নিকাব/মুখ ঢাকা প্রসঙ্গে-৫

আল্লাহ তা’লা আরো বলেছেন:

হে নবী! তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মু’মিনদের নারীদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের চাদরের প্রান্ত তাদের ওপর টেনে নেয়। এটি অধিকতর উপযোগী পদ্ধতি, যাতে তাদেরকে চিনে নেয়া যায় এবং কষ্ট না দেয়া হয়। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়। সূরা আহযাব: ৫৯

আরবী ভাষায় ‘জিলবাব’ বলা হয় বড় চাদরকে। আর ‘ইদন’ শব্দের আসল মানে হচ্ছে নিকটবর্তী করা ও ঢেকে নেয়া। কিন্তু যখন তার সাথে ‘আলা’ অব্যয় (Preposition) বসে তখন তার মধ্যে ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়ার অর্থ সৃষ্টি হয়। একথা সুস্পষ্ট যে, এখানে ‘মিন’ শব্দটি ‘কিছু’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ চাদরের এক অংশ। আর এটাও সুস্পষ্ট যে, জড়িয়ে নিতে হলে পুরো চাদর জড়াতে হবে, নিছক তার একটা অংশ নয়। তাই আয়াতের পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, নারীরা যেন নিজেদের চাদর ভালোভাবে জড়িয়ে ঢেকে নিয়ে তার একটি অংশ বা একটি পাল্লা নিজেদের ওপর লটকিয়ে দেয়।

 

‘জিলবাব’ হলো সাধারন পরিধেয় পোশাকের উপর একটি অতিরিক্ত বড় চাদর যা নারীর যাবতীয় সৌন্দর্য ও পরিধেয় পোশাককে ঢেকে দিবে। শুধু চোখ খোলা থাকবে। চলাফেরা ও কাজের সুবিধার জন্য বোরখা জিলবাবের ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সেটাকে অবশ্যই পর্দার উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে হবে।

 

এখানে আরো সুস্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন যে আমাদের সমাজের অনেকে নারীর মুখ-মণ্ডলকে ঢেকে রাখা জরুরী নয় বলে থাকেন এবং বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা আপনাদের সামনে সতর ও পর্দার মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছি।

শরীরের পরিধেয় বস্ত্র দিয়ে গা ঢেকে মুখ খোলা রাখা হল সতর যা মাহরাম আত্মীয়ের সামনে যাওয়ার জন্য। এটা পূর্বে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু গায়রে মাহরাম ব্যক্তির সামনে প্রয়োজনে যেতে হলে সতরের উপর অতিরিক্ত কাপড় নিতে হবে যা নারীর মাথা থেকে পা পুরু আবৃত করে রাখবে; শুধু চোখ খোলা থাকবে।

সবসময়ের জন্য এই বিধান প্রযোজ্য বলেই ইহরামের সময় বিশেষভাবে মুখ খোলা রাখা ও হাত-মোজা না পরার কথা এসেছে। যেমন রাসূল সা: বলেছেন:

ইহরাম অবস্থায় মহিলা নিকাব বা মুখাবরন ব্যবহার করবে না এবং হাত মোজা পরিধান করবেনা। বুখারী: ১৭০৬

তাহলে ইহরাম অবস্থায় মুখ খোলা রাখা ওয়াজিব। ওয়াজিবের বিরোধী কেবল আরেকটি ওয়াজিব হতে পারে।

রাসূল সা: এর সময়েও নারীরা নিকাব (মুখ আবৃত করার জন্য যে কাপড়) ব্যবহার করতেন, উমরা বা হজ্জের সময় ইহরাম অবস্থাটি একটু ব্যতিক্রম; এসময় ইহরাম যেন নষ্ট না হয় সেজন্য নারী-পুরুষ নিজেদের অনেক সংযত রেখে শুধুমাত্র মহান আল্লাহ তা’য়ালার কাছে দোয়া করতে থাকেন, তার মধ্যে তখন শুধুই একটি চিন্তা-তার উমরা বা হজ্জ যেন আল্লাহ তায়ালা কবুল করে নেন। সেই অবস্থায় নারীর মুখের সৌন্দর্যের দিকে কোন পুরুষের কুনজর পড়ার সুযোগ থাকে না। অথবা কোন ধরনের বিশৃঙ্খল হওয়ার সুযোগ সাধারণত থাকে না। তারপরও হযরত আয়েশা(রা) বলেছেন,

আমরা রাসূল সা:এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম। এমতাবস্থায় আমাদের পাশ দিয়ে কাফেলাগুলি অতিক্রম করছিল। যখন তারা আমাদের পাশাপাশি এসে যেত তখন আমরা আমাদের জিলবাব বা চাদর মাথার উপর থেকে মুখের উপর নামিয়ে দিতাম। যখন তারা আমাদের অতিক্রম করে চলে যেত তখন আমরা আবার মুখ অনাবৃত করতাম। আবু দাউদ, আস-সুনান: ২/১৬৭

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন:

নারী আউরাত বা আবৃতব্য গুপ্তাংগ; কাজেই যখন সে বের হয় শয়তান তাকে অভ্যর্থনা করে। তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৪৭৬

এ হাদীসে নারীর পুরো দেহই আবৃতব্য, এ থেকে কোন অংগই বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। প্রয়োজনে চোখ খোলা রাখবে।

ইফক বা অপবাদের ঘটনার বর্ণনায় আয়েশা রা: বলেন,

“(কাফেলা চলে গিয়েছে দেখে আমি সেখানেই বসে থাকলাম…) বসে থাকতে থাকতে এক সময় চক্ষু ভারী হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সাফওয়ান ইবনুল মুয়াত্তাল সুলামী সেনাবাহিনীর পিছনে ছিলেন। তিনি আমার অবস্থানের নিকট এসে একজন নিদ্রিত মানুষের অবয়ব দেখতে পান। তিনি আমাকে দেখে চিনতে পারেন, কারণ পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার আগে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। আমাকে চিনতে পেরে তিনি ‘ইন্নালিল্লাহি’ – বলে উঠেন, এবং সেই শব্দে আমার ঘুম ভেংগে যায়। তখন আমার জিলবাব বা চাদর দিয়ে আমার মুখ আবৃত করি”। বুখারী: ১৭৭৫, মুসলিম

হাদীস থেকে জানা যায় রাসূল সা: বলেছেন:

এইক্ষেত্রে শুধুমাত্র যিনি বিয়ে করবেন (বাগদত্ত) তিনি শুধুমাত্র কনেকে দেখে নেয়ার কথা বলা আছে। এইক্ষেত্রে নারীর মুখমণ্ডলের সৌন্দর্যই দেখে থাকেন। চেহারাই হলো সৌন্দর্যের মূল। অন্যসব সৌন্দর্য চেহারার অনুগামী। তাহলে বিয়ের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্যসময় নারীর মুখ দেখা যাবে না। অথচ আমাদের সমাজে দেখা যায় বিয়ের জন্য কনে দেখতে গেলে ছেলের বাবা, মামা, বন্ধু এরাও কনেকে দেখে মতামত দেন যা সম্পূর্ণ শরিয়ত বিরোধী। কনেকে শুধুমাত্র বাগদত্ত ও নারীর আত্মীয়া দেখতে পারবেন।

আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

আর যেসব যৌবন অতিক্রান্ত মহিলা বিয়ের আশা রাখে না, তারা যদি নিজেদের চাদর নামিয়ে রেখে দেয়, তাহলে তাদের কোন গোনাহ নেই, তবে শর্ত হচ্ছে তারা সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী হবে না। তবু তারাও যদি লজ্জাশীলতা অবলম্বন করে তাহলে তা তাদের জন্য ভালো এবং আল্লাহ‌ সবকিছু শোনেন ও জানেন। সূরা আন-নুর: ৬০

এই আয়াতে বলা হয়েছে এমন সব মহিলাদের কথা, যাদের বয়স এমন পর্যায়ে গিয়েছে, যে তাদের আর সন্তান জন্ম দেবার যোগ্যতা নেই; যে বয়সে তার নিজের যৌন কামনা মৃত হয়ে যায় এবং তাকে দেখে পুরুষদের মধ্যেও কোন যৌন আবেগ সৃষ্টি হতে পারে না।

“নিজেদের কাপড় নামিয়ে রাখে” – কিন্তু এর অর্থ সমস্ত কাপড় নামিয়ে উলংগ হয়ে যাওয়া তো হতে পারে না। এমন চাদর যার সাহায্যে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখার হুকুম দেয়া হয়েছিল অর্থাৎ ঘোমটা যা দ্বারা মুখ-মন্ডল বা মাথা ঢেকে রেখেছিল সেটা খুলে রাখলে অপরাধ হবে না যদি তাদের উদ্দেশ্য সৌন্দর্য প্রদর্শন করা না হয়। সাজ-গোজের মাধ্যমে নিজেকে আকর্ষণীয়া করে তোলা যার বাসনা থাকবে না, যার মনে বিবাহের বা সংসার জীবনের কোন আগ্রহই থাকবেনা বা কারো মনে তাদেরকে দেখে এরকম বাসনা আসবে না, সে ধরনের বয়স্ক নারীদের ব্যপারে পর্দার শিথিলতা রয়েছে কিন্তু এর অন্যথায় বৃদ্ধার জন্যও শিথিলতা নেই। তাহলে বুঝতে হবে যুবতি, মধ্যবয়সী, অল্প বৃদ্ধা নারীর ক্ষেত্রে শিথিলতা নেই। আয়াতের শেষে বৃদ্ধা নারীদেরকেও পূর্ণ পর্দা পালনে উৎসাহ দিয়েছেন আল্লাহ তা’য়ালা।