যে সকল চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্য হকের পথে টিকে থাকতে পারে না, সাময়িকভাবে হকের পথে আসলেও পরবর্তীতে এই পথে টিকে থাকার ধৈর্য্য রাখতে পারে না। যেমন-
১। নিজ প্রবৃত্তি বা লালসার অনুসরন করে চলে।
মহান আল্লাহ বলেছেন, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হিদায়াত ছাড়াই নিছক নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তার চেয়ে বড় পথভ্রষ্ট আর কে হবে? আল্লাহ এ ধরনের জালেমদেরকে কখনো হিদায়াত দান করেন না।
সূরা কাসাস: ৫০
২। দুনিয়ার ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে মহান আল্লাহকে ভুলে যায়।
তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহ তাদের নিজেদেরকেই ভুলিয়ে দিয়েছেন। তারাই ফাসেক। সূরা আল হাশর:১৯
পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান হলো সে বান্দা বা দাস, স্বাধীন বা মুক্ত নয়। সে কেবল এক আল্লাহর বান্দা, তাঁর ছাড়া আর কারো বান্দা সে নয়। একথাটি যে ব্যক্তি জানে না প্রকৃতপক্ষে সে নিজেই নিজেকে জানে না। আর যে ব্যক্তি একথাটি জেনেও এক মুহূর্তের জন্যও তা ভুলে যায় সেই মুহূর্তে সে এমন কোন কাজ করে বসতে পারে যা কোন আল্লাহদ্রোহী বা মুশরিক অর্থাৎ আত্মবিস্মৃত মানুষই করতে পারে। সঠিক পথের ওপর মানুষের টিকে থাকা পুরোপুরি নির্ভর করে আল্লাহকে স্মরণ করার ওপর। আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে গাফেল হওয়া মাত্রই সে নিজের সম্পর্কেও গাফেল হয়ে যায় আর এই গাফলতিই তাকে ফাসেক বানিয়ে দেয়।
৩। দুনিয়ার তাৎক্ষনিক লাভবান হওয়াকে অগ্রাধীকার দিতে যেয়ে নাফরমানির কাজে জড়িয়ে পড়ে বা শরিয়তকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা।
মহান আল্লাহ বলেছেন, প্রকৃত ব্যাপার হলো, হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পরও যারা তা থেকে ফিরে গেল শয়তান তাদের জন্য এরূপ আচরণ সহজ বানিয়ে দিয়েছে এবং মিথ্যা আশাবাদকে দীর্ঘায়িত করে রেখেছেন। এ কারণেই তারা আল্লাহর নাযিলকৃত দ্বীনকে যারা পছন্দ করে না তাদের বলেছে, কিছু ব্যাপারে আমরা তোমাদের অনুসরণ করবো। আল্লাহ তাদের এ সলা-পরামর্শ ভাল করেই জানেন। সে সময় কী অবস্থা হবে যখন ফেরেশতারা তাদের রূহ কবজ করবে এবং তাদের মুখমণ্ডল ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে নিয়ে যাবে। এসব হওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা এমন পন্থার অনুসরণ করেছে যা আল্লাহর অসন্তুষ্টি উৎপাদন করে এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথ অনুসরণ করা পছন্দ করেনি। এ কারণে তিনি তাদের সব কাজ-কর্ম নষ্ট করে দিয়েছেন। সূরা মুহাম্মদ: ২৫-২৭
সেসব বাহ্যিক কাজ যা তারা মুসলমান সেজে করেছে। তাদের নামায, রোযা, যাকাত, মোটকথা সেসব ইবাদাত-বন্দেগী ও নেকীর কাজসমূহ যা বাহ্যিকভাবে নেকীর কাজ বলে গণ্য হতো। এসব নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে তারা মুসলমান হয়েও আল্লাহ, তার দ্বীন এবং ইসলামী মিল্লাতের সাথে আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার আচরণ করেনি বরং শুধু নিজের পার্থিব স্বার্থের জন্য মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের স. বিধানের তোয়াক্কা না করে বিজাতীয় অনুকরন করে বা যারা এই বিধানকে পছন্দ করে না তাদের মনতুষ্টিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। ফলে এই ব্যক্তি হকের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়।
৪। মুনাফেকী সদৃশ আচরন থাকা
আমাদের সমাজে এইশ্রেনীর লোকের সংখ্যাই বেশী-সেটা বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক।
শরীয়াতের লাভজনক কথাগুলোকে যে ব্যক্তি সানন্দে গ্রহণ করে নেয় কিন্তু আল্লাহর শরীয়াতে যা কিছু তার স্বার্থ ও আশা-আকাংখার বিরোধী হয় তাকে সে প্রত্যাখ্যান করে এবং তার মোকাবিলায় দুনিয়ার অন্যান্য আইনকে প্রাধান্য দেয়, সে মু’মিন নয় বরং মুনাফিক। তার ঈমানের দাবী মিথ্যা। কারণ সে আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ঈমান রাখে না বরং ঈমান রাখে নিজের স্বার্থ ও প্রবৃত্তির ওপর। এ নীতি অবলম্বন করে এর সাথে সাথে সে যদি আল্লাহর শরীয়াতের কোন অংশকে মেনেও নেয়, তাহলে আল্লাহর দৃষ্টিতে এ ধরনের মেনে নেয়ার কোন মূল্য ও মর্যাদা নেই। মহান আল্লাহ বলেছেন,
তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি এবং আমরা আনুগত্য স্বীকার করেছি কিন্তু এরপর তাদের মধ্য থেকে একটি দল (আনুগত্য থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের লোকেরা কখনোই মু’মিন নয়। যখন তাদেরকে ডাকা হয় আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে, যাতে রসূল তাদের পরস্পররে মোকদ্দমার ফায়সালা করে দেন তখন তাদের মধ্যকার একটি দল পাশ কাটিয়ে যায়। তবে যদি সত্য তাদের অনুকূল থাকে, তাহলে বড়ই বিনীত হয়ে রসূলের কাছে আসে। তাদের মনে কি (মুনাফিকীর) রোগ আছে? না তারা সন্দেহের শিকার হয়েছে? না তারা ভয় করছে আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদের প্রতি যুলুম করবেন? আসলে তারা নিজেরাই যালেম।
সূরা নূর:৪৭-৫০
আর যখন তারা মুমিনদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এবং যখন গোপনে তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে মিলিত হয়, তখন বলে, ‘নিশ্চয় আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা তো কেবল উপহাসকারী’। আল্লাহ তাদের প্রতি উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরার অবকাশ দেন। সূরা বাকারাহ: ১৪,১৫
মুনাফিকরা দ্বৈতনীতির হয়ে থাকে। তাদের বাহ্যিক এক রকম আবার ভিতর আরেক রকম। তারা যখন মুমিনদের সাথে মিলে তখন তারা যেন পাক্কা ঈমানদার, আবার যখন কাফেরদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা কাট্টা কাফের। তাদের এ দ্বি-মুখী নীতির কারণে তাদের কেউ বিশ্বাস করে না। সবার কাছেই তারা ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করে বলেন,
তারা এর মধ্যে দোদুল্যমান, না এদের দিকে আর না ওদের দিকে। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি কখনো তার জন্য কোন পথ পাবে না। সূরা নিসা: ১৪৩
মুনাফিকদের চরিত্র হল, তারা সব সময় পিছু হটে থাকে। তারা কোন ভালো কাজের পিছনে থাকে। সালাতে তারা সবার পিছনে আসে এবং পিছনের কাতারে দাঁড়ায়। রাসূল সা. এর তালীমের মজলিশে তারা পিছনে থাকে। আল্লাহর পথে বের হলে তারা মুমিনদের পিছনে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
আর তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছে, যে অবশ্যই বিলম্ব করবে। সুতরাং তোমাদের কোন বিপদ আপতিত হলে সে বলবে, ‘আল্লাহ আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, আমি তাদের সাথে উপস্থিত ছিলাম না’।
সূরা নিসা: ৭২
আর তাদেরকে যখন বলা হয় এস, আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা তাদের মাথা নাড়ে। আর তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে, অহঙ্কারবশত বিমুখ হয়ে চলে যেতে। (সূরা আল-মুনাফিকুন: ৫)
মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীরা একে অপরের অংশ, তারা মন্দ কাজের আদেশ দেয়, আর ভাল কাজ থেকে নিষেধ করে, তারা নিজদের হাতগুলোকে সঙ্কুচিত করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে তিনিও তাদেরকে ভুলে গিয়েছেন, নিশ্চয় মুনাফিকরা হচ্ছে ফাসিক। (সূরা তওবা: ৬৭) ফলে এরা হকের পথে স্থির থাকতে পারে না।
৫। মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের অভাব।
মহান আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহর প্রতি নির্ভর করো। কর্ম সম্পাদনের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। সূরা আহযাব: ০৩
মানুষ যখন নিশ্চিত ভাবে জানবে ও মানবে যে আল্লাহ যে পথে চলার নির্দেশনা দিয়েছেন তখন সেই পথে চলার মধ্যেই সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে তার পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া উচিত। এরপর তার মধ্যে কল্যাণ, সুবিধা ও প্রজ্ঞা খুঁজে বেড়ানো সেই ব্যক্তির নিজের কাজ নয় বরং কাজ হওয়া উচিত শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে তাঁর হুকুম পালন করা। বান্দা তার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেবে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি পথ দেখাবার জন্যও যথেষ্ট এবং সাহায্য করার জন্যও। আর তিনিই এ বিষয়ের নিশ্চয়তাও দেন যে, তাঁর পথনির্দেশের আলোকে কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তি কখনো অশুভ ফলাফলের সম্মুখীন হবে না। কিন্তু এই জিনিষের যখন অভাব হয় তখনই ব্যক্তি হকের পথে টিকে থাকার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
৬। আখেরাতের প্রাপ্তিকে দুনিয়ার প্রাপ্তির চেয়ে কম গুরুত্ব দেয়া
সমাজে এই চিন্তার অধিকারী লোকের সংখ্যাই বেশী, আর তাই সিরাতুল মুস্তাকীমের পথ থেকে সরে গিয়ে অন্য আদর্শের সাথে তাল মিলিয়ে চলাটা তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ বলেছেন,
যে কেউ আশু লাভের আকাঙ্ক্ষা করে, তাকে আমি এখানেই যা কিছু দিতে চাই দিয়ে দেই, তারপর তার ভাগে জাহান্নাম লিখে দেই, যার উত্তাপ সে ভুগবে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়ে। আর যে ব্যক্তি আখেরাতের প্রত্যাশী হয় এবং সেজন্য প্রচেষ্টা চালায়, যেমন সেজন্য প্রচেষ্টা চালানো উচিত এবং সে হয় মুমিন, এক্ষেত্রে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির প্রচেষ্টার যথোচিত মর্যাদা দেয়া হবে। এদেরকেও এবং ওদেরকেও, দু’দলকেই আমি (দুনিয়ায়) জীবন উপকরণ দিয়ে যাচ্ছি, এ হচ্ছে তোমার রবের দান এবং তোমার রবের দান রুখে দেবার কেউ নেই। সূরা বনী ইসরাইল:১৮-২০
যে ব্যক্তি আখেরাত বিশ্বাস করে না অথবা আখেরাত পর্যন্ত সবর করতে প্রস্তুত নয় এবং শুধুমাত্র দুনিয়া এবং দুনিয়াবী সাফল্য ও সমৃদ্ধিকেই নিজের যাবতীয় প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে, সে যা কিছু পাবে এ দুনিয়াতেই পাবে। আখেরাতে সে কিছুই পেতে পারে না। আর শুধু যে আখেরাতে সে সমৃদ্ধি লাভ করবে না, তা নয়। বরং দুনিয়ার বৈষয়িক স্বার্থপূজা ও আখেরাতে জবাবদিহির দায়িত্বের ব্যাপারে বেপরোয়া মনোভাব তার কর্মধারাকে মৌলিকভাবে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করবে, যার ফলে সে উল্টা জাহান্নামের অধিকারী হবে।
মহান আল্লাহ সুরা আসরে সময়ের কসম করে বলেছেন, ৪টি গুন যাদের মধ্যে নেই তারা ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত।
এই চারটি গুনের মাঝে প্রথম দুটি ব্যক্তি নিজের সাথে সংযুক্ত,বাকী দুটি গুন পরিবার,সমাজ অর্থাৎ পারস্পরিক লেনদেনের সাথে সংযুক্ত।
প্রথম দুটি হলো- ইমান ও আমল
আর শেষের দুটি হলো- হক কথার উপদেশ দেয়া ও ধৈর্য্য ধারনের উৎসাহ দেয়া।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজে এই ক্ষতি থেকে কারা হেফাজতে থাকতে পারবে ঘোষনা দিয়েছেন, এটা অনেক বড় ব্যাপার। দুনিয়া ও আখেরাতের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য অবশ্যই সেই ৪টি গুন আছে কিনা নিজেকে পরখ করে দেখা দরকার।
হক কথার কথা বলতে গেলেই কখনো কখনো মানসিকভাবে বা শারিরীকভাবে আঘাত আসতে পারে। সর্বাবস্থায় সবরের নীতি অবলম্বন করা ও অন্যকে বলা হলো চার নং গুন। রাসূল স. এর জীবন থেকেও আমরা তা দেখতে পাই।
এই চারটি গুন এতো জরুরী যে সাহাবা আযমাঈন রা.একজন আরেকজনের সাথে দেখা হলেই স্মরণ করিয়ে দিতেন।
হক কথা যারা শুনাবেন তাদের কিছু যোগ্যতা অন্তরে ধারন করা প্রয়োজন।
প্রথমেই আসবো হক কথা যারা শুনাবেন তাদের কিছু যোগ্যতা অন্তরে ধারন করা প্রয়োজন, বিশেষ করে পরিবারে বা আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যখন আমরা এই দায়িত্ব পালন করতে যাবো। দেখা যায় আমরা বেশীর ভাগ মানুষই পরিবারের বাইরে খুব সুন্দরভাবে হকের কথা বলতে পারলেও পরিবারে এতো সবর ও হিকমাকে কাজে লাগাই না।অনেকে বলেন আমার ছেলে বা মেয়েকে একটু বুঝিয়ে বলুন। অথচ পরিবারই হলো প্রথম ক্ষেত্র যেখান থেকে শুরু করতে হবে হকের কথা বলার। এখানেও অত্যন্ত সুন্দর মাপের ধৈর্য্যে্র প্রয়োজন। এর জন্য যা প্রয়োজন–
১। ইলম বা জ্ঞান—
সবাই আলেম হবে তা নয় কিন্তু একজন মুমিন হিসেবে দীনের অন্তত ততটুকু জ্ঞান থাকা প্রয়োজন যা দিয়ে নিজের তাকওয়া ও আমল আখলাক সুন্দর শরীয়ার মাঝে রাখতে পারবে এবং পরিবার গঠনেও যে জ্ঞান প্রয়োজন তা অর্জনের চেষ্টায় থাকা খুবই জরুরী।
তাদেরকে বলে দাও, “আমি তো অহীর ভিত্তিতে তোমাদেরকে জানাচ্ছি”-কিন্তু বধিররা ডাক শুনতে পায় না, যখন তাদেরকে সতর্ক করা হয়। সূরা আম্বিয়া: ৪৫
তাদেরকে পরিষ্কার বলে দাওঃ আমার পথতো এটাই, আমি আল্লাহর দিকে ডাকি, আমি নিজেও পূর্ণ আলোকে নিজের পথ দেখছি এবং আমার সাথীরাও। সূরা ইউসুফ: ১০৮
পরিবারের সদস্যরা যখন দেখবে যে, আপনি যা বলেন তা আপনার নিজস্ব বক্তব্য নয়,সেটা অহীর জ্ঞানের আলোকে এবং আপনি যদি নিজে সেই আমল করে থাকেন তাহলে পরিবারের সদস্যরা নিজেরা আমল না করতে পারলেও চুপ করে কথা শুনবে ও একসময় অন্তরে সেটা রেখাপাত করবে ইন শা আল্লাহ। এইভাবে একসময় তার একটা ভালো পরিনতি আল্লাহর ইচ্ছায় দেখতে পাবেন কিন্তু যদি এইভাবে দেখা যায় যা আল্লাহ বলেছেন- আর এই যে, তোমাদের জিহবা (আল্লাহ তায়ালার উপর) মিথ্যা আরোপ করে কখনো একথা বলো না এটি হালাল এবং ওটি হারাম, যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তারা কখনোই সফলকাম হবে না। দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগ মাত্র কয়েকদিনের এবং পরিশেষে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। সূরা আন নহল: ১১৬-১১৭
তাহলে সেই দাওয়াতী কথার প্রভাব থাকে না। আবার আমরা অন্যদের সাথে কথা বলতে যেয়ে অনেকে বিভিন্ন রুপায়নে উপস্থাপন করে থাকি যেন শ্রোতা আকৃষ্ট হোন,কিন্তু পরিবারের বেলায় কি আপনি ততটুকু করে থাকেন, আসলে হওয়া দরকার পরিবারে বা আপনজনের সাথে আরো বেশী মধূরতাপূর্ণভাবে বলা।
আপনি বাইরের লোকের বেলায় সময় ও ব্যক্তির অবস্থা, তার মর্যাদা লক্ষ্য করে কথা বলে থাকেন, কিন্তু পরিবারে ছোট বড় প্রত্যেকেরই একটা স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে, আপনি কি সেটা খেয়াল রাখেন! তার শারিরীক ও মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেছেন!। আমার অভিজ্ঞতায় বলবো আমাদের সমাজে মানসিক ও শারিরীক অবস্থার অনেকে খবরই রাখার সময় পান না বা জানার প্রয়োজনবোধ করেন না। তাহলে হঠাৎ করে একটা বাহ্যিক অবস্থা দেখেই চট করে মন্তব্য,শাসন বা হেদায়েতের কথা বলা কিভাবে কার্যকরী হবে? পরিবারের সদস্যদের সাথে স্বল্প হলেও কার্যকরী সান্নিধ্য দেয়া প্রয়োজন।তাদের অন্তরের চাওয়া পাওয়ার কিছু হলেও বুঝার চেষ্টা করুন,তারপর সেই অবস্থার আলোকে মানুষের কাছে প্রচার না করে মহান রবের কাছে দোয়া করুন এবং হিকমাত দিয়ে অহীর কথা জানান।অস্থির ও হতাশ না হয়ে ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে যান,এটাই পরিবারের হক,এটাই আখেরাতের জন্য বড় ইনভেষ্টমেন্ট। পরিবারের সদস্যরা আছেইতো থাকবেইতো,এইভেবে নজরের বাইরে রেখে চলা পরিবারের জন্য যেমন ভয়াবহ পরিনতি আনতে পারে তেমনি আপনি যতই বাইরের মানুষের প্রশংসা কুড়ান না কেন, পরিবারের হক বঞ্চিত করার দায়ে আটকে যাবেন।
আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দান করুন। মহান আল্লাহ হৃদয়কে জয় করার মূল সম্পর্কে জানিয়েছেন-
(হে নবী!) এটা আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ যে, তোমার ব্যবহার তাদের প্রতি বড়ই কোমল। নয়তো যদি তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্ত হতে, তাহলে তারা সবাই তোমার চার পাশ থেকে সরে যেতো। সূরা আলে ইমরান:১৫
২। ভালোবাসা, বন্ধুত্বপূর্ন, অগাধ বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা—
রাসূল সা. বলেন- দীন হলো মানুষের কল্যাণ কামনা। আমরা বললাম এটা কাদের জন্য? রাসূল বললেন, এটা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও সকল মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণের জন্য।”
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ দীনের সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করে।
পরিবারসহ বাইরের যাকেই আমরা হকের কথা বলতে চাই,সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই ব্যক্তির প্রতি আন্তরিকভাবে তার কল্যান কামনা করা, হৃদ্যতাপূর্ণ ভালোবাসার আচরন দিয়ে কথাগুলো উপস্থাপন করা। আর তাই ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক এমন হতে হবে যেন যাকে দাওয়াত দিবেন তার এই ব্যাপারে গভীর বিশ্বাস আসে যে আপনি আসলেই তার নিঃস্বার্থ কল্যানকামী। আর এই কাজটা পরিবারে অনেক সুন্দর চরিত্র, ত্যাগ,আচরনের মাধূর্যতা দিয়ে পরিবেশ তৈ্রী করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অবিচল ধৈর্য্য।
অল্পতেই রেগে,বকা ঝকা দিয়ে,অস্থির হওয়া যদি স্বভাব থাকে কারো,তাহলে সে পরিবারে কোন হকের কথা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। যার নিজের আচরন সুন্দর হয় না সে কিভাবে অন্যকে সুন্দর হতে সাহায্য করবে!
হে মুহাম্মাদ! যদি এরা এ শিক্ষার প্রতি ঈমান না আনে, তাহলে দুশ্চিন্তায় তুমি হয়তো এদের পেছনে নিজের প্রাণটি খোয়াবে।আসলে পৃথিবীতে এ যা কিছু সাজ-সরঞ্জামই আছে এগুলো দিয়ে আমি পৃথিবীর সৌন্দর্য বিধান করেছি তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্য থেকে কে ভাল কাজ করে। সবশেষে এসবকে আমি একটি বৃক্ষ-লতাহীন ময়দানে পরিণত করবো। সূরা কাহফ: ৬-৮
আমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবন হলো আদর্শ। রাসূল স. এতো ভালোবাসা ও কল্যানকামী ছিলেন যে মানুষ কে ন দীনের পথে আসেনা সেই কারনে তিনি মানসিক কষ্টে পড়ে যেতেন যা আল্লাহ বলেছেন।
তিনি নিজের জাতিকে নৈতিক অধঃপতন, ভ্রষ্টাচার ও বিভ্রান্তি থেকে বের করে আনতে চাচ্ছিলেন এবং তারা কোনক্রমেই এ পথে পা বাড়াবার উদ্যোগ নিচ্ছিল না। তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, এ ভ্রষ্টতার অনিবার্য ফল ধ্বংস ও আল্লাহর আযাব ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি তাদেরকে এ পরিণতি থেকে রক্ষা করার জন্য দিনরাত প্রাণান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তারা আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন হবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। নবী সা. নিজেই তাঁর এ মানসিক অবস্থাকে একটি হাদীসে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “আমার ও তোমাদের দৃষ্টান্ত এমন এক ব্যক্তির মতো যে আলোর জন্য আগুন জ্বালালো কিন্তু পতংগরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলো পুড়ে মরার জন্য। সে এদেরকে কোনক্রমে আগুন থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে কিন্তু এ পতংগরা তার কোন প্রচেষ্টাকেই ফলবতী করতে দেয় না। আমার অবস্থা অনুরূপ। আমি তোমাদের হাত ধরে টান দিচ্ছি কিন্তু তোমরা আগুনে লাফিয়ে পড়ছো।” বুখারী ও মুসলিম।
আত্মীয় প্রতিবেশীদের বেলায়ও আমাদের এই আন্তরিকভাবে তাদের কল্যান চাই এমন একটা বিশ্বাস, আচরন ও কাজ দিয়ে তৈরী করতে হবে।
অনেকে নিজের পরিবারের আত্মীয়ের ব্যাপারে আন্তরিকতা থাকলেও দেখা যায় শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয়ের ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখা যায় না, সবাই যদি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের দায়বদ্ধতাকে সামনে রাখতো তাহলে ব্যাক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে আন্তরিকতা রক্ষা করলেই, সেখানে হকের কথা বলা সহজ হয়ে উঠে।
মহান আল্লাহ মূসা আ.কে প্রতাপশালী ফেরাউনের কাছে হকের কথা বলার জন্য যাওয়ার ক্ষেত্রে বলেন–
যাও, তোমরা দু’জন ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে। তার সাথে কোমলভাবে কথা বলো, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে। সূরা ত্বাহা: ৪৩-৪৪
নবী সা. বলেছেন- যে বিষয়েই নম্রতা পাওয়া গেছে তা সে বিষয়কেই সুশোভিত করেছে, আবার যে বিষয়েই খানিকটা কঠোরতা পাওয়া গেছে তা সে বিষয়কেই অশোভিত করেছে- দৃষ্টিকটু করে ফেলেছে। মুসলিম: ২৫৯৪
নবী সা. আরও বলেছেন-নিশ্চয়ই আল্লাহ দয়াশীল, প্রত্যেকটি বিষয়েই নম্র ব্যবহার তিনি পছন্দ করেন, নম্রতাপূর্ণ ব্যবহারের ফলে তিনি যা দান করেন কঠোরতার কারণে তা দেন না।’’
বুখারী: ১২/২৮০, ফাতহুল বারী আলা শারহিল বুখারী, কিতাবুল ইসতিহাবাহ
আল্লাহর দয়ার অন্যতম প্রকাশ যে আপনি তাদের প্রতি বিনম্র-কোমল হৃদয় ছিলেন। যদি আপনি রূঢ় ও কঠোর চিত্ত হতেন তাহলে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সূরা আলে ইমরান : ১৫৯
একটি হাদিসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন,
কতিপয় ইহুদি নবী করিম সা. এর নিকট এসে বলল, আস-সামু আলাইকুম (আপনার উপর মরণ অভিশাপ)। আয়েশা রা. রাগন্বিত হয়ে বলেন, তোমাদের উপর মরণ, তোমাদেরকে আল্লাহ অভিশপ্ত করুন এবং তোমাদের উপর তার ক্রোধ অবতীর্ণ হোক। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আয়েশা শান্ত হও। তুমি অবশ্যই সর্বদা বিনম্রতা ও বন্ধুভাবাপন্নতা অবলম্বন করবে। আল্লাহ সকল বিষয়ে বিনম্রতা ও বন্ধুভাবাপন্নতা ভালবাসেন। আর খবরদার! কখনই তুমি উগ্রতা ও অভদ্রতার নিকটবর্তী হবে না। আয়েশা রা. বলেন, তারা কী বলেছে আপনি কি তা শুনেননি? তিনি বলেন, আমি কি বলেছি তা কি তুমি শোন নি? আমি বলেছি, ওয়ালাইকুম অর্থাৎ তোমাদের উপরে। (বুখারি মুসলিম)
৩। মন্দকে ভালো দিয়ে প্রতিহত করা
. আদেশ দানকারী বা নিষেধকারীকে অবশ্যই কষ্টে সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল হতে হবে। কেননা, এ কথা সত্য যে, এই দায়িত্ব যারা পালন করেন, তার উপর বিপদ আসবেই। এমন সময় যদি সে ধৈর্য ধারণই না করে, সহ্যই না করে, তাহলে সে যা ভাল করতে পারত তার চাইতে নষ্টই করে বসবে বেশি। যেমন- লুকমান হাকীম নিজ পুত্রকে উপদেশ দিতে যেয়ে বলেছিলেন:
এবং (হে বৎস)! সৎকাজ আদেশ দান কর এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ কর, (এ কাজ করতে যেয়ে) তোমার উপর যে বিপদ আপতিত হবে তাতে ধৈর্য অবলম্বন কর, নি:সন্দেহে সেটা একটি মহৎ কাজ।’’ (সূরা লুকমান:১৭)
মহান আল্লাহ বলেছেন,
সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হবে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, সৎ কাজ করলো এবং ঘোষণা করলো আমি মুসলমান। ভাল এবং মন্দ সমান হতে পারে না। (মন্দ ) প্রতিহত কর উৎকৃষ্টতর (আচারণ) দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। এ গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই যারা ধৈর্যশীল, এ গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই যারা মহা সৌভাগ্যবান। (সূরা ফুসসিলাত/হা মীম আস সাজদাহ: ৩৩-৩৫)
মহান আল্লাহ বলেছেন:
মন্দের মুকাবিলা কর যা উৎকৃষ্টতর তা দিয়ে, তারা যা বলে আমি সে সম্পর্কে বিশেষ অবহিত। (সূরা মুমিনুন : ৯৬)
বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মনে রাখতে হবে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে গালির পরিবর্তে গালি, নিন্দার প্রতিবাদে নিন্দা, রাগের প্রতিবাদে রাগ ইত্যাদি নিষিদ্ধ। এসব মন্দ আচরণের প্রতিরোধ করতে হবে উৎকৃষ্টতর আচরণ দিয়ে। অথচ আমরা অনেক সময় এই নির্দেশের বিপরীত কর্ম করি। অনেক সময় নেটে বিভিন্ন জন এতো নোংরা ভাষায় উত্তর দিয়ে থাকেন যা একজন মুমিনের জন্য অবাঞ্চনীয়। হতে পারে কেউ অন্যায়ভাবে বা ভুলটা গ্রহন করেই বা খারাপ কথা দিয়ে মন্তব্য করেছে, এই ব্যক্তিতো এইভাবে করতেই পারে কারন সেতো এখনো দীনের জ্ঞান লাভ করে নাই, কিন্তু যারা অল্প হলেও জ্ঞান চর্চায় আছেন এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমাদের নিজেদের উপর দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করতে চাই, সবরতো আমাদের নিতে হবে, হতে পারে আমাদের সুন্দর আচরন পেয়ে সেই মানুষটির মন পরিবর্তন হয়ে যাবে, আর তা না হলেও আপনি আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাবো ইন শা আল্লাহ। তাই সবরে কখনো লোকসান বা ক্ষতি নেই।
কেউ প্রতিবাদ করলে বা খারাপ আচরণ করলে আমরা তার আচরণের চেয়ে নিকৃষ্টতর আচরণের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করি!! এটা সম্ভব যদি আমরা এইভাবে অনুসরন করি-
হে মুহাম্মাদ! সবর অবলম্বন করো— আর তোমার এ সবর আল্লাহরই সুযোগ দানের ফলমাত্র— এদের কার্যকলাপে দুঃখ করো না এবং এদের চক্রান্তের কারণে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ো না। সূরা আন-নাহল: ১২৭
আবার আর এক স্থানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: আপনি ধৈর্য ধারণ করুন, কেননা আল্লাহ তা‘আলা নিষ্ঠাবানদের কর্মফল বিলীন অর্থাৎ- নষ্ট করেন না।’’ সূরা হূদ: ১১৫
সুতরাং শিক্ষা, নম্রতা ও ধৈর্য-এ তিনটি বিষয় ছাড়া কোন ক্রমেই চলবে না। আদেশ করা বা নিষেধ করার পূর্বেই জ্ঞানের দরকার এবং সে সঙ্গে নম্রতা, আর এটার পরেই প্রয়োজন ধৈর্যের। যদিও এ ত্রিবিধ বিষয়গুলোই সর্বাবস্থাতেই একই সাথে থাকা দরকার।
রাসূলুল্লাহ সা. অশালীন, অশ্লীল, অশোভনীয় কথা বলতেন না, গালি দিতেন না, কটুক্তি করতেন না। বুখারি, মুসলিম
স্ত্রী,স্বামী,সন্তান বাবা,মা প্রত্যেকের সাথে আচার আচরনে আমাদের সচেতন থাকা প্রয়োজন, অনেকে এভাবে বলেন যে, এমন কথা বলেছে, এটা কি সহ্য করার মতো? সে এইরকম না করলে- আমি এমন করতাম না ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, অপছন্দনীয় অবস্থায় যা মানা যায় না- সেই অবস্থানেই সবরের নীতি অবলম্বনে অভ্যস্থ হওয়ার কথা আসে। আর এই ধরনের অবস্থায় যদি উত্তমটা আমি না করতে পারলাম, তাহলে আর আমি কিভাবে ঈমানদার দাবী করি! রাসূলের স. উম্মত বলে দাবী করি! কিভাবে আশা করি পরিবারের অন্যরাও আমাকে উত্তমটা দিবেন!
পরিবার থেকে শুরু করে সবখানেই আমাদের চেষ্টা করতে হবে উত্তম ও শীতল মাথা দিয়ে পরিস্থিতি বুঝে হিকমাত অবলম্বন করা। রাসূল স. বলেছেন,
তোমাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী অবস্থানের অধিকারী হবে তারা যারা তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম আচরণের অধিকারী। আর তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত এবং কিয়ামতের দিন আমার থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করবে তারা যারা বেশি কথা বলে, যারা কথা বলে জিতে যেতে চায়, বাজে কথা বলে এবং যারা অহঙ্কার করে। (তিরমিজি, হাদিসটি হাসান।)
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা যা রাসূল স. দিয়েছেন-
নিজের মতটি হক হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বিতর্ক পরিত্যাগ করল আমি তার জন্য জান্নাতের পাদদেশে একটি বাড়ির জিম্মাদারী গ্রহণ করলাম। আর যে ব্যক্তি হাসি-মশকারার জন্যও মিথ্যা বলে না আমি তার জন্য জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বাড়ির জিম্মাদারী গ্রহণ করলাম। আর যার আচরণ-ব্যবহার সুন্দর আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে একটি বাড়ির জিম্মাদারী গ্রহণ করলাম। (আবু দাউদ, হাসান, সহীহুল জামে।)
আজ পরিবারগুলোতে স্বামী স্ত্রীর মাঝে, পিতা মাতা ও সন্তান, শশুর শাশুরী বউ জামাইএর মাঝে প্রায়ই যে ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয় সে ক্ষেত্রে যদি আমরা ইগো থেকে দূরে থেকে হাদীসের অনুসরন করি তাহলে পরিবারগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সহজ হয়ে যেতো এবং সম্পর্কও সুন্দর থাকতো।
আমর ইবনুল আস রা. বলেন:
রাসূলুল্লাহ সা. সমাজের নিকৃষ্টতম ব্যক্তির সাথেও পরিপূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার দিকে পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে কথা বলতেন। এভাবে তিনি তার হৃদয় জয় করে নিতেন। তিনি আমার সাথেও কথা বলতেন পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে এবং আমার দিকে পূর্ণরূপে মুখ ফিরিয়ে। এমনকি আমার মনে হতো যেন আমিই সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ। (তাবরানি, হাসান।)
এখানে উল্লেখ্য যে, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ এবং অহংকারহীন হৃদয় না হলে এগুণ পুরোপুরি অর্জন করা যায় না।উত্তম আচরণ শুধু দাওয়াতের সফলতার চাবিকাঠিই নয়, উপরন্তু আখেরাতের সফলতার সর্বোত্তম উপায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
কিয়ামতের দাড়িপাল্লায় উত্তম আচরণের চেয়ে বেশি ভারি কোনো আমল আর রাখা হবে না। আর উত্তম আচরণের অধিকারী ব্যক্তি এ আচরণের দ্বারাই তাহাজ্জুদ ও নফল রোযা পালনকারীর মর্যাদা অর্জন করবে।
(তিরমিজি, আহমদ, আবু দাউদ, হাদিসের সূত্র সহীহ, সহীহুল জামে।)
তবে কখনো কখনো একটু ভিন্ন পরিস্থিতিতে এইরকম আচরন হলো উত্তম যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল স. জানিয়েছেন—
রহমানের (আসল) বান্দা তারাই যারা পৃথিবীর বুকে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খরা তাদের সাথে কথা বলতে থাকলে বলে দেয়, তোমাদের সালাম। সূরা আল ফুরকান: ৬৩-৬৪
রহমানের বান্দাদের পদ্ধতি হচ্ছে, তারা গালির জবাবে গালি এবং দোষারোপের জবাবে দোষারোপ করে না। এভাবে প্রত্যেক বেহুদাপনার জবাবে তারাও সমানে বেহুদাপনা করে না। বরং যারাই তাদের সাথে এহেন আচরণ করে তাদের সালাম দিয়ে তারা অগ্রসর হয়ে যায়, যেমন কুরআনের অন্য জায়গায় বলা হয়েছেঃ
“আর যখন তারা কোন বেহুদা কথা শোনে, তা উপেক্ষা করে যায়। বলে, আরে ভাই, আমাদের কাজের ফল আমরা পাবো এবং তোমাদের কাজের ফল তোমরা পাবে। সালাম তোমাদের, আমরা জাহেলদের সাথে কথা বলি না।” (আল কাসাসঃ ৫৫)
মহান আল্লাহ বলেছেন: হে মুমিনগণ, তোমাদের উপরে শুধু তোমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তা হলে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করবে না।
(সূরা মায়েদা: ১০৫)
তাহলে মুমিনের দায়িত্ব হল নিজেদের হকের পথে বিচল থাকা। আর নিজের এই অবিচল হয়ে থাকার অংশ হলো দীনের প্রচার ও প্রসারের চেষ্টা। আমাদের আদেশ-নিষেধ সত্ত্বেও যদি কেউ বা সকলে বিপথগামী হয় তবে সেজন্য আমাদের কোনো পাপ হবে না বা আমাদেরকে আল্লাহর দরবারে দায়ী হতে হবে না। কাপড় যিনি নিজ হাতে ধুয়ে পরিষ্কার করেন,তাতে হাতই বেশী পরিষ্কার হয়।আর যত উন্নত জিনিষ দিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হয় হাতের অবস্থা তত সুন্দর থাকে। তাই অন্যকে হকে কথা বলা ও অন্যায় থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টার যে পরিশ্রম তা নিজের জন্যই কল্যান,এটা মনে করলেও অস্থিরতা থেকে দূরে থাকা যাবে।
অনেক নবী শত শত বছর দাওয়াত ও আদেশ-নিষেধ করেছেন, কিন্তু অল্প কয়েকজন ছাড়া কেউ সুপথপ্রাপ্ত হয়নি। এতে তাঁদের মর্যাদায় কোনো কমতি হবে না বা তাঁদের দায়িত্ব পালনে কোনো কমতি হয়নি। কাজেই মুমিন কখনোই ফলাফলের জন্য ব্যস্ত হবেন না। বরং নিজের দায়িত্ব কোরআন ও হাদিসের আলোকে পালিত হচ্ছে কিনা সেটাই বিবেচনা করবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
মুমিনের উচিত নয় নিজেকে অপমানিত করা। সাহাবিগণ বলেন, কিভাবে সে নিজেকে অপমানিত করবে? তিনি বলেন, নিজেকে এমন বিপদের মুখে ফেলবে যা সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।
(তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, আবু ইয়ালা, তাবরানী। সহীহ, মাজমাউল ফাওয়াইদ ৭/২৭২-২৭৫)
অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
তোমরা ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে থাক। অবশেষে যখন দেখবে যে, সর্বত্র মানুষ জাগতিক লোভলালসার দাস হয়ে গিয়েছে, প্রত্যেকেই নিজ প্রবৃত্তির মর্জিমাফিক চলছে, দুনিয়াবি স্বার্থ সর্বত্র প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে এবং প্রত্যেকেই তার নিজের মতকে সর্বোত্তম বলে বিশ্বাস করছে, তখন তুমি নিজের ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হবে এবং সাধারণ মানুষের বিষয় ছেড়ে দেবে। কারণ তোমাদের সামনে রয়েছে এমন কঠিন সময়, যখন ধৈর্য্য ধারন করাও আগুনের অঙ্গার মুঠি করে ধরার মত কষ্টদায়ক হবে। সে সময় যারা কর্ম করবে তারা তোমাদের মত যারা কর্ম করে তাদের ৫০ জনের সমান পুরুস্কার লাভ করবে। সাহাবিগণ বলেন, না, বরং তোমাদের মধ্যকার ৫০ জনের সাওয়াব না তাদের মধ্যকার ? তিনি বলেন, না, বরং তোমাদের মধ্যকার ৫০ জনের সমপরিমাণ সাওয়াব। ( তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, ইবনু হিব্বান, হাকিম। সহীহ।)
উপরের আয়াত ও হাদিসগুলির আলোকে আলিমগণ উল্লেখ করেছেন যে, মুমিন যদি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন যে, আদেশ-নিষেধ বা দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে গেলে জুলুম বা অপমানের শিকার হতে হবে, অথবা গৃহযুদ্ধ, পরস্পর হানাহানি ও চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে তার কথা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটাবে, তবে তিনি তা পরিত্যাগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে চারটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে:
প্রথমত, উপরের হাদিসে আমরা দেখেছি যে, মানুষের ভয়ে হক্ক কথা বলা পরিত্যাগ করলে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। এজন্য সামান্য ভয় বা অনিশ্চিত আশঙ্কার কারণে এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা ঠিক নয়।
দ্বিতীয়ত, যদি মুমিন ক্ষতি বা অপমান সম্পর্কে নিশ্চিত হন তাহলে তাকে অবশ্যই সে স্থান পরিত্যাগ করা উচিত। আমরা উপরে কয়েকটি হাদিসে দেখেছি যে, যেখানে অন্যায় সংঘটিত হয় সেখানে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলে মুমিনের দায়িত্ব হলো অবিলম্বে সেস্থান পরিত্যাগ করা, নইলে তাকেও অভিশাপ ও গজবের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
তৃতীয়ত, সম্ভব হলে, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও সমস্যার মধ্যেও সাধ্যমত এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারণ এ পরিস্থিতিতে ভীতি ও ক্ষতির মধ্যেও যারা ধৈর্য্য ধারণ করে সাহাবিদের মত দাওয়াত ও আদেশ নিষেধের কাজ করতে পারবেন তাঁদের একজন ৫০ জন সাহাবির সমান সাওয়াব ও পুরুস্কার পাবেন।
চতুর্থত, সর্বাবস্থায় অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা ও অন্যায় অপসারণের জন্য হৃদয়ের আকুতি মুমিনের জন্য ফরজে আইন। অন্যায়কে মেনে নওয়া, এমন তো হতেই পারে, বা ওদের কাজ ওরা করছে আমি কি করব, ইত্যাদি চিন্তা করে নির্বিকার থাকা বা অন্যায়ের প্রতি মনোকষ্ট অনুভব না করা ঈমান হারানোর লক্ষণ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার অবমাননা যে মুমিনকে পীড়া না দেয় তার ঈমানের দাবী অসার।
ধৈর্য অর্জনের অত্যন্ত বড় অবলম্বন হলো সালাত ও দোয়া।
কোরআনুল কারীমে একাধিক স্থানে ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে শক্তি অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ বলেন:
আমি তো জানি, তারা যা বলে তাতে তোমার অন্তর সংকুচিত হয়। সুতরাং তোমার প্রতিপলকের তাসবিহ-তাহমিদ বা প্রশংসাময় পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং সাজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং একিন (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর। সূরা হিজর : ৯৭-৯৯
আল্লাহর পথে ডাকতে গেলে বা সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধ করতে গেলে মানুষের বিরোধিতা, শত্রুতা ও নিন্দার কারণে কখনো ক্রোধে, কখনো বা বেদনায় অন্তর সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। এ মনোকষ্ট দূর করার প্রকৃত ধৈর্য ও মানুষিক স্থিতি অর্জন করার উপায় হলো বেশি বেশি আল্লাহর যিকির, ক্রন্দন ও প্রার্থনা করা। এভাবেই আমরা (Re-active)না হয়ে (Pro-active) হতে পারব। কারো আচরণের প্রতিক্রিয়া আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা আচরণ করতে পারব। আমরা সত্যিকার অর্থে মহা- সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারব। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।