শাওয়াল মাসের সাওম সংক্রান্ত কয়েকটি প্রশ্ন ও উত্তরঃ২০২৩

শাওয়াল মাসের সাওম সংক্রান্ত কয়েকটি প্রশ্ন ও উত্তরঃ

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে——-

 

প্রশ্ন-১

শাওয়াল মাসে ছয় রোজা রাখার হুকুম কি? এই রোজাগুলো রাখা কি ফরজ?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

রমজানের সিয়াম পালনের পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখা সুন্নত-মুস্তাহাব; ফরজ নয়। শাওয়াল মাসে ছয়দিন রোজা রাখার বিধান রয়েছে। এ রোজা পালনের মর্যাদা অনেক বড়, এতে প্রভূত সওয়াব রয়েছে। যে ব্যক্তি এ রোজাগুলো পালন করবে সে যেন গোটা বছর রোজা রাখল। এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

আবু আইয়ুব (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল এরপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখল সে যেন গোটা বছর রোজা রাখল।”[সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিজি, সুনানে নাসায়ী ও সুনানে ইবনে মাজাহ]এ হাদিসকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য বাণী দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের পরে ছয়দিন রোজা রাখবে সে যেন গোটা বছর রোজা রাখল:যে ব্যক্তি একটি নেকি করবে সে দশগুণ সওয়াব পাবে।”অন্য বর্ণনাতে আছে- “আল্লাহ এক নেকিকে দশগুণ করেন। সুতরাং এক মাসের রোজা দশ মাসের রোজার সমান। বাকী ছয়দিন রোজা রাখলে এক বছর হয়ে গেল।”[সুনানে নাসায়ী, সুনানে ইবনে মাজাহ]হাদিসটি সহিহ আত-তারগীব ও তারহীব (১/৪২১) গ্রন্থেও রয়েছে। সহিহ ইবনে খুজাইমাতে হাদিসটিএসেছে এ ভাষায়- “রমজান মাসের রোজা হচ্ছে দশ মাসের সমান। আর ছয়দিনের রোজা হচ্ছে- দুই মাসের সমান। এভাবে এক বছরের রোজা হয়ে গেল।”

হাম্বলি মাযহাব ও শাফেয়ি মাযহাবের ফিকাহবিদগণ স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে, রমজান মাসের পর শাওয়াল মাসে ছয়দিন রোজা রাখা একবছর ফরজ রোজা পালনের সমান। অন্যথায় সাধারণ নফল রোজার ক্ষেত্রেও সওয়াব বহুগুণ হওয়া সাব্যস্ত। কেননা এক নেকিতে দশ নেকি দেয়া হয়।

এ ছাড়া শাওয়ালের ছয় রোজারাখার আরও ফায়দা হচ্ছে- অবহেলার কারণে অথবা গুনাহর কারণে রমজানের রোজার উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে থাকে সেটা পুষিয়ে নেয়া।কেয়ামতের দিন ফরজ আমলের কমতি নফল আমল দিয়ে পূরণ করা হবে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কেয়ামতের দিন মানুষের আমলের মধ্যে সর্বপ্রথমনামাযের হিসাব নেয়া হবে।তিনি আরো বলেন: আমাদের রব ফেরেশতাদেরকে বলেন –অথচ তিনি সবকিছু জানেন- তোমরা আমার বান্দার নামাযদেখ; সেকি নামায পূর্ণভাবে আদায় করেছে নাকি নামাযে ঘাটতি করেছে। যদি পূর্ণভাবে আদায় করে থাকে তাহলে পূর্ণ নামায লেখা হয়। আর যদি কিছু ঘাটতি থাকে তখন বলেন: দেখ আমার বান্দার কোন নফল নামায আছে কিনা? যদি নফল নামায থাকে তখন বলেন: নফল নামায দিয়ে বান্দার ফরজের ঘাটতি পূর্ণ কর। এরপর অন্য আমলের হিসাব নেয়া হবে।[সুনানে আবু দাউদ]

আল্লাহই ভাল জানেন। সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ

প্রশ্ন-২

শাও য়ালের ছয় দিনের রোযা ও হায়েযজনিত কারণে রমজানের ভঙ্গ হওয়া দিনগুলোর কাযা রোযা এক নিয়্যতে পালন করা কি জায়েয হবে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

না, তা শুদ্ধ নয়। কারণ রমজানের না-রাখা রোযার কাযা পালন সম্পূর্ণ শেষ না করা পর্যন্ত শাওয়ালের ছয় রোযা রাখা যাবে না।

শাইখ ইবনে উছাইমীন  ‘ফাতাওয়াস্‌ সিয়াম’ (৪৩৮) এ বলেছেন:

“যে ব্যক্তি আরাফাতের দিন অথবা আশুরার দিনে রোযা পালন করে এবং তার উপর রমজানের কাযা রোযা অনাদায় থাকে তবে তার রোযা রাখাটা সহিহ। তবে তিনি যদি এই রোযার মাধ্যমে রমজানের কাযা রোযা পালনেরও নিয়্যত করেন তবে তার দুটি সওয়াব হবে। আরাফাতের দিন অথবা আশুরার দিন রোযা পালনের সওয়াব ও কাযা রোযা আদায়ের সওয়াব। এটি সাধারণ নফল রোযার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রমজানের রোযার সাথে যে নফল রোযার কোন সম্পর্ক নেই। তবে শাওয়ালের ছয় রোযা রমজানের সাথে সম্পৃক্ত। সে রোযা রমজানের কাযা রোযা আদায়ের পরেই রাখতে হবে। তাই যদি কেউ কাযা আদায়ের আগে তা পালন করে তবে তিনি এর সওয়াব পাবেন না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেন :

من صام رمضان ثم أتبعه بست من شوال فكأنما صام الدهر

“যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোযা পালন করল, সে রোযার পর শাওয়াল মাসেও ছয়দিন রোযা পালন করল, সে যেন গোটা বছর রোযা রাখল।”

আর এটি জানা বিষয় যে, যার উপর কাযা রোযা রয়ে গেছে সে রমজান মাসে রোযা পালন করেছে বলে ধরা হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার কাযা রোযা আদায় সম্পূর্ণ করে।” সমাপ্ত।সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

প্রশ্ন-৩

শাওয়াল মাসের ছয় রোযা কি লাগাতরভাবে রাখা শর্ত নাকি আমি আলাদা আলাদাভাবে রাখতে পারি? কেননা আমি চাচ্ছি, প্রত্যেক সপ্তাহের শেষে সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিনে তিন ধাপে রোযাগুলো রাখতে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

শাওয়ালের রোযাগুলো লাগাতরভাবে রাখা শর্ত নয়। তাই এ রোযাগুলো কেউ আলাদা আলাদাভাবে রাখুক কিংবা লাগাতরভাবে রাখুক এতে কোন অসুবিধা নেই। তবে যত তাড়াতাড়ি আদায় করা যায় তত ভাল। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “তোমরা ভাল কাজে অগ্রণী হও।” আল্লাহ্‌ আরও বলেন: “তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমার দিকে দ্রুত ছুটে আস।” মুসা আলাইহিস সালাম বলেন: “আমি তাড়াতাড়ি আপনার কাছে আসলাম, আপনি সন্তুষ্ট হবেন এ জন্য।”[সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৮৪] তাছাড়া দেরী করলে নানা বিপদ-আপদ ঘটতে পারে। এটি শায়েফি মাযহাবের আলেমগণ ও হাম্বলি মাযহাবের কিছু কিছু আলেমের অভিমত। কিন্তু, অবিলম্বে আদায় না করে মাসের মাঝখানে কিংবা শেষে আদায় করলেও কোন অসুবিধা নেই।

ইমাম নববী বলেন:

“আমাদের মাযহাবের আলেমগণ বলেন: এ হাদিসের দলিলের ভিত্তিতে শাওয়াল মাসের ছয় রোযা রাখা মুস্তাহাব। শাওয়াল মাসের প্রথম দিকে লাগাতরভাবে রোযাগুলো রাখা মুস্তাহাব। আর যদি আলাদাভাবে রাখে কিংবা শাওয়াল মাসের পরে রাখে তবুও জায়েয হবে এবং এ সুন্নত পালনকারী হিসেবে গণ্য হবে এ হাদিসের ব্যাপকতার কারণে। এ বিষয়ে আমাদের আলেমগণের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। ইমাম আহমাদ ও দাউদও এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।”[আল-মাজমু শারহুল মুহায্‌যাব] সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ

প্রশ্ন-৪

ঈদের দিনের পর থেকে শাওয়ালের যে ছয় রোযা রাখা হয় কোন নারী হায়েযের কারণে রমযানের যে রোযাগুলো তার ছুটে গেছে সেগুলো কি আগে শুরু করবে, এরপর ছয় রোযা রাখবে; নাকি কিভাবে করবে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস “যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখল এরপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখল সে যেন গোটা বছর রোযা রাখল।”[সহিহ মুসলিম (১৯৮৪)-এ উদ্ধৃত সওয়াব যদি তিনি পেতে চান তাহলে তার উচিত হবে প্রথমে রমযানের রোযাগুলো পূর্ণ করা। এরপর শাওয়ালের ছয় রোযা রাখা; যাতে করে তার উপর হাদিসের বাণী প্রযোজ্য হয় এবং উল্লেখিত সওয়াব পেতে পারে।

কিন্তু, যদি বৈধতার দিক দেখা হয় তাহলে কাযা রোযাগুলো পালন করার ক্ষেত্রে পরবর্তী রমযান প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত বিলম্ব করা তার জন্য জায়েয।

সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ

প্রশ্ন-৫

শাওয়ালের ছয় রোযা কি সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রাখাটা সঠিক; যাতে করে আমি সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখার সওয়াবও পেতে পারি?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

হ্যাঁ। এতে কোন বাধা নেই। এভাবে রোযা রাখলে আপনার জন্য ছয় রোযার সওয়াব এবং সোমবার ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখার সওয়াবও লেখা হবে।

শাইখ মুহাম্মদ বিন উছাইমীন (রহঃ) বলেন:

“যদি এই ছয়দিনের রোযা সোমবারে বা বৃহস্পতিবারে পড়ে তাহলে তিনি দুটো সওয়াবই পেতে পারেন; যদি তিনি ছয় রোযার নিয়ত করেন এবং সোমবার বা বৃহস্পতিবারে রোযা রাখারও নিয়ত করেন। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কর্মসমূহ নিয়ত অনুযায়ী হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি যা নিয়ত করেন সেটাই তার প্রাপ্য”।[সমাপ্ত]

মাননীয় শাইখ মুহাম্মদ বিন উছাইমীন (রহঃ) ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা (২/১৫৪) সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

যে ব্যক্তি শাওয়ালের ছয় রোযার মধ্যে তিনটি রোযা বীযের দিনগুলোর রোযার সাথে একই নিয়তে রাখবে সে কি ফযিলত পাবে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আমি আমাদের শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায (রহঃ) কে এ মাসয়ালা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। জবাবে তিনি বলেন: আশা করি তিনি সে ফযিলত পাবেন। কেননা তার ক্ষেত্রে এ কথা বলা সত্য যে, তিনি ছয় রোযা রেখেছেন এবং এ কথা বলাও সত্য যে, তিনি বীযের দিনগুলোর রোযা রেখেছেন। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ প্রশস্ত।

একই মাসয়ালার জবাবে শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন আমাকে জবাব দিয়েছেন: হ্যাঁ। যদি কেউ শাওয়ালের ছয় রোযা রাখে তার উপর বীযের রোযাগুলো বাদ হয়ে যাবে; হোক না তিনি বীযের দিনগুলোতে কিংবা আগে কিংবা পরে রোযাগুলো রাখুন না কেন। যেহেতু তার ক্ষেত্রে এ কথা বলা সত্য হয় যে, তিনি প্রত্যেক মাসের তিনদিন রোযা রেখেছেন। তিনি কি মাসের প্রথমে রোযাগুলো রাখলেন; নাকি মাঝে রাখলেন; নাকি শেষে রাখলেন সেটা ধর্তব্য নয়। সুন্নত নামায আদায় করার মাধ্যমে যেমন তাহিয়্যাতুল মসজিদের নামায পড়া বাদ হয়ে যায় এটি সেই শ্রেণীর আমল। কেউ যদি মসজিদে প্রবেশ করে সুন্নত নামায পড়ে তাহলে তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করার বিধান বাদ হয়ে যায়…। আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ

প্রশ্ন-৬

আমি শাওয়ালের ছয় রোযা রাখা কখন শুরু করতে পারি; যেহেতু এখন আমাদের বাৎসরিক ছুটি যাচ্ছে।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

শাওয়াল মাসের দ্বিতীয় দিন থেকে ছয় রোযা রাখা শুরু করা যায়। কেননা ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম। আপনি চাইলে শাওয়াল মাসের যে কোন দিনসমূহে ছয় রোযা রাখতে পারেন। তবে, নেকীর কাজ অবিলম্বে করা উত্তম।

স্থায়ী কমিটির কাছে নিম্নোক্ত প্রশ্নটি এসেছে:

ছয় রোযা কি রমযানের পর ঈদের দিনের অব্যবহিত পরেই শুরু করা আবশ্যক; নাকি ঈদের কয়েকদিন পর শাওয়াল মাসে লাগাতরভাবে রাখাও জায়েয; নাকি জায়েয নয়?

জবাবে তাঁরা বলেন: ঈদের দিনের অব্যবহিত পরেই ছয় রোযা রাখা আবশ্যকীয় নয়। বরং ঈদের একদিন পর কিংবা কয়েক দিন পর শুরু করাও জায়েয। লাগাতরভাবে রাখা বা ভেঙ্গে ভেঙ্গে রাখা; যেভাবে সুবিধা হয় সেভাবে রাখা জায়েয। এ বিষয়টি প্রশস্ত। এটি ফরয রোযা নয়; বরং সুন্নত রোযা।

আল্লাহ্‌ই তাওফিকদাতা, আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সাহাবীবর্গের উপর আল্লাহ্‌র রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।

সূত্র: ফাতাওয়াল লাজনাহ্‌ আদ্‌-দায়িমা (১০/৩৯১)

 

শাওয়াল মাসের ছয় রোজা