সুরা বাকারাঃ ৩৮তম রুকু (২৭৪-২৮১)আয়াত

সুরা বাকারাঃ ৩৮তম রুকু (২৭৪-২৮১)আয়াত

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:২৭৪ اَلَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَهُمۡ بِالَّیۡلِ وَ النَّهَارِ سِرًّا وَّ عَلَانِیَۃً فَلَهُمۡ اَجۡرُهُمۡ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ ۚ وَ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ

২৭৪. যারা নিজেদের ধন-সম্পদ রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের প্রতিদান তাদের রব-এর নিকট রয়েছে। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।

এ আয়াতে ঐ সকল লোকের বিরাট প্রতিদান ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে, যারা আল্লাহর পথে ব্যয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা রাত্ৰে-দিনে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সবসময় ও সর্বাবস্থায় আল্লাহর পথে ব্যয় করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে যে, দান-সদকার জন্য কোন সময় নির্দিষ্ট নেই, দিনরাতেরও কোন প্রভেদ নেই। এমনিভাবে গোপনে ও প্রকাশ্যে উভয় প্রকারে আল্লাহর পথে ব্যয় করলে সওয়াব পাওয়া যায়। তবে শর্ত এই যে, খাঁটি নিয়্যতে দান করতে হবে। নাম-যশের নিয়্যত থাকলে চলবে না। প্রকাশ্যে দান করার কোন প্রয়োজন দেখা না দেয়া পর্যন্তই গোপনে দান করার শ্রেষ্ঠত্ব সীমাবদ্ধ। যেখানে এরূপ প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে প্রকাশ্যে দান করাই শ্ৰেয়। [মা’আরিফুল কুরআন]

এখানে দান-সদকা নির্ভুল ও সুন্নাত পদ্ধতি বর্ণনা করে বলা হয়েছেঃ যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে এবং ব্যয় করার পর অনুগ্রহ প্রকাশ করে না এবং যাকে দান করে, তাকে কষ্ট দেয় না, তাদের সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য তাদের কোন বিপদাশংকা নেই এবং অতীতের ব্যাপারেও তাদের কোন চিন্তা নেই।

২:২৭৫ اَلَّذِیۡنَ یَاۡکُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا کَمَا یَقُوۡمُ الَّذِیۡ یَتَخَبَّطُهُ الشَّیۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّ ؕ ذٰلِکَ بِاَنَّهُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَیۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا ۘ وَ اَحَلَّ اللّٰهُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ؕ فَمَنۡ جَآءَهٗ مَوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ فَانۡتَهٰی فَلَهٗ مَا سَلَفَ ؕ وَ اَمۡرُهٗۤ اِلَی اللّٰهِ ؕ وَ مَنۡ عَادَ فَاُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۲۷

২৭৫. যারা সুদ খায় তারা তার ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটা এ জন্য যে তারা বলে, ‘ক্রয়-বিক্রয় তো সুদেরই মত। অথচ আল্লাহ্‌ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। অতএব যার নিকট তার রব-এর পক্ষ হতে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, তাহলে অতীতে যা হয়েছে তা তারই; এবং তার ব্যাপার আল্লাহর ইখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।

রিবা’ শব্দের অর্থ সুদ। ‘রিবা’ আরবী ভাষায় একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। الربا (সূদ) এর আভিধানিক অর্থ হল, বাড়তি এবং বৃদ্ধি।

রিবা দু’প্রকারঃ একটি ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে। আর অপরটি ক্রয়-বিক্রয় ছাড়া। প্রথম প্রকার রিবা সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, অমুক অমুক বস্তুর ক্রয়-বিক্রয়ে কম-বেশী করা রিবার অন্তর্ভুক্ত। এ প্রকার রিবা’কে ‘রিবাল ফাদল’ বলা হয়। আর দ্বিতীয় প্রকার রিবাকে বলা হয়, ‘রিবা-আন-নাসিয়্যা’। এটি জাহেলিয়াত যুগে প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত ছিল। সে যুগের লোকেরা এরূপ লেন-দেন করত। এর সংজ্ঞা হচ্ছে, ঋণে মেয়াদের হিসাবে কোন মুনাফা নেয়া। যাবতীয় রিবাই হারাম।

কুরআন নাযিলের সময় যেসব ধরনের সুদী লেনদেনের প্রচলন ছিল সেগুলোকে নিম্নোক্তভাবে উপস্থাপন করা যায়৷ যেমন, এক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তির হাতের কোন জিনিস বিক্রি করতো এবং দাম আদায়ের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতো৷ সময়সীমা অতিক্রম করার পর যদি দাম আদায় না হতো, তাহলে তাকে আবার বাড়তি সময় দিতো এবং দাম বাড়িয়ে দিতো৷ অথবা যেমন, একজন অন্য একজনকে ঋণ দিত৷ ঋণদাতার সাথে চুক্তি হতো, উমুক সময়ের মধ্যে আসল থেকে এই পরিমাণ অর্থ বেশী দিতে হবে৷ অথবা যেমন, ঋণদাতা ও ঋনগ্রহীতার মধ্যে একটি বিশেষ সময়সীমার জন্য একটি বিশেষ হার স্থিরিকৃত হয়ে যেতো৷ ঐ সময়সীমার মধ্যে বর্ধিত অর্থসহ আসল অর্থ আদায় না হলে আগের থেকে বর্ধিত হারে অতিরিক্ত সময় দেয়া হত৷ এই ধরনের লেনদেনর ব্যাপারে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে৷

الربا (সূদ) এর আভিধানিক অর্থ হল, বাড়তি এবং বৃদ্ধি। শরীয়তে সূদ দুই প্রকার; ‘রিবাল ফায্ল’ এবং ‘রিবান নাসীয়াহ’। ‘রিবাল ফায্ল’ সেই সূদকে বলা হয় যা ছয়টি জিনিসের বিনিময়কালে কমবেশী অথবা নগদ ও ধারের কারণে হয়ে থাকে। (যার বিশদ বর্ণনা হাদীসে আছে।) যেমন, গমের পরিবর্তন যদি গম দ্বারা করা হয়, তাহলে প্রথমতঃ তা সমান সমান হতে হবে এবং দ্বিতীয়তঃ তা নগদ-নগদ হতে হবে। এতে যদি কমবেশী হয় তাও এবং নগদ নগদ না হয়ে যদি একটি নগদ এবং অপরটি ধারে হয় অথবা দু’টিই যদি ধারে হয় তবুও তা সূদ হবে। আর ‘রিবান নাসীয়াহ’ হল, কাউকে ছয় মাসের জন্য এই শর্তের ভিত্তিতে ১০০ টাকা দেওয়া যে, পরিশোধ করার সময় ১২৫ টাকা দিতে হবে। ছয় মাস পর নেওয়ার কারণে ২৫ টাকা বাড়তি নেওয়া। আলী (রাঃ)-এর এ সম্পর্কিত একটি উক্তিতে এটাকে ঠিক এইভাবে বলা হয়েছে, (كُلُّ قَرْضٍ جَرَّ مَنْفَعَةً فَهُوَ رِبَا) ‘‘যে ঋণ কোন মুনাফা টেনে আনে, তা-ই সূদ।’’ (ফাইযুল ক্বাদীর শারহুল জামেইস্ সাগীর ৫/২৮) এই ধার ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য নেওয়া হোক অথবা ব্যবসার জন্য উভয় প্রকার ধারের উপর নেওয়া সূদ হারাম। জাহেলিয়াতের যুগে এই ধারের প্রচলন ছিল। শরীয়ত উভয় প্রকারের ধারের মধ্যে কোন পার্থক্য না করে দু’টোকেই হারাম করে দিয়েছে। সুতরাং যারা বলে, ব্যবসার জন্য যে ঋণ (যা সাধারণতঃ ব্যাংক থেকে) নেওয়া হয়, তাতে যে বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হয়, তা সূদ নয়। কারণ ঋণগ্রহীতা তা থেকে উপকৃত হয় এবং সে তার (লাভের) কিয়দংশ ব্যাংক অথবা ঋণদাতাকে ফিরিয়ে দেয়। অতএব এতে দোষের কি আছে? এতে কি দোষ আছে তা এমন আধুনিক শিক্ষিত মানুষের নজরে পড়বে না, যারা এটাকে বৈধ সাব্যস্ত করতে চায়। তবে মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে তাতে বহু দোষ বিদ্যমান রয়েছে। যেমন, ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যকারীর লাভ যে হবেই তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বরং লাভ তো দূরের কথা মূল পুঁজি অবশিষ্ট থাকবে কি না তারও কোন ভরসা নেই। কখনো কখনো ব্যবসায় সমস্ত টাকা-পয়সা ডুবে যায়। পক্ষান্তরে ঋণদাতা (ব্যাংক হোক অথবা সূদের উপর টাকা-পয়সা দেয় এমন যেই হোক না কেন তার) লাভ একেবারে সুনিশ্চিত, তার লভ্যাংশ যে কোন অবস্থায় আদায় করতেই হবে। এটা হল যুলুমের একটি প্রকাশ্য চিত্র। ইসলামী শরীয়ত এটাকে কিভাবে বৈধ সাব্যস্ত করতে পারে? শরীয়ত তো ঈমানদারদেরকে সমাজের অভাবীদের উপর পার্থিব কোন লাভ ও উদ্দেশ্য ছাড়াই ব্যয় করার প্রতি উৎসাহ দান করেছে। যাতে সমাজে ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং দয়া-দাক্ষিণ্য ও প্রেম-প্রীতির উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে সূদী কারবারের ফলে হার্দিক কঠোরতা এবং স্বার্থপরতার সৃষ্টি হয়। একজন পুঁজিপতির কেবল মুনাফাই উদ্দেশ্য হয়; চাহে সমাজে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিরা রোগ, ক্ষুধা ও কপর্দকশূন্যতার জ্বালায় কাতরাতে থাকে এবং বেকার ও কর্মহীনরা নিজেদের জীবন থেকে নিরাশ হয়ে যায়। এই বর্বরতা ও নির্দয়তাকে শরীয়ত কিভাবে পছন্দ করতে পারে? এর আরো অনেক অপকারিতার দিক আছে। এখানে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। মোট কথা সূদ হারাম; তাতে তা ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য নেওয়া ঋণের সূদ হোক অথবা ব্যবসার জন্য নেওয়া ঋণের সূদ।

আরবরা পাগল ও দেওয়ানাকে বলতো, ‘মজনূন’ (অর্থাৎ জিন বা প্রেতগ্রস্ত)৷ কোন ব্যক্তি পাগল হয়ে গেছে, একথা বলার প্রয়োজন দেখা দিলে দ্বারা বলতো, উমুককে জিনে ধরেছে৷ এই প্রবাদটি ব্যবহার করে কুরআন সুদখোরকে এমন এক ব্যক্তির সাথে তুলনা করেছে যার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেছে৷ অর্থাৎ বুদ্ধিভ্রষ্ট ব্যক্তি যেমন ভারসাম্যহীন কথা বলতে ও কাজ করতে শুরু করে, অনুরূপভাবে সুদখোরও টাকার পেছনে পাগলের মতো ছুটো ভারসাম্যহীন কথা ও কাজের মহড়া দেয়৷ নিজের স্বার্থপর মনোবৃত্তির চাপে পাগলের মতো সে কোন কিছুরই পরোয়া করে না৷ তার সুদখোরীর কারণে কোন্ কোন্ পর্যায় মানবিক প্রেম-প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতির শিকড় কেটে গেলো, সামষ্টিক কল্যানের ওপর কোন ধরণের ধ্বংসকর প্রভাব পড়লো এবং কতগুলো লেকের দুরবস্থার বিনিময়ে সে নিজের প্রাচুর্যের ব্যবস্থা করলো-এসব বিষয়ে তার কোন মাথা ব্যাথাই থাকে না৷ দুনিয়াতে তার এই পাগলপারা অবস্থা৷ আর যেহেতু মানুষকে আখেরাতের সেই অবস্থায় ওঠানো হবে যে অবস্থায় সে এই দুনিয়ায় মারা গিয়েছিলেন, তাই কিয়ামতের দিন সুদখোর ব্যক্তি একজন পাগল ও বুদ্ধিভ্রষ্ট লোকের চেহারায় আত্মপ্রকাশ করবে৷

সূদখোরের এই অবস্থা কবর থেকে উঠার সময় হবে অথবা হাশর প্রান্তরে হবে। (এখান থেকে জ্বিন পাওয়ার কথা প্রমাণ হয়।)

অথচ ব্যবসায় নগদ টাকা এবং কোন জিনিসের মাঝে বিনিময় হয়ে থাকে। তাছাড়া এতে লাভ-নোকসান উভয়েরই সম্ভাবনা থাকে। পক্ষান্তরে সূদে উক্ত দু’টির কোনটাই থাকে না। এ ছাড়া ব্যবসাকে মহান আল্লাহ বৈধ করেছেন এবং সূদকে করেছেন হারাম। সুতরাং এ দু’টো কি করে একই হতে পারে?

অর্থাৎ, ঈমান আনা অথবা তওবা করার পর বিগত সূদের উপর পাকড়াও হবে না।

তিনি তাকে তওবার উপর সুদৃঢ় রাখবেন, অথবা বদ-আমল ও নিয়তের খারাবীর কারণে তাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিবেন। এই জন্যই পুনরায় সূদ গ্রহণকারীদের উপর কঠোর ধমক এসেছে।

(ক) বাইয়ে ইনা’র সংজ্ঞা :

কেউ তার কোনো পণ্য অপরের কাছে বাকিতে বিক্রি করে ক্রেতার হাতে পণ্য তুলে দিল। তারপর সে মূল্য পরিশোধের আগেই তার (ক্রেতার) কাছ থেকে বিক্রেতা ওই একই পণ্য নগদ মূল্যে কিনে নিল তার চেয়ে কম মূল্যে।[1]

যেমন- কেউ তার পণ্য অপর এক ব্যক্তির কাছে এক বছর সময় দিয়ে বাকিতে একশ’ টাকা মূল্যে বিক্রি করল। অতপর একই সময়ে বিক্রেতা তার সদ্য বেচা পণ্য ক্রেতার কাছ থেকে নগদ পঞ্চাশ টাকা মূল্যে কিনে নিল আর প্রথম ক্রেতার কাঁধে পুরো একশ টাকার ঋণ রয়ে গেল!

(খ) বাইয়ে ইনা’র নিন্দায় উচ্চারিত কিছু বক্তব্য :

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে ইরশাদ করতে শুনেছি, তিনি বলেন- ‘যখন তোমরা পরস্পর বাইয়ে ইনা’র লেনদেন করবে আর জিহাদ ছেড়ে দিয়ে বলদের লেজ ধরে সন্তুষ্ট থাকবে কৃষিকাজ নিয়ে, আল্লাহ তাআলা তখন তোমাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দিবেন। আল্লাহ এ লাঞ্ছনা তুলে নিবেন না যতক্ষণ তোমরা তোমাদের দীনের দিকে ফিরে আসবে। আবু দাউদ : ৩৪৬২, আউনুল মাবুদ : ৯/৩৩৫ হাদিসটি আরও কয়েকভাবে বর্ণিত হয়েছে। মুসনাদে ইমাম আহমদ : ২/৮৪

মালেক বিন আনাস, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমদ এবং কতিপয় শাফেয়ি প্রমুখ উলামায়ে কিরাম বাইয়ে ইনা’কে অবৈধ বলেছেন।

ইমাম শাওকানি রহ. বলেন, ‘ইনা’র লেনদেন যারা করে তারা এর নাম দেয় ক্রয়চুক্তি। অথচ আক্দ পুরা হওয়ার আগে এমনটি করা যে সুস্পষ্ট রিবার অন্তর্ভুক্ত সে ব্যাপারে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে একমত। তারপর তারা এ চুক্তির নাম দেয় মোয়ামালা। আর একে রূপ দেয় বিক্রয় চুক্তির। অথচ মোটেও তাদের এ ইচ্ছে নেই। এ হচ্ছে তাদের হিলা-বাহানা আর আল্লাহর সঙ্গে নিষ্ফল প্রতারণা। বাইয়ে ইনা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি সবচে সহজ যে হিলা আবলম্বন করে তা হলো, সে তাকে (উদাহরণ স্বরূপ) এক টাকা কম এক হাজার টাকা কর্জ দেয়। অতপর তার কাছে এক দিরহাম মূল্যের এক টুকরো কাপড় বিক্রি করে পাঁচশ টাকায়।

এ ধরনের চালাকির মূলে কুঠারাঘাত করেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর বিখ্যাত সে হাদিস ‘নিশ্চয় প্রত্যেক কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ বুখারি : ০১, মুসলিম : ১৯০৭

কারণ সে চায় এক হাজার টাকা দিয়ে দেড় হাজার টাকা কামাতে। তার কর্জ দেয়ার উদ্দেশ্যই হলো, অতিরিক্ত সুদ লাভ করা যেটাকে সে কাপড়ের মূল্য নাম দিয়ে হাসিল করতে চাইছে। প্রকৃতপক্ষে সে তাকে নগদ এক হাজার টাকা দিচ্ছে বাকিতে দেড় হাজার টাকার বিনিময়ে। আর কর্জ ও ক্রয়ের রূপ দিয়ে সে এ হারাম কাজ বৈধ করতে চাচ্ছে। আর এটা জানা কথা যে, এ ধরনের হিলা-বাহানা এর অবৈধতাকে রুখতে পারে না। সুদকে যেসব অকল্যাণের কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাও দূর করতে পারে না। বরং তা বিভিন্নভাবে এর অপকারিতা বাড়িয়ে দেয়।

প্রথম মাসআলা : শরয়ি দৃষ্টিকোণে কাগুজে মুদ্রা এবং তার বিধান

এ মাসআলা সম্পর্কে সৌদি মুফতি বোর্ডের লিখিত ফতোয়া প্রকাশ করা হয়েছে। নিম্নে হুবহু তার অনুবাদ তুলে ধরা হলো-

হামদ ও সালাতের পর, সৌদি মুফতি বোর্ড বরাবর উপস্থাপিত ‘শরয়ি দৃষ্টিকোণে কাগজের টাকা ও তার বিধান’ শীর্ষক গবেষণাকর্মটি বোর্ডের সদস্যবৃন্দ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করেছেন। তারা পরস্পর আলোচনা-পর্যালোচনা এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন

প্রথমত. যেহেতু সোনা-রুপাই টাকার মূল এবং আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুসারে সোনা-রুপায় তাদের মূল্যমানই সুদের ইল্লত আর ফকিহদের মতানুসারে উৎস এক হওয়া সত্ত্বেও সোনা-রুপাতেই মূল্যমানতা সীমাবদ্ধ নয় তাই। এবং যেহেতু টাকাই বর্তমানে মূল্য হিসেবে প্রচলন পেয়েছে, লেনদেনের বেলায় স্থান দখল করেছে সোনা-রুপার, এমনকি এ দিয়ে লেনদেন চলে, মানুষ এটা অর্জন ও সঞ্চয় করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে অথচ নিছক কাগজ হিসেবে তার কোনো মূল্য নেই; মূল্য তার অতিরিক্ত কারণে সেটা হলো, এর দ্বারা আস্থা অর্জন করা এবং লেনদেনের সময় বিনিময় মাধ্যম স্থির হওয়া আর এটাই মূল্যযোগ্য হওয়ার উদ্দেশ্য- এতসব কারণে মুফতি বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কাগজের টাকা একধরনের স্বতন্ত্র মুদ্রা যার বিধান সোনা-রুপার বিধানের অনুরূপ। সুতরাং এতে জাকাত ওয়াজিব হবে এবং এর ওপর সোনা-রুপার মতো সুদের উভয় প্রকার তথা ফযল ও নাসিয়া খাটবে। এককথায় কাগজের টাকা শরিয়তের সকল লেনদেনের ক্ষেত্রে সোনা-রুপার অনুরূপ হবে।

দ্বিতীয়ত. সোনা-রুপা ও অন্যান্য মুদ্রার মতো কাগজকেও স্বতন্ত্র মুদ্রা হিসেবে ধরা হবে। তেমনি কাগজের নোটকেও বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হবে। এটা হবে দেশ ও প্রকাশ-প্রচলন স্থানের ভিন্নতা বিচার করে। অর্থাৎ সৌদি টাকা এক শ্রেণী আর মার্কিনি টাকা আরেক শ্রেণী। এভাবে প্রত্যেক দেশের টাকা মুদ্রার একেক স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসেবে গণ্য হবে। আর সে অনুযায়ী সোনা-রুপা ও অন্যান্য মূল্যের মতো কাগজের মুদ্রা বা নোটের ওপরও সুদের বিধান খাটানো হবেআর এসবই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো দাবি করে :

(ক) কেবল নগদ ছাড়া বাকিতে কোনোভাবে কাগজের নোট একটার বদলে একটা কিংবা মুদ্রার অন্য কোনো প্রকার যেমন- সোনা,রুপা ইত্যাদির মোকাবেলায় বিক্রি করা বৈধ নয়। অতএব উদারণত, সৌদি রিয়াল অন্য কোনো দেশের কাগজের টাকার মোকাবেলায় কমবেশি করে হস্তগত না করে বাকিতে বিক্রি করা বৈধ নয়।

(খ) একই (দেশের) ধরনের কাগজের মুদ্রার একটার মোকাবেলায় অন্যটা কমবেশি করে বিক্রি করা বৈধ নয়; চাই তা নগদে হোক বা বাকিতে। সুতরাং কাগজের সৌদি দশ রিয়াল কাগুজের এগারো রিয়ালের বিনিময়ে বিক্রি করা বাকিতে বা নগদে কোনোটাই বৈধ নয়।

(গ) দুই ধরনের দুই কাগজের মুদ্রা একটার বিনিময়ে আরেকটা বিক্রি করা বৈধ। যদি তা হয় হাতে হাতে। সুতরাং পাকিস্তানি রুপি দিয়ে সৌদি রিয়াল ক্রয় করা জায়িয। চাই তা সোনার হোক বা রুপার, কম হোক বা বেশি। তেমনি এক মার্কিন ডলার সৌদি তিন রিয়াল কিংবা তার কম বা বেশি দিয়ে বিক্রি করা এবং সৌদি রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে সৌদি কাগুজে মুদ্রা কমবেশি করে বিক্রি করা জায়িয। যদি তা হয় নগদে। কারণ এটাকে এক জাতীয় মুদ্রার বিনিময়ে আরেক জাতীয় মুদ্রা বিক্রি হিসেবে গণ্য করা হবে। আর বাস্তবতা এবং মূল্য ভিন্ন হলে শুধু নাম এক হওয়ায় কোনো সমস্যা নেই।

তৃতীয়ত. সোনা-রুপার মতো কাগুজে মুদ্রার ওপরও জাকাত ফরজ হবে যখন স্বর্ণ বা রৌপ্য কোনোটার নেসাব পরিমাণ টাকা হবে। অথবা নেসাব পূর্ণ হবে অন্য কোনো মূল্য বা ব্যবসায়িক পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে।

চতুর্থত. কাগজের মুদ্রাকে বাইয়ে সলম এবং অংশীদারি কারবারগুলোতে মূলধন বানানো যাবে। ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৭৯-৩৮০, সৌদি শীর্ষ আলেমদের গবেষণা অভিসন্দর্ভ : ১/৩০-৫৮

ব্যবহৃত স্বর্ণ দিয়ে (অব্যবহৃত) নতুন স্বর্ণ ক্রয়

প্রশ্ন: এক লোক অলঙ্কারাদি ক্রয়-বিক্রয় করে। একজন তার কাছে এলো কিছু ব্যবহৃত স্বর্ণ নিয়ে। সে ওই স্বর্ণ তার থেকে কিনে নিল। মূল্য নির্ধারণ করল রিয়াল দিয়ে। তারপর সে সময় ও সে স্থানে মূল্য পরিশোধের আগেই পুরাতন স্বর্ণ বিক্রেতার কাছে নতুন স্বর্ণ বিক্রি করল। এর দামও নির্ধারণ করল রিয়াল দিয়ে। এরপর যতটুকু বাকি থাকল তা পরিশোধ করবে টাকা দিয়ে। জানতে চাই- এটা কি জায়িয নাকি আগে প্রথম ক্রয়-চুক্তির টাকা বিক্রেতার কাছে পুরোটা দিয়ে দিতে হবে তারপর বিক্রেতা যে নতুন স্বর্ণ কিনেছে তার মূল্য ওই টাকা বা অন্য কোনো টাকা থেকে পরিশোধ করতে হবে?

উত্তর: এসব ক্ষেত্রে ওয়াজিব হলো প্রথমে ব্যবহৃত স্বর্ণ হস্তান্তর করা। তারপর বিক্রেতা যখন মূল্য হাতে পাবে তখন তার ইচ্ছা। চাইলে যার কাছে পুরাতন স্বর্ণ বিক্রি করেছে তার কাছ থেকে অথবা চাইলে অন্যের কাছ থেকে নতুন স্বর্ণ কিনবে। এখন সে যদি তার কাছ থেকেই নতুন স্বর্ণ কেনে তাহলে তার জন্য উভয় সুযোগ রয়েছে। চাইলে নতুন স্বর্ণের মূল্য হিসেবে তার টাকাই তাকে ফেরত দিবে অথবা অন্য টাকা দিবে। এমন করার উদ্দেশ্য যাতে মুসলমান সুদী দ্রব্যের ভালোর বদলে কমবেশি করে মন্দটা বিক্রি করার মতো হারাম কাজে লিপ্ত না হয়।

ইমাম বুখারি রহ. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে খায়বরের গভর্নর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। একবার তিনি তাঁর দরবারে জানিব নামক উৎকৃষ্ট জাতের খেজুর নিয়ে আসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করেন খায়বরের সব খেজুরই এমন কি-না। তিনি উত্তর দেন, না। আমরা এ খেজুরের এক সা’ কিনি সাধারণ খেজুর দুই সা’ দিয়ে আর এর দুই সা’ নেই সাধারণ খেজুরের তিন সা’ দিয়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এমন করো না; বরং সাধারণ (জানিব) খেজুর কেনো দিরহাম দিয়ে তারপর সে দিরহামের বিনিময়ে জানিব কেনো। বুখারি : ২২০১, মুসলিম : ১৫৯৪

কারণ এ ধরনের ক্রয়-চুক্তিতে লেন-দেন ক্লিয়ার করণ যদিও একই সময়ে একই স্থানে হয় কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ‘সোনার বদলে কমবেশি করে সোনা বিক্রি’রই রূপ পরিগ্রহ করে। যা সুস্পষ্ট হারাম।

ইমাম মুসলিম রহ. উবাদা বিন সাবেত রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। তবে যখন এসব জিনিসের প্রকার পরিবর্তন করা হবে তো যেভাবে ইচ্ছে বিক্রি করো অবশ্য যখন সেটা হতে হবে নগদ নগদ। আবু সাইদ খুদরির এক রেওয়াতে আছে, যে বেশি দিবে অথবা বেশি নিবে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। দাতা -গ্রহীতা এক্ষেত্রে সমান অপরাধী। ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৯ আর হাদিসদ্বয়ের প্রাগুক্ত।

প্রশ্ন: আমি স্বর্ণ-বিক্রেতার কাছে কিছু পুরাতন স্বর্ণ নিয়ে গেলাম। স্বর্ণ-বিক্রেতা সেসব ওজন করে বললেন, এর দাম হবে ১৫০০ রিয়াল। তার কাছে ১৫০০ রিয়াল মূল্যে স্বর্ণগুলো বিক্রি করে আমি একই ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু নুতন স্বর্ণ কিনলাম- যার দাম ১৮০০ রিয়াল। এখন জানতে চাচ্ছি, আমার জন্য কি জায়িয হবে যে আমি তাকে শুধু ৩০০ রিয়াল দিয়ে দিব? নাকি প্রথমে ১৫০০ রিয়াল হস্তগত করব তারপর একসাথে ১৮০০ রিয়াল তাকে দিব?

উত্তর: নগদ মূল্যে হাতে হাতে সমান দামে ছাড়া স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করা জায়িয নেই যদিও ভালো-মন্দ হিসেবে তার প্রকার বদলানো হোক না কেন- এ কথা হাদিসে বারবার বলা হয়েছে দ্ব্যর্থহীনভাবে। বৈধ উপায় হলো- যে স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ কিনতে ইচ্ছুক সে প্রথমে তার কাছে যে স্বর্ণ আছে তা রুপা বা কাগজের মুদ্রা দিয়ে সে বিক্রি করবে তারপর সে মুদ্রা বা রুপা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণ কিনবে। তবে যদি সোনা-রুপা বিক্রি করা হয় কাগজের মুদ্রা বৈ অন্য কিছু দিয়ে যেমন- পরিবহন সামগ্রী কিংবা চিনি ইত্যাদির বিনিময়ে তবে চুক্তির উভয় মাধ্যম তথা পণ্য ও মূল্য হস্তগত করার আগেই ক্রেতা-বিক্রেতা মজলিস ত্যাগ করায় কোনো সমস্যা নেই। কারণ স্বর্ণ, রৌপ্য ও কাগজের মুদ্রা এবং এসব এবং এ ধরনের বস্ত্তর মাঝে রিবা বা সুদের বিধান প্রযোজ্য নয়। উল্লেখ্য যে, বিক্রি চুক্তি যখন বাকিতে হবে তখন পরিশোধের তারিখ নির্ধারণ করা জরুরি। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরস্পর ঋণের লেনদেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে।’ বাকারা : ২৮২, ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৫২

: ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে অংশগ্রহণ

প্রশ্ন: আমি একজন কুয়েতি নাগরিক। আমাদের দেশে বিভিন্ন কৃষি ও বাণিজ্যিক কোম্পানি রয়েছে। রয়েছে ব্যাংক, বীমা ও পেট্রোল কোম্পানি। এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য এসব কোম্পানির পার্টনার হওয়ার অনুমতি রয়েছে। জানতে ইচ্ছুক এসব কোম্পানিতে শেয়ার হোল্ডার হওয়া যাবে কি-না।

উত্তর: সবার জন্য এসব কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করা বৈধ যদি সে কোম্পানি সুদী কারবার না করে। যদি সুদী লেনদেন করে তাহলে জায়িয হবে না। কারণ কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার মাধ্যমে সুদের হারাম হওয়া প্রমাণিত। তেমনিভাবে মানুষের জন্য বাণিজ্যিক বীমা কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করাও বৈধ নয়। কারণ বীমা চুক্তিগুলো প্রতারণা, অজ্ঞতা এবং সুদে পরিপূর্ণ। আর যেসব চুক্তি প্রতারণা, অজ্ঞতা এবং সুদে ভরা ইসলামের দৃষ্টিতে তার সবই হারাম। ইসলামি ফাতাওয়া সংকলন : ২/৩৯০

২:২৭৬ یَمۡحَقُ اللّٰهُ الرِّبٰوا وَ یُرۡبِی الصَّدَقٰتِ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یُحِبُّ کُلَّ کَفَّارٍ اَثِیۡمٍ

২৭৬. আল্লাহ্‌ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ কোন অধিক কুফরকারী, পাপীকে ভালবাসেন না।

আল্লাহ্ তা’আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সদকাকে বর্ধিত করেন। এখানে একটি বিশেষ সামঞ্জস্যের কারণে সুদের সাথে সদকা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ সুদ ও দান-সদকা উভয়ের স্বরূপ যেমন পরস্পর বিরোধী, উভয়ের পরিণামও তেমনি পরস্পর বিরোধী। আর সাধারণতঃ যারা এসব কাজ করে, তাদের উদ্দেশ্য এবং নিয়্যতও পরস্পর বিরোধী হয়ে থাকে। এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, আয়াতে সুদকে মেটানো আর দান-সদকাকে বর্ধিত করার উদ্দেশ্য কি? কোন কোন তাফসীরকার বলেনঃ এ মেটানো ও বাড়ানো আখেরাতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সুদখোরের ধন-সম্পদ আখেরাতে তার কোনই কাজে আসবে না; বরং তা তার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। পক্ষান্তরে দান-সদকাকারীদের ধন-সম্পদ আখেরাতে তাদের জন্য চিরস্থায়ী নেয়ামত ও শান্তি লাভের উপায় হবে। এ ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট। এতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

সাধারণ তাফসীরকারগণ বলেনঃ সুদকে মেটানো এবং দান-সদকাকে বাড়ানো আখেরাতে তো হবেই, কিন্তু এর কিছু কিছু লক্ষণ দুনিয়াতেও প্রত্যক্ষ করা যায়। যে সম্পদের সাথে সুদ মিশ্রিত হয়ে যায়, অধিকাংশ সময় সেগুলো তো ধ্বংস হয়ই, অধিকন্তু আগে যা ছিল, তাও সাথে নিয়ে যায়। সুদ ও জুয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই এরূপ ঘটনা সংঘটিত হতে দেখা যায়। অজস্র পুঁজির মালিক কোটিপতি দেখতে দেখতে দেউলিয়া ও ফকীরে পরিণত হয়। মোটকথা, এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং দান-সদকাকে বর্ধিত করেন। এ উক্তি আখেরাতের দিক দিয়ে তো সম্পূর্ণ পরিস্কার; সত্য উপলব্ধির সামান্য চেষ্টা করলে দুনিয়ার দিক দিয়েও সুস্পষ্ট। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্তিঃ “সুদ যদিও বৃদ্ধি পায় কিন্তু এর শেষ পরিণতি হচ্ছে স্বল্পতা”। [মুসনাদে আহমাদঃ ১/৩৯৫] এর উদ্দেশ্যও তাই।

আয়াতের শেষে বলা হয়েছে “আল্লাহ্ তা’আলা কোন কাফের গোনাহগারকে পছন্দ করেন না”। এতে ইশারা করা হয়েছে যে, যারা সুদকে হারামই মনে করে না, তারা কুফরে লিপ্ত এবং যারা হারাম মনে করা সত্ত্বেও কার্যতঃ সুদ খায়, তারা গোনাহগার ও পাপাচারী। [মাআরিফুল কুরআন]

ব্যাবসায়িক বীমা এবং ব্যাংক গ্যারান্টি

প্রশ্ন: আমরা এমন সমস্যায় আছি যে ব্যাংকের সাথে কারবার না করে উপায় নাই। ব্যাপার হলো, আমরা একটি ব্যাংককে ঠিকাদার নিযুক্ত করেছি; যেটির নাম ‘সুন্দর ব্যবস্থাপনা ঠিকাদারি ব্যাংক (অর্থাৎ ব্যাংকটি চুক্তির ধারা অনুযায়ী সুন্দরভাবে চুক্তি বাস্তবায়নের জামিন হয়।) এখন আমরা সবিস্ময়ে জানছি, তারা যে জামিননামা পেশ করে তার বিনিময়ে মূল্য নেয়। এদিকে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ফিকহের কিতাব রয়েছে যেগুলো থেকে জানা যায়, জিম্মাদারি বা গ্যারান্টি একধরনের স্বেচ্ছাসেবা। এরপর আমরা প্রজেক্টি স্থগিত করেছি বিষয়টি সম্পর্কে শরয়ি প্রমাণাদিসহ বিস্তারিত জানার জন্য। জিজ্ঞাস্য হলো, জামিন বা গ্যারান্টার হওয়ার বিনিময়ে মূল্য নেয়া কি জায়িজ ?

তেমনি ব্যবসায়িক পণ্যের বীমা, জীবন বীমা এবং এ ধরনের চুক্তির ব্যাপারে শরিয়তের বক্তব্য কী আমাদের জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর: প্রথমত. যে আপনাদের কোনো চুক্তি বাস্তবায়নে জামিন হয়েয়ে তার জন্য যে নির্ধারিত এমাউন্টের বেশি লাভের ওপর জামিন হওয়া জায়িজ নেই। কারণ সে মুনাফা নিবে তা সুদী মুনাফা যা হারাম। দ্বিতীয়ত. ব্যাবসায়িক বীমা হারাম। নিম্নের কারণগুলোর ভিত্তিতে।

ব্যবসায়িক বীমা চুক্তি এক ধরনের অনিশ্চিত মুয়ামালা যাতে আছে নির্জলা প্রতারণা। কারণ বীমাকারী চুক্তির সময় জানতে পারে না কত টাকা তাকে দেয়া হবে। তাই দেখা যায় বীমাকারী হয়তো এক বা দুই কিস্তি দিয়েছে মাত্র; অমনি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। তখন সে বীমা কোম্পানি কর্তৃক ধার্যকৃত এমাউন্টের মালিক হয়। আবার কারো বেলায় দেখা যায় দুর্ঘটনা ঘটেই না। তখন সে সব কিস্তি পরিশোধ করেও কিছুই পায় না। আর কোম্পানিও নিশ্চিত করে জানতে পারে না প্রত্যেক চুক্তির বেলায় কত পাবে আর কত দিবে। কারণ সহি হাদিসে ধোঁকা-প্রতারণামূলক ব্যবসা বৈধ নয়। মুসলিম : ১৫১৩

ব্যবসায়িক বীমা এক ধরনের জুয়া। কারণ এতে ‘আর্থিক লেনদেনে শংকা’ রয়েছে, রয়েছে কোনো অপরাধ বা ভূমিকা ছাড়া ক্ষতি পূরণ এবং বিপরীতে কিছু ছাড়া মুনাফা বা বিনিময় ছাড়া প্রতিদান। দেখা যায় বীমাকারী মাত্র এক কিস্তি দিয়েছে ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে দুর্ঘটনা তখন বীমা কোম্পানি এর দায় বহন করে। আবার কারো বেলায় দুর্ঘটনা ঘটেই না। অথচ কোম্পানি তারপরও কোনো বিনিময় ছাড়াই সমুদয় কিস্তি গ্রহণ করে। এসবের সাথে সাথে যখন তাতে অজ্ঞতা যোগ হয় তখন তা হয়ে যায় পুরোমাত্রায় জুয়া। ফলে তখন এটি কুরআনে বর্ণিত ‘মাইসির’ এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ইরশাদ হয়েছে- ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা- বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। মায়িদা : ৯০

ব্যবসায়িক বীমায় নাসিয়া ও ফযল উভয় ধরনের সুদ রয়েছে। কারণ কোম্পানি যখন বীমাকারী বা তার উত্তরাধীকারীদের জমা দেয়া টাকার অতিরিক্ত দিবে তখন তা রিবায়ে ফযল বা অতিরিক্ত নেয়ার মাধ্যমে সুদ হবে। এদিকে কোম্পানি যেহেতু চুক্তির পরে শোধ করে তাই তা রিবায়ে নাসিয়া বা বাকি দেয়ার মাধ্যমে সুদ হবে। আর যদি মুনাফা না দিয়ে সমান দেয় তবুও তা হবে রিবায়ে নাসিয়া বলে গণ্য হবে। আর উভয় অবস্থায়ই হারাম।

ব্যবসায়িক বীমা এক ধরনের বাজি। যার উভয় তরফেই রয়েছে অজ্ঞতা, প্রতারণা এবং জুয়া। আর ইসলামে বাজি সম্পূর্ণ হারাম। কেবল ওইসব ক্ষেত্রে যেখানে ইসলামের কলম বা কথা দ্বারা ইসলামের বিজয় সাধন উদ্দেশ্য হয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাজি বৈধতা তিন ক্ষেত্রেই সীমিত রেখেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, …..

বীমা চুক্তিতে বিনিময় ছাড়া অন্যের সম্পদ ভক্ষণ করা হয় বলে তা আল্লাহর বাণী ‘হে মুমিনগণ তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।’[3]- এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়ে হারাম হবে।

ব্যবসায়িক বীমায় শরিয়ত যেটার ওপর মানুষকে বাধ্য করেনি সেটাতে বাধ্য করা হয়। কারণ কোম্পানি দুর্ঘটনা ঘটায় না; এর পেছনে তার কোনো হাতও থাকে না। কোম্পানি শুধু দুর্ঘটনার ক্ষতি বহনের গ্যারান্টি দিয়ে বীমাকারীর কাছ থেকে নির্ধারিত এমাউন্ট নিয়েছে। কোম্পানি বীমাকারীর জন্য এতটুকু শ্রম দেয়নি। সুতরাং এটা হারাম হবে। সৌদি শীর্ষ আলেমদের ফতোয়া সংকলন : ফতোয়া : ৩২৪৯

এ কথা আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, জীবন বীমা ও বাণিজ্যিক বীমা নিম্নোক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে অবৈধ-

১. বীমার মধ্যে সুদ রয়েছে। কারণ কোনো কোনো বীমায় লাভ দেয়া হয়। যেমন- জীবন বীমা। এতে কোম্পানি বীমাকারীকে তার সঞ্চিত পরিমাণের চেয়ে বেশি সুদসহ দেয়া হয়। বীমাকারী দেয় কম অথচ পায় তার চেয়ে বেশি।

২. বীমা মানুষকে অবৈধভাবে অন্যের সম্পদ ভোগে বাধ্য করে।

৩. বীমায় জুয়া রয়েছে। কারণ এটি ঝুঁকির ওপর কৃত চুক্তি- যা কখনো ঘটে; কখনো ঘটে না। সুতরাং এটি একধরনের জুয়া।

৪. বীমায় ধোঁকা-প্রতারণা ও অজ্ঞতা রয়েছে।

৫. বীমা চুক্তিকারীদ্বয়ের মাঝে অবিশ্বাস ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। কারণ যখন দুর্ঘটনা ঘটবে তখন উভয়পক্ষ চাইবে ক্ষতির দায়দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপাবে। এতে করে ঝগড়া-বিবাদ এবং বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে।

৬. বীমা এমন কোনো ব্যবস্থা নয় যা ছাড়া চলবে না। কারণ বীমার এ কাজের জন্য ইসলাম বিভিন্ন উপলক্ষে দান-সদকার নিয়ম প্রবর্তন করেছে। এবং গরিব-মিসকিন ও ঋণগ্রস্থদের সহযোগিতার উদ্দেশ্যে জাকাত ওয়াজিব করেছে। এ ছাড়াও ইসলামি রাষ্ট্র তার সকল প্রজার দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করে। ড. উমর বিন আব্দুল আজিজ, ইসলামি দৃষ্টিকোণে সুদ এবং অর্থনৈতিক লেনদেন। পৃষ্ঠা : ৪২৫

২:২৭৭ اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَوُا الزَّکٰوۃَ لَهُمۡ اَجۡرُهُمۡ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ ۚ وَ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ

২৭৭. নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, সালাত প্রতিষ্ঠা করেছে এবং যাকাত দিয়েছে, তাদের প্রতিদান রয়েছে তাদের রব-এর নিকট। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।

ইসলামী অর্থব্যবস্থা স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত। যা মানুষকে সৎ পথে জীবন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য পথনির্দেশ করে। এ অর্থ ব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। মানুষ তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে সম্পদের আমানতদার। এক্ষেত্রে সম্পদ উপার্জন, উৎপাদন ও ভোগে হারাম ও হালালের ব্যবধান নিশ্চিত করা হয়। এ অর্থনীতি সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য যাকাত, ওশর, জিযিয়া ও ছাদাকাতুল ফিৎর ইত্যাদি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। সূদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, কালোবাজারী, অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন, চুরি, ডাকাতি, শোষণ, মজুদদারী, যুলুম প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

যে অর্থব্যবস্থায় কুরআন ও সুন্না্হর আলোকে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিভাবে আয়, উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন, মূলধন ও বিনিয়োগ প্রভৃতি পরিচালিত হয়, তাই ইসলামী অর্থব্যবস্থা।

ইসলামী অর্থনীতি নির্ভর করে সম্পদের উপর,টাকা বা অর্থের উপর নয়। ফলে এখানে ক্ষতির সম্ভাবনা নাই বললেই চলে যা সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি টাকা বা মুদ্রার উপর নির্ভর করে।

প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় (পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্র) সূদের লেনদেনকে বৈধ বিবেচনা করে এর সম্প্রসারণের প্রয়াস চালানো হয়। সূদ প্রথা সমাজে ধন বৈষম্যের জন্ম দেয়, উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে না। ১৯৩০ সালের মহামন্দার মূল কারণও ছিল সূদের হার।[ মো. গোলাম মোস্তাফা, ইসলামি অর্থনীতি, পৃ. ৪)

কিন্তু ইসলামে সূদকে বর্জন করে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে আর্থিক পুঁজিকে উৎপাদন ও ব্যবসায়ে নিয়োগ করে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন ও আয় সৃষ্টিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ সূদের সাথে শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনা প্রভৃতি অশুভ বিষয় সম্পৃক্ত থাকে।

২:২৭৮ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ ذَرُوۡا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿

২৭৮. হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা মুমিন হও।

২:২৭৯ فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا فَاۡذَنُوۡا بِحَرۡبٍ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ ۚ وَ اِنۡ تُبۡتُمۡ فَلَکُمۡ رُءُوۡسُ اَمۡوَالِکُمۡ ۚ لَا تَظۡلِمُوۡنَ وَ لَا تُظۡلَمُوۡنَ

২৭৯. অতঃপর যদি তোমরা না কর তবে আল্লাহ ও তার রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও। আর যদি তোমরা তাওবা কর তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। তোমরা যুলুম করবে না এবং তোমাদের উপরও যুলুম করা হবে না।

আলোচ্য আয়াতে এ নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণকারীদেরকে কঠোর শাস্তির কথা শোনানো হয়েছে। অর্থাৎ তোমরা যদি সুদ পরিহার না কর, তবে আল্লাহ তা’আলা ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। কুফর ছাড়া অন্য কোন বৃহত্তম গোনাহর কারণে কুরআনুল কারীমে এত বড় শাস্তির কথা আর উচ্চারিত হয়নি। [মাআরিফুল কুরআন]

বলা হয়েছে ‘যদি তোমরা তাওবা করে ভবিষ্যতের জন্য বকেয়া সুদ ছেড়ে দিতে সংকল্পবদ্ধ হও, তবে তোমরা আসল মুলধন ফেরত পেয়ে যাবে’। মূলধনের অতিরিক্ত আদায় করে তোমরা কারো উপর যুলুম করতে পার না এবং কেউ মূলধন হ্রাস করে কিংবা পরিশোধে বিলম্ব করে তোমাদের উপরও যুলুম করতে পারবে না। আয়াতে মূলধন দেয়াকে তাওবার সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ যদি তোমরা তাওবা কর এবং ভবিষ্যতে সুদ ছেড়ে দিতে সংকল্পবদ্ধ হও, তবেই তোমরা মূলধন ফেরত পাবে। এ থেকে বাহ্যতঃ ইঙ্গিত বোঝা যায় যে, সুদ ছেড়ে দেয়ার সংকল্প করে তাওবা না করলে মূলধনও ফেরত পাবে না। সুদ হারাম হওয়ার পূর্বে যে ব্যক্তি সুদের অর্থ অর্জন করেছিল, সুদ হারাম হওয়ার পর সে যদি ভবিষ্যতের জন্য তাওবা করে নেয় এবং সুদ থেকে বিরত থাকে, তবে পূর্বেকার সঞ্চিত অর্থ শরীআতের নির্দেশ অনুযায়ী তারই অধিকারভুক্ত হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে, সে সর্বান্তকরণেই বিরত রয়েছে কি কপটতা সহকারে তাওবা করেছে- তার এ আভ্যন্তরীণ ব্যাপারটি আল্লাহর উপর নির্ভরশীল থাকবে।

এ প্রসঙ্গে প্রথমে বোঝা দরকার যে, জগতের কোন সৃষ্টবস্তু ও তার কাজ-কারবারই এমন নেই যাতে কোন না কোন বৈশিষ্ট্য বা উপকারিতা নেই। সাপ-বিচ্ছু, বাঘ-সিংহ এমনকি সংখিয়ার মত মারাত্মক বিষের মধ্যেও মানুষের হাজারো উপকারিতা নিহিত রয়েছে। চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, ঘুষ ইত্যাদির মধ্যেও কোন না কোন উপকার খুঁজে বের করা কঠিন নয়। কিন্তু প্রত্যেক ধর্ম ও জাতির চিন্তাশীল শ্রেণীর মধ্যেই দেখা যায়, যে জিনিষের মধ্যে উপকার বেশী এবং ক্ষতি কম, তাকে উপকারী ও উত্তম মনে করা হয়। পক্ষান্তরে যেসব জিনিষের অনিষ্ট ও অপকারিতা বেশী এবং উপকারিতা কম, সেগুলোকে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় মনে করা হয়। রিবা’ অর্থাৎ সুদের অবস্থাও তদ্রুপ। এতে সুদখোরের সাময়িক উপকার অবশ্যই দেখা যায়। কিন্তু এর দুনিয়া ও আখেরাতের মন্দ পরিণাম এ উপকারের তুলনায় অত্যন্ত জঘন্য।

প্রত্যেক বস্তুর উপকার-অপকার ও লাভ-ক্ষতি তুলনা করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক বুদ্ধিমানের কাছে এ বিষয়টিও লক্ষণীয় হয়ে থাকে যে, যদি কোন বস্তুর উপকার অস্থায়ী ও সাময়িক হয় এবং অপকার দীর্ঘস্থায়ী কিংবা চিরস্থায়ী হয়, তবে একে কোন বুদ্ধিমান উপকারী বস্তুসমূহের তালিকায় গণ্য করতে পারে না। এমনিভাবে যদি কোন বস্তুর উপকার ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয় এবং ক্ষতি সমগ্র জাতির ঘাড়ে চাপে, তবে একেও কোন সচেতন মানুষ উপকারী বলতে পারে না। চুরি ও ডাকাতিতে চোর ও ডাকাতের উপকার অনস্বীকার্য। কিন্তু তা সমগ্র জাতির জন্য ক্ষতিকর এবং তাদের শান্তি ও স্বস্তি বিনষ্টকারী। তাই কোন মানুষই চুরি-ডাকাতিকে ভাল বলে না। সুতরাং সামান্য চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, সুদখোরের সাময়িক ও অস্থায়ী উপকারের তুলনায় তার আত্মিক ও নৈতিক ক্ষতি এত তীব্র যে, সুদ গ্রহণে অভ্যস্ত ব্যক্তি মানবতার গণ্ডির ভেতরেই থাকতে পারে না। তার সাময়িক উপকারটিও শুধুমাত্র তার নিজস্ব ও ব্যক্তিগত উপকার। কিন্তু এর ফলে গোটা জাতিকে বিরাট ক্ষতি ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থার স্বীকার হতে হয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

من جمع مالا حراما، ثم تصدق به، لم يكن له فيه أجر، وكان إصره عليه. أخرجه ابن حبان، وقال الشيخ شعيب: إسناده حسن … وأخرجه الحاكم … وصححه، ووافقه الذهبي.

“যে ব্যক্তি হারাম সম্পদ উপার্জন করে তা সাদাকা করল, তাতে তার কোনো সওয়াব হবে না; বরং এর গুনাহ তার উপরই বর্তাবে।” -সহীহ ইবনে হিব্বান : ৩২১৬

ইসলাম সম্পর্কে যারা জানে না বা পরিকল্পিতভাবে জেনেই মিথ্যাচার করে, তারা বলে যে–

ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। কিন্তু রিবা ও সুদ এক নয়। রিবা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। এখানে কোনো মানবিকতা নেই। সুদ হচ্ছে কস্ট অব ফান্ড (তহবিলের ব্যয়) বা কস্ট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (প্রশাসনিক খরচ)। ধর্ম নিয়ে যাঁরা বেশি কথা বলেন, তাঁরা সুদ আর রিবাকে এক করে ফেলেন।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির কোনো কোনো ধারক-বাহক তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই ভ্রান্ত মতটিকে জিইয়ে রেখেছেন এবং মাঝে মাঝে তারা সেটি নতুন করে প্রচার করে থাকেন।

তাদের সবচেয়ে বড় যুক্তি হল (অথচ সেটি একান্তই মনগড়া) তখনকার রিবার হার ছিল অনেক বেশি এবং বর্তমানে তার হার কম। একথার সপক্ষে তারা কুরআনে কারীমের সূরা আলে ইমরানের ১৩০ নম্বর আয়াতকে পেশ করে থাকে। যার তরজমা হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা দ্বিগুণ-বহুগুণে (আদআফাম-মুদাআফা) সুদ খেয়ো না।”

এ যেন اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ

(তরজমা) তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান কর? (সূরা বাকারা ২ : ৮৫)-এর হুবহু নমুনা।

রিবা সংক্রান্ত কুরআন-হাদীসের অন্যান্য আয়াত ও হাদীসকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গিয়ে সম্ভবত ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মুসলমানদের মধ্যে সুদের মতো জঘন্যতম হারামের প্রচলনের জন্যই এই পদ্ধতির অবতারণা করা হয়েছে। আসলে কুরআনে ন্যূনতম সুদকেও স্পষ্টভাবে হারাম করা হয়েছে। এই আয়াতে তো সুদের অতি বেশি ভয়াবহ একটি পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। যাতে সুদের হার হয়ে থাকে অনেক বেশি। কুরআনের অন্যান্য আয়াতগুলোও পড়ুন।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ ذَرُوْا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ فَاِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا فَاْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ ۚ وَ اِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوْسُ اَمْوَالِكُمْ ۚ لَا تَظْلِمُوْنَ وَ لَا تُظْلَمُوْنَ

(তরজমা) হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে অংশই অবশিষ্ট রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও। যদি তোমরা মুমিন হও।

যদি তোমরা  না ছাড় তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আর তোমরা যদি তওবা কর তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। তোমরাও কারো প্রতি যুলুম করবে না এবং তোমাদের প্রতিও যুলুম করা হবে না। -সূরা বাকারা ২ : ২৭৮-২৭৯

প্রথম আয়াতে (২৭৮) সুদের যে অংশ বকেয়া ছিল তা ছেড়ে দেওয়ার আদেশ করেছেন। আরো আদেশ করেছেন যে, যদি তোমরা মুমিন হও তবে এই আদেশ পালন করো।

পরবর্তী আয়াতে (২৭৯) বলা হয়েছে যে, যদি তোমরা এই আদেশ পালন না কর তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। এরপর বলেছেন, যদি তোমরা এই হারাম থেকে তওবা কর তবে তোমরা নিজেদের মূলধনের অধিকারী হবে। যেন তোমাদের দ্বারা কারো প্রতি যুলুম না হয় এবং তোমরাও কারো জুলুমের শিকার না হও।

বোঝা গেল, কুরআন সামান্য সুদকেও হারাম করেছে এবং এটাকে জুলুম সাব্যস্ত করেছে যদিও তা হয় ০.০০১%। আর এ বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ঋণের বিপরীতে মূলধনের অতিরিক্ত সামান্য পরিমাণও কুরআনের দৃষ্টিতে রিবা।

আর রিবার প্রসিদ্ধ আয়াত- وَ اَحَلَّ اللّٰهُ الْبَیْعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا

(তরজমা : অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা বাকারা ২:২৭৫) প্রায় সব মুসলমানেরই জানা। এই আয়াতেও কম-বেশির কোনো পার্থক্য ছাড়া সকল রিবা বা সুদকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া অসংখ্য সহীহ হাদীস ও আছারে কম-বেশি, চক্রবৃদ্ধি-সরল নির্বিশেষে সব রকম রিবা বা সুদকে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।

সুতরাং কম এবং বেশি পরিমাণের সাথে রিবা হওয়া না-হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই; বরং ঋণের অতিরিক্ত যাই কিছু হোক সেটি রিবার অন্তর্ভুক্ত। তা ইন্টারেস্ট, মুনাফা, লাভ, ফিনান্সিয়াল চার্জ অথবা সুদ যে নামেই ডাকা হোক।

বৃটেনের অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা এ কথার পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। যাতে বলা হয়েছে, পুরো পৃথিবীর ৯৯% সম্পদ ভোগ করছে মাত্র ১% মানুষ। পক্ষান্তরে ৯৯% লোকের জন্য থাকছে মাত্র ১% সম্পদ। এটি সুদ ভিত্তিক অমানবিকতারই একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

তাছাড়া আল্লাহ তাআলার হারামকৃত কোনো বিষয় যদি কারো দৃষ্টিতে অমানবিক না-ও হয় তবুও তা শুধু এ জন্যই হারাম হবে যে, আল্লাহ তাআলা তা হারাম করেছেন। মুমিনের দৃষ্টিতে ঈমানই সবার আগে। ইসলামী বিধিনিষেধই তার কাছে বৈধ-অবৈধের মানদÐ।

(সংগৃহিত অংশ–সুদ কি ‘রিবা নয়? মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ)

সুদ ও মুনাফার পার্থক্য

অনেকেই বলেন, সুদ ও মুনাফা একই জিনিস। কিন্তু আসলে তা নয়। সুদ ও মুনাফার পার্থক্যগুলো হলো-

এক. লেনদেনের ক্ষেত্রে ঋণের অতিরিক্ত গ্রহণ করলে তা সুদ। অপরদিকে ব্যবসায় মূলধন খাটানোর মাধ্যমে মূলধনের অতিরিক্ত আয় হলো- মুনাফা।

দুই. সুদের উপাদান সময়, সুদের হার ও ঋণের পরিমাণ। মুনাফা নির্ভর করে ব্যয় সাশ্রয় ও অনুকূল বাজার চাহিদার ওপর।

তিন. সুদের উৎপত্তি ঋণ থেকে। মুনাফার উৎপত্তি ব্যবসার মূলধন বিনিয়োগ থেকে।

চার. সুদে ঋণদাতা ঝুঁকি বহন করে না। কিন্তু মুনাফায় ক্ষতির ঝুঁকি থাকে।

পাঁচ. সুদের ফলাফল ঋণদাতা একা ভোগ করে। অপরদিকে মুনাফা যোগানদার ও ব্যবহারকারী উভয়ই ব্যবহার করে।

ছয়. সুদ পূর্ব নির্ধারিত। অপরদিকে মুনাফা অর্জিত হয় পরে।

২:২৮০ وَ اِنۡ کَانَ ذُوۡ عُسۡرَۃٍ فَنَظِرَۃٌ اِلٰی مَیۡسَرَۃٍ ؕ وَ اَنۡ تَصَدَّقُوۡا خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ

২৮০. আর যদি সে অভাবগ্রস্থ হয় তবে স্বচ্চলতা পর্যন্ত তার অবকাশ। আর যদি তোমরা সদকা কর তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে।

এ আয়াতে সুদখুরীর মানবতা বিরোধী কাণ্ডকীর্তির বিপরীতে পবিত্র চরিত্র এবং দরিদ্র ও নিঃস্বদের প্রতি কৃপামূলক ব্যবহার শিক্ষা দিয়ে বলা হয়েছে যে, তোমার খাতক যদি রিক্ত হস্ত হয় – ঋণ পরিশোধে সক্ষম না হয়, তবে শরীআতের নির্দেশ এই যে, তাকে স্বাচ্ছন্দ্যশীল হওয়া পর্যন্ত সময় দেয়া বিধেয় যদি তাকে ঋণ থেকেই রেহাই দিয়ে দাও, তবে তা তোমার জন্য আরও উত্তম। সুদখোরদের অভ্যাস এই যে, খাতক নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষম ন৷ হলে সুদের অংক আসলের সাথে যোগ করে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের কারবার চালায় এবং সুদের হারও আগের চাইতে বাড়িয়ে দেয়। এখানে শ্রেষ্ঠতম বিচারক আল্লাহ তা’আলা আইন প্রনয়ণ করে দিয়েছেন যে, কোন খাতক বাস্তবিকই নিঃস্ব হলে এবং ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হলে তাকে অতিষ্ঠ করা জায়েয নয়; বরং তাকে সক্ষম হওয়া পর্যন্ত সময় দেয়া উচিত। সাথে সাথে এ ব্যাপারেও উৎসাহিত করেছেন যে, যদি এ গরীবকে ক্ষমা করে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য অধিক উত্তম। এখানে ক্ষমা করাকে কুরআনুল কারীম সদকা শব্দে ব্যক্ত করেছে।

এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, এ ক্ষমা তোমার জন্য সদকা হয়ে যাবে এবং বিরাট সওয়াবের কারণ হবে। এছাড়াও আরও বলেছেনঃ ক্ষমা করা তোমাদের জন্য উত্তম। হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পূর্বের যামানায় এক ব্যক্তি লোকদেরকে ঋণ দিত আর তার সন্তানদেরকে বলত যে, যখন কোন বিপদগ্রস্ত লোক আসে তখন তার কর্জ ক্ষমা করে দিও। হয়তো আল্লাহও আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। তিনি বলেনঃ অতঃপর (লোকটি মৃত্যুর পর) আল্লাহর সাক্ষাত পেল, তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। [বুখারীঃ ৩৪৮০] অন্য এক হাদীসে এসেছেঃ “যে কেউ অভাবীকে অবকাশ দিবে তার জন্য কর্জ পরিশোধের সময় পর্যন্ত প্রতিদিন সদকার সওয়াব লেখা হবে। তারপর যদি আবার তাকে নতুন করে কর্জ পরিশোধের অবকাশ দেয় তবে কর্জ আদায় করার সময় পর্যন্ত প্রতিদিন তার সদকার সওয়াব লেখা হবে। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৯, মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩৬০]

এ আয়াত থেকে শরীআতের এ বিধান গৃহীত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হয়ে পড়েছে, ইসলামী আদালাত তার ঋণদাতাদের বাধ্য করবে যাতে তারা তাকে সময় দেয় এবং কোন কোন অবস্থায় আদালত তার সমস্ত দেনা বা তার আংশিক মাফ করে দেয়ারও ব্যবস্থা করবে। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিভিন্ন হাদীস এসেছে।

সূরা আল-বাকারার ২৭৫ থেকে ২৮০ এ ছয়টি আয়াতে সুদের অবৈধতা ও বিধিবিধান বর্ণিত হয়েছে। প্রথম আয়াতের প্রথম বাক্যে সুদখোরদের মন্দ পরিণতি এবং হাশরের ময়দানে তাদের লাঞ্ছনার বিষয় উল্লেখিত হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা সুদ খায়, তারা দণ্ডায়মান হয় না; কিন্তু সে ব্যক্তির মত, যাকে কোন শয়তান জিন আসর করে দিশেহারা করে দেয়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ দণ্ডায়মান হওয়ার অর্থ হাশরের ময়দানে কবর থেকে উঠা। সুদখোর যখন কবর থেকে উঠবে, তখন ঐ পাগল বা উন্মাদের মত উঠবে, যাকে কোন শয়তান জিন দিশেহারা করে দেয়। [ইমাম ত্বাবারী সহীহ সনদে তার তাফসীরে বর্ণনা করেন।]

তাছাড়া সুদখোরের শাস্তি ও ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আরও অনেক হাদীস এসেছে, যেমন:

(১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদখোরকে লা’নত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ যে সুদ খায়, আর যে খাওয়ায়, আর যে লিখে এবং সুদের কর্মকাণ্ডের দুই সাক্ষী, তাদের প্রত্যেকের উপর আল্লাহর লা’নত হোক। [ইবনে মাজাহঃ ২২৭৭]

সুদ খেলে মানুষ লালত ও অভিশাপের ভাগী হয়। দূরে চলে যায় আল্লাহর রহমত থেকে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সুদদাতা, গ্রহীতা, সুদ-চুক্তির লেখক ও সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন।’ তিনি বলেছেন, ‘তারা সবাই সমান অপরাধী।’ মুসলিম : ১৫৯৭

(২) আবু যুহাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রক্তের মূল্য, কুকুরের মূল্য, যিনার ব্যবসা থেকে নিষেধ করেছেন এবং সুদ দাতা, গ্রহীতা, শরীর খোদাই করে নকশা করা, যে করায়, যে ছবি অংকন করে, এদের সবার উপর লা’নত করেছেন। [বুখারীঃ ৫৯৬২]

(৩) সামূরা ইবনে জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ সময়ই তার সাথীদের জিজ্ঞেস করতেনঃ তোমাদের কেউ কোন স্বপ্ন দেখেছ কি? কেউ কোন স্বপ্ন দেখে থাকলে, সে তার নিকট বলত যা আল্লাহ চাইতেন। একদিন সকালে তিনি বললেনঃ রাতে (স্বপ্নে) আমার নিকট দু’জন আগন্তুক (ফেরেশতা) আসল। আমাকে তারা উঠাল। তারপর আমাকে বললঃ চলুন।

আমি তাদের দু’জনের সাথে চললাম। … সামনে অগ্রসর হয়ে আমরা একটি নদীর নিকট পৌছলাম। … সে নদীতে একজনকে সাতরাতে দেখলাম। নদীর পাড়ে একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। যার নিকট ছিল অসংখ্য পাথরের এক স্তুপ। সাতারকারী লোকটি সাতরানো শেষ করে যার নিকট পাথরের স্তুপ ছিল তার নিকট এসে মুখ খুলে দিত। আর সে তার মুখে একটি করে পাথর নিক্ষেপ করত। তারপর সে সাতরাতে চলে যেত। সাতরিয়ে ফিরে এসে আবার অনুরূপ মুখ খুলে দিত। আর ঐ লোকটি তার মুখে একটি করে পাথর নিক্ষেপ করত। …. শেষ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিবরীল বললেনঃ আর যে লোক ঝর্ণায় সাতরাচ্ছিল, যার নিকট দিয়ে আপনি গিয়েছিলেন, যে পাথরের লোকমা খাচ্ছিল, সে ছিল সুদখোর। [বুখারীঃ ৩৪৮০]

ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সুদ যদিও সম্পদ বাড়ায় কিন্তু শেষ পরিণামে তা কমায়।মুসনাদে আহমদ : ৪২৪

সুদ ভক্ষণ খোদাভীতি, তাকওয়া শূন্যতা এবং দুর্বলতার প্রমাণ বহণ করে। যা মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে ব্যর্থ ও হতভাগ্য মানুষে পরিণত করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও। আর তোমরা আগুনকে ভয় কর, যা কাফিরদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।’ আলে ইমরান : ১৩০-১৩২

সুদ খাওয়া শাস্তি ও ধ্বংসের কারণ হয়। ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যখন এলাকায় সুদ ও ব্যভিচার প্রকাশ পাবে তখন বুঝতে হবে তারা নিজেদের ওপর আল্লাহর শাস্তি হালাল করে নিয়েছে।’ মুসতাদরাকে হাকেম : ২/৩৭

নিকৃষ্টতম কাজের মধ্যে তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে এই সুদের। যেমন-আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সুদের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে। সর্বনিম্নটি হলো নিজের মায়ের সঙ্গে জেনা করার মতো। আর অপর ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করা সবচে’ নিকৃষ্ট সুদ। মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৩৭

সুদ খেলে অন্তর কঠোর হয় এবং তাতে মরচে পড়ে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘কখনো নয়, বরং তারা যা অর্জন করত তা-ই তাদের অন্তরসমুহকে ঢেকে দিয়েছে।’ মুতাফ্ফিফিন : ১৪

সুদ খাওয়া হালাল রিজিক থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘সুতরাং ইয়াহূদীদের যুলমের কারণে আমি তাদের উপর উত্তম খাবারগুলো হারাম করেছিলাম, যা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে অনেককে তাদের বাধা প্রদানের কারণে। আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল। নিসা : ১৬০-১৬১

আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় তার মুমিন ভাইয়ের বিপদ দূর করবে আল্লাহ তাআলা তার বিপদ দূর করবেন দুনিয়া ও আখিরাতে। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে ছাড় দিবে আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়া-আখিরাতে ছাড় দিবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে আল্লাহ তাআলা উভয় জগতে তার দোষ গোপন করবেন। আর বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকে আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্যে থাকেন। মুসলিম : ২৬৯৯

আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- মুসলমান মুসলমানের ভাই- তার ওপর জুলুম করে না; তাকে একাকী ছেড়েও দেয় না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের কষ্ট লাঘব করবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার কষ্ট লাঘব করবেন। আর যে তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ গোপন রাখবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন। বুখারি : ২৪৪২, মুসলিম : ২৫৮০

তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি অভাবী লোককে সুযোগ দিবে অথবা তার প্রাপ্য মাফ করে দিবে আল্লাহ তাআলা তাকে নিজ ছায়াতলে স্থান দিবেন।মুসলিম : ৩০০৬

সুদ মানুষের সৌহার্দ্য-সহানুভূতির চেতনাকে গলা টিপে হত্যা করে। কারণ ঋণী ব্যক্তির সকল সম্পদ হাতছাড়া হতে দেখেও সুদখোরের অন্তরে মায়া জাগে না। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘দয়া-মায়া তার অন্তর থেকেই ছিনিয়ে নেয়া হয় যে হতভাগার দলে যোগ দিয়েছে।’ আবু দাউদ : ৪৯৪২, তিনমিযি : ১৯২৩

তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ তার ওপর দয়া দেখান না যে মানুষকে দয়া করে না।’ বুখারি : ৭৩৭৬, মুসলিম : ২৩১৯

অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘দয়াকারীদের ওপর দয়াবান-রহমান দয়া করেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর দয়া করো; আসমানবাসী তোমাদের ওপর দয়া করবেন। আবু দাউদ : ১৯৪১, তিরমিযি : ৯২৪

সুদ ব্যক্তি এবং দলের মাঝে হিংসা ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। অনৈক্য এবং বিশৃংখলা উস্কে দেয়। তাওযিহুল আহকাম ফি বুলুগিল মারাম : ৪/০৭

সুদ মানুষকে এমন সব কাজে উদ্বৃদ্ধ করে যার ফলাফল তার সহ্য ক্ষমতার বাইরে।

২:২৮১ وَ اتَّقُوۡا یَوۡمًا تُرۡجَعُوۡنَ فِیۡهِ اِلَی اللّٰهِ ٭۟ ثُمَّ تُوَفّٰی کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَ هُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ

২৮১. আর তোমরা সেই দিনের তাকওয়া অবলম্বন কর যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। তারপর প্রত্যেককে সে যা অর্জন করেছে তা পুরোপুরি প্রদান করা হবে। আর তাদের যুলুম করা হবে না।

এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বান্দাকে নসীহত করে বলছেন যে, দুনিয়ার আবাস ক্ষণস্থায়ী। এখান থেকে খুব কম সময়ের পরই তোমাদেরকে চলে যেতে হবে। এখানকার যাবতীয় সম্পদ রেখেই সবাইকে খালি হাতে আমার সামনে আসতে হবে। সুতরাং সে দিনের ব্যাপারে সদা সতর্ক ও সাবধান থাকা জরুরী যখন তোমরা আমার সামনে নীত হবে। সেদিন তোমাদের কৃতকর্ম অনুসারে তোমাদেরকে শাস্তি বা পুরষ্কার দেয়া হবে। সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এ আয়াত সবশেষে নাযিল হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৯ দিন জীবিত ছিলেন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মতে এর পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র ৩১ দিন জীবিত ছিলেন। [ইবনে কাসীর]

হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূল সা: বলেছেন, মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না, তাকে অসহায় অবস্থায় পরিত্যাগও করবে না এবং তাকে তুচ্ছজ্ঞান করবে না। তিনি নিজের বুকের দিকে ইশারা করে বলেন, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে। কোনো লোকের নিকৃষ্ট সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছজ্ঞান করে। প্রতিটি মুসলমানের জীবন, ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান সব মুসলমানের সম্মানের বস্তু (এর ওপর হস্তক্ষেপ করা তাদের জন্য হারাম)। (সহিহ মুসলিম)।

সুদের ক্ষতি-অপকারিতা-কুপ্রভাব

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, সুদের রয়েছে অনেক বড় বড় অপকারিতা এবং মারাত্মক শাস্তি। ইসলাম মানুষকে যা-ই করতে বলে তার মাঝে তার সৌভাগ্য এবং দুনিয়া-আখিরাতের সম্মান নিহিত থাকে। তেমনি ইসলাম এমন জিনিস থেকেই বারণ করে যার মাঝে তার দুর্ভাগ্য এবং উভয় জগতের ক্ষতি রয়েছে। হ্যা, সুদেরও আছে অনেক অকল্যাণকর দিক। তার মধ্য হতে কয়েকটি। যেমন-

সুদের আত্মিক-চারিত্রিক ক্ষতি : সুদ ভক্ষণেচ্ছা যাদের রয়েছে তাদের চরিত্র নিয়ে ভাবলেই বুঝা যায় এর ক্ষতি কতটুকু। কারণ, সমাজে আমরা তাদেরকেই সুদী কারবার করতে দেখি যাদের অন্তরে কৃপণতা, নির্দয়তা, অর্থলিপ্সা এবং বস্ত্ত লোলুপতা প্রভৃতি বদগুণ স্থান করে নিয়েছে।

সুদের সামাজিক ক্ষতি : যে সমাজে সুদী লেনদেন হয় সেটা ভ্রষ্ট, অন্তসার শূন্য সমাজ। যেখানে একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসে না। কেউ কারো সামান্য উপকার করে না স্বার্থ ছাড়া। এ সমাজের বিত্তশালীরা নিঃস্বদের ঘৃণা করে। বলাবাহুল্য যে, এমন সমাজে কখনো ঐক্য-স্থিতি টিকে থাকতে পারে না। এর সদস্যরা অনৈক্য ও অশান্তির দিকে ঝুঁকে থাকে সদা সর্বদা।

সুদের অর্থনৈতিক ক্ষতি : সুদ সমাজ জীবনের সকল লেনদেনের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্ক রাখে। কারণ সমাজের সবাই কমবেশি কর্জ দেয়া-নেয়া করে।

আর কর্জ কয়েক প্রকার : যথা-

(ক) এমন কর্জ যেটা অভাবী শ্রেণী তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের অভিপ্রায়ে গ্রহণ করে। ঋণের এই সনাতনী ধারাকে অবলম্বন করেই সুদী কারবার সবচে বেশি প্রসারতা লাভ করেছে। এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই সুদী ব্যবসা যার রাহুগ্রাস থেকে খুব কম সংখ্যক দেশই নিরাপদ আছে। যে ব্যক্তিই এ সুদী চক্রের কব্জায় একবার এসেছে আমৃত্যু সে এর নাগপাশ থেকে মুক্তি পায় না।

(খ) এমন কর্জ যেটা ব্যবসায়ী, নির্মাতা এবং ভূ-স্বামীগণ গ্রহণ করে থাকে তাদের সফল প্রকল্পগুলোয় কাজে লাগানোর জন্য।

(গ) এমন ঋণ যা কোনো দেশ অন্য দেশের অর্থবাজার থেকে গ্রহণ করে থাকে তার প্রয়োজন মেটাবার নিমিত্তে।

ঋণের সবগুলো প্রকারই সমাজের প্রভুত দুর্দশা ও অকল্যাণ বয়ে আনে। চাই ঋণ নেয়া হোক ব্যবসা বা কারখানার জন্য, চাই ঋণ গ্রহণ করুক গরিব রাষ্ট্র ধনী রাষ্ট্রের কাছ থেকে। কারণ সবগুলোই এমন ব্যাপক অনিষ্ট ডেকে আনে যা থেকে ওই সমাজ বা রাষ্ট্র সহজে পরিত্রাণ পায় না। এটা হচ্ছে শুধু ইসলামি পদ্ধতির অনুসরণ না করার ফলেই। যে ইসলাম মানুষকে সব রকম কল্যাণের দিকে আহবান জানায়। নির্দেশ দেয় গরিব, মিসকিন ও অভাবীদের প্রতি দয়া, অনুগ্রহ ও সহমর্মিতা দেখাতে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।’ মায়িদা : ০২

তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন মুসলমানদের পরস্পর দয়া, সহানুভূতি দেখাতে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকতে। তিনি ইরশাদ করেন- ‘মুসলমান মুসলমানের জন্য প্রাচীরের মতো যার এক অংশ অপর অংশের সঙ্গে বাঁধা আছে। এ বলে তিনি তাঁর এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখালেন। বুখারি : ৪৮১, মুসলিম : ২৫৮৫

তিনি আরও বলেন, পরস্পর ভালোবাসা, সৌহার্দ্য এবং একতার দিক দিয়ে মুমিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের ন্যায়। যখন তার কোনো অঙ্গ অসুস্থ হয় তখন তার সব অঙ্গই জ্বর বা জাগরণের মাধ্যমে সাড়া দেয়। বুখারি : ৬০১১, মুসলিম : ২৫৮৬

সুতরাং বুঝা গেল, বিপদ থেকে বাঁচতে হলে, কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিৎ করতে হলে ইসলাম ও ইসলামি আদর্শের কোনো বিকল্প নেই।

সুদ মানুষের কর্ম-শক্তিকে অকার্যকর বানিয়ে দেয়। কেননা সুদ থেকে যখন চাহিদা মেটাতে পারে সুদী কারবারি তখন বেকারত্ব ওপরই সন্তুষ্ট থাকে।

ইসলামি সমাজগুলো পর্যন্ত সুদের দাবানল থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না।

মানুষের কাছে অলস বেকার টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অর্থনীতি বিকৃত ও ভ্রান্ত পথে হাঁটতে শুরু করেছে।

মুসলমানদের সম্পদ তাদের শত্রুদের হাতে চলে যাচ্ছে। এটা মুসলমানদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক ব্যাপার। কারণ তারা তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ কাফেরদের ব্যাংকগুলোয় জমা রাখছে। এর দ্বারা তারা যেমন আমাদের বিরুদ্ধে আমাদেরই টাকা নিয়ে শক্তিশালী হচ্ছে তেমনি সে টাকা দিয়ে আমাদেরকেই দুর্বল বানানোর চেষ্টা করছে। তাছাড়া তাদের কাছে টাকা গচ্ছিত রাখার কারণে মুসলমানরা উপকরণ সল্পতারও শিকার হচ্ছে।

সুদ আল্লাহর দুশমন অভিশপ্ত ইহুদিদের স্বভাব-আমল। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।’ নিসা : ১৬১

সুদ বর্বরযুগের লোকদের স্বভাব। যে সুদী কারবার করে যে বর্বরদের গুণে গুণান্বিত হয়।

ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সুদ যদিও সম্পদ বাড়ায় কিন্তু শেষ পরিণামে তা কমায়।মুসনাদে আহমদ : ৪২৪

সুদ ভক্ষণ খোদাভীতি, তাকওয়া শূন্যতা এবং দুর্বলতার প্রমাণ বহণ করে। যা মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে ব্যর্থ ও হতভাগ্য মানুষে পরিণত করে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও। আর তোমরা আগুনকে ভয় কর, যা কাফিরদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।’ আলে ইমরান : ১৩০-১৩২

সুদ খেলে মানুষ লালত ও অভিশাপের ভাগী হয়। দূরে চলে যায় আল্লাহর রহমত থেকে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সুদদাতা, গ্রহীতা, সুদ-চুক্তির লেখক ও সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন।’ তিনি বলেছেন, ‘তারা সবাই সমান অপরাধী।’ মুসলিম : ১৫৯৭

সুদখোরকে মৃত্যুর পর রক্তের নদীতে সাঁতরানোর শাস্তি দেয়া হবে। সে সাঁতরাবে আর তাকে পাথর ছুড়ে নদীর মাঝখানে পৌঁছে দেয়া হবে। সামুরা রা. থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসের শেষে বলা হয়েছে ‘আমি যাকে নদীর মাঝে দেখেছি সে হলো সুদখোর। বুখারি : ২০৮৫

সুদ মানুষকে মারাত্মকভাবে ধ্বংসকারী বিষয়গুলোর অন্যতম। আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘ধ্বংসকারী সাতটি জিনিস থেকে বেঁচে থাক। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, সেগুলো কী কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, শিরক করা, যাদু করা, অনুমোদিত কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের মাল ভক্ষণ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং মুমিনা সরলা সতী নারীকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া। বুখারি : ২৬১৫, মুসলিম : ৮৯

সুদ খাওয়া শাস্তি ও ধ্বংসের কারণ হয়। ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যখন এলাকায় সুদ ও ব্যভিচার প্রকাশ পাবে তখন বুঝতে হবে তারা নিজেদের ওপর আল্লাহর শাস্তি হালাল করে নিয়েছে।’ মুসতাদরাকে হাকেম : ২/৩৭

নিকৃষ্টতম কাজের মধ্যে তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে এই সুদের। যেমন-আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সুদের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে। সর্বনিম্নটি হলো নিজের মায়ের সঙ্গে জেনা করার মতো। আর অপর ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করা সবচে’ নিকৃষ্ট সুদ। মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৩৭

সুদ খাওয়ার অর্থ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরুদ্ধাচারণ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘অতএব যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে।’ নূর : ৬৩

‘আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক আযাব।’ নিসা : ১৪

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন- ‘আর আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।আহযাব : ৩৬

আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাতে তারা চিরস্থায়ী হবে।’ জিন : ২৩

সুদখোরকে জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে যদি সে তওবা না করে। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।’বাকারা : ২৭৫

আল্লাহ তাআলা সুদের অর্থ দিয়ে সদকা করলে সেটা গ্রহণ করেন না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘আল্লাহ তাআলা পবিত্র তিনি শুধু পবিত্র মালই গ্রহণ করেন।’ মুসলিম : ১০১৪

সুদখোরের দুআ কবুল হয় না। আবু হোরায়রা রা. বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই ব্যক্তির কথা বলেন, যে প্রায়শই দীর্ঘ ভ্রমণে থাকে। তার কেশ এলোমেলো আর বেশ আলুথালু। আকাশ পানে হাত প্রসারিত করে সে বলে, হে রব, হে রব, অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং ভরণপোষণও হারাম তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এর দুআ কীভাবে কবুল হবে? (তার দুআ কবুল করা হয় না।)

সুদ খেলে অন্তর কঠোর হয় এবং তাতে মরচে পড়ে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘কখনো নয়, বরং তারা যা অর্জন করত তা-ই তাদের অন্তরসমুহকে ঢেকে দিয়েছে।’ মুতাফ্ফিফিন : ১৪

সুদ খাওয়া হালাল রিজিক থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘সুতরাং ইয়াহূদীদের যুলমের কারণে আমি তাদের উপর উত্তম খাবারগুলো হারাম করেছিলাম, যা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে অনেককে তাদের বাধা প্রদানের কারণে। আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল। নিসা : ১৬০-১৬১

সুদখোর কল্যাণ আহরণের যাবতীয় উপলক্ষ্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাই সে উত্তম ঋণ দেয় না, অভাবীর প্রতি লক্ষ্য করে না এবং দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তির কষ্ট দূর করে না। কারণ তার পক্ষে বোধগম্য স্বার্থ ছাড়া অর্থ নিয়োগ কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ আল্লাহ তাআলা যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে সাহায্য করে এবং তার বিপদ দূর করে তার ফজিলত বলে দিয়েছেন।

প্রশ্নঃ—————-

ক- ইজারা তথা ভাড়ার পরিচিতি:

নির্দিষ্ট মেয়াদে দু’জনের মধ্যে বৈধ উপকারের বিনিময় চুক্তি করা।

খ- ইজারার হুকুম:

ইজারা জায়েয। এটা দুপক্ষের মাঝে অত্যাবশ্যকীয় চুক্তি।

গ- ইজারা শরী‘আতসম্মত হওয়ার হিকমত:

ইজারা মূলত মানুষের মাঝে পরস্পর সুবিধা বিনিময়। শ্রমিকদের কাজের প্রয়োজন, থাকার জন্য ঘরের দরকার, মালামাল বহন, মানুষের আরোহণ ও সুবিধার জন্য পশু, গাড়ি ও যন্ত্রের দরকার। আর ইজারা তথা ভাড়ায় খাটানো বৈধ হওয়ায় মানুষের জন্য অনেক কিছু সহজ হয়েছে ও তারা তাদের প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম হচ্ছে।

ঘ- ইজারার প্রকার:

ইজারা দু’প্রকার। তা হচ্ছে:

১- নির্দিষ্ট জিনিস ও আসবাবপত্র ভাড়া দেওয়া। যেমন, কেউ বলল, আমি আপনাকে এ ঘর বা গাড়িটি ভাড়া দিলাম।

২- কাজের ওপর ভাড়া দেওয়া। যেমন, কেউ দেয়াল নির্মাণ বা জমি চাষাবাদ ইত্যাদি করতে কোনো শ্রমিককে ভাড়া করল।

ঙ- ইজারার শর্তাবলী:

ইজারার শর্ত চারটি। তা হলো:

১- লেনদেনটি জায়েয হওয়া।

২- উপকারটি নির্দিষ্ট হওয়া। যেমন, ঘরে থাকা বা মানুষের খিদমত বা ইলম শিক্ষা দেওয়া ইত্যাদি।

৩- ভাড়া নির্ধারণ করা।

৪- উপকারটি বৈধ হওয়া। যেমন ঘরটি বসবাসের জন্য হওয়া। অতএব, কোনো হারাম উপকার সাধনে যেমন, যিনা, গান বাজনা, ঘরটি গীর্যার জন্য ভাড়া দেওয়া বা মদ বিক্রির জন্য ব্যবহার করা ইত্যাদি হারাম কাজের সুবিধার জন্য ভাড়া দেওয়া বৈধ নয়।