রজব থেকে রামাদান ডায়েরী-৫ (রামাদান মাস কেন এতো সম্মানিত)

 

রামাদান  বিশেষ মাস বলে সম্মানিত লাভ যে কারণে তা হলো:

  • নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমান ও পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী হওয়ার উপায়
  • পথ নির্দেশিকা আল কোরআন নাযিল
  • তাকওয়া অর্জনের জন্য রোযা ফরয
  • আত্মশুদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের মাস
  • বিশেষ রজনী কদরের রাত – ভাগ্যরজনী এটাই।

মহান আল্লাহ তা’লা ইবাদাত সমূহ প্রবর্তন করেছেন আর লেন দেন ব্যবস্থাপনা চালু করেছেন তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করার জন্য। কে মহান রবের দাসত্ব করে আর কে প্রবৃত্তির দাসত্ব করে। বান্দাহদের জন্য প্রবর্তিত এমন কোন ইবাদাত নেই যার পেছনে পরিপূর্ণ হিকমাহ নেই। আমাদের কোন ইবাদাতের হিকমাহ না জানা, হিকমাহ না থাকার প্রমাণ নয়।

মহান আল্লাহ সুবহান বলেছেন:  তোমাদেরকে ইলমের সামান্য কিছু দেয়া হয়েছে।  সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৫

সাহাব রা.দের মতো ‘আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম’ এই নীতি নিয়ে পূর্ণ ঈমানের সাথে আত্মসমর্পণকারী হয়ে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ তা’লার দাসত্বে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। রামাদান মাসে সাওমের বিধানই সেই ক্ষেত্র তৈরী করতে সক্ষম একজন মুমিন বান্দাহর জন্য।

যে নিজ আগ্রহ ও অভিরুচির বাইরে কোন ইবাদত গ্রহণ করে না এবং আল্লাহ প্রদত্ত বিধান বা রীতিনীতির অনুসরণ করে না, সে হলো প্রবৃত্তির দাস।

মহান আল্লাহ বলেছেন:

আর যদি হক (সত্য) তাদের প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করতো তাহলে অবশ্যই বিশাল আকাশ ও যমীন এবং এর মধ্যবর্তী সবকিছুই বিশৃঙ্খল হয়ে যেত। বরং আমরা তাদের কাছে তাদের উপদেশ নিয়ে এসেছি, কিন্তু তারা উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।   সূরা আল মু’মিনুন: ৭১

রামাদান কোরআন নাযিলের মাস

মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন, কোরআন পাওয়ার ফলে আমাদের আনন্দ করা প্রয়োজন।

হে মানুষ! তোমাদের কাছে তোমাদের মালিকের পক্ষ থেকে নসীহত (বিশিষ্ট কিতাব) এসেছে, মানুষের অন্তরে যে সব ব্যাধি রয়েছে, (এটা) তার প্রতিকার এবং মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত।

হে নবী, বলুন, মানুষের উচিত আল্লাহর এই অনুগ্রহ ও রহমতের কারণে আনন্দ প্রকাশ করা, কারণ এটা সেই সব জিনিষ হতে উত্তম তারা যা কিছু (জ্ঞান ও সম্পদ) জমা করেছে। সূরা ইউনুস: ৫৭-৫৮

কিন্তু আমরা কি সেইভাবে মনের মাঝে আনন্দ অনুভব করি এবং আমার  মহান রবের কাছ থেকে পাওয়া উপদেশ যা আমার জীবনের জন্যই প্রয়োজন তা বুঝার জন্য কতটুকু উদ্যোগী হই?

আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

অতঃপর আমার নিকট থেকে যে জীবন বিধান তোমাদের নিকট পৌঁছুবে যারা আমার সেই বিধান মেনে চলবে তাদের জন্য কোন চিন্তা ও ভাবনার কোন কারণ থাকবে না। সূরা আল বাকারা: ৩৮

(এই) সেই (মহান) গ্রন্থ আল কোরআন তাতে কোন সন্দেহ নেই, যারা আল্লাহ তা’লাকে ভয় করে, এই কিতাব তাদের জন্যই ভয় প্রদর্শক। সূরা আল বাকারা: ২

যে উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য এই নিয়ামতটি (কোরআন) দান করা হয়েছিল তাকে পুর্ণ করার জন্য নিজেকে সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত করা দরকার। কোরআন আমাদেরকে এই উদ্দেশ্যে দান করা হয়েছে যে, আমরা এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টির পথ জেনে নিয়ে নিজেরা সেই পথে চলবো এবং অন্যদেরকেও সেই পথে চলার আহবান জানাবো। এভাবে নিজেদের তৈরী করার সর্বাত্মক মাধ্যম হচ্ছে রোযা। মহান আল্লাহ বলেছেন:

রমযান মাস এতেই নাযিল করা হয়েছে কোরআন, মানুষের জন্য হিদায়াত স্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে পাবে মাসটি, সে যেন এতে রোযা রাখে।

সূরা আল বাকারা: ১৮৫

হা-মীম। এই সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, আমি এটি এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাযিল করেছি। কারণ, আমি মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছিলাম। এটি ছিল সেই রাত – যাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারের বিজ্ঞতাসূচক ফয়সালা আমাদের নির্দেশে প্রকাশ করা হয়ে থাকে।       সূরা আদ দুখান: ১-৫

আমরা এটি (কোরআন) কদরের রাতে নাযিল করেছি। তুমি কি জান ক্বদরের রাত কি?  ক্বদরের রাত্রি হাজার মাস হতে উত্তম। ফেরেশতা ও রূহ এই রাত্রিতে তাদের আল্লাহর অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয়। সেই রাত্রি পুরোপরি শান্তি ও নিরাপত্তার – ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত।       সূরা আল ক্বদর: ১-৫

এটি এক বহু বরকতসম্পন্ন কিতাব যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন লোকেরা এর আয়াতগুলো সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে এবং জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকসম্পন্ন লোকেরা তা হতে সতর্কবাণী গ্রহণ করে।

সূরা সা’দ: ২৯

তোমাদের কাছে আল্লাহর কাছ থেকে রৌশনী এসেছে, এমন একখানি সত্য প্রদর্শনকারী কিতাব যা দিয়ে আল্লাহ তা’লা তাঁর সন্তোষ সন্ধানকারী লোকদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথ বলে দেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং সঠিক পথে তাদেরকে পরিচালিত করেন।      সূরা আল মায়িদা: ১৫-১৬

মহান আল্লাহর এই কথাগুলো অবশ্যই সত্য। আসলেই কেউ যখন কোরআন নাযিলের ইতিহাস পড়ে দেখবেন এবং অতীতে যারা কোরআন বিশ্বাস করেছিলেন তাদের ওপর কোরআনের কি প্রভাব পড়েছিল সে সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করবেন, তখন যে কেউ অনুধাবন করবেন যে কোরআনের উপরোক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত কথাগুলো তাঁদের জীবনে বাস্তবায়িত হয়েছিল। সেই সাহাবারা রা. বাস্তব ময়দানে থেকে কোরআনকে উপলব্ধি করেছিলেন ও আমল করে দেখিয়ে গিয়েছেন। আজ আমরা প্রিয় নবী সা. এর মহব্বতের কথা বলে মীলাদ ও কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছি, কিন্তু নিজের জীবন চরিতকে মিলিয়ে দেখছি না সেই পরশ পাথরের সাথে। আজ নবীর সা. প্রতি কটাক্ষ কারীদের ব্যাপারে যতটুকু অসহনীয়তা দেখিয়ে রাস্তায় নেমে আসি অথচ প্রতিনিয়ত নবীর সা. আদর্শের পরিপন্থী কাজ দেখেও নিরবে দুনিয়ার ভোগ বিলাসে নিমগ্ন রয়েছি বা নিজেই আদর্শহীনতায় লিপ্ত হচ্ছি।  দুঃখ হলেও সত্য আজ আমাদের মাঝে কোরআন আছে কিন্তু সাহাবাদের রা. মতো প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণকারীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। তাই আমাদের আজ এতো দুর্দশা।

  • অনেকে কোরআন পড়েন কিন্তু অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক দিকগুলো অবজ্ঞা করে গৌণ দিকগুলো প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
  • অনেকে কোরআনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য সনাক্ত করতে ও বুঝতে ব্যর্থ হন ফলে কোরআন পড়েন কিন্তু কোরআন যা চায় তা সেখান থেকে গ্রহণ করতে পারেন না।
  • সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি সহকারে কোরআনের নিকটবর্তী হতে পারেন না ফলে এই কিতাব যা শিক্ষা দেয় এবং সেই শিক্ষা কিভাবে মানবকূলকে প্রভাবিত করতে পারে এই দুয়ের মাঝে যোগসূত্র করতে ব্যর্থ হন।
  • অনেকে কোরআনের যথাযথ ব্যাখ্যা না পড়ার কারণে সঠিক ও শুদ্ধ শিক্ষা লাভ করতে ব্যর্থ হন।

আলজিরিয়া দখলের শতবর্ষ পূর্তিতে ফরাসী ঔপনিবেশিক গভর্ণর বলেছিলেন, যদি আমরা তাদের উপর বিজয়ী হতে চাই তবে তাদের মাঝ থেকে আরবী কোরআন সরিয়ে ফেলা এবং তাদের জিহবা থেকে আরবী ভাষা সরিয়ে ফেলা এক অবশ্য করণীয় কর্তব্য।

মুসলিম জীবনের কেন্দ্রবিন্দু থেকে কেবল কোরআনকে সরিয়ে নিলেই অর্থাৎ জীবনের সকল কর্মকাণ্ড যে কোরআনকে ঘিরেই আবর্তিত হয় সেটার অবসান ঘটাতে পারলেই ইসলামের শত্রুদের মূখ্য কাজ সমাধা হবে।

মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

আমরা এই কোরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ মাধ্যম বানিয়েছি। এ হতে উপদেশ গ্রহণের কেউ আছে কি?    সূরা আল ক্বামার: ১৭

 

যে কোরআন কষ্ট করে পড়ে তার জন্য দু’টি পুরষ্কার:

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কোরআন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি (আখেরাতে) সম্মানিত নেককার লিপিকার ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোরআন পড়ে এবং এটা তার পক্ষে খুবই কঠিন ও কষ্টকর, সে দু’টি পুরস্কার পাবে।    সহীহ আল বুখারী, তিরমিযী: ২৮৩৯

যে কোরআন বুঝে পড়তে সময় দেয় তার পুরষ্কার উত্তম:

রাসূল সা. বলেছেন: মহান রাব্বুল ইজ্জত বলেন, কোরআন (চর্চার ব্যস্ততা) যাকে আমার যিকির ও আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করতে বিরত রেখেছে আমি তাকে আমার কাছে যারা চায় তাদের চেয়ে অনেক উত্তম পুরস্কার দিব। সব কালামের উপর আল্লাহর কালামের মর্যাদা এত অধিক যত অধিক আল্লাহর মর্যাদা তাঁর সকল সৃষ্টির উপর।       জামে আত তিরমিযী: ২৮৬১

আল্লাহ সুবহান বলেছেন: আর যে ব্যক্তি আমার যিকির (উপদেশমালা) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য হবে দুনিয়ায় সংকীর্ণ জীবন এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে উঠাবো অন্ধ করে। সে বলবে, “হে আমার রব! দুনিয়ায় তো আমি চক্ষুষ্মান ছিলাম কিন্তু এখানে আমাকে অন্ধ করে উঠালে কেন? আল্লাহ বলবেন, “হাঁ, এভাবেই তো আমার আয়াত যখন তোমার কাছে এসেছিল, তুমি তখন তাকে ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হচ্ছে – এভাবেই আমি সীমালংঘনকারী এবং নিজের রবের আয়াত অমান্যকারীকে (দুনিয়ায়) প্রতিফল দিয়ে থাকি। আর আখেরাতের আযাব বেশী কঠিন এবং বেশীক্ষণ স্থায়ী।    সূরা আত ত্বাহা: ১২৪-১২৭

যার অন্তরে কোরআনের কিছুই নেই সে পরিত্যক্ত ঘরতুল্য।         জামে আত তিরমিযী: ২৮৫০

তোমার মালিকের পক্ষ থেকে সত্য বাণী নিয়েই এই গ্রন্থ (আল কোরআন) নাযিল করা হয়েছে, অতএব তুমি কখনো সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।

ন্যায় ও ইনসাফের আলোকে তোমার মালিকের কথাগুলো পরিপূর্ণ এবং তাঁর এ কথার পরিবর্তন করার কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।   সূরা আল আন’আম: ১১৪-১১৫

বুঝে পড়ার সাথে সাথে অত্যন্ত জরুরী বিষয় হচ্ছে কোরআনকে নিজের মধ্যে আত্মীকরণ করা, কোরআনের সাথে মন ও রূহের সম্পর্ক গভীর করা এবং লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলা।

কোরআনে আল্লাহ বলেছেন:

প্রকৃত ঈমানদারতো তারাই যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণে কেঁপে উঠে। আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। তারা তাদের আল্লাহর উপর আস্থা এবং নির্ভরতা রাখে।

সূরা আল আনফাল: ২

তাই কোরআন তেলাওয়াতে, অধ্যয়নে আমাদের গোটা দেহ ও মন নিয়ে পুরোপুরিভাবে জড়িত হতে হবে। কেবলমাত্র এভাবেই আমরা আমাদের সত্ত্বাকে উন্নীত করতে পারি কোরআনের কাংখিত স্তরে, যেখানে পৌঁছলে আমরা সত্যিকারের বিশ্বাসী হিসাবে অভিহিত হবো।

মহান আল্লাহ বলেছেন:

আমরা যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা তা যথোপযুক্তভাবে পড়ে, তারা তার প্রতি নিষ্ঠা সহকারে ঈমান আনে। তার প্রতি যারা কুফরী করে মূ্লতঃ তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। সূরা আল বাকারা: ১২১