মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন সবরকারীদের প্রতিদান দুনিয়া ও আখেরাতে কি রেখে দিয়েছেন, তা জানা থাকলেও সবরের পথ অবলম্বন করা সহজ হয়ে আসে। মহান আল্লাহর উপর দৃঢ় আস্থা দিয়ে এই সবরপ্রাপ্তি সহজ হয়।
১। দুনিয়া ও আখেরাতে প্রতিদান বেহিসাব-
মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন- হে নবী সা. বলো, হে আমার সেসব বান্দা যারা ঈমান গ্রহণ করেছো তোমাদের রবকে ভয় করো। যারা এ পৃথিবীতে সদাচরণ গ্রহণ করেছে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ আর আল্লাহর পৃথিবী তো অনেক বড়। ধৈর্যশীলদেরকে তো অঢেল পুরস্কার দেয়া হবে। সূরা আয যুমার: ১০
২। আল্লাহর সাহায্য ও সমর্থন লাভ-
আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না, তাহলে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তির দিন শেষ হয়ে যাবে। সবরের পথ অবলম্বন করো, অবশ্যি আল্লাহ সবরকারীদের সাথে রয়েছেন। সূরা আনফাল: ৪৬
৩। দুনিয়াতেও লাভবান বা সফলতা আসে-
ইউসুফ আ. এর জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, কঠিন অবস্থার মুকাবিলায় সবরের প্রাপ্তি কত উন্নত। মহান রব জানিয়েছেন-
তারা চমকে উঠে বললো, “হায় তুমিই ইউসুফ নাকি?” সে বললো, “হ্যাঁ, আমি ইউসুফ এবং এই আমার সহোদর। আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আসলে কেউ যদি তাকওয়া ও সবর অবলম্বন করে তাহলে আল্লাহর কাছে এ ধরণের সৎলোকদের কর্মফল নষ্ট হয়ে যায় না। সূরা ইউসুফ: ৯০
৪। আখেরাতে প্রতিদান জান্নাত-
মহান আল্লাহ বলে দিয়েছেন, এবং তাদেরকে বলবেঃ “তোমাদের প্রতি শান্তি। তোমরা দুনিয়ায় যেভাবে সবর করে এসেছো তার বিনিময়ে আজ তোমরা এর অধিকারী হয়েছো। কাজেই কতই চমৎকার এ আখেরাতের গৃহ! সূরা আর রাদ: ২৪
আর তাদের সবরের বিনিময়ে তাদেরকে জান্নাত ও রেশমী পোশাক দান করবেন। সূরা আদ দাহর: ১২
তাদের অবস্থা হয় এই যে, নিজেদের রবের সন্তুষ্টির জন্য তারা সবর করে, নামায কায়েম করে, আমার দেয়া রিযিক থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করে এবং ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করে। আখেরাতের গৃহ হচ্ছে তাদের জন্যই। অর্থাৎ এমন সব বাগান যা হবে তাদের চিরস্থায়ী আবাস। সূরা আর রাদ: ২২
৫। আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা বা আল্লাহর ভালোবাসা লাভ-
আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি। এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন।
সূরা আলে ইমরান: ১৪৬
৬। শত্রুর অনিষ্ঠ থেকে হেফাজত লাভ-
তোমাদের ভালো হলে তাদের খারাপ লাগে এবং তোমাদের ওপর কোন বিপদ এলে তারা খুশী হয়। তোমরা যদি সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের কোন কৌশল কার্যকর হতে পারে না। তারা যা কিছু করছে আল্লাহ তা চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করে আছেন। সূরা আলে ইমরান: ১২০
৭। নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন-
আর যখন তারা সবর করে এবং আমার আয়াতের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় পোষণ করতে থাকে তখন তাদের মধ্যে এমন নেতা সৃষ্টি করে দেই যারা আমার হুকুম অনুসারে পথপ্রদর্শন করতো। সূরা আস সাজদাহ: ২৪
৮। মহান রবের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ,রহমত ও হেদায়াত লাভ–
আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানী হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সবর করে এবং যখনই কোন বিপদ আসে বলেঃ “আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে, — তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও। তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের ওপর বিপুল অনুগ্রহ বর্ষিত হবে, তাঁর রহমত তাদেরকে ছায়াদান করবে এবং এই ধরণের লোকরাই হয় সত্যানুসারী। সুরা আল বাকারা: ১৫৫-১৫৭
৯। আলোকিত ও শক্তিশালী করে-
সবর হলো আলো স্বরুপ।(ওয়াল সোয়াবরু দিয়াও)। সহিহ মুসলিম
এই হাদীসের শিক্ষা হলো সবরের এই আলো সূর্যের আলোর মত কারন কুর’আনে দিয়া বলতে সূর্যের আলোকে বুঝানো হয়েছে যা মানুষকে আলো দেয় ও তাপ দিয়ে শক্তি যোগায়।
১০। দৃঢ় সংকল্প গুন অর্জন—
হে পুত্র! নামায কায়েম করো, সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো এবং যা কিছু বিপদই আসুক সেজন্য সবর করো। নিঃসন্দেহে এটি হচ্ছে অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ। সূরা লুকমান: ১৭
১১। উচুঁ ধরনের সাহসীকতার গুন অর্জন—
(হে মুসলমানগণ!) তোমাদের অবশ্যি ধন ও প্রাণের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এবং তোমরা আহলি কিতাব ও মুশরিকদের থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি এমন অবস্থায় তোমরা সবর ও তাকওয়ার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো তাহলে তা হবে বিরাট সাহসিকতার পরিচায়ক। সূরা আলে ইমরান: ১৮৬
রাসূল স. বলেছেন—আল্লাহ তাআলা দয়া-মায়াকে একশত ভাগে বিভক্ত করে তার নিরান্নব্বই ভাগ নিজের কাছে রেখেছেন এবং একভাগ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এ এক ভাগের কারনেই প্রাণীকূল একে অপরের প্রতি দয়া-মায়া দেখায়। এমনকি ঘোড়া তার শাবকের ওপর থেকে পা তুলে নেয় তার কষ্ট পাওয়ার আশংকায়। সহীহ আল বুখারী
একজন মা সন্তানকে কত ভালবাসে কিন্তু এ হাদীস থেকে জানা যায় মহান আল্লাহ নিরান্নব্বই গুন বেশী ভালবাসেন। তাহলে বান্দার কষ্ট আল্লাহ কখনই চাইতে পারেন না। আমাদের জন্য যা কল্যান তা-ই তিনি করেন। এতো শিক্ষা ও সাবধানতা সবই তার ভালবাসার প্রকাশ। আমরা যেমন সন্তানকে তার ভালোর জন্য কত দিক-নির্দেশনা দিতে থাকি। মহান আল্লাহ আরো বেশী মহব্বত দিয়ে আমাদেরকে আল-কোর’আন ও হাদীসের আলোকে শিক্ষা দিয়েছেন।
আসলেই দুনিয়ায় মানুষের জীবন বড় বৈচিত্রময়। কেউ সন্তান নাই বলে অসন্তুষ্ট, আবার কেউ সন্তান বেশী হয় বলে অসন্তুষ্ট। আমাদের মনে রাখা দরকার–
আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন অথবা দান করেন পুত্র কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি বন্ধ্যা করে দেন। তিনিই সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। সূরা আশ-শূরা: ৪৯-৫০
আর আল্লাহই তোমাদের জন্য তোমাদের সমজাতীয় স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই এ স্ত্রীদের থেকে তোমাদের পুত্র-পৌত্রাদি দান করেছেন এবং ভালো ভালো জিনিস তোমাদের খেতে দিয়েছেন ৷ তারপর কি এরা (সবকিছু দেখার ও জানার পরও) বাতিলকে মেনে নেবে এবং আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করে ?
সূরা আন নহল: ৭২
আর যে ব্যক্তি কোন সৎকাজ করবে, সে পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন , তবে যদি সে মুমিন হয় , তাহলে এই ধরনের লোকেরাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের এক অণুপরিমাণ অধিকারও হরণ করা হবে না ৷
সেই ব্যক্তির চাইতে ভালো আর কার জীবনধারা হতে পারে , যে আল্লাহর সামনে আনুগত্যের শির নত করে দিয়েছে , সৎনীতি অবলম্বন করেছে এবং একনিষ্ট হয়ে ইবরাহীমের পদ্ধতি অনুসরণ করেছে ? সেই ইবরাহীমের পদ্ধতি যাকে আল্লাহ নিজের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছিলেন ৷ সূরা নিসা: ১২৪-১২৫
জীবনে সন্তান সম্পদ আছে কি নেই, সে জন্য হতাশায় মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য আল্লাহ আমাদের দুনিয়াতে পাঠান নাই, প্রত্যেকেই আমাদের যার যার কবর ও ফয়সালার দিকে যেতে হবে। সুতরাং মহান আল্লাহ যাকে যে কয়টা ফাইল( দায়িত্ব) দিয়েছেন সেগুলোর সঙ্গরক্ষন করে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে মানুষের অনুভূতিকে সম্মান দিয়েই মহান আল্লাহ সবরের বিনিময়ে শান্তি ও পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়েছেন। রসূল(সঃ) বলেছেন-
যখন কোন বান্দার সন্তান মারা যায় তখন আল্লাহ তাঁর
ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি আমার বান্দার সন্তানকে কেড়ে নিয়ে এলে ?
তারা বলে, হাঁ। আল্লাহ আবার জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি তার হৃদয়ের টুকরাকে কেড়ে নিয়ে
এলে ? তার বলে হাঁ। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, আমার বান্দা তখন কি বলেছে? তারা
বলে, সে আপনার প্রশংসা করেছে এবং ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন
পড়েছে। আল্লাহ বলেন, আমার এই বান্দার জন্য বেহেশতের মধ্যে একটি ঘর নির্মান কর
এবং তার নাম রাখ “ বাইতুল হামদ” বা প্রশংসালয়*। সহিহ জামে আত তিরমিযী
রসূল(সঃ) বলেছেন- আমার উম্মতের মধ্যে যার দু’টি মৃত সন্তান থাকবে, তাদের
বিনিময়ে আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। আইশা(রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,
আপনার উম্মতের মধ্যে যার একটি মৃত সন্তান থাকবে? তিনি বলেন-হে কল্যানকামিনী!
যার এরুপ একটি সন্তান থাকবে তাকেও। সহিহ জামে আত তিরমিযী
আরেকটি হাদীস থেকে জানা যায়- এটা শুধু তার জন্য যে প্রথম আঘাতে ধৈর্য ধারন করেছে।-তিরমিযী
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এমন সময় রাসূল স. আমাদের সামনে উপস্থিত হলেন,যখন আমরা তাকদীর নিয়ে তর্ক বিতর্ক করছিলাম। এতে তিনি ভীষন রেগে গেলেন, ক্রোধের আতিশয্যে তাঁর চেহারা মোবারক লাল হয়ে গেলো, মনে হচ্ছিল তাঁর কপোলদ্বয়ে ডালিম ভেংগে তার রস লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর তিনি বললেন, তোমরা কি এ বিষয়ে তর্ক বিতর্ক করার জন্য আদিষ্ট হয়েছ নাকি আমি এ মর্মে তোমাদের মাঝে প্রেরিত হয়েছি! তোমাদের পূর্ববর্তীরাতো তখনই ধ্বংস হয়েছিল, যখন তারা এ বিষয়ে তর্ক করেছিল। তোমাদের প্রতি আমার কঠোর নির্দেশ রইলো, তোমরা এ নিয়ে তর্ক করবে না।
সহিহ তিরমিযী:২১২৩ শায়খ আলবানী হাদীসটি হাসান বলেছেন।
তাই আমাদের তাকদীর নিয়ে চিন্তা না করে সময়, সুযোগ ও নিয়ামতকে ভালো কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে জান্নাতের পথে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়ে।