সবর কেন?-২

 

আমাদের জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমভাবে এসে থাকে। অনেকেই আমরা বলে থাকি যে, গুনাহের কারনে এই বিপদ এসেছে।

আসলে এইভাবে শুধুমাত্র গুনাহের কারনে শাস্তি হিসেবে বিপদে পড়েছে মনে করার কোন অবকাশ নেই। আমাদের এই অবস্থাটা মনে করতে হবে যে, এটা মহান আল্লাহর অত্যন্ত দয়ার প্রকাশ। এই পরিস্থিতিতে মানুষ খুব বেশী আল্লাহর সাহায্য ও দয়া পেতে চায়, আর তাই মহান রবের সান্নিধ্যে  যেতে চায়। মহান আল্লাহর কাছে অনেক বেশী আশা নিয়ে হাত তুলে। অন্তরের ভিতর তখন শুধু নিজের গুনাহের জন্য অনুতপ্ততা, বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য মহান রবের দরবারে আকুতি, এমনকি তখন অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বিনয় ও কৃতজ্ঞ অন্তর দেখা যায়। এই সময় বিপদাপন্ন ব্যক্তি মহান রবের একত্ববাদ, এক সার্বভৌমত্বে্র ও একমাত্র প্রতিপালক, একমাত্র রিযিকদাতা এক কথায় তাওহীদের কাছে নিজেকে সমর্পন করার সুযোগ লাভ করে। মহান আল্লাহ বান্দার এই ফিরে আসাকে খুব পছন্দ করেন।

আপনারা বলবেন তাহলে কষ্ট ও কঠিন অবস্থা দিয়ে কেনো, আল্লাহতো ভালোবাসা দিয়ে ক্ষমা দিয়েই হেদায়েতের পথে নিতে পারেন? ভালোবাসা ও ক্ষমার প্রকাশেরই একটি ধরন পরীক্ষা।

ধরুন আপনার একটি অসুস্থতার জন্য ডাক্তারের কাছে গেলেন, ডাক্তার দেখলো আপনার পায়ের কিছু অংশ ঘাঁ হয়ে পঁচে গিয়েছে এবং আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে শরীরের অন্যান্য অংশে। তখন ডাক্তার আপনাকে পায়ের সেই অংশটুকুসহ একটু ভালো অংশ কেঁটে ফেলতে বললেন, তাতে আপনি বাকী শরীরের অংশ নিয়ে সুস্থ্য থাকতে পারবেন। তখনতো আপনি নিজেই সেই ভালো ও বেঁচে থাকার কথা চিন্তা করে অপারেশন করতে ডাক্তারকে অনুরোধ করবেন তাই না? আর ডাক্তারও তখন পঁচা অংশটুকুর জন্য  কষ্ট ও মায়া লাগলেও আপনার প্রতি ভালোবাসা ও সুস্থ্য শান্তির জন্য অপারেশনের উদ্যোগ নিবেন তাড়াতাড়ি। আর আপনি সারাজীবন ডাক্তারের কাছে ঐ পা সময়মতো  কেঁটে ফেলার জন্য কৃ্তজ্ঞতায় থাকলেন।

আমাদের জীবনের ঘাত প্রতিঘাতকে এইভাবে মনে করে, মহান রবের প্রতি আমাদের আরো বেশী  কৃ্তজ্ঞ হওয়া প্রয়োজন, কবরের জীবন ও পরকালের স্থায়ী জীবনের  সুখ ও শান্তিময় জীবনের জন্য!

দুনিয়াতে যে যেমন কাজ করবে, তার সেই কাজ কবরের জীবনে সেইরুপ নিয়ে হাযির হবে অর্থাৎ যদি কেউ খারাপ কাজ করে থাকে, তাহলে বিভৎস চেহারা নিয়ে এসে বলবে, আমি তোমার সেই আমল যা দুনিয়াতে করেছিলে এবং ভালো কাজ করলে সুন্দর চেহারা নিয়ে এসে বলবে আমি তোমার সেই আমল যা দুনিয়াতে করেছিলে।

কবরে যাওয়ার পরে যেন আমলের ভয়ঙ্কর চেহারা  না হয়, তাই এখনই সুন্দর করে নেই নিজেকে, নিজের আমল সুন্দর করার মাধ্যমে।।

আবূ হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দুঃখ-কষ্টে ফেলেন।’’( সহীহ বুখারী: ৫৬৪৫, মুওয়াত্তা মালেক: ১৭৫২)

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো বিপদে পড়ার কারণে যেন মরার আকাঙ্ক্ষা না করে। আর যদি করতেই হয়, তাহলে সে যেন বলে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে জীবিত রাখ; যে পর্যন্ত জীবিত থাকাটা আমার জন্য মঙ্গলময় হয়। আর আমাকে মরণ দাও; যদি মরণ আমার জন্য মঙ্গলময় হয়।’’ (সহীহ বুখারী ৫৬৭১, ৬৩৫১, ৭২৩৩, মুসলিম ২৬৮০)

যে কোন পরীক্ষা আসলে, মহান আল্লাহ দেখতে চান যে, তাঁর বান্দা সেই অবস্থায় কি করে

১-প্রথম প্রতিক্রিয়া কি হয়

২-প্রতিক্রিয়ার বাস্তব রুপ কি ধরনের ও কিভাবে সেটাকে রুপায়ন করছে

৩-এই অবস্থায় মহান আল্লাহর নৈকট্যে যাওয়ার আকাংক্ষা এসেছে কিনা

৪-আল্লাহর পক্ষ থেকে এটা দয়া বা রহমত মনে হয় কি না

তাহলে শরীরের যে অংশগুলো সবরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে  তা হলো- অন্তর > জিহবা > হাত/পা

সাধারনত কোন সমস্যার খবর শুনার সাথে সাথে এতো বেশী প্রতিক্রিয়া দেখায় মানুষ যে, তখন অনেকে বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং মুখে ও শরীরের অংগ প্রত্যংগ দিয়ে তার প্রকাশ করে থাকেন যা একজন মুমিনের চরিত্রে থাকার কথা না।

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী স. একটি মহিলার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। সে একটি কবরের পাশে বসে কাঁদছিল। তিনি বললেন, তুমি আল্লাহকে ভয় কর এবং ধৈর্য ধারণ কর।’’ সে বলল, ‘আপনি আমার নিকট হতে দূরে সরে যান। কারণ, আমি যে বিপদে পড়েছি আপনি তাতে পড়েননি।’ সে তাঁকে চিনতে পারেনি (তাই সে চরম শোকে তাঁকে অসঙ্গত কথা বলে ফেলল)। অতঃপর তাকে বলা হল যে, ‘তিনি নবী স. ছিলেন।’ সুতরাং (এ কথা শুনে) সে নবী স.-এর দুয়ারের কাছে এল। সেখানে সে দারোয়ানদেরকে পেল না। অতঃপর সে (সরাসরি প্রবেশ করে) বলল, ‘আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।’ তিনি স. বললেন, ‘‘আঘাতের শুরুতে সবর করাটাই হল প্রকৃত সবর।’’

(সহীহ বুখারী: ১২৫২/১২৮৩/, মুসলিম:৯২৬)

মুসলিমের একটি বর্ণনায় আছে, সে (মহিলাটি) তার মৃত শিশুর জন্য কাঁদছিল।

এই হাদীস থেকে বুঝা যায় সবরের কল্যান পেতে হলে প্রথমেই আমাদের আবেগ বা প্রতিক্রিয়া যা অন্তরে এসে থাকে তার নিয়ন্ত্রন করা। আসলে এই অবস্থা দিয়েও নিজের ঈমানের স্তর কতটুকু মাপা যায়।

অস্থিরতা হারানো বস্তু ফিরিয়ে আনতে পারে না, বরং তা হিতকামনাকারীকে দুঃখিত ও অশুভ কামনাকারীকে আনন্দিত করে।  মুসিবতের দুঃখের সাথে হতাশার নৈরাশ্য সংযোজন করা ঠিক নয় কারণ উভয়ের সঙ্গে ধৈর্যের সহাবস্থান হয় না। এমন বিপরীতধর্মী জিনিস অন্তরও গ্রহণ করে না। এ জন্য বলা হয়, “ধৈর্য্যের মুসিবত, সবচে’ বড় মুসিবত।”

সবরের জন্য যে অনুভূতি থাকা প্রয়োজন-

প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন কর্মের ক্ষেত্রে আমরা মহান আল্লাহর উপর ভরসা ও সাহায্য নিয়ে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার যে ঘোষনা দিয়ে থাকি বা প্রতি সালাতে বলে থাকি, ওয়াদা করি মহান আল্লাহর সাথে-সেইগুলো কি আমরা, অন্তরে পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে বলি কিনা তার বাস্তব নমুনা দেখার সুযোগ হয়ে যায়,  বিপদের কথা শুনার সাথে সাথে যে প্রতিক্রিয়া হয় সেই আবেগটি দিয়েই। মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন পরীক্ষায় পাশ হওয়ার জন্য যে অনুভূতি থাকার দরকার আর তা হলো-

“আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের উপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।” আল-বাকারা : ১৫৫-১৫৭

উম্মে ছালামা বর্ণনা করেন, আমি রসূল সা.কে বলতে শুনেছি :

“যে কোন মুসলমান মুসিবত আক্রান্ত হয় এবং বলে- আমরা আল্লাহর জন্য এবং তার কাছেই ফিরে যাব। হে আল্লাহ, তুমি আমার এ মুসিবতের প্রতিদান দাও এবং এর চেয়ে উত্তম জিনিস দান কর। আল্লাহ তাকে উত্তম জিনিস দান করেন।” মুসলিম : ১৫২৫

মুমিনের ব্যাপারটি চমৎকার, নেয়ামত অর্জিত হলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, যা তার জন্য মঙ্গলজনক এতে কৃতজ্ঞতার সওয়াব অর্জিত হয়। মুসিবতে পতিত হলে ধৈর্যধারণ করে, তাও তার জন্য কল্যাণকর এতে ধৈর্যের সওয়াব লাভ হয়।” মুসলিম : ৫৩১৮

সত্যিকার মুমিন আপন প্রভুর প্রতি সুধারণা পোষণ করে। হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আমার ব্যাপারে আমার বান্দার ধারণা অনুযায়ী, আমি ব্যবহার করি।”  বুখারী: ৬৭৫৬ মুসলিম: ৪৮২২

মুসিবত দৃশ্যত অসহ্য-কষ্টদায়ক হলেও পশ্চাতে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তাই বান্দার কর্তব্য আল্লাহর সুপ্রসস্ত রহমতের উপর আস্থাবান থাকা।

এরশাদ হচ্ছে :

“এবং হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।  সূরা আল বাকারা : ২১৬

“মুমিনের বিষয়টি চমৎকার, আল্লাহ তাআলা যা ফয়সালা করেন, তা-ই তার জন্য কল্যাণকর।” মুসনাদ : ২০২৮৩

মহান আল্লাহ আমাদের কত নিয়ামত দিয়ে রেখেছেন, তা আমরা একটু খেয়াল করে বুঝার দরজাটা খুলে যদি তাকিয়ে দেখি, তাহলেই ধরা পড়ে যাবে। মহান আল্লাহ আমদের নিয়ামত নামক সাগরে ছেড়ে দিয়েছেন যার কোন শেষ নেই। এই সাগরের নীচে ও উপরে দেখার জন্য আল্লাহ মাঝে মাঝে সুযোগ করে দেন যেন, নিজের অবস্থানে থেকে সন্তুষ্টি সহকারে দিন যাপন করতে পারি।

“অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শোকর আদায় করো, আমার সাথে কুফরী কোরো না।” (আল-বাকারা : ১৫২)

“হে মু’মিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযিক দিয়েছি তা থেকে আহার করো এবং আল্লাহ্‌র জন্য শোকর করো যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।” (সূরা বাকারা : ১৭২)

 “আর অবশ্যই আমি তো তোমাদেরকে যমীনে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতে তোমাদের জন্য রেখেছি জীবনোপকরণ। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো।” (সূরা আরাফ : ১০)

মু‘আয ইবনু জাবাল (রা) বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ্‌র রাসুল (সা) তার হাত ধরে বললেন ,

 “হে মু‘আয! আল্লাহ্‌র কসম, তোমাকে আমি ভালবাসি, আল্লাহ্‌র কসম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” তারপর তিনি বললেন, “হে মু‘আয! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, প্রত্যেক সালাতের শেষে তুমি বলতে ভুলে যাবে না : আল্লাহুম্মা আইন্নী আলা যিকরিকা ওয়া শুকরিকা ওয়া হুসনি ইবাদাতিকা অর্থাৎ হে আল্লাহ্‌! তোমাকে উত্তমরূপে স্মরণ করার, তোমার শুকরিয়া করার এবং তোমার ইবাদত করার জন্য আমাকে সাহায্য করো।”

(আবু দাউদ (১৫২২) এবং নাসা‘ঈ কর্তৃক সংকলিত; সহীহ আবি দাউদে আল-আলবানি হাদীসটি সহীহ বলে মত দিয়েছেন)

আল্লাহ্‌র নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন,

“আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।’ সূরা ইবরাহীম : ৭

মানুষ কীভাবে তার প্রতিপালকের দেওয়া নেয়ামতরাজির শুকরিয়া আদায় করবে? আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায়ের ক্ষেত্রে সবগুলো নির্ধারিত শর্তসমূহ পূর্ণ করা অপরিহার্য। যেমন :

১। অন্তরের শুকরিয়া, ২। জিহ্বার শুকরিয়া এবং ৩। অন্য সকল শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া।

ইবনুল কাইয়্যিম র. বলেন : “অন্তরের শুকরিয়া হলো আত্মসমর্পণ এবং বিনম্রতায়

জিহ্বার শুকরিয়া হলো প্রশংসা এবং স্বীকারোক্তিতে

আর শারীরিক ক্ষমতার শুকরিয়া হলো আনুগত্য এবং বশ্যতায়।”(মাদারিজ আল-সালিকীন (২/২৪৬))

ঈমানের মূলকথাই হলো আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করা যা তিনটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত :

 বান্দার প্রতি আল্লাহ্‌র সমস্ত নেয়ামতকে অন্তরে স্বীকার করা এবং সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা; আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করা; এবং এই শুকরিয়াকে কাজে লাগিয়ে একমাত্র আল্লাহ্‌র ইবাদত এবং আনুগত্য করা যিনি সমস্ত নেয়ামতের যোগানদাতা।”

(আল-কাওল আস্‌-সাদীদ ফী মাকাসিদুত তাওহীদ

যারা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না, তারা কোন ধরণের মানুষ, সে সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন :“তারা আল্লাহ্‌র নেয়ামত চেনে, তারপরও তা অস্বীকার করে, আর তাদের অধিকাংশই কাফির।”

(সূরা নাহল : ৮৩)

আল্লাহ তাআলা আমাদের যে সমস্ত নেয়ামত ও অনুদান দিয়ে ঢেকে রেখেছেন, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা, যাতে এ অনুভূতির উদয় হয় যে, বর্তমান মুসিবত বিদ্যমান নেয়ামতের তুলনায় বিন্দুমাত্র। আল্লাহ তাআলা চাইলে মুসিবত আরো বীভৎস-কঠোর হতে পারত। তদুপরি আল্লাহ তাআলা আরো যে সমস্ত বালা মুসিবত থেকে নিরাপদ রেখেছেন, যে সকল দুর্ঘটনা থেকে নাজাত দিয়েছেন, তা অনেক বড়, অনেক বেশী।

 মুহাম্মদ সা. পার্থিব জগতে মোমিনদের অবস্থার একটি উদাহরণ পেশ করেছেন। তিনি বলেন :

“একজন মোমিনের উদাহরণ একটি শস্যের মত, থেকে থেকে বাতাস তাকে দোলায়। তদ্রূপ একের পর এক মুসিবত অবিরাম অস্থির করে রাখে মোমিনকে। পক্ষান্তরে একজন মুনাফেকের উদাহরণ একটি দেবদারু বৃক্ষের ন্যায়, দুলে না, কাত হয়েও পড়ে না, যাবৎ-না শিকড় থেকে সমূলে উপড়ে ফেলা হয় তাকে।” সহিহ মুসলিম : ৫০২৪

শস্যের শিকড় মাটি আঁকড়ে ধরে। তার সাথে একাকার হয়ে যায়। যদিও বাতাস শস্যকে এদিক-সেদিক দোলায়মান রাখে। কিন্তু ছুঁড়ে মারতে, টুকরা করতে বা নীচে ফেলে দিতে পারে না। তদ্রুপ মুসিবত যদিও মোমিনকে ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত ও চিন্তামগ্ন রাখে, কিন্তু সে তাকে হতবিহ্বল, নিরাশ কিংবা পরাস্ত করতে পারে না। কারণ, আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস তাকে প্রেরণা দেয়, তার মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে, সর্বোপরি তাকে হেফাজত করে।

হাসান র. বলেন :”আমাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানীদেরও অভিজ্ঞতা, ধৈর্যের চেয়ে মূল্যবান বস্তু আর পায়নি। ধৈর্যের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা যায়, তবে তার সমাধান সে নিজেই।” অর্থাৎ প্রত্যেক জিনিসের জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন, আবার ধৈর্যের জন্যও ধৈর্য প্রয়োজন। হাদিসে এসেছে :

“ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও ব্যাপকতর কল্যাণ কাউকে প্রদান করা হয়নি।” বুখারী : ১৭৪৫

যে জ্ঞানীর মত ধৈর্যধারণ না করে, সে চতুষ্পদ জন্তুর মত যন্ত্রণা সহ্য করে।”

 হযরত আলী রা. বলেন :”যদি তুমি ধৈর্যধারণ করো, তাহলে তোমার ওপর তকদির বর্তাবে, তবে তুমি নেকি লাভ করবে। পক্ষান্তরে যদি ধৈর্যহারা হও, তাহলেও তোমার উপর তকদির বর্তাবে, তবে তুমি গুনাহ্‌গার হবে।” আদাবুদ দুনিয়া ওদ্দিন পৃ : ৪০৭

মহান আল্লাহ ভবিষ্যতদ্রষ্টা, তিনি সবই দেখেন ও জানেন। তিনি বলেছেন,

“যমীনে এবং তোমাদের নিজদের মধ্যে এমন কোন মুসীবত আপতিত হয় না, যা আমি সংঘটিত করার পূর্বে কিতাবে লিপিবদ্ধ রাখি না। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ। যাতে তোমরা আফসোস না কর তার উপর যা তোমাদের থেকে হারিয়ে গেছে এবং তোমরা উৎফুল্ল না হও তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার কারণে। আর আল্লাহ কোন উদ্ধত ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।” সূরা আল হাদীদ : ২২-২৩

মুসনাদে ইমাম আহমদ বর্ণিত-

“আল্লাহ তাআলা যখন কোন বান্দার মর্যাদার স্থান পূর্বে নির্ধারণ করে দেন, আর সে আমল দ্বারা ওই স্থান লাভে ব্যর্থ হয়, তখন আল্লাহ তার শরীর, সম্পদ বা সন্তানের ওপর মুসিবত দেন এবং ধৈর্যের তওফিক দেন। এর দ্বারা সে নির্ধারিত মর্যাদার উপযুক্ত হয়।” মুসনাদ : ২২৩৩৮