যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ হলো আরাফার দিন। এই দিনটি হজ্জ আদায়ের জন্য যারা আরাফার ময়দানে আছেন এবং যারা গমন করেননি-সকল মুসলিমদের জন্যই একটি মর্যাদাপূর্ণ দিন। কারণ এই দিনে বিশ্বমুসলিমের প্রতি আল্লাহ তা’য়ালা তার নিয়ামত ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ ঘোষনা করেন।
মহান আল্লাহ বলেছেন,
আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাংগ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম। সূরা আল মায়িদা: ০৩
ইহুদীরা উমর রা. কে বললো যে, আপনারা এমন একটি আয়াত তিলাওয়াত করে থাকেন যে, যদি সেই আয়াতটি আমাদের উপর নাযিল হতো তাহলে আমরা সেই দিনটিকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করতাম। উমর রা. এ কথা শুনে বললেন, আমি জানি কখন তা অবতীর্ণ হয়েছে, কোথায় তা অবতীর্ণ হয়েছে, আর অবতীর্ণ হওয়ার সময় রাসূল স. কোথায় ছিলেন। হ্যা, সেই দিনটি হল আরাফার দিবস। আল্লাহর শপথ! আমরা সেদিন আরাফার ময়দানে ছিলাম। আর আয়াতটি হলো, “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাংগ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম”।
সহিহ বুখারী: ৪৬০৬
আরাফাহ দিবস হল এক মর্যাদাসম্পন্ন দিন। এ দিনটি অন্যান্য অনেক ফজিলত সম্পন্ন দিনের চেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী। যে সকল কারণে এ দিবসটির এত মর্যাদা তার কয়েকটি নীচে আলোচিত হল :
১। ইসলাম ধর্মের পূর্ণতা লাভ, বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিন
আল কুর’আনে এসেছে,
আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাংগ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম। সূরা আল মায়িদা: ০৩
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে রজব রহ. সহ অনেক উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে এ আয়াত নাজিলের পূর্বে মুসলিমগণ ফরজ হিসেবে হজ আদায় করেননি। তাই হজ ফরজ হিসেবে আদায় করার মাধ্যমে দ্বীনে ইসলামের পাঁচটি ভিত্তি মজবুত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল। লাতায়েফুল মাআরেফ : ইবনে রজব, পৃ-৪৮৬
২। এ দিন হল ঈদের দিন সমূহের একটি
আবু দাউদ সাহাবি আবু উমামাহ রা. থেকে বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : আরাফাহ দিবস, কোরবানির দিন, ও আইয়ামে তাশরীক (কোরবানি পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলামের অনুসারীদের ঈদের দিন। আর এ দিনগুলো খাওয়া-দাওয়ার দিন। সহিহ সুনানে আবু দাউদঃ ২১১৪
ইতিপূর্বে আলোচিত উমর রা. বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রা. বলেন : সূরা মায়েদার এ আয়াতটি নাজিল হয়েছে দুটো ঈদের দিনে। তাহল জুমআর দিন ও আরাফাহ দিবস।সহিহ সুনানে তিরমিজিঃ ২৪৩৮
৩। আরাফাহ দিবসের রোজা দু বছরের কাফ্ফারা
সাহাবী আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ স.-কে আরাফাহ দিবসের সওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ইহা বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
সহিহ মুসলিমঃ ১১৬৩
৪। আরাফার দিন গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন
হজ্জ আদায়ে যারা মক্কায় অবস্থিত তারা মীনা থেকে এসে আরাফাতের সীমায় অবস্থান করবে। ৯ই জিলহজ্জ সূর্যোদয়ের পর হাজীগন মীনা হতে আরাফার দিকে রওয়ানা দিবেন এবং সূর্য ঢলা পর্যন্ত নামীরা নামক ময়দানে অবস্থান করাটা সুন্নাত, যদি তা সহজসাধ্য হয়। যেখানেই অবস্থান করুন কিবলামুখী হয়ে বসবেন। সম্ভব হলে জাবালে রাহমাত নামক পর্বতকে সামনে রেখে কিবলামুখী হয়ে বসবেন।
এই দিনে মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য তাঁর অনুগ্রহের দ্বার খুলে দেন। ফেরেশতাদের নিকট বান্দাদের আনুগত্য ও নিজের গৌরব প্রকাশ করেন। এই দিনে বেশী সংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন।
তাই এই স্থানে আমাদের করণীয় আল্লাহ তা’আলার যিকর, হাত তুলে কান্না-কাটি করে দু’আ করা নিজের জন্য, পিতা-মাতা, পুত্র কন্যা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সবার জন্য, নিজেদের সর্বপ্রকার পাপ এবং ভুল-ত্রুটি হতে তাওবাহ ইসতিগফারের মাধ্যমে শয়তানকে হেয় ও উদ্বিগ্ন করে তোলা। সূর্যাস্ত পূর্ব পর্যন্ত এইভাবে আল্লাহর কাছে ধরনা দিতে হবে। সূর্যাস্তের পর মুযদালিফার দিকে রওয়ানা দিতে হবে। এ সময় বেশী করে তালবিয়া পড়তে হবে যেহেতু রাসূল স. করেছেন।
এছাড়া লাব্বাইকা উচ্চারণ সহ কুর’আনের তিলাওয়াত করাও উত্তম।
এই আরাফাতে অবস্থানই হজ্জের মূল কাজ। রাসূল স. বলেছেন-শ্রেষ্ঠ দু’আ হচ্ছে এই দিবসের দু’আ।আমি এবং নবীগণ কর্তৃক উচ্চারিত শ্রেষ্ঠতম কথা হচ্ছে: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ইউহয়ী ওয়া ইয়ূমীতু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। সহিহ আল বুখারী, মুসলিম
এই শ্রেষ্ঠ দু’আটি বেশী বেশী পড়া সুন্নাত, এর অর্থ হলো-
“আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। সমস্ত রাজত্ব একমাত্র তাঁরই অধিকারভুক্ত। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তাঁর প্রাপ্য। তিনিই জীবিত করেন, তিনি মৃত্যু প্রদান করেন। আর তিনি সব বস্তুর উপর সর্বশক্তিমান।“
রাসূল স. বলেছেন-
আল্লাহর নিকট চারটি কালাম সর্বাধিক প্রিয়। তা হচ্ছে, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার।
দু’আগুলো অন্তরে ভয়-ভীতি এবং নরম দিলে খুব বেশী করে মনোযোগ সহকারে পাঠ করতে হবে। রাসূল স. দু’আগুলো তিনবার করে পড়তেন।
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, আরাফার দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কি চায় ? সহিহ মুসলিম-১৩৪৮
ইমাম নবভী রহ. বলেন, এ হাদিসটি আরাফাহর দিবসের ফজিলতের একটি স্পষ্ট প্রমাণ।
ইবনে আব্দুল বির বলেন, এ দিনে মোমিন বান্দারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। কেননা, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন গুনাহগারদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন না। তবে তওবা করার মাধ্যমে ক্ষমা-প্রাপ্তির পরই তা সম্ভব। হাদিসে আরো এসেছে: আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলে কারীম স. বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরাফাতে অবস্থানকারীদের নিয়ে আসমানের অধিবাসীদের কাছে গর্ব করেন। বলেন, আমার এ সকল বান্দাদের দিকে চেয়ে দেখ ! তারা এলোমেলো কেশ ও ধুলোয় ধূসরিত হয়ে আমার কাছে এসেছে। আহমদ ও হাকেম, হাদিসটি সহিহ