সূরা আল বাকারাঃ ৫ম রুকু(আয়াতঃ ৪০-৪৬)

সূরা আল বাকারাঃ ৫ম রুকু(আয়াতঃ ৪০-৪৬)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:৪০ یٰبَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتِیَ الَّتِیۡۤ اَنۡعَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ وَ اَوۡفُوۡا بِعَهۡدِیۡۤ اُوۡفِ بِعَهۡدِکُمۡ ۚ وَ اِیَّایَ فَارۡهَبُوۡنِ

৪০. হে ইসরাঈল বংশধরগণ তোমরা আমার সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি এবং আমার সঙ্গে তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর, আমিও তোমাদের সঙ্গে আমার অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর।

আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার ভুলে যাওয়ায় হযরত আদম (আ.)-কে বেহেশত থেকে বহিষ্কার করা এবং হযরত আদমকে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব দেয়ার কাহিনী বর্ণনার পর, এই আয়াতে আল্লাহপাক আরেকটি কাহিনীর বর্ণনা দিয়েছেন। হযরত আদম (আ.)-এরই সন্তান অর্থাৎ বনী ইসরাইল গোত্র কি পরিণতির শিকার হয়েছিল সে কথাই এখানে বলা হয়েছে।

মহান আল্লাহ এখানে ইসরাইল বংশধরদের নাম উল্লেখ করেই বলেছেন, এটা তাদের মর্যাদা গুরুত্বকে বাড়িয়ে দেয়।

কোন একজন ব্যক্তিকে যেমন বলা হয় হে অমুকের সন্তান,তখন মর্যাদার ব্যপারটি আসে।বনী অর্থ সন্তানগন

“ইস্রাঈল” (অর্থ আব্দুল্লাহ) ইয়াক্বুব (আঃ)-এর উপাধি। ইয়াহুদীদেরকে বানী ইস্রাঈল – অর্থাৎ ইয়াক্বুব (আঃ)-এর সন্তান বলা হত।

ইয়াক্বুব আ ইবরাহীম আ এর নাতি। কারণ ইয়াক্বুব (আঃ)-এর বারো জন সন্তান ছিল, তা থেকে বারোটি বংশ গঠিত হয় এবং এ­ই বংশসমূহ থেকে বহু নবী ও রসূল হন।

ইহুদীরা দাওয়াতী কাজ করে না কারন ওরা বানিয়ে নিয়েছে যে ইহুদী বংশে জন্ম না নিলে ইহুদী হতে পারবে না। তাই ওদের দাওয়াত দেয়ার প্রয়োজন হয় না।

তারা আল্লাহর নবীর নামেই রাষ্ট্রের নাম রেখেছে ইস্রাইল, তাহলেতো নবীর প্রতি অনুরাগ আছে। নবীর প্রতি তাদের এতো শ্রদ্ধা ভক্তি ছিলো যার দাবিই হলো নবী যা কাজ করেছেন তা অনুসরন করো।

ইউসুফ (আঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষ মূসা ও হারূন আ। অর্থাৎ মূসা হ’লেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ।

শেষনবী (সা)-এর আবির্ভাবের প্রায় ১৫৪৬ বছর পূর্বে সুলায়মান (আঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রাহবা‘আম (رحبعام) ১৭ বছর রাজত্ব করেন। অতঃপর বনু ইস্রাঈলের রাজত্ব বিভক্ত হয়ে যায়।

এক ভাগকে ‘ইয়াহূদিয়াহ  বলা হত এবং তাদের রাজধানী ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাসে।

অপর ভাগের নাম ছিল ‘ইস্রাঈল এবং তাদের রাজধানী ছিল তৎকালীন সামেরাহ এবং বর্তমান নাবলুসে।

প্রথম ছিল মক্কায় বায়তুল্লাহ বা কা‘বাগৃহ। যা হযরত আদম (আঃ) কর্তৃক প্রথম নির্মিত হয়। অতঃপর ইবরাহীম ও তৎপুত্র ইসমাঈলের হাতে পুনর্নির্মিত হয়।

দ্বিতীয়টি ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস, যা কাবাগৃহের চল্লিশ বছর পর আদম-পুত্রগণের কারো হাতে প্রথম নির্মিত হয়, যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অতঃপর ইবরাহীম (আঃ)-এর পৌত্র ইয়াকূব বিন ইসহাক (আঃ) কর্তৃক নির্মিত হয়। অতঃপর দাউদ ও সুলায়মান (আঃ) কর্তৃক পুনর্নির্মিত হয়।

ইয়াহুদীদের আরবে বিশেষ মর্যাদা ছিল। কারণ, তারা অতীত ইতিহাস এবং ইলম ও দ্বীন সম্পর্কে অবহিত ছিল। আর এই জন্যই তাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত অতীত নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে বলা হচ্ছে যে, তোমরা সেই অঙ্গীকার রক্ষা কর, যা শেষ নবী এবং তাঁর নবুঅতের উপর ঈমান আনার ব্যাপারে তোমাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল। যদি তোমরা সেই অঙ্গীকার রক্ষা করো, তাহলে আমিও আমার অঙ্গীকার রক্ষা করে তোমাদের উপর থেকে সেই বোঝা নামিয়ে দেব, যা তোমাদের ভুল-ত্রুটির কারণে শাস্তিস্বরূপ তোমাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তোমাদেরকে পুনরায় উন্নতি দান করব। আর আমাকে ভয় করো, কারণ আমি তোমাদেরকে অব্যাহত লাঞ্ছনা ও অধঃপতনের মধ্যে রাখতে পারি, যাতে তোমরা পতিত আছ এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষগণও পতিত ছিল।

এ সূরার ৪০ চল্লিশতম আয়াত থেকে আরম্ভ করে ১২৩ একশত তেইশতম আয়াত পর্যন্ত শুধু আসমানী গ্রন্থে বিশ্বাসী আহলে-কিতাবদেরকে বিশেষভাবে সম্বোধন করা হয়েছে। সেখানে তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য প্রথমে তাদের বংশগত কৌলিন্য, বিশ্বের বুকে তাদের যশ-খ্যাতি, মান-মর্যাদা এবং তাদের প্রতি আল্লাহ্ তা’আলার অগণিত অনুকম্পাধারার বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

অতঃপর তাদের পদচ্যুতি ও দুস্কৃতির জন্য সাবধান করে দেয়া হয়েছে এবং সঠিক পথের দিকে আহবান করা হয়েছে। প্রথম সাত আয়াতে এসব বিষয়েরই আলোচনা করা হয়েছে।

বনী ইসরাঈলকে যে সমস্ত নেআমত প্রদান করা হয়েছে তা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, ফেরআউন থেকে নাজাত, সমুদ্রে রাস্তার ব্যবস্থা করে তাদের বের করে আনা, তীহ ময়দানে মেঘ দিয়ে ছায়া প্রদান, মান্না ও সালওয়া নাযিলকরণ, সুমিষ্ট পানির ব্যবস্থা করণ ইত্যাদি। তাছাড়া তাদের হিদায়াতের জন্য অগণিত অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ ও তৎকালীন বিশ্বের সবার উপর শ্ৰেষ্ঠত্ব প্রদানও উল্লেখযোগ্য।

এ আয়াতে ইসরাঈল-বংশধরগণকে সম্বোধন করে এরশাদ হয়েছেঃ “আর তোমরা আমার অঙ্গীকার পূরণ কর।” অর্থাৎ তোমরা আমার সাথে যে অঙ্গীকার করেছিলে, তা পূরণ কর কাতাদাহ-এর মতে তাওরাতে বর্ণিত সে অংগীকারের কথাই কুরআনের এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে,

“আল্লাহ বনী-ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং আমি তাদের (১২ গোত্রের) মধ্য থেকে বার জন সর্দার নিযুক্ত করেছিলাম। আল্লাহ বলে দিলেনঃ আমি তোমাদের সঙ্গে আছি যদি তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর, যাকাত দিতে থাক, আমার পয়গম্বরদের প্রতি বিশ্বাস রাখ, তাঁদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ বা উত্তম পন্থায় ঋণ দিতে থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গোনাহ দূর করে দেব এবং অবশ্যই তোমাদেরকে বিভিন্ন বেহেশতে প্রবিষ্ট করব, যেগুলোর (গাছপালার) তলদেশ দিয়ে বয়ে গেছে নানা ঝরণা বা স্রোতস্বিনী। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি এরপরও কাফের হয়, সে নিশ্চিতই সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে।” (মায়েদা:১২)

সমস্ত রাসূলের উপর ঈমান আনার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারই এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যাদের মধ্যে আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। এছাড়া সালাত, যাকাত এবং মৌলিক ইবাদতও এ অঙ্গীকারভূক্ত। এ জন্যই ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন যে, এ অঙ্গীকারের মূল অর্থ মুহাম্মাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ণ অনুসরণ।

এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, অঙ্গীকার ও চুক্তির শর্তাবলী পালন করা অবশ্য কর্তব্য আর তা লংঘন করা হারাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে,

অঙ্গীকার ভংগকারীদেরকে নির্ধারিত শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে এই শাস্তি দেয়া হবে যে, হাশরের ময়দানে যখন পূর্ববতী ও পরবর্তী সমগ্র মানবজাতি সমবেত হবে, তখন অঙ্গীকার ভংগকারীদের পিছনে নিদর্শনস্বরূপ একটি পতাকা উত্তোলন করে দেয়া হবে এবং যত বড় অঙ্গীকার ভংগ করবে, পতাকাও তত উচু ও বড় হবে। [সহীহ মুসলিম: ১৭৩৮] এভাবে তাদেরকে হাশরের ময়দানে লজ্জিত ও অপমানিত করা হ

“যারা বলেঃ আমরা নাসারা বা হযরত ঈসার অনুসারী বলে দাবি করে, আমি তাদের কাছ থেকেও তাদের অঙ্গীকার নিয়েছিলাম। অতঃপর তারাও (ইহুদিদের মত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তাদের মতই) যেসব উপদেশ (ধর্মগ্রন্থ) পেয়েছিল, সেসবের একাংশ ভুলে যায়। অতঃপর আমি কেয়ামত পর্যন্ত তাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিয়েছি। অবশেষে আল্লাহ শিগগিরই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন।” (৫:১৪)

৪০নং আয়াতে তিনটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা আল্লাহ প্রদত্ত সকল কর্মসূচির উৎস।

প্রথমত: আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের কথা স্মরণ করতে হবে। এতে মানুষের মধ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অনুভূতি সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তার আনুগত্যের স্পৃহা জেগে ওঠে।

দ্বিতীয়ত: আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও সুখ-সম্পদ শর্তহীনভাবে দেয়া হয়নি। একই সাথে আল্লাহ মানুষের কাছ থেকেও অঙ্গীকার নিয়েছেন। তাই মানুষের বিশেষ কিছু দায়িত্ব আছে। সে যদি আল্লাহ নির্দেশিত পথে চলে তাহলে আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহ থেকে পুরোপুরি লাভবান হতে পারবে।

তৃতীয়ত: আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোন শক্তিকে ভয় পেলে চলবে না। শত্রুদের হুমকি ও প্রচারণা যাতে মানুষের মধ্যে কোন প্রভাব ফেলতে না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

কুর’আনে সবচেয়ে বেশী আলোচিত মুসা আ। তারপরেও ইহুদীরা এই কুর’আনকে মেনে নেই নি

২:৪১ وَ اٰمِنُوۡا بِمَاۤ اَنۡزَلۡتُ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَکُمۡ وَ لَا تَکُوۡنُوۡۤا اَوَّلَ کَافِرٍۭ بِهٖ ۪ وَ لَا تَشۡتَرُوۡا بِاٰیٰتِیۡ ثَمَنًا قَلِیۡلًا ۫ وَّ اِیَّایَ فَاتَّقُوۡنِ ﴿

৪১। তোমাদের কাছে যা আছে তার সত্যায়নকারীরূপে আমি যা অবতীর্ণ করেছি তা বিশ্বাস কর। আর তোমরাই ওর  প্রথম অবিশ্বাসকারী হয়ো না এবং আমার আয়াতের বিনিময়ে স্বল্প মূল্য গ্রহণ করো না। তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর।

بِه (ওর) সর্বনাম দ্বারা ক্বুরআনকে বুঝানো হয়েছে অথবা মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে। আর উভয় মতই সঠিক। কেননা, দু’টিই আপোসে অবিচ্ছেদ্য। যে ক্বুরআনের সাথে কুফরী করল, সে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাথেও কুফরী করল। আর যে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাথে কুফরী করল, সে ক্বুরআনের সাথেও কুফরী করল। (ইবনে কাসীর) “প্রথম অবিশ্বাসকারী হয়ো না” এর অর্থ,

প্রথমতঃ তোমাদের যে জ্ঞান রয়েছে, অন্যরা সে জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। কাজেই তোমাদের দায়িত্ব সর্বাধিক।

দ্বিতীয়তঃ মদীনায় ইয়াহুদীদেরকেই সর্বপ্রথম ঈমানের প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল; যদিও হিজরতের পূর্বে অনেক মানুষ ইসলাম কবুল করে নিয়েছিল। তাই সতর্ক করা হচ্ছে যে, ইয়াহুদীদের মধ্যে তোমরা প্রথম অবিশ্বাসকারী হয়ো না। কারণ, যদি তোমরা তা হও, তাহলে সমস্ত ইয়াহুদীদের কুফরী ও অবিশ্বাস করার (পাপের) বোঝা তোমাদের উপর চাপব

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হবে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সেই সত্তার শপথ যার হাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন! এ উম্মতের যে কেউ, চাই সে ইয়াহুদি হোক বা নাসারা। আমার রিসালাতের কথা শুনে, অথচ আমি যা সহকারে প্রেরিত হয়েছি তার ওপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করে, সে অবশ্যই জাহান্নামের অধিবাসী হবে। (মুসলিম)

“তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর ওপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তদীয় বংশধরের প্রতি এবং মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীকে তাদের রবের পক্ষ থেকে যা দান করা হয়েছে, তৎসমূদয়ের ওপর। আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি না। আর আমরা তাঁরই আনুগত্যকারী।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৩৬]

“আর আমরা আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ, যা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। অতএব আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফয়সালা করুন।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৮]

“আর আমরা তাদের পেছনে মারিয়ামের পুত্র ঈসাকে প্রেরণ করেছি। তিনি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তাওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। আমি তাকে ইঞ্জীল প্রদান করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তাওরাতের-সত্যায়ন করে, পথ প্রদর্শন করে এবং এটি মুত্তাকীদের জন্যে হেদায়াত ও উপদেশবানী।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪৬]

“যারা আনুগত্য করে এ রাসূলের, যিনি নিরক্ষর নবী, যার সম্পর্কে তাদের নিজেদের কাছে রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জীলে লিখা দেখতে পায়, তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে, তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন ও নিষিদ্ধ করেন নিকৃষ্ট বস্তুসমূহ, আর তাদের ওপর থেকে সে বোঝা নামিয়েছেন এবং সে বন্দীত্ব অপসারণ করেন যা তাদের ওপর বিদ্যমান ছিল।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৭]

ইহুদীরা আশা করেছিল ইসলামের নবী আসবে তাদের বনী ইসরাইল গোত্র থেকে আর তাহলেই কেবল তারা ওই নবীর প্রতি ঈমান আনবে। কিন্তু তাদের স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায় গোত্রীয় হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি। এমনকি তারা আল্লাহর এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানিয়ে বসে। ইহুদীরা তাদের এ আচরণের মাধ্যমে ক্ষতিকর লেনদেনের স্বীকার হয়েছে। কারণ তারা প্রতিশ্রুত নবীর প্রতি ঈমান আনার জন্যে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল। এ জন্যে তাদেরকে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাই পরিণত হয় ইসলামের শত্রুতে। কেবল গোঁড়ামী আর হিংসার কারণেই তারা নবীর প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে এবং নিজেদেরকে বিক্রি করে হিংসার মূল্যে। এভাবে তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছুতে ব্যর্থ হয়।

“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণকে অস্বীকার করে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অস্বীকার করি এবং এরাই মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য অস্বীকারকারী। আর যারা সত্য অস্বীকারকারী তাদের জন্য তৈরী করে রেখেছি অপমানজনক শাস্তি।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৫০-১৫১]

যখন তাদেরকে বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তাতে বিশ্বাস কর। তারা বলে আমাদের নবীর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা তাতে বিশ্বাস করি। তা ছাড়া সব কিছুই তারা প্রত্যাখ্যান করে। যদিও এ কোরআন সত্য এবং তাদের কাছে যা আছে তা (কোরআনকে) সমর্থন করে। হে নবী! আপনি তাদের বলুন, যদি তোমরা অতীতে তোমাদের ওপর অবতীর্ণ হওয়া বিষয়ের প্রতি বিশ্বাসী হতে তবে কেন তোমরা অতীতে নবীদেরকে হত্যা করেছিলে?” (২:৯১

এ আয়াতে ইহুদীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ‘তোমরা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনছো না এ জন্যে যে, তিনি তোমাদের গোত্রের নন। তোমরা যদি সত্যিই ঐশি গ্রন্থ মেনে চল তবে কেন তোমরা অতীতে নবীদেরকে হত্যা করেছিলে? এ থেকে বোঝা যায় তোমরা মূলত: সত্যের বিরোধী ৷ ওই সত্য তোমাদের নবীই বলুক অথবা ইসলামের নবীই বলুক তাতে তোমাদের কিছু এসে যায় না৷ কোরআনের বাণীকে তোমরা যেমন অগ্রাহ্য করেছ তেমনি তওরাতের কথাও তোমরা গ্রহণ করনি।’

মূলত: আসমানী গ্রন্থের সব বিষয় এসেছে এক আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং সেসব কোন বিশেষ জাতি বা গোত্রের জন্যে আসেনি বরং এসেছে তাবত মানুষের জন্যে। তাই এটা কারো বলার অধিকার নেই যে, আমি কেবল আমার জাতির নবীকে অনুসরণ করব, অন্য কাউকে নয়। সব ঐশী ধর্মের বিষয়বস্তুর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এক এবং একটির সঙ্গে অন্যটির কোন বিরোধ নেই।

 

“আমার আয়াতের বিনিময়ে স্বল্প মূল্য গ্রহণ করো না” এর অর্থ এই নয় যে, বেশী মূল্য পেলে ইলাহী বিধানের বিনিময়ে তা গ্রহণ করো। বরং অর্থ হল, ইলাহী বিধানসমূহের মোকাবেলায় পার্থিব স্বার্থকে কোন প্রকার গুরুত্ব দিও না।

আল্লাহর বিধানসমূহের মূল্য এত বেশী যে, দুনিয়ার বিষয়-সম্পদ এর মোকাবেলায় খুবই তুচ্ছ; কিছুই না। উক্ত আয়াতে বানী-ইসরাঈলকে সম্বোধন করা হলেও এই নির্দেশ কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের জন্য। যে ব্যক্তি সত্যকে বাতিল, বাতিলকে প্রতিষ্ঠা অথবা জ্ঞানকে গোপন করার কাজে জড়িত হবে এবং কেবল পার্থিব স্বার্থের খাতিরে সত্য-প্রতিষ্ঠা করা ত্যাগ করবে, সেও এই ধমকের অন্তর্ভুক্ত। (ফাতহুল ক্বাদীর)

এ আয়াতটির অর্থ বুঝার জন্য সমকালীন আরবের শিক্ষাগত অবস্থাটা সামনে থাকা দরকার ৷ আরববাসীরা সাধারণভাবে ছিল অশিক্ষিত ৷ তাদের তুলনায় ইহুদিদের মধ্যে এমনিতেই শিক্ষার চর্চা ছিল অনেক বেশী ৷ তাছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইহুদিদের মধ্যে এমন অনেক বড় বড় আলেম ছিলেন যাদের খ্যাতি আরবের গন্ডী ছাড়িয়ে বিশ্ব পর্যায়ে ও ছড়িয়ে পড়েছিল ৷ তাই আরবদের ওপর ইহুদিদের ‘জ্ঞানগত’ প্রতিপত্তি ছিল অনেক বেশী ৷ এর ওপর ছিল আবার তাদের উলামা ও মাশায়েখের ধর্মীয় দরবারের বাহ্যিক শান –শওকত৷ এসব জাঁকালো দরবারে বসে তারা ঝাঁড়-ফুঁক, দোয়া-তাবিজ ইত্যাদির কারবার চালিয়েও জনগণের ওপর নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি গভীরতর ও ব্যাপকতর করেছিলেন ৷ বিশেষ করে মদীনাবাসীদের ওপর তাদের প্রভাব ছিল প্রচন্ড ৷ কারণ তাদের আশেপাশে ছিল বড় বড় ইহুদি গোত্রের আবাস ৷ ইহুদিদের সাথে তাদের রাতদিন ওঠাবসা ও মেলামেশা চলতো ৷ একটি অশিক্ষিত জনবসতি যেমন তার চাইতে বেশ শিক্ষিত , বেশী সংস্কৃতিবান ও বেশী সুস্পষ্ট ধর্মীয় গুণাবলীর অধিকারী প্রতিবেশীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে , এই মেলামেশায় মদীনাবাসীরাও ঠিক তেমনী ইহুদিদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে , এই মেলামেশায় মদীনাবাসীরাও ঠিক তেমনি ইহুদিদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল ৷

এ অবস্থায় নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নিজেকে নবী হিসেবে পেশ করলেন এবং লোকদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে থাকলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই অশিক্ষিত আরবরা আহলে কিতাব ইহুদিদের কাছে দিয়ে জিজ্ঞেস করতো, “আপনারাও তো একজন নবীর অনুসারী এবং একটি আসমানী কিতাব মেনে চলেন, আপনারাই বলুন, আমাদের মধ্যে এই যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করছেন তাঁর এবং তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে আপনাদের অভিমত কি? ” মক্কার লোকেরাও ইতিপূর্বে ইহুদিদের কাছে এ প্রশ্নটি বার বার করেছিল ৷

রসূলুল্লাহ সাল্লালাহু ওয়া সাল্লাম মদীনায় আসার পর এখানেও বহু লোক ইহুদি আলেমদের কাছে গিয়ে একথা জিজ্ঞেস করতো৷

কিন্তু ইহুদি আলেমরা কখনো এর জবাবে সত্য কথা বলেনি ৷ ডাহা মিথ্যা কথা তাদের জন্য কঠিন ছিল ৷ যেমন, মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে তাওহীদ পেশ করছেন তা মিথ্যা ৷ অথবা আম্বিয়া , আসমানী গ্রন্থসমূহ , ফেরেশতা ও আখেরাত সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য সঠিক নয় ৷ অথবা তিনি যে নৈতিক মূলনীতি শিক্ষা দিচ্ছেন তার মধ্যে কোন গলদ রয়ে গেছে৷ হবে যা কিছু তিনি পেশ করছেন তা সঠিক ও নির্ভুল—এ ধরনের স্পষ্ট ভাষায় সত্যের স্বীকৃতি দিতেও তারা প্রস্তুত ছিল না তারা প্রকাশ্য সত্যের প্রতিবাদ করতে পারছিল না আবার সোজাসুজি তাকে সত্য বলে মেনে নিতেও প্রস্তুত ছিল না ৷ এ দু’টি পথের মাঝখানে তারা তৃতীয় একটি পথ অবলম্বন করলো ৷ প্রত্যেক প্রশ্নকারীর মনে তারা নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম , তাঁর জামায়াত ও তাঁর মিশনের বিরুদ্ধে কোন না কোন অসঅসা-প্ররোচনা দিয়ে দিত ৷ তাঁর বিরুদ্ধে কোন না কোন অভিযোগ আনতো, এমন কোন ইংগিতপূর্ণ কথা বলতো যার ফলে লোকেরা সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে পড়ে যেতো৷ এভাবে তারা মানুষের এবং তাদের মাধ্যমে নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদেরকেও আটকাতে চাইতো ৷ তাদের এ দৃষ্টিভংগী ও কর্মনীতির কারণে তাদেরকে বলা হচ্ছেঃ সত্যের গায়ে মিথ্যার আবরণ চড়িয়ে দিয়ো না ৷ নিজেদের মিথ্যা প্রচারণা এবং শয়তানী সন্দেহ-সংশয় আপত্তির সাহায্য সত্যকে দাবিয়ে ও লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করো না ৷ সত্য ও মিথ্যা মিশ্রণ ঘটিয়ে দুনিয়াবাসীকে প্রতারিত করো না ৷

উক্ত আয়াত দিয়ে অনেকে বলতে চান যে কুর’আন সেখানোর বিনিময় নেয়া জায়েয নয়, আসলে কথাটা সঠিক নয়।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর ব্যাপকতা “তোমরা যে যে কাজের জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ কর এর মধ্যে আল্লাহর কিতাব সবচেয়ে উপযুক্ত”[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম]

২:৪২ وَ لَا تَلۡبِسُوا الۡحَقَّ بِالۡبَاطِلِ وَ تَکۡتُمُوا الۡحَقَّ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۴۲﴾

আর তোমরা হককে বাতিলের সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে হককে গোপন করো না।

কাতাদাহ ও হাসান বলেন, ‘হককে বাতিলের সাথে মিশ্রণ ঘটিয়ো না এর অর্থ ইয়াহুদীবাদ ও নাসারাবাদকে ইসলামের সাথে এক করে দেখবে না কেননা, আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন হচ্ছে, ইসলাম।

আর ইয়াহুদীবাদ ও নাসারাবাদ (খৃষ্টবাদ) হচ্ছে বিদ’আত বা নব উদ্ভাবিত বিষয়। সেটি কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। সুতরাং এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিভিন্ন ধর্মকে একাকার করে এক ধর্মে পরিণত করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে নাজায়েয। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

আবুল আলীয়াহ বলেন, এর অর্থ তোমরা হককে বাতিলের সাথে মিশ্রিত করো না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যাপারে আল্লাহর বান্দাদের কাছে নসীহত পূর্ণ কর। অর্থাৎ তোমাদের কিতাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা আল্লাহর বান্দাদের কাছে বর্ণনা কর। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

আল্লামা শানকীতী বলেন, তারা যে হককে বাতিলের সাথে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে তা হচ্ছে, তারা তাওরাতের কিছু অংশের উপর ঈমান এনেছে। আর যে বাতিলকে হকের সাথে মিশিয়েছে তা হচ্ছে, তারা তাওরাতের কিছু অংশের সাথে কুফরী করেছে এবং তা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যেমন, মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যে সমস্ত গুণাগুণসহ অনুরূপ যা কিছু তারা গোপন করেছে এবং মেনে নিতে অস্বীকার করেছে।

এর বর্ণনায় পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “তবে কি তোমরা কিতাবের কিছুর উপর ঈমান আন, আর কিছুর সাথে কুফরী কর” [সূরা আল-বাকারাহ: ৮৫] এ আয়াত দ্বারা আরও প্রমাণিত হয় যে, শ্রোতা এবং সম্বোধিত ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করে উপস্থাপন করা সম্পূর্ণ নাজায়েয।

২. ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এর অর্থ, তোমরা আমার রাসূল মুহাম্মাদ এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন তা সম্পর্কে যে জ্ঞান তোমাদের নিকট আছে তা গোপন কর না। অথচ তার সম্পর্কে তোমরা তোমাদের কাছে যে গ্রন্থ আছে তাতে নিশ্চিতভাবেই অনেক কিছু পাচ্ছ। [আত-তাফসীরুস সহীহ] মুজাহিদ বলেন, আহলে কিতাবগণ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গোপন করে থাকে। অথচ তারা তার ব্যাপারে তাওরাত ও ইঞ্জীলে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা পেয়ে থাকে। [তাবারী] এ আয়াত থেকে আরও প্রমাণিত হয়েছে যে, কোন ভয় বা লোভের বশবর্তী হয়ে সত্য গোপন করাও হারাম।

“অতএব, তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের দরুন আমি তাদের উপর অভিসম্পাত করেছি ও (নিজ রহমত থেকে তাদের দূরে রেখেছি) এবং তাদের অন্তরকে কঠোর করে দিয়েছি। তারা আল্লাহর কালামকে বিকৃত করে দেয় বা শব্দগুলোর আসল অর্থ বিকৃত করে এবং তাদেরকে যেসব উপদেশ দেয়া হয়েছিল, তার একাংশ তারা ভুলে গেছে বা তা থেকে উপকার লাভ করার বিষয়টি বিস্মৃত হয়েছে। আপনি সর্বদা তাদের কোন না কোন প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে অবগত হতে থাকেন, তাদের অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই এ ধরনের ষড়যন্ত্রে জড়িত ও তাদের হৃদয় কঠোর নয়। অতএব,হে নবী! আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদের ভুলগুলো মার্জনা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীল বা অনুগ্রহকারীদেরকে ভালবাসেন।” (৫:১৩)

 

সূরা ইনফিতার-নেক লোকেরা নিয়ামতে থাকবে, গুনাহগার জাহীমে থাকবে।

আল্লাহর রহমত কোথায় থাকে? মুহসেনাতের নিকটেই।

আল্লাহর কাছে সম্মানিত কে?

যে লোকের আদব আখলাক মানুষের সাথে উন্নত, গুনাহ থেকে দূরে থাকা, মানুষকে কষ্ট না দেয়া,সচেতন,স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে চলে।

কোন আমল আল্লাহ পছন্দ করেন?

ফরয আমল ঠিক মতো করা ও গুনাহ থেকে দূরে থাকা। গুনাহ থেকে দূরে থাকা অনেক বড় আমল। কোন দু’আ কবুল হয়?

অভাবী লোকদের দান করার পর যে দু’আ আসে।

কোন দান উত্তম?

এমন দান করা কম থাকাবস্থায় করা হয় ও খুব কশটে পতিত আছে তাকে দেয়া এবং খোটা না দেয়া।

কোন কথা ইনসাফপূর্ন?

সেই ব্যক্তির সামনে কথা বলা যার সামনে হক কথা বললে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

কে বুদ্ধিমান?

যে আল্লাহর আনুগত্যে চলে ও অন্যদের আহবান করে।

আহাম্মক কে?

সেই মুমিন যে ব্যক্তি অন্যদের হুকুম পালন করতে যেয়ে নফসের খায়েসাত পূর্ন করার জন্য যুলুম বা অন্যায় করে।

বিচারপতি ৩ ধরনের-

১। জান্নাতী- হক্বের উপর কায়েম থেকে ইনসাফ করে।

২। জাহান্নামী-হক জেনেই অন্যায় করে।

৩। জাহান্নামী- যে বুঝেনা জানেনা কিন্তু জুলুম করে

বর্তমান সমাজের বিচার ব্যবস্থা কি চিত্র বহন করে!!!

পূর্ব পুরুষরা যা করেছে ক্ষমতা লাভের জন্য, রক্ত ঝরিয়েছে, তাদের অবস্থা যদি জানতেন।

২:৪৩ وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَ ارۡکَعُوۡا مَعَ الرّٰکِعِیۡنَ

৪৩. আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা কর ও যাকাত দাও এবং রুকূ’কারীদের সাথে রুকূ কর।

হাসান বলেন, সালাত এমন এক ফরয যা না পাওয়া গেলে অন্য কোন আমলই কবুল করা হয় না। অনুরূপভাবে যাকাতও। [আত-তাফসীরুস সহীহ] আয়াতে বর্ণিত ‘রুকূ’ এর শাব্দিক অর্থ ঝুঁকা বা প্রণত হওয়া। এ অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে এ শব্দ সিজদার স্থলেও ব্যবহৃত হয়। কেননা, সেটাও ঝুঁকারই সর্বশেষ স্তর। কিন্তু শরীআতের পরিভাষায় ঐ বিশেষ ঝুঁকাকে রুকূ’ বলা হয়, যা সালাতের মধ্যে প্রচলিত ও পরিচিত। আয়াতের অর্থ এই যে, রুকূ’কারীগণের সাথে রুকূ কর। এখানে প্রণিধানযোগ্য এই যে, সালাতের সমগ্ৰ অংগ-প্রত্যংগের মধ্যে রুকূ’কে বিশেষভাবে কেন উল্লেখ করা হলো? উত্তর এই যে, এখানে সালাতের একটি অংশ উল্লেখ করে গোটা সালাতকেই বুঝানো হয়েছে। যেমন, কুরআনুল কারীমের এক জায়গায় (وَقُرْآنَ الْفَجْرِ) “ফজর সালাতের কুরআন পাঠ” বলে সম্পূর্ণ ফজরের সালাতকেই বুঝানো হয়েছে। তাছাড়া হাদীসের কোন কোন রেওয়াতে “সিজদা” শব্দ ব্যবহার করে পূর্ণ এক রাকাআত বা গোটা সালাতকেই বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এর মর্ম এই যে, সালাত আদায়কারীগণের সাথে সালাত আদায় কর। অর্থাৎ “রুকূ’কারীদের সাথে” শব্দদ্বয়ের দ্বারা জামা’আতের সাথে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

২:৪৪ اَتَاۡمُرُوۡنَ النَّاسَ بِالۡبِرِّ وَ تَنۡسَوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ تَتۡلُوۡنَ الۡکِتٰبَ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ

৪৪. তোমরা কি মানুষকে সৎকাজের নির্দেশ দাও, আর নিজেদের কথা ভুলে যাও! অথচ তোমরা কিতাব অধ্যয়ন কর। তবে কি তোমরা বুঝ না?

এ আয়াতে ইয়াহুদী আলেমদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। এতে তাদেরকে ভৎসনা করা হচ্ছে যে, তারা তো নিজেদের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করতে এবং ইসলামের উপর স্থির থাকতে নির্দেশ দেয়। এতে বুঝা যায় ইয়াহুদী আলেমগণ দ্বীন ইসলামকে নিশ্চিতভাবে সত্য বলে মনে করতো। কিন্তু নিজেরা প্রবৃত্তির কামনার দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত ছিল যে, ইসলাম গ্রহণ করতে কখনো প্রস্তুত ছিল না। মূলত: তারাই অপরকে পুণ্য ও মংগলের প্রেরণা দেয়, অথচ নিজের ক্ষেত্রে তা কার্যে পরিণত করে না, প্রকৃত প্রস্তাবে তারা সবাই ভৎসনা ও নিন্দাবাদের অন্তর্ভুক্ত।

এ শ্রেণীর লোকদের সম্পর্কে হাদীসে করুণ পরিণতি ও ভয়ংকর শাস্তির প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, মি’রাজের রাতে আমি এমন কিছুসংখ্যক লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের জিহ্বা ও ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল। আমি জিবরীল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? জিবরীল বললেন, এরা আপনার উম্মতের পার্থিব স্বার্থপূজার উপদেশদানকারী – যারা অপরকে তো সৎকাজের নির্দেশ দিত, কিন্তু নিজের খবর রাখতো না। [মুসনাদে আহমাদ ৩/১২০, সহীহ ইবনে হিব্বান: ৫৩]

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কিছুসংখ্যক জান্নাতবাসী অপর কিছুসংখ্যক জাহান্নামবাসীদেরকে অগ্নিদগ্ধ হতে দেখে জিজ্ঞেস করবেন যে, তোমরা কিভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করলে, অথচ আল্লাহর কসম, আমরা তো সেসব সৎকাজের দৌলতেই জান্নাত লাভ করেছি, যা তোমাদেরই কাছে শিখেছিলাম? জাহান্নামবাসীরা বলবে, আমরা মুখে অবশ্য বলতাম কিন্তু নিজে তা কাজে পরিণত করতাম না। [বুখারীঃ ৩২৬৭, মুসলিমঃ ২৯৮৯]

আল্লাহর রাসূলের পবিত্র জীবন উম্মতের সামনে। তিনি ছিলেন তাঁর দাওয়াতের বাসত্মব ও সর্বোত্তম নমুনা। তিনি ঈমানের দাওয়াত দিয়েছেন, তাঁর ঈমান ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। তিনি সালাতের দাওয়াত দিয়েছেন, তাঁর সালাত ছিল সবচেয়ে সুন্দর। তিনি সুন্দর আখলাকের কথা বলেছেন, তিনি ছিলেন সর্বোত্তম আখলাকের অধিকারী। এ কারণে ইসলামের যিনি দাঈ তাকে নিজের দাওয়াত সর্ব প্রথম নিজের মধ্যে বাসত্মবায়িত করতে হবে। এরপর নিজের নিকটজনদের মধ্যে বাসত্মবায়নের চেষ্টা করতে হবে। ইসলামের দাওয়াত কপটতার দাওয়াত নয় যে, অন্যরা সকল কাজ করুক, আমরা শুধূ সুফলটুকু ভোগ করব। ইসলামের দাওয়াত সত্যের দাওয়াত, যা সবাইকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে হবে এবং যথাযথভাবে পালন করতে হবে। অন্যথায় তার মুক্তির কোনো উপায় নেই। এ কারণে ইসলামে আত্ন-সংশোধনের এত গুরুত্ব। পরিবার-পরিজনের সংশোধনের চেষ্টার এত গুরুত্ব।  তবে এর অর্থ এই নয় যে, ঘরের লোক পুরাপুরি ঠিক হওয়ার আগে অন্যদের দাওয়াত  দেয়া যাবে না। দেয়া যাবে। কারণ আল্স্নাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দিয়েছেন। একই সাথে ঘরে-বাইরে দাওয়াত দিয়েছেন। গোত্রের লোকদেরও ডেকেছেন আবার অন্যদেরও ডেকেছেন। অন্যদের ডাকার জন্যে গোত্রের  সবার ঈমান আনার অপেক্ষা করেননি। কিছু লোককে দেখা যায়, দ্বীনের দাওয়াত এই বলে প্রত্যাখ্যান করে যে ‘ আগে নিজের ঘরের লোকদের ঠিক করুন।’ এটা ঠিক নয়।  কারণ, ঘরের লোকদের ঠিক করার শক্তি দাঈর নেই। তিনি চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু ঠিক করার মালিক আল্লাহ।

আল্লাহ বলেন

,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ

‘হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা কর না’ (ছফ ৬১/২)।

২:৪৫ وَ اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ ؕ وَ اِنَّهَا لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ

৪৫. আর তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। আর নিশ্চয় তা বিনয়ীরা ছাড়া অন্যদের উপর কঠিন।

সবর শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, বাধা দেয়া , বিরত রাখা ও বেঁধেঁ রাখা ৷ এ ক্ষেত্রে মজবুত ইচ্ছা , অবিচল সংকল্প ও প্রবৃত্তির আশা –আকাংখাকে এমনভাবে শৃংখলাবদ্ধ করা বুঝায়, যার ফলে এক ব্যক্তি প্রবৃত্তির তাড়না ও বাইরের সমস্যাবলীর মোকাবিলায় নিজের হৃদয় ও বিবেকের পছন্দনীয় পথে অনবরত এগিয়ে যেতে থাকে৷ এখানে আল্লাহর এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে , এই নৈতিক গুণটিকে নিজের মধ্যে লালন করা এবং বাইর থেকে একে শক্তিশালী করার জন্য নিয়মিত নামায পড়া ৷

আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই: মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও। [আল-বাক্বারাহ ১৫৫]

আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় সালাত অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে। [সূরা আল-আনকাবুত: ৪৫] এটা নিশ্চয় এক বিরাট সাহায্য।

তাছাড়া সালাতের মাধ্যমে রিযকের মধ্যে প্রশস্তি আসে। আল্লাহ বলেন, “আর আপনার পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দিন ও তাতে অবিচল থাকুন, আমরা আপনার কাছে কোন জীবনোপকরণ চাই না; আমরাই আপনাকে জীবনোপকরণ দেই এবং শুভ পরিণাম তো তাকওয়াতেই নিহিত [সূরা ত্বা-হা: ১৩২] আর এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন বিষয়ে সমস্যায় পড়তেন বা চিন্তাগ্রস্ত হতেন তখনই তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন”। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩৮৮]

সুতরাং যে কোন বিপদাপদে ও সমস্যায় সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্কটা তাজা করে নেয়ার মাধ্যমে সাহায্য লাভ করা যেতে পারে। সালফে সালেহীন তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও সত্যনিষ্ঠ ইমামগণ থেকে এ ব্যাপারে বহু ঘটনা বর্ণিত আছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার নিকট তার ভাই ‘কুছাম’ এর মৃত্যুর খবর পৌছল, তিনি তখন সফর অবস্থায় ছিলেন। তিনি তার বাহন থেকে নেমে দুরাকাআত সালাত আদায় করেন এবং এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন। আবার অনুরূপভাবে আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু অসুস্থ অবস্থায় পড়লে একবার এমনভাবে বেহুশ হয়ে যান যে সবাই ধারণা করে বসেছিল যে, তিনি বুঝি মারাই গেছেন। তখন তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মসজিদে গিয়ে আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৬৯]

২. কুরআন ও সুন্নায় যেখানে خُشُوْعٌ বা বিনয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদানের বর্ণনা রয়েছে, সেখানে এর অর্থ অক্ষমতা ও অপারগতাজনিত সেই মানসিক অবস্থাকেই বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহ্ তা’আলার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা ও দীনতার অনুভূতি থেকে সৃষ্টি হয়। এর ফলে ইবাদাত সহজতর হয়ে যায়। কখনো এর লক্ষণাদি দেহেও প্রকাশ পেতে থাকে। তখন সে শিষ্টাচারসম্পন্ন বিনম্র ও কোমলমন বলে পরিদৃষ্ট হয়। যদি হৃদয়ে আল্লাহভীতি ও নম্রতা না থাকে, মানুষ বাহ্যিকভাবে যতই শিষ্টাচারের অধিকারী ও বিনম্র হোক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে সে বিনয়ের অধিকারী হয় না। বিনয়ের লক্ষণাদি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ করাও বাঞ্ছনীয় নয়।

উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একবার এক যুবককে নতশিরে বসে থাকতে দেখে বললেন, মাথা উঠাও, বিনয় হৃদয়ে অবস্থান করে। ইবরাহীম নখয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘মোটা কাপড় পরা, মোটা খাওয়া এবং মাথা নত করে থাকাই বিনয় নয় خُشُوْعٌ বা বিনয় অর্থ ‘অধিকারের ক্ষেত্রে ইতর-ভদ্র নির্বিশেষে সবার সংগে একই রকম ব্যবহার করা এবং আল্লাহ্ তাআলা যা ফরয করে দিয়েছেন তা পালন করতে গিয়ে হৃদয়কে শুধু তারই জন্য নির্দিষ্ট ও কেন্দ্রিভূত করে নেয়া। সারকথা, ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম উপায়ে বিনয়ীদের রূপ ধারণ করা শয়তান ও প্রবৃত্তির প্রতারণা মাত্র। আর তা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। অবশ্য যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তবে তা ক্ষমার্হ।

ধৈর্য এবং নামায প্রত্যেক আল্লাহভীরু লোকের বড় হাতিয়ার। নামাযের মাধ্যমে একজন মুমিনের সম্পর্ক মহান আল্লাহর সাথে বলিষ্ঠ হয়। এরই দ্বারা সে আল্লাহর নিকট থেকে শক্তি ও সাহায্য লাভ করে। ধৈর্যের মাধ্যমে কার্যে সুদৃঢ় এবং দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রেরণা সৃষ্টি হয়।

হাদীসে এসেছে, নবী কারীম (সাঃ)-এর সামনে যখন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসে উপস্থিত হত, তখন তিনি সত্বর নামাযের শরণাপন্ন হতেন। (আহমদ, আবূ দাউদ, ফাতহুল ক্বাদীর)

নামাযের যত্ন নেওয়া সাধারণ মানুষের জন্য ভারী কাজ, কিন্তু বিনয়ী-নম্র মানুষের জন্য তা সহজ এবং নামায তাঁদের হূদয়ের প্রশান্তির উপকরণ। এই লোক কারা? এরা সেই লোক যাঁরা কিয়ামতের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখে। অর্থাৎ, কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস সৎকর্মসমূহকে সহজতর করে দেয় এবং আখেরাত থেকে উদাসীনতা।

ড সাইফুল্লাহঃ——–

আল্লাহ তাআলা সবরকে বানিয়েছেন তেজদীপ্ত অশ্ব যা কখনো হোঁচট খায় না। এমন ক্ষুরধার তরবারি, যা কখনো তেজ হারায় না এমন বিজয়ী সৈনিক যা কখনো পরাজিত হয় না এমন সুরক্ষিত দূর্গ যা কখনো ধ্বংস হয় না। সবর আর বিজয় দুই সহোদর ভাই। এমন কেউ নেই, যে সবরের অস্ত্রে সজ্জিত হয়েছে অথচ তার নাসফ অথবা শয়তান তাকে পরাহত করেছে। যার সবর নেই সে শক্তিহীন, পঙ্গু। যে ব্যক্তি তার জিহাদ-সংগ্রামে সবরকে সঙ্গী বানাবে না, সে পরাজিত হতে বাধ্য। তাইতো আল্লাহ তাআলা কালামে মাজীদে ইরশাদ ফরমান:

{أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ}

‘ হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য ধর ও ধৈর্যে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও’ (সূরা আলে-ইমরান: ২০০)।

সবর মুমিনের জন্য গৃহাপালিত জন্তু বেঁধে রাখার খুঁটির মতো। ইচ্ছামত এদিক সেদিক ঘোরে কিন্তু পরিশেষে তাকে সেই খুঁটির কাছেই ফিরে আসতে হয়। সবর ঈমানের শেকড়রে মতো। বৃক্ষ যেভাবে শেকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে ঈমানও তদ্রুপ সবরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। তাই যার সবর নেই তার পূর্ণ ঈমান নেই। সবরবিহীন ঈমানদার দ্বিধাগ্রস্ত ঈমানদার। এ ধরনের ঈমানদার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :

{وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انْقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ}

‘ মানুষের মধ্যে কতক এমন রয়েছে, যারা দ্বিধার সাথে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি তার কোন কল্যাণ হয় তবে সে তাতে প্রশান্ত হয়। আর যদি তার কোন বিপর্যয় ঘটে, তাহলে সে তার আসল চেহারায় ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি হল সুস্পষ্ট ক্ষতি’ (সূরা হজ: ১১)।

এ ব্যক্তি তো সবর হারিয়ে শুধু তার দুর্ভাগ্যই কামাই করলো। পক্ষান্তরে যে সবর করে, বিপদে ধৈর্য ধারণ করে সেই ভাগ্যবান। পৃথিবীতে যারা সুন্দর জীবন গড়তে পেরেছে, তারা সবরের গুণেই তা গড়েছে। তারা সর্বোচ্চ শেখরে আরোহন করেছে এই সবরের বদৌলতেই। তারা দুঃসময় এলে ধৈর্য ধারণ করে আর সুসময় এলে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করে। আর এভাবে তারা সবর ও শোকরের ডানায় চড়ে জান্নাতের অধিকারী হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন:

{ذَلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ}

‘এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল’ (সূরা হাদীদ: ২১)।

সবর বা ধৈর্য আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা যাকে এই গুণ দেন সেই এই গুণ ধারণ করার শক্তি অর্জন করে। নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালামদের আল্লাহ তাআলা এই বিরল গুণে ভূষিত করেছিলেন। তাই নবী-রাসূলগণই হলেন সবরের সকল আকার-প্রকৃতির উজ্জ্বলতম উদাহরণ।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা নব্বই জায়গায় সবরের কথা বলেছেন। অতএব ভেবে দেখুন সবর কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়! তিনি বিভিন্নভাবে সবরের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। নিচে তার কয়েকটি তুলে ধরছি -আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে সবরকারী তথা ধৈর্যশীলদের প্রশংসা করেছেন এবং তাদেরকে হিসাব ছাড়া প্রতিদান দেবেন বলে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে :

 

{قُلْ يَا عِبَادِ الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا رَبَّكُمْ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا فِي هَذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةٌ وَأَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةٌ إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ.}

বল, ‘হে আমার বান্দারা যারা ঈমান এনেছ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। যারা এ দুনিয়ায় ভাল কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ। আর আল্লাহর যমীন প্রশস্ত, কেবল ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেয়া হবে কোন হিসাব ছাড়াই’ (সূরা যুমার: ১০)।

আল্লাহ তাআলা বলেন, তিনি ধৈর্যশীলদের জন্য হিদায়েত ও সুস্পষ্ট বিজয় নিয়ে তাদের সাথেই আছেন। ইরশাদ হয়েছে :

{وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ.}

‘আর তোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’ (সূরা আনফাল: ৪৬)।

আল্লাহ তাআলা সবর ও ইয়াকীনের কারণে মানুষকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করেন।

ইরশাদ হয়েছে :

{وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يُوقِنُونَ.}

‘আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলাম, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত’ (সূরা আস-সাজদাহ: ২৪)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, সবরই মানুষের জন্য কল্যাণকর। ইরশাদ হয়েছে :

{وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ}

‘আর যদি তোমরা সবর কর, তবে তাই সবরকারীদের জন্য উত্তম’ (সূরা আন-নাহল : ১২৬)।

আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, কারও যদি সবর থাকে, তাহলে যত বড় শত্র“ই হোক তাকে হারাতে পারবে না। ইরশাদ হয়েছে :

{وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ}

‘ আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কোন ক্ষতি করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে, তা পরিবেষ্টনকারী’ (সূরা আলে-ইমরান : ১২০)।

আল্লাহ তাআলা বিজয় ও সফলতার জন্য সবর ও তাকওয়া অবলম্বনের শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন :

{يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

‘হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য ধর ও ধৈর্যে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও’ (সূরা আলে-ইমরান: ২০০)

আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলকে ভালোবাসেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? ইরশাদ হয়েছে :

{وَكَأَيِّنْ مِنْ نَبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ}

 

‘আর কত নবী ছিল, যার সাথে থেকে অনেক আল্লাহওয়ালা লড়াই করেছে। তবে আল্লাহর পথে তাদের ওপর যা আপতিত হয়েছে তার জন্য তারা হতোদ্যম হয়নি। আর তারা দুর্বল হয়নি এবং তারা নত হয়নি। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালবাসেন’ (সূরা আলে-ইমরান: ১৪৬)

আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলদের তিনটি বিষয়ে সুসংবাদ দিয়েছেন যার প্রতিটি বিষয় পাবার জন্য দুনিয়াবাসী একে অপরের সঙ্গে ইর্ষা করেন। ইরশাদ হয়েছে :

‘ আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রামণ করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত’ (সূরা আল বাকারা : ১৫৫-১৫৭)।

ধৈর্যশীলদের জন্য আল্লাহ তাআলা রেখেছেন জান্নাত লাভের কামিয়াবি আর জাহান্নাম থেকে মুক্তির সাফল্য। ইরশাদ হয়েছে :

{إِنِّي جَزَيْتُهُمُ الْيَوْمَ بِمَا صَبَرُوا أَنَّهُمْ هُمُ الْفَائِزُونَ}

‘ নিশ্চয় আমি তাদের ধৈর্যের কারণে আজ তাদেরকে পুরস্কৃত করলাম নিশ্চয় তারাই হল সফলকাম’ (সূরা মুমিনূন: ১১১)।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের চারটি স্থানে উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর নিদর্শনাবলী থেকে ধৈর্যশীল ও শোকরগুযার বান্দারাই উপকৃত হয় এবং তারাই সৌভাগ্যবান। যেমন সূরা লুকমানে ইরশাদ হয়েছে :

{أَلَمْ تَرَ أَنَّ الْفُلْكَ تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِنِعْمَةِ اللهِ لِيُرِيَكُمْ مِنْ آيَاتِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ}

‘ তুমি কি দেখনি যে, নৌযানগুলো আল্লাহর অনুগ্রহে সমুদ্রে চলাচল করে, যাতে তিনি তাঁর কিছু নিদর্শন তোমাদের দেখাতে পারেন। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে’ (আয়াত : ৩১)

সূরা ইবরাহীমে আল্লাহ তাআলা বলেন :

{وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَى بِآيَاتِنَا أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَذَكِّرْهُمْ بِأَيَّامِ اللَّهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ}

‘ আর আমি মূসাকে আমার আয়াতসমূহ দিয়ে পাঠিয়েছি যে, ‘তুমি তোমার কওমকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে বের করে আন এবং আল্লাহর বসসমূহ তাদের স্মরণ করিয়ে দাও’। নিশ্চয় এতে প্রতিটি ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য রয়েছে অসংখ্য নিদর্শন’ (আয়াত : ৫)।

সূরা সাবায় ইরশাদ হয়েছে :

{فَقَالُوا رَبَّنَا بَاعِدْ بَيْنَ أَسْفَارِنَا وَظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ فَجَعَلْنَاهُمْ أَحَادِيثَ وَمَزَّقْنَاهُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ}

‘কিন্তু তারা বলল, ‘হে আমাদের রব, আমাদের সফরের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিন’। আর তারা নিজদের প্রতি যুল্ম করল। ফলে আমি তাদেরকে কাহিনী বানালাম এবং তাদেরকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিলাম। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে’ (আয়াত : ১৯)।

সবর কী?

সবরের আভিধানিক অর্থ বাধা দেয়া বা বিরত রাখা। শরী‘আতের পরিভাষায় সবর বলা হয় অন্তরকে অস্থির হওয়া থেকে, জিহ্বাকে অভিযোগ করা থেকে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গাল চাপড়ানো ও বুকের কাপড় ছেঁড়া ইত্যাদি থেকে বিরত রাখা।

কারো কারো মতে, এটি হলো মানুষের অন্তরগত একটি উত্তম স্বভাব, যার মাধ্যমে সে অসুন্দর ও অনুত্তম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের একটি অন্তরগত শক্তি, যা দিয়ে সে নিজকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে পারে।

জুনায়েদ বাগদাদী রহ. কে সবর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘হাসি মুখে তিক্ততার ঢোক গেলা’।

যুন্নূন মিসরী রহ. বলেন, ‘আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ থেকে দূরে থাকা বিপদের সময় শান্ত থাকা এবং জীবনের কুরুক্ষেত্রে দারিদ্রের কষাঘাত সত্ত্বেও অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করা’। কারও মতে, ‘সবর হলো সুন্দরভাবে বিপদ মোকাবিলা করা’। আবার কারও মতে, ‘বিপদকালে অভিযোগ-অনুযোগ না করে অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করাই সবর’।

এক বুযুর্গ এক ব্যক্তিকে অন্যের কাছে তার সমস্যা নিয়ে অনুযোগ করতে শুনে বললেন, ‘তুমি ভাই এর বেশি কিছু করোনি যে, যিনি দয়া করেন না তার কাছে দয়াকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছ’। এ সম্পর্কে আরও বলা হয়, ‘তুমি যখন মানুষের কাছে অভিযোগ কর, তখন মূলত দয়াময়ের বিরুদ্ধে নির্দয়ের কাছেই অভিযোগ কর’।

অভিযোগ দু’টি পন্থায় করা হয়: একটি হলো, আল্লাহ তাআলার কাছে অনুযোগ করা। এটি সবর পরিপন্থী নয়। যেমন ইয়াকূব আলাইহিস সালাম প্রিয় পুত্র ইউসুফকে হারিয়ে বলেছেন, ‘আমি আল্লাহর কাছেই আমার দুঃখ বেদনার অভিযোগ জানাচ্ছি’।

অপরটি হলো, নিজের মুখ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভাষার মাধ্যমে মানুষের কাছে অভিযোগ করা। এটি সবর পরিপন্থী।

আমরা যে সবরের কথা আলোচনা করছি তা তিন প্রকারের। যথা

১. আল্লাহ তাআলার আদেশ-নির্দেশ পালন ও ইবাদত-বন্দেগী আদায় করতে গিয়ে ধৈর্যধারণ করা। ২. আল্লাহ তাআলার নিষেধ ও তাঁর বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করা এবং ৩. তাকদীর ও ভাগ্যের ভালো-মন্দে অসন্তুষ্ট না হয়ে তার ওপর ধৈর্যধারণ করা

এই তিন প্রকার সম্পর্কেই শায়খ আবদুল কাদির জিলানী রহ. তদীয় গ্রন্থ ‘ফুতুহুল গাইব’ এ বলেন, ‘একজন বান্দাকে অবশ্যই তিনটি বিষয়ে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে : কিছু আদেশ পালনে, কিছু নিষেধ থেকে বিরত থাকায় এবং ফয়সালাকৃত তাকদীরের ওপর’।

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত লুকমান আলাইহিস সালামের বিখ্যাত উপদেশেও এ তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে :

{ يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ }

‘ হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ’ (সূরা লুকমান : ১৭)।

লুকমান আলাইহিস সালাম যে ‘সৎকাজের আদেশ দাও’ বলেছেন, তার মধ্যে নিজে সৎ কাজ করা এবং অপরকে সৎ কাজের উপদেশ দেয়া উভয়টি অন্তর্ভুক্ত। তেমনি অসৎকাজে নিষেধ করার মধ্যেও উভয়টি রয়েছে। এখানে ‘সৎকাজের আদেশ’ ও ‘অসৎকাজে নিষেধ’ শব্দ থেকেই এমনটি বুঝা যায়। তাছাড়া শরীয়তের দৃষ্টিতেও ‘সৎকাজের আদেশ’ ও ‘অসৎকাজে নিষেধ’ বাস্তবায়িত হয় না, যতক্ষণ না আগে সে নিজে তা পালন করে। এ দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:

{ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ . الَّذِينَ يُوفُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَلَا يَنْقُضُونَ الْمِيثَاقَ وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ . وَالَّذِينَ صَبَرُوا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً وَيَدْرَءُونَ بِالْحَسَنَةِ السَّيِّئَةَ أُولَئِكَ لَهُمْ عُقْبَى الدَّارِ . }

‘ বুদ্ধিমানরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে। যারা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না’ আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করে, আর মন্দ হিসাবের আশঙ্কা করে। যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সবর করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিযক প্রদান করেছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং ভাল কাজের মাধ্যমে মন্দকে দূর করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখিরাতের শুভ পরিণাম (সূরা রা‘দ: ১৯-২২)।

 

বিপদে ধৈর্য ধারণ করার ফযীলত অনেক। তাই বলে শরীয়তে বিপদ কামনা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। কারণ মুমিন সচেতন ও বুদ্ধিমান। সে কখনো বিপদ প্রত্যাশা করতে পারে না। হ্যাঁ, বিপদ এসে পড়লে তাতে বিচলিতও হয় না বরং তাতে ধৈর্য ধারণ করে। বিপদের সময় সে সহনশীলতার পরিচয় দেয়। যেমন সহীহ বুখারীতে আবদুল্লাহ বিন আবূ আওফা রাযি.

থেকে বর্ণিত হয়েছে, যুদ্ধের দিনগুলোতে একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপেক্ষায় থাকলেন। যখন সূর্য ডুবে গেল তখন তিনি তাঁদের মাঝে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে লোকসকল, তোমরা শত্র“দের সঙ্গে মুখোমুখী হবার প্রত্যাশা করো না। আল্লাহ তাআলার কাছে শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করো। তবে যখন তোমরা তাদের মুখোমুখী হও, তখন ধৈর্য ধারণ করো এবং সবর করো। আর জেনে রেখো, জান্নাত তরবারির ছায়ার নিচে’ (বুখারী)।

! আপনারা কি সেই সাহাবীর কথা শুনেননি যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত অবস্থায় যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন? এ জন্যই কিন্তু আবু বকর সিদ্দীক রাযি. বলতেন, ‘আমার কাছে বিপদে পড়ে সবর করার চেয়ে সুখে থেকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করাই অধিক পছন্দনীয়’।

একজন প্রকৃত মুমিন কিন্তু সর্বাবস্থায় দৃঢ়ভাবে এ কথা বিশ্বাস করে যে, সে যে অবস্থায় আছে, তাতে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

যেমন মুসলিম শরীফে সুহাইব ইবন সিনান রাযি. থেকে মারফূ‘ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুমিনের অবস্থা কতইনা চমৎকার! তার সব অবস্থাতেই কল্যাণ থাকে। এটি শুধু মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য যে, যখন সে আনন্দে থাকে, তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে এবং যখন সে কষ্টে থাকে, তখন সবর করে। আর এ উভয় অবস্থাই তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।’

আমাদের মনে রাখতে হবে, মুমিনের পুরো জীবনই কিন্তু পরীক্ষা। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :

{ كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ }

‘ আর ভাল ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে’ (সূরা আম্বিয়া: ৩৫)।

আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাকে প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা করেন। তিনি দেখতে চান কে ধৈর্যশীল, কে মুজাহিদ আর কে সত্যবাদী। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

{ أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ }

‘তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জানেননি তাদেরকে, যারা তোমাদের মধ্য থেকে জিহাদ করেছে এবং জানেননি ধৈর্যশীলদেরকে’ (সূরা আলে-ইমরান: ১৪২)

আল্লাহ তাআলা মুমিনকে সম্পদ-সন্তান সব কিছু দিয়েই পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :

{ إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَاللهُ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ }

তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহর নিকটই মহান প্রতিদান’ (সূরা তাগাবুন: ১৫)।

২:৪৬ الَّذِیۡنَ یَظُنُّوۡنَ اَنَّهُمۡ مُّلٰقُوۡا رَبِّهِمۡ وَ اَنَّهُمۡ اِلَیۡهِ رٰجِعُوۡنَ

৪৬. যারা বিশ্বাস করে যে, নিশ্চয় তাদের রব-এর সাথে তাদের সাক্ষাত ঘটবে এবং নিশ্চয় তারা তারই দিকে ফিরে যাবে।

আয়াতে বর্ণিত ظَنٌّ শব্দটির অর্থ, মনে করা বা ধারনা করা। কিন্তু মুজাহিদ বলেন, কুরআনে যেখানে ظَنٌّ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সেখানেই নিশ্চিত জ্ঞানের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। [তাবারী, ইবনে কাসীর]

তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ظَنٌّ শব্দটি يَقِيْنٌ এর অর্থে ব্যবহৃত হলেও সবস্থানেই যে এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ব্যাপারটি এমন নয়, যেমন, সূরা আল-জাসিয়াহ ২৪, সূরা আল-বাকারাহ: ৭৮, সূরা আন-নিসা ১৫৭, সূরা আল আন’আম: ১১৬ [আত-তাফসীরুস সহীহ] তবে এখানে সমস্ত মুফাসসিরের মতেই ظَنٌّ শব্দটি يَقِيْنٌ বা নিশ্চিত বিশ্বাসের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। [আদওয়াউল বায়ান]

যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুগত নয় এবং আখেরাতে বিশ্বাস করে না , তার জন্য নিয়মিত নামায পড়া একটি আপদের শামিল ৷ এ ধরনের আপদে সে কখনো নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারে না ৷ কিন্তু যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সোপর্দ করেছে এবং যে ব্যক্তি মৃত্যুর পর তার মহান প্রভুর সামনে হাযির হবার কথা চিন্তা করে , তার জন্য নামায পড়া নয়, নামায ত্যাগ করাই কঠিন ৷