সম্মানিত মাস মুহাররম-২ (হিজরি সন প্রবর্তনের কারন)

একনজরে মুহাররম মাসের ঘটনাবলী

 

১। এ মাসকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সম্মানিত ঘোষনা করেছেন এবং এই মাসের সাওম আল্লাহর কাছে প্রিয়।

২। ইসলামের ইতিহাসের ক্যালেন্ডার অর্থাৎ বছরের প্রথম মাস হিসেবে গননা শুরু। যা আমাদের রাসূল স. সহ মুমিন মুহাজিরদের ত্যাগ তিতিক্ষার কথা স্মরন করিয়ে দেয়। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য,প্রিয় রাসূল স.এর ভালোবাসায় উজ্জীবিত হয়ে নিজের প্রিয়জন,প্রিয় বাসস্থান,আত্মীয়-স্বজন ও জন্মভূমিকে ত্যাগ করে ঈমান রক্ষার্থে মুসলিমরা ও মহান আল্লাহর নির্দেশে প্রিয় নবী স. মদিনায় চলে এসেছিলেন যাকে হিজরত বলা হয়।

৩। এটি সেই দিন যাতে নূহ আ.-এর কিশতি জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল, তাই নূহ আ. আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ার্থে সেদিন সাওম রেখেছিলেন।

৪। অত্মাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে প্রিয় নবী মুসা আ. ও  বনী ইসরাইল জাতীকে রক্ষা করেছিলেন। মুসা আ. এই শাসক ফেরাউওনকে আল্লাহর আনুগত্যের দাওয়াত দিয়েছিলেন কিন্তু শাসক গোষ্ঠী সেই দাওয়াত গ্রহন না করে মুসা আ. ও তাঁর অনুসারীদের পাকড়াও করেছিল। মহান রবের অশেষ মেহেরবানীতে ফেরাউনের কবল থেকে মুসা আ. উদ্ধার পেয়েছিলেন। তাই মহান আল্লাহর শুকরিয়া হিসেবে মুসা আ. সাওম রেখেছিলেন।

৫। এইদিনেই হযরত ইমাম হুসাইন রা. ইসলামের ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা,তার প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তন যেন না আসে সেই, খিলাফাতের ধারা বজায় যেন থাকে,সেই জন্য সত্যের ধারক হয়ে কারবালায় শহীদ হয়েছিলেন।

 

হিজরি সন প্রবর্তনের  কারণ:

 

উমার রা. এর খেলাফত কালে যখন ইসলামী সনের প্রচলনের বিষয় আলোচনা হচ্ছিল তখন কোন এক ব্যক্তি প্রস্তাব করেছিলেন যে ইসলামী সন রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্ম দিন থেকে শুরু করা যেতে পারে। তখন এ প্রস্তাব প্রায় সকল সাহাবা এ বলে প্রত্যাখ্যান করলেন যে এটা খৃষ্টানদের নিয়ম-নীতির মধ্যে পড়ে। তারা তাদের নবীর জন্ম দিন থেকে সন গণনা করেছে। আমরা তা করবোনা। আমরা আমাদের নবীর হিজরত থেকে সন গণনা করবো। (উসূলুদ্দাওয়াহ)

হিজরি বৎসর ও তারিখ প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে চুক্তি ও সম্পাদন যোগ্য বিষয়াবলীর একটি থেকে অপরটিকে পৃথক করে সামঞ্জস্য বিধান।

 হযরত ওমর রা. তাঁর রাজত্বকালে যখন ইসলামি খেলাফতের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল, তাঁর নিকট বিভিন্ন স্টেট থেকে সময় তারিখ উল্লেখ বিহীন অনেক চিঠিপত্র আসতে লাগল, তখন প্রত্যেক চিঠিকে আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা এবং লেখার তারিখ ও সময় সম্পর্কে অবহিত হয়ে কাজে শৃঙ্খলা ও গত আনার জন্যে চিঠিতে তারিখ লাগানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। ওমর রা. সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করলেন সাহাবারা হিজরতের (রাসূল স. যে বছর মহান আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদীনায় চলে এসেছিলেন) বৎসরকে হিজরি তারিখের সূচনা করে নতুন গণনা শুরু করার পরামর্শ দিলেন এবং তৎকালীন বিদ্যমান থাকা মীলাদী (ঈসায়ী) তারিখকে বাদ দিয়ে হিজরতকে প্রথম ধরে হিজরি সনের প্রবর্তন করলেন। এর ফলে  যুক্তি ও লেখার সময় জানা থাকে এবং কাজ সুশৃঙ্খল ও গতিশীল হয়। এটিই ছিল হিজরি সন প্রবর্তনের মূল কারণ। হিজরি তারিখের প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও এ ছিল না যে, শুরু বর্ষকে লোকেরা এটি উপলক্ষ বানাবে। একে অপরকে অভিনন্দন জানাবে। বিভিন্ন উপায়ে উদযাপন করবে, উৎসব করবে, আলোচনা করবে।  এটিকে একটি উপলক্ষ বানিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসব উদযাপন করে বিদয়াতের রাস্তা ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে এর প্রবর্তন হয়নি।

(সুনান খ্যাত গবেষক শায়খ সালেহ আল ফাউযান।

এই হিজরতের মাধ্যমে মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় আসার মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ঘটেছে, ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে এবং দলে দলে মানুষ ইসলাম কবুল করেছে। আল কুর’আনে এসেছে,

যখন আল্লাহর সাহায্য এসে যায় এবং বিজয় লাভ হয়

আর (হে নবী!) তুমি (যদি) দেখ যে লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করছ্‌

 তখন তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও। অবশ্যি তিনি বড়ই তাওবা কবুলকারী। সূরা আন নসর

সাহাবাগন দলে দলে হিজরত করেছেন কিন্তু আল্লাহর রসূল স. অপেক্ষা করছিলেন আল্লাহর নির্দেশের। কারন মক্কায় তিনি অমানবিক যন্ত্রনা ও নির্যাতন ভোগ করেছেন। শুধু তিনিই নন,অসহায় দাসদাসি ও অন্যান্য সাহাবাগন যারাই ঈমান এনেছে তাদের উপর অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার করা হয়েছে।

যেদিন তিনি মক্কা ত্যাগ করছেন সেদিন তার হৃদয়ে এক মর্মপীড়ার কারন। সব স্মৃতিকে বিসর্জন দিয়ে চলে গিয়েছিলেন একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ পালন ও দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। সাহাবাদের অনেকে ধনাঢ্য ব্যাক্তি ছিলেন। তারা তাদের সমস্ত সম্পদ বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে উঁচু করার জন্য হিজরত করেছিলেন। এই হিজরতের মাধ্যমে তিনি নতুন একটি মুসলিম সমাজের গোড়াপত্তন করলেন। আজকের মক্কা ও মদিনার চিত্র দেখে কি আমাদের মনে আসে না এই স্থানগুলোতে আল্লাহর রাসুল স. ও সাহাবা রা. এর ত্যাগের কত ঘটনা মিশে আছে! সারা বিশ্বে আজানের সুমধুর ডাক শুনে কি মনে হয় না,কত পরিশ্রম,ত্যাগ তিতিক্ষার ফসল এই আজান!

সেজন্য যখনি আমাদের কাছে একটি বছর ফিরে আসে আমাদের স্মরন করা দরকার হিজরি সনের অতীত ইতিহাসকে। এটি আমাদের ঈমান ও আকীদার প্রান সঞ্চার করে। রসূল স. ও সাহবা কেরাম যে দ্বীনের জন্য পার্থিব সবকিছু ছেড়ে হিজরত করেছেন,আমরা কতটুকু দ্বীনের জন্য কুরবানি করছি সেটিই ভাবার বিষয়। আমাদের জীবনের সময়গুলো সমাজ ও মানুষের কল্যানে কতটুকু ব্যয় করছি তার পরিমাপ করার জন্য  আমাদের পর্যালোচনা দরকার। অতীত একটি বছর যদি আমাদের কর্মে থাকে কল্যান আর কল্যান তাহলে আমরা কামিয়াব হলাম। আর যদি না করা হয় তার জন্য অনুশোচনা ও আগামি বছর হায়াত পেলে সামনের দিনগুলো পুনর্বিবেচনা করার মাধ্যমে আমরা আমাদের তৈরি করতে পারি। আল্লাহর রসূল স. ও সাহাবকেরাম যতটুকু দ্বীনের খেদমত করেছেন তা উম্মতের কারো পক্ষেই করা সম্ভব নয়।তবে তাদের অনুসরন করে আমাদের সময়গুলোকে কাজে লাগানোর অংগীকার আমরা করতে পারি। সুন্দর সমাজ বিনির্মানের জন্য সবারই এগিয়ে আসা প্রয়োজন।