প্রেক্ষাপট-১
ডাক্তার বা চিকিৎসক ও রোগীর অবস্থান
ক হাসপাতালে একজন ডাক্তার আছেন যিনি খুব নামাজী এবং সুন্নাতী দাঁড়ী এবং লেবাস খুব ভদ্র এবং সে নিজেকে প্র্যাক্টিসিং মুসলিম বলে থাকেন এবং পরহেজগার লোকদের সাথেই উঠা বসা করেন বেশী অথচ সে সকালে সকলের আগে এসে হাসপাতালে হাজিরা দিয়ে চলে যান অন্য জায়গায় প্র্যাকটিস করতে আবার বেলা ২টার দিকে চলে আসেন, এর মাঝে তাকে কাজের জন্য পাওয়া যায় না। এইভাবেই প্রায়ই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন দুটি জায়গায় মানুষের সেবা দেয়ার ভূমিকা রেখে। এইক্ষেত্রে একজায়গায়(হাসপাতালে) সে যে চুক্তি করেছিল, যার বিনিময়ে মাসের শেষে বেতন উত্তোলন করে থাকেন, সেখানে ফাঁকি দিয়ে অতিরিক্ত আরো কিছু টাকা লাভের প্রত্যাশায় অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছেন ডাক্তার হিসেবে ভূমিকা রাখার জন্য। একবারও কি মনে হয় নি যে মাসের শেষে এই টাকা তার জন্য কতটা হালাল? চুক্তি অনুযায়ী সে আমানত ওয়াদার ভংগকারী হয়ে চলেছেন।
এইরকম চুক্তিবদ্ধ চাকরীতে যা করনীয় অনেকেই অবলীলায় সেই করনীয় ঘাটতি রেখে ব্যক্তিগত কাজ করে সময় পার করেন যা মাসের শেষে আয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।
ডাক্তার প্রফেশন অত্যন্ত গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয় যা একদিকে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থ্যতার পাশাপাশি দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার সুযোগ রয়েছে। এত বড় একটি মহান হালাল পেশা যা দিয়ে মহান রবের সন্তুষ্টি পাওয়া আরো সহজ। আমাদের সমাজে অনেক ডাক্তারই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে থাকেন আলহামদুলিল্লাহ। মহান রবের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য যে জ্ঞান প্রয়োজন এই প্রফেশনে একটু চিন্তা গবেষনা করলেই সেটা আয়ত্ত্বে আনা সহজ। মানুষের প্রতি এহসানের ভূমিকাও অনেকে রেখে থাকেন নিজের বিবেকের কারনে।
কিন্তু দেখা যায় কিছু ডাক্তার জেনে বা না জেনে বুঝে বা না বুঝে কিছু ত্রুটিযুক্ত ভূমিকা রাখার কারনে ভালো কাজের প্রতিদান উত্তমের জায়গায় গুনাহকেই লিখে নেন। এখানে কিছু দূর্বলতা বা লক্ষ্যনীয় দিক তুলে ধরা হলো শুধুমাত্র সতর্ক হয়ে সংশোধন হবার জন্য যেন দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন সফল হয়, জাহান্নাম থেকে মুক্ত হতে পারেন।
দেখা যায় অনেকেই জেনে বা না জেনে সঠিক নিয়ত না থাকায় ও কিছু অনৈতিক ভূমিকা দিয়ে জীবনের এই আয়ের খাতকে হালাল আছে কি না প্রশ্নবিদ্ধ করে নিচ্ছেন। অনেকেই উল্লেখিত ঘটনার ডাক্তারের মতোই রোজগার করে যাচ্ছেন আর মাসের শেষে হারাম টাকা নিয়ে খুব খুশী থাকছেন। একটুও কি তাদের মহান রবের কাছে জবাবদীহিতার কথা মনে পড়ে না?
আবার অনেক ডাক্তার চাকরীর চুক্তিবদ্ধ সময়ে রোগীর ইতিহাস শুনা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা না করেই কিছু কমন ঔষধ দিয়ে দেন, দেখা যায় এন্টিবায়োটিক লাগবে না কিন্তু রোগীর কথা শুনার জন্য এতো সময় না দিয়ে প্রেশক্রিপশন লিখে ছেড়ে দেন। তাহলে এই রোগীর পরবর্তী জটিলতার জন্য কে দায়ী। আবার অনেকে জেনেশুনে ঔষধ কোম্পানীদের কাছ থেকে কিছু কমিশন বা উপহার পাওয়ার জন্য নিম্নমানের ঔষধ লিখে দিচ্ছেন। একবারও কি মনে হয় না এই রোগীটি যদি নিজের পরিবারের আপন কেউ হতো তাহলে কি এই কাজটি করতে পারতেন? আবার অল্প খরচে সঠিক চিকিৎসা হাসপাতালে দেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেকে নিজের প্র্যাক্টিসের বা ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেন।
অনেক ডাক্তার আছেন যারা কলিগদের নিয়ে বা মোবাইল নিয়ে আসরে মেতে থাকেন, কিন্তু রোগীর একটু বিস্তারিত ভাবে সমস্যা শুনা এবং এই নিয়ে একটু কো-রিলেট করে পরামর্শ দেয়ার মত ধৈর্য রাখেন না বা সময় দিতে চান না, বিশেষ করে যদি কোন গরীব রোগী হয়ে থাকে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী হাসপাতালের সময়টুকু পুরোটাই কিন্তু রোগীর জন্য বা চুক্তিবদ্ধ কাজের জন্য। মহান রবের সামনে প্রতিটি দায়িত্বে্র জবাবদিহীর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
রাসূল(সঃ) এর সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে নিজের জন্য যা পছন্দ করেন অপরের জন্য তা না করলে সে পূর্ণ ঈমানদার না। এই হাদীসটি অত্যন্ত জরুরী কারন তা ঈমানের সাথেই সংশ্লিষ্ট।
বিশেষ করে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বেসরকারী ক্লিনিক বা হাসপাতালে মিথ্যা বা প্রতারনা করে টাকা নিচ্ছেন। এক রোগী একবার ঢাকার একটি হাসপাতালে আসেন চিকিৎসার জন্য তখন আল্ট্রাসনোগ্রাম করে সনোলজিষ্ট বললো আপনার পিত্ত ভালো আছে, তখন রোগী শুনে বলে- আমিতো ৬মাস আগে অপারেশন করেছি, আমার পিত্তে নাকি পাথর ছিলো তাই ওটা ফেলে দিয়েছে। তখন সেই রোগী কাগজ পত্র দেখালো, কিন্তু তাতে কি অপারেশন করেছে তা লেখা নেই। কিন্তু তার শরীরে অপারেশনে কাটা দাগ আছে। এইভাবে অনেকেই প্রতারিত হচ্ছেন। এই প্রতারনা করে ডাক্তার যা উপার্জন করছে তা হলো জাহান্নামের জায়গাটা বরাদ্দ করা।
কিছু প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিক আছে যেখানে চাকরী করতে গেলে মালিকের সাথে কিছু চুক্তিবদ্ধ হতে হয় যা কিছু অবৈধ চুক্তি সেক্ষেত্রে এই চাকরীতে মোটা অংকের বেতন লাভে যোগ দিয়ে আর সেই অবৈধ কাজে সহযোগীতা করার গুনাহ জমাতে থাকেন।
আবার অনেকে চারিত্রিক অশ্লীলতার শিকার হোন। একজন পুরুষ ডাক্তারের কাছে নারী রোগী তখনই যাবে যখন কোন মহিলা ডাক্তার না থাকেন। যদি বাধ্য হয়ে পুরুষ ডাক্তারের কাছে যেতেই হয় তবে শরীয়ত যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু শরীরের অংশ দেখাবে এবং অবশ্যই সেখানে রোগীর মাহরাম বা নার্স থাকতে হবে।
পুরুষ বা নারী যে ডাক্তারই হোন না কেনো যখনই বিপরীত লিংগের রোগী আসবে তখন আরেকজন নার্স বা রোগীর সাথে আসা অভিভাবককে সাথে অবশ্যই রাখা শরীয়ত নির্দেশ দেয় কারন একজন নারী ও একজন গায়ের মাহরাম একা একস্থানে নির্জনে থাকলে সেখানে তৃতীয়জন হয় শয়তান। তাই রোগী ডাক্তার উভয়কেই সচেতন হয়ে শরীয়তের নিয়ম রক্ষা করে চলতে হবে।
আবার কথা বলার ক্ষেত্রেও অপ্রাসঙ্গিক গল্প করে দেখা যায় ডাক্তার ও রোগীর মাঝেও অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। অনেক পুরুষ/নারী রোগী আছেন যারা দীন সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন না বা দীনের পথে চলার আগ্রহ নেই তারা একজন প্র্যাক্টিসিং মুসলিম ডাক্তারের কাছে গিয়ে অতিরিক্ত আবেগপ্রবন কথা বলতে থাকেন। আর ডাক্তার প্রয়োজন না থাকলেও গায়ে হাত দিয়ে কেনো দেখলোনা তার পর্যালোচনা করে থাকেন। এই ধরনের রোগীদের খুশি করার জন্য অনেক ডাক্তার অপ্রয়োজনীয় কথা ও গায়ে হাত দিয়ে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার ভাব দেখিয়ে থাকেন-এটা ব্যক্তির কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। ঠিক তদ্রুপ পুরুষ রোগীও নারী ডাক্তারের কাছে গিয়ে এই ধরনের অনাকাঙ্খিত অবস্থা সৃষ্টি করেন।
অনেক নারী ডাক্তার আছেন যারা হিজাবের কিছু অংশ মানেন অর্থাৎ বাহ্যিক ড্রেসের দিক দিয়ে মানেন কিন্তু কথা বার্তায় চলাফেরায় বেপর্দা নারীদের মতোই বরং কোন কোন ক্ষেত্রে একটু বেশী কারন তারা ভাবেন আমিতো পর্দা করছি আমার গায়ের মাহরাম কলিগের সাথে একটু গল্প-গুজব করলে অসুবিধা নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত সম্পর্ক গড়ে উঠে, এইভাবেই খারাপ কাজের ফলে সমাজে অনেকগুলো পরিবার ভেঙ্গে গিয়েছে।
পরিবার ভাংগা বা না ভাঙ্গার চেয়ে বড় কথা এখানে ব্যক্তি মহান রবের নিষেধবানীকে অগ্রাহ্য করছে যা অত্যন্ত বড় ধরনের গুনাহ।
ডাক্তার ও নার্সদের মাঝেও অনেক সময় অনৈতিক সম্পর্কের ঘটনা দেখা দেয় এর কারন হলো শরীয়তের নিয়ম উপেক্ষা করে অতিরিক্ত কথা আদান প্রদান করাচ এবং শরীয়তের পর্দা না মেনে চলা।
রাসূল স. বা সাহাবাদের জীবনের ইতিহাসে কোথাও হিজাবের কাপড় ধারন করে এইভাবে গায়ের মাহরামের সাথে গল্পেতো মেতে থাকার প্রশ্নই আসেনা বরং প্রয়োজনীয় ফিকাহ জানতে আসলে পর্দার আড়াল থেকে প্রয়োজনীয় কথাটুকু বলে দিতেন।
আবার অনেকে দুনিয়ার খ্যতি যশকে প্রাধান্য দিতে যেয়ে প্রমোশন লোভী হয়ে দেখা যায় নিজের কলিগের সাথে অন্যায় আচরন এবং বসকে খুশি করার জন্য অনৈতিক অবস্থার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠিত হন না। জীবন ক্ষনস্থায়ী, কবরে এই খ্যতি যশ যাবে না কিন্তু কোন পদ্ধতিতে জীবনের চাঁকা ঘুড়িয়ে চলেছেন তার জন্য জিজ্ঞাসিত হতে হবে।
আসলে সবসময় যদি নিজের অন্তরে আল্লাহভীতি নিয়ে কেউ চলে তাহলেই কখন কোথায় কতটুকু করা আমার জন্য শরীয়ত অনুমোদন করে তা স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে। যে কাজ বা কথা কেউ দেখে ফেলুক বা জানুক তা নিয়ে বিচলিত হতে হয় বুঝতে হবে সেই কাজ বা কথা গুনাহের দিকে নিয়ে যেতে পারে। শরীয়তকে উপেক্ষা করে যেকোন কল্যানমূলক কাজই ব্যর্থ বলে প্রমানিত হবে। হয়তো সাময়িকভাবে তা বুঝা যায় না। এই ধরনের অবস্থায় প্রবৃত্তি ও শয়তানের ধোঁকাকে বুঝে, এদের আনুগত্য থেকে দূরে থাকতে হবে।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল(সঃ)-কে দু’টি বিষয়ের কোন একটি গ্রহনের এখতিয়ার দেয়া হলে এবং তা গোনাহের কাজ না হলে যেটি সহজতর তিনি সেটি গ্রহন করতেন। যদি গোনাহের কাজ হতো তবে তিনি তা থেকে সবার চেয়ে বেশী দূরে অবস্থান করতেন। রাসূল(সঃ) কোন ব্যপারে নিজ স্বার্থে কখনো প্রতিশোধ গ্রহন করেননি। তবে আল্লাহর কোন নিষেধাজ্ঞা প্রকাশ্য লংঘন হলে তিনি তখন আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রতিশোধ নিতেন। বুখারী-কিতাবুল আদাব: ৫৬৮৬
রাসূল স. বলেছেন, লজ্জার অধিকার আদায় করে আল্লাহর কাছে যথার্থভাবে লজ্জিত হও। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর প্রতি আমাদের লজ্জাবোধ আছে। নবী (সঃ) বলেন, লজ্জা বলতে তা বুঝায়না। আল্লাহর কাছে লজ্জাবোধের মানে হলো “ মাথা-মস্তিষ্কের চিন্তা শক্তি এবং পেটকে হেফাজত করা, মৃত্যু ও ধ্বংসের কথা স্মরন করা এবং পরকালের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তি দুনিয়ার সৌন্দর্যকে ত্যাগ করে আখেরাতকে ইহকালের উপর অগ্রাধিকারই আল্লাহর প্রতি যথার্থ লজ্জাবোধ (তিরমিযী)
একজন ডাক্তারকে মনে রাখা প্রয়োজন যে এই প্রফেশন যোগ্যতাকে পুরুপুরি মহান রবের সন্তুষ্টির জন্যই বাস্তবে আমল করতে হবে যদি বিনিময় পেতে চান,আর তাই অত্যন্ত সবরের সহিত একটু বেশী পরিশ্রমী হয়েই কাজ করে যেতে হবে যা অনেক ক্ষেত্রেই চুক্তির সময়ের বাইরেও হতে পারে,সঠিক জ্ঞান দিয়েই চিকিৎসা করতে হবে, নিজের এই প্রফেশনের জ্ঞানার্জনে ফাঁকি দিলেও সেটার জন্য রোগীর ক্ষতি হলে মহান রবের কাছে জবাবদিহীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদের তাঁর নির্দেশনার উপর আমল করার দৃঢ় অন্তর দান করুন।