প্রথমেই আমরা আপনাদের সামনে সতর ও হিজাবের সম্পর্ক তুলে ধরেছি।
১। সতরের বিষয়টি শুধু শরীর আবৃত করার সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু হিজাব বা পর্দা সম্পর্কিত থাকে নৈতিক, সামাজিক, শারীরিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের সাথে।
২। সতরের উদ্দেশ্য শরীর আবৃত করা কিন্তু হিজাবের উদ্দেশ্য সৌন্দর্য, আকর্ষণ ও সংস্পর্শকে আড়াল ও পৃথক করা।
৩। সতর রক্ষা করে চলতে হবে সবার সামনে। কিন্তু হিজাব পালনের ক্ষেত্রে মুহরিম ও গায়রে মুহরিমের মধ্যে পার্থক্য টেনে দেয়া হয়েছে।
৪। সতরের উপর আলাদা কাপড় (জিলবাব) নিয়েই হিজাব পালন করতে হবে- নারীর জন্য।
হিজাব কুরআনের একটি বিশেষ পরিভাষা। পর্দা শব্দটি ফার্সি এবং এটি বাংলায় বহুল প্রচলিত। পর্দা বা হিজাব আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক নৈতিকতা সম্পর্কিত বিধি বিধানগুলোর অন্যতম। হিজাবের আভিধানিক অর্থ প্রতিহত করা, ফিরিয়ে রাখা, আড়াল করা। পারিভাষিক অর্থ- সেই বিধি-ব্যবস্থা ও চেতনা যার মাধ্যমে ঘর থেকে শুরু করে পথ-প্রতিষ্ঠান-সমাবেশ সহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের নিজস্বতা সংরক্ষণ ও সম্মান বজায় রেখে উভয়ের মধ্যে অপ্রয়োজনীয়, নিয়ন্ত্রণহীন কথাবার্তা, দর্শন, দৃষ্টিবিনিময়, সৌন্দর্য প্রদর্শন ও সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ করা হয়। মহান আল্লাহকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্মরণের উদ্দেশ্যে নামাজ, রোজা, যাকাত ইত্যাদি ফরয ইবাদাত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। কিন্তু ঈমান রক্ষা ও হিজাব পালন নারী ও পুরুষের জন্য সার্বক্ষণিক ফরয ইবাদাত যার জন্য প্রতিটি মুহূর্তেই সতর্ক থাকতে হয়। একটি সমাজে নানা রকমের মানুষ বসবাস করে। ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ও নৈতিক জীবন যাপনের জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামকে সার্বজনীন জীবন বিধান হিসাবে অনুসরণযোগ্য করে পাঠিয়েছেন যা প্রতি যুগের জন্য উপযোগী। একমাত্র মহান আল্লাহই ভবিষ্যতকেও জানেন, মানুষকে যে জ্ঞান মেধা দিয়েছেন সেটাকে কাজে লাগিয়ে সে কতদূর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করবে তাও জানেন। মহান আল্লাহই কিয়ামত পর্যন্ত হিজাবের বিধান দিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন:
নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্টিত হয়েছেন। তিনি পরিয়ে দেন রাতের উপর দিনকে এমতাবস্থায় যে, দিন দৌঁড়ে রাতের পিছনে আসে। তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র দৌঁড় স্বীয় আদেশের অনুগামী। শুনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ দান করা। আল্লাহ, বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক।
সুরা আল-আ’রাফ: ৫৪
বহুমাত্রিক সমাজ বৈচিত্রের মাঝখানে হিজাবের যথার্থ কার্যকারিতা লাভ করতে হলে এর সাথে গভীরভাবে যুক্ত করতে হবে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ও ভয়কে (তাকওয়া)। আমাদের অনুসরণ করতে হবে রাসূল সা:এর দিক-নির্দেশনাকে। অনেকেই বর্তমান সমাজের অশ্লীলতার তুলনায় নিজেদেরকে ভালো মনে করে একটা মান পর্যন্ত যেয়ে সন্তষ্ট থাকেন অথবা শয়তান তাদের সন্তষ্ট করে রাখে। অথচ মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা:এর দেয়া মানদণ্ড কি তা আর জানতেও চান না তারা। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন:
হে ঈমানদারগন! শয়তানের পদাংক অনুসরণ করে চলো না। যে কেউ তাঁর অনুসরণ করবে তাকে সে অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ করার হুকুম দিবে। সূরা আন-নুর: ২১
হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদের আবার ঠিক তেমনিভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ না করে যেমনভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল এবং তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেবার জন্য তাদেরকে বিবস্ত্র করেছিল। সে ও তার সাথীরা তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখে যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। এ শয়তানদেরকে আমি যারা ঈমান আনে না তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি।
সূরা আল-আরাফ: ২৭
বোনেরা, লক্ষ্য করুন শয়তানের প্রথম কাজই ছিল লজ্জাকে হরণ করা। এখনো শয়তান ঘরে ঘরে অশ্লীলতার ব্যাপক বিস্তার করে যাচ্ছে। আজ দেখা যায় নারীর পোশাক ছোট হয়ে আসছে আবার পুরুষের পোশাক পায়ের নীচে চলে যাছে। দেখুন, শয়তান কিভাবে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:এর বিরুদ্ধাচরণ করার কত সুন্দর কৌশল অবলম্বন করছে এবং মুসলমান শয়তানের আনুগত্যের মাধ্যমে দুনিয়ার জীবনের কিছু সময় অশ্লীল আনন্দ লাভ করছে, কিন্তু ধীরে ধীরে ইসলামের সুমহান আদর্শ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এভাবেই একটি মুসলিম পরিবার তথা জাতি নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
আল্লাহ তা’লা বলেছেন: প্রত্যেক জাতির জন্য অবকাশের একটি সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। তারপর যখন কোন জাতির সময় পূর্ণ হয়ে যাবে তখন এক মুহূর্তকালের জন্যও তাকে বিলম্বিত বা ত্বরান্বিত করা হবে না।
হে বনী আদম! মনে রেখো, যদি তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে কোন রাসূল এসে তোমাদেরকে আমার আয়াত শুনাতে থাকে, তাহলে যারা আমার নাফরমানী করা থেকে বিরত থাকবে এবং নিজেদের কর্মনীতির সংশোধন করে নেবে, তাদের কোন ভয়ভীতি থাকবে না এবং তারা দুঃখিত ও চিন্তিত হবে না। সূরা আল-আরাফ: ৩৪-৩৫
রাসুল সা: বলেছেন:
কোন ব্যক্তি পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় যে সব কাজে গুনাহ নেই তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত আল্লাহভীরু লোকদের শ্রেণীভুক্ত হতে পারে না। তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ
রাসুল সা: বলেছেন: হে আয়েশা! ছোট-খাটো গুনাহর ব্যাপারেও সতর্ক হও। কেননা এজন্যও আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। ইবনে মাজাহ
মহান আল্লাহ তা’লার ওয়াদা অনুযায়ী আমরা যদি কুরআন হাদীসের আলোকে নিজেদের জীবনযাত্রাকে সংশোধন করে নেই তাহলে ইনশাআল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের কোন ভয় বা চিন্তার কিছু নেই। দুনিয়াতে শান্তি ও নিরাপত্তা এবং আখিরাতে স্থায়ী বাসস্থান জান্নাত প্রাপ্তি হবে ইনশাআল্লাহ।
অনেকেই পর্দা বা হিজাব পালনের কথা বলেই মনে করেন এটা শুধু নারীর জন্য। অথচ কুরআনের পর্দার আয়াত এসেছে প্রথমেই পুরুষদের আহবান করে। মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
হে নবী! মু’মিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য বেশী পবিত্র পদ্ধতি। যা কিছু তারা করে আল্লাহ তা জানেন।
সূরা আন-নূর: ৩০
একটি গল্প আপনাদের অনেকেরই জানা আছে। পায়ে ময়লা লাগে বিধায় রাজ্যের সবাইকে নিয়ে রাজা বিরাট সভা ডাকলেন, কিভাবে এই ময়লা থেকে নিজেকে পরিষ্কার রাখা যাবে। ঝাড়ু দিয়ে, পানি দিয়ে ধুয়ে ময়লা পরিষ্কার করতে যেয়ে সারা দেশে হুলস্থূল অবস্থা। শেষে একজন বুদ্ধি দিল পায়ে জুতা বানিয়ে পড়লেই এর থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব। আমাদের সমাজেও কাফের, মুশরিক, মুনাফিক ও আল্লাহর অবাধ্য নারীদের থেকে নিজেদের পূত-পবিত্র রাখার জন্য পুরুষদের জন্য সহজ উপায় মহান আল্লাহ তা’আলা দিয়ে দিয়েছেন তা হলো দৃষ্টিকে সংযত রাখা। অনেক সময় পর্দানশীল নারীর অনিচ্ছাকৃত সৌন্দর্য্য প্রকাশের কবল থেকে নিজেকে হেফাজতের জন্যও এই বিধান সহায়ক ভূমিকা রাখে।
মানবীয় শক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী দিকটি হচ্ছে তার নৈতিক শক্তি, চিন্তাশক্তি ও মন। যখন ব্যক্তির নৈতিক শক্তি ব্যধিগ্রস্থ হয়ে পড়ে তখন সে মানবীয় গুনাবলী হারানো দ্বিপদ প্রাণীতে পরিণত হয়।
চোখ মনের আয়না। দৃষ্টি বা চোখ মনেই গিয়ে আশ্রয় লাভ করে। মনকে প্রভাবিত করে, চালিত করে। মনকে শুদ্ধ রাখতে চাইলে, ভালো চিন্তা ভাবনায় উদ্বুদ্ধ রাখতে চাইলে দৃষ্টি ও শ্রুতি নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরী।
আমাদের সমাজে পর্দার ব্যপারে নারীর কথা যতবার আসে পুরুষদের ব্যপারে তেমন কোন কথা শোনাই যায় না। ছোট বেলা থেকে দেখা যায় মেয়ে শিশুকে হিজাবের কথা যতটা গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয় কিন্তু ছেলে শিশুকে কিছুই শেখানো হয় না। ফলে সমাজে এই ছেলেটি বড় হতে হতে বাইরে নিজেকে অশ্লীলতায় মিশিয়ে ফেলে এবং যখন সংসার শুরু করে তখন পর্দা করা নারীকে তার পছন্দ হয় না। এরপরের বংশীয় ধারায় পর্দা তো দূরে থাক, পোশাকের শালীনতাটুকু হারাতে থাকে। এভাবেই পরিবারগুলো ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে চলে যায়। বর্তমান সমাজে এখন যা দেখা যাচ্ছে এ তারই নমুনা।
আবার অনেক পুরুষ তার ঘরের নারীর পর্দার ব্যাপারে সচেতন থাকেন পুরোপুরিভাবে কিন্তু নিজের পর্দার কথা আমলে নেন না। এটা সাধারণত একটু ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে পরিবারগুলোতে দেখা যাচ্ছে। দেখা যায় নিজে বেপর্দা নারীর সাথে অকপটে হাসি-ঠাট্টা করে যাচ্ছেন, নিজের ভাবীদের সাথে বসে একান্তে গল্প-গুজব করছেন, কর্ম-ক্ষেত্রে নারীর সাথে অবাধ মেলা মেশাতে কোন শরীয়ত মেনে চলছেন না। তাহলে সেই পরিবারের নারী এই পুরুষ অভিভাবককে কতটা শ্রদ্ধা সহকারে আনুগত্য করবে? এভাবেই একে অপরের প্রতি সম্পর্কের মধুরতা দূর হয়ে তিক্ততা চলে আসে একসময়। পুরুষ অভিভাবকটি বাইরের পরিবেশে তার স্ত্রীর জন্য রাখা যৌনতার কিছু অংশ পরনারী (গায়রে মাহরাম নারী) কে দিয়ে পূর্ণ করে আসেন। বাসায় এসে তার সেই আকর্ষণ অনেক সময় থাকে না। এইভাবে অনেক পরিবার ভেংগে যাচ্ছে ।
বোনেরা আমার, একটু চিন্তা করুন আমরা নারীরাও, নারীদের কিভাবে সর্বনাশ করে যাচ্ছি। আমার পর্দাহীনতার জন্য আরেকটি নারীর সংসার ভেংগে যেতে পারে অথবা অশান্তি এনে দিতে পারে। আবার পুরুষেরা নিজেদের ভুলের জন্য (পর্দার বিধান না মানার কারণে) কত নারীকে সমস্যায় ফেলে দিচ্ছেন, কত সংসার ভেংগে দিচ্ছেন, কত সন্তান স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে মানুষ হতে পারছে না। এভাবেই সমাজে বখাটে ছেলে-মেয়ের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আজ আপনজনের প্রতিও বিশ্বাসের, নির্ভরতার অভাব তৈরী হয়ে গিয়েছে।
স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে সন্দেহ করছেন, ভালোবাসা আনুগত্য থাকছে না, শুধুমাত্র একটি ছাদের নীচে অবস্থান করে সমাজের মানুষ যেন না বুঝে, অভিনয় করে স্বামী-স্ত্রী দিন পার করে যাচ্ছেন। ঝগড়া-ঝাটি প্রায়ই চলে। কোন কোন ক্ষেত্রে নারী/পুরুষ মানসিক ভারসাম্য রাখতে না পেরে মানসিক ডাক্তারের নিয়মিত রোগী হিসেবে বাকি জীবনটা পার করে যান অথবা কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন অথবা ডিভোর্স দিয়ে সংসার ভেংগে দেন। তারপর সেই পরিবারের সন্তানটি অসুস্থ মন-মানষিকতা নিয়েই বড় হতে থাকে এবং সমাজ হতে থাকে অসুস্থ অস্বাভাবিক মানুষের বাসস্থান। এই মানুষদের থেকে ভালো কিছু কিভাবে সমাজ আশা করতে পারে???
একটু ভেবে দেখুন তো, আল্লাহর রাসূল সা:এর প্রতি খাদীজা রা:এর বিশ্বাস, আস্থা-ভালোবাসা, নির্ভরতার পূর্ণ প্রকাশ হয়েছিল রাসূল সা:এর চরিত্র মাধূর্যতা, কথা-কাজে মিল ও তাকওয়ার উন্নত নমুনার জন্য। আবার দেখুন, হযরত ইবরাহীম আ:এর জীবনেও সেই একই নমুনা পরিলক্ষিত হয়। বিবি হাযেরা ও শিশু পুত্র ঈসমাইল আ:কে যখন মরুপ্রান্তরে একা রেখে এসেছেন, ঈসমাইল আ:কে কুরবানী করতে নিয়ে গিয়েছেন, প্রতিটি ঘটনার সফলতার পিছনে পুরো পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক ভালোবাসা ও অগাধ বিশ্বাস কাজ করেছিল এবং ইবরাহীম আ: আল্লাহর নির্দেশিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন। প্রতিটি সদস্য নিজ নিজ জায়গাতে প্রকৃত তাকওয়াসম্পন্ন আমলদার মুসলিম, প্রত্যেকেই নিজের চিন্তা-চেতনা, কথা-কাজের জবাবদিহিতার ব্যাপারে সচেতন এবং পরবর্তী (আখিরাতে) স্থায়ী জীবনে সুন্দর পরিণতির জন্য ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার জীবনকে আল্লাহর নির্দেশনায় যেভাবে সাজানো যায়, যতটুকু ত্যাগ-কুরবানী প্রয়োজন, তা করতে সদা প্রস্তুত থাকতেন।
তাই আমাদের নারী পুরুষ উভয়কে প্রতিযোগিতামুলক ভাবে একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করতে হবে জান্নাতে যাওয়ার ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে যত কাজ আছে তা করার জন্য। একটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যকেই একেকজন কুরআনের প্রতিচ্ছবি হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের অন্তরে সেভাবে কুরআনকে ধারণ করে দিন। আমীন।
দৃষ্টি
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো এবং হুকুম শোনার পর তা অমান্য করো না। তাদের মতো হয়ে যেয়োনা, যারা বললো, ‘আমরা শুনেছি’ অথচ তারা শোনে না। অবশ্যই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের জানোয়ার হচ্ছে সেই সব বধির ও বোবা লোক, যারা বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগায় না। সূরা আনফাল: ২০-২২
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
হে নবী! মু’মিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য বেশী পবিত্র পদ্ধতি। যা কিছু তারা করে আল্লাহ তা জানেন।
সূরা আন-নূর: ৩০
আর হে নবী! মু’মিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে আর তাঁদের সাজ-সজ্জা না দেখায় যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া। আর তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে। সূরা আন-নূর: ৩১
উপরোক্ত আয়াত দু’টিতে আল্লাহ তা’আলা মুসলিম নর-নারীদেরকে চক্ষু অবনমিত ও লজ্জাস্থানের হেফাজতের নির্দেশ দেন। মানুষের মন নির্লিপ্ত পাথর খণ্ড নয়। যা কিছুই আমাদের চোখে পড়ে, মন সে সম্পর্কে কিছু না কিছু ভেবে থাকে। যাবতীয় আপত্তিকর ও অকল্যাণকর বিষয় থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখতে হবে। সেই ভাবে ফিরিয়ে রাখতে হবে, যে ভাবে আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন।
রাসূল সা: হযরত আলী রা:কে বললেন, হে আলী! দৃষ্টির উপর দৃষ্টি ফেলো না। হঠাৎ যে দৃষ্টি পড়ে ওটা তোমার জন্য ক্ষমার্হ, কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষমার যোগ্য নয়। আবু দাউদ
আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, পথের উপর বসা থেকে তোমরা বেঁচে থাকো। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসূল সা:! কাজ কর্মের জন্য এটাতো জরুরী। উত্তরে তিনি বললেন: আচ্ছা তাহলে পথের হক আদায় করো। সাহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, পথের হক কী? তিনি বললেন, দৃষ্টি নিম্নমুখী করা, কাউকে কষ্ট না দেয়া, সালামের উত্তর দেয়া, ভাল কাজের আদেশ করা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা। মুসলিম: ৫৪০০
রাসূল সা:এর আদর্শ যদি স্কুল-কলেজে শেখানো হতো তাহলে আজ ইভটিজিংএর কবল থেকে অনেক মেয়েরাই রেহাই পেতো।
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সা: বলেছেন, আদম সন্তানের জন্য তার ব্যভিচারের অংশ নির্ধারিত করা হয়েছে। সে তা অবশ্যই করবে। দু’চোখ-তাদের ব্যভিচার দেখা, দু’কান-তাদের ব্যভিচার শোনা। জিহবা-তার ব্যভিচার কথা বলা। হাত-তার ব্যভিচার ধরা। পা-তার ব্যভিচার চলা। মন-তা চায় ও আকাঙ্ক্ষা করে। আর গুপ্ত অংগ তাকে সত্য বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। মুসলিম: ৬৫৬৪
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
তোমরা যেনার নিকটবর্তীও হইওনা। উহা অত্যন্ত খারাপ কাজ, আর উহা অতি নিকৃষ্ট পথ। সূরা বনী ইসরাঈল: ৩২
অর্থাৎ যেনাকে উত্তেজিত করে যে সব জিনিষ তা থেকে দূরে থাকার আদেশ এসেছে এই আয়াতে। অথচ দেখুন, আজ সমাজে ঘরে ঘরেই সেই প্ররোচনা চালাচ্ছে শয়তান ও মানবরূপী শয়তান। আপনি কম্পিউটারে কাজ করছেন, ইন্টারনেট থাকলে দেখবেন কত অশ্লীল ছবি নিজ থেকে সামনে চলে আসছে, বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছে অশ্লীল নারীর ছবি দিয়ে ইত্যাদি। টিভিতে এখন দেশীয় কোন অনুষ্ঠানও দেখার মত নয়, এমনকি খবর দেখতেও চোখের যেনা হয়ে যায়। পত্রিকাগুলোতেও বিনোদনের নামে অশ্লীলতার প্রচার চলছে। ভয়ানক এক সমাজে অবস্থান করছি আমরা।
মহান আল্লাহ বলছেন:
যারা বড় বড় গোনাহ এবং প্রকাশ্য ও সর্বজনবিদিত অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে – তবে ছোটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতি হওয়া ভিন্ন কথা – নিশ্চয়ই তোমার রবের ক্ষমাশীলতা অনেক ব্যাপক। যখন তিনি মাটি থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্রূণ আকারে ছিলে তখন থেকে তিনি তোমাদের জানেন। অতএব তোমরা নিজেদের পবিত্রতার দাবী করো না। সত্যিকার মুত্তাকী কে তা তিনিই ভাল জানেন।
সূরা আন-নাজম: ৩২
এই আয়াতে মহান রব কবীরা গুনাহর সাথে অশ্লীল কাজ থেকেও দূরে থাকার কথা উল্লেখ্য করে বলেছেন ছোট গুনাহ মাফ করে দিতে পারেন। অন্তরের অবস্থা সহ বান্দাহর সব কিছুই মহান রবের কাছে জানা। অনেকে রাত জেগে সিনেমা-গান-নাচ সহ অশ্লীল ঘটনাকে মুভি আকারে দেখে থাকে। একবারও কি তাদের মনে হয় না যে, দুইজন ফেরেশতা আমলনামায় লিখে যাচ্ছেন, মহান আল্লাহ তা’আলা দেখছেন, এই মুহুর্তে মৃত্যুর ফেরেশতা এসে জান কবয করলে-কি অবস্থায় চিরন্তন জীবনের ফয়সালায় আল্লাহর সামনে হাযির হতে যাচ্ছেন তারা!!!
আর হে লোকেরা, তোমরা যা কিছু করো সে সবের মধ্যে আমি তোমাদের দেখতে থাকি। আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে কোন অণু পরিমাণ বস্তুও এমন নেই এবং তার চেয়ে ছোট্ট বা বড় কোন জিনিস ও নেই, যা তোমাদের রবের দৃষ্টিতে অগোচরে আছে এবং যা একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা নেই। সূরা ইউনুস: ৬১
যারা চায় মু’মিনদের সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক তারা দুনিয়ায় ও আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে। আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো না। সূরা আন-নূর: ১৯
যারা পরিকল্পিতভাবে সমাজে বিভিন্ন মিডিয়াতে/হলে/হোটেলে/মোবাইলে নোংরা অশ্লীলতার রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে যাচ্ছে তাদের সাবধান করে দিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা। এক্ষেত্রে মুমিন নারী ও পুরুষের চোখকে সংযম করে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই জীবন ক্ষণস্থায়ী। মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদের পরীক্ষা করছেন অর্থাৎ আমরা পরীক্ষার হলে আছি, সময় অনিশ্চিত, যে কোন মুহূর্তেই প্রত্যেককেই নিজ নিজ খাতা নিয়ে হাযির হয়ে যেতে হবে চিরস্থায়ী ফলাফল লাভের জীবনে।
রাসূল(সঃ) বলেছেন-মহিলারা হল পর্দায় থাকার বস্তু। সুতরাং তাঁরা যখন (পর্দা উপেক্ষা করে) বাইরে বের হয়ে আসে, তখন শয়তান তাদেরকে (অন্য পুরুষের চোখে) সুসজ্জিত করে দেখায়। তিরমিযী: ১১৭৩
মহান আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
আর সেই সময়ের কথাও একটু চিন্তা করো যখন আল্লাহর এসব দুশমনকে দোযখের দিকে যাওয়ার জন্য পরিবেষ্টিত করা হবে। তাদের অগ্রবর্তীদেরকে পশ্চাদবর্তীদের আগমন করা পর্যন্ত থামিয়ে রাখা হবে। পরে যখন সবাই সেখানে পৌঁছে যাবে তখন তাদের কান, তাদের চোখ এবং তাদের দেহের চামড়া তারা পৃথিবীতে কি করতো সে সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। তারা তাদের শরীরের চামড়াসমূহকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা জবাব দেবে, সেই আল্লাহই আমাদের বাকশক্তি দান করেছেন যিনি প্রতিটি বস্তুকে বাকশক্তি দান করেছেন। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। আর এখন তোমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পৃথিবীতে অপরাধ করার সময় তোমরা গোপন করতে তখন তোমরা চিন্তাও করোনি যে, তোমাদের নিজেদের কান, তোমাদের চোখ এবং তোমাদের দেহের চামড়া কোন সময় তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। তোমরা তো বরং মনে করেছিলে, তোমাদের বহু সংখ্যক কাজ-কর্মের খবর আল্লাহও রাখেন না। সূরা হামীম আস-সাজদাহ: ২০-২১
রাসূল সা: বলেছেন: যে মুসলমানের দৃষ্টি কোন মেয়ের সৌন্দর্যের উপর পড়ে এবং সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, এ অবস্থায় আল্লাহ তার ইবাদাতে বিশেষ স্বাদ সৃষ্টি করে দেন।
মুসনাদে আহমাদ
রাসূল সা: বলেছেন, আমি আমার পরে এমন কোন মারাত্মক ফিৎনাহ রেখে যাইনি যা পুরুষের জন্যে অধিকতর ক্ষতিকর হতে পারে নারীদের ফিৎনাহ অপেক্ষা। অর্থাৎ আমার পরে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষতিকর ফিৎনাই হচ্ছে নারীদের থেকে। মুসলিম: ৬৭৪৮
অনেক পুরুষ দেখা যায় যারা পর্দা করে মুখ ঢেকে চলে সেই সব নারীদের সাথে প্রয়োজনে কথা বললে দৃষ্টি নত রাখে আবার এই ব্যক্তিটিই মুখের সৌন্দর্য খোলা রেখে চলা নারীদের সাথে হাসি-ঠাট্টা করে যায় অপ্রয়োজনে। বলতে হবে পুরোপুরি পর্দা যারা মেনে চলেন সেই নারীদের প্রতি এটা আল্লাহ প্রদত্ত সম্মান। এই ধরনের পুরুষদের জন্য রয়েছে সাবধানবানী। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন:
এসব লোকদের সেদিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও যা সন্নিকটবর্তী হয়েছে। যেদিন কলিজা মুখের মধ্যে এসে যাবে আর সব মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত ও দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে। জালেমদের জন্য না থাকবে কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু, না থাকবে কোন গ্রহণযোগ্য শাফায়াতকারী। আল্লাহ চোখের চুরি ও মনের গোপন কথা পর্যন্ত জানেন। সূরা মু’মিন: ১৮-১৯
রাসূল(সঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই এই দুনিয়াটা একটা মধুর চাকচিক্যময় বস্তু এবং মহান আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ায় স্থলাভিষিক্ত করে দিয়েছেন। তিনি অবলোকন করছেন, তোমরা কি ভাবে কাজকর্ম করছো। অতএব তোমরা দুনিয়া থেকে সাবধান থাক। এবং নারী জাতি থেকে সাবধান থাক। মনে রেখ, বনী ইসরাইলের প্রথম ফিৎনাহ ছিল নারীদের সম্পর্কিত। মুসলিম: ৬৭৫১
নারীকে যেমন শরীয়তের পর্দা মেনে চলে ফিতনার বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে তেমনি পুরুষকেও শরীয়তের পর্দা মেনে দৃষ্টি সংযত রেখে ফিতনাহ থেকে দূরে হেফাজত অবস্থানে থাকতে হবে।
তবে পুরুষের দৃষ্টি দেয়ার ব্যপারে যতটা শক্ত করে বলা হয়েছে নারীর বেলায় একটু কম শক্ত করে বলা আছে। প্রকৃতিগতভাবেই এই পার্থক্য। পুরুষ যত সহজে একজন নারীকে দেখলেই আবেগাপ্লুত হতে পারে নারী ততো সহজেই তা হয় না। তাই দেখা যায় বুখারী হাদীসে এসেছে:
হযরত আয়েশা(রা) বলেন, “আমি দেখেছি, রাসূল সা: আমার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁর চাদর দিয়ে আমাকে পর্দা করছিলেন এবং আমি ইথিওপীয়-হাবশীদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তারা মসজিদের মধ্যে তাঁদের সড়কি-বল্লম নিয়ে খেলা করছিল। অতঃপর যতক্ষণ না আমি নিজে ক্লান্ত হতাম ততক্ষন তিঁনি আমার জন্য এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতেন। কাজেই তোমরা অল্পবয়স্কা খেলাধূলা-প্রিয় মেয়ের মর্যাদা-গুরুত্ব অনুধাবন করবে।
বুখারী: ৫/২০০৬
এই ঘটনাটি ঘটেছিল ৭ম হিজরীতে ইথিওপিয়া থেকে মদিনায় মুসলিম প্রতিনিধি দলের আগমনের পর যখন হযরত আয়েশা(রাঃ) এর বয়স ছিল ১৬ বছর।
আবার আরেকটি ঘটনায় দেখা যায়- হযরত উম্মে সালমা(রা) ও হযরত উম্মে মাইমূনাহ(রা) রাসূল(সঃ)এর কাছে বসেছিলেন। এমন সময় হযরত ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) এসে গেলেন। নবী(সঃ) উভয় স্ত্রীকে বললেন, তার থেকে পর্দা করো। স্ত্রীরা বললেন, তিনি কি অন্ধ নন? তিনি বললেন, “তোমরা দুজনও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছো না?” আবু দাউদ, তিরমিযী
দৃষ্টি হলো হৃদয়ের পরিচালক, তার সংবাদবাহক ও গোয়েন্দা।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী(সঃ) আল্লাহর উক্তি বর্ণনা করেছেন- “দৃষ্টি হচ্ছে ইবলিসের বিষাক্ত তীরগুলোর মধ্য থেকে একটি তীর, যে ব্যক্তি আমাকে ভয় করে সে তা ত্যাগ করবে আমি তার বদলে তাকে এমন ঈমান দান করবো যার মিষ্টতা সে নিজের হৃদয়ে অনুভব করবে”। তাবারানী
নিষিদ্ধ দৃশ্যাবলী থেকে চোখকে অবনমিত রাখলে- যেমন নারী ও শ্মশ্রুবিহীন সুদর্শন পুরুষের দিকে নজর দেয়া থেকে চোখকে অবনমিত রাখলে তিন প্রকারের অতি মর্যাদাপূর্ণ ফায়দা পাওয়া যায়:
১। ঈমানের সুখ-স্বাদ আস্বাদন করা।
২। আত্মিক নূর ও অন্তর্দৃষ্টির আলোর অধিকারী হওয়া।
৩। আত্মিক শক্তি, দৃঢ়তা ও সাহসিকতা অর্জন।
আল্লাহ তা’আলা তার মধ্যে যুক্তি-প্রমান উপস্থাপনের যোগ্যতা প্রদানের সাথে সাথে দৃষ্টি ক্ষমতা দান করেন। কারণ যে ব্যক্তি তার নফসের বিপরীত কাজ করে শয়তান তার ছায়া থেকে বেরিয়ে পড়ে। এ কারনে কু-প্রবৃত্তির অনুসারীরা আত্মিক লাঞ্ছনা, অপমান ও দূর্বলতায় ভোগে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
অথচ সম্মান ও মর্যাদা তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মু’মিনদের জন্য। কিন্তু এসব মুনাফিক তা জানে না। সুরা মুনাফিকুন: ৮
কণ্ঠস্বরের শালীনতা
মহান আল্লাহ তা’আলার প্রিয় রাসূল সা: আমাদের জন্য যেমন আদর্শ তেমনি তাঁর স্ত্রীরাও অর্থাৎ উম্মুহাতুল মু’মিনীনদের জীবনেও নারীর জন্য অনুসরণীয় বিধান রয়েছে। নবীপত্নী উম্মুহাতুল মু’মিনীন অতি উত্তম ও পবিত্র হওয়া সত্বেও আল্লাহ তা’লা ইসলামের পর্দার বিধানকে সুন্দরভাবে সেই সম্মানিতাদের সম্বোধন করে জানিয়ে দিয়েছেন। আমরা সাধারণ নারীরাও যেন আরো সচেতনভাবে পর্দার বিধানকে নিজেদের জীবনে, পারিবারিক জীবনে ও সমাজে তার সুন্দর নমুনা রাখতে পারি। একটু চিন্তা করে দেখুন আল্লাহর রাসূলের পত্নীরা কত উচ্চ মানের চরিত্রের অধিকারী ছিলেন; রাসূল সা: হলেন তাঁদের সরাসরি অভিভাবক, উঁনারা প্রত্যেকেই আখিরাতের জন্য দুনিয়ার জীবনের ভোগ-বিলাস, চাওয়া-পাওয়াকে সীমিত করে রেখেছিলেন; সেই পরিপূর্ণ ঈমানদার, পবিত্রতার অধিকারী ও অতি উন্নত তাকওয়া সম্পন্ন মু’মিনাদেরকেও আল্লাহ কিভাবে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই আমাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সেই নির্দেশনা অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি হাসিল করতে হবে।
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন:
হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে। মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে। আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানগর্ভ কথা, যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয় তোমরা সেগুলো স্মরণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সূক্ষ্ণদর্শী, সর্ববিষয়ে খবর রাখেন। সূরা আহযাব: ৩২-৩৪
এই আয়াতে “তোমরা সাধারণ নারীদের মতো নও” দ্বারা এ অর্থ বুঝায় না যে, সাধারণ নারীদের সাজসজ্জা করে বাইরে বের হওয়া ও ভিন পুরুষদের সাথে মুক্তভাবে মেলামেশা করা উচিত। বরং এভাবে বুঝার চেষ্টা করুন। এক ব্যক্তি নিজের সন্তানদের বললেন, তোমরা বাজারের ছেলে মেয়েদের মত নও। তোমাদের মুখ দিয়ে গালাগালি করা উচিত নয়। এ থেকে আপনি এটা বুঝবেন না যে, সে কেবল মাত্র নিজের ছেলে-মেয়েদের গালি দেয়াকে খারাপ মনে করে এবং অন্য ছেলে মেয়েদের মধ্যে এ দোষ থাকলে তাতে কোন আপত্তি নেই।
দৃষ্টির সংরক্ষণের পর কথা বলার ক্ষেত্রেও যে দিক নির্দেশনা রয়েছে তা এই আয়াতে বলা হয়েছে। কণ্ঠস্বর হলো হৃদয়ের ভাষ্যকার। গায়ের মাহরামদের(পরপুরুষ) সাথে নরম স্বরে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ কারো অন্তর যদি ব্যধিগ্রস্ত হয় তাহলে সেই (আকর্ষণীয়) কণ্ঠস্বর শুনেও যিনার কামনা-বাসনা জাগ্রত হতে পারে। কত গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশনা, আজকাল মোবাইলে এই কথা বলার ফিতনায় পড়ে কত ছেলে-মেয়ের জীবন ধ্বংস হয়েছে তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক পরিবারের স্বামী বেচারা, স্ত্রীকে হারাচ্ছে অথবা অসহায় স্ত্রী, স্বামীকে হারাচ্ছে শুধুমাত্র ফোনে নরম স্বরে কথা বলা বা কোন অনুষ্ঠানে আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় কথা বলা বিপরীত লিঙ্গের যেনার দিকে উত্তেজিত করার মাধ্যমে।
তাই মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের জীবনে সুন্দর স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্যই নরম স্বরে/ইনিয়ে-বিনিয়ে/স্বাভাবিক থেকে একটু ভিন্ন আকর্ষণীয় করে বিপরীত লিংগের সাথে কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে নারীরাই অধিক অগ্রগামী বলেই তাদেরকেই সাবধান করা হয়েছে। তাই দেখা যায় মসজিদে জামায়াতে নামায আদায়কালে ইমামের ভুল হলে নারীকে মুখে কোন কথা না বলে শব্দ (এক হাতের উপর অন্য হাত মেরে) দিয়ে ভুল ধরিয়ে দেয়ার নির্দেশনা এসেছে যেখানে পুরুষদেরকে সুবহানাল্লাহ বলে ইমামকে সতর্ক করতে বলা হয়েছে। তাহলে একটু চিন্তা করুন, নারী শিল্পীর সুর-গান কিভাবে একজন পুরুষ শুনতে পারেন? যা একজন পুরুষ নয় নারীর অন্তরকেও প্রলুব্ধ করে অবৈধ প্রেম ভালোবাসার দিকে।
প্রয়োজনে নারী-পুরুষের সাথে কথা বলার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, কথা বলার ভঙ্গি ও ধরণ এমন হবে যেন পুরুষের মনে এ ধরণের চিন্তার উদয় না হয় যে, এ নারীর ব্যাপারে অন্য কিছু আশা করা যায়। বলার ভঙ্গিতে কোন নমনীয়তা থাকবে না। তার কথায় কোন মনমাতানো ভাব থাকবে না। স্বরে মাধুর্য্য সৃষ্টি করবে না, যা শ্রবণকারী পুরুষের আবেগ উদ্বেলিত করে সামনে পা বাড়াবার প্ররোচনা দেবে ও সাহস যোগাবে। প্রয়োজনীয় কথাটুকুই সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলেই চলে যাবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা: থেকে বর্ণিত। নবী সা: বলেন, তোমাদের কেউ আল্লাহর চেয়ে বেশী আত্মসম্মানবোধশীল নয়। এ কারণেই তিনি সবরকমের অশ্লীল কাজ হারাম করেছেন এবং আল্লাহ ছাড়া অপর কেউ নিজ প্রশংসা বেশী পছন্দ করেন না। বুখারী: ৪৮৩৭
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
নবীর স্ত্রীদের কাছে যদি তোমাদের কিছু চাইতে হয় তাহলে পর্দার আড়াল থেকে চাও। এটা তোমাদের এবং তাদের মনের পবিত্রতার জন্য বেশী উপযোগী। সূরা আহযাব: ৫৩
সহীহ বুখারীতে আনাস ইবনে মালেক রা: কর্তৃক উদ্ধৃত হয়েছে যে, উমর রা: এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার আগে নবী করীম সা:এর কাছে নিবেদন করেছিলেন: হে আল্লাহর রাসূল সা:! আপনার এখানে ভালোমন্দ সবরকম লোক আসে। আহা, যদি আপনি আপনার পবিত্র স্ত্রীদেরকে পর্দা করার হুকুম দিতেন।
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, একবার উমর রা: নবী করীম সা:এর স্ত্রীদের বলেন: যদি আপনাদের ব্যাপারে আমার কথা মেনে নেয়া হয় তাহলে আমার চোখ কখনোই আপনাদের দেখবে না।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা: যেহেতু আইন রচনার ক্ষেত্রে স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না, তাই তিনি মহান আল্লাহর ইশারার অপেক্ষায় ছিলেন। শেষপর্যন্ত এ হুকুম এসে গেলো যে, মাহরাম পুরুষরা ছাড়া অন্য কোন পুরুষ নবী সা:এর গৃহে প্রবেশ করবে না। আর সেখানে মহিলাদের কাছে কারো কোন প্রয়োজন হলে তাকে পর্দার আড়াল থেকেই কথা বলতে হবে। এ নির্দেশনার পরে পবিত্র স্ত্রীদের গৃহে দরজার ওপর পর্দা ঝুলিয়ে দেয়া হয় এবং যেহেতু নবী সা:এর গৃহ সকল মুসলমানের জন্য আদর্শ গৃহ ছিল তাই সকল মুসলমানের গৃহের দরজায়ও পর্দা টানানো হয়। আয়াতের শেষ অংশ নিজেই এদিকে ইঙ্গিত করছে যে, যারাই পুরুষ ও নারীদের মন পাক-পবিত্র রাখতে চায় তাদেরকে অবশ্যই এ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের পুরুষদেরকে গুরুত্ব দিতে হবে যে, বেপর্দা নারীতো বটেই, পর্দানশীন নারীদের সাথেও সরাসরি কথা বলার ভয়াবহতা থেকে দূরে থাকতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গণ ও কর্মক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান না মানার কারণে এর কুপরিণতি দেখা যায়। বিপরীত লিঙ্গের কাছে ভালো ও আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য অপ্রয়োজনীয় গল্প/কথা করে থাকেন যার পরিনতি আজ সমাজে দেখা যাচ্ছে। মানুষকে খুশি করতে যেয়ে আল্লাহ সুবহানের বিধান থেকে পাশ কেটে যাওয়া নিজেকেই জান্নাতের পথ থেকে সরে নিয়ে আসার নামান্তর মাত্র। প্রতিটি নর-নারী যার যার অবস্থানে থেকে শরীয়তের পর্দা মেনে চললেই আমাদের সমাজটা হতো একটি সুখ-শান্তির আবাসস্থল।
গায়ের মাহরামদের সঙ্গে সহাবস্থান
কুরআনে পুরুষদের গায়ের মাহরাম নারীদের সাথে সরাসরি কথা না বলে প্রয়োজনে পর্দার আড়াল থেকে বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অথচ আমাদের সমাজে অনেক পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটি নিজ ঘরের নারীকে পর্দার আড়ালে রাখলেও নিজে আবার সরাসরি গায়রে মাহরাম আত্মীয়ার সাথে গল্প-গুজব করে থাকেন অথবা প্রয়োজনীয় কথা একা ঘরে সামনা-সামনি বসে বলে থাকেন যা শরীয়ত সম্মত নয়।
কোন গায়রে মাহরাম পুরুষ ও নারী একা একত্রে অবস্থান করতে পারে না।
রাসূল সা: বলেছেন: যে সব নারীর স্বামী বাইরে গেছে তাদের কাছে যেয়োনা। কারন শয়তান তোমাদের মধ্যে থেকে প্রত্যেকের রক্ত ধারায় আবর্তন করছে। তিরমিযী
রাসূল সা: বলেছেন: সাবধান! গায়ের মাহরাম নারীদের কাছে তোমরা যেও না। তখন একজন আনসার সাহাবী আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! দেবরের কাছে যাওয়া সম্পর্কে আপনার কি মত? তিনি বললেন: দেবর তো মৃত্যুতুল্য। বুখারী: ৫২৩২
ইবনে আব্বাস(রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভাষণদানকালে বলতে শুনেছি: কোন পুরুষ কখনো(গায়ের মাহরাম) কোন নারীর সাথে নির্জনে অবস্থান করবে না। তবে তার সাথে তার মাহরাম কোন পুরুষ থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। বুখারী: ৫২৩৩
আমাদের সমাজে দেখা যায় দেবর ভাবী, দুলাভাই, শালী(বৌ এর বোন), ভাসুর(স্বামীর বড় ভাই), এই ধরনের সম্পর্কগুলো বড়ই বিপদজনক ঘটনা ঘটাতে পারে যদি আল্লাহর ভয় এবং শরীয়তের বিধান না থাকে। ছাত্র/ছাত্রী ও শিক্ষক/ শিক্ষিকা, বিপরীত লিংগের ডাক্তার ও রোগী, বাসার গৃহ পরিচারিকা/ড্রাইভার/বাবুর্চী/আরবী শিক্ষক/শিক্ষিকা কোনো ক্ষেত্রেই শরীয়তের বিধান অমান্য করে একা অবস্থান করতে পারবেনা। শরীয়তের বিধান মেনে না চলার কারণেই আজ পত্রিকায় দেখা যায় এ ধরনের সম্পর্কের সাথে লেন-দেনে অবৈধ/অনৈতিক কাজ হয়ে চলেছে, যার পরিণতিতে আত্মহত্যা, অবৈধ ভ্রুণ হত্যা বা মানসিক বিকারগ্রস্থ হওয়ার মত ঘটনাও ঘটছে।
প্রতিটা পুরুষ এবং নারীর নিজেদের পবিত্র রাখার জন্য পুরোপুরি পর্দা মেনে চলার কোন বিকল্প নেই। কোন মানুষ যদি এই কথা বলে যে আমার মনে কখনোই কোন খারাপ/ভালো কোন আকর্ষণই আসে না তাই সবার সাথে খোলাখুলি থাকতে/মিশতে পারি, তাহলে বুঝতে হবে সে মিথ্যে বলছে অথবা তার শারীরিক সমস্যা আছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে হবে সেই ব্যক্তির মনে কোন দুষ্ট বা খারাপ চিন্তার উদ্রেক না হলেও যাদের সাথে মিশছেন তাদের কারো মনে খারাপ চিন্তা আসতে পারে। মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টিগতভাবে আকর্ষণ করার ও আকর্ষিত হবার চাহিদা দিয়ে দিয়েছেন। এই অবস্থা না দিলে পরিবারগুলোতে বন্ধন শিথিল হয়ে যেতো, সমাজব্যবস্থা ভেংগে যেতো। এই আকর্ষণ শরীয়তসম্মতভাবে ব্যবহৃত হলে পরিবারগুলোর মাঝে সুন্দর ও পবিত্র সুখ ও আনন্দের জোয়ার বয়ে যেতো এবং সমাজ হয়ে উঠত শান্তি ও নিরাপত্তায় ঘেরা সুন্দর এক পরিবেশ।
আয়েশা(রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেন: হে মুহাম্মদের উম্মা, আল্লাহর চেয়ে বেশী আত্মমর্যাদাবোধ আর কারো নেই। সুতরাং তিনি হারাম করেছেন তাঁর কোন বান্দা বা বান্দীর ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। হে মুহাম্মদের উম্মাত, যা আমি জানি তা যদি তোমরা জানতে তাহলে খুব কম হাসতে এবং বেশী কাঁদতে। বুখারী: ৪৮৩৮
আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত। নবী সা: বলেন: আল্লাহ তায়ালার আত্মমর্যাদাবোধ আছে এবং আল্লাহ তায়ালার
আত্মমর্যাদাবোধে ঐ সময় আঘাত লাগে যখন মু’মিন ব্যক্তি আল্লাহ কর্তৃক হারাম করা কোন কাজে লিপ্ত হয়। বুখারী: ৪৮৪০
গৃহের বাহিরে শালীনতা
মহান আল্লাহ তায়ালা নবী সা:এর সহধর্মীনীদেরকে আদব-কায়দা ও ভদ্রতা শিক্ষা দিয়েছেন। সব স্ত্রীলোক তাঁদের অধীনস্থ। এই নির্দেশাবলী সকল মুসলিম নারীর জন্য প্রযোজ্য। নবীর পবিত্র স্ত্রীগনকে সম্বোধন করার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, যখন নবী সা:এর গৃহ থেকে এ পবিত্র জীবন ধারার সুচনা হবে তখন অন্যান্য সকল মুসলিম গৃহের মহিলারা আপনা আপনিই এর অনুসরণ করতে থাকবে। কারণ এই গৃহটিই তাদের জন্য আদর্শ ছিল।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:
নিজেদের গৃহের মধ্যে অবস্থান করো এবং পূর্বের জাহেলী যুগের মতো সাজসজ্জা দেখিয়ে বেড়িও না। নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো। আল্লাহ তো চান, তোমাদের নবী-পরিবার থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক-পবিত্র করে দিতে।
আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের যেসব কথা তোমাদের গৃহে শুনানো হয়, তা মনে রেখো। অবশ্যই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী ও সর্ব অবহিত। সূরা আহযাব: ৩২-৩৪
জাহেলিয়াত বলতে ইসলামী পরিভাষায় এমন প্রত্যেকটি কার্যধারা বুঝায় যা ইসলামী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, ইসলামী শিষ্টাচার ও নৈতিকতা এবং ইসলামী মানসিকতার বিরোধী।
এই আয়াতে নিশ্চিন্তে ও স্থির হয়ে ঘরে অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। নারীর আসল কর্মক্ষেত্র হচ্ছে তার গৃহ। নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, সৌন্দর্য ও প্রশান্তি আসে এই গৃহে অবস্থানের মাধ্যমে কারণ মহান আল্লাহ তা’য়ালা সৃষ্টিগতভাবেই তাকে এই পরিবেশের উপযোগী করেছেন। এই বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করে সে নিশ্চিন্তে নিজের দায়িত্ব সম্পাদন করে যেতে পারবে। কেবলমাত্র প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সে গৃহের বাইরে যাবে এবং এ কারণেই পর্দার বিধান এসেছে। নারী যেন বাইরে যেতে পারে সেজন্যেই পর্দার নির্দেশনা এসেছে। নারী শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সফরে, বেড়াতে যাবে আর তার জন্যই প্রয়োজন মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা, যা নারীকে সম্মানিত করবে, হেফাজত করবে।
কিন্তু দেখা যায় আমাদের সমাজের কিছু নারীর ঘরে থাকতে ভালো লাগে না। তারা বাজারে বা শপিংমলে প্রয়োজন ছাড়া ঘুরতে পছন্দ করেন। আবার কর্মজীবী অনেক নারী আছেন যারা কিছুদিন ছুটি নিয়ে বাসায় থাকা শুরু করার দু-একদিনের মধ্যেই অস্থির হয়ে যান বাইরে যাওয়ার জন্য। ঘরে ছেলে-মেয়ে বা স্বামী বা মা- বাবাকে সময় দেয়াকে প্রয়োজন মনে করেন না। নিজের সংসারের কাজটি যত্ন সহকারে করাটাও যে তার দায়িত্ব তা ভুলে যান।
আমার প্রিয় মা-বোনেরা, জীবনের বেশীর ভাগ সময় আমরা সংসারের নানাবিধ কাজ ও কর্মক্ষেত্রের জন্য সময়কে অপরিকল্পিতভাবে ব্যয় করে যাচ্ছি, অথচ নিজেকে জান্নাতী নারীদের কাতারে শামিল করার জন্য, কবরের জীবনকে আলোকিত করার জন্য যে জ্ঞান ও আমল থাকা প্রয়োজন তার জন্য কতটা ঘণ্টা বা মিনিট বের করছি? আমরা ভুলে যাই, যেকোন সময় আমার বিদায়ের ঘণ্টা বেজে যেতে পারে, আমি একজন লাশ হিসেবে দ্রুত কবরের জীবনে চলে যাবো, চলে যাবো সেই জীবনে, যেখানে চলে গেলে ফিরে এসে সময়কে আবার সুন্দর করে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। যা আমার আমলনামায় জমিয়েছি তাই নিয়ে চলবে হিসাব নিকাশ। হয়ে যাবে চিরস্থায়ী জীবনের ফয়সালা। তখন আপনজনরাও কোন কাজে আসবে না।
মা বাবার সান্নিধ্যে যে সন্তান বড় হয় তার মানবিক বোধ, শ্রদ্ধা, শিষ্টাচার অবশ্যই সুন্দর হবে যদি মা-বাবা সেই আদর্শের পরশ দিতে পারেন। কর্মজীবি মা-বাবারাও যদি কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনীয় সময়টুকু বাদে বাকী সময়কে পরিকল্পিতভাবে ধৈর্য্য সহকারে গঠনমূলক করে পরিবারে দেন তাহলেও আমাদের আজকের সমাজের চিত্র অনেকটাই শান্তি ও সুন্দরের দিকে পালটে যেতো। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককেই দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার তৌফিক দান করুন।
ইবনে উমার(রা) থেকে বর্ণিত। নবী সা: বলেন: তোমাদের প্রত্যেকেই রাখাল (অভিভাবক) এবং নিজ অধীনস্থ লোকদের ব্যপারে সে দায়ী। শাসক একজন অভিভাবক এবং কোন ব্যক্তি তার পরিবারের লোকদের অভিভাবক (দায়িত্বশীল)। কোন মহিলা তার স্বামী, গৃহের ও তার সন্তানদের অভিভাবক(রক্ষক)। অতএব তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং নিজ অধীনস্থ লোকদের ব্যপারে তোমাদের প্রত্যেককেই জবাবদিহি করতে হবে।
বুখারী: ৪৮১৮
পূর্বের জাহেলী যুগের মতো সাজসজ্জা দেখিয়ে বেড়িও না। এখানে ‘তাবাররুজ’ শব্দটি এসেছে, যা বোঝায় প্রকাশ ও প্রদর্শনী করা। আরবী ভাষায় ‘তাবাররুজ’ মানে উন্মুক্ত হওয়া, প্রকাশ হওয়া এবং সুস্পষ্ট হয়ে মনে এসে যাওয়া।
নারীর জন্য তাবাররুজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বুঝতে হবে:
১। সে তার চেহারা ও দেহের সৌন্দর্য (মাথা, মুখমণ্ডল, গ্রীবা, বক্ষ, বাহু, পায়ের নালা ইত্যাদি) লোকদের দেখায়।
২। সে তার চাল-চলনের মাধ্যমে নিজেকে অন্যদের সামনে তুলে ধরে।
৩। নিজের এমন গুনাবলী প্রকাশ করে যেগুলো তার গোপন রাখা উচিত।
সাজসজ্জা প্রদর্শন এমন একটা বিষয় যা মাদকাসক্তির মত একটি অভ্যাস। এ আসক্তিতে যারা আক্রান্ত হয় দিনের অধিকাংশ সময়ই তাদের এ বাবদই ব্যয় হয়। সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়ানো একট বিকৃত আচরণ এবং এটি আরো বহু বিকৃত আচরনের জন্ম দিয়ে থাকে।
রাসূল সা: বলেছেন: মহিলারা হল পর্দায় থাকার বস্তু। সুতরাং তারা যখন (পর্দা উপেক্ষা করে) বাইরে বের হয়ে আসে, তখন শয়তান তাদেরকে (অন্য পুরুষের চোখে) সুসজ্জিত করে দেখায়।
তিরমিযী: ১১৭৩
আমাদের সমাজের যে সব নারীরা অনেক সাজসজ্জা করে, পর্দা না করে ঘর থেকে বের হোন, একটু কি ভেবে দেখেছেন কাকে দেখানোর জন্য এই সাজসজ্জা?
রিকশাওয়ালা/ড্রাইভার/রাস্তার সব বখাটে ছেলে-পুরুষরাইতো এই সৌন্দর্যের বাহবা দিবে, এই জন্যই কি মহান আল্লাহর বিধানকে অবহেলা করা? যারা মুমিন ও মুমিনা তারাতো এই ধরনের নারীদের প্রতি সুধারণা পোষণ করবে না। আবার এ অবস্থায়ই তার সাজসজ্জা তার জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায় যখন সে লোলুপ দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের আক্রমনের শিকার হয়। তাহলে কি এর মাধ্যমে নিজেকে জেনে বুঝে হুমকির দিকে ধাবিত করা হচ্ছে না?
অনেকেই বলেন নিজের ভালো লাগার জন্য সেজেগুজে বের হই-একবার কি ভেবে দেখেছেন এই ভালো লাগাটা হলো শয়তানের আনুগত্য করা, শয়তানকে খুশি করা, নিজেকে রহমানের বান্দা হওয়া থেকে দূরে রাখা, নিজের সম্মানকে বিকিয়ে দেয়া, নারী জাতির ইজ্জতকে অমর্যাদা করা, অন্য আরেকটি সংসার নষ্ট করা, অন্য একটি যুবক বা পুরুষকে চরিত্রহীন করা, প্রকারান্তে নিজেকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত ও পরকালের জাহান্নামীদের অন্তর্ভূক্ত করা।
যে সৌন্দর্যকে নিয়ে এতো অনৈতিকতা যখন সেটা বয়সের ভারে বা কোন দূর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে যায় সেটা কি আর ফিরে পাওয়া যায়? জীবন শেষ হয়ে লাশ যখন মাটির নীচে পচে-গলে যাবে তখন কি হবে? কতদিন এই সৌন্দর্যের প্রতিযোগীতায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারবে?
তাই আসুন আমরা আরো সচেতন হই। নিজের নফসকে সংযত করে মহান আল্লাহর দেয়া বিধানের কাছে মাথা নত করে নিজেদের সুন্দর ও পবিত্র রাখি, যেন দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণটুকু পুরোপুরি আদায় করতে পারি।
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
তুমি কি কখনো সেই ব্যক্তির অবস্থা ভেবে দেখেছো যে তার প্রবৃত্তির কামনা বাসনাকে প্রভূ বানিয়ে নিয়েছে আর জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তাকে গোমরাহীর মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন, তার দিলে ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং চোখে আবরণ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে তাকে হিদায়াত করতে পারে? তোমরা কি কোন শিক্ষা গ্রহণ করো না? সূরা জাসিয়াহ: ২৩
তোমাদের কাছে যে জ্ঞান এসেছে তা লাভ করার পর যদি তোমরা তাদের ইচ্ছা ও বাসনার অনুসারী হও, তাহলে নিঃসন্দেহে তোমরা জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।সূরা বাকারা: ১৪৫
মহান আল্লাহ নিজে সুন্দর এবং তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই যা আল্লাহ সুবহান দুনিয়ার জীবনে উপভোগ করার জন্য একটি নমুনা দেখিয়েছেন। আর জান্নাতটা তৈরি করেছেন এবং সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর মেহমানদের জন্য (জান্নাতী নর-নারী)। ভেবে দেখুন সেই দৃশ্য কি অপরুপ হতে পারে!
কিন্তু মহান রব বাড়াবাড়ি, সীমালঙ্ঘন ও অপব্যবহার পছন্দ করেন না। তাই নারী ও পুরুষকে পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি ও সুসজ্জিত থাকতে বলেছেন কিন্তু তা প্রদর্শন ও প্রতিযোগীতা করে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধরে নাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো। সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই, আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে। আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে। সূরা আনফাল: ১-২
আল্লাহ তায়ালা নারীর যে সকল সৌন্দর্য পুরুষদের হৃদয়কে আন্দোলিত করে তা জাহেলী যুগের মত প্রকাশ করে চলাফেরা করতে নিষেধ করেছেন।