সূরা ইউনুসঃ ২য় রুকু (আয়াত ১১-২০নং)

সূরা ইউনুসঃ ২য় রুকু (আয়াত ১১-২০নং)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

১০:১১ وَ لَوۡ یُعَجِّلُ اللّٰهُ لِلنَّاسِ الشَّرَّ اسۡتِعۡجَالَهُمۡ بِالۡخَیۡرِ لَقُضِیَ اِلَیۡهِمۡ اَجَلُهُمۡ ؕ فَنَذَرُ الَّذِیۡنَ لَا یَرۡجُوۡنَ لِقَآءَنَا فِیۡ طُغۡیَانِهِمۡ یَعۡمَهُوۡنَ ﴿۱۱

১১. আর আল্লাহ যদি মানুষের অকল্যাণে (সাড়া দিতে) তাড়াতাড়ি করেন, যেভাবে তাদের কল্যাণে (সাড়া দিতে) তাড়াতাড়ি করেন, তবে অবশ্যই তাদের মৃত্যুর সময় এসে যেত।। কাজেই যারা আমাদের সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না তাদেরকে আমরা তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরতে ছেড়ে দেই।

এ আয়াতে الشر বা খারাপ বস্তু কি? এ নিয়ে মতভেদ আছে। এক. কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এখানে খারাপ বস্তু বলতে নদর ইবনে হারেস নামীয় কাফেরের বদদোআ বোঝানো হয়েছে। যাতে সে বলেছিলঃ হে আল্লাহ! যদি মুহাম্মাদের দ্বীন সত্য হয়, তবে আমার উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করে আমাকে ধ্বংস করে দিন। [বাগভী] এর উত্তরে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ সর্ববিষয়েই ক্ষমতাশীল, প্রতিশ্রুত এ আযাব এক্ষণেই নাযিল করতে পারেন। কিন্তু তিনি তার মহান হেকমত ও দয়া করুণার দরুন এ মূৰ্খরা নিজেদের জন্য যে বদদোআ করে এবং বিপদ ও অকল্যাণ কামনা করে তা নাযিল করেন না।

যদি আল্লাহ তা’আলা তাদের বদদোআগুলোও তেমনিভাবে যথাশীঘ্ৰ কবুল করে নিতেন, যেভাবে তাদের ভাল দোআগুলো কবুল করেন, তাহলে এরা সবাই ধ্বংস হয়ে যেত। দুই. অধিকাংশ মুফাসসিরীনের মতে এক্ষেত্রে বদদোআর মর্ম এই যে, কোন কোন সময় কেউ কেউ রাগের বশবর্তী হয়ে নিজের সন্তান-সন্ততির কিংবা অর্থ-সম্পদ ধ্বংসের বদদোআ করে বসে কিংবা বস্তুসামগ্রীর প্রতি অভিসম্পাত করতে আরম্ভ করে- আল্লাহ তা’আলা স্বীয় করুণা ও মহানুভবতাবশতঃ সহসাই এসব দোআ কবুল করেন না। [তাবারী; কুরতুবী; বাগভী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা একদা রাসূল (সা.) এর সঙ্গে বাত্বনে বুওয়াত্ব নামক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। যাতে আমরা পালাক্রমে একই উটে পাঁচ, ছয় অথবা সাত জন করে আরোহণ করতাম। এভাবে জনৈক আন্সারী সাহাবীর উটে চড়ার পালা আসলে সে উটটিতে আরোহণ করেই তাকে তাড়া দিলে উটটি থেমে থেমে চলতে লাগলো। তখন সে উটটিকে ধমক দিয়ে আল্লাহ্’র অভিশাপ দিলে রাসূল (সা.) বললেন: কে তার উটের অভিশাপকারী ? লোকটি বললোঃ আমি। তখন রাসূল (সা.) বললেন:

انْزِلْ عَنْهُ ، فَلاَ تَصْحَبْنَا بِمَلْعُوْنٍ ، لاَ تَدْعُوْا عَلَى أَنْفُسِكُمْ ، وَلاَ تَدْعُوْا عَلَى أَوْلاَدِكُمْ ، وَلاَ تَدْعُوْا عَلَى أَمْوَالِكُمْ ، لاَ تُوَافِقُوْا مِنَ اللهِ سَاعَةً يُسْأَلُ فِيْهَا عَطَاءٌ فَيَسْتَجِيْبُ لَكُمْ

‘‘তুমি উটটি থেকে নেমে যাও। অভিশপ্ত উট নিয়ে আমাদের সাথী হয়ো না। তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদকে বদদুআ দিও না। হয়তো-বা উক্ত বদদুআ এমন এক সময়ে পড়ে বসবে যখন আল্লাহ্ তা’আলার নিকট কিছু চাওয়া হলে আললাহ্ তা’আলা তা দ্রুত কবুল করেন.(মুসলিম ৩০০৯)

এতে প্রতীয়মান হয় যে, কল্যাণ ও মঙ্গলের শুভ দোআ-প্রার্থনার ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলার রীতি হচ্ছে যে, অধিকাংশ সময় তিনি সেগুলো শীঘ্ৰ কবুল করে নেন। অবশ্য কখনো কখনো হেকমত ও কল্যাণের কারণে কবুল না হওয়া এর পরিপন্থী নয়। কিন্তু মানুষ যে কখনো নিজেদের অজান্তে এবং কোন দুঃখ-কষ্ট ও রাগের বশে নিজের কিংবা নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য বদদোআ করে বসে, অথবা আখেরাতের প্রতি অস্বীকৃতির দরুন আযাবকে প্রহসন মনে করে নিজের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানাতে থাকে সেগুলো তিনি সঙ্গে সঙ্গে কবুল করেন না; বরং অবকাশ দেন, যাতে অস্বীকারকারীরা বিষয়টি চিন্তা-ভাবনা করে নিজেদের অস্বীকৃতি থেকে ফিরে আসার সুযোগ পায় এবং কোন সাময়িক দুঃখকষ্ট, রাগ-রোষ কিংবা যদি মনোবেদনার কারণে বদদোআ করে বসে, তাহলে সে যেন নিজের কল্যাণ-অকল্যাণ, ভাল-মন্দ লক্ষ্য করে, তার পরিণতি বিবেচনা করে তা থেকে বিরত হবার অবকাশ পেতে পারে।

তারপরও কোন কোন সময় এমন কবুলিয়ত বা মঞ্জুরীর সময় আসে, যখন মানুষের মুখ থেকে যে কোন কথা বের হয়, তা সঙ্গে সঙ্গে কবুল হয়ে যায়। সেজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ নিজের সন্তান-সন্ততি ও অর্থ-সম্পদের জন্য কখনো বদদোআ করো না। এমন যেন না হয় যে, সে সময়টি হয় মঞ্জুরীর সময় এবং দোআ সাথে সাথে কবুল হয়ে যায়। [আবু দাউদঃ ১৫৩২, মুসলিমঃ ৩০০৯]

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা পরস্পরে আল্লাহর লা’নত, তার গজব ও জাহান্নামের অভিশাপ দিবে না।সুনানে তিরমিযি-১৯৮৬

অভিশাপকারী আখেরাতেও মর্যাদা পাবে না। এ ব্যাপারে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন অভিশাপকারীরা সুপারিশ করতে পারবে না। এবং স্বাক্ষ্য প্রদানও করতে পারবে না।[সহীহ মুসলিম-২৫৯৮ নং হাদীস।]

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন কোন বান্দা কোন ব্যক্তিকে অভিশাপ দেয়,তখন অভিশাপ আকাশে চলে যায়, আকাশের দরজাগুলো তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়, অতপর তা জমিনের দিকে নেমে আসে, তখন জমিনের দরজাগুলোও তার থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়, অতপর তা ডানে বামে ঘুরতে থাকে, যখন কোন উপায় না পায়, তখন যাকে অভিসম্পাত করা হয়েছে, সে যদি এর যোগ্য হয় তাহলে তার প্রতি পতিত হয়, অন্যথায় অভিশাপকারীর (নিজের) দিকেই ধাবিত হয়।সুনানে আবু দাউদ-৪৯০৭ নং হাদীস।

২ : ১৫ اَللّٰهُ یَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ وَ یَمُدُّهُمۡ فِیۡ طُغۡیَانِهِمۡ یَعۡمَهُوۡنَ ﴿

১৫. আল্লাহ তাদের সাথে উপহাস করেন, এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতার মধ্যে বিভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াবার অবকাশ দেন। বাকারাঃ ১৫

৭৫. আর যদি আমরা তাদেরকে দয়া করি এবং তাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করি তবুও তারা অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরতে থাকবে। ৭৬. আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম, তারপরও তারা তাদের রব-এর প্রতি অবনত হল না এবং কাতর প্রার্থনাও করল না। ৭৭. অবশেষে যখন আমরা তাদের উপর কঠিন কোন শাস্তির দুয়ার খুলে দেব তখনই তারা এতে আশাহত হয়ে পড়বে। সূরা মুমিনুনঃ৭৫-৭৭

 

তারা আযাবে পতিত হওয়ার সময় আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে। আমি যদি তাদের ফরিয়াদের কারণে দয়াপরবশ হয়ে আযাব সরিয়ে দেই, তবে মজ্জগত অবাধ্যতার কারণে আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার পরীক্ষণেই ওরা আবার নাফরমানীতে মশগুল হয়ে যাবে। এ আয়াতে তাদের এমনি ধরণের এক ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাদেরকে একবার এক আযাবে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দো’আর বরকতে আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও তারা আল্লাহর কাছে নত হয়নি এবং শির্ককেই আঁকড়ে ধরে থাকে। মূলতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসীদের উপর দুর্ভিক্ষের আযাব দেয়ার জন্য দোআ করেছিলেন। ফলে কুরাইশরা ঘোরতর দুর্ভিক্ষে পতিত হয় এবং মৃত জন্তু, কুকুর ইত্যাদি খেতে বাধ্য হয়।

নবী (সাঃ) বদ্দুআ করেছিলেন, ‘‘হে আল্লাহ! ইউসুফ (আঃ)-এর যুগের ৭ বছর দুর্ভিক্ষের মত দুর্ভিক্ষে পীড়িত করে তাদের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য কর। (বুখারীঃ দু’আ অধ্যায়, মুসলিমঃ মাসাজিদ অধ্যায়।) যার ফলে মক্কার কাফেররা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে।

অবস্থা বেগতিক দেখে আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয় এবং বলেঃ আমি আপনাকে আত্মীয়তার কসম দিচ্ছি। আপনি কি একথা বলেননি যে, আপনি বিশ্ববাসীদের জন্যে রহমতস্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন? তিনি উত্তরে বললেন হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে আমি একথা বলেছি, এবং বাস্তবেও তাই। আবু সুফিয়ান বললঃ স্বগোত্রের প্রধানদেরকে তো বদর যুদ্ধে তরবারী দ্বারা হত্যা করেছেন। যারা জীবিত আছে, তাদেরকে ক্ষুধা দিয়ে হত্যা করছেন। আল্লাহর কাছে দোআ করুন, যাতে এই আযাব আমাদের উপর থেকে সরে যায়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো’আ করলেন। ফলে, তৎক্ষণাৎ আযাব খতম হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই উক্ত আয়াত নাযিল হয়। আয়াতে বলা হয়েছে যে, আযাবে পতিত হওয়া এবং আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও তারা তাদের পালনকর্তার সামনে নত হয়নি। বাস্তব ঘটনা তাই ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দো’আয় দুর্ভিক্ষ দূর করা হলো কিন্তু মক্কার মুশরিকরা তাদের শির্ক ও কুফরে পূর্ববৎ অটল রইল। [সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ১৭৫৩,

 

১০:১২ وَ اِذَا مَسَّ الۡاِنۡسَانَ الضُّرُّ دَعَانَا لِجَنۡۢبِهٖۤ اَوۡ قَاعِدًا اَوۡ قَآئِمًا ۚ فَلَمَّا کَشَفۡنَا عَنۡهُ ضُرَّهٗ مَرَّ کَاَنۡ لَّمۡ یَدۡعُنَاۤ اِلٰی ضُرٍّ مَّسَّهٗ ؕ کَذٰلِکَ زُیِّنَ لِلۡمُسۡرِفِیۡنَ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ

১২. আর মানুষকে যখন দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করে তখন সে শুয়ে, বসে বা দাঁড়িয়ে আমাদেরকে ডেকে থাকে অতঃপর আমরা যখন তার দুঃখ-দৈন্য দূর করি, তখন সে এমনভাবে চলতে থাকে যেন তাকে দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করার পর তার জন্য সে আমাদেরকে ডাকেইনি। এভাবেই সীমালংঘনকারীদের কাজ তাদের কাছে শোভনীয় করে দেয়া হয়েছে।

এ আয়াতে সাধারণ মানুষের এক রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তা হলো এই যে, সাধারণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময় এরা আল্লাহ ও আখেরাতের বিরুদ্ধে যুক্তি-তর্কে লিপ্ত হয়, অন্যান্যদেরকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করে এবং তাদেরই কাছে উদ্দেশ্য সিদ্ধির আশা করে, কিন্তু যখন কোন বিপদে পড়ে তখন এরা নিজেরাও আল্লাহ ব্যতীত সমস্ত লক্ষ্যস্থলের প্রতি নিরাশ হয়ে গিয়ে শুধু আল্লাহকেই ডাকতে আরম্ভ করে। শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে সর্বাবস্থায় একমাত্র তাকেই ডাকতে বাধ্য হয়। [সা’দী] অথচ তারই সাথে তাদের অনুগ্রহ বিমুখতার অবস্থা হল এই যে, যখনই আল্লাহ্ তা’আলা তাদের বিপদাপদ দূর করে দেন, তখনই আল্লাহ্ তা’আলার ব্যাপারে এমন মুক্ত হয়ে যায়, যেন কখনো তাঁকে ডাকেইনি, তার কাছে যেন কোন বাসনাই প্রার্থনা করেনি। এ বিষয়টি আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের অন্যান্য স্থানেও উল্লেখ করেছেন। যেমন,

আর মানুষকে যখন দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করে তখন সে একাগ্রচিত্তে তার রবকে ডাকে। তারপর যখন তিনি নিজের পক্ষ থেকে তার প্রতি অনুগ্রহ করেন তখন সে ভুলে যায় তার আগে যার জন্য সে ডেকেছিল তাকে এবং সে আল্লাহ্‌র সমকক্ষ দাঁড় করায়, অন্যকে তার পথ থেকে বিভ্ৰান্ত করার জন্য। বলুন, কুফরীর জীবন তুমি কিছুকাল উপভোগ করে নাও। নিশ্চয় তুমি আগুনের অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত। সূরা আয-যুমারঃ ৮

৪৯. অতঃপর যখন কোন বিপদ-আপদ মানুষকে স্পর্শ করে, তখন সে আমাদেরকে ডাকে; তারপর যখন তাকে আমরা আমাদের কোন নিয়ামতের অধিকারী করি তখন সে বলে, আমাকে এটা দেয়া হয়েছে কেবল আমার জ্ঞানের কারণে। বরং এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের বেশীর ভাগই তা জানে না।, আয-যুমারঃ ৪৯

৮৩. আর আমরা যখন মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করি তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও দূরে সরে যায়। আর যখন তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে তখন সে একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে। আল-ইসরাঃ ৮৩,

৫১. আর যখন আমরা মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করি তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও দূরে সরে যায়। আর যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে তখন সে দীর্ঘ প্রার্থনাকারী হয়। ফুসসিলাতঃ ৫১৷

কিন্তু যাদের হেদায়াত নসীব হয়েছে এবং ঈমান এনেছে, তারা সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ রাখে। আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে সূরা হুদের ১১ নং আয়াতে ব্যতিক্রম বলে ঘোষণা করেছেন।

৯. আর যদি আমরা মানুষকে আমাদের কাছ থেকে রহমত আস্বাদন করাই(১) ও পরে তার কাছ থেকে আমরা তা ছিনিয়ে নেই তবে তো নিশ্চয় সে হয়ে পড়ে হতাশ ও অকৃতজ্ঞ। ১০. আর যদি দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করার পর আমরা তাকে সুখ আস্বাদন করাই তখন সে অবশ্যই বলবে, আমার বিপদ-আপদ কেটে গেছে, আর সে তো হয় উৎফুল্ল ও অহংকারী। ১১. কিন্তু যারা ধৈর্যশীল ও সৎকর্মপরায়ণ তাদেরই জন্য আছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। সূরা হুদঃ ৯-১১

অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

মুমিনের কাজ-কারবার দেখে আশ্চৰ্য্য হতে হয়, আল্লাহ তার জন্য যা কিছুই ঘটাক সেটাই তার জন্য কল্যাণের রূপ নেয়। যদি তার কোন ক্ষতি বা দুঃখজনক কিছু ঘটে তখন সে তাতে ধৈর্য ধারণ করে, ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি তার কোন খুশী বা লাভজনক কিছু হয় তাতে সে কৃতজ্ঞ হয়, শুকরিয়া আদায় করে, ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। এটা একমাত্র মুমিনই পেতে পারে, আর কারো পক্ষে নয়’। [মুসলিমঃ ২৯৯৯]

সত্যিকার মানুষকে সাধারণ মানবীয় দুর্বলতা হতে পৃথক করে বলা হয়েছে যে, সে সব ব্যক্তি সাধারণ মানবীয় দুর্বলতার উর্ধ্বে যাদের মধ্যে দুটি বিশেষ গুণ রয়েছে।

একটি হচ্ছে ধৈর্য ও সহনশীলতা, দ্বিতীয়টি সৎকর্মশীলতা।

সবর শব্দটি আরবী ভাষায় অনেক ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়। সবরের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বাধা দেয়া, বন্ধন করা। কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় অন্যায় কার্য হতে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করাকে সবর বলে। সুতরাং শরীআতের পরিপন্থী যাবতীয় পাপকার্য হতে প্রবৃত্তিকে দমন করা যেমন সবরের অন্তর্ভুক্ত তদ্রুপ ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ও মুস্তাহাব ইত্যাদি নেক কাজের জন্য প্রবৃত্তিকে বাধ্য করাও সবরের শামিল। এর বাইরে বিপদাপদে নিজেকে সংযত রাখতে পারাও সবরের অন্তর্ভুক্ত। [ইবনুল কাইয়্যেম: মাদারেজুস সালেকীন] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যার হাতে আমার আত্মা তার শপথ করে বলছি, একজন মুমিনের উপর আপতিত যে কোন ধরনের চিন্তা, পেরেশানী, কষ্ট, ব্যথা, দুর্ভাবনা এমনকি একটি কাটা ফুটলেও এর মাধ্যমে আল্লাহ তার গুণাহের কাফফারা করে দেন”। [বুখারীঃ ৫৬৪১, ৫৬৪২, মুসলিমঃ ২৫৭৩]

৮. কাউকে যদি তার মন্দকাজ শোভন করে দেখানো হয়। ফলে সে এটাকে উত্তম মনে করে, (সে ব্যক্তি কি তার সমান যে সৎকাজ করে?)। তবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে বিভ্ৰান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছে হিদায়াত করেন। অতএব তাদের জন্য আক্ষেপ করে আপনার প্ৰাণ যেন ধ্বংস না হয়। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত। সূরা ফাতির ৮

এই আমল শোভন করা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ অথবা অবকাশস্বরূপ হতে পারে। শয়তানের পক্ষ থেকে কুমন্ত্রণা দ্বারাও হতে পারে। আবার মানুষের ঐ আত্মার পক্ষ থেকেও হতে পারে, যে আত্মা মানুষকে নোংরা কাজে উদ্বুদ্ধ করে।

১২:৫৩ وَ مَاۤ اُبَرِّیٴُ نَفۡسِیۡ ۚ اِنَّ النَّفۡسَ لَاَمَّارَۃٌۢ بِالسُّوۡٓءِ اِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّیۡ ؕ اِنَّ رَبِّیۡ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

৫৩. আর আমি নিজকে নির্দোষ মনে করিনা, কেননা নিশ্চয় মানুষের নাফস খারাপ কাজের নির্দেশ দিয়েই থাকে, কিন্তু সে নয়, যার প্রতি আমার রব দয়া করেন। নিশ্চয় আমার রব অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

(يوسف-৫৩) إِنَّ النَّفْسَ لأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ বস্তুতঃ সীমালংঘনকারীরাই এর শিকার হয়। এখানে অর্থ এই দাঁড়ালো যে, দু’আ থেকে বিমুখতা, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা থেকে ঔদাস্য এবং প্রবৃত্তিপূজা ইত্যাদি কর্মকে তাদের জন্য সুশোভিত করে দেওয়া হয়েছে। (ফাতহুল কাদীর)

 

১০:১৩ وَ لَقَدۡ اَهۡلَکۡنَا الۡقُرُوۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَمَّا ظَلَمُوۡا ۙ وَ جَآءَتۡهُمۡ رُسُلُهُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ وَ مَا کَانُوۡا لِیُؤۡمِنُوۡا ؕ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡقَوۡمَ الۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿

১৩. আর অবশ্যই আমরা তোমাদের আগে বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি যখন তারা যুলুম করেছিল। আর তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ এসেছিল, কিন্তু তারা ঈমান আনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এভাবে আমরা অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি।

মূল আয়াতে, “কার্ন” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ সাধারণভাবে আরবীতে এর অর্থ হয় কোন বিশেষ যুগের অধিবাসী বা প্রজন্ম৷ কিন্তু কুরআন মজীদে যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তাতে মনে হয় কার্ন শব্দের মাধ্যমে এমন জাতির কথা বুঝানো হয়েছে যারা নিজেদের যুগে উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল এবং পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিল৷ এ ধরনের জাতির ধ্বংস নিশ্চিতভাবে এ অর্থ বহন করে না যে,শাস্তি হিসেবে তাদের সমগ্র জনশক্তিকেই ধ্বংস করে দেয়া হতো বরং তাদেরকে উন্নতি ও নেতৃত্বের আসন থেকে নামিয়ে দেয়া, তাদের সভ্যত-সংস্কৃতি ধবংস হয়ে যাওয়া তাদের বৈশিষ্ট বিলুপ্ত হওয়া এবং তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য জাতির মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হতো৷ মূলত এসবই ধ্বংসের এক একটি প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়৷

সাধারণভাবে জুলুম বলতে যা বুঝায় এখানে সেই ধরনের কোন সংকীর্ণ অর্থ ব্যবহার করা হয়নি৷ বরং আল্লাহর বান্দা ও গোলাম হিসেবে যে সীমারেখা ও বিধি নিষেধ মেনে চলা মানুষের কর্তব্য, সেই বিধি নিষেধ ও সীমারেখা লংঘন করে সে যেসব গোনাহ করে এখানে সেগুলোর অর্থেই জুলুম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ৷

যালেম শব্দটি গভীর অর্থবোধক ৷ ‘যুলুম’ বলা হয় অধিকার হরণকে ৷ যে ব্যক্তি কারো অধিকার হরণ করে সে যালেম ৷ যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম পালন করে না , তাঁর নাফরমানি করে সে আসলে তিনটি বড় বড় মৌলিক অধিকার হরণ করে ৷

প্রথমত সে আল্লাহর অধিকার হরণ করে ৷ কারণ আল্লাহর হুকুম পালন করতে হবে, এটা আল্লাহর অধিকার ৷

দ্বিতীয়ত এই নাফরমানি করতে গিয়ে সে যে সমস্ত জিনিস ব্যবহার করে তাদের সবার অধিকার সে হরণ করে তার দেহের অংগ-প্রত্যংগ, স্নায়ু মন্ডলী, তার সাথে বসবাসকারী সমাজের অন্যান্য লোক, তার ইচ্ছা ও সংকল্প পূর্ণ করার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ফেরেশতাগণ এবং যে জিনিসগুলো সে তার কাজে ব্যবহার করে –এদের সবার তার উপর অধিকার ছিল , এদেরকে কেবলমাত্র এদের মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে ৷ কিন্তু যখন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে তাদের ওপর নিজের কর্তৃত্ব ব্যবহার করে তখন সে আসলে তাদের ওপর যুলুম করে ৷ তৃতীয়ত তার নিজের অধিকার হরণ করে ৷ কারণ তার ওপর তার আপন সত্তাকে ধ্বংস থেকে বাঁচবার অধিকার আছে ৷ কিন্তু নাফরমানি করে যখন সে নিজেকে আল্লাহর শাস্তিলাভের অধিকারী করে তখন সে আসলে নিজের ব্যক্তি সত্তার ওপর যুলুম করে ৷ এসব কারণে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ‘গোনাহ’ শব্দটি জন্য যুলুম এবং ‘গোনাহগার’ শব্দটি জন্য যালেম পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে ৷

কেউ যেন আল্লাহ্ তা’আলার অবকাশ দানের কারণে এমন ধারণা করে না বসে যে, পৃথিবীতে আযাব আসতেই পারে না। বিগত জাতিসমূহের ইতিহাস এবং তাদের ঔদ্ধত্য ও কৃতঘ্নতার সাক্ষীস্বরূপ বিভিন্ন রকম আযাব এ পৃথিবীতেই এসে গেছে। এটা হচ্ছে জাতিসমূহের ব্যাপারে আল্লাহর নীতি। [সা’দী] আল্লাহ্ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ দোআ কবুল করে নিয়েছেন যে, কোন সাধারণ ব্যাপক আযাব এ উম্মতের উপর আসবে না। ফলে আল্লাহ তা’আলার এহেন করুণা, অনুগ্রহ এসব লোককে এমন নির্ভয় করে দিয়েছে যে, তারা একান্ত দুঃসাহসের সাথে আল্লাহর আযাবকে আমন্ত্রণ জানাতে এবং তার দাবী করতে তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, আল্লাহ্ তা’আলার আযাব সম্পর্কে এ নিশ্চিন্ততা কোন অবস্থাতেই তাদের জন্য সমীচীন ও কল্যাণকর নয়। কারণ, গোটা উম্মত এবং সমগ্র বিশ্বের উপর ব্যাপক আযাব না আসলেও বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের উপর আযাব নেমে আসা অসম্ভব নয়।

১০:১৪ ثُمَّ جَعَلۡنٰکُمۡ خَلٰٓئِفَ فِی الۡاَرۡضِ مِنۡۢ بَعۡدِهِمۡ لِنَنۡظُرَ کَیۡفَ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿

১৪. তারপর আমরা তোমাদেরকে তাদের পর যমীনে স্থলাভিষিক্ত করেছি, তোমরা কিরূপ কাজ কর তা দেখার জন্য।

خلائف, خليفة এর বহুবচন। যার অর্থ হল, পূর্ব জাতির প্রতিনিধি। অথবা এক অপরের প্রতিনিধি বা স্থলাভিষিক্ত।

মনে রাখতে হবে, এখানে সম্বোধন করা হচ্ছে, আরববাসীদেরকে ৷ তাদেরকে বলা হচ্ছে, আগের জাতিগুলোকে তাদের যুগে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত জুলুম ও বিদ্রোহের নীতি অবলম্বন করেছিল এবং তাদেরকে সঠিক পথ দেখাবার জন্য যেসব নবী পাঠানো হয়েছিল তাদের কথা তারা মানেনি৷ তাই আমার পরীক্ষায় তারা ব্যর্থ হয়েছে৷ এবং তাদেরকে ময়দান থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ এখন হে আরববাসীরা! তোমাদের পালা এসেছে৷ তাদের জায়গায় তোমাদের কাজ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে৷ তোমরা এখন পরীক্ষা গৃহে দাঁড়িয়ে আছো৷ তোমাদের পূর্ববর্তীরা ব্যর্থ হয়ে এখান থেকে বের হয়ে গেছে৷ তোমরা যদি তাদের মতো একই পরিণামের সম্মুখীন হতে না চাও তাহলে তোমাদের এই যে সুযোগ দেয়া হচ্ছে এ থেকে যথাযথভাবে লাভবান হও৷ অতীতের জাতিদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো এবং যেসব ভূল তাদের ধ্বংসের কারণে পরিণত হয়েছিল সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করো না৷

অতঃপর পূর্ববর্তী জাতি-সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার পর আমি তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছি। এই মর্যাদা ও সম্মান দানের পিছনে আসল উদ্দেশ্য হলো তোমাদের পরীক্ষা নেয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “দুনিয়া হলো সুফলা সুমিষ্ট জিনিস, আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাতে প্রতিনিধিত্ব করাবেন। এতে করে তিনি দেখতে চান তোমাদের আমল কেমন? সুতরাং তোমরা দুনিয়ার ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন কর এবং মহিলাদের ব্যাপারেও তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। কেননা বনী ইসরাঈলদের প্রথম পরীক্ষা ছিল মহিলাদের দ্বারা”। [মুসলিমঃ ২৭৪২]

১০:১৫ وَ اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡهِمۡ اٰیَاتُنَا بَیِّنٰتٍ ۙ قَالَ الَّذِیۡنَ لَا یَرۡجُوۡنَ لِقَآءَنَا ائۡتِ بِقُرۡاٰنٍ غَیۡرِ هٰذَاۤ اَوۡ بَدِّلۡهُ ؕ قُلۡ مَا یَکُوۡنُ لِیۡۤ اَنۡ اُبَدِّلَهٗ مِنۡ تِلۡقَآیِٔ نَفۡسِیۡ ۚ اِنۡ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا یُوۡحٰۤی اِلَیَّ ۚ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اِنۡ عَصَیۡتُ رَبِّیۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿

১৫. আর যখন আমাদের আয়াত, যা সুস্পষ্ট, তাদের কাছে পাঠ করা হয় তখন যারা আমাদের সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না তারা বলে, অন্য এক কুরআন আন এটা ছাড়া, বা এটাকে বদলাও। বলুন, নিজ থেকে এটা বদলানো আমার কাজ নয়। আমার প্রতি যা ওহী হয়, আমি শুধু তারই অনুসরণ করি। আমি আমার রবের অবাধ্যতা করলে অবশ্যই মহা দিনের শাস্তির আশংকা করি।

এ আয়াতে আখেরাত অস্বীকারকারীদের একটি ভ্রান্ত ধারণা এবং অন্যায় আবদারের খণ্ডন করা হয়েছে। এসব লোক আল্লাহ তা’আলার ওহী ও রেসালাত সম্পর্কিত কোন পরিচয় জানত না। যে কুরআনুল কারীম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে পৌছেছে, তার সম্পর্কে এদের ধারণা ছিল এই যে, এটি স্বয়ং তারই কালাম, তারই রচনা। এ ধারণার প্রেক্ষিতেই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে দাবী জানায় যে, কুরআন এটি তো আমাদের বিশ্বাসের বিরোধী; যে মূর্তি-বিগ্রহকে আমাদের পিতা-পিতামহ সততঃ সম্মান করে এসেছে, কুরআন সে সমুদয়কে বাতিল ও পরিতাজ্য সাব্যস্ত করে। তদুপরি কুরআন আমাদের বলে যে, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হতে হবে এবং সেখানে হিসাব-নিকাশ হবে। এসব বিষয় আমাদের বুঝে আসে না। আমরা এসব মানতে রাযী নই। সুতরাং হয় আপনি এ কুরআনের পরিবর্তে অন্য কুরআন তৈরী করে দিন যাতে এসব বিষয় থাকবে না, আর না হয় অন্ততঃ এতেই সংশোধন করে সে বিষয়গুলো বাদ দিয়ে দিন। [দেখুন, বাগভী; কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

তারা আরও চাচ্ছিল যে, হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করে দিন। [তাবারী; কুরতুবী] আল্লাহ্ তা’আলা তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে হেদায়াত দান করেছেন যে, আপনি তাদের বলে দিনঃ এটি আমার কালামও নয় এবং নিজের ইচ্ছামত আমি এতে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধনও করতে পারি না। আমি তো শুধুমাত্র আল্লাহর ওহীর তাবেদার। আমি আমার ইচ্ছামত এতে যদি সামান্যতম পরিবর্তনও করি, তাহলে অতি কঠিন গোনাহগার হয়ে পড়ব এবং নাফরমানদের জন্য যে আযাব নির্ধারিত রয়েছে, আমি তার ভয় করি। কাজেই আমার পক্ষে এমনটি অসম্ভব। [ফাতহুল কাদীর]

এটি হচ্ছে ওপরের দুটি কথার জবাব। এখানে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, আমি এ কিতাবের রচয়িতা নই বরং অহীর মাধ্যমে এটি আমার কাছে এসেছে এবং এর মধ্যে কোন রকম রদবদলের অধিকারও আমার নেই। আর তাছাড়া এ ব্যাপারে কোন প্রকার সমঝোতার সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই। যদি গ্রহণ করতে হয় তাহলে এ সমগ্র দীনকে হুবহু গ্রহণ করতে হবে, নয়তো পুরোপুরি রদ করে দিতে হবে।

 

১০:১৬ قُلۡ لَّوۡ شَآءَ اللّٰهُ مَا تَلَوۡتُهٗ عَلَیۡکُمۡ وَ لَاۤ اَدۡرٰىکُمۡ بِهٖ ۫ۖ فَقَدۡ لَبِثۡتُ فِیۡکُمۡ عُمُرًا مِّنۡ قَبۡلِهٖ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿

১৬. বলুন, আল্লাহ যদি চাইতেন আমিও তোমাদের কাছে এটা তিলাওয়াত করতাম না এবং তিনিও তোমাদেরকে এ বিষয়ে জানাতেন না। আমি তো এর আগে তোমাদের মধ্যে জীবনের দীর্ঘকাল অবস্থান করেছি; তবুও কি তোমরা বুঝতে পার না?

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নিজে এ কিতাবের রচয়িতা নন বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে অহীর মাধ্যমে এটি তার ওপর নাযিল হচ্ছে, তার এ দাবীর সপক্ষে এটি একটি জোরালো যুক্তি। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন তো তাদের মাঝেই ছিল। নবুওয়াত লাভের আগে পুরো চল্লিশটি বছর তিনি তাদের মধ্যে অতিবাহিত করেছিলেন। কোন লেখা পড়া জানতেন না। [কুরতুবী] তিনি তাদের শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের চোখের সামনে তাঁর শিশুকাল অতিক্রান্ত হয়। সেখানেই বড় হন। যৌবনে পদার্পণ করেন তারপর প্রৌঢ়ত্বে পৌছেন। থাকা-খাওয়া, ওঠা-বসা, লেনদেন, বিয়ে শাদী ইত্যাদি সব ধরনের সামাজিক সম্পর্ক তাদের সাথেই ছিল এবং তার জীবনের কোন দিক তাদের কাছে গোপন ছিল না।

এ সময়টুকু ছিল, চল্লিশ বৎসর। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ “আল্লাহ্ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চল্লিশ বৎসর বয়সে নবুওয়াত দেন।” [বুখারীঃ ৩৫৪৮, মুসলিমঃ ২৩৪৭]

তার এ জীবনধারার মধ্যে দুটি বিষয় একেবারেই সুস্পষ্ট ছিল। মক্কার প্রত্যেকটি লোকই তা জানতো।

এক, নবুওয়াত লাভ করার আগে তার জীবনের পুরো চল্লিশটি বছরে তিনি এমন কোন শিক্ষা, সাহচর্য ও প্রশিক্ষণ লাভ করেননি এবং তা থেকে এমন তথ্যাদি সংগ্রহ করেননি যার ফলে একদিন হঠাৎ নবুওয়াতের দাবী করার সাথে সাথেই তার কণ্ঠ থেকে এ তথ্যাবলীর ঝর্ণাধারা নিঃসৃত হতে আরম্ভ করেছে।

দ্বিতীয় যে কথাটি তাঁর পূর্ববর্তী জীবনে সুস্পষ্ট ছিল সেটি এই যে, নবুওয়াত লাভের পূর্ব থেকেই তিনি সততা ও আমানতদারীতে প্রসিদ্ধ ছিলেন। [কুরতুবী] মিথ্যা, প্রতারণা, জালিয়াতী, ধোঁকা, শঠতা, ছলনা এবং এ ধরনের অন্যান্য অসৎগুণাবলীর কোন সামান্যতম গন্ধও তাঁর চরিত্রে পাওয়া যেতো না।

মূলতঃ এটা এমন একটি দিক যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তের অত্যন্ত সুস্পষ্ট দলীল। সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তোমরা কি তাকে (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) এ-ধরনের (অর্থাৎ নবুওয়তের) দাবীর পূর্বে কখনো মিথ্যা বলার অপবাদ দিতে? আবু সুফিয়ান তখন বলেছিল, না– অথচ আবু সুফিয়ান ঐ সময় কাফেরদের সর্দার ছিল। তারপরও সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে হক কথা বলতে বাধ্য হয়েছিল। আর জানা কথা যে, শক্রদের মুখ থেকে যে প্রশংসা বের হয় তা যথার্থ প্রশংসা।

মোটকথাঃ তখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস বলেছিলেনঃ “আমি এটা অবশ্যই বুঝি যে, সে মানুষের সাথে মিথ্যা কথা ত্যাগ করেছে তারপর সে আল্লাহর উপর মিথ্যা কথা বলবে এটা কখনো হতে পারে না” [বুখারীঃ ৭, মুসলিমঃ ১৭৭৩]

অনুরূপভবে জাফর ইবনে আবি তালেবও আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজাসির দরবারে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে বলেছেন যে, “আল্লাহ আমাদের মধ্যে এমন একজন রাসূলকে পাঠিয়েছেন যার গুণাগুণ বংশ পরিচয় ও আমানতদারী সম্পর্কে আমাদের সবাই জানে”। [মুসনাদে আহমাদ: ১/২০১]

৪৪. তিনি যদি আমাদের নামে কোন কথা রচনা করে চালাতে চেষ্টা করতেন, ৪৫. তবে অবশ্যই আমরা তাকে পাকড়াও করতাম ডান হাত দিয়ে ৪৬. তারপর অবশ্যই আমরা কেটে দিতাম তার হৃদপিণ্ডের শিরা, ৪৭. অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউই নেই, যে তাঁকে রক্ষা করতে পারে। সূরা হাক্কাহঃ ৪৪-৪৭

১০:১৭ فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰهِ کَذِبًا اَوۡ کَذَّبَ بِاٰیٰتِهٖ ؕ اِنَّهٗ لَا یُفۡلِحُ الۡمُجۡرِمُوۡنَ ﴿

১৭. অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রচনা বা আল্লাহর আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? নিশ্চয় অপরাধীরা সফলকাম হবে না।

অর্থাৎ তার চাইতে বড় যালেম আর কেউ নেই যে আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে এবং তাঁর বাণী পরিবর্তন করে। আর তিনি যা নাযিল করেছেন তার সাথে কোন কিছু যোগ করে দেয়। অনুরূপভাবে তোমাদের থেকে বড় যালেমও আর কেউ হবে না যদি তোমরা কুরআনকে অস্বীকার কর এবং আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দাও এবং বল যে, এটা আল্লাহর কালাম নয়। এটাই আল্লাহ তা’আলা তার রাসূলকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তিনি তাদেরকে এটা জানিয়ে দেন। [কুরতুবী]

(২) অর্থাৎ যারা আল্লাহর উপর মিথ্যাচার করে তারা কখনো সফলকাম হবে না। তাদের কর্মকাণ্ড মানুষের কাছে মিথ্যা হিসেবে বিবেচিত হবেই। মূলত: নবী সত্য বা মিথ্যা এটা জানার বিভিন্ন পদ্ধতি বিদ্যমান। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, দু’জনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, কথাবার্তা, চাল-চলন ইত্যাদি তুলনা করা। বিবেকবান মাত্রই এ কাজটি সহজে করতে পারে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মুসাইলামা কাযযাবের কোন তুলনা কি চলে? আমর ইবনে আস একবার মুসাইলামার কাছে গেল। মুসাইলামা তার পুরাতন বন্ধু ছিল। আমর তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। তখন মুসাইলামা তাকে জিজ্ঞাসা করলঃ হে আমর! তোমাদের লোকের (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর) উপর এ সময়ে কি নাযিল হয়েছে? আমর ইবনে আস জবাবে বললঃ আমি তার সাথীদের একটি সূরা পড়তে শুনেছি।

মুসাইলামা বললঃ সেটা কি? আমর বললঃ (وَالْعَصْرِ ٭ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ ٭ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ) সূরাটি শুনে মুসাইলামা কিছুক্ষণ চিন্তা করতে থাকলো, তারপর বললোঃ আমার উপরও অনুরূপ নাযিল করা হয়েছে। আমর বললোঃ সেটা কি? সে বললঃ يَاوَبَرَ إنَّهَا أنْتَ أُذْنَانِ وَصَدَرُ وَسَائِرُكَ حَقْرٌ نَقْرٌ তারপর মুসাইলামা বাহাদুরী নেয়ার আশায় আমরের দিকে তাকিয়ে বললোঃ আমর! কেমন লাগলো? তখন আমর বললোঃ আল্লাহর শপথ করে বলছি, তুমি অবশ্যই এটা জানো যে, আমি জানি, তুমি মিথ্যা বলছ। [ইবন কাসীর; ইবন রাজাব, জামেউল উলুম ওয়াল হিকাম: ১১২] এটাই যদি একজন কাফেরের বিশ্লেষণ তাহলে মুমিন কত সহজেই সত্য নবী ও মিথ্যা নবীর মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে তা বলাই বাহুল্য।

অপরদিকে আমরা সত্য নবীর ব্যাপারেও তার সততার সাক্ষ্য খুব সহজভাবেই দেখতে পাই। আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বলেনঃ “যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমণ করলেন তখন লোকেরা চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসলো। আমিও তাদের সাথে আসার পর যখন আমি তাকে দেখলাম তখনি বুঝতে পারলাম যে, তার চেহারা কোন মিথ্যুক লোকের চেহারা নয়। তখন আমি প্রথম যে কথা কয়টি শুনেছিলাম তা হলোঃ হে মানব সম্প্রদায়! সালামের প্রসার কর, খাবার খাওয়াও, আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখো এবং রাতে মানুষেরা যখন ঘুমন্ত থাকে তখন সালাত আদায় কর, ফলে তোমরা প্রশান্তির সাথে বা সালামের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে”। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ৪২৮৩]।

১৮ وَ یَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مَا لَا یَضُرُّهُمۡ وَ لَا یَنۡفَعُهُمۡ وَ یَقُوۡلُوۡنَ هٰۤؤُلَآءِ شُفَعَآؤُنَا عِنۡدَ اللّٰهِ ؕ قُلۡ اَتُنَبِّـُٔوۡنَ اللّٰهَ بِمَا لَا یَعۡلَمُ فِی السَّمٰوٰتِ وَ لَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ سُبۡحٰنَهٗ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ

১৮. আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদাত করছে যা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। বলুন, তোমরা কি এমন কিছুর সংবাদ দেবে যা তিনি জানেন না? তিনি মহান, পবিত্র এবং তারা যাকে শরীক করে তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।

অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলাই সর্বজ্ঞানী। আসমান ও যমীনে যা আছে তার জ্ঞান সেটাকে ঘিরে আছে। তিনি তোমাদের জানাচ্ছেন যে, তার কোন শরীক নেই, তার সাথে কোন ইলাহ নেই। আর হে মুশরিক সম্প্রদায়! তোমরা মনে করছ যে, তাঁর শরীক পাওয়া যায়? তোমরা কি তাকে এমন বিষয়ের সংবাদ দিচ্ছ যা তার কাছে গোপন রয়েছে এবং তোমরা জেনে নিয়েছ? এটা নিঃসন্দেহে বড় অসার কথা। এ মূৰ্খ লোকগুলো কি রাব্বুল আলামীনের চেয়ে বেশী জানে? এ বিষয়টি সম্পর্কে সামান্য চিন্তা করলেই এর অসারতা ধরা পড়ে। [সা’দী]

কারণ, কোন জিনিসের আল্লাহর জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার মানেই হচ্ছে এই যে, সেটির কোন অস্তিত্বই নেই। কারণ, যা কিছুর অস্তিত্ব আছে সবই আল্লাহর জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই আল্লাহ তো জানেন না আকাশে ও পৃথিবীতে তার কোন শরীক আছে। অনুরূপভাবে তিনি জানেন না তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে কোন সুপারিশকারী আছে, এটি সুপারিশকারীদের অস্তিত্বহীনতার ব্যাপারে একটি চমৎকার বর্ণনা পদ্ধতি। অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবীতে যখন কোন সুপারিশকারী আছে বলে আল্লাহর জানা নেই এখন তোমরা কোন সুপারিশকারীদের কথা বলছ? [ফাতহুল কাদীর] অন্য আয়াতেও আল্লাহ্ তা’আলা এ কথাটি বলেছেন। তিনি বলেন, “আর তারা আল্লাহর বহু শরীক সাব্যস্ত করেছে। বলুন, তাদের পরিচয় দাও। নাকি তোমরা যমীনের মধ্যে এমন কিছুর সংবাদ দিতে চাও যা তিনি জানেন না?” [সূরা আর-রাদ: ৩৩]

১০:১৯ وَ مَا کَانَ النَّاسُ اِلَّاۤ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً فَاخۡتَلَفُوۡا ؕ وَ لَوۡ لَا کَلِمَۃٌ سَبَقَتۡ مِنۡ رَّبِّکَ لَقُضِیَ بَیۡنَهُمۡ فِیۡمَا فِیۡهِ یَخۡتَلِفُوۡنَ ﴿

১৯. আর মানুষ ছিল একই উম্মত, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে। আর আপনার রবের পূর্ব ঘোষণা না থাকলে তারা যে বিষয়ে মতভেদ ঘটায় তার মীমাংসা তো হয়েই যেত।

অর্থাৎ সমস্ত আদম সন্তান প্রথমে একত্ববাদে বিশ্বাসী একই উম্মত ও একই জাতি ছিল। শির্ক ও কুফরের নামও ছিল না। পরে একত্ববাদে মতবিরোধ সৃষ্টি করে বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন সম্পপ্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়। একই উম্মত এবং সবার মুসলিম থাকার সময়কাল কতদিন এবং কবে ছিল তা বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, নূহ আলাইহিস সালাম-এর যুগ পর্যন্ত এমনি অবস্থা ছিল।

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আদম ও নৃহের মধ্যে দশ প্রজন্ম ছিল যারা তাওহীদের উপর ছিল। [তাবারী; ইবন কাসীর]। এরপর মানুষের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং ঈমানের বিরুদ্ধে কুফর ও শির্কী বিস্তার লাভ করে, তখন আল্লাহ্ তা’আলা তার নবী-রাসূলদেরকে ভীতিপ্রদর্শনকারী ও সুসংবাদদানকারী হিসেবে কিতাবসহ প্রেরণ করেন। “যাতে যে কেউ ধ্বংস হবে সে যেন সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পর ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকবে সে যেন সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পর জীবিত থাকে।” [সূরা আল-আনফাল ৪২] [ইবন কাসীর]

(২) কোন কোন মুফাসসির বলেন, সে কলেমাটি হচ্ছে এই যে, তিনি এ উম্মতকে সবশেষে আনবেন এবং তাদেরকে দুনিয়াতে আযাব না দিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ দিবেন। যদি এ অবকাশ না থাকত তবে অবশ্যই তাদের আযাব দিয়ে শেষ করে দেয়া হতো অথবা কিয়ামত অনুষ্ঠিত হয়ে যেত। [কুরতুবী] কোন কোন তাফসীরবিদ বলেন, এখানে ‘কালেমা’ বলে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, তিনি কাউকে দলীল-প্রমাণাদি ছাড়া পাকড়াও করবেন না। আর সেটা হচ্ছে, রাসূল প্রেরণ। যেমন অন্য আয়াতে বলেছেন, “আর আমরা রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত শাস্তি প্রদানকারী নই।” [সূরা আল-ইসরাঃ ১৫]

কারও কারও মতে, এখানে কালেমা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসে বর্ণিত একটি কালেমাকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে এসেছে, আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রাধান্য পাবে’। [বুখারী: ৭৫৫৩; মুসলিম: ২৭৫১] যদি তা না হতো তবে তিনি অপরাধীদেরকে তাওবার সময় দিতেন না। [কুরতুবী]

১০:২০ وَ یَقُوۡلُوۡنَ لَوۡ لَاۤ اُنۡزِلَ عَلَیۡهِ اٰیَۃٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ ۚ فَقُلۡ اِنَّمَا الۡغَیۡبُ لِلّٰهِ فَانۡتَظِرُوۡا ۚ اِنِّیۡ مَعَکُمۡ مِّنَ الۡمُنۡتَظِرِیۡنَ ﴿

২০. আর তারা বলে, ‘তার রবের কাছ থেকে তার কাছে কোন নিদর্শন নাযিল হয় না কেন? বলুন, গায়েবের জ্ঞান তো শুধু আল্লাহরই আছে। কাজেই তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি।

অর্থাৎ এ ব্যাপারে নিদর্শন যে, তিনি যথার্থই সত্য নবী এবং যা কিছু তিনি পেশ করছেন তা পুরোপুরি ঠিক। এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে রাখতে হবে। সেটি হচ্ছে, নিদর্শন পেশ করার দাবী তারা এ জন্য করেনি যে, তারা সাচ্চা দিলে সত্যের দাওয়াত গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল। আসলে নিদর্শনের এ দাবী শুধুমাত্র ঈমান না আনার জন্য একটি বাহানা হিসেবে পেশ করা হচ্ছিল। তাদেরকে যাই কিছু দেখানো হতো তা দেখার পরও তারা একথাই বলতো, আমাদের কোন নিদর্শনই দেখানো হয়নি। কারণ তারা ঈমান আনতে চাচ্ছিল না। আল্লাহ বলেনঃ “কত মহান তিনি যিনি ইচ্ছে করলে আপনাকে দিতে পারেন এর চেয়ে উৎকৃষ্ট বস্তু-উদ্যানসমূহ যার নিম্নদেশে নদী-নালা প্রবাহিত এবং তিনি দিতে পারেন আপনাকে প্রাসাদসমূহ! কিন্তু তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করেছে এবং যে কিয়ামতকে অস্বীকার করে তার জন্য আমি প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত আগুন। [সূরা আল-ফুরকানঃ ১০] অন্য আয়াতে বলেনঃ “পূর্ববর্তীগণের নিদর্শন অস্বীকার করাই আমাকে নিদর্শন পাঠান থেকে বিরত রাখে।” [সূরা আল-ইসরাঃ ৫৯l

কারণ, তাদের চাহিদা মোতাবেক নিদর্শন পাঠানোর পর যদি ঈমান না আনে তাহলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। কারণ, আল্লাহর নিয়ম হচ্ছে যে, সুনির্দিষ্ট কোন নিদর্শন চাওয়া হলে সেটা দেয়ার পর যদি ঈমান না আনে তবে তাদের ধ্বংস করা হয়। আর এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যখন নিদর্শন দেয়া ও অবকাশ না দেয়া আর নিদর্শন না দিয়ে অবকাশ দেয়ার মধ্যে কোন একটি গ্রহণ করার অধিকার প্রদান করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেছিলেন [ইবন কাসীর] কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে মোটেই কোন নিদর্শন দেখাননি। তাদেরকে অনেক বড় নিদর্শন দেখিয়েছেন। যেমন তাদের চাহিদা মোতাবেক চাঁদকে এমনভাবে দ্বিখণ্ডিত করে দেখিয়েছেন যে, কাফেরগন দুখণ্ডের মাঝে পাহাড় দেখতে পেয়েছিল। [বুখারীঃ ৩৬৩৬, মুসলিমঃ ২৮০০] কিন্তু তারপরও তারা ঈমান আনেনি। বরং আরো বেশী নিদর্শন দাবী করতে লাগল। আসলে তাদের উদ্দেশ্য ঈমান আনা নয়, তাদের উদ্দেশ্য হঠকারিতা। আল্লাহ বলেনঃ “তারা যত নিদর্শনই দেখুক না কেন ঈমান আনবে না”। [সূরা আল-আনআমঃ ২৫] আরো বলেনঃ “তারা যাবতীয় নিদর্শন দেখলেও ঈমান আনবে না”। [সূরা আল-আরাফঃ ১৪৬]

আরো বলেনঃ “নিশ্চয়ই যাদের বিরুদ্ধে আপনার প্রতিপালকের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে, তারা ঈমান আনবে না। যদিও তাদের কাছে সবগুলো নিদর্শন আসে, যতক্ষন পর্যন্ত না তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেখতে পাবে”। [সূরা ইউনুসঃ ৯৬–৯৭] অন্য আয়াতে বলেনঃ “আমরা তাদের কাছে ফিরিশতা পাঠালেও, মৃতেরা তাদের সাথে কথা বললেও এবং সকল বস্তুকে তাদের সামনে হাজির করলেও তারা কখনো ঈমান আনবে না; তবে যদি আল্লাহর ইচ্ছে হয়।” [সূরা আল-আনআমঃ ১১১]।

অহংকার ও সত্যকে অস্বীকার করা তাদের মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সুস্পষ্ট বিষয়কেও জেনে বুঝে অস্বীকার করতে দ্বিধা করে না। আল্লাহ বলেনঃ “যদি তাদের জন্য আকাশের দরজা খুলে দেই এবং তারা সারাদিন তাতে আরোহন করতে থাকে, তবুও তারা বলবে,আমাদের দৃষ্টি সম্মোহিত করা হয়েছে; না, বরং আমরা এক জাদুগ্ৰস্ত সম্প্রদায়।” [সূরা আল-হিজরঃ ১৪–১৫] আরো বলেনঃ “তারা আকাশের কোন খন্ড ভেংগে পড়তে দেখলে বলবে, এটা তো এক পুঞ্জিভূত মেঘ। [সূরা আত-তূরঃ ৪৪] আল্লাহ আরো বলেনঃ “আমরা যদি আপনার প্রতি কাগজে লিখিত কিতাবও নাযিল করতাম আর তারা যদি সেটা হাত দিয়ে স্পর্শও করত তবুও কাফিররা বলত, এটা স্পষ্ট জাদু ছাড়া আর কিছু নয়।” [সূরা আল-আনআমঃ ৭]

(২) অর্থাৎ আয়াত নাযিল করা একান্ত গায়েবী বিষয়। [কুরতুবী] আল্লাহ যা কিছু নাযিল করেছেন তা আমি পেশ করে দিয়েছি। আর যা তিনি নাযিল করেননি তা আমার ও তোমাদের জন্য “গায়েবী বিষয়” এর ওপর আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইখতিয়ার নেই। তিনি চাইলে তা নাযিল করতে পারেন। এখন আল্লাহ যা কিছু নাযিল করেননি তা আগে তিনি নাযিল করুন—একথার ওপর যদি তোমাদের ঈমান আনার বিষয়টি আটকে থাকে তাহলে তোমরা তার অপেক্ষায় বসে থাকো। [কুরতুবী] অথবা আয়াতের অর্থ, তোমরা আমাদের আল্লাহর ফয়সালার অপেক্ষা কর। তিনি হককে অবশ্যই বাতিলের উপর প্রকাশ করে দিবেন। [বাগভী]

সংগ্রহে

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন