রজব থেকে রামাদান ডায়েরী-১৫ (ঈদে করণীয় ও বর্জনীয়)

 

আরবীতে ঈদ শব্দের সাধারন অর্থ হচ্ছে এমন সম্মেলন যা বার বার ফিরে আসে চাই তা সপ্তাহে মাসে বা বছর ঘুরে ফিরে আসুক।

দীর্ঘ একমাসের সংযম অনুশীলনের পর মানুষের আনন্দ উৎসবের জন্য এই দিনটিকে নির্ধারণ করেছেন। বিগত একমাসের ত্যাগের ও নিয়মানুবর্তিতার কঠোর সাধনার পর মহান আল্লাহর কাছে পুরস্কার প্রাপ্তিকে সামনে রেখেই বৈধ আনন্দ উৎসবে দিন পার করবে।

পবিত্র মাহে রামাদান মাসটা অনেকেই যারা অন্যান্য মাসে সংযত থাকেন না তারাও এই মাসে অনেক সংযত থাকার চেষ্টা করেন। অনেকে অন্য মাসে যুলুম করলেও, হারাম কাজে লিপ্ত থাকলেও এই মাসে একটু হলেও লজ্জা বা ভয় পান সেই কাজ করতে। অনেকে সাওম না রাখলেও সাওমকারীর সামনে খেতে লজ্জা বোধ করেন। কারণ শয়তান তাদেরকে উস্কানী দিতে সক্ষম নয়, যতটুকু খারাপ কাজ করে তা হলো নফসের শক্তি বিবেকের শক্তির চেয়ে বেশী বলে। দেখা যায় একটি রামাদান মাসের শিক্ষা কারো জীবনকে বদলে দিয়ে হেদায়াতের পথে নিয়ে এসেছে, ফলশ্রুতিতে দেখা যায় রামাদান শেষ হলেও ব্যক্তির আমলের কোন পরিবর্তন করে না বরং নতুন করে আরো ঈমানিয়াতে উজ্জীবিত হয়ে মহান আল্লাহর বান্দাহ হয়ে চলার পথে অগ্রগামী হওয়ার প্রচেষ্টায় থাকে।

কিন্তু যারা নফসকে দমন করতে পারলো না তারা রামাদান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শুরু করে দেয় তার নফসের চাহিদা পূরনে এবং সাথে তখন শয়তান এসে আরো রঞ্জিত করার জন্য উস্কানী দিতে থাকে। আর তাই দেখা যায় ঈদের চাঁদ দেখার নামে ছাদে বা পাড়া মহল্লায় তরুণ তরুণীদের বেহায়াপনা শুরু হয়ে যায়, শুরু হয়ে যায় বাদ্য যন্ত্রের তালে তালে ঈদের গান। এলাকায় মসজিদেও যারা নামাজ আদায় করতে যান তারাও এই হারাম বাদ্যযন্ত্রের ফিতনা থেকে বাচতে চাইলেও পারেন না, এতো উচ্চ ভলিউমে গান বাজনা চলতে থাকে। অনেকে এখন এই গুনাহকে সাধারণ ও স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিচ্ছেন যা অত্যন্ত ভয়াবহ ব্যাপার। রাসূল সা. এই কথাটি জানিয়ে সাবধান করেছেন।

আমার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক এমন থাকবে যারা ব্যাভিচার, রেশম, মদ এবং বাদ্যযন্ত্রকে হালাল হিসেবে গণ্য করবে।  সহীহ আল বুখারী: ৫৫৯০

তাই আমাদের সাবধান হয়ে ও মহান আল্লাহর ভয়কে যা রামাদান মাসের প্রশিক্ষণে আরো উজ্জীবিত হওয়ার কথা সেটা পুঁজি করে আল কোরআন ও সুন্নাহকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে চলার অঙ্গীকারে অটল থাকি।

দেখা যায় সেই রাতে তারাবীহ নামাজ নেই বলে অনেকে খুব খুশী মনে বেঁচে যায়। এশার নামাজের জামাতে মুসুল্লীর সংখ্যা কমে যায়। শপিং মল গুলোতে অবাধ ধাক্কাধাক্কি করে কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়।

নারীরা তাদের সাজগোজের জিনিস নিয়ে ব্যস্ত বা রান্নার আয়োজনে এতো ব্যস্ত হয়ে যান যে এশা বা ফজর কোন নামাজই আদায় করা সম্ভব হয় না।

এদের অবস্থা সেই নারীর মত যা কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন,

যে মজবুত করে সুতো বুননের পর, তার বুনন খুলে নষ্ট করে দেয়!   সূরা আন নাহল: ৯২

মহান আল্লাহ বলেছেন:

আল্লাহ অবশ্যই সেই সব লোকের তাওবাহ কবুল করবেন যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে এবং এরপর শীঘ্রই তাওবাহ করে ফেলে, আল্লাহ তাদেরই তাওবাহ কবুল করবেন, আল্লাহতো সব জানেন, মহাজ্ঞানী। তাওবাহ তাদের জন্য নয় যারা তাদের কারও মৃত্যু আসা পর্যন্ত খারাপ কাজে লিপ্ত থাকে, এরপর মৃত্যু সময় আসন্ন হলে বলে, আমি এখন তাওবাহ করলাম। তাওবাহ তাদের জন্যও নয় যারা কাফির অবস্থায় মারা যায়। আমি তাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।  সূরা আন নিসা: ১৭-১৮

তাই একজন তাকওয়াবান, খালেস মুমিন ব্যক্তির উচিৎ মহান আল্লাহর ভয়কে পুঁজি করে তাঁর আনুগত্যে সচেষ্ট থাকা এবং সর্বদা কল্যাণমূলক কাজ ও দাওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকা।

সাবান যতটুকু কাপড় পরিষ্কার করে তার চেয়ে যে কাপড় ধৌত করে তার হাত বেশী পরিষ্কার হয়। তাই অন্যদের মাঝে মহান আল্লাহর বাণী পৌঁছে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখলে ব্যক্তির আমল আরো সুন্দর ও উন্নত হবে দিনে দিনে ইনশা’আল্লাহ তবে এইক্ষেত্রে খালেস নিয়্যাত থাকতে হবে।

মহান আল্লাহ বলেছেন:

যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ, এরপর (এ পথে) অটল, অবিচল থাকে, নিশ্চয়ই তাদের উপর ফিরিশতাগন অবতরন করবেন, তারা (ফিরিশতাগণ) বলবেন, তোমরা ভয় পেয়ো না, দুঃখ করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহন কর যার ব্যাপারে তোমাদের ওয়াদা করা হয়েছিল। আমরা (ফিরিশতাগণ) দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে তোমাদের সংগী, তোমাদের জন্য সেখানে (জান্নাতে) তাই আছে যা তোমাদের মন চায় এবং তোমাদের জন্য সেখানে তাই আছে যা তোমরা চাও।  সূরা হামীম আস সাজদাহ: ৩০-৩১

দুনিয়ার জীবনেও মহান আল্লাহর সৃষ্টি ফিরিশতারাও আপনার আমার বন্ধু হয়ে যাবে যদি আমরা ঐ শর্তে অটল থাকি। সাওমের প্রশিক্ষন আমরা একরাতের মধ্যে উড়িয়ে না দিয়ে নিজেদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করি এবং মহান আল্লাহ তা’লার পথে তাঁরই নির্দেশনা মোতাবেক চলি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

করণী

  • তাকবীর উচ্চারণ: মুস্তাহাব

ঈদুল ফিতরের রাত্রি অর্থাৎ শাওয়ালের চাঁদ দেখার পর বা ৩০ রামাদান শেষে সূর্যাস্তের পর থেকে শুরু করে নারী পুরুষ সকল মুসলিম ঈদের খুতবা শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর দিবেন অথবা ঈদগাহে ইমাম আসার সাথে সাথে তাকবীর উচ্চারন বন্ধ করতে হবে।

শুধুমাত্র সালাতের পর এই তাকবীর উচ্চারনকে সীমাবদ্ধ করা হয়নি।

ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বে পুরুষদের জন্য জোরে তাকবীর উচ্চারন সুন্নাত।

তাকবীর – আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার ওয়াল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।

ঈদুল ফিতরের দিন নির্দিষ্ট শব্দ বলা নেই, স্বাভাবিকভাবেই মহান আল্লাহর বড়ত্ব করতে থাকবে।

  • ঈদের সালাত আদায় করা প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিব।
  • ঈদের সালাতের জন্য ঈদগাহে মুসলিমদের একটি বিরাট সম্মেলন।

এই সম্মেলনের মাধ্যমে শিক্ষা হলো মহান আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর বিধি-বিধান আলোচনা করাই এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য। এ ছাড়া মুসলিম জাতির জন্য এটি একটি মহড়া যা শৌর্যবীর্যের ও সংখ্যার আধিক্যের প্রকাশ তাই সকলেরই ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। হায়েজ ও নিফাসে আক্রান্ত নারীদেরকেও ঈদগাহে যাবার নির্দেশ রয়েছে। যাওয়া আসার পথ ভিন্ন করা যেন সবাই জানতে পারে।

  • গোসল করে সুন্দর উত্তম কাপড় পরিধান করা সুন্নাত।
  • পুরুষদের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত।
  • ঈদুল ফিতরের দিনে কিছু খেয়ে সালাতে বের হওয়া সুন্নাত, বেজোড় সংখ্যা খেজুর খাওয়া মুস্তাহাব।
  • এক পথে যাওয়া ও অন্য পথে আসা সুন্নাত।
  • পায়ে হেঁটে যাওয়া মুস্তাহাব।
  • তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম বলে কুশল বিনিময় করা যেতে পারে।

বর্জনীয়

  • অনেকে ঈদের রাত ইবাদাতের মাধ্যমে উদযাপিত করাকে হাদীসের আলোকে বর্ণনা করে থাকেন, যা শরীয়ত সম্মত একটি নতুন প্রবর্তিত বিষয় (বিদ’আত)। অন্যান্য রাতের মতোই অভ্যাসবশত কেউ ইবাদাত করলে তাতে কোন সমস্যা নেই।
  • আবার অনেকে এই দিনকে কবর যিয়ারত করার জন্য নির্দিষ্ট করে নেন যা ঈদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। ঈদ যা আনন্দ উল্লাস ও সুখের প্রকাশ মুসলিমের জন্য।
  • এই দিনে আপ্যায়ন ও বেড়ানোকে ইস্যু করে দেখা যায় নামাজ জামায়াতে আদায় করা থেকে বিরত থাকেন যা দুঃখজনক।
  • অনেক নারীরা সাজগোজ করে পর্দার বিধান লঙ্ঘন করে তীব্র সুগন্ধি মেখে বাইরে বেড়াতে থাকেন যা হারাম।
  • রাস্তা ঘাট ও ক্যাফেগুলোতে দেখা যায় তরুন-তরুনীদের খোলা মেলা আড্ডা যা ভয়ানক এক চিত্র এই সমাজের। সব পিতা-মাতাদের এই ব্যাপারে নিজ নিজ সন্তানদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্য দায়িত্বশীল হতে হবে।