছিল মহা পরীক্ষা। সূরা আল আরাফ:১৪১

যাও, তোমরা দুজন(মুসা আ. ও তাঁর ভাই হারুন আ.) ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে। তার সাথে কোমলভাবে কথা বলো, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে। সূরা ত্বাহা :৪৩-৪৪

যাও তার কাছে এবং বলো, আমরা তোমার রবের প্রেরিত, বনী ইসরাঈলকে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিয়ো না। আমরা তোমার কাছে নিয়ে এসেছি তোমার রবের নিদর্শন এবং শান্তি তার জন্য যে সঠিক পথ অনুসরণ করে। আমাদের অহীর সাহায্যে জানানো হয়েছে যে, শাস্তি তার জন্য যে মিথ্যা আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফেরাউন বললো, আচ্ছা, তাহলে তোমাদের দুজনের রব কে হে মূসা? মূসা জবাব দিল, আমাদের রব তিনি যিনি প্রত্যেক জিনিসকে তার আকৃতি দান করেছেন তারপর তাকে পথ নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা ত্বাহা:৪৭-৫০

আমি ফেরাউনকে আমার সমস্ত নিদর্শন দেখালাম কিন্তু সে মিথ্যা আরোপ করতে থাকলো এবং মেনে নিল না। সূরা ত্বাহা:৫৬

আর ফেরাউন বললো, হে সভাসদবর্গ! তো আমি নিজেকে ছাড়া তোমাদের আর কোন প্রভু আছে বলে জানি না। ওহে হামান! আমার জন্য ইট পুড়িয়ে একটি উঁচু প্রাসাদ তৈরি করো, হয়তো তাতে উঠে আমি মূসার প্রভুকে দেখতে পাবো, আমিতো তাঁকে মিথ্যুক মনে করি। সে এবং তার সৈন্যরা পৃথিবীতে কোন সত্য ছাড়াই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার করলো এবং মনে করলো তাদের কখনো আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। শেষে আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম।  এখন এ জালেমদের পরিণাম কি হয়েছে দেখে নাও। সূরা কাসাস:৩৮-৪০

দেখো, ফেরাউন যখন সে রসূলের কথা মানলো না তখন আমি তাকে কঠোরভাবে পাকড়াও করলাম। তোমরা যদি মানতে অস্বীকার করো তাহলে সেদিন কিভাবে রক্ষা পাবে যেদিনটি শিশুকে বৃদ্ধ বানিয়ে দেবে? যেদিনের কঠোরতায় আকাশ মণ্ডল বিদীর্ণ হয়ে যেতে থাকবে? আল্লাহর প্রতিশ্রুতি তো পূর্ণ হবেই। এ একটি উপদেশ বাণী। অতএব যে চায় সে তার প্রভুর পথ অবলম্বন করুক। সূরা মুযযাম্মীল:১৬-১৯

 শেষ পর্যন্ত ফেরাউন মূসা ও বনী ইস্রাঈলকে দুনিয়ার বুক থেকে উৎখাত করার সংকল্প করলো। কিন্তু আমি তাকে ও তার সঙ্গী-সাথীদেরকে এক সাথে ডুবিয়ে দিলাম। সূরা বনী ইসরাইল:১০৩

 

আমি মূসার কাছে অহী পাঠালাম যে, এবার রাতারাতি আমার বান্দাদের নিয়ে বের হয়ে পড়ো এবং তাদের জন্য সাগরের বুকে শুকনা সড়ক বানিয়ে নাও। কেউ তোমাদের পিছু নেয় কিনা সে ব্যাপারে একটুও ভয় করো না এবং (সাগরের মাঝখান দিয়ে পার হতে গিয়ে) শংকিত হয়ো না। পিছন থেকে ফেরাউন তার সেনাবাহিনী নিয়ে পৌঁছলো এবং তৎক্ষণাত সমুদ্র তাদের উপর ছেয়ে গেলো যেমন ছেয়ে যাওয়া সমীচীন ছিল। ফেরাউন তার জাতিকে পথভ্রষ্ট করেছিল, কোন সঠিক পথ দেখায়নি।

সূরা ত্বাহা:৭৭-৭৯

এ মুক্তির পর তিনি সাওম পালন করে আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করার প্রয়াস পেয়েছেন। কেননা নেক আমল হল আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায়ের বড় মাধ্যম।

যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ

“হে দাউদ পরিবার! শুকরিয়া হিসেবে তোমরা নেক আমল করতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই শুকরিয়া আদায়কারী রয়েছে।” সূরা সাবা: ১৩

শুকরিয়া আদায়ের অর্থ হল যে অনুগ্রহ করেছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

  • পাঁচটি বিষয়ের উপর আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায়ের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।

সে গুলো হলঃ

এক. নেয়ামত দাতা আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত হওয়া।

দুই. নেয়ামত দাতা আল্লাহকে মহব্বত করা।

তিন. নেয়ামতকে মনে প্রাণে গ্রহণ ও স্বীকার করা।

চার. মুখ দ্বারা নেয়ামত দাতা আল্লাহর প্রশংসা করা।

পাঁচ. নেয়ামতকে নেয়ামত দানকারী আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে ব্যবহার না করা বরং তাঁর সন্তুষ্টির পথে তা ব্যয় করা।

(মাদারেজুস সালেকীন)

 

আরবী আশারা অর্থ দশ।

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরার দিন সাওম পালন করছে। নবীজী বললেন, এটি কি? তারা বলল, এটি একটি ভাল দিন। এ দিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলকে তাদের দুশমনের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাই মুসা আ. সাওম পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ স.বললেন, মুসাকে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। অত:পর তিনি সাওম রেখেছেন এবং সাওম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

সহিহ আল বুখারি:১৮৬৫

মুসলিমের বর্ণনায় আছে,

এটি একটি মহান দিন, আল্লাহ তাআলা তাতে মুসা আ. ও তাঁর কওমকে রক্ষা করেছেন আর ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়কে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছেন। সহিহ মুসলিম

মুসা আ. সাওম পালন করেছেন। সহিহ বুখারি

ইমাম মুসলিম তার রেওয়ায়াতে সামান্য বাড়িয়ে বর্ণনা করেছেন,

আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় স্বরূপ তাই আমরাও সাওম পালন করি।

বুখারির অন্য রেওয়ায়াতে আছে, আর আমরা সাওম পালন করি তার সম্মানার্থে

আশুরার সাওম বহু সংখ্যক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।এর মধ্য থেকে কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশুরার সাওম পালন করত এবং রসূলুল্লাহ স. ও সাওম পালন করতেন। যখন তিনি মদীনায় হিজরত করলেন তখন তিনি এ সাওম পালন করলেন ও অন্যদের পালন করতে আদেশ দিলেন। যখন রামাদান মাসের সাওম ফরয হল তখন তিনি আশুরার সাওম সম্পর্কে বললেনঃ যার ইচ্ছা আশুরার সাওম পালন করবে, আর যার ইচ্ছা ছেড়ে দিবে। বুখারী ও মুসলিম

মহিলা সাহাবী রবী বিনতে মুয়াওয়াজ রা. থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন: রসূলুল্লাহ স.আশুরার দিনে ভোরে মদীনার নিকটবর্তী আনসারদের মহল্লায় খবর পাঠালেন যে, তোমাদের মধ্যে যে সাওম শুরু করেছে সে যেন তা পূর্ণ করে। আর যে সাওম শুরু না করে খাওয়া-দাওয়া করেছে সে যেন দিনের বাকী সময়টা পানাহার থেকে বিরত থাকে।

বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শোনার পর আমরা সাওম পালন করলাম এবং আল্লাহর ইচ্ছায় ছোট ছেলে-মেয়েদের দিয়ে সাওম পালন করালাম। আমরা তাদেরকে মসজিদে নিয়ে যেতাম। বাজার থেকে খেলনা কিনে নিতাম। যখন খাবার চাইত তখন হাতে খেলনা তুলে দিতাম, যেন তারা খাবারের কথা ভুলে গিয়ে সাওম পূর্ণ করতে পারে।’সহিহ মুসলিম

 মুয়াবিয়া রা. বলেন: আমি রসূলুল্লাহ স. কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন:”এটা হল আশুরার দিন। এর সাওম আল্লাহ তোমাদের উপর ফরয করেননি। কিন্তু আমি সাওম পালন করছি। তোমাদের যার কাছে ভাল লাগে সে যেন সাওম পালন করে। আর যার খেতে মনে চায় সে খাওয়া-দাওয়া করতে পারে।সহিহ বুখারী ও মুসলিম

এটি সেই দিন যাতে নূহ আ.-এর কিশতি জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল, তাই নূহ আ. আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ার্থে সেদিন সাওম রেখেছিলেন।ইমাম আহমাদ

বুখারির বর্ণনা, এবং সাওম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

আশুরার সাওম পূর্ব হতেই প্রসিদ্ধ ছিল এমনকি রাসূলুল্লাহর নবুওয়ত প্রাপ্তির পূর্বে জাহেলি যুগেও আরব সমাজে তার প্রচলন ছিল।

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, জাহেলি যুগের লোকেরা আশুরাতে সাওম রাখত।..

ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন,

কোরাইশরা আশুরার সাওম প্রসঙ্গে সম্ভবত বিগত শরিয়ত যেমন ইবরাহীম আ.-এর উপর নির্ভর করত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরাত করার পূর্বেই মক্কাতে আশুরার সাওম রাখতেন।

 হিজরতের পর দেখতে পেলেন মদিনার ইহুদিরা এদিনকে উদযাপন করছে। তিনি কারণ সম্বন্ধে তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা উপরোল্লেখিত উত্তর দিল। তখন নবীজী সাহাবাদেরকে ঈদ-উৎসব উদযাপন প্রসঙ্গে ইহুদিদের বিরোধিতা করার নির্দেশ দিলেন। যেমন আবু মুসা রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন,

অর্থাৎ, আশুরার দিনকে ইহুদিরা ঈদ হিসাবে গ্রহণ করেছিল।

মুসলিমের রেওয়ায়াতে এসেছে,

আশুরার দিনকে ইহুদিরা বড় করে দেখত (সম্মান করত), একে তারা ঈদ হিসাবে গ্রহণ করেছিল।

মুসলিমের অন্য বর্ণনায় এসেছে,

খায়বর অধিবাসীরা (ইহুদিরা) আশুরার দিনকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করেছিল। তারা এদিন নিজ স্ত্রীদেরকে নিজস্ব অলঙ্কারাদি ও ব্যাজ পরিধান করাত।

তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বললেন, তাহলে তোমরাও সাওম রাখ। সহিহ আল বুখারি

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদেরকে এদিনে রোজা রাখার নির্দেশ দানের আপাত কারণ হচ্ছে, ইহুদিদের বিরোধিতা করা। যেদিন তারা ঈদ উদযাপন করে ইফতার করবে সেদিন মুসলমানগণ সাওম রাখবে। কারণ ঈদের দিন সাওম রাখা হয় না। সার-সংক্ষেপ, ফাতহুল বারি শারহুল বুখারি, আল্লামা ইবন হাজার আসকালানি