কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত ধারণা ঠিক নয়:
হোসাইন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুতে আকাশ থেকে রক্তের বৃষ্টি হওয়া, সেখানের কোন পাথর উঠালেই তার নীচ থেকে রক্ত প্রবাহিত হওয়া এবং কোন উট জবাই করলেই তা রক্তে পরিণত হয়ে যাওয়ার ধারণা মিথ্যা ও বানোয়াট। মুসলমানদের আবেক ও অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলে তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এ সমস্ত বানোয়াট ঘটনা বলা হয়ে থাকে। এগুলোর কোন সহীহ সনদ নেই।
ইমাম ইবনে কাসীর র. বলেন: হোসাইনের মৃত্যুর ঘটনায় লোকেরা উল্লেখ করে থাকে যে, সে দিন কোন পাথর উল্টালেই রক্ত বের হত, সে দিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, আকাশের দিগন্ত লাল হয়ে গিয়েছিল এবং আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হয়েছিল। এসব কথা সন্দেহ মূলক। প্রকৃত কথা হচ্ছে, এগুলো বিশেষ একটি গোষ্ঠীর বানোয়াট ও মিথ্যা কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা বিষয়টিকে বড় করার জন্য এগুলো রচনা করেছে।
কোন সন্দেহ নেই যে, কারবালার ময়দানে সপরিবারে হোসাইনের শাহাদাত বরণ একটি বিরাট ঘটনা। কিন্তু তারা এটিকে কেন্দ্র করে যে মিথ্যা রচনা করেছে, তার কোনটিই সংঘটিত হয় নি।
ইসলামের ইতিহাসে হোসাইনের মৃত্যুর চেয়ে অধিক ভয়াবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সে সমস্ত ঘটনায় উপরোক্ত বিষয়গুলোর কোনটিই সংঘটিত হয় নি।
হোসাইনের পিতা আলী রা. আব্দুর রাহমান মুলজিম খারেজীর হাতে নির্মম ভাবে নিহত হন। সকল আলেমের ঐকমতে হুসাইনের চেয়ে আলী রা. অধিক শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত ছিলেন। তার শাহাদাতের দিন কোন পাথর উল্টালেই রক্ত বের হয় নি, সে দিন সূর্যগ্রহণ হয় নি, আকাশের দিগন্ত লাল হয়ে যায় নি এবং আকাশ থেকে পাথরও বর্ষিত হওয়ারও কোন প্রমাণ নেই।
উসমান বিন আফফান রা.এর বাড়ি ঘেরাও করে বিদ্রোহীরা তাঁকে হত্যা করে। তিনি মজলুম অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে এসবের কোনটিই সংঘটিত হয় নি। উসমান রা.এর পূর্বে খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাব ফজরের নামাযে দাঁড়ানোর সময় নির্মমভাবে নিহত হন। এই ঘটনায় মুসলিমগণ এমন মুসীবতে পড়েছিলেন, যা ইতিপূর্বে কখনও পড়েন নি। তাতে উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা যায় নি।
আল্লাহর সর্বশেষ্ঠ বান্দা সমগ্র নবী-রাসূলের সরদার রাহমাতুল লিল আলামীন মৃত্যু বরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে এমন কিছু সংঘটিত হয় নি। যেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিশু পুত্র ইবরাহীম মৃত্যু বরণ করেন, সেদিন সূর্যগ্রহণ লেগেছিল। লোকেরা বলতে লাগল: ইবরাহীমের মৃত্যুতে আজ সূর্যগ্রহণ হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্যগ্রহণের নামায আদায় করলেন এবং খুতবা প্রদান করলেন। খুতবায় তিনি বর্ণনা করলেন যে, সূর্য এবং চন্দ্র কারও মৃত্যু বা জন্ম গ্রহণের কারণে আলোহীন হয় না। এগুলো আল্লাহর নিদর্শন। তিনি এগুলোর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদেরকে ভয় দেখিয়ে থাকেন।
ইমাম হোসাইনের রা. এর কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা
১। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, দেশের মালিক আল্লাহ,জনসাধারন আল্লাহর প্রজা এবং এই প্রজা পালনের ব্যাপারে রাষ্ট্রকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহী করতে হবে। রাষ্ট্র প্রধানদের কাজ হলো সর্বপ্রথম আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বে নিজেদের সঁপে দেয়া। এই কথা মুখে উচ্চারনের সাথে মনে প্রানে মেনে নেয়া ও কাজের মাধ্যমে তার প্রমান পেশ করা।
এই অবস্থার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে দেখেই ইমাম হোসাইন রা. ঈমানের দাবী পূরন করার লক্ষ্যে যা ইসলামের ইতিহাসকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করবে সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
২। ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো,আল্লাহর পৃথিবীতে তাঁরই পছন্দের সৎবৃত্তিগুলোর প্রতিষ্ঠা এবং প্রসার আর অসৎবৃত্তিগুলোর পথরোধ ও বিলুপ্ত সাধন।
কিন্তু এর বিপরীতে মানব রচিত রাজতন্ত্র দিয়ে মানুষের উপর মানুষের প্রভূত্ব, বিলাসী জীবন যাপন ইত্যাদিসহ ধাপে ধাপে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে শাসক গোষ্ঠীসহ সমাজের কিছু ব্যক্তিবর্গও।
৩। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রান শক্তি হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি।
কিন্তু ইমাম হোসাইন লক্ষ্য করলেন যে আভ্যন্তরিণ পরিবর্তণ শুরু হয়ে গিয়েছে এই রাজতন্ত্র দ্বারা। ইনসাফের পরিবর্তে জুলুম ও নিপীড়ন,আল্লাহভীতির পরিবর্তে উচ্ছৃংখলতা,চরিত্রহীনতা,গান বাজনা এবং বিলাসিতার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। মানুষের ঈমান ও বিবেককে জাগ্রত করার পরিবর্তে বখশিশের লোভ দেখিয়ে বেচা কেনা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
৪। ইসলামী শাসনতন্ত্রের বুনিয়াদী ধারাই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল।
- সাধারন মানুষের স্বাধীন মতামত এবং সাধারন মানুষের আনুগত্য নিয়েই কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন হবে।
- পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে এবং পরামর্শ করতে হবে ইলম, তাকওয়া এবং নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌছার মত বুদ্ধিবৃত্তির উপর, যাদের উপর সাধারন মানুষের আস্থা আছে।
- সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের প্রতিরোধ করা প্রত্যেক মুসলমানের অধিকার ও কর্তব্য,এর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে।
- শাসক গোষ্ঠী এবং তার রাষ্ট্রকে আল্লাহর এবং সাধারন মানুষের নিকট জবাবদিহী করতে হবে।
- বায়তুলমাল আল্লাহর সম্পত্তি এবং মুসলমানের আমানত। আল্লাহর নির্দেশিত পথ ছাড়া অন্য কোন পথে আয় বা ব্যয় করতে পারবে না।
- দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকবে,আল্লাহ ও রাসূলের স. আইন সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে।
- অধিকার ও মর্যাদার দিক দিয়ে পূর্ণ সাম্যের প্রতিষ্ঠা থাকবে। একজন অন্যজনের চাইতে শ্রেষ্ঠ হতেন শুধু চরিত্র,নৈতিক যোগ্যতা এবং জনসেবার কারনে।
ইমাম হোসাইন রা. বুঝতে পেরেছিলেন যে ধীরে ধীরে এইসব ধারা ইসলামী রাষ্ট্র থেকে বিলুপ্ত হতে থাকবে,তাই তিনি পেরেশান হয়েছিলেন। একজন মুমিনের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদী নীতিগুলোর সংরক্ষণ করার জন্য জান ও মালকে ব্যবহার করা।
আল্লাহর পথে জিহাদ করো যেমন জিহাদ করলে তার হক আদায় হয়। তিনি নিজের কাজের জন্য তোমাদেরকে বাছাই করে নিয়েছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোন সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও। আল্লাহ আগেও তোমাদের নাম রেখেছিলেন “মুসলিম” এবং এর (কুরআন) মধ্যেও (তোমাদের নাম এটিই) যাতে রসূল তোমাদের ওপর সাক্ষী হন এবং তোমরা সাক্ষী হও লোকদের ওপর। কাজেই নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাও। তিনি তোমাদের অভিভাবক, বড়ই ভালো অভিভাবক তিনি, বড়ই ভালো সাহায্যকারী তিনি। আল হাজ্জঃ ৭৮