সূরা কাহফ ৮ম রুকুঃ ( ৫৪-৫৯ আয়াত)

সূরা কাহফ

৮ম রুকুঃ ( ৫৪-৫৯ আয়াত)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

 

১৮:৫৪ وَ لَقَدۡ صَرَّفۡنَا فِیۡ هٰذَا الۡقُرۡاٰنِ لِلنَّاسِ مِنۡ کُلِّ مَثَلٍ ؕ وَ کَانَ الۡاِنۡسَانُ اَکۡثَرَ شَیۡءٍ جَدَلًا

৫৪. আর অবশ্যই আমরা মানুষের জন্য এ কুরআনে সব ধরনের উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। আর মানুষ সবচেয়ে বেশী বিতর্কপ্রিয়।

আল্লাহ বলছেন, আমরা কুরআনে প্রতিটি বিষয় স্পষ্ট ও বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। কোন ফাঁক রাখিনি। যাতে তারা সৎপথ থেকে হারিয়ে না যায়; হেদায়াতের পথ থেকে বের না হয়ে যায়। [ইবন কাসীর] এত সুন্দরভাবে বর্ণনা করার পরও এখন সত্যকে মেনে নেবার পথে তাদের জন্য কি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? শুধুমাত্র এটিই যে তারা আযাবের অপেক্ষা করছে।

আরবীতে جِدَال (জিদাল) অর্থ হ’ল ঝগড়া, বিবাদ, তর্ক-বিতর্ক, কলহ ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করে নিজের কথা সত্য প্রমাণ করা। আবু ইয়ালা বলেন, বিতর্ক হ’ল পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের মাঝে কথার বিনিময় হওয়া এবং এর দ্বারা একে অপরের উপর বিজয়ী হওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা থাকা’।

আরবীতে বিতর্কের আরেকটি প্রতিশব্দ হ’ল مِرَاء (মিরা)। অনেকে বলেন, উভয় শব্দের অর্থ একই। তবে মিরা হ’ল নিন্দনীয় বিতর্ক। কারণ এটি হ’ল, হক প্রকাশ পাওয়ার পরও তা নিয়ে অনর্থক বিতর্ক করা। তবে ‘জিদাল’ এ রকম নয়। কখনও এটি ভাল অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে ২৯ জায়গায় ‘জিদাল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে’। তন্মধ্যে মাত্র কয়েকটি জায়গা ব্যতীত বাকী জায়গায় মন্দ অর্থে এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন

,وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ، ‘

তোমরা কিতাবধারীদের সঙ্গে বিতর্ক করবে না উত্তম পন্থা ব্যতীত’ (আনকাবূত: ৪৬)।

সমগ্র সৃষ্টজীবের মধ্যে মানুষ সর্বাধিক তর্কপ্রিয়। এর সমর্থনে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে একটি হাদীস বর্ণিত রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “কেয়ামতের দিন কাফেরদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে পেশ করা হবে। তাকে প্রশ্ন করা হবেঃ আমার প্রেরিত রাসূল সম্পর্কে তোমার কর্মপন্থা কেমন ছিল? সে বলবেঃ হে আমার রব! আমি তো আপনার প্রতি, আপনার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলাম এবং তাদের আনুগত্য করেছিলাম। আল্লাহ্ তাআলা বলবেনঃ তোমার আমলনামা সামনে রাখা রয়েছে। এতে তো এমন কিছু নেই। লোকটি বলবেঃ আমি এই আমলনামা মানি না। আমি এ আমলনামার লেখকদেরকে চিনি না এবং আমল করার সময় তাদেরকে দেখিনি।

আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ সামনে লওহে-মাহফুয রয়েছে। এতেও তোমার অবস্থা এরূপই লিখিত রয়েছে। সে বলবেঃ হে আমার রব! আপনি আমাকে যুলুম থেকে আশ্রয় দিয়েছেন কি না? আল্লাহ বলবেনঃ নিশ্চয় যুলুম থেকে তুমি আমার আশ্রয়ে রয়েছ। সে বলবেঃ হে আমার রব! যেসব সাক্ষ্য আমি দেখিনি সেগুলো কিরূপে আমি মানতে পারি? আমার নিজের পক্ষ হতে যে সাক্ষ্য হবে, আমি তাই মানতে পারি। তখন তার মুখ সীল করে দেয়া হবে এবং তার হাত-পা তার কুফর এবং শির্ক সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ [ মুসলিমঃ ৫২৭১]

অন্য এক হাদীসে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন আলী ও ফাতেমাকে দেখতে গিয়েছিলেন, তাদেরকে তিনি বললেনঃ তোমরা রাতে সালাত আদায় কর না? তারা বললেনঃ আমরা ঘুমোলে আল্লাহ আমাদের প্রাণ হরণ করে তার হাতে নিয়ে নেন। সুতরাং আমরা কিভাবে সালাত আদায় করব? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে গেলেন, তারপর তাকে শুনলাম তিনি ফেরা অবস্থায় নিজের রানে আঘাত করছেন আর বলছেন, মানুষ ভীষণ ঝগড়াটে।” [বুখারীঃ ১১২৭, ৪৭২৪, মুসলিমঃ ৭৭৫]

এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী ও ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার পক্ষ থেকে এ ধরনের বিতণ্ডা অপছন্দ করলেন। কারণ, এটা বাতিল তর্ক। মহান আল্লাহর আনুগত্য না করার জন্য তাকদীরের দোহাই দেয়া জায়েয নেই।

আল্লাহর নিকট তর্কপ্রিয় মানুষ অপ্রিয় :

অধিকাংশ মানুষ হক জানে না। আবার অনেকে হক জানলেও তা মানে না এবং হক গ্রহণে উদারতা প্রদর্শন করে না। বরং ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। হক মানতে তর্ক-বিতর্ক করে। অথচ তর্কপ্রিয় মানুষ মহান আল্লাহর নিকট অপসন্দনীয়।

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন

,إِنَّ أَبْغَضَ الرِّجَالِ إِلَى اللهِ الأَلَدُّ الْخَصِمُ

‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ হ’ল কঠিন ঝগড়াটে ব্যক্তি’। বুখারী হা/২৪৫৭; মুসলিম হা/২৬৬৮; মিশকাত হা/৩৭৬২।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তর্ক করে না, তার জন্য পরকালীন জীবনে রয়েছে জান্নাত। আবূ উমামাহ বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন

,أَنَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ فِي رَبَضِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا، وَبِبَيْتٍ فِي وَسَطِ الْجَنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كَانَ مَازِحًا وَبِبَيْتٍ فِي أَعْلَى الْجَنَّةِ لِمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ،

‘আমি ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের শেষ সীমায় একটি ঘর দেওয়ার যামিন হচ্ছি, যে হক হওয়া সত্ত্বেও ঝগড়া বর্জন করে। ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে একটি ঘরের যামিন হচ্ছি, যে উপহাসছলেও মিথ্যা বলা বর্জন করে। আর ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় একটি ঘরের যামিন হচ্ছি, যার চরিত্র উত্তম’।আবূদাঊদ হা/ ৪৮০০; ছহীহাহ ১/৪৯১ পৃ.।

পক্ষান্তরে অন্যায় দাবীর পক্ষে বিতর্ক করা আরো ঘোরতর অপরাধ। এমন ব্যক্তি আল্লাহর ক্রোধের পাত্র হিসাবে গণ্য হবে। আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন

,وَمَنْ خَاصَمَ فِى بَاطِلٍ وَهُوَ يَعْلَمُهُ لَمْ يَزَلْ فِى سَخَطِ اللهِ حَتّٰـى يَنْزِعَ عَنْهُ

‘যে ব্যক্তি জেনেশুনে কোন বাতিল (অন্যায়) বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করে, সে ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর রোষাণলে থাকে, যতক্ষণ না সে তা বর্জন করে’। আবূদাউদ হা/৩৫৯৭; ছহীহাহ হা/৪৩৭; ছহীহুল জামে’ হা/৬১৯৬।

রাসূলের যুগে বিতর্ক :

রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেও ছাহাবীগণ কোন কোন সময় বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হ’তেন। যেমন একটি হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন,

إنَّ نَفَراً كَانُوا جُلُوساً بِبَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ بَعْضُهُمْ أَلَمْ يَقُلِ اللهُ كَذَا وَكَذَا. وَقَالَ بَعْضُهُمْ أَلَمْ يَقُلِ اللهُ كَذَا وَكَذَا فَسَمِعَ ذَلِكَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَأَنَّمَا فُقِئَ فِى وَجْهِهِ حَبُّ الرُّمَّانِ فَقَالَ بِهَذَا أُمِرْتُمْ أَوْ بِهَذَا بُعِثْتُمْ أَنْ تَضْرِبُوا كِتَابَ اللهِ بَعْضَهُ بِبَعْضٍ إِنَّمَا ضَلَّتِ الأُمَمُ قَبْلَكُمْ فِى مِثْلِ هَذَا إِنَّكُمْ لَسْتُمْ مِمَّا هَاهُنَا فِى شَىْءٍ انْظُرُوا الَّذِى أُمِرْتُمْ بِهِ فَاعْمَلُوا بِهِ وَالَّذِى نُهِيتُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا،

‘কিছু মানুষ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরজায় বসেছিল। তাদের কেউ বলে, আল্লাহ কি একথা বলেননি? আবার কেউ বলে, আল্লাহ কি একথা বলেননি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একথা শুনতে পান। তাঁর পবিত্র মুখমন্ডল ক্রোধে লাল হয়ে যায়, যেন তাঁর মুখমন্ডলে বেদানার রস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তোমাদের কি এরূপ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর কিতাবের এক অংশকে অন্য অংশের বিপরীতে দাঁড় করাবে? তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগুলি এরূপ করার কারণেই বিভ্রান্ত হয়েছে। তোমাদের কাজ এটি নয়। তোমাদেরকে কি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা দেখ এবং তা পালন কর। আর যা তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে তা বর্জন কর’। আহমদ হা/৬৮৪৫, শুআইব আরনাউত হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন

১৮:৫৫ وَ مَا مَنَعَ النَّاسَ اَنۡ یُّؤۡمِنُوۡۤا اِذۡ جَآءَهُمُ الۡهُدٰی وَ یَسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّهُمۡ اِلَّاۤ اَنۡ تَاۡتِیَهُمۡ سُنَّۃُ الۡاَوَّلِیۡنَ اَوۡ یَاۡتِیَهُمُ الۡعَذَابُ قُبُلًا

৫৫. আর যখন তাদের কাছে পথনির্দেশ আসে তখন মানুষকে ঈমান আনা ও তাদের রব-এর কাছে ক্ষমা চাওয়া থেকে বিরত রাখে শুধু এ যে, তাদের কাছে পূর্ববর্তীদের বেলায় অনুসৃত রীতি আসুক অথবা আসুক তাদের কাছে সরাসরি আযাব

আয়াতে ব্যবহৃত قُبُلًا শব্দের অর্থ, সামনা সামনি বা চাক্ষুষ। [ইবন কাসীর] কাফেররা সবসময় নিজের চোখে আযাব দেখতে চাইত। কুরআনের অন্যত্র এসেছে, “তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে আকাশের এক খণ্ড আমাদের উপর ফেলে দাও।” [সূরা আশ-শু’আরা: ১৮৭]

অনুরূপ বলা হয়েছে, “উত্তরে তাঁর সম্প্রদায় শুধু এটাই বলল, আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আনয়ন কর—তুমি যদি সত্যবাদী হও।” [সূরা আল আনকাবূত: ২৯]

“স্মরণ করুন, তারা বলেছিল, “হে আল্লাহ! এগুলো যদি আপনার কাছ থেকে সত্য হয়, তবে আমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করুন কিংবা আমাদেরকে মর্মম্ভদ শাস্তি দিন৷” [সূরা আল-আনফাল: ৩২]

“তারা বলে, ওহে যার প্রতি কুরআন নাযিল হয়েছে! তুমি তো নিশ্চয় উন্মাদ। ‘তুমি সত্যবাদী হলে আমাদের কাছে ফিরিশতাদেরকে উপস্থিত করছ না কেন?” [সূরা আল-হিজর: ৬, ৭]

১৮:৫৬ وَ مَا نُرۡسِلُ الۡمُرۡسَلِیۡنَ اِلَّا مُبَشِّرِیۡنَ وَ مُنۡذِرِیۡنَ ۚ وَ یُجَادِلُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِالۡبَاطِلِ لِیُدۡحِضُوۡا بِهِ الۡحَقَّ وَ اتَّخَذُوۡۤا اٰیٰتِیۡ وَ مَاۤ اُنۡذِرُوۡا هُزُوًا

৫৬. আর আমরা শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই রাসূলদেরকে পাঠিয়ে থাকি, কিন্তু কাফেররা বাতিল দ্বারা তর্ক করে, যাতে তার মাধ্যমে সত্যকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। আর তারা আমার নিদর্শনাবলী ও যা দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে সেসবকে বিদ্রুপের বিষয়রূপে গ্রহণ করে থাকে।

আল্লাহর আয়াতের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হল, তা মিথ্যাজ্ঞান করার অতীব নিকৃষ্টতম প্রকার। অনুরূপ মিথ্যা ও বাতিল দ্বারা বিতর্ক (অর্থাৎ, বাতিল তরীকা অবলম্বন) করে সত্যকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার প্রচেষ্টা করাও অতি ঘৃণিত আচরণ। আর এই বাতিল পন্থায় বিতর্ক করার একটি প্রকার হল, কাফেরদের এই বলে রসূলদের রিসালাতকে অস্বীকার করে দেওয়া যে, তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ।

مَا أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا (يـس: ১৫) অতএব আমরা তোমাদেরকে রসূল কিভাবে মেনে নিতে পারি?

دَحَضَ এর প্রকৃত অর্থ হল, স্খলন ঘটা, পিছল কাটা। যেমন বলা হয়, دَحَضَتْ رِجْلُهُ (তার পদস্খলন ঘটেছে)। এখান থেকেই এ শব্দটি কোন জিনিস থেকে সরে যাওয়ার এবং ব্যর্থ হওয়ার অর্থে ব্যবহার হতে লেগেছে। বলা হয় যে, دَحَضَتْ حُجَّتُهُ دُحُوْضًا أي بَطَلَتْ (তার হুজ্জত বাতিল গণ্য হয়েছে।) এই দিক দিয়ে أدْحَضَ يُدْحِضُ এর অর্থ হবে, বাতিল বা ব্যর্থ করা। (ফাতহুল কাদীর)

১৮:৫৭ وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ ذُکِّرَ بِاٰیٰتِ رَبِّهٖ فَاَعۡرَضَ عَنۡهَا وَ نَسِیَ مَا قَدَّمَتۡ یَدٰهُ ؕ اِنَّا جَعَلۡنَا عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ اَکِنَّۃً اَنۡ یَّفۡقَهُوۡهُ وَ فِیۡۤ اٰذَانِهِمۡ وَقۡرًا ؕ وَ اِنۡ تَدۡعُهُمۡ اِلَی الۡهُدٰی فَلَنۡ یَّهۡتَدُوۡۤا اِذًا اَبَدًا

৫৭. আর তার চেয়ে অধিক যালেম আর কে হতে পারে, যাকে তার রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, অতঃপর সে তা থেকে বিমুখ হয়েছে এবং সে ভুলে গেছে যা তার দু-হাত পেশ করেছে? নিশ্চয় আমরা তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা কুরআন বুঝতে না পারে এবং তাদের কানে বধিরতা এঁটে দিয়েছি। আর আপনি তাদেরকে সৎপথে ডাকলেও তারা কখনো সৎপথে আসবে না।

আয়াত থেকে বুঝা গেল যে, আল্লাহর দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা, দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীন থাকা, দ্বীন শিক্ষা করতে ও করাতে আগ্রহী না হওয়া কুফরী। এসবগুলোই বড় কুফরীর অংশ। [দেখুন, নাওয়াকিদুল ইসলাম]

অর্থাৎ তাদের গোনাহ ও অবাধ্যতার কারণে শাস্তিস্বরূপ তাদের অন্তরের উপর আল্লাহ আবরণ দিয়েছেন। [ফাতহুল কাদীর] কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। যেমন

২:৭ خَتَمَ اللّٰهُ عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ وَ عَلٰی سَمۡعِهِمۡ ؕ وَ عَلٰۤی اَبۡصَارِهِمۡ غِشَاوَۃٌ ۫ وَّ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ

আল্লাহ তাদের হৃদয়সমূহ ও তাদের শ্রবনশক্তির উপর মোহর করে দিয়েছেন, এবং তাদের দৃষ্টির উপর রয়েছে আবরণ। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। সূরা আল বাকারাহ: ৭,

আর আপনি যখন কুরআন পাঠ করেন তখন আমরা আপনার ও যারা আখিরাতের উপর ঈমান রাখে না তাদের মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন পর্দা রেখে দেই। আর আমরা তাদের অন্তরের উপর আবরণ রেখে দিয়েছি যেন তারা তা বুঝতে না পারে এবং তাদের কানে দিয়েছি বধিরতা; আপনার রব এক, এটা যখন আপনি কুরআন থেকে উল্লেখ করেন তখন তারা পিঠ দেখিয়ে সরে পড়ে। যখন তারা কান পেতে আপনার কথা শুনে তখন তারা কেন কান পেতে শুনে তা আমরা ভাল জানি এবং এটাও জানি, গোপনে আলোচনাকালে যালিমরা বলে, তোমরা তো এক জাদুগ্ৰস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছ। সূরা আল-ইসরা: ৪৫–৪৭,

এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা’নত করেছেন, ফলে তিনি তাদের বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন। সূরা মুহাম্মাদ: ২৩,

তারা যমীনে আল্লাহ্‌কে অপারগ করতে পারত না এবং আল্লাহ ছাড়া তাদের অন্য কোন সাহায্যকারী ছিল না; তাদের শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে; তাদের শুনার সামর্থ্যও ছিল না এবং তারা দেখতেও পেত না। সূরা হূদ: ২০।

১৮:৫৮ وَ رَبُّکَ الۡغَفُوۡرُ ذُو الرَّحۡمَۃِ ؕ لَوۡ یُؤَاخِذُهُمۡ بِمَا کَسَبُوۡا لَعَجَّلَ لَهُمُ الۡعَذَابَ ؕ بَلۡ لَّهُمۡ مَّوۡعِدٌ لَّنۡ یَّجِدُوۡا مِنۡ دُوۡنِهٖ مَوۡئِلًا

৫৮. আর আপনার রব পরম ক্ষমাশীল, দয়াবান৷ তাদের কৃতকর্মের জন্য যদি তিনি তাদেরকে পাকড়াও করতেন, তবে তিনি অবশ্যই তাদের শাস্তি তরান্বিত করতেন; কিন্তু তাদের জন্য রয়েছে এক প্রতিশ্রুত মুহুর্ত, যা থেকে তারা কখনই কোন আশ্রয়স্থল পাবে না।

এ আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর দুটি গুণ ব্যবহার করেছেন।

এক. তিনি ক্ষমাশীল। দুই. তিনি রহমতের মালিক।

যে রহমত সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে। সুতরাং তিনি তাদেরকে তাদের অন্যায়ের কারণে দ্রুত শাস্তি দিচ্ছেন না। [ফাতহুল কাদীর]

কেউ কোন দোষ করলে সংগে সংগেই তাকে পাকড়াও করে শাস্তি দিয়ে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ  “আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে ভূ-পৃষ্ঠে কোন জীব-জিন্তুকেই রেহাই দিতেন না, কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর তাদের নির্দিষ্ট কাল এসে গেলে আল্লাহ তো আছেন তাঁর বান্দাদের সম্যক দ্রষ্টা।” [সূরা ফাতের: ৪৫]

আর আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের সীমালংঘনের জন্য শাস্তি দিতেন তবে ভূপৃষ্ঠে কোন জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন তাদের সময় আসে তখন তারা মুহুর্তকাল আগাতে বা পিছাতে পারে না। সূরা নহল ৬১

আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা জানিয়ে দিচ্ছেন। তা হচ্ছে, তিনি যদি মানুষকে তাদের অত্যাচার-অনাচারের কারণে পাকড়াও করতেন তবে যমীনের বুকে কোন প্রাণী রাখতেন না। এখানে প্রাণী বলে কাফের উদ্দেশ্য নেয়া হলে কোন সমস্যা নেই। কারণ, তিনি তাদেরকে অবকাশ দেয়ার শাস্তি দিবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি প্রাণী বলে যমীনে বিচরণশীল সব প্রাণীই উদ্দেশ্য হয় তবে আল্লাহর পাকড়াও দ্বারা কেবল মানুষই ধ্বংস হতো না বরং তাদের সহ যমীনের উপর যত প্রাণী আছে সবাইকে তা পেয়ে বসত। ফলে যমীন প্রাণীশূণ্য হয়ে পড়ত। কিন্তু আল্লাহ্ তাআলা অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু।

তিনি তাদেরকে একটি সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। যাতে যারা তাওবা করার করতে পারে, আর যারা অন্যায়কারী তাদের অন্যায় কাজের পরিপূর্ণতা লাভ করে। [ফাতহুল কাদীর] এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কাফেরকে ধ্বংস করার পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীদেরকে কেন ধ্বংস করা হবে, অথচ তাদের কোন গোনাহ নেই? এর উত্তরে কোন কোন মুফাসসির বলেন, যালেমকে তার শাস্তি বিধান করতে ধ্বংস করবেন। আর যদি অন্যান্য প্রাণী হিসাব-নিকাশ আছে এ রকম হয় তবে তাদের সওয়াব পূর্ণ করার জন্য, আর যদি হিসাব-নিকাশ নেই এ রকম প্রাণী হয়, তবে যালেমদের যুলুমের কু-প্রভাবের কারণে। [ফাতহুল কাদীর]

এর দ্বারা বোঝা গেল যে, মানুষ অন্যায়ের কারণে অন্যান্য প্রাণীজগতকেও কষ্টে নিক্ষেপ করে। আর যদি ভাল কাজ করে তখন অন্যান্য প্রাণীকুলও তাদের ভালকাজের সুফল ভোগ করে। এ জন্যই যারা দ্বীনের জ্ঞানে জ্ঞানী তাদের জন্য পানির মাছ এবং আকাশের পাখিও দো’আ করে। কারণ তারা দ্বীনি জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে অন্যায় আচরণ থেকে নিজেরা দূরে থাকবে অন্যদেরকেও দূরে রাখবে। ফলে আল্লাহর রহমত নাযিল হওয়ার কারণ হবে। যা মানুষ ও সবার জন্য সমভাবে আসে। আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের গুনাহর কারণে তাদেরকে অনাবৃষ্টির মাধ্যমে শাস্তি দেন। এ শাস্তি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীজগত সবাইকে শামিল করে। তাই মানুষের উচিত যাবতীয় অন্যায়-অনাচার থেকে দূরে থাকা। যাতে তাদের আচরণে এমন প্রাণীদের কষ্ট না হয় যারা কোন অন্যায় করেনি। [কুরতুবী ইবনুল কাইয়্যেম, মিফতাহু দারিস সা’আদাহ: ১/৬৫]

৭:৩৪ وَ لِکُلِّ اُمَّۃٍ اَجَلٌ ۚ فَاِذَا جَآءَ اَجَلُهُمۡ لَا یَسۡتَاۡخِرُوۡنَ سَاعَۃً وَّ لَا یَسۡتَقۡدِمُوۡنَ

আর প্রত্যেক জাতির জন্য এক নির্দিষ্ট সময় আছে। অতঃপর যখন তাদের সময় আসবে তখন তারা মুহুর্তকাল দেরি করতে পারবে না এবং এগিয়েও আনতে পারবে না। সূরা আরাফঃ৩৪

এ সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা দুনিয়াতে ভোগ-বিলাসে থাকতে পারবে। কিন্তু এরপর যখন আল্লাহ তা’আলা তাদের পাকড়াও করতে চাইবেন তখন তাদের আর সময় দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সূরায় অনুরূপ আলোচনা এসেছে, যেমনঃ

১৫:৫ مَا تَسۡبِقُ مِنۡ اُمَّۃٍ اَجَلَهَا وَ مَا یَسۡتَاۡخِرُوۡنَ

কোন জাতি তার নির্দিষ্ট কালকে ত্বরান্বিত করতে পারে না, বিলম্বিতও করতে পারে না।সূরা আল-হিজরঃ ৫

তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর তাকওয়া অবলম্বন কর, আর আমার আনুগত্য কর,

তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে অবকাশ দেবেন। এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। নিশ্চয় আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হলে তা বিলম্বিত করা হয় না; যদি তোমরা এটা জানতে! সূরা নূহঃ ৩-৪,

এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, তোমাদের মৃত্যুর যে সময়কাল নির্ধারণ করা আছে, ঈমান আনা অবস্থায় সেটাকে বাড়িয়ে দিয়ে বেঁচে থাকার আরো অবকাশ দেবেন এবং সেই আযাবকে তোমাদের উপর হতে দূর করে দেবেন, ঈমান না আনার ফলে যার আসাটা তোমাদের উপর অবধারিত ছিল। এই আয়াতকে দলীল বানিয়ে বলা হয় যে, আল্লাহর আনুগত্য, নেকীর কাজ এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায়ে সত্যিকারে আয়ু বৃদ্ধি হয়। হাদীস শরীফেও এসেছে যে, صِلَةُ الرِّحِمِ تَزِيْدُ فِي العُمُرِ অর্থাৎ, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় আয়ু বৃদ্ধি করে। (ইবনে কাসীর) কেউ কেউ বলেন, অবকাশ দেওয়ার মানে, বরকত দেওয়া। ঈমান আনলে আয়ুতে বরকত হবে। আর ঈমান না আনলে এই বরকত থেকে বঞ্চিত হতে হবে।

তোমরা ঈমান আনলে আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিবেন। বয়সের নির্দিষ্ট মেয়াদের পূর্বে তোমাদেরকে কোন আযাবে ধ্বংস করবেন না। [সা’দী]

وَ لَنۡ یُّؤَخِّرَ اللّٰهُ نَفۡسًا اِذَا جَآءَ اَجَلُهَا ؕ وَ اللّٰهُ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ

আর যখন কারো নির্ধারিত কাল উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ্ তাকে কিছুতেই অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা আমল কর আল্লাহ্‌ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। সূরা আল-মুনাফিকূনঃ ১১।

আরও বলেনঃ “মংগলের আগেই ওরা আপনাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে, যদিও ওদের আগে এর বহু দৃষ্টান্ত গত হয়েছে। মানুষের সীমালংঘন সত্বেও আপনার রব তো মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল এবং আপনার প্রতিপালক শাস্তি দানে তো কঠোর।” [সূরা রা’দ: ৬]

তিনি সহিষ্ণুতা অবলম্বন করেন, গোপন রাখেন, ক্ষমা করেন, কখনও তাদের কাউকে হেদায়াতের পথেও পরিচালিত করেন। তারপরও যদি কেউ অপরাধের পথে থাকে তাহলে তার জন্য তো এমন এক দিন রয়েছে যে দিন নবজাতক বৃদ্ধ হয়ে যাবে, গর্ভধারিনী তার গর্ভ রেখে দিবে। [ইবন কাসীর]

১৮:৫৯ وَ تِلۡکَ الۡقُرٰۤی اَهۡلَکۡنٰهُمۡ لَمَّا ظَلَمُوۡا وَ جَعَلۡنَا لِمَهۡلِکِهِمۡ مَّوۡعِدًا

৫৯. আর ঐসব জনপদ–তাদের অধিবাসীদেরকে আমরা ধ্বংস করেছিলাম, যখন তারা যুলুম করেছে এবং তাদের ধ্বংসের জন্য আমরা স্থির করেছিলাম নির্দিষ্ট সময়।

এ থেকে আ’দ, সামুদ এবং শুআইব ও লূত عليهما السلام প্রভৃতিদের সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছে। যারা হিজাযবাসীদের সন্নিকটে এবং তাদের পথের ধারে আবাদ ছিল। তাদেরকেও তাদের যুলুমের কারণে ধ্বংস করা হয়েছে।

তবে ধ্বংস সাধনের পূর্বে তাদেরকে পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর যখন এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তাদের যুলুম ও অবাধ্যতা এমন সীমায় পৌঁছে গেছে, যে সীমায় পৌঁছে যাওয়ার পর হিদায়াতের সমস্ত পথ একেবারে বন্ধ এবং তাদের নিকট থেকে আর কোন কল্যাণের আশা অবর্তমান, তখন তাদের আমলের অবকাশ শেষ হয়ে গেল এবং ধ্বংস আরম্ভ হয়ে গেল। অতঃপর তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হল। আর এটাকে বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ গ্রহণের নমুনা বানিয়ে দিলেন।

আসলে মক্কাবাসীদেরকে বুঝানো হচ্ছে যে, তোমরা আমার সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ রসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে মিথ্যাবাদী মনে করছ, তা সত্ত্বেও তোমাদেরকে অবকাশ দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করো না যে, তোমাদেরকে কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করার নেই, বরং এই অবকাশ ও ঢিল দেওয়া হল আল্লাহর একটি দস্তর। তিনি প্রত্যেক ব্যক্তি, দল এবং জাতিকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দেন। যখন সে সময় শেষ হয়ে যাবে এবং তোমরা কুফরী ও অবাধ্যতা থেকে ফিরে আসবে না, তখন তোমাদের অবস্থাও তাদের থেকে ভিন্ন হবে না, যারা তোমাদের পূর্বে গত হয়েছে।

কওমে ‘আদ-এর ধ্বংসের প্রধান কারণ সমূহ

১. মনস্তাত্ত্বিক কারণ সমূহ :

(ক) তারা আল্লাহর অনুগ্রহ সমূহের অবমূল্যায়ন করেছিল। যার ফলে তারা আল্লাহর আনুগত্য হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং শয়তানের আনুগত্য বরণ করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে গিয়েছিল (খ) আল্লাহর নে‘মত সমূহকে তাদের জন্য চিরস্থায়ী ভেবেছিল (গ) আল্লাহর গযব থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন কল্পিত উপাস্যের অসীলা পূজা শুরু করেছিল (ঘ) তারা আল্লাহর নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল (ঙ) তারা আল্লাহর গযব থেকে নির্ভীক হয়ে গিয়েছিল। যদিও তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করত।

২. বস্তগত কারণসমূহ : প্রধানত: তিনটি :

(ক) তারা অযথা উঁচু স্থান সমূহে সুউচ্চ টাওয়ার ও নিদর্শন সমূহ নির্মাণ করত। যা স্রেফ অপচয় ব্যতীত কিছুই ছিল না (শো‘আরা ১২৮)।

(খ) তারা অহেতুক মযবূত প্রাসাদ রাজি তৈরী করত এবং ভাবত যেন তারা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে (ঐ, ১২৯)।

(গ) তারা দুর্বলদের উপর নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানতো এবং মানুষের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতো (ঐ, ১৩০)।

কওমে ‘আদ-এর উপরে আপতিত গযব-এর বিবরণ

মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক বলেন, কওমে ‘আদ-এর অমার্জনীয় হঠকারিতার ফলে প্রাথমিক গযব হিসাবে উপর্যুপরি তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত সমূহ শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বাগ-বাগিচা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও তারা শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেনি। কিন্তু অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। তখন আসমানে সাদা, কালো ও লাল মেঘ দেখা দেয় এবং গায়েবী আওয়ায আসে যে, তোমরা কোনটি পসন্দ করো? লোকেরা কালো মেঘ কামনা করল। তখন কালো মেঘ এলো। লোকেরা তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, هَذَا عَارِضٌ مُّمْطِرُنَا ‘এটি আমাদের বৃষ্টি দেবে’। জবাবে তাদের নবী হূদ (আঃ) বললেন,

بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُمْ بِهِ رِيْحٌ فِيْهَا عَذَابٌ اَلِيْمٌ، تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِرَبِّهَا… (الأحقاف ২৪-২৫)-

‘বরং এটা সেই বস্ত্ত যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা এমন বায়ু যার মধ্যে রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’। ‘সে তার প্রভুর আদেশে সবাইকে ধ্বংস করে দেবে…’। আহক্বাফ ৪৬/২৪, ২৫; ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৭১।

ফলে অবশেষে পরদিন ভোরে আল্লাহর চূড়ান্ত গযব নেমে আসে। সাত রাত্রি ও আট দিন ব্যাপী অনবরত ঝড়-তুফান বইতে থাকে। মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রাঘাতে বাড়ী-ঘর সব ধ্বসে যায়, প্রবল ঘুর্ণিঝড়ে গাছ-পালা সব উপড়ে যায়, মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে যমীনে পতিত হয় (ক্বামার ৫৪/২০; হাক্বক্বাহ ৬৯/৬-৮) এবং এভাবেই শক্তিশালী ও সুঠাম দেহের অধিকারী বিশালবপু ‘আদ জাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, এছাড়াও তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী অভিসম্পাৎ দুনিয়া ও আখেরাতে (হূদ ১১/৬০)।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মেঘ বা ঝড় দেখতেন, তখন তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত এবং বলতেন হে আয়েশা! এই মেঘ ও তার মধ্যকার ঝঞ্ঝাবায়ু দিয়েই একটি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে। যারা মেঘ দেখে খুশী হয়ে বলেছিল, ‘এটি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করবে’। বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১৫১৩ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘ঝঞ্ঝা-বায়ু’ অনুচ্ছেদ।

রাসূলের এই ভয়ের তাৎপর্য ছিল এই যে, কিছু লোকের অন্যায়ের কারণে সকলের উপর এই ব্যাপক গযব নেমে আসতে পারে। যেমন ওহোদ যুদ্ধের দিন কয়েকজনের ভুলের কারণে সকলের উপর বিপদ নেমে আসে। যেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,

 

وَاتَّقُوْا فِتْنَةً لاَّتُصِيْبَنَّ الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوْآ أَنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ- (الأنفال ২৫)-

‘আর তোমরা ঐসব ফেৎনা থেকে বেঁচে থাক, যা বিশেষভাবে কেবল তাদের উপর পতিত হবে না, যারা তোমাদের মধ্যে যালেম। আর জেনে রাখো যে, আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (আনফাল ৮/২৫)।

উল্লেখ্য যে, গযব নাযিলের প্রাক্কালেই আল্লাহ স্বীয় নবী হূদ ও তাঁর ঈমানদার সাথীদের উক্ত এলাকা ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন ও তাঁরা উক্ত আযাব থেকে রক্ষা পান (হূদ ১১/৫৮)। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

সংগ্রহে

তাফসিরে যাকারিয়া ও আহসানুল বায়ান ও নবী কাহীনী