কুর’আন তেলাওয়াত এর হক
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
মহান রবুল আ’লামীনের অশেষ অনুগ্রহে আমরা জীবন বিধান হিসেবে পবিত্র আল কুর’আন পেয়েছি। জীবন চলার পথকে সহজ সুন্দর পবিত্র নিরাপদ করার জন্য এর বিকল্প নেই। দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা যে পথে নিহিত তা রবের পাঠানো এই কিতাব থেকেই জেনে, বুঝে, চিনে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে চলতে হবে। রবের কাছেই চাইতে থাকতে হবে এই পথের চলার সহজতা ও সফলতা।
আমরা মুসলিম পরিবারগুলোর মাঝে অনেক পরিবারেই এই ধরনের বক্তব্য শুনা যায়—
– কুর’আন শিখেছি হুজুরের কাছে, প্রতিদিনই অল্প পড়ি, খতমও দেই, আর প্রতি রমাদানেতো খতম দেই ই।
– ছেলে মেয়েকে হুজুর রেখে কুর’আন শিখিয়েছি, আমার ছেলে/মেয়ে দুই বা তিনবার খতম দিয়ে ফেলেছে।
– নিজে সময় পাইনা কিন্তু তাই বলে কি, মাদরাসা এতিমখানায় টাকা দিয়ে দেই কুর’আন খতম দেয়ার জন্য।
– রমাদান মাসেতো খতম তারাবীহ পড়ি।
এই হচ্ছে সমাজের অনেক অংশের চিত্র।
তবে আলহামদুলিল্লাহ ধীরে ধীরে এখন কুর’আন তেলাওয়াত বলতে কি বুঝায় বা কুর’আনকে কিভাবে পড়তে হবে তা অনেক মুসলিম পরিবারের সদস্যদের মাঝে উপলব্ধি, জ্ঞান ও সচেতনতা এসেছে।
একবার কি ভেবে দেখেছি, এই কুর’আন আমাদের সৃষ্টিকর্তার নিজস্ব নির্দেশনা যা তাঁর সৃষ্টির মাঝে অন্যতম মানুষ জাতির জীবন পরিচালনার জন্য পাঠিয়েছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন এর অনুসরনেই শান্তি মুক্তি।
ইরশাদ হয়েছে-
আমরা বললাম , “ তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও । এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত তোমাদের কাছে পৌছুবে তখন যারা আমার সেই হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোন ভয় দুঃখ বেদনা ৷
আর যারা একে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে তারা হবে আগুনের মধ্যে প্রবেশকারী ৷ সেখানে তারা থাকবে চিরকাল ৷(বাক্বারাহ ৩৮-৩৯)।
আল-কুরআন ((اَلْقُرْانُ শব্দটি আরবি, যা قَرْأٌ কিংবা قَرْنٌ শব্দ থেকে উৎপন্ন। قَرْأٌ (পড়া) শব্দ থেকে আসলে قُرْاَنُ শব্দের অর্থ হয় অধিক পঠিত।
আর قَرْنٌ (মিলিত থাকা) শব্দ থেকে আসলে قُرْاٰنُ শব্দের অর্থ হয়; পরিপূর্ণভাবে মিলিত ও সংযুক্ত। যেহেতু কুরআন মাজিদ সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ এবং এর আয়াত অর্থ ও বিষয়বস্তুর মাঝে পরিপূর্ণ মিল রয়েছে, তাই এর নাম اَلْقُرْاٰنُ।
পারিভাষিক ভাবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির হেদায়াতের জন্য জিবরাইল আলাইহিস সালাম এর মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াতের দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে যে কিতাব নাজিল হয়েছে তার সমষ্টি আল কুরআন।
পবিত্র কুরআনের মূল ৫টি নামের মধ্যে প্রধান নাম হলো কুরআন।
পবিত্র কুরআন এমন একটি গ্রন্থ, যা বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি পঠিত বা পড়া হয়। তাই কুরআনকে কোরআন নামকরণ করা হয়েছে। অথবা কুরআন এমন এক গ্রন্থ, যা মানুষের কল্যান-মুক্তি ও ইহ-পরলোকে শান্তির জন্য অবশ্যই পড়তে হবে, বুঝতে হবে, জানতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই কুরআনের নাম কুরআন রাখা হয়েছে। লিসানুল আরব, ১/১২৪; মু’জামুল ওয়াসীত, পৃ. ৭২২।
একবিংশ শতাদ্বীর অন্যতম কুরআন গবেষক আল্লামা তকি উসমানি বলেন, কুরআন নামটি মূলত অবিশ্বাসীদের প্রত্যাখ্যানের জবাবে রাখা হয়েছে।
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَسْمَعُوا لِهَٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ
‘তারা বলেছিলো- তোমরা এ কুরআন শুনো না। তা তেলাওয়াতের সময় হট্টগোল সৃষ্টি করো। সূরা হামিম আস সাজদাহ : ২৬।
এ সিদ্ধান্তের জবাবে ‘কুরআন’ নামটি এতই প্রসিদ্ধ হয়ে যায় যে, এটিই হয়ে ওঠে এ গ্রন্থের প্রধান নাম। অবিশ্বাসীরা চেয়েছিলো- এ গ্রন্থ যেন মানুষ না শোনে। আর আল্লাহ চেয়েছেন, এটিই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থ। তাই এর নামও রাখা হয়েছে আল কুরআন। অধিক পড়া হয় যে কিতাব।’ উলুমুল কুরআন : ১৮ পৃ.।
আজ আমরা কুর’আন তিলাওয়াত এর হক সম্পর্কে আমরা জানার চেষ্টা করি। (কুর’আন অধ্যয়ন সহায়িকা বই থেকে সংগৃহিত)
তিলাওয়াত এমন একটি শব্দ, যা কুরআন পড়ার কাজটি বোঝার জন্য কুরআনে ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজী বা অন্য কোন ভাষায় এক শব্দে সরাসরি এর অনুবাদ করা যায় না। ‘অনুসরণ’করা শব্দটির প্রাথমিক অর্থের সবচাইতে কাছাকাছি, পড়ার ব্যপারটি দ্বিতীয় পর্যায়ের। কেননা, পড়ার মধ্যেও শব্দ শব্দকে অনুসরণ করে, একটির পর আরেকটি অত্যন্ত গভীরভাবে, সুশৃংখল এবং তাৎপর্যময় ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। যদি একটি শব্দ অপরটিকে অনুসরণ না করে অথবা যদি বিন্যাস এবং ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে অর্থ বিকৃত হয়ে যায়।
সুতরাং প্রাথমিকভাবে তিলাওয়াত অর্থ ঘনিষ্ঠভাবে পশ্চাতে চলা, সামনে অগ্রসর হওয়া, ধারাবাহিকভাবে প্রবাহিত হওয়া, অভীষ্ট লক্ষয়ে পৌঁছার চেষ্টা চালানো, পথ-প্রদর্শোক, নেতা, প্রভু এবং আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা, কর্তৃত্ব গ্রহণ করা, স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা, আমল করা, পথ চলা, জীবন ব্যাবস্থার অনুশীলন করা, বুঝা, চিন্তার বাহনকে অনুসরণ করা অথবা অনুকরণ করা। কুরআন পাঠ করা, কুরআন বুঝা, কুরআন অনুসরণ করা। যারা দাবী করে যে, কুরআনের প্রতি তাদের বিশ্বাস আছে, এইভাবেই তারা নিজেদের জীবনকে এর সাথে সংশ্লিষ্ট করতে পারে।
তিলাওয়াত বা আবৃত্তি করা এমনই একটি কাজ যাতে একজন মানুষকে তার দেহ, হৃদয়, মন, ভাষা অর্থাৎ সংক্ষেপে গোটা মানবীয় অস্তিত্ব সহকারেই এতে অংশ নিতে হয়। কুরআন পড়তে দেহ ও মন, যুক্তি ও অনুভূতি তাদের পার্থক্য হারিয়ে ফেলে এবং সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। যখন জিহবার সাহায্যে আবৃত্তি করা হয়, তখন ঠোঁট থেকে শব্দ বের হয়ে আসে, মন চিন্তা করতে করতে থাকে, হৃদয় প্রতিফলিত করে, আত্মা গ্রহণ করে, চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হয়, শরীরে শিহরণ জাগে। আর এভাবেই সে তার প্রভুর আলোয় পথ চলে।
আল্লাহ অতি উত্তম কালাম নাযিল করেছেন- ইরশাদ হয়েছে
এ এমন এক কিতাব যার সমস্ত অংশ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যাতে বার বার একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তা শুনে তাদের গাত্রে লোমহর্ষণ দেখা দেয়, যারা নিজেদের আল্লাহকে ভয় করে। পরে তাদের দেহ ও তাদের দিল নরম হয়ে আল্লাহর স্মরণে উৎসাহী ও উৎসুক হয়ে ওঠে। এ হচ্ছে আল্লাহর হিদায়াত, এর দ্বারা তিনি হিদায়াতের পথে নিয়ে আসেন যাকে তিনি চান। আর আল্লাহ যাকে হিদায়াত না করেন, তার জন্য হিদায়াতকারী কেউ নেই। (আয-যুমার-৩৯ : ২৩)।
যেভাবে কুরআন পাঠ করা উচিৎ, সেভাবে কুরআন পড়া সহজ কাজ নয়, কিন্তু খুব কঠিন বা অসম্ভবও নয়। অন্যথায় আমাদের মত সাধারণ লোকদের জন্য কুরআন পাঠানো হতো না কিংবা কুরআন সত্যিকার অর্থে যে করুণা ও পথ-নির্দেশনা দিয়ে থাকে, তা কেউ পেত না। কিন্তু স্পষ্টতই কুরআন অধ্যয়নে অনিবার্যভাবে হৃদয় ও মন, দেহ ও আত্মার কঠিন পরিশ্রম হতে বাধ্য। তাছাড়া অভ্যন্তরীন ও বাহ্যিকভাবে কতগুলো শর্ত মেনে চলতে হবে এবং অনিবার্য দাবী পূরণ করতে হবে। কুরআনের মহিমান্বিত জগতে প্রবেশের আগেই ঐসব বিষয় জানতে এবং তা পালনে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
কেবলমাত্র তখনই মহান গ্রন্থ আল-কুরআনে মানুষের জন্য যে কল্যাণ ও মহিমা রয়েছে তা থেকে ফায়দা গ্রহণ বা ফল লাভ সম্ভব হবে। তখনই কুরআনের দরজা একজন মানুষের জন্য খুলে যাবে, কেবলমাত্র তখনই তিনি কুরআনের অভ্যন্তরে ঢুকতে পারবেন এবং কুরআন তার মধ্যে গভীর চিন্তা ও ভাবাবেগের উদ্রেক করবে। মায়ের গর্ভে নয় মাস অতিবাহিত করার পর এক ফোঁটা পানি হতে রূপান্তরিত হয়ে আপনি শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও চিন্তাশক্তির অধিকারী একজন জীবন্ত মানুষে পরিণত হন। আপনি কি কল্পনা করতে পারেন জীবনের কতটা সময় আপনি কুরআনের সাথে অতিবাহিত করতে পারেন- অনুসন্ধান, শ্রবণ, দেখা, চিন্তা ও সংগ্রাম করে এবং এটা আপনার জন্য কত প্রয়োজনে আসতে পারে। এটা আপনাকে এক সম্পূর্ণ নতুন মানুষে পরিণত করতে পারে
কুরআনে গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপ এবং কুরআনের সাথের মুহুর্তগুলো অতিক্রমের মাধ্যমে আপনি অনুভব করবেন যে, আপনি ঊর্ধ্বমুখে আরোহণ করছেন। কুরআনের প্রবহমাণ শক্তি ও সৌন্দর্য আপনাকে আঁকড়ে ধরবে এবং আপনি হৃদয় দিয়ে তা উপলদ্ধি করতে থাকবেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেছেন
কুরআনের সাথীকে বলা হবে, তিলাওয়াত কর এবং ঊর্ধ্বে আরোহণ কর। দৃঢ়ভাবে আরোহণ করতে থাকো ঠিক যেইভাবে সাবলীলভাবে তুমি কুরআন তিলাওয়াত করতে দুনিয়ায়। তোমার চূড়ান্ত প্রতীক্ষা হচ্ছে সেই উচ্চতা যা তুমি সর্বশেষ আয়াতে পাঠ করেছ। (আবু দাউদ, তিরমিযী, আহমাদ, নাসাঈ)।(উপরের অংশটুকু কুর’আন অধ্যয়ন সহায়িকা বই থেকে সংগৃহিত)
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-
﴿لَوْ أَنزَلْنَا هَٰذَا الْقُرْآنَ عَلَىٰ جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّهِ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ﴾
‘আমি যদি এই কুরআনকে কোন পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে তা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ছে এবং ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে৷ আমি মানুষের সামনে এসব উদাহরণ এ জন্য পেশ করি যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে’ সূরা হাশরঃ ২১’
কুরআন শুনে এবং কুরআন তেলাওয়াতের সময় অন্তর ভীত হওয়া আবশ্যক। কেননা কুরআন যদি পাহাড়ের উপর নাযিল করা হতো, তাহলে পাহাড় এত কঠিন ও মজবুত হওয়া সত্ত্বেও কুরআন বুঝার পর আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হতো এবং আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ফেটে যেত। সুতরাং আমাদের উপলব্ধি হওয়ার জন্য এতো সুন্দর সহজভাবে বুঝিয়েছেন, আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-
اَلَّذِیۡنَ اٰتَیۡنٰهُمُ الۡکِتٰبَ یَتۡلُوۡنَهٗ حَقَّ تِلَاوَتِهٖ ؕ اُولٰٓئِکَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِهٖ ؕ وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِهٖ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ
যাদেরকে আমরা কিতাব দিয়েছি, তাদের মধ্যে যারা যথাযথভাবে তা তিলাওয়াত করে, তারা তাতে ঈমান আনে। আর যারা তার সাথে কুফরী করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। সূরা বাকারাঃ ১২১
এখানে বলা হয়েছে যথাযথভাবে তেলাওয়াত করার কথা এর অর্থই হলো তেলাওয়াতের হক আদায় করেই তেলাওয়াত করতে হবে।
“কুর’আন তিলাওয়াত সম্বন্ধে আল্লাহ্ সাধারণভাবে যে আদেশ দিয়েছেন :
‘ওহীর মাধ্যমে কিতাবের যেটুকু তোমাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে তা তিলাওয়াত কর’ (সূরা আনকাবুত: ৪৫)
‘তোমাদের প্রভুর কিতাবের যা তোমাদের কাছে নাযিল করা হয়েছে তা আবৃত্তি কর’ (সূরা কাহফ:২৭)
আবূ উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে।(মুসলিম ১৯১০)
এবং তাঁর রাসূল (সা.) সম্বন্ধে আল্লাহর বাণী, ‘যারা আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে এবং কুর’আন তিলাওয়াত করবে, আমাকে তাদের মাঝে একজন হতে আদেশ করা হয়েছে’ (আল নামল: ৯১-৯২)
– এসবের সাথে সঙ্গতি রেখে একজন মুসলিমের উচিত, তার সামর্থ অনুযায়ী কুর’আন তিলাওয়াত অব্যাহত রাখা এবং যত ঘন ঘন সম্ভব তাতে আত্মনিয়োগ করা। তারা যথাযথভাবে তা পাঠ করে (তারা তার হক আদায় করে তেলাওয়াত করে) এর কয়েকটি অর্থ তাফসিরকারকরা বলেছেন। যেমনঃ
(ক) অত্যধিক একাগ্রতা ও মনোযোগের সাথে পড়ে। জান্নাতের কথা এলে জান্নাত কামনা করে এবং জাহান্নামের কথা এলে তা থেকে পানাহ চেয়ে নেয়।
(খ) তার হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম মনে করে এবং আল্লাহর কালামের কোন বিকৃতি ঘটায় না।
(গ) এতে যা কিছু লেখা আছে, তা সবই লোকমাঝে প্রচার করে, এর কোন কিছুই গোপন করে না। এর সুস্পষ্ট আয়াতগুলোর উপর আমল করে, অস্পষ্ট আয়াতগুলোর উপর ঈমান রাখে এবং যে কথাগুলো বুঝে আসে না, তা আলেমদের মাধ্যমে বুঝে নেয়।
(ঘ) এর প্রত্যেকটি কথার অনুসরণ করে। (ফাতহুল ক্বাদীর) বস্তুতঃ (উল্লিখিত) সব অর্থই যথাযথভাবে তেলাওয়াতের আওতায় পড়ে। আর হিদায়াত এমন লোকদের ভাগ্যেই জুটে, যারা উল্লিখিত কথাগুলির প্রতি যত্ন নেয়।
মোটকথা: আল্লাহর আয়াতকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করাই এর যথাযথ তেলাওয়াত বলে বিবেচিত হবে। [ইবনে কাসীর] যথাযথ তেলাওয়াতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনা এবং তার যাবতীয় আদেশ নিষেধ বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়া।
আমাদের ওপর কোরআনের যে হকগুলো রয়েছে তা এখানে আলোচনা করা হলো:
১. ঈমান আনা
২. সহীহভাবে পড়তে জানা
৩. তেলাওয়াত করা ও শ্রবণ করা
৪. বুঝা ও উপলব্ধি করা
৫. আমল করা (বাস্তবায়িত করা)
৬. অপরকে শিক্ষা দেয়া
৭. হিফয বা মুখস্ত করা
৮. যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়া
৯. কুরআনের দাওয়াত দেয়া ও এর নির্দেশনা প্রতিষ্ঠা করা।
(১) ঈমান আনা:
কুরআনের হকসমূহের মধ্যে প্রধানতম হক বা অধিকার হলো কুরআনের প্রতি ঈমান আনা। কুরআনের প্রতি ঈমান আনার অর্থ হলো, কুরআন আল্লাহর কালাম, এটি আসমানী শেষ কিতাব এবং এই কিতাবের মধ্য দিয়ে সকল আসমানী কিতাব রহিত হয়ে গিয়েছে। কুরআন বিশ্ব মানবমন্ডলীর জন্য হেদায়াত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর বা আলো। ইরশাদ হয়েছে-
‘অতএব তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং আমি যে নূর অবতীর্ণ করেছি তার প্রতি ঈমান আন। আর তোমরা যে আমল করছ আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।’ (সূরা আত-তাগাবুন : ০৮)।
আর এই ঈমান হতে হবে পূর্ণরুপে অর্থাৎ কিতাবের পুরু অংশ বাস্তবে আমল করার বিষয়ে নির্দেশনা এসেছে, কেউ কিছু মানা আর না মানার পরিনতি যা বলা হয়েছে কুর’আনে–
‘তোমরা কী কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর, সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লানত ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে! আর কিয়ামাতের দিন তাদেরকে কঠিনতম আজাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আর আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।’ (সূরা আল-বাকারাহ : ৮৫)।
(২) সহীহভাবে পড়তে জানা:
কুরআন শিক্ষা করা ফরজ করা হয়েছে। প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে, ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা আলাক : ১)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তা তেলাওয়াত কর’ (মুসনাদ আল-জামি: ৯৮৯০)।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, মহান আল্লাহ এভাবে উৎকর্ণ হয়ে কোন কথা শোনেন না, যেভাবে সেই মধুরকণ্ঠী পয়গম্বরের প্রতি উৎকর্ণ হয়ে শোনেন, যিনি মধুর কণ্ঠে উচ্চ স্বরে কুরআন মাজীদ পড়তেন।(বুখারী ৫০২৪, মুসলিম ১৮৮৩
(৩) তেলাওয়াত করা ও শুনা:
কুরআন তেলাওয়াত করা কুরআনের অন্যতম হক। কুরআন মাজীদে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তেলাওয়াত কর’ (সূরা আনকাবুত : ৪৫)। সহীহভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। তেলাওয়াতের আদবগুলো রক্ষা করতে হবে।
আবূ হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কুরআন সুন্দর উচ্চারণে পড়ে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে শামিল নয়’ (সহীহ বুখারী : ৭৫২৭)। ধীরস্থীরভাবে তেলাওয়াত করার নির্দেশ দিয়ে কুরআনে বলা হয়েছে।‘তুমি কুরআনকে তারতীলের সঙ্গে অর্থাৎ ধীর স্থীরভাবে তেলাওয়াত কর’ (সূরা আল-মুযযাম্মিল : ৪)।
আর কুরআন তেলাওয়াতে রয়েছে বিরাট সাওয়াব। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’ (সুনান আত-তিরমিযি : ২৯১০)।
তামীম দারী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এক রাতে একশ’টি আয়াত পাঠ করবে, সে ব্যক্তির আমলনামায় ঐ রাত্রির কিয়াম (নামাযের) সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে।
(আহমাদ ১৬৯৫৮, নাসাঈর কুবরা ১০৫৫৩, ত্বাবারানী ১২৩৮, দারেমী ৩৪৫০, সিলসিলাহ সহীহাহ ৬৪৪)
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করা হল, কুরআন পাঠে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আওয়াজ কার? উত্তরে তিনি বললেন, তার, যার কুরআন পাঠ করা শুনে মনে হয়, সে আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। (যুহদ, ইবনুল মুবারক, দারেমী ৩৪৮৯, ত্বাবারানী ৬৭৩)
খালিদ ইবনু ইয়াযীদ (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রতি বছর জিবরীল(আলাইহিস সালাম) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে একবার কুরআন শরীফ দাওর করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি ওফাত লাভ করেন সে বছর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে দু’বার দাওর করেন। প্রতি বছর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে দশ দিন ই’তিকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি ওফাত লাভ করেন সে বছর তিনি বিশ দিন ই’তিকাফ করেন। সহিহ বুখারিঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৪৬৩২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৯৯৮
ইসহাক … আবদুল্লাহ ইবনু আম্র (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “এক মাসে কুরআন খতম কর”। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশী করার শক্তি রাখি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে প্রতি সাত দিনে একবার খতম করো এবং এর চেয়ে কম সময়ের মধ্যে খতম করো না। সহিহ বুখারিঃ ই ফা নাম্বারঃ ৪৬৮৫, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫০৫৪
কুরআন তেলাওয়াত শুনাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, (হে ইবনে মাসঊদ!) আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনাকে পড়ে শোনাব, অথচ আপনার উপরে তা অবতীর্ণ করা হয়েছে?’ তিনি বললেন, অপরের মুখ থেকে (কুরআন পড়া) শুনতে আমি ভালবাসি। সুতরাং তাঁর সামনে আমি সূরা নিসা পড়তে লাগলাম, পড়তে পড়তে যখন এই (৪১) আয়াতে পৌঁছলাম—যার অর্থ, তখন তাদের কী অবস্থা হবে, যখন প্রত্যেক সম্প্রদায় থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকেও তাদের সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব? তখন তিনি বললেন, যথেষ্ট, এখন থাম। অতঃপর আমি তাঁর দিকে ফিরে দেখি, তাঁর নয়ন যুগল অশ্রু ঝরাচ্ছে।(বুখারী ৪৫৮২, মুসলিম ১৯০৩-১৯০৫)
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ اِذَا قُرِیٴَ الۡقُرۡاٰنُ فَاسۡتَمِعُوۡا لَهٗ وَ اَنۡصِتُوۡا لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ
‘আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা হবে।’ (সুরা আরাফ : ২০৪)
(৪) বুঝা ও উপলব্ধি করা:
কুরআনের অর্থ বুঝা ও অনুধাবন করা কুরআনের অন্যতম হক। কুরআনের অর্থ না বুঝতে পারলে কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য ও দাবী আমরা কেউ পালন করতে পারবো না। না বুঝে পড়লে কুরআনের আসল আনন্দ পাওয়া যাবে না। কুরআন বুঝার জন্য শব্দের অর্থ, আয়াতের ব্যাখ্যা, অবতীর্ণ হওয়ার কারণ বা প্রেক্ষাপট এবং আয়াতসমূহের শিক্ষা জানতে হবে। ইরশাদ হয়েছে ‘নিশ্চয় আমি একে আরবী কুরআনরূপে নাজিল করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার।’ (সূরা ইউসুফ: ০২)
কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে হাদিসের সাহায্য না নিলে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে হাদিসের সাহায্য নিলেই কেবল সহীহভাবে কুরআন বুঝা সম্ভব। সাহাবায়ে কেরাম উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)-কে রাসুল (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করলে,আয়েশা (রা.) বলেন, ‘তোমরা কী কুরআন পাঠ করো না? জেনে রাখো! পুরো কুরআনই হলো রাসুল (সা.)-এর চরিত্র।’ অর্থাৎ তিনি ছিলেন আল-কুরআনের বাস্তব নমুনা। (মুসনাদ আহমদ, : ২৫৮১৩)
আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও।’ (সূরা আল-হাশর: ৭)।
কুরআন বুঝার পাশাপাশি তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। ‘তবে কী তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে।’ (সূরা মুহাম্মাদ : ২৪)।
রমযানের মাস, এ মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে , যা মানব জাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত, যা সত্য –সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয় ৷ (সূরা বাক্বারা:১৮৫)
সুতরাং কুর’আন বুঝার মাধ্যমেই এইগুলো লাভ সম্ভব ইন শা আল্লাহ।
(৫) আমল করা:
কুরআনের আমল করার অর্থ, পূর্ণ অনুসরণ করা। এর নির্দেশনা অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাজিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর।’ (সূরা আল-আরাফ : ৩)।
কুরআনের জ্ঞানে পারদর্শী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কুরআনের দশটি আয়াত শিক্ষা গ্রহণ করতাম, এরপর ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরবর্তী দশটি আয়াত শিক্ষা করতাম না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই দশ আয়াতের ইলম ও আমল শিখতাম।’ (শরহে মুশকিলুল আছার : ১৪৫০)।
মহান আল্লাহ বলেন-وَ هٰذَا کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰهُ مُبٰرَکٌ فَاتَّبِعُوۡهُ وَ اتَّقُوۡا لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ
‘এ কিতাব (কুরআন) বরকতময়; যা আমি নাজিল করেছি। সুতরাং কুরআনের অনুসরণ কর এবং সাবধান হও, হয়তো তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে।’ (সুরা আনআম : ১৫৫)
(৬) অপরকে শিক্ষা দেয়া:
কুরআনের অন্যতম হক হলো তা অপরকে শিক্ষা দেয়া। আমাদের প্রিয় নবীর (সা.) অন্যতম কাজ ছিল মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেয়া। আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৬৪)।
কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। হাদিসে এসেছে, হজরত উসমান রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’ (সহীহ বুখারী : ৫০২৭)। যদি কেউ অপরকে কুরআন শিক্ষা দেয়, তবে তার জন্য শিক্ষাগ্রহণকারীর সমান সওয়াবের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘ভালো কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরুপ সাওয়াব পাবে।’ (সুনান আত-তিরমীযি : ২৬৭০)
(৭) হিফয বা মুখস্থ করা:
কুরআন হিফয করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহ তায়ালা নিজেই কুরআন হিফযের দায়িত্ব নিয়েছেন। এ হিফযেরই এক প্রকার হচ্ছে, বান্দাদেরকে কুরআন হিফয করানো। যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী।’ (সূরা আল-হিজর : ০৯)।
যে যত বেশি অংশ হিফয করতে পারবে তা তার জন্য ততই উত্তম। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কুরআনের হাফেযকে বলা হবে কুরআন পড়ে যাও, আর উপরে উঠতে থাক, ধীর-স্থিরভাবে তারতীলের সঙ্গে পাঠ কর, যেমন দুনিয়াতে তারতীলের সঙ্গে পাঠ করতে। কেননা জান্নাতে তোমার অবস্থান সেখানেই হবে, যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হয়।’ (সুনান আত-তিরমিযী : ২৯১৪)।
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কুরআনের (শুদ্ধভাবে পাঠকারী ও পানির মত হিফযকারী পাকা) হাফেয মহাসম্মানিত পুণ্যবান লিপিকার (ফিরিশতাবর্গের) সঙ্গী হবে। আর যে ব্যক্তি (পাকা হিফয না থাকার কারণে) কুরআন পাঠে ‘ওঁ-ওঁ’ করে এবং পড়তে কষ্টবোধ করে, তার জন্য রয়েছে দু’টি সওয়াব। (একটি তেলাওয়াত ও দ্বিতীয়টি কষ্টের দরুন।)(বুখারী ৪৯৩৭, মুসলিম ১৮৯৮)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দু’জনের ক্ষেত্রে ঈর্ষা করা সিদ্ধ। (১) যাকে আল্লাহ কুরআন (মুখস্থ করার শক্তি) দান করেছেন, সুতরাং সে ওর (আলোকে) দিবা-রাত্রি পড়ে ও আমল করে। (২) যাকে আল্লাহ তাআলা মালধন দান করেছেন এবং সে (আল্লাহর পথে) দিন-রাত ব্যয় করে।(বুখারী ৫০২৫, মুসলিম ১৯৩০)
আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এই কুরআনের প্রতি যত্ন নাও। (অর্থাৎ, নিয়মিত পড়তে থাক ও তার চর্চা রাখ।) সেই মহান সত্তার কসম, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন আছে, উট যেমন তার রশি থেকে অতর্কিতে বের হয়ে যায়, তার চেয়ে অধিক অতর্কিতে কুরআন (স্মৃতি থেকে) বের হয়ে (বিস্মৃত হয়ে) যায়। (অর্থাৎ, অতিশীঘ্র ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে।)(বুখারী ৫০৩৩, মুসলিম ১৮৮০)
মুহাম্মদ ইবনু আর’আরা (রহঃ) … আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এটা খুবই খারাপ কথা যে, তোমাদের মধ্যে কেউ বলবে, আমি কুরআনের অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি; বরং তাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং, তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করতে থাক কেননা, তা মানুষের অন্তর থেকে উটের চেয়েও দ্রুতবেগে চলে যায়। সহিহ বুখারিঃ ই ফা নাম্বারঃ ৪৬৬২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫০৩২
উক্ববাহ বিন আমের (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা সুফফাহ (মসজিদে নববীর এক বিষেশ জায়গা; যাতে দরিদ্র মুহাজিরগণ অবস্থান করতেন সেই স্থানে) ছিলাম। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গৃহ হতে বের হয়ে আমাদের নিকট এসে বললেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে কে পছন্দ করে যে, প্রত্যহ বুত্বহান (মদীনার নিকটবর্তী একটি জায়গা) অথবা আক্বীক্ব (মদীনার এক উপত্যকা) গিয়ে দুটি করে বড় বড় কুঁজবিশিষ্ট উটনী নিয়ে আসবে; যাতে কোন পাপ ও নাহক কারো অধিকার হরণও হবে না?’’ আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! এতো আমাদের প্রত্যেকেই পছন্দ করে।’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে সে মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাব থেকে দুটি আয়াত শিক্ষা অথবা (বুঝে) মুখস্থ করে না কেন? এটাই দুটি উষ্ট্রী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ! অনুরূপ ৩টি আয়াত ৩টি উষ্ট্রী, ৪টি আয়াত ৪টি উষ্ট্রী এবং এর চেয়ে অধিক সংখ্যক আয়াত ঐরূপ অধিক সংখ্যক উষ্ট্রী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ!’’(মুসলিম ৮০৩)
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কারো এ কথা বলা নিকৃষ্ট যে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি। বরং তাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।(বুখারী ৫০৩৯, মুসলিম ১৮৭৭)
(৮) যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়া:
কুরআন মাজীদ সম্মানিত এবং যারা কুরআনের সঙ্গে থাকবে তারাও সম্মানের অধিকারী। এজন্য কুরআনের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। কুরআন তেলাওয়াতের সময় তার হক আদায় করতে হবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তারাই তার প্রতি ঈমান আনে। আর যে তা অস্বীকার করে, সে-ই ক্ষতিগ্রস্থ।’ (সূরা আল-বাকারাহ : ১২১)।
কুরআনকে মহববত করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মহববত করার শামিল। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যে কুরআনকে মহববত করল সে যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মহববত করল।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ৩২৯)।
(৯) কুরআন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা:
কুরআনের প্রচার, প্রসার ও তা প্রতিষ্ঠার কাজ করা কুরআনের অন্যতম হক। নিজ ব্যবস্থাপনায় কুরআন শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, হিফয প্রতিযোগিতা, কুরআন বুঝার আসর, মকতব চালু করা, বিভিন্ন এলাকায় কুরআনের মুয়াল্লিম ঠিক করে শিক্ষার ব্যবস্থা করা, কুরআন হাদিয়া দেয়া, কুরআনের মুয়াল্লিম তৈরি করা, এই ধরনের কাজে নিয়োজিত সংস্থাকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা, এ কাজের অন্তর্ভুক্ত। সর্বোপরি কুরআনের বিধান সমাজে প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে।
‘আর আমি যেন আল-কুরআন অধ্যয়ন করি, অতঃপর যে হেদায়াত লাভ করল সে নিজের জন্য হেদায়াত লাভ করল; আর যে পথভ্রষ্ঠ হলো তাকে বল, আমিতো সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আন-নামল : ৯২)
‘হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও।’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৬৭)। কুরআন এমন একটি কিতাব যা নিয়ে ঈমানদার বান্দাহগণ আনন্দ প্রকাশ করতে পারে। ইরশাদ হয়েছে,
‘হে মানুষ! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত। বল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম।’ (সূরা ইউনুস : ৫৭-৫৮)।
আবূ সাইদ খুদরী রাদি আল্লাহু আনহু বলেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ হলো আল-কুরআন এবং এর অধিকারী হওয়াই রহমত।’ (শুয়াবুল ঈমান)।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখনই কোন সম্প্রদায় আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোন এক ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর গ্রন্থ (কুরআন) পাঠ করে, তা নিয়ে পরস্পরের মধ্যে অধ্যয়ন করে, তাহলে তাদের প্রতি (আল্লাহর পক্ষ থেকে) প্রশান্তি অবতীর্ণ হয় এবং তাদেরকে তাঁর রহমত ঢেকে নেয়, আর ফিরিশতাবর্গ তাদেরকে ঘিরে ফেলেন। আল্লাহ স্বয়ং তাঁর নিকটস্থ ফিরিশতামণ্ডলীর কাছে তাদের কথা আলোচনা করেন। (মুসলিম ৭০২৮, আবূ দাঊদ ১৪৫৭)
কিন্তু এরপরেও দেখা যায় আমাদের মুসলিম সমাজের অনেকের কুর’আনকে দিনের পর দিন ফেলেই রাখেন। আবার পড়লেও হক আদায় করে পড়েন না। একটি গ্রুপের কথা মহান আল্লাহ কুর’আনে জানিয়েছেন যারা কুর’আনকে পরিত্যাজ্য করেছে।
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন
وَ قَالَ الرَّسُوۡلُ یٰرَبِّ اِنَّ قَوۡمِی اتَّخَذُوۡا هٰذَا الۡقُرۡاٰنَ مَهۡجُوۡرًا
রসূল বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য মনে করেছে। সূরা ফুরকানঃ ৩০
একজন মুসলিম যে সব উপায়ে কুর’আন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে বলে ওলামারা চিহ্নিত করেছেন, তার যে কোনটির মাধ্যমেই কুর’আন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা,
সে সব সময় এড়িয়ে চলবে। [সূরা আল ফুরক্বানের ৩০ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা ও ‘মাহজুর’ শব্দের অর্থ সংক্রান্ত বর্ণনা ইবনে কাসীরের তাফসীর থেকে তুলে দিয়েছেন]।”
وَ قَالَ الرَّسُوۡلُ یٰرَبِّ اِنَّ قَوۡمِی اتَّخَذُوۡا هٰذَا الۡقُرۡاٰنَ مَهۡجُوۡرًا
রসূল বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় তো এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য মনে করেছে। সূরা ফুরকানঃ ৩০
আজকের দিনে যে কেউ যুক্তি সহকারে দেখিয়ে দিতে পারবেন রাসূলের (সা.) অনেক উম্মতই পবিত্র কুর’আনকে, অবজ্ঞার বা দূরে সরিয়ে রাখার মত এক বস্তুতে পরিণত করেছে। কোন মুসলিমই জেনে বুঝে এমন একটা কাজ করতে পারে না সত্যি। কিন্তু অসচেতন ভাবে একজন মুসলিম এ ধরনের একটা গর্হিত কাজও করতে পারে – আর এখানেই নিহিত রয়েছে আজকের বিশ্বের প্রধান সমস্যার একটি।
কুর’আনকে মাহজুর হিসেবে নেবার অনেক কারণ ও পদ্ধতি থাকতে পারে। নিম্নলিখিত উপায়ে আমরা কুর’আনকে এক অবহেলার বস্তুতে বা পরিহাসের বস্তুতে পরিণত করতে পারি বলে ইবনুল কাইয়্যিম মতামত ব্যক্ত করেছেন :
১। কুর’আন তিলাওয়াত না করা, এতে বিশ্বাস না করা, এর প্রতি মনোযোগ না দেওয়া অথবা এর প্রতি আকর্ষণ বোধ না করা।
২। পবিত্র কুর’আন যা কিছুকে হালাল অথবা হারাম বলে ঘোষণা করে, সেসব বিধিনিষেধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করা – যদিও বা কেউ নিয়মিত কুর’আন তিলাওয়াত করে এবং সেটাতে বিশ্বাসও করে।
৩। দ্বীনের মূল ও আনুষঙ্গিক সকল বিষয়ে পবিত্র কুর’আনকে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী হিসাবে না মানা – অথবা কুর’আনের প্রতিটি বিষয়ে নিশ্চিত বিশ্বাসকে অপরিহার্য মনে না করা।
৪। এর অর্থ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা না করা, তা বুঝতে ব্যর্থ হওয়া এবং আল্লাহ্ কুর’আনের পাঠকের কাছ থেকে কি ধরনের কার্যকলাপ দাবী করেন তা জানতে ব্যর্থ হওয়া।
৫। অন্তরের রোগসমূহের নিরাময়ে পবিত্র কুর’আনকে ব্যবহার না করে, অন্যান্য উৎসের কাছে রোগ নিরাময়ের প্রত্যাশায় ছুটে যাওয়া।
ইবনুল কাইয়্যিম যেসব বলেছেন তা ছাড়াও আরেকটি গুরুতর উপায়ে আমরা কুর’আনকে মাহজুর হিসেবে দেখে থাকি – যেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা ব্যাপার, কারণ কেউ হয়তো ব্যাপারটা বুঝতেই পারবেন না অথবা স্বীকারও করতে চাইবেন না – সেটা হচ্ছে এই যে, কুর’আনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে একপাশে সরিয়ে রেখে, গৌণ ব্যাপারগুলোকে মুখ্য মনে করা এবং সেগুলোর ব্যাপারে সর্বতোভাবে মনোনিয়োগ করা বা কেবল সেগুলো নিয়েই মেতে থাকা।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) কে এক ব্যক্তি বলল, ‘আমি এক রাকআতে মুফাস্স্বাল (সূরা ক্বাফ থেকে সূরা নাস পর্যন্ত অংশ) পাঠ করি।’ এ কথা শুনে তিনি বললেন, ‘কবিতা আওড়ানোর মত পড়? কিছু সম্প্রদায় আছে যারা কুরআন পড়ে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠের নিচে নামে না। আসলে সেই কুরআন পাঠ কাজে দেবে, যা হৃদয়ে এসে গেঁথে যাবে এবং তা পাঠকারীকে উপকৃত করবে—। (বুখারী ৭৭৫, মুসলিম ১৯৪৫)
আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সে ব্যক্তি কুরআন বুঝে না, যে তিন দিনের কম সময়ে তা খতম করে।(আবূ দাঊদ ১৩৯৬, তিরমিযী ২৯৪৯, ইবনে মাজাহ প্রমুখ, সহীহুল জামে’ ৭৭৪৩)
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে (সূরা মারয়্যামের ৫৯ আয়াত পাঠ করার পর) বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘‘ষাট বছর পর কিছু অপদার্থ পরবর্তীগণ আসবে, তারা নামায নষ্ট করবে ও প্রবৃত্তিপরায়ণ হবে; সুতরাং তারা অচিরেই অমঙ্গল প্রত্যক্ষ করবে। অতঃপর এক জাতি আসবে, যারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠের অক্ষকাস্থি পার হবে না। (হৃদয়ে জায়গা পাবে না।) কুরআন তিন ব্যক্তি পাঠ করে; মু’মিন, মুনাফিক ও ফাজের।’’
বর্ণনাকারী বাশীর বলেন, আমি অলীদকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওরা তিন ব্যক্তি কে কে?’ তিনি বললেন, ‘মুনাফিক তা অস্বীকার করে, ফাজের তার অসীলায় পেট চালায় এবং মু’মিন তার প্রতি ঈমান রাখে।’(আহমাদ ১১৩৬০, হাকেম ৩৪১৬, ৮৬৪৩, সিলসিলাহ সহীহাহ ১/২৫৭)
মুমিনদের প্রতি আহবান––
দ্বীন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাসমূহের একটি হচ্ছে ‘আল ওয়ালার’ ধারণা – আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ধারণা – আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করার ধারণা। রাসূল (সা.) বলেছেন :
“ঈমানের সবচেয়ে শক্ত বন্ধন হচ্ছে আল্লাহর ওয়াস্তে আনুগত্য, আল্লাহর জন্য অন্যের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করা, আল্লাহর জন্য (কাউকে) ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্য (কাউকে) ঘৃণা করা।” (আল তায়ালিসী, আল-হাকিম, আল-তাবারানী ইত্যাদি – আলবানীর মতে সহীহ)
আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের(সা.) প্রতি একজন ব্যক্তির যে ভালবাসা, তাই হচ্ছে কুর’আনের প্রতি তার ভালবাসার উৎস। কারো পক্ষে এরকম হওয়া সম্ভব নয় যে, সে আল্লাহকে ভালবাসবে অথচ আল্লাহর বাণী এবং মানবকুলের কাছে তাঁর ওহীকে ভালবাসবে না। বরং কেউ যে কুর’আনকে ভালবাসে, তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকেও (সা.) ভালবাসে।
বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, “কেউ যদি পরখ করতে চায় যে, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল(সা.)-কে ভালবাসে কিনা, তবে তার উচিত এই ব্যাপারটা যাচাই করা যে সে কুর’আন ভালবাসে কিনা – যদি সে কুর’আন ভালবাসে, তবে সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে।” (আল-তাবারানী)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি চায় যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে (অধিক) ভালবাসুক (অথবা আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাকে ভালবাসুন), সে যেন কুরআন দেখে পাঠ করে।(বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান ২২১৯, সিলসিলাহ সহীহাহ ২৩৪২)
আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানবমণ্ডলীর মধ্য হতে আল্লাহর কিছু বিশিষ্ট লোক আছে; আহলে কুরআন (কুরআন বুঝে পাঠকারী ও তদনুযায়ী আমলকারী ব্যক্তিরাই) হল আল্লাহর বিশেষ ও খাস লোক।(আহমাদ ১২২৭৯, নাসাঈ, বাইহাক্বী, হাকেম, সহীহুল জামে ২১৬৫)
কুর’আনের প্রতি কারো দায়-দায়িত্বের ব্যাপারে রাসূলের (সা.) একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীসে তিনি বলেন :
“দ্বীন হচ্ছে নসীহাত।” লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো, “কার প্রতি?” নবী (সা.) উত্তর দিলেন, “আল্লাহর প্রতি ও তাঁর কিতাবের প্রতি, এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ও মুসলিমদের নেতৃবৃন্দের প্রতি এবং সাধারণ মুসলিমদের প্রতি।” (মুসলিম)
এই হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন যে, কারো আল্লাহর কিতাবের নসীহাত করা উচিত।
নসীহাত হচ্ছে এমন একটি শব্দ যার ভাষান্তর করা দুরূহ। শব্দটির ভাষাগত মূল ও কুর’আনে এর ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে আল রাগিব আল ইসফাহানী এর শরীয়াভিত্তিক সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে : “নসীহাত হচ্ছে এমন একটা কর্মপন্থা বা বক্তব্যের সন্ধান করা যাতে অপর ব্যক্তির জন্য কল্যাণ ও উৎকর্ষের ব্যাপার রয়েছে।” ইবনে আল সালাহ বলেছেন যে, নসীহাতের অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে এরকম যে, যিনি নসীহাত (বিশ্বস্তভাবে অন্যের মঙ্গল কামনা করা) করছেন, তিনি সত্যি সত্যি যাকে নসীহাত করছেন, তার জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম কল্যাণ কামনা করছেন। আরেকভাবে বলতে গেলে তার নিয়তে ও তার কর্মে তিনি অপর সেই ব্যক্তির জন্য সর্বোত্তম মঙ্গল
কুর’আনের প্রতি বিশ্বাসীদের এই ধরনের মনোভাব থাকা উচিত। অর্থাৎ, কুর’আনের প্রতি আচরণে একজন বিশ্বাসীর বিশ্বস্ত হওয়া উচিত এবং এমন কাজ করা উচিত যা “এর জন্য কল্যাণকর” – এখানে যা র অর্থ হবে এটা পড়া, এটা বোঝা, এবং জীবনে এর প্রয়োজন ইত্যাদি ইত্যাদি।
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اسۡتَجِیۡبُوۡا لِلّٰهِ وَ لِلرَّسُوۡلِ اِذَا دَعَاکُمۡ لِمَا یُحۡیِیۡکُمۡ
হে ঈমানদারগণ, রাসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে ডাকে যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে তখন তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের ডাকে সাড়া দেবে। আনফালঃ ২৪
….যে কেউ আমার দিক-নির্দেশনা অনুসরণ করলে তাদের জন্য ভয়ের বা দুঃখের কোন কারণ থাকবে না। যারা অবিশ্বাসী এবং যারা আমাদের আয়াতসমূহের ব্যাপারে মিথ্যা আরোপ করে, তারা হচ্ছে জ্বলন্ত আগুনের বাসিন্দা এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে।” (সূরা বাক্বারা: ৩৮-৩৯)
“তোমরা যারা ঈমান এনেছো! আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও যখন তাঁরা তোমাদের, যা তোমাদের জীবন দান করে, তার দিকে ডাকেন।….” (সূরা আনফাল: ২৪)
“নিশ্চয়ই এই কুর’আন যা সবচেয়ে সঠিক তার দিকেই পরিচালিত করে এবং ঐ বিশ্বাসীদের চমৎকার পুরস্কারের সুসংবাদ দেয় যারা সৎকাজ করে। আর যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের জন্য আমরা যে বাস্তবিকই এক কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করেছি, এটা তারও ঘোষণা দেয়।” (সূরা আল-ইসরা : ৯-১০)
“এবং এটা হচ্ছে এমন একটি কিতাব, যা আমরা এক রহমত স্বরূপ তোমাদের কাছে প্রেরণ করেছি : সুতরাং এটা অনুসরণ কর ও ন্যায়পরায়ণ হও – যেন তোমরা রহমত লাভ করতে পার।” (সূরা আন্‘আম :১৫৫
আবূ মূসা আল আশ্‘আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআন পাঠকারী মু’মিনের দৃষ্টান্ত হলো তুরঞ্জ ফল বা কমলা লেবুর ন্যায়। যার গন্ধ ভাল, স্বাদও উত্তম। যে মু’মিন কুরআন পড়ে না, তার দৃষ্টান্ত হলো খেজুরের ন্যায়। এর কোন গন্ধ নেই বটে, কিন্তু উত্তম স্বাদ আছে। কুরআন পাঠ করে না যে মুনাফিক, সে হানাযালাহ্ (তিতা) ফলের মতো, যার কোন গন্ধ নেই অথচ স্বাদ তিতা। আর ওই মুনাফিক যে কুরআন পড়ে তার দৃষ্টান্ত ঐ ফুলের মতো, যার গন্ধ আছে কিন্তু স্বাদ তিতা। (বুখারী, মুসলিম।)
অন্য এক বর্ণনায় আছে, যে মু’মিন, কুরআন পড়ে ও সে অনুযায়ী ‘আমল করে সে কমলা লেবুর মতো। আর যে মু’মিন কুরআন পড়ে না, কিন্তু এর উপর ‘আমল করে সে খেজুরের মতো।) সহীহ বুখারী ৫৪২৭, ৫০৫৯, মুসলিম ৭৯৭,
মুহাম্মদ বিন হুসাইন (তিনিই আজুর্রি) বলেন: আপনাদের প্রতি আল্লাহ্ রহম করুন! আপনারা কি দেখছেন না যে, আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর বাণী অনুধাবন করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করছেন। যে ব্যক্তি তাঁর বাণী অনুধাবন করে সে রব্বকে চিনতে পারে, তাঁর মহা ক্ষমতা ও শক্তি জানতে পারে, ঈমানদারদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ অবগত হতে পারে, জানতে পারে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের উপর যা কিছু ফরয করেছেন; তখন ওয়াজিব পালন করাকে সে নিজের উপর অবধারিত করে নেয় এবং তার মহান মনিব যা কিছু থেকে থেকে সতর্ক করেছেন সেটা থেকে সতর্ক হয় এবং যা কিছুর প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন সেগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়।
নিজে কুরআন তেলাওয়াত করার সময় কিংবা অন্যের তেলাওয়াত শ্রবণ করার সময় যে ব্যক্তির অবস্থা এমন হবে তার জন্য কুরআন নিরাময়ক। সে ব্যক্তির সম্পদ না থাকলেও সে ধনী। আত্মীয়-স্বজন না থাকলেও সে শক্তিমান। যখন অন্যেরা নির্জনতা অনুভব করে তখন সে তা অনুভব করে না। সে যখন কোন সূরা পড়া শুরু করে তখন তার লক্ষ্য থাকে কখন আমি যা তেলাওয়াত করছি সেটা থেকে নসীহত গ্রহণ করতে পারব? তার উদ্দেশ্য এটা থাকে না যে কখন আমি সূরাটি শেষ করতে পারব? তার উদ্দেশ্য থাকে কখন আমি আল্লাহ্র ভাষ্য উপলব্ধি করতে পারব? কখন আমি (নিষেধ) থেকে বিরত হব? কখন আমি শিক্ষা গ্রহণ করব? কেননা তার কুরআন তেলাওয়াত হচ্ছে- ইবাদত। গাফলতি নিয়ে কোন ইবাদত হয় না। আল্লাহ্ই তাওফিকদাতা।[“আখলাকু হামালাতিল কুরআন”, পৃষ্ঠা-৩]
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে যা পাঠ করতেন- কিছু বর্ননা জানা যায়।
১ম যে কোন সময় রাতে
সূরা সাজদা, মূলক, যুমার, বনী ইসরাইল, কাফেরুন, ইখলাস
২য় নির্দিষ্ট——– ঘুমের পূর্বে (কাফেরুন, ইখলাস, ফালাক, নাস)
আয়াত যা তেলাওয়াত করতেন—
ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে—আয়াতুল কুরসী ও সূরা বাকারার শেষ ২ আয়াত
রাতের যখন ঘুম থেকে উঠতেন বিশেষ করে তাহাজ্জুদের সময়- সূরা আলে ইমরান ১৯১-২০০
মাগরিব সালাতঃ সূরা তুর
ইশা সালাতেঃ সূরা ত্বীন
জুমুয়ার দিনঃ জুময়া, মুনাফিকুন সূরা
সুরা ফাতিহাঃ
আলী ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) … আবূ সাঈদ ইবনু মু’আল্লা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সালাত (নামায/নামাজ)-রত ছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলেন; কিন্তু আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম না। পরে আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি সালাতরত ছিলাম। তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা কি বলেননি, “হে মু’মিনগণ, আল্লাহ ও রাসূল যখন তোমাদেরকে আহবান করেন তখন আল্লাহ ও রাসূলের আহবানে সাড়া দাও”। তারপর তিনি বললেন, মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে আমি কি তোমাকে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা শিক্ষা দেব না? তখন তিনি আমার হাত ধরলেন। যখন আমরা মসজিদ থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করলাম তখন আমি বললাম, ইয়া, রাসূলাল্লাহ! আপনি তো বলেছেন মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে আমাকে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরার কথা বলবেন। তিনি বললেন, তা হলঃ “আল হামদুলিল্লাহ রাব্বিল আলামীন”। এটা বারবার পঠিত সাতটি আয়াত (সাবআ মাছানী) এবং কুরআন আজীম যা আমাকে দেয়া হয়েছে। সহিহ বুখারি, ই ফা নাম্বারঃ ৪৬৪০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫০০৬
বাকারা ও আলে ইমরানঃ
আবু উমামাহ বাহেলী (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে শুনেছি, তিনি বলেছেন, তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা, তা কিয়ামতের দিন তার পাঠকারীদের জন্য সুপারিশকারীরূপে উপস্থিত হবে। তোমরা দুই জ্যোতির্ময় সূরা; বাক্বারাহ ও আ-লে ইমরান পাঠ কর। কারণ উভয়েই মেঘ অথবা উড়ন্ত পাখীর ঝাঁকের ন্যায় কিয়ামতের দিন উপস্থিত হয়ে তাদের পাঠকারীদের হয়ে (আল্লাহর নিকট) হুজ্জত করবে। তোমরা সূরা বাক্বারাহ পাঠ কর। কারণ তা গ্রহণ করায় বরকত এবং বর্জন করায় পরিতাপ আছে। আর বাতেলপন্থীরা এর মোকাবেলা করতে পারে না। মুআবিয়াহ বিন সাল্লাম বলেন, আমি শুনেছি যে, বাতেলপন্থীরা অর্থাৎ যাদুকরদল।(মুসলিম ১৯১০)
নাউওয়াস বিন সামআন কিলাবী (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন কুরআনকে হাজির করা হবে এবং আহলে কুরআনকেও; যারা তার মুতাবেক আমল করত। যার সর্বাগ্রে থাকবে সূরা বাক্বারাহ ও আ-লে ইমরান। আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সূরা দুটি যেরূপ হাজির হবে তার) তিনটি উদাহরণ দিয়েছেন, আমি এখনও ভুলে যাইনি; তিনি বলেছেন, যেন সে দুটি দুই খণ্ড মেঘ অথবা কালো ছায়া যার মাঝে থাকবে দীপ্তি, অথবা যেন উড়ন্ত পাখীর ঝাঁক; উভয়েই তাদের সপক্ষে (পরিত্রাণের জন্য আল্লাহর নিকট) হুজ্জত করবে। (মুসলিম ১৯১২)
আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা নিজেদের ঘর-বাড়িগুলোকে কবরে পরিণত করো না। কেননা, যে বাড়িতে সূরা বাক্বারাহ পাঠ করা হয়, সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে।
(অর্থাৎ সুন্নাত ও নফল নামায তথা পবিত্র কুরআন পড়া ত্যাগ ক’রে ঘরকে কবর বানিয়ে দিয়ো না। যেহেতু কবরে এ সব বৈধ নয়।)(মুসলিম ১৮৬০)
আয়াতুল কুরসীঃ
আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয নামাযের পশ্চাতে ‘আয়াতুল কুরসী’ পাঠ করবে, সে ব্যক্তির জন্য তার মৃত্যু ছাড়া আর অন্য কিছু জান্নাত প্রবেশের পথে বাধা হবে না।
(নাসাঈ কুবরা ৯৯২৮, ত্বাবারানী ৭৫৩২, সহীহুল জামে ৬৪৬৪)
উসমান ইব্ন হায়সাম (রহঃ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রমযানে প্রাপ্ত যাকাতের মাল হেফাজতের দায়িত্ব দিলেন। এ সময় জনৈক ব্যাক্তি এসে খাদ্য-দ্রব্য উঠিয়ে নিতে উদ্যত হল। আমি তাকে ধরে ফেললাম এবং বললাম, আমি তোমাকে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নিয়ে যাব। এরপর পুরো হাদীস বর্ণনা করে। তখন লোকটি বলল, যখন আপনি ঘুমাতে যাবেন, তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করবেন। এর ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন পাহারাদার নিযুক্ত করা হবে এবং ভোর পর্যন্ত শয়তান আপনার কাছে আসতে পারবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (এ ঘটনা শুনে) বললেন, (যে তোমার কাছে এসেছিল) সে সত্য কথা বলেছে, যদিও সে বড় মিথ্যাবাদী শয়তান। সহিহ বুখারি হাদিস নং ৫০০৮, ৫০০৯ ও ৫০১০
সূরা বাকারা শেষ ২ আয়াতঃ
আবূ মাসঊদ বদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বারার শেষ আয়াত দু’টি পাঠ করবে, তার জন্য সে দু’টি যথেষ্ট হবে।’
বলা হয়েছে যে, সে রাতে অপ্রীতিকর জিনিসের মোকাবেলায় যথেষ্ট হবে। অথবা তাহাজ্জুদের নামায থেকে যথেষ্ট হবে।
(বুখারী ৪০০৮, মুসলিম ১৯১৪-১৯১৬)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা জিবরীল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বসে ছিলেন। এমন সময় উপর থেকে একটি শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি (জিবরীল) মাথা তুলে বললেন, ‘এটি আসমানের একটি দরজা, যা আজ খোলা হল। ইতোপূর্বে এটা কখনও খোলা হয়নি। ওদিক দিয়ে একজন ফিরিশতা অবতীর্ণ হল। এই ফিরিশতা যে দুনিয়াতে অবতরণ করেছে, ইতোপূর্বে কখনও অবতরণ করেনি।’ সুতরাং তিনি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সালাম জানিয়ে বললেন, ‘‘আপনি দু’টি জ্যোতির সুসংবাদ নিন। যা আপনার আগে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। (সে দু’টি হচ্ছে) সূরা ফাতেহা ও সূরা বাক্বারার শেষ আয়াতসমূহ। ওর মধ্য হতে যে বর্ণটিই পাঠ করবেন, তাই আপনাকে দেওয়া হবে।
(মুসলিম ১৯১৩)
সূরা আল ইখলাসঃ
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সূরা) ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ সম্পর্কে বলেছেন, সেই মহান সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে, নিঃসন্দেহে এটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল। (বুখারী ৫০১৩, ৬৬৪৩, ৭৩৭৪)
অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাগণকে বললেন, তোমরা কি এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়তে অপারগ? প্রস্তাবটি তাঁদের পক্ষে ভারী মনে হল। তাই তাঁরা বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রসূল! এ কাজ আমাদের মধ্যে কে করতে পারবে? (অর্থাৎ, কেউ পারবে না।) তিনি বললেন, ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস স্বামাদ’ (সূরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল। (অর্থাৎ, এই সূরা পড়লে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়ার সমান নেকী অর্জিত হয়।) (ঐ ৫০১৫)
মুআয বিন আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ‘ক্বুল হুঅল্লা-হু আহাদ’ শেষ পর্যন্ত ১০ বার পাঠ করবে, আল্লাহ সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতে এক মহল নির্মাণ করবেন। এ কথা শুনে উমার বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) বললেন, তাহলে আমরা বেশি বেশি করে পড়ব হে আল্লাহর রসূল! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহও বেশি দানশীল ও বেশি পবিত্র।(আহমাদ ১৫৬১০, প্রমুখ, সিসিলাহ সহীহাহ ৫৮৯)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নিবেদন করল, হে আল্লাহর রসূল! আমি এই (সূরা) ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ ভালবাসি। তিনি বললেন, এর ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।(তিরমিযী ২৯০১ হাসান সূত্রে, বুখারী বিচ্ছিন্ন সনদে ৭৭৫ এর আগে
সূরা ফালাক ও নাসঃ
একদা ইবনে আবেস জুহানী (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে ইবনে আবেস! আমি তোমাকে উত্তম ঝাড়-ফুঁকের কথা বলে দেব না কি, যার মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনাকারীরা আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকে? তিনি বললেন, অবশ্যই বলে দিন, হে রাসূলাল্লাহ! তিনি ফালাক ও নাস সূরা দুটিকে উল্লেখ করে বললেন, এ সূরা দুটি হল মুআব্বিযাতান (ঝাড়-ফুঁকের মন্ত্র)।
(আহমাদ ১৫৪৪৮, ১৭২৯৭, নাসাঈ কুবরা ৭৮৪৭)
আবদুল্লাহ ইবনু ইউসুফ (রহঃ) … আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, যখনই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হতেন তখনই তিনি ‘সূরায়ে মু’আবিযাত’ পাঠ করে নিজের উপর ফুঁক দিতেন। যখন তাঁর রোগ কঠিন আকার ধারন করল, তখন বরকত লাভের জন্য আমি এই সকল সূরা পাঠ করে হাত দিয়ে শরীর মাসেহ্ করিয়ে দিতাম। সহিহ বুখারিঃ ই ফা নাম্বারঃ ৪৬৪৭, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫০১৬
সূরা কাফিরুনঃ
আনাস বিন মালিক (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ‘ক্বুল ইয়া-আইয়্যুহাল কা-ফিরূন’ পাঠ করবে, তার এক চতুর্থাংশ কুরআন পাঠের সমান সওয়াব লাভ হবে। আর যে, ব্যক্তি ‘ক্বুল হুওয়াল্লা-হু আহাদ পাঠ করবে তার এক তৃতীয়াংশ কুরআন পাঠের সমান সওয়াব লাভ হবে। (তিরমিযী ২৮৯৩, সহীহুল জামে’ ৬৪৬৬)
সূরা মূলকঃ
আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কুরআনে ত্রিশ আয়াতবিশিষ্ট একটি সূরা এমন আছে, যা তার পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে এবং শেষাবধি তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে, সেটা হচ্ছে ‘তাবা-রাকাল্লাযী বিয়্যাদিহিল মুলক’ (সূরা মুলক)।(আবূ দাঊদ ১৪০২, তিরমিযী ২৮৯১, হাসান)
কাহফঃ
আবূ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুরা কাহফের প্রথম দিক থেকে দশটি আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের (ফিৎনা) থেকে পরিত্রাণ পাবে। অন্য বর্ণনায় ‘কাহফ সূরার শেষ দিক থেকে’ উল্লেখ হয়েছে। (মুসলিম ১৯১৯-১৯২০)
আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি জুমআর দিন সূরা কাহফ পাঠ করে, সে ব্যক্তির জন্য দুই জুমআর মধ্যবর্তী কাল জ্যোতির্ময় হয়ে যায়।(হাকেম, বাইহাক্বী, সহীহুল জামে’ ৬৪৭০)
‘Abd-Allah ibn Mas’ud (may Allah be pleased with him) said concerning Bani Israil (al-Isra), al-Kahf , Maryam, Taha and al-Anbiya: They are among the best of the earliest ones that I learned by heart. (Narrated by al-Bukhari, 4994)
Abu Umamah (may Allah be pleased with him) narrated that the Messenger of Allah (peace and blessings of Allah be upon him) said: “The greatest name of Allah appears in three surahs of the Quran: in al-Baqarah
, Al ‘Imran and Taha.” (Narrated by Ibn Majah (3856) and al-Hakim (1/686); classed as hasan (sound) by al-Albani in al-Silsilah al-Sahihah (746)
It was narrated from Ibn ‘Abbaas that the Prophet (peace and blessings of Allaah be upon him) said: “Hood, al-Waaqi’ah, al-Mursalaat, ‘Amma yatsaa’iloon [al-Naba’] and Idha al-‘shamsu kuwwirat [al-Takweer] have made my hair grey.”
(Narrated by al-Tirmidhi, 3297. classed as saheeh by Shaykh al-Albaani, al-Saheehah, 955)
Power point presentation