সূরা বাকারাঃ ১১তম রুকু (৮৭–৯৬)আয়াত

 সূরা বাকারাঃ ১১তম রুকু (৮৭–৯৬)আয়াত

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:৮৭ وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا مُوۡسَی الۡکِتٰبَ وَ قَفَّیۡنَا مِنۡۢ بَعۡدِهٖ بِالرُّسُلِ ۫ وَ اٰتَیۡنَا عِیۡسَی ابۡنَ مَرۡیَمَ الۡبَیِّنٰتِ وَ اَیَّدۡنٰهُ بِرُوۡحِ الۡقُدُسِ ؕ اَفَکُلَّمَا جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌۢ بِمَا لَا تَهۡوٰۤی اَنۡفُسُکُمُ اسۡتَکۡبَرۡتُمۡ ۚ فَفَرِیۡقًا کَذَّبۡتُمۡ ۫ وَ فَرِیۡقًا تَقۡتُلُوۡنَ

অবশ্যই আমরা মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রাসূলগণকে পাঠিয়েছি এবং আমরা মারইয়াম-পুত্র ‘ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছি এবং রূহুল কুদুস” দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি। তবে কি যখনি কোন রাসূল তোমাদের কাছে এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপূত নয় তখনি তোমরা অহংকার করেছ? অতঃপর (নবীদের) একদলের উপর মিথ্যারোপ করেছ এবং একদলকে করেছ হত্যা?

‘পবিত্র রূহ’ বলতে অহী-জ্ঞান বুঝানো হয়েছে ৷ অহী নিয়ে দুনিয়ায় আগমনকারী জিব্রীল আ কেও বুঝানো হয়েছে ৷ আবার হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পাক রূহকেও বুঝানো হয়েছে ৷ আল্লাহ নিজেই তাঁকে পবিত্র গুণাবলীতে ভূষিত করেছিলেন ৷ ‘উজ্জ্বল নিশানী’ অর্থ সুস্পষ্ট আলামত ও চিহ্ন , যা দেখে প্রত্যেকটি সত্যপ্রিয় ও সত্যানুসন্ধিৎসু ব্যক্তি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর নবী বলে চিনতে পারে

এ আয়াতে স্পষ্ট প্রমাণ’ কি তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়নি। তবে অন্য জায়গায় সেটা বলা হয়েছে, যেমন,

“আর তাকে বনী ইসরাঈলের জন্য রাসূলরুপে (তিনি বলবেন) নিশ্চয় আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি যে, অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য কাদামাটি দ্বারা একটি পাখিসদৃশ আকৃতি গঠন করব; তারপর তাতে আমি ফুঁ দেব; ফলে আল্লাহর হুকুমে সেটা পাখি হয়ে যাবে। আর আমি আল্লাহর হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থকে নিরাময় করব এবং মৃতকে জীবিত করব। আর তোমরা তোমাদের ঘরে যা খাও এবং মজুদ কর তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব।” [সূরা আলে ইমরান। ৪৯]

(رُوْحُ الْقُدُسِ) (রূহুল ক্বুদুস বা পবিত্রের আত্মা) বলে জিবরীল (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। তাঁকে ‘পবিত্রের আত্মা’ এই জন্য বলা হয়েছে যে, তিনি আল্লাহর (‘কুন’ শব্দের মাধ্যমে) নির্দেশক্রমে অস্তিত্বে এসেছিলেন। অনুরূপ ঈসা (আঃ)-কেও ‘রূহ’ বলা হয়েছে। আর ‘ক্বুদুস’; থেকে আল্লাহকে বুঝানো হয়েছে। আর আল্লাহর সাথে উক্ত ‘রূহ’বা আত্মার সম্বন্ধ সম্মানসূচক। ইবনে জারীর এ (রূহুল ক্বুদুস বলতে জিবরীল উদ্দিষ্ট হওয়ার) মতটাকেই সর্বাধিক সঠিক বলেছেন। কারণ সূরা মায়েদার ১১০নং আয়াতে ‘রূহুল ক্বুদুস’ এবং ইঞ্জীল পৃথক পৃথক উল্লিখিত হয়েছে। (কাজেই রূহুল ক্বুদুস অর্থ ইঞ্জীল হতে পারে না।)

স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ বলবেন, হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা! আপনার প্রতি ও আপনার জননীর প্রতি আমার নেয়ামত স্মরণ করুন, যখন রুহুল কুদুস দিয়ে আমি আপনাকে শক্তিশালী করেছিলাম এবং আপনি দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলতেন; আপনাকে কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইঞ্জীল শিক্ষা দিয়েছিলাম; আপনি কাদামাটি দিয়ে আমার অনুমতিক্রমে পাখির মত আকৃতি গঠন করতেন এবং তাতে ফুঁ দিতেন, ফলে আমার অনুমতিক্রমে তা পাখি হয়ে যেত; জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীদেরকে আপনি আমার অনুমতিক্রমে নিরাময় করতেন এবং আমার অনুমতিক্রমে আপনি মৃতকে জীবিত করতেন; আর যখন আমি আপনার থেকে ইসরাঈল সন্তানগনকে বিরত রেখেছিলাম আপনি যখন তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন এনেছিলেন তখন তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল তারা বলেছিল, এটাতো স্পষ্ট জাদু।মায়িদাঃ১১০

বলুন, আপনার রবের কাছ থেকে রূহুল-কুদুস (জিবরীল) যথাযথ ভাবে একে নাযিল করেছেন, যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সুদৃঢ় করার জন্য এবং হিদায়াত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ। নহল-১০২

অন্য আর এক আয়াতে জিবরীল (আঃ)-কে ‘রূহুল আমীন’ বলা হয়েছে। অনুরূপ রসূল (সাঃ) হাসসান (রাঃ) সম্পর্কে বলেছিলেন, اللَّهُمَّ أَيِّدْهُ برُوْحِ الْقُدُسِ ‘হে আল্লাহ! ‘রূহুল ক্বুদুস’ দ্বারা ওকে শক্তিশালী কর। অপর আর এক হাদীসে এসেছে, وَجِبْرِيْلُ مَعَكَ জিবরীল তোমার সাথে রয়েছেন। জানা গেল যে, ‘রূহুল ক্বুদুস’ বলে জিবরীল (আঃ)-কেই বুঝানো হয়েছে। (ফাতহুল বায়ান, ইবনে কাসীর, বরাতে আশরাফুল হাওয়াশী)

نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ

عَلَىٰ قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنذِرِينَ

একে নিয়ে আমানতদার রূহ অবতরন করেছে তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি তাদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও যারা (আল্লাহর পক্ষ থেকে আল্লাহর সৃষ্টির জন্য) সতর্ককারী হয়,   সূরা শুয়ারাঃ ১৯৩-১৯৪

২:৮৮ وَ قَالُوۡا قُلُوۡبُنَا غُلۡفٌ ؕ بَلۡ لَّعَنَهُمُ اللّٰهُ بِکُفۡرِهِمۡ فَقَلِیۡلًا مَّا یُؤۡمِنُوۡنَ

আর তারা বলেছিল, ‘আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত’, বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তাদেরকে লা’নত করেছেন। সুতরাং তাদের কম সংখ্যকই ঈমান আনে।

তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তা এতই পাকাপোক্ত যে, যে যাই কিছু বল না কেন এদের মনে তোমাদের কথা কোন রকম প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না ৷ যেসব হঠধর্মী লোকের মন-মস্তিষ্ক অজ্ঞতা ও মূর্খতার বিদ্বেষে আচ্ছন্ন থাকে তারাই এ ধরনের কথা বলে ৷ তারা একে মজবুত বিশ্বাস নাম দিয়ে নিজেদের একটি গুণ বলে গণ্য করে ৷ অথচ এটা মানুষের গুণ নয় দোষ্ ৷ নিজের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তার গলদ ও মিথ্যা বলিষ্ঠ যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হবার পরও তার ওপর অবিচল থাকার চাইতে বড় দোষ মানুষের আর কি হতে পারে ?

হে মুহাম্মাদ! আমাদের উপর তোমার কথার কোনই প্রভাব পড়বে না। যেমন, অন্যত্র আছে,

{وَقَالُوا قُلُوبُنَا فِي أَكِنَّةٍ مِمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ} অর্থাৎ, তারা বলে, তুমি যার প্রতি আমাদেরকে আহবান করছ, সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণে আচ্ছাদিত।’’ (সূরা হা-মীম সিজদা ৫ আয়াত)

অন্তরে কথার প্রভাব সৃষ্টি না হওয়াটা কোন গর্বের ব্যাপার নয়, বরং এটা অভিশপ্ত হওয়ার নিদর্শন। অতএব তাদের ঈমান অতি অল্প (যা আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় নয়) অথবা তাদের মধ্যে ঈমান আনার মত লোক খুব কম সংখ্যকই হবে।

‘যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তাদের জন্য দুর্ভোগ। তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে রয়েছে’ (যুমার ৩৯/২২)।

আল্লাহ আরো বলেন, فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ

‘তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে। অতএব তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে’ (হাদীদ ৫৭/১৬)।

কুরআনের আয়াত অনুযায়ী অন্তরকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। আমাদের অন্তর এই তিনটি স্তরের মধ্যে উঠানামা করে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা দ্বিতীয় স্তরে আটকে থাকে। চলুন তবে পবিত্র কুরআন হতে এই তিন স্তর সম্পর্কে জেনে নিই।

প্রথম স্তরঃ মৃত অন্তরঃ আল্লাহ তাআলা বলেন,

خَتَمَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَعَلَىٰ سَمْعِهِمْ ۖ وَعَلَىٰ أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

“আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন তাদের অন্তরসমূহের উপর এবং তাদের শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের উপর, আর তাদের চক্ষুগুলোর উপর পড়ে আছে আবরণ। সুতরাং, তাদের জন্য রয়েছে বিরাট আযাব।” –সূরা বাকারা: ৭

এটি হচ্ছে সেই ধরণের অন্তর যা তার প্রভুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে অক্ষম। আল্লাহ এমন অন্তরের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিয়েছেন। ফলে তারা আল্লাহর নাজিলকৃত নিদর্শনকে দেখে না। তিঁনি কেড়ে নিয়েছেন এর শ্রবণশক্তিকে। ফলে তারা সত্যের আহবান শুনতে পায় না।

এটি সম্পূর্ণরূপে অসতর্ক-অমনোযোগী এক অন্তর। এবং প্রবৃত্তি একে যেখানে নিয়ে যেতে চায় সেখানেই যায়। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এধরণের অন্তরের অধিকারীদের সম্পর্কে বলেছেন-

مَثَلُهُمْ كَمَثَلِ الَّذِي اسْتَوْقَدَ نَارًا فَلَمَّا أَضَاءَتْ مَا حَوْلَهُ ذَهَبَ اللَّهُ بِنُورِهِمْ وَتَرَكَهُمْ فِي ظُلُمَاتٍ لَّا يُبْصِرُونَ

“তাদের উপমা হলো ঐ ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালালো। আগুন যখন তার চারপাশ আলোকিত করে তুললো, তখন আল্লাহ তার চোখের আলো নিয়ে নিলেন এবং তাকে ছেড়ে দিলেন অন্ধকার রাশিতে, তাই কিছুই দেখতে পায় না তাদের দৃষ্টি। তারা বধির, বোবা, অন্ধ; তাই তারা ফিরে আসবে না (হিদায়াতের পথে)।” –সূরা বাকারা: ১৭

আল্লাহ কখন তার বান্দার অন্তরে মহর মেরে দেন? যখন বান্দা পাপের মাঝে খুব বেশি নিমগ্ন হয়ে যায়। আল্লাহ পাপের পথকে তখন তার জন্য সহজ করে দেন এবং অন্তরের রোগকে আরও বাড়িয়ে দেন।

فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ

“তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে রোগ। তাই আল্লাহ তাদের রোগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব, কারণ তারা মিথ্যা বলে।” –সূরা বাকারা: ১০

কাজেই, তাদের অন্তরের এই মৃত্যুর জন্য তারা নিজেরাই দায়ী।

فَبِمَا نَقْضِهِم مِّيثَاقَهُمْ وَكُفْرِهِم بِآيَاتِ اللَّهِ وَقَتْلِهِمُ الْأَنبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَقَوْلِهِمْ قُلُوبُنَا غُلْفٌ ۚ بَلْ طَبَعَ اللَّهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُونَ إِلَّا قَلِيلًا

“এবং তারা অভিশপ্ত হয়েছে তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে, আল্লাহর আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করার কারণে, অন্যায়ভাবে নবীদের হত্যা করার কারণে এবং তাদের এই কথার কারণে যেঃ ‘আমাদের অন্তর আচ্ছাদিত’। বরং তাদের কুফুরির কারণে আল্লাহ তাদের অন্তর সীলমোহর করে দিয়েছেন। ফলে তারা আর ঈমান আনবে না, স্বল্প সংখ্যক ছাড়া।” –সূরা নিসা: ১৫৫

এই অবস্থাটা খুবই ভয়ানক একটা ব্যাপার। আমাদেরকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন আমরা কখনই এই স্তরে পৌঁছে না যাই।

দ্বিতীয় স্তরঃ রুগ্ন অন্তর

এই স্তরে অন্তর মৃত নয় তবে রোগে আক্রান্ত। হৃদয়ে রোগের মাত্রায় তারতম্য হতে পারে এবং তা সামান্য থেকে তীব্র মাত্রার হতে পারে। আল্লাহ কুরআনে নিম্নোক্ত দৃষ্টান্ত দিয়েছেন-

أَوْ كَصَيِّبٍ مِّنَ السَّمَاء فِيهِ ظُلُمَاتٌ وَرَعْدٌ وَبَرْقٌ يَجْعَلُونَ أَصْابِعَهُمْ فِي آذَانِهِم مِّنَ الصَّوَاعِقِ حَذَرَ الْمَوْتِ واللّهُ مُحِيطٌ بِالْكافِرِينَ

“আর তাদের উদাহরণ সেসব লোকের মত যারা দুর্যোগপূর্ণ ঝড়ো রাতে পথ চলে, যাতে থাকে আঁধার, গর্জন ও বিদ্যুৎচমক। মৃত্যুর ভয়ে গর্জনের সময় কানে আঙ্গুল দিয়ে রক্ষা পেতে চায়। অথচ সমস্ত কাফেরই আল্লাহ কর্তৃক পরিবেষ্ঠিত।” –সূরা বাকারা: ১৯

রোগাক্রান্ত অন্তর বিশিষ্টদের আল্লাহ তাদেরকে সতর্ক করেছেন যে, তিনি যদি চান তাহলে তাদের অন্তরে মহর মেরে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি তা এখনও করেন নি। সুতরাং তাদের উচিত যত দ্রুত সম্ভব অন্তরের রোগের চিকিৎসা করানো।

তৃতীয় স্তরঃ সুস্থ অন্তর

এটি এমন এক অন্তর যা পবিত্র। যা সকল ধরণের রোগ থেকে মুক্ত। এই অন্তর স্রষ্টাকে এবং তার আনুগত্যকে ভালোবাসে। ভালো কাজ করা তার জন্য সহজ মনে হয় এবং নাফরমানি ও মন্দ কাজকে সে ভয় এবং ঘৃণা করে।

يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ . إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

“যেদিন মাল সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি কোনো উপকারে আসবে না, তবে উপকার লাভ করবে সে, যে হাজির হবে শুদ্ধ প্রশান্ত অন্তর নিয়ে।” –সূরা শুআরা: ৮৯   এটাই হৃদয়ের সেই স্তর যেখানে আমরা সবাই পৌঁছাতে চাই।

 

মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, ঈমানী দুর্বলতা থেকে সংগৃহিতঃ

অন্তর কঠিন হওয়ার আলামত :

(১) আল্লাহর আনুগত্য ও ভালকাজে অলসতা :

মানুষের অন্তর কঠিন হ’লে ইবাদতে অলসতা চলে আসবে। ছালাত পড়বে কিন্তু অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকবে না। ছালাতে নফল ও সুন্নাত আদায়ের পরিমাণ কমে যাবে। মুনাফিকদের চরিত্র প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَلاَ يَأْتُوْنَ الصَّلاَةَ إِلاَّ وَهُمْ كُسَالَى وَلاَ يُنْفِقُوْنَ إِلاَّ وَهُمْ كَارِهُوْنَ ‘তারা ছালাতে আসে অলসতার সাথে আর ব্যয় করে সংকুচিত মনে’ (তওবা ৯/৫৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قَامُوْا إِلَى الصَّلاَةِ قَامُوْا كُسَالَى- ‘যখন তারা ছালাতে দাঁড়ায় তখন তারা অলসভাবে দাঁড়ায়’ (নিসা ৪/১৪২)।

(২) আল্লাহর আয়াত ও উপদেশ শুনে অন্তর প্রভাবিত না হওয়া :

অন্তর কঠিন হ’লে মানুষ কুরআনের আয়াত শুনে বিশেষ করে আযাবের আয়াতগুলি শুনে ভীত হয় না; বরং কুরআন পড়া ও শোনাকে নিজের কাছে ভারী মনে হয়।

আল্লাহ বলেন, فَذَكِّرْ بِالْقُرْآنِ مَن يَخَافُ وَعِيْدِ ‘অতএব যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কুরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান করুন’ (ক্বাফ ৫০/৪৫)।

অন্যত্র আল্লাহ মুমিনদের প্রশংসা করে বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَاناً وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ- ‘যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় আল্লাহর আয়াত, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ারদেগারের প্রতি ভরসা করে’ (আনফাল ৮/ ২)।

(৩) দুনিয়াতে আল্লাহর আযাব-গযব ও মানুষের মৃত্যু দেখে অন্তর ভীত না হওয়া :

মানুষ সাধারণত আযাব-গযব ও নিকটজনের মৃত্যু দেখলে ভীত হয়। কিন্তু কেউ যদি ভীত না হয়, ভাল আমল না করে, খারাপ আমল ছেড়ে না দেয়, তাহ’লে বুঝতে হবে তার অন্তর কঠিন হয়ে গেছে।

আল্লাহ বলেন, أَوَلاَ يَرَوْنَ أَنَّهُمْ يُفْتَنُوْنَ فِيْ كُلِّ عَامٍ مَّرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ لاَ يَتُوْبُوْنَ وَلاَ هُمْ يَذَّكَّرُوْنَ ‘তারা কি লক্ষ্য করে না, প্রতিবছর তারা দু’একবার বিপর্যস্ত হচ্ছে, অথচ তারা এরপরও তওবা করে না কিংবা উপদেশ গ্রহণ করে না’ (তওবা ৯/১২৬)।

(৪) দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধি পাওয়া ও আখেরাতকে ভুলে যাওয়া :

মুমিনদের আসল বাসস্থান হ’ল জান্নাত। দুনিয়া হ’ল আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। যদি কেউ আখেরাতের কথা ভুলে দুনিয়া অর্জনের পিছনে লেগে থাকে, তাহ’লে বুঝতে হবে তার অন্তর কঠিন হয়ে গেছে।

(৫) আল্লাহকে সম্মান করা কমে যাওয়া : আল্লাহকে সম্মান না করার অর্থ হ’ল আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে মান্য না করা। সুতরাং কেউ আল্লাহর আদেশকে মান্য না করে নিষেধগুলিতে ডুবে থাকলে বুঝতে হবে লোকটির অন্তর কঠিন হয়ে গেছে।

অন্তর কঠিন হওয়ার কারণ :

অন্তর কঠিন হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে।

(১) অন্তরকে দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত রেখে আখেরাতকে ভুলিয়ে রাখা :

(২) অলসতা :

(৩) খারাপ বন্ধুদেরকে ভালবাসা ও তাদের সাথে উঠা-বসা করা

(৪) অধিক হারে গুনাহ ও খারাপ কাজ করা

(৫) মৃত্যুর কষ্ট ও আখেরাতের আযাব ভুলে যাওয়া

অন্তর কঠিন হওয়ার প্রতিকার :

(১) আল্লাহ তা‘আলাকে চেনা

(২) কুরআন তিলাওয়াত করা

(৩) অন্তরকে পরকালীন চেতনায় উজ্জীবিত করা

(৪) মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী অবস্থার কথা চিন্তা করা

(৫) কবর যিয়ারত করা ও তাদের অবস্থা চিন্তা করা

(৬) আল্লাহর নির্দশনাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা

(৭) বেশী বেশী আল্লাহর যিকর করা ও গুনাহ মাফ চাওয়া :

(৮) সৎ লোকদের সঙ্গী হওয়া ও তাদের থেকে উপদেশ গ্রহণ করা

(৯) আত্মসমালোচনা করা

১০. দো‘আ করা :

‘আমি বহু জিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় রয়েছে, কিন্তু তারা তদ্বারা উপলব্ধি করে না। তাদের চক্ষু রয়েছে কিন্তু তারা তদ্বারা দেখে না। তাদের কর্ণ রয়েছে, কিন্তু তদ্বারা তারা শোনে না। তারাই হ’ল পশুর ন্যায় বরং তা অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত। তারাই হ’লো গাফিল বা অমনোযোগী’ (আ‘রাফ ৭/১৭৯)।

২:৮৯ وَ لَمَّا جَآءَهُمۡ کِتٰبٌ مِّنۡ عِنۡدِ اللّٰهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمۡ ۙ وَ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ یَسۡتَفۡتِحُوۡنَ عَلَی الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ۚۖ فَلَمَّا جَآءَهُمۡ مَّا عَرَفُوۡا کَفَرُوۡا بِهٖ ۫ فَلَعۡنَۃُ اللّٰهِ عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ

আর যখন তাদের কাছে যা আছে আল্লাহর কাছ থেকে তার সত্যায়নকারী কিতাব আসলো; অথচ পূর্বে তারা এর সাহায্যে কাফেরদের বিরুদ্ধে বিজয় প্রার্থনা করত, তারপর তারা যা চিনত যখন তা তাদের কাছে আসল, তখন তারা সেটার সাথে কুফরী করল। কাজেই কাফেরদের উপর আল্লাহর লা’নত।

এ আয়াতাংশে বলা হয়েছে যে, তারা তাকে জানতে ও চিনতে পেরেছে। তার সপক্ষে বহু তথ্য-প্রমাণ সে যুগেই পাওয়া গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী সাক্ষ্য পেশ করেছেন উম্মুল মুমিনীন সাফিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি নিজে ছিলেন একজন বড় ইয়াহুদী আলেমের মেয়ে এবং আরেকজন বড় আলেমের ভাইঝি। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মদীনা আগমনের পর আমার বাবা ও চাচা দু’জনেই তার সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘক্ষণ তার সাথে কথাবার্তা বলার পর তারা ঘরে ফিরে আসেন।

এ সময় আমি নিজের কানে তাদেরকে এভাবে আলাপ করতে শুনিঃ চাচা বললেন, আমাদের কিতাবে যে নবীর খবর দেয়া হয়েছে, ইনি কি সত্যিই সেই নবী? পিতা বললেন, আল্লাহর কসম, ইনিই সেই নবী। চাচা বললেন, এ ব্যাপারে তুমি কি একেবারে নিশ্চিত? পিতা বললেন, হ্যাঁ। চাচা বললেন, তাহলে এখন কি করতে চাও? বাবা বললেন, যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে এর বিরোধিতা করে যাব। [দালায়েলুন নাবুওয়াহ লিল বাইহাকী, সীরাতে ইবনে হিশাম]

নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমণের পূর্বে ইয়াহুদীরা তাদের পূর্ববতী নবীগণ যে নবীর আগমনবার্তা শুনিয়ে গিয়েছিলেন তার জন্য প্রতীক্ষারত ছিল। তারা দো’আ করত তিনি যেন অবিলম্বে এসে কাফেরদের প্রাধান্য খতম করে ইয়াহুদী জাতির উন্নতি ও পুনরুত্থানের সূচনা করেন। মুহাম্মাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে মদীনাবাসীদের প্রতিবেশী ইয়াহুদী সম্প্রদায় নবীর আগমনের আশায় জীবন ধারণ করত, মদীনাবাসীরা নিজেরাই এর সাক্ষী। যত্রতত্র যখন তখন তারা বলে বেড়াতঃ ঠিক আছে, এখন প্রাণ ভরে আমাদের উপর যুলুম করে নাও।

কিন্তু যখন সেই নবী আসবেন, আমরা তখন এই যালিমদের সবাইকে দেখে নেব। মদীনাবাসীরা এসব কথা আগের থেকেই শুনে আসছিল। তাই নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা শুনে তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলঃ দেখ, ইয়াহুদীরা যেন তোমাদের পিছিয়ে দিয়ে এ নবীর দ্বীন গ্রহণ করে বাজী জিতে না নেয়। চল, তাদের আগে আমরাই এ নবীর উপর ঈমান আনব। কিন্তু তারা অবাক হয়ে দেখল, যে ইয়াহুদীরা নবীর আগমন প্রতীক্ষায় দিন গুনছিল, নবীর

আগমনের পর তারাই তার সবচেয়ে বড় বিরোধী পক্ষে পরিণত হল। [দেখুন, মুসনাদে আহমাদ ৩/৪৬৭, তাফসীর ইবনে কাসীর]

২:৯০ بِئۡسَمَا اشۡتَرَوۡا بِهٖۤ اَنۡفُسَهُمۡ اَنۡ یَّکۡفُرُوۡا بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ بَغۡیًا اَنۡ یُّنَزِّلَ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖ عَلٰی مَنۡ یَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِهٖ ۚ فَبَآءُوۡ بِغَضَبٍ عَلٰی غَضَبٍ ؕ وَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابٌ مُّهِیۡنٌ

যার বিনিময়ে তারা তাদের নিজদেরকে বিক্রি করেছে তা কতই না নিকৃষ্ট! তা হচ্ছে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তারা তার সাথে কুফরী করেছে, হটকারিতাবশতঃ শুধু এ জন্যে যে, আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় অনুগ্রহ নাযিল করেন। কাজেই তারা ক্রোধের উপর ক্রোধ অর্জন করেছে। আর কাফেরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাময় শাস্তি.

তারা চাচ্ছিল, ঐ নবী তাদের ইসরাঈল বংশের মধ্যে জন্ম নেবে ৷ কিন্তু যখন তিনি বনী ইসরাঈলের বাইরে এমন এক বংশে জন্মগ্রহণ করলেন , যাদেরকে তারা নিজেদের মোকাবিলায় তুচ্ছ-জ্ঞান করতো, তখন তারা তাঁকে অস্বীকার করতে উদ্যত হলো ৷ অর্থাৎ তারা যেন বলতে চাচ্ছিল,আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করে নবী পাঠালেন না কেন ?যখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস না করে যাকে ইচ্ছা তাকে নবী বানিয়ে পাঠালেন তখন তারা বেঁকে বসলো ৷

এ কথা জানা সত্ত্বেও যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) সেই শেষ নবী, যাঁর গুণাবলীর কথা তাওরাত ও ইঞ্জীলে উল্লিখিত হয়েছে এবং আহলে কিতাব তাদের এক মুক্তিদাতা হিসেবে তাঁর আগমনের অপেক্ষাও করছিল, কিন্তু কেবল এই জ্বালায় ও হিংসায় তাঁর উপর ঈমান আনেনি যে, নবী আমাদের মধ্য থেকে কেন হল না, যেমন আমাদের ধারণা ছিল। অর্থাৎ, তারা (নবীর নবুঅতকে) অস্বীকার করেছিল জাতিগত বিদ্বেষ ও হিংসার ভিত্তিতে, দলীল ও প্রমাণের ভিত্তিতে নয়।

এখানে তাদের শক্রতাকে কুফরের কারণ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এখানে এক ক্রোধ কুফরের কারণে এবং অপর ক্রোধ হিংসার কারণে। এ জন্যই ক্রোধের উপর ক্রোধ বলা হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে তাদের যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তা থেকে কুফর প্রমাণিত হয় এবং হিংসাও বুঝা যায়। তবে ইকরিমাহ বলেন, তাদের উপর এক ক্রোধ হচ্ছে, ঈসা আলাইহিস সালামের উপর কুফরী করার কারণে, আর অন্য ক্রোধ হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কুফরীর কারণে। তাছাড়া শাস্তির সাথে অপমানজনক পদ যোগ করে বলা হয়েছে যে, এ শাস্তি কাফেরদের জন্যই নির্দিষ্ট। কেননা, পাপী ঈমানদারদেরকে যে শাস্তি দেয়া হবে, তা হবে তাকে পাপমুক্ত করার উদ্দেশ্যে, অপমান করার উদ্দেশ্যে নয়।

কাফেরদের জন্য অপমানজনক শাস্তির আরেক কারণ হচ্ছে, তাদের অহঙ্কার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন অহংকারীদেরকে মানুষের সুরতে পিপড়ার মত করে জমায়েত করা হবে। ছোট সব কিছুই তাদের উপর থাকবে। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে জাহান্নামের এক কয়েদখানায় প্রবিষ্ট করানো হবে যার নাম হচ্ছে, বুলস! যাবতীয় আগুন তাদের উপরে থাকবে। তাদেরকে জাহান্নামবাসীদের পুজ তীনাতুল খাবাল’ থেকে পান করানো হবে।” [মুসনাদে আহমাদ: ২/১৭৯]

 আয়াতে উল্লেখিত দুটি শাস্তির প্রথমটি হলো পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা ও দুর্গতি। তা এভাবে বাস্তব রূপ লাভ করেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমলেই মুসলিমদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিভংগের অপরাধে বনী-কুরাইযা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও বন্দী হয়েছে এবং বনী-নাদীরকে চরম অপমান ও লাঞ্ছনার সাথে সিরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়েছে।

২:৯১ وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُمۡ اٰمِنُوۡا بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ قَالُوۡا نُؤۡمِنُ بِمَاۤ اُنۡزِلَ عَلَیۡنَا وَ یَکۡفُرُوۡنَ بِمَا وَرَآءَهٗ ٭ وَ هُوَ الۡحَقُّ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَهُمۡ ؕ قُلۡ فَلِمَ تَقۡتُلُوۡنَ اَنۡۢبِیَآءَ اللّٰهِ مِنۡ قَبۡلُ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ

. আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তাতে ঈমান আনো, তারা বলে, আমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে আমরা কেবল তাতে ঈমান আনি। অথচ এর বাইরে যা কিছু আছে সবকিছুই তারা অস্বীকার করে, যদিও তা সত্য এবং তাদের নিকট যা আছে তার সত্যায়নকারী। বলুন, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক, তবে কেন তোমরা অতীতে আল্লাহর নবীদেরকে হত্যা করেছিলে?

আমরা শুধু তাওরাতের প্রতিই ঈমান আনব, অন্যান্য গ্রন্থের প্রতি ঈমান আনব না, ইয়াহুদীদের এ উক্তি সুস্পষ্ট কুফর। সেই সাথে তাদের উক্তি যা (তাওরাত) আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে। এ থেকে প্রতিহিংসা বুঝা যায়। এর পরিস্কার অর্থ হচ্ছে এই যে, অন্যান্য গ্রন্থ যেহেতু আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়নি, কাজেই আমরা সেগুলোর প্রতি ঈমান আনব না। আল্লাহ তা’আলা তিন পন্থায় তাদের এ উক্তি খণ্ডন করেছেন।

প্রথমতঃ অন্যান্য গ্রন্থের সত্যতা ও বাস্তবতা যখন অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত, তখন সেগুলো অস্বীকার করার কোন কারণ থাকতে পারে না। অবশ্য দলীলের মধ্যে কোন আপত্তি থাকলে তারা তা উপস্থিত করে দূর করে নিতে পারত। অহেতুক অস্বীকার করার কোন অর্থ হয় না।

দ্বিতীয়তঃ অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে একটি হচ্ছে কুরআনুল কারীম, যা তাওরাতেরও সত্যায়ন করে। সুতরাং কুরআনুল কারীমকে অস্বীকার করলে তাওরাতের অস্বীকৃতিও অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

তৃতীয়তঃ আল্লাহর সকল গ্রন্থের মতেই নবীদের হত্যা করা কুফর! তোমাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা কয়েকজন নবীকে হত্যা করেছে। অথচ তারা বিশেষভাবে তাওরাতের শিক্ষাই প্রচার করতেন। তোমরা সেসব হত্যাকারীকেই নেতা ও পুরোহিত মনে করেছ। এভাবে কি তোমরা তাওরাতের সাথেই কুফরী করনি? সুতরাং তাওরাতের প্রতি তোমাদের ঈমান আনার দাবী আসার প্রমাণিত হয়। মোটকথা, কোন দিক দিয়েই তোমাদের কথা ও কাজ শুদ্ধ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পরবর্তী আয়াতে আরও কতিপয় যুক্তির দ্বারা ইয়াহুদীদের দাবী খণ্ডন করা হয়েছে। [মাআরিফুল কুরআন]

২:৯২ وَ لَقَدۡ جَآءَکُمۡ مُّوۡسٰی بِالۡبَیِّنٰتِ ثُمَّ اتَّخَذۡتُمُ الۡعِجۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِهٖ وَ اَنۡتُمۡ ظٰلِمُوۡنَ

অবশ্যই মূসা তোমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছিলেন, তারপর তোমরা তার অনুপস্থিতিতে গো বৎসকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করেছিলে। বাস্তবিকই তোমরা যালিম।

এ আয়াতে ‘স্পষ্ট প্রমাণ’ কি তা ব্যাখ্যা করে বলা হয় নি। অন্য আয়াতে সেটা এসেছে। যেমন, বলা হয়েছে, “তারপর আমরা তাদেরকে তুফান, পঙ্গপাল, উকুন, ভেক ও রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি। এগুলো স্পষ্ট নিদর্শন; কিন্তু তারা অহংকারই রয়ে গেল, আর তারা ছিল এক অপরাধী সম্প্রদায়” [সূরা আল-আরাফ: ১৩৩]

আরও বলা হয়েছে, “তারপর মূসা তার হাতের লাঠি নিক্ষেপ করল এবং সাথে সাথেই তা এক অজগর সাপে পরিণত হল এবং তিনি তার হাত বের করলেন আর সাথে সাথেই তা দর্শকদের কাছে শুভ্র উজ্জ্বল দেখাতে লাগল” [সূরা আল-আরাফঃ ১০৭-১০৮]

আরও এসেছে, “তারপর আমরা মূসার প্রতি ওহী করলাম যে, আপনার লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত করুন। ফলে তা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতের মত হয়ে গেল” [সূরা আশ-শু’আরা: ৬৩] অনুরূপ আরও কিছু আয়াতে।

 ইয়াহুদীদের দাবীর খণ্ডনে আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমরা একদিকে ঈমানের দাবী কর, অন্যদিকে প্রকাশ্য শির্কে লিপ্ত হও। ফলে শুধু মূসা আলাইহিস সালাম-কেই নয়, আল্লাহকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে চলেছ। কুরআন নাযিলের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমলে যেসব ইয়াহুদী ছিল, তারা গোবৎসকে উপাস্য নির্ধারণ করেনি সত্য; কিন্তু তারা নিজেদের পূর্ব-পুরুষদের সমর্থক ছিল। অতএব তারাও মোটামুটিভাবে এ আয়াতের লক্ষ্য। [তাফসীরে মা’আরিফুল কুরআন]

২:৯৩ وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِیۡثَاقَکُمۡ وَ رَفَعۡنَا فَوۡقَکُمُ الطُّوۡرَ ؕ خُذُوۡا مَاۤ اٰتَیۡنٰکُمۡ بِقُوَّۃٍ وَّ اسۡمَعُوۡا ؕ قَالُوۡا سَمِعۡنَا وَ عَصَیۡنَا ٭ وَ اُشۡرِبُوۡا فِیۡ قُلُوۡبِهِمُ الۡعِجۡلَ بِکُفۡرِهِمۡ ؕ قُلۡ بِئۡسَمَا یَاۡمُرُکُمۡ بِهٖۤ اِیۡمَانُکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ

স্মরণ কর, যখন আমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম এবং তুরকে তোমাদের উপর উত্তোলন করেছিলাম, (বলেছিলাম,) যা দিলাম দৃঢ়ভাবে গ্রহণ কর এবং শোন’। তারা বলেছিল, “আমরা শোনলাম ও অমান্য করলাম”। আর কুফরীর কারণে তাদের অন্তরে গো-বৎস প্রীতি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। বলুন, যদি তোমরা ঈমানদার হও তবে তোমাদের ঈমান যার নির্দেশ দেয় তা কত নিকৃষ্ট!

এ হল শেষ পর্যায়ের কুফরী ও অস্বীকার যে, মৌখিকভাবে তো তারা মেনে নিল, ‘আমরা শ্রবণ করলাম’ অর্থাৎ, আনুগত্য করব, কিন্তু অন্তরে এই নিয়ত লুক্কায়িত যে, আমাদেরকে কোন্ কাজ করতে হবে?

অর্থাৎ, অবাধ্যতা এবং বাছুরের ভালবাসা ও পূজার কারণে তা কুফরী ছিল, যা তাদের হৃদয়ে স্থান লাভ করে নিয়েছিল।

একে তো প্রীতি-ভক্তি এমন এক জিনিস, যা মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে দেয়। তাতে আবার সে প্রীতি (রস) তাদের হৃদয়কে {أُشْرِبُوْا} ‘পান করানো হয়েছিল’ বলে অভিব্যক্ত করা হয়েছে। কেননা, পানি মানুষের শিরা-উপশিরায় যেভাবে দ্রুত চলাচল করে আহারাদি সেভাবে করে না। (ফাতহুল ক্বাদীর) (এ থেকে তাদের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়।)

২:৯৪ قُلۡ اِنۡ کَانَتۡ لَکُمُ الدَّارُ الۡاٰخِرَۃُ عِنۡدَ اللّٰهِ خَالِصَۃً مِّنۡ دُوۡنِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الۡمَوۡتَ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ

বলুন, যদি আল্লাহ্‌র কাছে আখেরাতের বাসস্থান অন্য লোক ছাড়া বিশেষভাবে শুধু তোমাদের জন্যই হয়, তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর—যদি সত্যবাদী হয়ে থাক।

ইহুদিদের দুনিয়া প্রীতির প্রতি এটি সূক্ষ্ম বিদ্রূপ বিশেষ ৷ আখেরাতের জীবন সম্পর্কে যারা সচেতন এবং আখেরাতের জীবনের সাথে যাদের সত্যিই কোন মানসিক সংযোগ থাকে তারা কখনো পার্থিব স্বার্থ লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে না ৷ কিন্তু ইহুদিদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল এবং এখনো আছে ৷

২:৯৫ وَ لَنۡ یَّتَمَنَّوۡهُ اَبَدًۢا بِمَا قَدَّمَتۡ اَیۡدِیۡهِمۡ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌۢ بِالظّٰلِمِیۡنَ

কিন্তু তাদের কৃতকর্মের কারণে তারা কখনো তা কামনা করবে না। আর আল্লাহ যালিমদের সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানী।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর তফসীর করেছেনঃ মুবাহালা’র প্রতি আহবান। অর্থাৎ, ইয়াহুদীদেরকে বলা হল, যদি তোমরা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবুঅতের অস্বীকৃতিতে এবং আল্লাহর সাথে ভালবাসার দাবীতে সত্যবাদী হও, তাহলে ‘মুবাহালা’ কর। অর্থাৎ, মুসলিম ও ইয়াহুদী উভয়ে মিলে আল্লাহর সমীপে এই দরখাস্ত পেশ কর যে, হে আল্লাহ! উভয়ের মধ্যে যে মিথ্যুক, তাকে মৃত্যু দান কর। সূরা জুমুআহ (৭নং আয়াতে)-তেও এই আহবান তাদেরকে করা হয়েছে। নাজরানের খ্রিষ্টানদেরকেও মুবাহালা’র দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। যেমন, সূরা আলে-ইমরানে তা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু খ্রিষ্টানদের মত ইয়াহুদীরাও যেহেতু তাদের দাবীতে মিথ্যাবাদী ছিল, সেহেতু খ্রিষ্টানদের মতই ইয়াহুদীদের ব্যাপারেও মহান আল্লাহ বললেন, এরা কখনো মৃত্যু কামনা (মুবাহালা) করবে না। হাফেয ইবনে কাসীর এই ব্যাখ্যাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর)

তাহলে মৃত্যু চেয়ে নাও৷ কিন্তু যেসব অপকর্ম তারা করেছে  তার কারণে তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না৷ আল্লাহ এসব জালেমকে খুব ভালভাবেই জানেন৷ সূরা জুমুআহ (৭নং আয়াত)

অন্য কথায় মৃত্যু থেকে তাদের এই পালানো বিনা কারণে নয় ৷ মুখে তারা যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, আল্লাহর দীনের সাথে তারা যে আচরণ করেছে এবং পৃথিবীতে তারা যা করেছে আখেরাতে সেই সব আচরণ ও কাজকর্মের কিরূপ ফলাফল আশা করা যায় তাদের জ্ঞান ও বিবেক তা ভাল করেই জানতো ৷ এ কারণে তাদের প্রবৃত্তি আল্লাহর আদালতের মুখোমুখি হতে টালবাহানা করে ৷

২:৯৬ وَ لَتَجِدَنَّهُمۡ اَحۡرَصَ النَّاسِ عَلٰی حَیٰوۃٍ ۚۛ وَ مِنَ الَّذِیۡنَ اَشۡرَکُوۡا ۚۛ یَوَدُّ اَحَدُهُمۡ لَوۡ یُعَمَّرُ اَلۡفَ سَنَۃٍ ۚ وَ مَا هُوَ بِمُزَحۡزِحِهٖ مِنَ الۡعَذَابِ اَنۡ یُّعَمَّرَ ؕ وَ اللّٰهُ بَصِیۡرٌۢ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ

আর আপনি অবশ্যই তাদেরকে জীবনের প্রতি অন্যসব লোকের চেয়ে বেশী লোভী দেখতে পাবেন, এমনকি মুশরিকদের চাইতেও। তাদের প্রত্যেকে আশা করে যদি হাজার বছর আয়ু দেয়া হত; অথচ দীর্ঘায়ু তাকে শাস্তি হতে নিষ্কৃতি দিতে পারবে না। তারা যা করে আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।

মৃত্যু কামনা তো দূরের কথা; পার্থিব জীবনের প্রতি এদের লোভ ও আকর্ষণ তো সকল মানুষ এমনকি মুশরিকদের চেয়েও বেশী। কিন্তু সুদীর্ঘ জীবন তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারবে না। এই আয়াতগুলো থেকে জানা গেল যে, ইয়াহুদীরা তাদের এই দাবীতে মিথ্যাবাদী ছিল যে, তারাই আল্লাহর প্রিয়, জান্নাতের অধিকারী কেবল তারাই, অন্যরা হবে জাহান্নামী। কারণ, প্রকৃতপক্ষে যদি তাই হত অথবা কমসে কম তাদের দাবীর সত্যতার উপর তারা যদি পূর্ণ আস্থাবান হত, তাহলে তারা অবশ্যই ‘মুবাহালা’ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যেত। যাতে তাদের সত্যবাদিতা এবং মুসলিমদের মিথ্যাবাদিতা প্রকাশ পেয়ে যেত। মুবাহালা’র পূর্বে ইয়াহুদীদের অমান্য করা ও মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করে যে, তারা মৌখিকভাবে নিজেদের সম্পর্কে আনন্দদায়ক কথা বলে নিলেও তাদের অন্তর প্রকৃতত্বের ব্যাপারে অবহিত ছিল। তারা জানত যে, আল্লাহর নিকটে যাওয়ার পর তাদের পরিণাম তা-ই হবে, যা আল্লাহ অবাধ্যজনদের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন।

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান ও তাফহিমুল কুর’আন, ইমানী দূর্বলতা(সালিহ আল মুনাজ্জিদ)