পরিকল্পিত জীবনে প্রবেশ-১

 

জীবনটাকে আমরা অনেক সুন্দর  উন্নত ও স্বার্থক হিসেবে পেতে চাই যেখানে থাকবে শান্তি,আনন্দ,স্বস্তি,তৃপ্তি। আরো থাকবে সম্মান ভালোবাসা। আমরা অনেকেই জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছি। এটাও সত্যি আমরা প্রত্যকেই চাই সেইভাবে জীবনের সময়গুলোকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর খাস বান্দাহ হতে। জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যারা এখনও জানেন নি তাদের জন্য অবশ্য এই পরিকল্পিত জীবনে প্রবেশ করা কঠিন ও অবাস্তব মনে হতে পারে।

আজ বাস্তব সমাজের সাথে নিজেদের ঈমানিয়াত ঠিক রেখে চলার অবস্থা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু তাই বলেতো আখেরাতের জবাবদিহীতা থেকে পার পেয়ে যাবো না। আমাদের সেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। প্রথম মঞ্জিল কবরের অবস্থা নিয়েই চিন্তা করিনা একটু।

জীবন ক্ষণস্থায়ী। আমরা যতই মনে করি না কেন যে আরো অনেক বছর বেঁচে থাকবো বা বিভিন্ন চাওয়া পাওয়ার মাঝে সাময়িক ভুলে থাকি যে, আমাকে যে কোন মুহূর্তে চলে যেতে হবে এই সুন্দর মায়াময়ী সংসার ও মনভুলানো দুনিয়া থেকে। মহান আল্লাহ বলেছেন:

তোমরা যেখানেই থাকো না কেন মৃত্যু (এসে) তোমাদের গ্রাস করবেই, এমনকি তোমরা যদি (কোনো) মজবুত দুর্গেও থাকো (সেখানেও মৃত্যু এসে হাযির হবে)। সূরা আন নিসা: ৭৮

কোন প্রাণীই আল্লাহর (সিদ্ধান্ত ও) অনুমতি ছাড়া মরতে পারে না, (আল্লাহ তা’লার কাছে প্রত্যেকটি প্রাণীরই মৃত্যুর) দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট। সূরা আলে ইমরান: ১৪৫

সঠিকভাবে তাওবা ও ইস্তেগফার করার পর নিজেকে দীনের পথে ভালো কাজের দিকে ধরে রাখার জন্য যা প্রয়োজন সেই দিক নির্দেশনা পাওয়ার জন্য নিচের আয়াত ও হাদীস নিয়ে একটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন। “ পরিকল্পিত জীবনে প্রবেশ করি”এই বার্তা নিয়ে এগুতে থাকি।

মহান আল্লাহ বলেছেন-

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর দরবারে নৈকট্য লাভের উপায় অনুসন্ধান করো এবং তাঁর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনা করো, সম্ভবত তোমরা সফলকাম হতে পারবে।  আল মায়েদাহঃ ৩৫

যারা ঈমানের দাবী করেন তাদের সফলতার পথ বাতলে দিয়েছেন মহান প্রতিপালক, আর সেই পথের দিশা পেতে হলে প্রয়োজন-

ক) মহান আল্লাহকে ভয় করা(তাকওয়া অর্জন)

খ) মহান রবের নৈকট্য বা প্রিয় বান্দা হওয়ার উপায় অনুসন্ধানে লেগে থাকা

গ) মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে সেই উপায় উপাদানে স্থির থেকে অন্যকেও আহবান করা।

এই কাজগুলো করার পর পরবর্তী করনীয় দেখি নিচের আয়াতের আলোকে, আর তা হলো-

হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তিই যেন খেয়াল রাখে যে, সে আগামী দিনের জন্য কি ব্যবস্থা রেখেছে। আর তোমরা ভয় করো আল্লাহ তা’লাকে। আল্লাহ নিশ্চিতই তোমাদের সেই সব আমল সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা করতে থাকো। তোমরা সেই লোকদের মত হয়ে যেও না যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা বানিয়ে দিয়েছেন। এসব লোকেরাই ফাসেক। সুরা আল হাশর: ১৮-১৯

এখানেও যা করনীয় তা হলো-

ক) মহান আল্লাহকে ভয় করা

খ) আত্মপর্যালোচনা করা যে, সফলতার কাজগুলো কতটুকু করা প্রয়োজন,কতটুকু করা হচ্ছে, সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা এবং সফলতাকে ব্যর্থতায় রুপান্তরিত করার মত কাজ হয়ে যাচ্ছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন হয়ে

পরিকল্পিত জীবনে আসা।

গ) আবারো মহান রবের ভয় করা, সঠিক পর্যালোচনা দিয়ে নিজেকে উত্তোরত্তোর ঈমান ও আমলিয়াতে উন্নীত করা

ঘ) সকল আমল সম্পর্কেই মহান আল্লাহ অবগত আছেন। গোপন প্রকাশ্য সবই লেখা হয়ে যাচ্ছে আমলনামায়।

ঙ)  ফাসেকরাই আত্মভোলা।  আত্মভোলা থেকে নিজেকে হেফাজত করতে হলে মহান আল্লাহকে স্মরন রাখতে হবে প্রতিটি সময়।

মূল বিষয় হলো মহান রবের ভয় অন্তরে জাগ্রত রাখা, আর জানোতো আপুরা এই ভয় হলো ভালোবাসার আরেকপিঠ। মহান আল্লাহকে ভালোবাসলেই তাঁর অপ্রিয় কাজ যেন না হয় সেই ভয় থাকাটাই ভালবাসার দাবী।

মহান রবের পূর্ণ আনুগত্যে নিজেকে স্থীর রাখতে চাইলে ও বাস্তবতায় সেইভাবে উদ্যোগ নিলে আল্লাহই সকল সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেন ও অন্তরে সন্তুষ্টি বা তৃপ্তি দিয়ে দেন। আর তাই দেখা যায়–

রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

আল্লাহ তা’লা বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি নিজেকে আমার ইবাদাতের জন্য মুক্ত করে দাও, আমি তোমার বক্ষকে ঐশ্বর্য ও অভাবহীনতা দিয়ে পূর্ণ করে দিব। তোমার দারিদ্র ও অভাব দূর করে দিব। আর যদি তা না করো, তবে আমি তোমার অন্তরকে ব্যস্ততা দিয়ে পূর্ণ করবো এবং তোমার দারিদ্র দূর করব না।  আল জামে আত তিরমিযী ও ইবনে মাজা

মানুষের আজকের অতৃপ্ত আত্মার অস্থিরতার কারনই হলো নিজেকে মহান আল্লাহর আনুগত্যে পরিপূর্ণভাবে সঁপে না দিয়ে নিজের ও সমাজ ব্যবস্থার কাছে আংশিক রেখে দিয়ে আসা। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন সময় ও অবস্থা একরকম থাকে না, সেকেন্ড করে করে এগিয়ে যাচ্ছে দুনিয়ার শেষ পরিনতির দিকে। হাদীসে উপলব্ধির মাধ্যমে সচেতন হওয়ার জন্য বলা হয়েছে–

৪। রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব প্রদান করতে শিখিয়েছেন:

ক। বার্ধক্য আসার আগে যৌবনকে

খ। রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে

গ। দারিদ্র আসার পূর্বে স্বচ্ছলতা।

ঘ। ব্যস্ত হয়ার পুর্বে অবসর সময়কে।

ঙ। মৃত্যু আসার পূর্বে জীবনকে।                  মিশকাত শরীফ

এই জীবনের মূল লক্ষ্য কি হবে ? জীবনের চাওয়া পাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু কি হওয়া প্রয়োজন, সেটাও মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন আর তা হলো-

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহ‌কে ভয় করো। মুসলিম থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়। আলে ইমরানঃ ১০২

এখানে মহান রবের প্রতি যথাযথ ভয় রাখা দিয়ে প্রতিটি ব্যক্তির যার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ভয় করার আদেশ করেছেন যেন ভালো কাজে এগিয়ে যাওয়া ( আল্লাহর আদেশ সমূহ) ও অন্যায়

কাজ(আল্লাহর নিষেধ সমূহ) থেকে দূরে থাকা সম্ভব হয়।

رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা ঈমান এনেছি, কাজেই আমাদের গোনাহ ক্ষমা করে দাও আর আমাদেরকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা কর। সূরা আলে ইমরানঃ ১৬

رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا ۚ رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ

হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিশ্চিতরূপে শুনেছি একজন আহবানকারীকে ঈমানের প্রতি আহবান করতে যে, তোমাদের পালনকর্তার প্রতি ঈমান আন; তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের পালনকর্তা! অতঃপর আমাদের সকল গোনাহ মাফ কর এবং আমাদের সকল দোষত্রুটি দুর করে দাও, আর আমাদের মৃত্যু দাও নেক লোকদের সাথে। সূরা আলে ইমরানঃ ১৯৩

“Our Lord! we have heard the call of one calling (Us) to Faith, ‘Believe ye in the Lord,’ and we have believed. Our Lord! Forgive us our sins, blot out from us our iniquities, and take to Thyself our souls in the company of the righteous.

رَبَّنَا وَآتِنَا مَا وَعَدْتَنَا عَلَىٰ رُسُلِكَ وَلَا تُخْزِنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ

হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে দাও, যা তুমি ওয়াদা করেছ তোমার রসূলগণের মাধ্যমে এবং কিয়ামতের দিন আমাদিগকে তুমি অপমানিত করো না। নিশ্চয় তুমি ওয়াদা খেলাফ করো না। সূরা আলে ইমরানঃ ১৯৪

لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۚ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ ۗ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ ۖ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا ۚ أَنْتَ مَوْلَانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ

আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার উপর বর্তায় যা সে করে।

হে আমাদের পালনকর্তা, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি, তবে আমাদেরকে অপরাধী করো না।

হে আমাদের পালনকর্তা! এবং আমাদের উপর এমন দায়িত্ব অর্পণ করো না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর অর্পণ করেছ, হে আমাদের প্রভূ! এবং আমাদের দ্বারা ঐ বোঝা বহন করিও না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নাই। আমাদের পাপ মোচন কর। আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের কে সাহায্যে কর।

আবার ঘুরে ঘুরে রামাদান চলে আসলো বলে, আমরা কি পরিকল্পিত জীবনে প্রবেশ করেছি?

গত রামাদান কি আমার জীবনে এমন কোন পরিবর্তন এনে দিয়েছে যা মহান রবের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে?

কোন ভালো কাজকে আগামীদিনের জন্য ফেলে না রেখে কল্যানের কাজ নিজের হাতে করে যাওয়াটাই অগ্রে পাঠিয়ে দেয়া আমল।

সময়, জীবনের অপর নাম সময়। জীবনকাল সীমাবদ্ধ।

“তিনি সূর্যের আলোক আর চাঁদ কে আলোকময় করেছেন এবং

কক্ষপথ ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,যাতে করে তোমরা বছর ও

তারিখ গননা করতে পারো।আল্লাহ সবকিছু সঠিকভাবে সৃষ্টি করেছেন।

তিনি জ্ঞানীদের জন্য নিজের নিদর্শন বিশদভাবে বর্ননা করেন।            সূরা ইউনুস-৫-৬

এভাবেই সূর্য চলছে, পৃথিবী চলছে,আর আমাদের নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে-কিয়ামতের দিকে।

“প্রত্যেক ব্যক্তিকেই মরতে হবে।”  সূরা আনকাবুত-৫৭

“আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ মরতে পারবেনা। প্রত্যেকের মৃত্যুর সময়টি সুনির্দিষ্ট রয়েছে।”     আলে ইমরান-৬৮

“আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি তোমাদের মৃত্যু দেন।

আর তোমাদের কাউকে কাউকেও নিকৃষ্টতম বৃদ্ধ বয়সে পৌছে দেয়া হয়।

তখন সবকিছু জানার পরও যেনো কিছুই জানে না।”        সূরা আন নাহল-৭০

“বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য হলো তার সময়কে ভাগ করে নেয়া। কিছু সময় ব্যয় করবে তার আল্লাহর কাছে একান্ত প্রার্থনায়, কিছু সময় আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল বিষয়ে চিন্তা করা, কিছু সময় রাখবে আত্মসমীক্ষার জন্য, আর কিছ সময় ব্যয় করবে জীবিকার প্রয়োজনে।–(ইবনে হিব্বন)”

তাই চলুন সাদা কাপড়ে নিজেকে মুড়ানোর আগে সময়কে কাজে লাগাই কারন-

“হে লোকেরা! তোমাদের সর্বশক্তি্মান প্রভু আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার কাজ করো এবং সেইদিনটিকে ভয় করো, যেদিন কোন পিতা তার সন্তানের কোনোই উপকারে আসবে না,আর সন্তান ও পিতার কোনো উপকারে আসবে না। আল্লাহর প্র্রতিশ্রুতি সত্য।সু্তরাং দুনিয়ার জীবন যেনো তোমাদের প্রতারিত না করে।আর বড় প্রতারক শয়তান যেনো তোমাদের প্রতারিত না করে।” সূরা লোকমান-৩৩