রজব থেকে রামাদান ডায়েরী-৯ (রামাদান মাসের পূর্বে কিছু প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা)

রমজান মাসকে সামনে রেখে আপনাদের সামনে কিছু পরিকল্পনা তুলে ধরলাম। এর সাথে আপনারাও আরো কিছু করণীয় যোগ করে নিতে পারেন। আল্লাহ আমাদের হিকমাহ বাড়িয়ে দিন ও আমল করার তৌফিক দিন।

আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদান এলে কি করতেন হাদীস থেকে আমরা জানার চেষ্টা করি।

গোটা মানব জাতির মধ্যে নবী সা. সবচেয়ে দানশীল ছিলেন। রামাদান মাসে জিবরাঈল আ. যে সময় তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন সে সময় তিনি সবচেয়ে বেশী দানশীল হয়ে উঠতেন। জিবরাঈল রামাদানে প্রতি রাতেই তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন। এভাবেই রামাদান মাস অতিবাহিত হত। নবী স. (এ সময়) তার সামনে কোরআন পড়ে শুনাতেন। যখন জিবরাঈল তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি গতিবান বায়ুর চাইতেও বেশী দানশীল হয়ে উঠতেন।            সহীহ আল বুখারী: ১৭৬৭

তাহলে এই হাদিস থেকে জানা যায় নবী সা. রামাদানে কি করতেন:

  • বেশী বেশী দান করা
  • কোরআন পাঠ করা

মহান আল্লাহ সুবহান বলেছেন:

যারা নিজেদের অর্থ সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের (দানের) উপমা একটি শস্যবীজ, যা উৎপাদন করে সাতটি শীষ এবং প্রত্যেক শীষে শতদানা। (এভাবেই) যাকে ইচ্ছা আল্লাহ বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। তিনি মহা প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞানী।      সূরা আল বাকারা: ২৬১

হে সেই সব লোক যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে না দেয়।  যারা এরূপ করবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে।

আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় আসার পূর্বেই তা থেকে খরচ করো। সে সময় সে বলবে: হে আমার রব, তুমি আমাকে আরো কিছুটা অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি দান করতাম এবং নেককার লোকদের মধ্যে শামিল হয়ে যেতাম। অথচ যখন কারো কাজের অবকাশ পূর্ণ হয়ে যাওয়ার সময় এসে যায় তখন আল্লাহ

তাকে আর কোন অবকাশ দেন না মোটেও। তোমরা যা কিছু কর সে বিষয়ে আল্লাহ‌ পুরোপুরি অবহিত।      সূরা আল মুনাফিকুন: ৯-১১

পরিকল্পনা: রামাদানের পূর্বে

১। পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বসে রামাদান মাসের গুরুত্ব ও করণীয় তুলে ধরে কিছু দিক নির্দেশনা দিন যেমন:

  • মুরুব্বী (যেমন মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানী বা অন্যান্য) যিনি পরিবারে থাকেন, উনার জন্য একটি পরিকল্পনা করে দিন।
  • অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ের জন্য একটি পরিকল্পনা করে দিন।
  • প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েকে বলুন পরিকল্পনা করে আপনাকে দেখাতে যেন পরামর্শ দিতে পারেন।
  • গৃহপরিচারিকা, ড্রাইভার, দারোয়ান সবার জন্য রামাদানে করণীয় দিকের পরামর্শ এখনই দিন।
  • সংযমের মাস, তাই ইফতারের মেন্যু সহজ, পুষ্টিকর, সময়বিনষ্টকারী নয়, ইফতারের আগের মুহূর্ত ধীর হয়ে যিকির ও দোয়ায় ব্যস্ত থাকা যায় সেই রকম ভাবে পরিবারের সবার মন-মানসিকতা গঠন করে নিন এখনই।

২।  আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের মাঝে এখনি রামাদান ও ইসলামের মূল বিষয় সংক্রান্ত বই/ওয়েব লিঙ্ক দিন ও উৎসাহ প্রদান করুন।

৩।  গরীব আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন ভাই-বোনদের জন্য এখনই রামাদানে সহযোগিতায় শুকনো খাবার (চাল, খেজুর, চিনি, চিড়া, মুড়ি, সেমাই বা টাকা) ও রোযা সংক্রান্ত বই পৌঁছে দিতে পারেন।

৪।  ঘরের ভারী কাজগুলো (পরিচ্ছন্নতার) এখনই সেরে ফেলুন। গৃহপরিচারিকার জন্য সাওম রাখা একটু সহজ হবে।

৫।  ঈদের মূল কেনা-কাটা করে ফেলুন।

৬।  যারা চাকরিজীবী, রাস্তায় যাওয়া আসার সময়কে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা এখনই করে নিন যেমন, লেপটপ বা মোবাইলে কোরআন অর্থসহ তিলাওয়াত/তাফসীর/দোয়া-ইত্যাদি সেট করে নিন।

৭।  যারা চাকরিজীবী, সম্ভব হলে শেষ দশদিন বা বেজোড় দিনগুলো ছুটি নেয়ার পরিকল্পনা করতে পারেন। বছরে তো একবারই শবে-ক্বদর আসে তাই না!!!

৮।  রামাদান সংক্রান্ত মাসলা-মাসায়েল এখন থেকে আরো গুরুত্ব দিয়ে পড়ুন। কোন কোন দোয়া পড়বেন তা তালিকাভুক্ত করে নিন।

৯। ঈদের বাজেটে এই মাসে পরিবারের পাঠাগারে নতুন কিছু বই (তাফসীর, সহীহ হাদীস গ্রন্থ বা জীবনী) যোগ করুন।

১০। ঈদের বাজেট থেকে কিছু টাকা গরীবদের কেনা কাটার জন্য সন্তানদের শিক্ষা দিন।

মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

যে কেউ আশু লাভের আকাঙ্ক্ষা করে, তাকে আমি এখানেই যা কিছু দিতে চাই দিয়ে দেই, তারপর তার ভাগে জাহান্নাম লিখে দেই, যার উত্তাপ সে ভুগবে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়ে। আর যে ব্যক্তি আখেরাতের প্রত্যাশী হয় এবং সেজন্য প্রচেষ্টা চালায়, যেমন সেজন্য প্রচেষ্টা চালানো উচিত এবং সে হয় মুমিন, এক্ষেত্রে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির প্রচেষ্টার যথোচিত মর্যাদা দেয়া হবে। এদেরকেও এবং ওদেরকেও, দু’দলকেই আমি (দুনিয়ায়) জীবন উপকরণ দিয়ে যাচ্ছি, এ হচ্ছে তোমার রবের দান এবং তোমার রবের দান রুখে দেবার কেউ নেই। কিন্তু দেখো, দুনিয়াতেই আমি একটি দলকে অন্য একটির ওপর কেমন শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে রেখেছি এবং আখেরাতে তার মর্যাদা আরো অনেক বেশী হবে এবং তার শ্রেষ্ঠত্বও আরো অধিক হবে।    সুরা বনী ইসরাঈল: ১৮-২১

আশু লাভের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, যে জিনিস দ্রুত পাওয়া যায়। কুরআন মজীদে একে পারিভাষিক অর্থে দুনিয়ার জন্য ব্যবহার করেছে, অর্থাৎ যার লাভ ও ফলাফল এ দুনিয়ার জীবনেই পাওয়া যায়। আমাদের আখেরাতের প্রত্যাশী অর্থাৎ মৃত্যুর পরবর্তী স্থায়ী জীবনের সফলতাকেই মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগুতে হবে।

আল্লাহ সুবহান আরো বলেছেন:

প্রত্যেক মানুষের ভাল-মন্দ কাজের নিদর্শন আমি তার গলায় ঝুলিয়ে রেখেছি এবং কিয়ামতের দিন তার জন্য বের করবো একটি লিখন, যাকে সে খোলা কিতাবের আকারে পাবে। পড়ো, নিজের আমলনামা, আজ নিজের হিসেব করার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট। যে ব্যক্তিই সৎপথ অবলম্বন করে, তার সৎপথ অবলম্বন তার নিজের জন্যই কল্যাণকর হয়। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়, তার পথভ্রষ্টতার ধ্বংসকারিতা তার ওপরই বর্তায়। কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না।   সুরা বনী ইসরাঈল: ১৩-১৫

সময়ের সাথে সাথে আল্লাহ সুবহানের সহায়তায় সহীহ দীনের জ্ঞান অর্জন হাতের নাগালে চলে এসেছে। এখন শুধু প্রয়োজন একটু সদিচ্ছা ও ইচ্ছার বাস্তবমুখী উদ্যোগ।

অন্তর থেকে কেউ যদি নিজেকে মহান আল্লাহ তা’লার কাছে সমর্পণ করতে চান, আমাদের রব অবশ্যই সেই পথে চলার সহজ উপায় ও শক্তি দান করবেন ইনশাআল্লাহ।

মনে রাখতে হবে মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

যে ব্যক্তিই আল্লাহকে ভয় করে চলবে আল্লাহ তার জন্য কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সৃষ্টি করে দেবেন। এবং এমন পন্থায় তাকে রিযিক দেবেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করে থাকেন। আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের জন্য একটা মাত্রা ঠিক করে রেখেছেন।   সূরা আত তালাক: ২-৩

আল্লাহ তোমাদের জন্য জীবনকে সংকীর্ণ করে দিতে চান না, কিন্তু তিনি চান তোমাদেরকে পাক-পবিত্র করতে এবং তাঁর অনুগ্রহগুলো তোমাদের ওপর সম্পূর্ণ করে দিতে, হয়তো তোমরা শোকর গুজার হবে। আল্লাহ তোমাদের যে নিয়ামত দান করেছেন তার কথা মনে রাখো এবং তিনি তোমাদের কাছ থেকে যে পাকাপোক্ত অঙ্গীকার নিয়েছেন তা ভুলে যেয়ো না। অর্থাৎ তোমাদের একথা – আমরা শুনেছি ও আনুগত্য করেছি। আর আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ মনের কথা জানেন।     সূরা আল মায়েদা: ৬-৭

আসলে তোমাদের প্রচেষ্টা নানা ধরনের। কাজেই যে (আল্লাহর পথে) ধন সম্পদ দান করেছে, (আল্লাহর নাফরমানি থেকে) দূরে থেকেছে এবং সৎবৃত্তিকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তাকে আমি সহজ পথের সুযোগ- সুবিধা দেবো।    সূরা আল লাইল: ৪-৭

আর নিজের অন্তরকে তাদের সঙ্গলাভে নিশ্চিন্ত করো – যারা নিজেদের রবের সন্তুষ্টির সন্ধানে সকাল-সাঁঝে তাঁকে ডাকে এবং কখনো তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরাবে না। তুমি কি পার্থিব সৌন্দর্য পছন্দ করো? এমন কোন লোকের আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার অনুসরণ করেছে এবং যার কর্মপদ্ধতি কখনো উগ্র, কখনো উদাসীন।

পরিষ্কার বলে দাও, এ হচ্ছে সত্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে, এখন যে চায় মেনে নিক এবং যে চায় অস্বীকার করুক। আমি (অস্বীকারকারী) জালেমদের জন্য একটি আগুন তৈরি করে রেখেছি যার শিখাগুলো তাদেরকে ঘেরাও করে ফেলেছে। সেখানে তারা পানি চাইলে এমন পানি দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করা হবে, যা হবে তেলের তলানির মতো। এবং যা তাদের চেহারা দগ্ধ করে দেবে। কত নিকৃষ্ট পানীয় এবং কি জঘন্য আবাস! তবে যারা মেনে নেবে এবং সৎকাজ করবে, সেসব সৎকর্মশীলদের প্রতিদান আমি কখনো নষ্ট করি না।   সূরা আল কাহফ: ২৮-৩০

আমি রামাদানে করণীয় পরিকল্পনাটি তিনটি গ্রুপে ভাগ করেছি

১। বাড়ীর মুরুব্বীদের জন্য (পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, শশুর-শাশুড়ী, অন্যান্য বয়োবৃদ্ধদের জন্য)।

২। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের জন্য।

৩। পূর্ণ বয়স্ক সন্তানের জন্য।