আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই কম বেশী বিপদ আপদ এসে থাকে, অনেকেই আমরা আফসোস করে বলে ফেলি, ইস! যদি আমি এটা করতাম তাহলে বিপদে পড়তাম না। সম্পদ নষ্ট, শস্য-ফসলের ক্ষতি, সড়ক দুর্ঘটনা কবলিত হলে অথবা অন্য যে কোন বিপদাপদ এলে চিন্তিত, রাগান্বিত ও বিরক্ত হয়ে অনেকেই বলে, যদি আমি এমন করতাম, তাহলে এমনটি হত না অথবা, আমি যদি এমন করতাম, তাহলে এমন হত! আমি যদি সফর না করতাম, তাহলে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতাম! এই কথাটা বলা অন্যায় কারন তাতে তাকদীরের প্রতি অপবাদ দেয়া হয়। হ্যা, একেকটি অবস্থা বা ঘটনা আমাদের জন্য অনেক শিক্ষাও নিয়ে আসে,অভিজ্ঞতাও এনে দেয়। সেটাকে বুদ্ধি,প্রজ্ঞা দিয়ে ভবিষ্যতে কাজে লাগানো যাবে কিন্তু যা হয়ে গিয়েছে বা এসেছে তা রোধ করার ছিল না।
মুসীবতে বান্দাকে ধৈর্য্যধারণ এবং তওবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহার করলে বান্দার আফসোস,অস্থিরতা এবং দুশ্চিন্তাই শুধু বাড়ে তাতে কোন সমস্যার সমাধান হয় না। তাছাড়া এতে তাক্বদীরের বিরোধিতার ফলে ঈমানের সাথে সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার ভয় রয়ে যায়।
আমরা কোন কিছু অর্জনের যথারীতি প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও যদি তা অর্জন করতে না পারি, তাহলে রাসূল সা. প্রদর্শিত নীতিমালা মেনে চলতে হবে। তিনি বলেছেন,
এমতাবস্থায় তোমাদের কেউ যেন না বলে, ‘আমি যদি এমন এমন করতাম’। বরং সে যেন বলে, এটিই আল্লাহ নির্ধারিত তাক্বদীর এবং তিনি যা চেয়েছেন, তা-ই হয়েছে। কেননা ‘যদি’ শয়তানের কাজের পথ খুলে দেয়’।
সহীহ মুসলিম:২৬৬৪
হাদীসটিতে স্পষ্ট ঘোষণা করা হল যে, কোন কিছু ঘটে যাওয়ার পরে ‘যদি’ কোন ফায়দা দেয় না। সুতরাং তাক্বদীরের উপর খুশী থাকতে হবে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এর প্রতিদানের প্রত্যাশী হতে হবে। সাথে সাথে ভবিষ্যতে আরো ভাল কিছু অর্জনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
আল কুর’আনে সেকারণেই আল্লাহ মুনাফিক্বদেরকে ভর্ৎসনা করে তাদের এ ধরণের বাক্য তুলে ধরে বলেন,
‘আমাদের যদি কিছু করার থাকত, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না’ সূরা আলে ইমরান: ১৫৪
‘তারা হলো ঐসব লোক, যারা (যুদ্ধে না যেয়ে) বসে থাকে এবং তাদের ভাইদের সম্বদ্ধে বলে, যদি তারা আমাদের কথা শুনত, তবে নিহত হত না’। আলে ইমরানঃ ১৬৮
আল্লাহ তাদের এ জাতীয় কথার জবাব দিয়েছেন এভাবে,
‘তাদেরকে বলে দিন, এবার তোমরা তোমাদের নিজেদের উপর থেকে মৃত্যুকে সরিয়ে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’ (আলে ইমরান ১৬৮)।
তবে বিপদাপদ ছাড়াই কল্যাণকর কোন কিছুর আশা করে ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহার করা যায়। যেমনঃ আল্লাহ যদি আমাকে ধন-সম্পদ দিতেন, তাহলে তাঁর পথে অনেক ব্যয় করতাম। গতকাল যদি আমি ক্লাসে যেতাম, তাহলে অনেক উপকৃত হতাম।
“ধৈর্য অসম্ভব বা অসাধ্য কিছু নয়, যে র্ধৈয্যধারণ করে আল্লাহ তাকে ধৈর্য্যধারণের ক্ষমতা দান করেন।” সহিহ বুখারী : ১৩৭৬
যার যেই কঠিন অবস্থা,তার প্রয়োজন তার থেকেও যে বেশী কষ্টের মাঝে আছে তাকে দেখে শুকরিয়া আদায় করা। কারো ভালো সেন্ডেল নেই সে তার দিকে তাকাবে যার একটি পা নেই। মাঝে মাঝে হাসপাতালে,বস্তিতে,ষ্টেশনে ভিজিট করা প্রয়োজন-তাহলে নিজেকে অনেক নিয়ামতের মাঝে অবস্থান দেখা যাবে। শুকরিয়ায় মাথা নত হয়ে যাবে মহান আল্লাহর দরবারে।
ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ইউসুফ আ.-কে হারিয়ে অনেক বছর যাবৎ পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে রাখেন। বৃদ্ধ ও দুর্বল হওয়ার পর আবার দ্বিতীয় সন্তান হারান। প্রথম সন্তান হারিয়ে বলেছিলেন :
“সুতরাং (আমার করণীয় হচ্ছে) সুন্দর ধৈর্য। আর তোমরা যা বর্ণনা করছ সে বিষয়ে আল্লাহই সাহায্যস্থল। সূরা ইউসুফ : ১৮
দ্বিতীয় সন্তান হারিয়ে বলেন :
“সে বলল, ‘বরং তোমাদের নাফ্স তোমাদের জন্য একটি গল্প সাজিয়েছে, সুতরাং (আমার করণীয় হচ্ছে) সুন্দর ধৈর্য। আশা করি, আল্লাহ তাদের সকলকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবেন, নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
সূরা ইউসুফ : ৮৩
ওলিদ ইবনে আব্দুল মালেক এর নিকট চোখ ঝলসানো, বিকৃত চেহারার একজন লোক এসে উপস্থিত হয়। তিনি তার অবস্থা আপাদ-মস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন। কিন্তু তার ভেতর অস্থিরতার কোনও আলামত পেলেন না। অতঃপর তার ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। সে বলল : “আমি অনেক সম্পদ, সন্তানের মালিক ছিলাম, একদা আমরা একটি ময়দানে রাত যাপন করি। অকস্মাৎ বিশাল এক মরুঝড় আমাদের আক্রমণ করে বসে। একটা উট, একজন সন্তান ছাড়া সব নিয়ে যায় সে। অবশেষে উটটিও পালিয়ে যেতে লাগল। সন্তানটি আমার কাছে, আমি সন্তান রেখে উট ধরতে গেলাম। সন্তানের কাছে ফিরে এসে দেখি, নেকড়ে বাঘ তার পেটে মাথা ঠুকে আছে, বাকি অংশ সাবাড়। তাকে রেখে উটের পিছু নেই, সে প্রচন্ড এক লাথি মারে, যদ্দরুণ আমার চেহারা বিকৃত হয়ে যায়, সাথে সাথে দৃষ্টিও চলে যায় চোখের। অবশেষে আমি সম্পদ, সন্তান এবং দৃষ্টি শক্তিহীন এ দুনিয়াতে নিঃসঙ্গ বেঁচে রইলাম। ওলিদ বললেন, তাকে উরওয়ার কাছে নিয়ে যাও; সে যাতে বুঝে, তার চেয়ে অধিক বিপদগ্রস্ত লোকও এ পৃথিবীতে বিদ্যমান আছে।