মহান রাব্বুল আলামীন বলেছেন:
তারা যেন নিজেদের যে সৌন্দর্য তারা লুকিয়ে রেখেছে তা লোকদের সামনে প্রকাশ করে দেবার উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে মু’মিনগণ! তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তওবা করো, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে। সুরা আন-নূর: ৩১
এই আয়াতে বলা হয়েছে নারী এমনভাবে হাটবে না যেন তার পায়ের মল বা পায়ে পরিহিত অন্যান্য গহনারাজি এবং সেই স্থানটি সম্পর্কে গায়রে মাহরাম পুরুষ জেনে ফেলে। বোনেরা খেয়াল করুন যেখানে পায়ের মল বা নূপুর ইত্যাদির আওয়াজে পুরুষের ফিতনার ভয়ে পা ফেলার ক্ষেত্রেও নির্দেশনা এসেছে তাহলে ভেবে দেখুন নারীর মুখের সৌন্দর্যতো আরো মারাত্মকভাবে ফিতনার ক্ষেত্র।
একজন নারীর মুখমণ্ডল ও শরীরের অন্যান্য আকর্ষনীয় স্থানসমূহ ঢাকার মাধ্যমে পর্দা করা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় লজ্জাশীলতার পরিচায়ক। আর যে মহৎ গুনাবলী নিয়ে রাসূল সা: এই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন লজ্জাশীলতা তন্মধ্যে অন্যতম।
সাফিয়া বিনতে উবায়েদ রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বর্ণনা করেন, নবী সা:এর স্ত্রী উম্মে সালামা রা: রাসূল সা:কে জিজ্ঞাসা করলেন, যখন তিনি পরিধেয় বস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন, ইয়া রাসূলল্লাহ! নারীদের ইযার ব্যবহারের হুকুম কি? তিনি বললেন: তারা এক বিঘত নিচে পর্যন্ত ঝুলিয়ে পরতে পারে। উম্মে সালামা রা: বলেন, তাতেও তার কিছু অংশ খোলা থাকবে। তিনি বললেন: তবে এক হাত ঝুলিয়ে পরো; এর বেশী নয়।
আবু দাউদ: ৪১১৭
উক্ত হাদীসে মহিলাদের কাপড়ের ঝুল পায়ের নলা বা গোড়ালির নিচে একহাত ঝুলিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন যেন চলাচল, কর্ম বা সালাতের মাঝে পায়ের পাতা অনাবৃত না হয়। মুসলিম রমণীগন এভাবেই পোশাক পরিধান করতেন। তাঁদের পোশাকের নিম্নভাগ সবসময় মাটি স্পর্শ করতো বিধায় তাঁরা নাপাক হওয়ার ভয় পেতেন। এই বিষয়ে বিভিন্ন মহিলা সাহাবী রাসূল সা:কে প্রশ্ন করতেন। তিনি তাদেরকে পোশাকের নিম্নপ্রান্ত গোড়ালি পর্যন্তও উঁচু করতে অনুমতি দেননি। বরং কাপড় ভূলুণ্ঠিত করে হাঁটতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং পরবর্তী পাক মাটি পূর্বের নাপাকি দূর করবে বলে উল্লেখ করেছেন।
উম্মু সালামা রা: বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, পরের পাক মাটি এ নাপাকি পাক করে দেবে। আবু দাউদ, আস-সুনান: ১/১০৪
বোনেরা আমার, আজ আমাদের মেয়েরা যুগের সাথে তথাকথিত তাল দেয়ার নামে ইযার বা পাজামাকে উপরে উঠিয়ে ফেলেছে এবং পুরুষরা নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিচ্ছে-ভয়ানক শয়তানের ষড়যন্ত্র। যা আল্লাহ নিষেধ করেন তা করাবে এবং যা করতে বলেন তা করতে দিবে না-এটাই শয়তানের চ্যালেঞ্জ। আর আমরা মহান আল্লাহ তা’য়ালার নিয়ামত ভোগ করে তাঁর আদেশ মানার ব্যপারে কত প্রশ্ন/ সংশয়/দ্বিধা ইত্যাদি তৈরী করে শেষ পর্যন্ত শয়তানকে সুযোগ করে দেই জয়ী হতে। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের হেফাজত করুন।
রাসূল সা: বলেছেন: যুবতি মেয়েরা, কুমারী মেয়েরা এবং ঋতুবতী মেয়েরাও ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার জন্য বের হবে। তারা কল্যাণে (সালাতে) এবং মুমিনদের দু’য়ায় উপস্থিত থাকবে। তবে ঋতুবতীগণ সালাতের স্থান থেকে সরে থাকবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, যদি আমাদের কারো জিলবাব না থাকে? তিনি বলেন, তার বোন যেন তাকে তার জিলবাব পরিধান করতে দেয়। বুখারী: ৫৯৫, মুসলিম: ৬০৬
সালাতুল ঈদে অংশগ্রহনের জন্য নারীকে তাকিদ দেয়া সত্ত্বেও জিলবাব ছাড়া যাওয়ার কথা রাসূল সা: বলেন নি। বরং জিলবাব কারো কাছ থেকে নিয়ে হলেও ঈদগাহে যেতে বলেছেন।
আল্লাহ তা’লা আরো বলেছেন:
হে নবী, তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মু’মিন নারীদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের চাদরের প্রান্ত তাদের ওপর টেনে নেয়। এটি অধিকতর উপযোগী পদ্ধতি, যাতে তাদেরকে চিনে নেয়া যায় এবং কষ্ট না দেয়া হয়। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়। সূরা আহযাব: ৫৯
ইবনে আব্বাস রা: বলেন, “চিনে নেয়া যায়” এর অর্থ হচ্ছে, তাদেরকে এ ধরনের অনাড়ম্বর লজ্জা-নিবারণকারী পোশাকে সজ্জিত দেখে প্রত্যেক প্রত্যক্ষকারী জানবে তারা অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের পূত-পবিত্র মেয়ে, এমন ভবঘুরে, অসতী ও পেশাদার মেয়ে নয়, কোন অসদাচারী মানুষ যার কাছে নিজের কামনা পূর্ণ করার আশা করতে পারে।
“না কষ্ট দেয়া হয়” এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তাদেরকে যেন উত্যক্ত ও জ্বালাতন না করা হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে মা-বাবারাই ছেলে-মেয়েদের ছোটবেলায় তথাকথিত স্মার্ট দেখানোর নামে অশ্লীল, আঁটসাঁট, পাতলা পোশাক পড়িয়ে অভ্যাস করান, ফলে যখন এই সন্তানরাই বড় হয়েও সেই চিন্তা ধারাতেই পোশাক পড়ে মা-বাবার চোখের সামনে দিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়, তখন তারা লজ্জায়-কষ্টে চোখের পানি মুছেন আর আফসোস করতে থাকেন। এরপর যখন প্রেম, নেশা-ঘটিত ব্যপারে জড়িয়ে যায় সন্তানটি এবং এতো কষ্টের লালন করা সন্তানটি মা-বাবার সাথে অশোভন আচরণ করা শুরু করে তখন জীবন হয়ে উঠে আরো দুর্বিসহ। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই অবস্থা থেকে রক্ষা করুন।
এছাড়া এ আয়াত থেকে আপনা-আপনিই একথা প্রকাশ হয়ে যায় যে, এ নির্দেশ এমন সব মহিলাকে দেয়া হচ্ছে যারা পুরুষদের হাতে উত্যক্ত হবার এবং তাদের দৃষ্টিতে পড়ার ও তাদের কামনা-লালসার বস্তুতে পরিণত হবার ফলে আনন্দ অনুভব করার পরিবর্তে একে নিজেদের জন্য কষ্টদায়ক লাঞ্ছনাকর মনে করে, যারা সমাজে নিজেদেরকে বে-আবরু মক্ষিরাণী ধরনের মহিলাদের মধ্যে গণ্য করাতে চায় না।
আরব সমাজে মালিকানাধীন দাসী ও সম্ভ্রান্ত নারীর মধ্যে এবং মুমিন স্ত্রীলোক ও অমুসলিম নারীর মধ্যে পার্থক্য করা হয়ে থাকে এই জিলবাব ব্যবহার করে সম্পূর্ণ পর্দা করার মাধ্যমে।
সুগন্ধির ব্যবহার, কৃত্রিম চুল ও ভ্রু-প্লাক
মুসলিম মহিলা ঘরে সুগন্ধি ব্যবহার করবেন। পরিষ্কার সুন্দর করে পরিপাটি হয়ে থাকবেন নিজ ঘরে। নারী পুরুষ উভয়েই বাড়িতে তদের দাম্পত্য সাথীর জন্য সর্বোত্তম সাজগোজ ও সুগন্ধি ব্যবহার করে থাকবেন।
যদি কোন নারী বা পুরুষ বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করার জন্য সুগন্ধি দিয়ে বের হন তাহলে অবশ্যই গুনাহগার হতে হবে। আবু মূসা আশআ’রী রা: বলেন, রাসূল সা: বলেছেন:
যদি কোন মহিলা সুগন্ধি মেখে মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে, যেন মানুষেরা তার সুগন্ধ অনুভব করে, তবে সেই মহিলা ব্যভিচারিণী। তিরমিযী, আস-সুনান ৫/১০৬, আবু দাউদ, নাসাঈ
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন: যদি কোন নারী মসজিদে গমন করার সময় তার সুগন্ধি প্রসারিত হয় তবে আল্লাহ তার সালাত কবুল করবেন না, যতক্ষণ না সে তার বাড়িতে ফিরে যেয়ে গোসল করে।
বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/২৪৫
ভ্রু প্লাকের ব্যাপারেও হাদীসে এসেছে:
আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ রা: থেকে বর্ণিত।তিনি বলেন, যে নারী উলকি আঁকে এবং যে আঁকায়, যে নারী চোখের পাতা চেঁছে ফেলে এবং যে চাঁছায়, যে নারী সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য দাত চেঁছে সরু করে এর মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন সাধন করে-এদের উপর আল্লাহ তা’লা অভিশাপ করেছেন। মুসলিম: ৫৪১০
আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সব নারীর উপর লানত করেছেন, যারা অঙ্গে উলকি আঁকে এবং যে আঁকায় এবং সৌন্দর্যের জন্য ভ্রুর চুল উপড়িয়ে আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে।
তিরমিযী: ২৭১৯
উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা: বর্ণনা করেন, এক আনসারী মহিলা তাঁর মেয়ে বিয়ে দিল। অতঃপর সে রোগাক্রান্ত হলে তার চুল পড়ে যায়। মহিলাটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে আরজ করল, তার স্বামী চুল খুবই পছন্দ করে। আমি কি তাঁর মাথায় কৃত্রিম চুল লাগিয়ে দিব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে কৃত্রিম চুল লাগায় তাকে অভিশাপ দেয়া হয়েছে।
মুসলিম: ৫৪০৬
ইসলাম কখনোই মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় না। তাতে পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরতার ঘাটতি দেখা যায়। আজ সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পার্লারে যেয়ে যেভাবে শরীরকে সতর ছাড়া করা হয় তা একজন নারীর কাছেও লজ্জাজনক মনে হয়। শালীনতা থাকে না বললেই চলে। আয়েশা রা: যেমন ছিলেন স্লীম ফিগারের তেমনি ছিলেন দুধে আলতা রঙধারিণী। কিন্তু সম্মানীতা উম্মুল মু’মিনীন পবিত্র ও শালীনতার জীবন যাপন করেছেন। যেদিন রাসূল সা: তাঁর সঙ্গে রাত্রি যাপন করতে আসতেন তিঁনি সেদিন নববধূর মত পরিপাটি হয়ে থাকতেন।
আমাদের এই দুনিয়ার জীবনে সে আদর্শকে আমলে নেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজ পরিবার ব্যবস্থাতে যেভাবে কোন্দল চলে আসছে তার একটি কারণ দাম্পত্য জীবনে ইসলামের অনুসরণ না করা, পর্দার নীতি না মেনে চলা।