সুরা বাকারাঃ ২১তম রুকু (১৬৮-১৭৬)আয়াত

সুরা বাকারাঃ ২১তম রুকু (১৬৮-১৭৬)আয়াত

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ 

২:১৬৮ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ کُلُوۡا مِمَّا فِی الۡاَرۡضِ حَلٰلًا طَیِّبًا ۫ۖ وَّ لَا تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّهٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ

হে মানুষ! তোমরা খাও যমীনে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে। আর তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।

حلّ শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো গিট খোলা। যেসব বস্তু সামগ্রীকে মানুষের জন্য হালাল বা বৈধ করে দেয়া হয়েছে, তাতে যেন একটা গিঠই খুলে দেয়া হয়েছে এবং সেগুলোর উপর থেকে বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হয়েছে।

সাহল ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মুক্তি বা পরিত্রাণ লাভ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল

(১) হালাল খাওয়া, (২) ফরয আদায় করা এবং (৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতসমূহের আনুগত্য ও অনুসরণ করা।

طيب শব্দের অর্থ পবিত্র। শরীআতের দৃষ্টিতে হালাল এবং মানসিক দিক দিয়ে আকর্ষণীয় সমস্ত বস্তু-সামগ্ৰীও এরই অন্তর্ভুক্ত।

خُطُوَاتٌ শব্দটি خُطْوَةٌ এর বহুবচন। خُطْوَةٌ বলা হয় পায়ের দুই ধাপের মধ্যবর্তী ব্যবধানকে। সে অনুসারে (خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ) এর অর্থ হচ্ছে শয়তানী পদক্ষেপসমূহ বা শয়তানী কর্মকাণ্ড। হাদীসে কুদসীতে এসেছে, “আমি আমার বান্দাকে যে সম্পদ দিয়েছি তা বৈধ। আর আমি আমার সকল বান্দাকেই একনিষ্ঠ দ্বীনের উপর সৃষ্টি করেছি। তারপর তাদের কাছে শয়তানরা এসে তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং তাদের উপর তা হারাম করে দেয় যা আমি তাদের জন্য হালাল করেছিলাম।” [মুসলিম: ২৮৫৬] (অর্থাৎ তারা সেগুলোকে দেব-দেবীর নামে উৎসর্গ করে সেগুলোকে হারাম বানিয়ে ফেলে)

নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু; কাজেই তাকে শত্রু হিসেবেই গ্ৰহণ কর। সে তো তার দলবলকে ডাকে শুধু এজন্যে যে, তারা যেন প্রজ্জলিত আগুনের অধিবাসী হয়। সূরা ফাতিরঃ ৫-৬

ইসলামের সরল সঠিক রাজপথে ওঁৎ পেতে বসে থেকে মানুষকে প্রলুব্ধ ও বিভ্রান্ত করে দুই পাশের পাপের গলিতে ঢুকিয়ে দেয়াই শয়তানের কাজ।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে একটি দাগ দিলেন, অতঃপর বললেন, এটা আল্লাহর সরল সঠিক পথ। এরপর ডানে বামে দাগ কাটলেন এবং বললেন, এই রাস্তাগুলির প্রত্যেকটিতে একজন শয়তান দাঁড়িয়ে আছে। যে মানুষকে তার দিকে আহবান করে থাকে। অতঃপর পাঠ করলেন, ‘এটাই আমার সরল সঠিক পথ, এরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করনা, তা হ’লে (শয়তান) তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে’ (আন‘আম ৬/১৫৩)। হাকেম হা/৩২৪১; মিশকাত হা/১৬৬, সনদ হাসান; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা হা/১১১১০।

আয়াতের মর্মে ও হাদীছের ভাষ্যে বুঝা যায় শয়তান রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে মানুষকে তাদের দিকে বিভ্রান্ত করার জন্য আহবান করে থাকে।

২:১৬৯ اِنَّمَا یَاۡمُرُکُمۡ بِالسُّوۡٓءِ وَ الۡفَحۡشَآءِ وَ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا عَلَی اللّٰهِ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ

সে তো শুধু তোমাদেরকে নির্দেশ দেয় মন্দ ও অশ্লীল কাজের এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন সব বিষয় বলার যা তোমরা জান না

سُوْءٌ বলা হয় এমন বস্তু বা বিষয়কে যা দেখে রুচিজ্ঞানসম্পন্ন যে কোন বুদ্ধিমান লোক দুঃখবোধ করে।

فَحْشَاءٌ অর্থ অশ্লীল ও নির্লজ্জ কাজ। আবার অনেকে বলেন যে, এ ক্ষেত্রে سُوْءٌ এবং فَحْشَاءٌ এর মর্ম যথাক্রমে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পাপ। অর্থাৎ সাধারণ গোনাহ এবং কবীরা গোনাহ।

হজরত আবু বাকরাহ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ। ঈমানের অবস্থান হলো জান্নাত। অশ্লীলতা হলো অত্যাচার, আর অত্যাচার থাকবে জাহান্নামে।’ (ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান)।

‘হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, মুমিন খোঁটা দানকারী, অভিশাপকারী, নির্লজ্জ ও অশ্লীলভাষী হয় না।’ (তিরমিজি -১৯৭৭, আহমদ, ইবনে হিব্বান-১৯২, আদাবুল মুফরাদ-৩৩২,

‘হজরত আবু দারদা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা অশ্লীলভাষী, নির্লজ্জ ইতরকে ঘৃণা করে থাকেন।’ (তিরমিজি, বায়হাকী -১৫৬, বুলুগুল মারাম)।

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘হজরত আবু দারদা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন (নেকি) ওজন করার দাঁড়িপাল্লায় সচ্চরিত্রতার চেয়ে কোনো বস্তুই অধিক ভারী হবে না। আর আল্লাহতায়ালা অশ্লীল ও চোয়াড়কে অপছন্দ করেন। (তিরমিজি-২০০২, আদাবুল মুফরাদ)।

না জেনে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীন সম্পর্কে কথা বলা বড় গোনাহ। এ আয়াতে এবং পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীন সম্পর্কে না জেনে কথা বলাকে বড় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। [যেমন, সূরা আল-বাকারাহ: ৮০, সূরা আল আরাফ: ২৮, ৩৩, সূরা ইউনুস: ৬৮]

—তারা বলে, জাহান্নামের আগুন আমাদের কখনো স্পর্শ করবে না , তবে কয়েক দিনের শাস্তি হলেও হয়ে যেতে পারে । এদেরকে জিজ্ঞেস করো, তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোন অংগীকার নিয়েছো, যার বিরুদ্ধাচারণ তিনি করতে পারেন না? অথবা তোমরা আল্লাহর ওপর চাপিয়ে দিয়ে এমন কথা বলছো যে কথা তিনি নিজের ওপর চাপিয়ে নিয়েছেন বলে তোমাদের জানা নেই? আচ্ছা জাহান্নামের আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে না কেন ?  সূরা আল-বাকারাহ: ৮০

তারা যখন কোন অশ্লিল কাজ করে তখন বলে, আমাদের বাপ-দাদারদেকে আমরা এভাবেই করতে দেখেছি এবং আল্লাহই আমাদের এমনটি করার হুকুম দিয়েছেন৷ তাদেরকে বলে দাও আল্লাহ কখনো নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার হুকুম দেন না৷  তোমরা কি আল্লাহর নাম নিয়ে এমন কথা বলো যাকে তোমরা আল্লাহর কথা বলে জানো না? সূরা আল আরাফ: ২৮

﴿قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾

হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাও, আল্লাহ যেসব জিনিস হারাম করেছেন সেগুলো হচ্ছেঃ প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, গোনাহ, সত্যের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি  আল্লাহর সাথে তোমাদের কাউকে শরীক করা যার স্বপক্ষে তিনি কোন সনদ পাঠাননি এবং আল্লাহর নামে তোমাদের এমন কোন কথা বলা, যা মূলত তিনি বলেছেন বলে তোমাদের জানা নেই৷ সূরা আল আরাফ: ৩৩

লোকেরা বলে, আল্লাহ কাউকে পুত্র বানিয়েছেন৷ সুবহানাল্লাহ -তিনি মহান-পবিত্র!  তিনি তো অভাবমুক্ত৷ আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তার মালিকানাধীন৷ একথার সপক্ষে তোমাদের কাছে কি প্রমাণ আছে? তোমরা কি আল্লাহর সপক্ষে এমন সব কথা বলো যা তোমাদের জানা নেই?  সূরা ইউনুস: ৬৮

তবে এ আয়াতে না জেনে কোন কথা বলতে শয়তান মানুষকে নির্দেশ দেয় সেটা ব্যাখ্যা করে বলা হয় নি। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র সেটার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেমন, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও সস্তুষ্টি বিধানের জন্য জন্তু-জানোয়ারকে ছেড়ে দেয়া, হালালকে হারাম করা ও হারামকে হালাল করা, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করা, আল্লাহর জন্য এমন গুণাবলী সাব্যস্ত করা যা থেকে তিনি পবিত্র। যেমন আল্লাহ বলেন, “বাহীরাহ, সায়েবাহ, ওছলাহ ও হামী আল্লাহ প্রবর্তণ করেননি; কিন্তু কাফেররা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে এবং তাদের অধিকাংশই উপলব্ধি করে না।” [সূরা আল-মায়েদাহঃ ১০৩]

“তারা জিনকে আল্লাহর শরীক করে, অথচ তিনিই এদেরকে সৃষ্টি করেছেন, আর তারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর প্রতি পুত্র-কন্যা আরোপ করে; তিনি পবিত্র—মহিমান্বিত এবং ওরা যা বলে তিনি তার উর্ধ্বে।” [সূরা আল-আনআমঃ ১০০]

“যারা নির্বুদ্ধিতার জন্য ও অজ্ঞানতাবশত নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবিকাকে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করার উদ্দেশ্যে নিষিদ্ধ গণ্য করে তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।” [সূরা আল-আনআমঃ ১৪০]

“বলুন, তোমরা কি ভেবে দেখেছ আল্লাহ তোমাদের যে রিযক দিয়েছেন তারপর তোমরা তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম করেছ? বলুন, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এটার অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করছ।” [সূরা ইউনুস: ৫৯]

“তারা বলে, ‘আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন’। তিনি মহান পবিত্র তিনি অভাবমুক্ত! যা কিছু আছে আসমানসমূহে ও যা কিছু আছে পৃথিবীতে তা তারই। এ বিষয়ে তোমাদের কাছে কোন সনদ নেই। তোমরা কি আল্লাহর উপর এমন কিছু বলছ যা তোমরা জান না?” [সূরা ইউনুস: ৬৮]

“তোমাদের জিহবা মিথ্যা আরোপ করে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার জন্য তোমরা বলো না, এটা হালাল এবং ওটা হারাম৷ নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা উদ্ভাবন করবে তারা সফলকাম হবে না।” [সূরা আন-নাহ্‌ল: ১১৬]

“আর তারা আল্লাহকে যথোচিত সম্মান করেনি। অথচ কিয়ামতের দিন সমস্ত যমীন থাকবে তার হাতের মুঠিতে এবং আসমানসমূহ থাকবে ভাজ করা অবস্থায় তার ডান হাতে। পবিত্র ও মহান তিনি, তারা যাদেরকে শরীক করে তিনি তাদের ঊর্ধ্বে।” [সূরা আয-যুমার: ৬৭]

মহান আল্লাহ বলেছেন-

তিনি এজন্য এমনটি হতে দেন) যাতে শয়তানের নিক্ষিপ্ত অনিষ্টকে পরীক্ষায় পরিণত করেন তাদের জন্য যাদের অন্তরে (মুনাফিকীর) রোগ রয়েছে এবং যাদের হৃদয়বৃত্তি মিথ্যা-কলূষিত-আসলে এ জালেমরা শত্রুতায় অনেক দূরে পৌঁছে গেছে ।

এবং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে তারা জেনে নেয় যে, তোমার রবের পক্ষ থেকে এটা সত্য এবং তারা এর প্রতি ঈমান আনে এবং এর সামনে তাদের অন্তর ঝুঁকে পড়ে; যারা ঈমান আনে তাদেরকে অবশ্যই আল্লাহ চিরকাল সত্য-সরল পথ দেখিয়ে থাকেন। সূরা হজ্জঃ ৫৩-৫৪

২:১৭০ وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُمُ اتَّبِعُوۡا مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ قَالُوۡا بَلۡ نَتَّبِعُ مَاۤ اَلۡفَیۡنَا عَلَیۡهِ اٰبَآءَنَا ؕ اَوَ لَوۡ کَانَ اٰبَآؤُهُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ شَیۡئًا وَّ لَا یَهۡتَدُوۡن

আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা তোমরা অনুসরণ কর’, তারা বলে, ‘না, বরং আমরা অনুসরণ করবো তার, যার উপর আমাদের পিতৃ পুরুষদেরকে পেয়েছি’। যদিও তাদের পিতৃপুরুষরা কিছু বুঝতো না এবং তারা সৎপথেও পরিচালিত ছিল না, তবুও কি?

এ আয়াতের দ্বারা বাপ-দাদা, পূর্বপুরুষের তাকলীদ বা অন্ধ অনুকরণ-অনুসরণের যেমন নিন্দা প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি বৈধ অনুসরণের জন্য কতিপয় শর্ত এবং একটা নীতিও জানা যাচ্ছে। যেমন, দু’টি শব্দে বলা হয়েছে (لَا يَعْقِلُونَ) এবং (لَا يَهْتَدُونَ) এতে প্রতীয়মান হয় যে, বাপ-দাদা, পূর্বপুরুষের আনুগত্য ও অনুসরণ এ জন্য নিষিদ্ধ যে, তাদের মধ্যে না ছিল জ্ঞান-বুদ্ধি, না ছিল কোন আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত। হিদায়াত বলতে সে সমস্ত বিধি-বিধানকে বোঝায়, যা পরিস্কারভাবে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে। আর জ্ঞান-বুদ্ধি বলতে সে সমস্ত বিষয়কে বোঝানো হয়েছে, যা শরীআতের প্রকৃষ্ট ‘নস’ বা নির্দেশ থেকে গবেষণা করে বের করা হয়।

অতএব, তাদের আনুগত্য ও অনুসরণ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণটি সাব্যস্ত হলো এই যে, তাদের কাছে না আছে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কোন বিধি-বিধান, না আছে তাদের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার বাণীর পর্যালোচনা-গবেষণা করে তা থেকে বিধি-বিধান বের করে নেয়ার মত কোন যোগ্যতা। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, কোন আলেমের ব্যাপারে এমন নিশ্চিত বিশ্বাস হলে যে, কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানের সাথে সাথে তার মধ্যে ইজতিহাদ (উদ্ভাবন)-এর যোগ্যতাও রয়েছে, তবে এমন মুজতাহিদ আলেমের আনুগত্য অনুসরণ করা জায়েয। অবশ্য এ আনুগত্য তার ব্যক্তিগত হুকুম মানার জন্য নয়, বরং আল্লাহর এবং তার হুকুম-আহকাম মানার জন্যই হতে হবে। [মা’আরিফুল কুরআন, পরিমার্জিত]

মক্কার মুশরিক, মদিনায় ইহুদী, নাসারা, সকলেই এইভাবেই বাপ দাদাদের অন্ধ অনুসরন করার কথা বলে তাওহীদের ডাক থেকে ফিরে থাকে।

আজও যদি বিদআতীদেরকে বুঝানো হয় যে, এই বিদআতগুলোর দ্বীনে কোন ভিত্তি নেই, তবে তারা এই উত্তরই দেয় যে, এই প্রথাগুলো তো আমাদের পূর্বপুরুষদের নিকট থেকেই চলে আসছে। অথচ হতে পারে যে, পূর্বপুরুষরাও দ্বীনী ব্যাপারে অজ্ঞ এবং হিদায়াত থেকে বঞ্চিত ছিল। কাজেই শরীয়তের দলীলের মোকাবেলায় বাপ-দাদার (অন্ধ) অনুকরণ বা ইমাম ও আলেমদের অনুসরণ করা ভুল। মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে (ভ্রষ্টতার) এই কর্দম থেকে বের করুন! (আমীন)

ইসহাক ইবনু রাহওয়াইহ (রহঃ) … ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ আমার (সাহাবীগণের) যুগ। এরপর তৎ-সংলগ্ন যুগ (তাবেয়ীদের যুগ)। এরপর তৎ-সংলগ্ন যুগ (তাবে-তাবেয়ীদের যুগ)। ইমরান (রাঃ) বলেন, তিনি তাঁর যুগের পর দু’যুগ অথবা তিন যুগ বলেছেন তা আমার স্মরণ নেই। তারপর (তোমাদের যুগের পর) এমন লোকের আগমন ঘটবে যারা সাক্ষ্য প্রদানে আগ্রহী হবে অথচ তাদের নিকট সাক্ষ্য চাওয়া হবে না। বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে তাদেরকে কেউ বিশ্বাস করবে না। তারা মানত করবে কিন্তু পূরণ করবে না। পার্থিব ভোগ বিলাসের কারণে তাদের মাঝে চর্বিযুক্ত স্থুলদেহ প্রকাশ পাবে। হাদিসের মানঃ সহিহ,সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)

২:১৭১ وَ مَثَلُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا کَمَثَلِ الَّذِیۡ یَنۡعِقُ بِمَا لَا یَسۡمَعُ اِلَّا دُعَآءً وَّ نِدَآءً ؕ صُمٌّۢ بُکۡمٌ عُمۡیٌ فَهُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ

আর যারা কুফরী করেছে তাদের উদাহরণ তার মত যে, এমন কিছুকে ডাকছে যে হাঁক-ডাক ছাড়া আর কিছুই শুনে না। তারা বধির, বোবা, অন্ধ, কাজেই তারা বুঝে না।

যে কাফেররা পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুকরণে নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধিকে অকেজো করে রেখেছে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই পশুদের মত, যাদেরকে রাখাল ডাকে ও আওয়াজ দেয় এবং তারা সেই ডাক ও আওয়াজ তো শোনে, কিন্তু বুঝে না যে, তাদেরকে কেন ডাকা ও আওয়াজ দেওয়া হচ্ছে? অনুরূপ এই অন্ধ অনুকরণকারীরা বধির, তাই সত্যের ডাক শোনে না। বোবা, তাই হক কথা তাদের জবান থেকে বের হয় না। অন্ধ, তাই সত্য দেখতে তারা অক্ষম এবং জ্ঞানশূন্য, তাই সত্যের দাওয়াত এবং তাওহীদ ও সুন্নতকে তারা বুঝতে পারে না। এখানে دعاء (ডাক) অর্থ নিকটের শব্দ এবং نداء (হাঁক) অর্থ দূরের শব্দ।

এ উপমাটির দুটি দিক রয়েছে। (এক) তাদের অবস্থা সেই নিবোধ প্রাণীদের মত, যারা এক-একটি পালে বিভক্ত হয়ে নিজেদের রাখালদের পিছনে চলতে থাকে এবং না জেনে-বুঝেই তাদের হাক-ডাকের উপর চলতে-ফিরতে থাকে। (দুই) এর দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে, কাফের-মুশরিকদেরকে আহবান করার ও তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত প্রচারের সময় মনে হতে থাকে যেন নির্বোধ জন্তু-জানোয়ারদেরকে আহবান জানানো হচ্ছে, তারা কেবল আওয়াজ শুনতে পারে কিন্তু কি বলা হচ্ছে, তা কিছুই বুঝতে পারে না। [মুয়াস্‌সার]

২:১৭২ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُلُوۡا مِنۡ طَیِّبٰتِ مَا رَزَقۡنٰکُمۡ وَ اشۡکُرُوۡا لِلّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ اِیَّاهُ تَعۡبُدُوۡنَ

হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে আমরা যেসব পবিত্র বস্তু দিয়েছি তা থেকে খাও(১) এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা শুধু তারই ইবাদাত কর।

আলোচ্য আয়াতে যেমন হারাম খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে হালাল ও পবিত্র বস্তু খেতে এবং তা খেয়ে শুকরিয়া আদায় করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তার সমস্ত নবী-রাসূলগণের প্রতি হিদায়াত করেছেন যে, (يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا) অর্থাৎ “হে রাসূলগন! পবিত্র খাদ্য গ্রহন করুন এবং নেক আমল করুন”। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নেক আমলের ব্যাপারে হালাল খাদ্যের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অনুরূপ হালাল খাদ্য গ্রহণে দোআ কবুল হওয়ার আশা এবং হারাম খাদ্যের প্রতিক্রিয়ায় তা কবুল না হওয়ার আশংকাই থাকে বেশী। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “হে মানুষ! নিশ্চয় আল্লাহ্ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত কোন কিছু কবুল করেন না।

তিনি মুমিনগণকে সেটার নির্দেশ দিয়েছেন যেটার নির্দেশ রাসূলগণকে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র থেকে খাও এবং সৎকাজ কর, নিশ্চয় আমি তোমরা যা কর সে ব্যাপারে সবিশেষ অবগত।” [সূরা আল-মুমিনুন: ৫১)

فَکُلُوۡا مِمَّا رَزَقَکُمُ اللّٰهُ حَلٰلًا طَیِّبًا ۪ وَّ اشۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ اِیَّاهُ تَعۡبُدُوۡنَ

অতএব আল্লাহ তোমাদেরকে হালাল ও পবিত্র যে রিযিক দিয়েছেন তা থেকে তোমরা খাও এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, যদি তোমরা শুধু তারই ইবাদাত করে থাক। সূরা নহলঃ১১৪

এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্যনীয় তা হলো, মহান আল্লাহ যে নি’আমত বা রিযক দিয়েছেন যা পবিত্র ও খেতে অনুমতি দিয়েছেন, সেই অনুগ্রহের কথা মনে করে কৃতজ্ঞ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন, এর সাথে বলা হয়েছে যদি মহান রবের এককভাবে ইবাদাত করে থাকে। অর্থাৎ মানুষ যে নিজেকে রবের দাসত্বে পুরুপুরি নিয়োজিত করতে পেরেছে সেই ব্যক্তি কিন্তু এই পবিত্র জীবন বা পবিত্র খাবার বা হালাল জীবনে থাকতে সক্ষম হয়। আর যে ব্যক্তি নিজকে রবের দাসত্বে আনতে পারে নি, সে হয়তো ঈমান আনার ঘোষনা দিয়ে কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে(সালাত/সাওম,হজ্জ) নিজেকে নিয়োগ রেখেছে তবে অপবিত্র/হারাম জীবন উপভোগ করতে দ্বিধা করে না। ফলে দেখা যায় অনেক ব্যক্তিই সালাত পড়ছে ঠিকই কিন্তু সুদ বা হারাম ব্যবসা বা হারাম খাবার খেতে সহজেই লিপ্ত হয়।  নিজের মনের চাওয়া পাওয়া, ভালো লাগা বা দুনিয়ার ভোগ বিলাসে গা হেলিয়ে সেই চলতে পারে যে নিজেকে রবের দাসত্ব(ইবাদাতে) নিয়োগ করতে চায় না । এই আয়াতে এই বিষয়টি বুঝা যায়।

আমি লুকমানকে দান করেছিলাম সূক্ষ্ণজ্ঞান৷ যাতে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় ৷ যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তার কৃতজ্ঞতা হবে তার নিজেরই জন্য লাভজনক৷ আর যে ব্যক্তি কুফরী করবে, সে ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ অমুখাপেক্ষী এবং নিজে নিজেই প্রশংসিত। সূরা লুকমানঃ১২

মহান আল্লাহ বলেছেন,

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ

“তোমরা আমাকে স্মরণ কর; আমিও তোমাদের স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর কৃতঘ্ন হয়ো না।” (সূরা বাকারা ১৫২ আয়াত)

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘অবশ্যই আমি তাকে পথপ্রদর্শন করেছি, এখন সে হবে শোকরকারী অথবা অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা দাহর : ৩)।

আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘আর যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার নিজেরই কল্যাণের জন্য। আর যে কেউ অকৃতজ্ঞ হবে, সে জেনে রাখুক যে, আমার রব অভাবমুক্ত, মহানুভব।’ (সুরা নামল : ৪০)

তিনি অন্যত্র বলেন,لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ

“তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দান করব, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর।” (সূরা ইব্রাহীম ৭ আয়াত)

আবূ মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন কোন বান্দার সন্তান মারা যায়, তখন মহান আল্লাহ স্বীয় ফিরিশতাদেরকে বলেন, ’তোমরা আমার বান্দার সন্তানের জীবন হনন করেছ কি?’ তাঁরা বলেন, ’হ্যাঁ।’ তিনি বলেন, ’তোমরা তার হৃদয়ের ফলকে হনন করেছ?’ তাঁরা বলেন, ’হ্যাঁ।’ তিনি বলেন, ’সে সময় আমার বান্দা কি বলেছে?’ তারা বলে, ’সে আপনার হামদ (প্রশংসা) করেছে ও ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রা-জিঊন (অর্থাৎ আমরা তোমার এবং তোমার কাছেই অবশ্যই ফিরে যাব) পাঠ করেছে।’ মহান আল্লাহ বলেন, ’আমার (সন্তানহারা) বান্দার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি গৃহ নির্মাণ কর, আর তার নাম রাখ, ’বায়তুল হামদ’ (প্রশংসা-ভবন)।” (তিরমিযী হাসান) তিরমিযী ১০২১

আর রাত জেগে জেগে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে নফল নামায পড়তে গিয়ে কখনো তাঁর পা ফুলে যেত। হযরত আয়েশা রা. একদিন তাই জানতে চাইলেন- আপনি এত কষ্ট করেন কেন, আল্লাহ কি আপনার আগে-পরের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেননি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন,

أَفَلاَ أُحِبُّ أَنْ أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا

আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হতে চাই না? -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৭

এ কৃতজ্ঞতা মুমিনের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। পরকালীন সমৃদ্ধির পাশাপাশি দুনিয়ার জীবনেও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আরও অধিক পরিমাণ নিআমত লাভের মাধ্যম এ কৃতজ্ঞতা। আর আখেরাতের অসীম পুরস্কারের ঘোষণা তো আছেই। উদাহরণস্বরূপ একটি হাদীস

হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

الطَّاعِمُ الشَّاكِرُ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ الصَّائِمِ الصَّابِرِ খেয়ে যে আল্লাহর শোকর আদায় করে সে ধৈর্যশীল রোযাদার ব্যক্তির সমান পুরস্কার লাভ করবে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৬৫

কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় : আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিভিন্ন উপায় আছে। যেমন

১.   কলব বা অন্তরের মাধ্যমে অর্থাৎ নিয়ামতদাতার নিয়ামত পেয়ে অন্তরে শুকরিয়া আদায় করা। এর পদ্ধতি হলো, আল্লাহকে ভয় করা, তাঁর অবাধ্যতার মানসিকতা না থাকা এবং তাকওয়া অবলম্বন করা।

২.   ভাষার মাধ্যমে। অর্থাৎ মুখে নিয়ামতের শোকরিয়া প্রকাশ করা, গণনা করা ইত্যাদি। বুজুর্গ ব্যক্তিরা নিজের জবান দিয়ে রাতের পর রাত আল্লাহর প্রশংসা করেছেন।

৩.   অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে শুকরিয়া হলো সালাত আদায় করা ও বেশি বেশি নেক আমল করা।

আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৪৪)।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে না, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাও আদায় করে না।’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ)।

পাঁচটি বিষয়ের উপর আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায়ের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।

সে গুলো হলঃ

এক. নেয়ামত দাতা আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত হওয়া।

দুই. নেয়ামত দাতা আল্লাহকে মহব্বত করা।

তিন. নেয়ামতকে মনে প্রাণে গ্রহণ ও স্বীকার করা।

চার. মুখ দ্বারা নেয়ামত দাতা আল্লাহর প্রশংসা করা।

পাঁচ. নেয়ামতকে নেয়ামত দানকারী আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে ব্যবহার না করা বরং তাঁর সন্তুষ্টির পথে তা ব্যয় করা।(মাদারেজুস সালেকীন)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন ব্যক্তির উল্লেখ করলেন, যে লম্বা সফর করেছে, ধুলি-মলিন অবস্থায় দু’হাত আকাশের দিকে তুলে ধরে বলতে থাকে হে রব! হে রব! অথচ তার খাবার হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোষাক হারাম, সে খেয়েছেও হারাম। সুতরাং তার দোআ কিভাবে কবুল হতে পারে?” [মুসলিম: ১০১৫]

আয়াতে ঈমানদারদেরকে সেই সমস্ত পবিত্র জিনিস খাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা আল্লাহ হালাল করেছেন। আর খেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার তাকীদ করা হয়েছে।

প্রথমতঃ এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ কর্তৃক হালালকৃত জিনিসগুলোই পাক-পবিত্র এবং তাঁর হারামকৃত জিনিসগুলো অপবিত্র; যদিও তা মানুষের কাছে প্রিয় ও তৃপ্তিকর। (যেমন, ইউরোপবাসীদের নিকট শুয়োরের গোশত খুবই প্রিয়)।

দ্বিতীয়তঃ মূর্তিদের নামে উৎসর্গীকৃত জানোয়ার ও জিনিষাদি মুশরিকরা যে নিজেদের উপর হারাম করে নিত (যার বিস্তারিত আলোচনা সূরা আনআম ১৩৬-১৪০ আয়াতে আসবে), তাদের এ কাজ ভুল ছিল, এইভাবে কোন হালাল জিনিস হারাম হয় না। তোমরাও তাদের মত (হালালকে) হারাম করো না। (হারাম কেবল সেই জিনিসগুলো যার বর্ণনা পরের আয়াতে রয়েছে।)

তৃতীয়তঃ যদি তোমরা কেবল আল্লাহরই ইবাদত সম্পাদনকারী হও, তাহলে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে যত্নবান হও।

২:১৭৩ اِنَّمَا حَرَّمَ عَلَیۡکُمُ الۡمَیۡتَۃَ وَ الدَّمَ وَ لَحۡمَ الۡخِنۡزِیۡرِ وَ مَاۤ اُهِلَّ بِهٖ لِغَیۡرِ اللّٰهِ ۚ فَمَنِ اضۡطُرَّ غَیۡرَ بَاغٍ وَّ لَا عَادٍ فَلَاۤ اِثۡمَ عَلَیۡهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

তিনি আল্লাহ তো কেবল তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশত এবং যার উপর আল্লাহর নাম ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু যে নিরূপায় অথচ নাফরমান এবং সীমালংঘনকারী নয় তার কোন পাপ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

এই আয়াতে চারটি হারামকৃত জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এখানে إنما শব্দ দ্বারা সীমিতকরণে এই সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে, হারাম কেবল এই চারটি জিনিসই। অথচ এ ছাড়াও আরো অনেক জিনিস হারাম আছে। তাই প্রথমতঃ এটা বুঝে নেওয়া উচিত যে, এই সীমিতকরণ বিশেষ কথা প্রসঙ্গে এসেছে। অর্থাৎ, মুশরিকরা হালাল জানোয়ারকেও হারাম করে নিত। তাই মহান আল্লাহ বললেন, হারাম শুধুমাত্র এইগুলো। কাজেই এই সীমিতকরণ তুলনামূলক। অর্থাৎ, এ ছাড়াও আরো হারাম জিনিস আছে যা এখানে উল্লিখিত হয়নি।

যেসব প্রাণী হালাল করার জন্য শরীআতের বিধান অনুযায়ী যবেহ্ করা জরুরী, সেসব প্রাণী যদি যবেহ ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে যেমন, আঘাত প্রাপ্ত হয়ে, অসুস্থ হয়ে কিংবা দম বন্ধ হয়ে মারা যায়, তবে সেগুলোকে মৃত বলে গণ্য করা হবে এবং সেগুলোর গোশত খাওয়া হারাম হবে। তবে অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,

তোমাদের জন্য সামুদ্রিক শিকার হালাল করা হল। [সূরা আল-মায়িদাহঃ ৯৬] এ আয়াতের মর্মানুযায়ী সামুদ্রিক জীব-জন্তুর বেলায় যবেহ করার শর্ত আরোপিত হয়নি। ফলে এগুলো যবেহ ছাড়াই খাওয়া হালাল। অনুরূপ এক হাদীসে মাছ এবং টিড্ডি নামক পতঙ্গকে মৃত প্রাণীর তালিকা থেকে বাদ দিয়ে এ দুটির মৃতকেও হালাল করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আমাদের জন্য দুটি মৃত হালাল – মাছ এবং টিড্ডি (এক জাতীয় ফড়িং)। [বাগভীঃ শরহুস-সুন্নাহঃ ২৮০৩, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ৩২১৮]

সুতরাং বোঝা গেল যে, জীব-জন্তুর মধ্যে মাছ এবং ফড়িং মৃতের পর্যায়ভুক্ত হবে না, এ দুটি যবেহ না করেও খাওয়া যাবে। অনুরূপ যেসব জীব-জন্তু ধরে যবেহ্ করা সম্ভব নয়, সেগুলোকে বিসমিল্লাহ বলে তীর কিংবা অন্য কোন ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে যদি মারা হয়, তবে সেগুলোও হালাল হবে, এমতাবস্থায়ও শুধু আঘাত দিয়ে মারলে চলবে না, কোন ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে আঘাত করা শর্ত। আজকাল একরকম চোখা গুলী ব্যবহার হয়, এ ধরণের গুলী সম্পর্কে কেউ কেউ মনে করতে পারে যে, এসব ধারালো গুলীর আঘাতে মৃত জন্তুর হুকুম তীরের আঘাতে মৃতের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু আলেমগণের সম্মিলিত অভিমত অনুযায়ী বন্দুকের গুলী চোখা এবং ধারালো হলেও তা তীরের পর্যায়ভুক্ত হয় না। কেননা, তীরের আঘাত ছুরির আঘাতের ন্যায়, অপরদিকে বন্দুকের গুলী চোখা হলেও গায়ে বিদ্ধ হয়ে গায়ে বিস্ফোরণ ও দাহিকা শক্তির প্রভাবে জন্তুর মৃত্যু ঘটায়। সুতরাং এরূপ গুলী দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত জানোয়ার যবেহ্ করার আগে মারা গেলে তা খাওয়া হালাল হবে না। এক্ষেত্রে গুলী দ্বারা শিকার করা হলে তা আবার যবেহ্ করতে হবে।

এখানে আরও জানা আবশ্যক যে, আয়াতে তোমাদের জন্য মৃত হারাম বলতে মৃত জানোয়ারের গোশত খাওয়া যেমন হারাম, তেমনি এগুলোর ক্রয়-বিক্রয়ও হারাম হিসেবে বিবেচিত হবে। যাবতীয় অপবিত্র বস্তু সম্পর্কে সেই একই বিধান প্রযোজ্য। অর্থাৎ মৃত জানোয়ারের গোশ্‌ত ব্যবহার যেমন হারাম, তেমনি এগুলো ক্রয়-বিক্রয় কিংবা অন্য কোন উপায়ে এগুলো থেকে যেকোনভাবে লাভবান হওয়াও হারাম। এমনকি মৃত জীব-জন্তুর গোশত নিজ হাতে কোন গৃহপালিত জন্তুকে খাওয়ানোও জায়েয নয়।

তাছাড়া আয়াতে ‘মৃত’ শব্দটির অন্য কোন বিশেষণ ছাড়া সাধারণভাবে ব্যবহার করাতে প্রতীয়মান হয় যে, হারামের হুকুমও ব্যাপক এবং তন্মধ্যে মৃত জন্তুর সমুদয় অংশই শামিল। কিন্তু অন্য এক আয়াতে (عَلَىٰ طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ) [সূরা আল-আন’আম: ১৪৫] শব্দ দ্বারা এ বিষয়টিও ব্যাখ্যা করে দেয়া হয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, মৃত জন্তুর শুধু সে অংশই হারাম যেটুকু খাওয়ার যোগ্য। সুতরাং মৃত জন্তুর হাড়, পশম প্রভৃতি যেসব অংশ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় না, সেগুলোর ব্যবহার করা হারাম নয়; সম্পূর্ণ জায়েয। কেননা, কুরআনের অন্য এক আয়াতে আছে, (وَمِنْ أَصْوَافِهَا وَأَوْبَارِهَا وَأَشْعَارِهَا أَثَاثًا وَمَتَاعًا إِلَىٰ حِينٍ) [সূরা আন-নাহলঃ ৮০] এতে হালাল জানোয়ারসমূহের পশম প্রভৃতির দ্বারা ফায়দা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এখানে যবেহ্ করার শর্ত আরোপ করা হয়নি। চামড়ার মধ্যে যেহেতু রক্ত প্রভৃতি নাপাকীর সংমিশ্রণ থাকে, সেজন্য মৃত জানোয়ারের চামড়া শুকিয়ে পাকা না করা পর্যন্ত নাপাক এবং ব্যবহার হারাম। কিন্তু পাকা করে নেয়ার পর ব্যবহার করা সম্পূর্ণ জায়েয। সহীহ হাদীসে এ সম্পর্কিত আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। অনুরূপভাবে মৃত জানোয়ারের চর্বি এবং তদ্বারা তৈরী যাবতীয় সামগ্রীই হারাম। এসবের ব্যবহার কোন অবস্থাতেই জায়েয নয়। এমনকি এসবের ক্রয়-বিক্রয়ও হারাম। [মাআরিফুল কুরআন]

(২) আয়াতে যেসব বস্তু-সামগ্রীকে হারাম করা হয়েছে, তার দ্বিতীয়টি হচ্ছে রক্ত। এ আয়াতে শুধু রক্ত উল্লেখিত হলেও অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, (أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا) [সূরা আল-আন’আম: ১৪৫] অর্থাৎ ‘প্রবাহমান রক্ত’ উল্লেখিত রয়েছে। রক্তের সাথে প্রবাহমান শব্দ সংযুক্ত করার ফলে শুধু সে রক্তকেই হারাম করা হয়েছে, যা যবেহ করলে বা কেটে গেলে প্রবাহিত হয়। এ কারণেই কলিজা এবং এরূপ জমাট বাঁধা রক্তে গঠিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফেকাহবিদগণের সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী পাক ও হালাল। আর যেহেতু শুধুমাত্র প্রবাহমান রক্তই হারাম ও নাপাক, কাজেই যবেহ্ করা জন্তুর গোশতের সাথে রক্তের যে অংশ জমাট বেঁধে থেকে যায়, সেটুকু হালাল ও পাক৷ ফেকাহবিদ সাহাবী ও তাবেয়ীসহ সমগ্র আলেম সমাজ এ ব্যাপারে একমত। এখানে আরও একটি বিষয় জানা আবশ্যক যে, রক্ত খাওয়া যেমন হারাম, তেমনি অন্য কোন উপায়ে তা ব্যবহার করাও হারাম। অন্যান্য নাপাক রক্তের ন্যায় রক্তের ক্রয়-বিক্রয় এবং তা দ্বারা অর্জিত লাভালাভও হারাম।

(৩) আলোচ্য আয়াতে তৃতীয় যে বস্তুটি হারাম করা হয়েছে, সেটি হলো শূকরের গোশত। এখানে শূকরের সাথে লাহম’ বা গোশ্বত শব্দসংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে ইমাম কুরতুবী বলেন, এর দ্বারা শুধু গোশত হারাম এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। বরং শূকরের সমগ্র অংশ অর্থাৎ হাড়, গোশত, চামড়া, চর্বি, রগ, পশম প্রভৃতি সর্বসম্মতিক্রমেই হারাম। তবে লাহম তথা গোশত যোগ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, শূকর অন্যান্য হারাম জন্তুর ন্যায় নয়, তাই এটি যবেহ্ করলেও পাক হয় না। কেননা, গোশত খাওয়া হারাম এমন অনেক জন্তু রয়েছে যাদের যবেহ করার পর সেগুলোর হাড়, চামড়া প্রভৃতি পাক হতে পারে। কিন্তু যবেহ্ করার পরও শূকরের গোশ্‌ত হারাম তো বটেই, নাপাকও থেকে যায়। কেননা, এটি একাধারে যেমনি হারাম তেমনি ‘নাজাসে আইন’ বা অপবিত্র বস্তু। [মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষেপিত]

(৪) আয়াতে উল্লেখিত চতুর্থ হারাম বস্তু হচ্ছে সেসব জীব-জন্তু, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহ বা উৎসর্গ করা হয়। সাধারণত এর তিনটি উপায় প্রচলিত রয়েছে।

প্রথমতঃ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যা উৎসর্গ করা হয় এবং যবেহ্ করার সময়ও সে নাম নিয়েই যবেহ করা হয়, যে নামে তা উৎসর্গিত হয়। এমতাবস্থায় যবেহকৃত জন্তু সমস্ত মত-পথের আলেম ও ফেকাহবিদগণের দৃষ্টিতেই হারাম ও নাপাক। এর কোন অংশের দ্বারাই ফায়দা গ্রহণ জায়েয হবে না। (وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ) আয়াতে যে অবস্থার কথা বোঝানো হয়েছে এ অবস্থা এর সরাসরি নমুনা, যে ব্যাপারে কারো কোন মতভেদ নেই

দ্বিতীয় অবস্থা হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর সন্তুষ্টি বা নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যা যবেহ্ করা হয়, তবে যবেহ্ করার সময় তা আল্লাহর নাম নিয়েই যবেহ্ করা হয়। যেমন অনেক অজ্ঞ মুসলিম পীর, কবরবাসী বা জীনের সন্তুষ্টি অর্জনের মানসে গরু, ছাগল, মুরগী ইত্যাদি মানত করে তা যবেহ করে থাকে। কিন্তু যবেহ্ করার সময় আল্লাহর নাম নিয়েই তা যবেহ করা হয়। এ সুরতটিও ফকীহগণের সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী হারাম এবং যবেহকৃত জন্তু মৃতের শামিল। দুররে মুখতার কিতাবুয-যাবায়েহ অধ্যায়ে বলা হয়েছেঃ যদি কোন আমীরের আগমন উপলক্ষে তারই সম্মানার্থে কোন পশু যবেহ্ করা হয়, তবে যবেহকৃত সে পশুটি হারাম হয়ে যাবে। কেননা, এটাও তেমনি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নামে যা যবেহ্ করা হয় – এ আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত; যদিও যবেহ্ করার সময় আল্লাহর নাম নিয়েই তা যবেহ্ করা হয়। আল্লামা শামীও এ অভিমত সমর্থন করেছেন।

তৃতীয় সুরত হচ্ছে পশুর কান কেটে অথবা শরীরের অন্য কোথাও কোন চিহ্ন অঙ্কিত করে কোন দেব-দেবী বা পীর-ফকীরের নামে ছেড়ে দেয়া হয়। সেগুলো দ্বারা কোন কাজ নেয়া হয় না, যবেহ করাও উদ্দেশ্য থাকে না। বরং যবেহ্ করাকে হারাম মনে করে। এ শ্রেণীর পশু আলোচ্য দু’আয়াতের কোনটিরই আওতায় পড়ে না। এ শ্রেণীর পশুকে কুরআনের ভাষায় ‘বহীরা’ বা ‘সায়েবা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধরনের পশু সম্পর্কে হুকুম হচ্ছে যে, এ ধরনের কাজ অর্থাৎ কারো নামে কোন পশু প্রভৃতি জীবন্ত উৎসর্গ করে ছেড়ে দেয়া কুরআনের সরাসরি নির্দেশ অনুযায়ী হারাম। যেমন বলা হয়েছেঃ (مَا جَعَلَ اللَّهُ مِنْ بَحِيرَةٍ وَلَا سَائِبَةٍ) “আল্লাহ তা’আলা বহীরা ও সায়েবা সম্পর্কে কোন বিধান দেননি।” (সূরা আল-মায়িদাহ ১০৩]

তবে এ ধরনের হারাম আমল কিংবা সংশ্লিষ্ট পশুটিকে হারাম মনে করার ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণেই সেটি হারাম হয়ে যাবে না। বরং হারাম মনে করাতেই তাদের একটা বাতিল মতবাদকে সমর্থন এবং শক্তি প্রদান করা হয়। তাই এরূপ উৎসর্গকৃত পশু অন্যান্য সাধারণ পশুর মতই হালাল। শরীআতের বিধান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট পশুর উপর তার মালিকের মালিকানা বিনষ্ট হয় না, যদিও সে ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে এরূপ মনে করে যে, এটি আমার মালিকানা থেকে বের হয়ে যে নামে উৎসর্গ করা হয়েছে তারই মালিকানায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু শরীআতের বিধানমতে যেহেতু তার সে উৎসর্গীকরণই বাতিল, সুতরাং সে পশুর উপর তারই পূর্ণ মালিকানা কায়েম থাকে। [মা’আরিফুল কুরআন]

(৫) এ ক্ষেত্রে কুরআনুল কারীম মরণাপন্ন অবস্থায়ও হারাম বস্তু খাওয়াকে হালাল ও বৈধ বলেনি; বলেছে, “তাতে তার কোন পাপ নেই”। এর মর্ম এই যে, এসব বস্তু তখনো যথারীতি হারামই রয়ে গেছে, কিন্তু যে লোক খাচ্ছে তার অনোন্যপায় অবস্থার প্রেক্ষিতে হারাম খাদ্য গ্রহণের পাপ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে অনোন্যপায় হওয়ার কারণ উল্লেখ করা হয়নি। অন্য আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে, “তবে কেউ পাপের দিকে না ঝুঁকে ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হলে তখন আল্লাহ নিশ্চয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-মায়েদাহ: ৩] অর্থাৎ ক্ষুধার কারণেই শুধু হারাম বস্তু গ্রহণ করা যেতে পারে।

২:১৭৪ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡتُمُوۡنَ مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ یَشۡتَرُوۡنَ بِهٖ ثَمَنًا قَلِیۡلًا ۙ اُولٰٓئِکَ مَا یَاۡکُلُوۡنَ فِیۡ بُطُوۡنِهِمۡ اِلَّا النَّارَ وَ لَا یُکَلِّمُهُمُ اللّٰهُ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ لَا یُزَکِّیۡهِمۡ ۚۖ وَ لَهُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ

নিশ্চয় যারা গোপন করে আল্লাহ কিতাব হতে যা নাযিল করেছেন তা এবং এর বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই খায় না। আর কেয়ামতের দিন আল্লাহ্‌ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

এর অর্থ হচ্ছে,সাধারণ লোকদের মধ্যে যত প্রকার বিভ্রান্তিরকর কুসংস্কার প্রচলিত আছে এবং বাতিল রীতিনীতি ও অর্থহীন বিধি-নিষেধের যেসব নতুন নতুন শরীয়াত তৈরী হয়ে গেছে- এসবগুলোর জন্য দায়ী হচ্ছে সেই আলেম সমাজ,যাদের কাছে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান ছিল কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছায়নি৷তারপর অজ্ঞতার কারণে লোকদের মধ্যে যখন ভুল পদ্ধতির প্রচলন হতে থাকে তখনো ঐ জালেম গোষ্ঠী মুখ বন্ধ করে বসে থেকেছে৷ বরং আল্লাহর কিতাবের বিধানের ওপর আবরণ পড়ে থাকাটাই নিজেদের জন্য লাভজনক বলে তাদের অনেকেই মনে করেছে৷

যেসব ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ মিথ্যা দাবী করে এবং জনগণের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট প্রচারণা চালায় এখানে আসলে তাদের সমস্ত দাবী ও প্রচারণার প্রতিবাদ করা হয়েছে৷ তারা সম্ভাব্য সকল উপায়ে নিজেদের পূত-পবিত্র সত্তার অধিকারী হবার এবং যে ব্যক্তি তাদের পেছনে চলবে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তার সুপারিশ করে তার গোনাহ খাতা মাফ করিয়ে নেয়ার ধারণা জনগনের মনে বদ্ধমূল করার চেষ্টা করে এবং জনগণও তাদের একথায় বিশ্বাস করে৷ জবাবে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন,আমি তাদের সাথে কথাই বলবো না এবং তাদের পবিত্রতার ঘোষণাও দেবো না৷

আর আমি যা নাযিল করেছি তোমরা তাতে ঈমান আন। এটা তোমাদের কাছে যা আছে তার সত্যতা প্রমাণকারী। আর তোমরাই এর প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করো না। আর তোমরা শুধু আমারই তাকওয়া অবলম্বন কর। বাকারাঃ৪১

আমার আয়াতের বিনিময়ে স্বল্প মূল্য গ্রহণ করো না” এর অর্থ এই নয় যে, বেশী মূল্য পেলে ইলাহী বিধানের বিনিময়ে তা গ্রহণ করো। বরং অর্থ হল, ইলাহী বিধানসমূহের মোকাবেলায় পার্থিব সবার্থকে কোন প্রকার গুরুত্ব দিও না। আল্লাহর বিধানসমূহের মূল্য এত বেশী যে, দুনিয়ার বিষয়-সম্পদ এর মোকাবেলায় খুবই তুচ্ছ; কিছুই না। উক্ত আয়াতে বানী-ইসরাঈলকে সম্বোধন করা হলেও এই নির্দেশ কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের জন্য। যে ব্যক্তি সত্যকে বাতিল, বাতিলকে প্রতিষ্ঠা অথবা জ্ঞানকে গোপন করার কাজে জড়িত হবে এবং কেবল পার্থিব স্বার্থের খাতিরে সত্য-প্রতিষ্ঠা করা ত্যাগ করবে, সেও এই ধমকের অন্তর্ভুক্ত। (ফাতহুল ক্বাদীর)

ইরশাদ হয়েছে-

আর আমি যে কিতাব পাঠিয়েছি তার ওপর ঈমান আন ৷ তোমাদের কাছে আগে থেকেই যে কিতাব ছিল এটি তার সত্যতা সমর্থনকারী ৷ কাজেই সবার আগে তোমরাই এর অস্বীকারকারী হয়ো না৷ সামান্য দামে আমার আয়াত বিক্রি করো না ৷বাকারাঃ৪১

আমার গযব থেকে আত্মরক্ষা করো ৷   ‘সামান্য দাম’ বলে দুনিয়ার স্বার্থ ও লাভের কথা বুঝানো হয়েছে ৷ এর বিনিময়ে মানুষ আল্লাহর বিধান প্রত্যাখ্যান করছিল ৷ সত্যকে বিক্রি করে তার বিনিময়ে সারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ হাসিল করলেও তা আসলে সামান্য দামই গণ্য হবে ৷ কারণ সত্য নিসন্দেহে তার চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান ৷

২:১৭৫ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ اشۡتَرَوُا الضَّلٰلَۃَ بِالۡهُدٰی وَ الۡعَذَابَ بِالۡمَغۡفِرَۃِ ۚ فَمَاۤ اَصۡبَرَهُمۡ عَلَی النَّارِ ﴿

তারাই হিদায়াতের বিনিময়ে ভ্রষ্টতা এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে; সুতরাং আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল!

২:১৭৬ ذٰلِکَ بِاَنَّ اللّٰهَ نَزَّلَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ ؕ وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ اخۡتَلَفُوۡا فِی الۡکِتٰبِ لَفِیۡ شِقَاقٍۭ بَعِیۡدٍ

সেটা এ জন্যই যে, আল্লাহ সত্যসহ কিতাব সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করেছে অবশ্যই তারা সুদূর বিবাদে লিপ্ত।

মহান আল্লাহ তাদের সাথে কেনো কথা বলবেন না ও পবিত্র করবেন না, সেটা বলেছেন যে এরা ভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে। এতোই বেপড়োয়া হয়েছে যে আল্লাহ বলেছেন জাহান্নামের ব্যপারে এরা এতো সবর করছে।

মুনাফিকরা দুনিয়ার লালসায় হেদায়েতের বিনিময়ে ভ্রষ্টতাকে গ্রহণ করে। তারা হেদায়েতের ওপর ভ্রষ্টতাকে অগ্রাধিকার দেয়। মানুষ যে জিনিসকে ভালোবাসে ও পছন্দ করে, সে জিনিসই ক্রয় করে। মুনাফিকরা ঈমান বিক্রি করে নিফাককে ক্রয় করে অর্থাৎ ঈমানের ওপর নিফাককে প্রাধান্য দেয়।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা এমন লোক, যারা হেদায়েতের পরিবর্তে ভ্রষ্টতাকে ক্রয় করে নিয়েছে। সুতরাং তাদের এ ব্যবসায় লাভজনক হয়নি; আর তারা হেদায়েতও পায়নি’ (সূরা বাকারা : ১৬)।

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন,