বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
প্রতি বছরই রমাদান মাস আসে আবার চলে যায়। এর মাঝে একেকজনের জীবনে রেখে যায় অনেক শিক্ষা, পরিবর্তন মহান রবের অনুমতিক্রমে।
এই বছরেও রমাদান মাস কারা পাবেন আর কারা পাবেন না তা একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন। তবে এই মুহুর্তে আমরা যারা এখনো সুস্থভাবে বেঁচে আছি তারা অন্তত এখন থেকেই পরিকল্পনা করে এগুতে থাকি যেনো রমাদান মাসের মর্যাদা ও ফায়দা লাভ করতে পারি ইন শা আল্লাহ।
আমরা অনেকেই বছরের একটি সময় একটু আনন্দ ঘন পরিবেশ পাওয়ার জন্য ট্যুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে অনেক আগে থেকেই স্থান বুকিং দিয়ে রাখি ও আর্থিক অবস্থাও গুছিয়ে কর্মজীবন থেকে ছুটির ব্যবস্থাও করে নেই তাই না!
বছরে এই একটি মাস রমাদানও কিন্তু একবারের জন্যই সুযোগ নিয়ে আসে। এই মাসে এমন একটি মূল্যবান জিনিষ মহান আল্লাহ দিয়েছেন যার জন্য আনন্দ করার কথাই মহান আল্লাহ জানিয়েছেন। আর সেই জিনিষের কারনেই রমাদান মাসকে এতো বেশী মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এটাও জানিয়েছেন দুনিয়াতে যত সম্পদ অর্জনই করুক না কেনো সকল সম্পদ বা অর্জন থেকে এই জিনিষের মূল্য অনেক অনেক বেশী। তাহলে সেই জিনিষটি কি? আমরা কি জানি?
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-
﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ ۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ۗ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾
রমাদান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়াতের জন্য এবং হিদায়তের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ থাকলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। সূরা আল বাকারাঃ ১৮৫
মহান আল্লাহ জানিয়েছেন- সূরা ইউনুসঃ ৫৭-৫৮
১০:৫৭ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡکُمۡ مَّوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ شِفَآءٌ لِّمَا فِی الصُّدُوۡرِ ۙ وَ هُدًی وَّ رَحۡمَۃٌ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ
হে লোকসকল! তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে উপদেশ ও অন্তরসমূহে যা আছে তার আরোগ্য এবং মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত।
১০:৫৮ قُلۡ بِفَضۡلِ اللّٰهِ وَ بِرَحۡمَتِهٖ فَبِذٰلِکَ فَلۡیَفۡرَحُوۡا ؕ هُوَ خَیۡرٌ مِّمَّا یَجۡمَعُوۡنَ
তুমি বলে দাও, ‘এ হল তাঁরই অনুগ্রহ ও করুণায়; সুতরাং এ নিয়েই তাদের আনন্দিত হওয়া উচিত; এটা তারা যা (পার্থিব সম্পদ) সঞ্চয় করছে তা হতে অধিক উত্তম।’
এখানে সূরা ইউনুসের এই দুটি আয়াতে কুরআনুল কারীমের চারটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে-(তাফসিরে যাকারিয়া)
এক. উপদেশবানী
(مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ) مَوْعِظَةٌ ও وَعْظٌ এর প্রকৃত অর্থ হলো উৎসাহ কিংবা ভীতিপ্রদর্শনের মাধ্যমে পরিণাম সম্পর্কে স্মরণ করে দেয়া। [ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ এমন বিষয় বর্ণনা করা, যা শুনে মানুষের অন্তর কোমল হয় এবং আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়ে। পার্থিব গাফলতীর পর্দা ছিন্ন হয়ে মনে আখেরাতের ভাবনা উদয় হয়। যাবতীয় অন্যায় ও অশ্লিলতা থেকে বিরত করে। [ইবন কাসীর]
কুরআনুল কারীমের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই ‘মাওয়ায়েযে হাসানাহ’-এর অত্যন্ত সালঙ্কার প্রচারক। এর প্রতিটি জায়গায় ওয়াদা-প্রতিশ্রুতির সাথে সাথে ভীতি-প্রদর্শন, সওয়াবের সাথে সাথে আযাব, পার্থিব জীবনের কল্যাণ ও কৃতকার্যতার সাথে সাথে ব্যর্থতা ও পথভ্রষ্টতা প্রভৃতির এমন সংমিশ্রিত আলোচনা করা হয়েছে, যা শোনার পর পাথরও পানি হয়ে যেতে পারে।
যে ব্যক্তি মন দিয়ে কুরআন পাঠ করবে এবং তার অর্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, কুরআন তার জন্য উপদেশ। ওয়াযের প্রকৃত অর্থ হল পরিণাম ও ফলাফল স্মরণ করিয়ে দেওয়া; চাই তা উৎসাহ দানের মাধ্যমে হোক বা ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে। আর একজন উপদেষ্টা (বক্তা) একজন ডাক্তারের মত, তিনি রোগীকে ঐ সকল বস্তু থেকে বিরত থাকতে বলেন, যা রোগীর শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনুরূপ কুরআনও উৎসাহদান ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে ওয়ায-নসীহত করে এবং ঐ সকল পরিণাম ও ফলাফল সম্পর্কে সতর্ক করে, যা আল্লাহর অবাধ্যাচরণের কারণে ভোগ করতে হবে। আর ঐ সকল কর্ম থেকে নিষেধ করে যে কর্ম দ্বারা মানুষের আখেরাত বরবাদ হয়।
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছ থেকে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, এর মাধ্যমে তিনি তাদের শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে তাদের অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর তিনি তাদের সরল পথে পরিচালিত করেন।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ১৫-১৬)
﴿كِتَابٌ أُنزِلَ إِلَيْكَ فَلَا يَكُن فِي صَدْرِكَ حَرَجٌ مِّنْهُ لِتُنذِرَ بِهِ وَذِكْرَىٰ لِلْمُؤْمِنِينَ﴾
এটি তোমার প্রতি নাযিল করা একটি কিতাব৷ কাজেই তোমার মনে যেন এর সম্পর্কে কোন সংকোচ না থাকে। এটি নাযিল করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর মাধ্যমে তুমি (অস্বীকারকারীদেরকে )ভয় দেখাবে এবং মুমিনদের জন্যে এটি হবে একটি স্মারক৷আরাফঃ২
আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে উপদেশ দাও কোরআনের মাধ্যমে।’ (সুরা : কাফ, আয়াত : ৪৫)
﴿اتَّبِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ ۗ قَلِيلًا مَّا تَذَكَّرُونَ﴾
হে মানব সমাজ! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং নিজেদের রবকে বাদ দিয়ে অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না৷ কিন্তু তোমরা খুব কমই উপদেশ মেনে থাকো৷ আরাফঃ ৩
দুই. রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থাপত্র
কুরআনুল কারীমের দ্বিতীয় গুণ (وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ) বাক্যে বর্ণিত হয়েছে। شِفَاءٌ অর্থ রোগ নিরাময় হওয়া আর صُدُوْرٌ হলো صَدْرٌ এর বহুবচন, যার অর্থ বুক। আর এর মর্মার্থ অন্তর। সারার্থ হচ্ছে যে, কুরআনুল কারীম অন্তরের ব্যাধিসমূহ যেমন সন্দেহ, সংশয়, নিফাক, মতবিরোধ ও ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদির জন্য একান্ত সফল চিকিৎসা ও সুস্থতা এবং রোগ নিরাময়ের অব্যররথ ব্যবস্থাপত্র। [কুরতুবী]
অনুরূপভাবে অন্তরে যে সমস্ত পাপ পঙ্কিলতা রয়েছে সেগুলোর জন্যও মহৌষধ। [ইবন কাসীর] সঠিক আকীদা বিশ্বাস বিরোধী যাবতীয় সন্দেহ কুরআনের মাধ্যমে দূর হতে পারে। [ফাতহুল কাদীর]
সূরা ইউনুসের এই আয়াতে কুর’আনকে অন্তরের চিকিৎসা বলে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে – অন্তর হচ্ছে সেই স্থান, যেখানে বিশ্বাস সংরক্ষিত হয়। কেননা সেটাই হচ্ছে কুর’আনের প্রধান লক্ষ্য এবং সেটাই হচ্ছে অন্যান্য দিকগুলোর ভিত্তি। এটা এজন্য যে, যদি খারাপ বিশ্বাস ও সন্দেহগুলোকে অন্তর থেকে দূর করা যায় এবং সত্যে বিশ্বাস স্থাপন করা হয় ও নিশ্চয়তা ধরে রাখা হয়, তখন আত্মা পরিশুদ্ধ হয়ে যায় – ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং সামাজিক পর্যায়ে মানুষের ব্যবহার শুদ্ধ হয়ে যায় এবং তারা তখন পূর্ণতার দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়।
তবে আত্মিক রোগের ধ্বংসকারিতা মানুষের দৈহিক রোগ অপেক্ষা বেশী মারাত্মক এবং এর চিকিৎসাও যে কারো সাধ্যের ব্যাপার নয়। সে কারণেই এখানে শুধু আন্তরিক ও আধ্যাত্মিক রোগের উল্লেখ করা হয়েছে। এতে একথা প্রতীয়মান হয় না যে, দৈহিক রোগের জন্য এটি চিকিৎসা নয়।
হাদীসের বর্ণনা ও উম্মতের আলেম সম্প্রদায়ের অসংখ্য অভিজ্ঞতাই এর প্রমাণ যে, কুরআনুল কারীম যেমন আন্তরিক ব্যাধির জন্য অব্যর্থ মহৌষধ, তেমনি দৈহিক রোগ-ব্যাধির জন্যও উত্তম চিকিৎসা।
কোরআনের মূল দৃষ্টি অন্তরের রোগের নিরাময়ের প্রতি। এর কারণ
প্রথমত, অন্তরে অসুখ থাকলে পরিপাটি ও সুস্থ দেহের কোনো মূল্য নেই। যার অন্তর কলুষিত, তার সবল দেহ থেকে সে নিজেও উপকৃত হতে পারে না, অন্যরাও পারে না।
দ্বিতীয়ত, আত্মার রোগের ক্ষতি দেহের রোগের ক্ষতি থেকে বেশি মারাত্মক।
তৃতীয়ত, দেহের রোগের ওষুধ আবিষ্কার করা মানুষের পক্ষে সম্ভব; কিন্তু আত্মার অসুখের প্রতি মানুষ দৃষ্টিই নিবদ্ধ করে না।
আর মানুষের সীমাবদ্ধ মস্তিষ্কে আত্মার ব্যাধির প্রতিকার করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই কোরআন অন্তরের অসুখ নিরাময়ের প্রতি জোর দিয়েছে।
﴿وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ ۙ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا﴾
আমি এ কুরআনের অবতরণ প্রক্রিয়ায় এমন সব বিষয় অবতীর্ণ করছি যা মুমিনদের জন্য নিরাময় ও রহমত এবং জালেমদের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না। বনী ইসরাইলঃ ৮১
সাহাবি বারা ইবনে আযেব রা. বর্ণনা করেছেন-জনৈক সাহাবি সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করছিলেন। তার নিকট রশি দিয়ে বাঁধা একটি ঘোড়া ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই একটি জলধর তাকে ঢেকে নিল এবং ক্রমেই সেটি কাছে আসছিল আর ঘোড়া ছোটাছুটি করছিল। সকাল হলে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে পূর্ণ ঘটনা খুলে বললেন। শুনে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন সেটি সাকীনা (এক প্রকার বিশেষ রহমত যা দ্বারা অন্তরের প্রশান্তি লাভ হয়) কোরআনুল কারীমের তিলাওয়াতের কারণে অবতীর্ণ হয়েছে। (বুখারী, মুসলিম)
যাহোক, কুর’আন যে শারীরিক ও আত্মিক দুই ধরনের রোগের বেলায়ই শিফা, তা নিম্নলিখিত হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে:
আবু সাঈদ আল খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলের (সা.) কিছু সাহাবী এমন এক আরব গোত্রের সদস্য ছিলেন, যারা তাঁদের প্রতি অতিথিপরায়ণ হতে নারাজ ছিলেন। তাঁরা যখন সেই গোত্রের মাঝে অবস্থান করছিলেন, তখন সেই গোত্রের প্রধানকে সাপে কামড়েছিল (অথবা বৃশ্চিক দংশন করেছিল) এবং তারা সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করলো, “তোমাদের সাথে কি কোন ওষুধ আছে? অথবা তোমাদের সাথে এমন কেউ আছে যে ঝাড়-ফুঁক করতে পারে?” তাঁরা উত্তর দিলেন, “তোমরা আমাদের প্রতি অতিথিপরায়ণ হতে নারাজ ছিলে, তাই তোমরা অর্থপ্রদান না করলে আমরা তার চিকিৎসা করবো না।” তারা একপাল ভেড়া দিতে সম্মত হলো। একজন সাহাবী সূরা ফাতিহা পড়তে শুরু করলেন এবং তাঁর লালা জড়ো করে তিনি ঐ ব্যক্তির ক্ষতস্থানে লাগালেন। ঐ গোত্রপ্রধান ভাল হয়ে উঠলো এবং তার লোকেরা সাহাবীদের ভেড়ার পাল দিতে চাইলে তাঁরা বলেন, “আমরা নবীকে (সা.) জিজ্ঞেস না করে এটা গ্রহণ করবো না (আমাদের জন্য এটা বৈধ কিনা সেটা না জেনে)।” তাঁরা যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করতে গেলেন, তখন তিনি মৃদু হেসে বললেন, “তোমরা কি করে জানলে যে সূরা ফাতিহা দিয়ে ঝাড় ফুঁক করা যায়? ওটা (ভেড়ার পাল) নাও এবং আমার জন্য এক অংশ বরাদ্দ করো।” (বুখারী)।
তিন. হেদায়াত
কুরআনুল কারীমের তৃতীয় গুণ হচ্ছেঃ কুরআন হলো হেদায়াত। অর্থাৎ যে তার অনুসরণ করবে তার জন্য সঠিক পথের দিশা প্রদানকারী। [কুরতুবী] আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে কুরআনকে হেদায়াত বলে অভিহিত করেছেন।
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُستَقِيْمَ
‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন ’ (ফাতিহা ৬) অর্থাৎ হেদায়াত দিন
স্নেহ ও করুণা এবং কল্যাণ কামনাসহ কাউকে মঙ্গলময় পথ দেখিয়ে দেয়া ও মনজিলে পৌছিয়ে দেয়াকে আরবী পরিভাষায় ‘হেদায়াত’ বলে। হেদায়াত’ শব্দটির দুইটি অর্থ।
একটি পথ প্রদর্শন করা, আর দ্বিতীয়টি লক্ষ্য স্থলে পৌছিয়ে দেয়া। যেখানে এই শব্দের পর দুইটি object থাকবে إلى থাকবে না, সেখানে এর অর্থ হবে লক্ষ্যস্থলে পৌছিয়ে দেয়া। আর যেখানে এ শব্দের পর إلى শব্দ আসবে, সেখানে অর্থ হবে পথ-প্রদর্শন। যেমন আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্বোধন করে বলেছেন
, إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ
“নিশ্চয়ই আপনি লক্ষ্যস্থলে—মনজিলে পৌঁছিয়ে দিতে পারবেন না যাকে আপনি পৌছাতে চাইবেন। বরং আল্লাহই লক্ষ্যস্থলে পৌছিয়ে দেন যাকে তিনি ইচ্ছা করেন [সূরা আল-কাসাস ৫৬] এ আয়াতে হেদায়েত শব্দের পর إلى ব্যবহৃত হয়নি বলে লক্ষ্যস্থলে পৌছিয়ে দেয়া অর্থ হয়েছে এবং তা করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাধ্যায়ত্ত নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে পথ প্রদর্শন রাসূলে করীমের সাধ্যায়ত্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ “হে নবী। আর আপনি অবশ্যই সরল সঠিক দৃঢ় ঋজু পথ প্রদর্শন করেন [সূরা আশ-শূরা: ৫২]
কিন্তু লক্ষ্যস্থলে পৌছিয়ে দেয়ার কাজ কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। তাই তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, وَلَهَدَيْنَاهُمْ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا “আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে সরল সোজা সুদৃঢ় পথে পৌছিয়ে দিতাম।[সূরা আন-নিসা: ৬৮] সূরা আল-ফাতিহা’র আলোচ্য আয়াতে হেদায়েত শব্দের পর إلى শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। ফলে এর অর্থ হবে সোজা সুদৃঢ় পথে মনজিলের দিকে চালনা করা। অর্থাৎ যেখানে বান্দাহ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে শুধু এতটুকু বলে না যে, হে আল্লাহ্! আপনি আমাদেরকে সোজা সুদৃঢ় পথের সন্ধান দিন। বরং বলে, হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে সরল সুদৃঢ় পথে চলবার তাওফীক দিয়ে মনজিলে পৌছিয়ে দিন। কেননা শুধু পথের সন্ধান পাইলেই যে সে পথ পাওয়া ও তাতে চলে মনজিলে পোঁছা সম্ভবপর হবে তা নিশ্চিত নয়।
কিন্তু সিরাতে মুস্তাকীম কি? সিরাত শব্দের অর্থ হচ্ছে, রাস্তা বা পথ। আর মুস্তাকীম হচ্ছে, সরল সোজা। সে হিসেবে সিরাতে মুসতাকীম হচ্ছে, এমন পথ, যা একেবারে সোজা ও ঋজু, প্রশস্ত ও সুগম; যা পথিককে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছিয়ে দেয়; যে পথ দিয়ে লক্ষ্যস্থল অতি নিকটবর্তী এবং মনযিলে মাকছুদে পৌছার জন্য যা একমাত্র পথ, যে পথ ছাড়া লক্ষ্যে পৌছার অন্য কোন পথই হতে পারে না।
আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ আমারও রব তোমাদেরও রব, অতএব একমাত্র তারই দাস হয়ে থাক। এটাই হচ্ছে সিরাতুম মুস্তাকীম-সঠিক ও সুদৃঢ় ঋজু পথ [সূরা মারইয়াম: ৩৬] অর্থাৎ আল্লাহকে রব স্বীকার করে ও কেবল তারই বান্দাহ হয়ে জীবন যাপন করলেই সিরাতুম মুস্তাকীম অনুসরণ করা হবে।
অন্যত্র ইসলামের জরুরী বিধি-বিধান বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর এটাই আমার সঠিক দৃঢ় পথ, অতএব তোমরা এই পথ অনুসরণ করে চল। এছাড়া আরও যত পথ আছে, তাহার একটিতেও পা দিও না; কেননা তা করলে সে পথগুলো তোমাদেরকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দিবে-ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন এ উদ্দেশ্যে, যেন তোমরা ধ্বংসের পথ হতে আত্মরক্ষা করতে পার [সূরা আল-আনআমঃ ১৫৩]
একমাত্র আল্লাহর নিকট থেকে যে পথ ও বিধি-বিধান পাওয়া যাবে, তাই মানুষের জন্য সঠিক পথ। আল্লাহ বলেন, “প্রকৃত সত্য-সঠিক-ঋজু-সরল পথ প্রদর্শন করার দায়িত্ব আল্লাহর উপর, যদিও আরও অনেক বাঁকা পথও রয়েছে। আর আল্লাহ চাইলে তিনি সব মানুষকেই হেদায়াতের পথে পরিচালিত করতেন [সূরা আন-নাহ্ল: ৯]
সে পথ ও পন্থা (হেদায়াতের পথ-সঠিক সরল পথ) নির্দেশ করতে গিয়ে আল্লাহ এর তিনটি সুস্পষ্ট পরিচয় উল্লেখ করেছেনঃ
১. এই জীবন কিভাবে যাপন করতে হবে তা তাদের নিকট হতে গ্রহণ করতে হবে, যারা উক্ত বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করে আল্লাহর নিকট হতে নিয়ামত ও অসীম অনুগ্রহ লাভ করেছে।
২. এই পথের পথিকদের উপর আল্লাহর গজব নাযিল হয় নি, অভিশপ্তও তারা নয়।
৩, তারা পথভ্রান্ত লক্ষ্যভ্রষ্টও নয়।
﴿ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ﴾
- এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই ৷ এটি হিদায়াত সেই ‘মুত্তাকী’দের জন্য- বাকারাঃ ২
- আসলে এ কুরআন এমন পথ দেখায় যা একেবারেই সোজা৷ যারা একে নিয়ে ভাল কাজ করতে থাকে তাদেরকে সে সুখবর দেয় এ মর্মে যে, তাদের জন্য বিরাট প্রতিদান রয়েছে৷বনী ইসরাইলঃ ৯
هَٰذَا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ
- এটি মানব জাতির জন্য একটি সুস্পষ্ট সর্তকবাণী এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ৷আলে ইমরানঃ ১৩৮
- তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ, পথনির্দেশ ও রহমত এসে গেছে ৷ এখন তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হবে, যে আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলে এবং তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ? যারা আমার আয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদের এ সত্য বিমুখতার কারণে তাদেরকে আমি নিকৃষ্টতম শাস্তি দেবো৷ আনয়ামঃ ১৫৭
৭৩:১৯ اِنَّ هٰذِهٖ تَذۡکِرَۃٌ ۚ فَمَنۡ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰی رَبِّهٖ سَبِیۡلًا
নিশ্চয় এটা এক উপদেশ, অতএব যে চায় সে তার রবের দিকে পথ অবলম্বন করুক! সূরা মুযযাম্মিলঃ ১৯
তাওফিক ও হেদায়েত আল্লাহ্র হাতে। তিনি যাকে হেদায়েত দিতে চান তাকে হেদায়েত দেন; আর যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান তাকে পথভ্রষ্ট করেন। আল্লাহ্তাআলা বলেন: “এটা আল্লাহ্র পথনির্দেশ, তিনি তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত করেন। আল্লাহ্যাকে বিভ্রান্ত করেন তার কোন হেদায়াতকারী নেই।”[সূরা যুমার, ৩৯:২৩]
তিনি আরও বলেন: “আল্লাহ্যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে রাখেন।”[সূরা আনআম, ৬:৩৯] তিনি আরও বলেন: “আল্লাহ্যাকে পথ দেখান সে-ই পথ পায় এবং যাদেরকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।”[সূরা আল-আরাফ, ৭:১৭৮]
আল্লাহ্তাআলা বলেন: “কিন্তু তারা যখন বাঁকা পথ ধরল, তখন আল্লাহ্ও তাদের অন্তরকে বাঁকা করে দিলেন।”[সূরা আছ-ছফ, ৬১:৫] তিনি আরও বলেন:”অতএব তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে আমি তাদেরকে অভিসম্পাত দিয়েছি এবং তাদের অন্তরসমূহ কঠিন করেছি। তারা শব্দসমূহের সঠিক অর্থ বিকৃত করে। তাদেরকে যা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তারা ভুলে গিয়েছে।”[সূরা আল-মা’ইদাহ, ৫:১৩]
চার. রহমত
কুরআনুল করীমের চতুর্থ গুণ হচ্ছেঃ কুরআন হলো রহমত। যার এক অর্থ হচ্ছে নে’আমত। [কুরতুবী]
﴿وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ ۙ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا﴾
আমি এ কুরআনের অবতরণ প্রক্রিয়ায় এমন সব বিষয় অবতীর্ণ করছি যা মুমিনদের জন্য নিরাময় ও রহমত এবং জালেমদের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না। সূরা আল-ইসরার ৮২
তাদেরকে বলে দাও, আমি তো কেবল সেই অহীরই আনুগত্য করি যা আমার রব আমার কাছে পাঠান৷ এটি তো অন্তরদৃষ্টির আলো তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এবং হেদায়াত ও রহমত তাদের জন্য যারা একে গ্রহণ করে। আল-আরাফঃ ২০৩
﴿وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾
যখন কুরআন, তোমাদের সামনে পড়া হয়, তা শোনো মনোযোগ সহকারে এবং নীরব থাকো, হয়তো তোমাদের প্রতিও রহমত বর্ষিত হবে৷ আল-আরাফঃ ২০৪
কুরআনুল কারীমকে যাদের জন্য রহমত সাব্যস্ত করা হয়েছে, সেজন্য শর্ত হচ্ছে যে, তাদেরকে কুরআনের আদব ও মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত হতে হবে এবং এর উপর আমল করতে হবে। আর কুরআনের বড় আদব হলো এই যে, যখন তা পাঠ করা হয়, তখন শ্রোতা সেদিকে কান লাগিয়ে নিশ্চুপ থাকবে। [সা’দী]
সহীহ বুখারী এবং মুসলিমে যেমন বর্ণিত আছে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবী, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এঁর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন যেন তিনি লোকজনকে আল্লাহর কিতাব শিক্ষা দিতে পারেন। সেই ইবনে আব্বাস (রা.) পবিত্র কুর’আন সম্বন্ধে বলেছেন:
“ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামত এবং তিনি যে তোমাদের কুর’আনের জনগোষ্ঠী বানিয়েছেন, তা হচ্ছে তোমাদের প্রতি তাঁর করুণা।”
বাস্তবিকই, আর-রাহমান নামক সূরা, যেখানে আল্লাহ্ মানুষকে দান করা তাঁর বহু নিয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন, সেই সূরার শুরুতে আল্লাহ্ বলেছেন :
“পরম দয়ালু আল্লাহ্(হে মানব তোমাদের) কুর’আন শিক্ষা দিয়েছেন (করুণাবশত)। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা রাহমান, ৫৫:১-৩)
এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তাঁর দয়ার বশবর্তী হয়ে করা কাজ হিসেবে মানবতার সৃষ্টির আগে, মানুষকে কুর’আনের শিক্ষা দেওয়ার কাজকে স্থান দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কোন কোন জ্ঞানীজনেরা বলে থাকেন যে, উপরোক্ত আয়াতে এই ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহর কুর’আন শিক্ষাদানের কাজ, তাঁর মানবকুল সৃষ্টির কাজের চেয়ে অধিকতর বড় দয়ার নিদর্শন। এই তাফসীর বা ব্যাখ্যা, উপরে উদ্ধৃত কুর’আন সম্বন্ধে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা.) উক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
আনন্দ’ বা ‘খুশি’ বলা হয় ঐ অবস্থাকে যা কোন আকাঙ্ক্ষিত বস্তু অর্জনের ফলে মানুষ নিজ মনে অনুভব করে। মু’মিনগণকে বলা হচ্ছে যে, এই কুরআন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত, এ অনুগ্রহ লাভ করে মু’মিনগণের আনন্দিত হওয়া উচিত। এর অর্থ এই নয় যে, আনন্দ প্রকাশ করার জন্য জালসা-জলুস করে, আলোকসজ্জা বা অন্য কোনরূপ অপচয়ের অনুষ্ঠান উদ্যাপন করবে। যেমন বর্তমানের বিদআতীরা উক্ত আয়াত দ্বারা ‘নবীদিবস’ ইত্যাদি অভিনব বিদআতী অনুষ্ঠান বৈধ হওয়ার কথা প্রমাণ করতে চায়
অর্থাৎ মানুষের কর্তব্য হলো আল্লাহ তা’আলার রহমত ও অনুগ্রহকেই প্রকৃত আনন্দের বিষয় মনে করা এবং একমাত্র তাতেই আনন্দিত হওয়া দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েশ ও মান-সম্ভ্রম কোনটাই প্রকৃতপক্ষে আনন্দের বিষয় নয়। কারণ, একে তো কেউ যত অধিক পরিমাণেই তা অর্জন করুক না কেন, সবই অসম্পূর্ণ হয়ে থাকে; পরিপূর্ণ হয় না।
দ্বিতীয়তঃ সর্বদাই তার পতনাশঙ্কা লেগেই থাকে। তাই আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে- (هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ) অর্থাৎ আল্লাহর করুণা-অনুগ্রহ সে সমস্ত ধন-সম্পদ ও সম্মান-সাম্রাজ্য অপেক্ষা উত্তম, যেগুলোকে মানুষ নিজেদের সমগ্র জীবনের ভরসা বিবেচনা করে সংগ্রহ করে। এ আয়াতে দুটি বিষয়কে আনন্দ-হর্ষের বিষয় সাব্যস্ত করা হয়েছে।
একটি হলো فضل ফদল, অপরটি হলো رحمة রহমত।
আবু সাঈদ খুদরী ও ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাসহ অনেক মুফাসসির বলেছেন যে, ফদল অর্থ কুরআন; আর রহমত অর্থ ইসলাম। [কুরতুবী] অন্য বর্ণনায় ইবন আব্বাস বলেন, ফদল হচ্ছে, কুরআন, আর তার রহমত হচ্ছে এই যে, তিনি আমাদেরকে কুরআনের অনুসারী করেছেন। হাসান, দাহহাক, মুজাহিদ, কাতাদা বলেন, এখানে ফদল হচ্ছে ঈমান, আর তার রহমত হচ্ছে, কুরআন। [তাবারী; কুরতুবী]
বস্তুতঃ রহমতের মর্ম এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে কুরআনের শিক্ষা দান করেছেন এবং এর উপর আমল করার সামর্থ্য দিয়েছেন। কারণ, ইসলামও এ তথ্যেরই শিরোনাম। যখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট ইরাকের খারাজ নিয়ে আসা হলো তখন তিনি তা গুনছিলেন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিলেন। তখন তার এক কর্মচারী বললঃ এগুলো আল্লাহর দান ও রহমত। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ তোমার উদ্দেশ্য সঠিক নয়। আল্লাহর কুরআনে যে কথা বলা হয়েছে যে, “বল তোমরা আল্লাহর দান ও রহমত পেয়ে খুশী হও যা তোমরা যা জমা করছ তার থেকে উত্তম” এ আয়াত দ্বারা দুনিয়ার কোন ধন-সম্পদ বুঝানো হয়নি। কারণ আল্লাহ তা’আলা জমা করা যায় এমন সম্পদ থেকে অন্য বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তা উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদই জমা করা যায়। সুতরাং আয়াত দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ বুঝানো উদ্দেশ্য নয়। [ইবনে আবী হাতিম]। বরং ঈমান, ইসলাম ও কুরআনই এখানে উদ্দেশ্য। আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক দ্বারাও এ অর্থ স্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
সুতরাং এ জাতীয় দ্বীনী কোন সুসংবাদ যদি কারো হাসিল হয় তিনিও এ আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
আব্দুর রহমান ইবনে আবযা তার পিতা থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেনঃ “আমার উপর একটি সূরা নাযিল হয়েছে এবং আমাকে তা তোমাকে পড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।” তিনি বললেন, আমি বললামঃ আমার নাম নেয়া হয়েছে? রাসূল বললেনঃ হ্যাঁ। বর্ণনাকারী বলেনঃ আমি আমার পিতা (উবাই রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে বললামঃ হে আবুল মুনযির! আপনি কি তাতে খুশী হয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমাকে খুশী হতে কিসে নিষেধ করল অথচ আল্লাহ তা’আলা বলছেনঃ “বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তারই রহমতের উপর তোমরা খুশী হও”। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ৩/৩০৪, আবু দাউদঃ ৩৯৮০]
বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, “কেউ যদি পরখ করতে চায় যে, সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল(সা.)-কে ভালবাসে কিনা, তবে তার উচিত এই ব্যাপারটা যাচাই করা যে সে কুর’আন ভালবাসে কিনা – যদি সে কুর’আন ভালবাসে, তবে সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে।” (আল-তাবারানী)
কুর’আন ভালবাসার সাথে সাথে, একজন ব্যক্তির এইজন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, আল্লাহ্ আমাদের জন্য কুর’আন নাযিল করেছেন এবং তাঁর রাসূল(সা.)-কে পাঠিয়েছেন আমাদেরকে তাঁর কিতাব শিক্ষা দেওয়ার জন্য। আল্লাহ্ নিজেই বিশ্বাসীদের তাঁর এই বিরাট নিয়ামতের কথা মনে করিয়ে দেন এবং সেই সাথে এও মনে করিয়ে দেন যে, এই কিতাব নাযিল হওয়ার পূর্বে বিশ্বাসীরা সত্য সম্বন্ধে জানত না এবং তারা বিপথগামী ছিল। আল্লাহ্ বলেন :
“বিশ্বাসীদের মাঝে, আল্লাহ্ তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করে তাদের উপর এক বিরাট অনুগ্রহ করেছেন, যিনি তাদের মাঝে আল্লাহর আয়াতসমূহ পড়ে শোনান, তাদের পবিত্র করেন, তাদেরকে হিকমত শিক্ষা দেন, অথচ ইতিপূর্বে তারা স্পষ্টত বিপথগামী ছিল।” (সূরা আলে-ইমরান, ৩:১৬৪)
power point presentation of sura younus: 57-58
মাহে রমাদানের পূর্ব আহবান-পর্বঃ ১
কুর’আনকে নিয়ে আনন্দ করার জন্যই এর মর্মার্থ বুঝার পরিকল্পনা নেই। কুর’আনকে সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ মনে করেই এর মূল্যায়ন করি সঠিক অনুসরনের মাধ্যমে। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
আসন্ন রমাদান মাসকে সামনে রেখে এই জমাদিউস সানি মাসেই একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হলো-
রমাদান পূর্ব পরিকল্পনাঃ ২০২২
(জমাদিউস সানি, রজব, শাবান মাস)
১। ব্যক্তিগত আত্মউন্নয়নের জন্যঃ
- কুর’আন অর্থসহ তেলাওয়াতঃ প্রতিদিন ৭পৃষ্ঠা করে
- কুর’আনিক শব্দার্থ মুখস্থঃ প্রতিদিন ৫টি করে
- কুর’আনের তাফসীরঃ
সূরা আন নিসা, ইউনুস, নূর, আহযাব, দুখান, হুজুরাত, বনী ইসরাইল, সূরা
কাহাফ, আস সাজদাহ, মূলক, ক্বামার, হাদীদ ও ৩০তম পারার সূরা সমূহ
- তাফসীর থেকে নোট করে পড়াঃ
সূরা ইউনুসঃ ৫৭-৫৮, সূরা ক্বামারঃ ৪০, সূরা হাদীদঃ ৫-১১, সুরা হাদীদঃ ১২- ২১,
সুরা নুরঃ ৩০-৩১ সূরা আহযাবঃ ৩২-৩৬
- মুখস্থঃ সুরা কাহাফঃ ১-১০ আয়াত, সূরা মূলক, সূরা সাজদাহ ও ৩০তম পারার
- হাদীস পাঠঃ বুলুগুল মারাম/ বুখারী শরীফ এর সালাত, সাওম, যাকাত/ফিতরা/সাদাকা
অধ্যায়(কমপক্ষে প্রতিদিন ২টি করে)
- দু’আ মুখস্থঃ সালাতে পঠিত বিষয়াদি ও নিত্য কাজের পূর্বের দু’আ সমূহ থেকে – প্রতি সপ্তাহে ৩টি
- বই নোটঃ রমাদানের সাওগাত (ড আব্দুল্লাহ জাহাংগির রহ), রজব থেকে রমাদান- ডায়রী
- যত্নশীল হতে হবেঃ নিজের খাদ্য ও ঘুম (শারিরীক ও মানসিক সুস্থতা)
ফরয সালাত,সাওম,পর্দা ও তাহাজ্জুদ সালাত ও দু’আ করা
যাকাত,দান সাদাকা
- যা থেকে দূরে থাকতে হবে—–অতিরিক্ত গল্প ও অতিরিক্ত কথা বলা থেকে
সামাজিক মিডিয়াতে অতিরিক্ত সময় দেয়া থেকে
ছবি দেয়া বা দেখা থেকে
গান শুনা/নাটক/মুভি দেখা থেকে
অপ্রয়োজনে শপিং মলে যাওয়া থেকে
যা ছাড়তে হবে——– রাগ, জোড়ে কথা বলা, অট্ট হাসি, গীবত, হিংসা, মিথ্যা বলা, ঝগড়া,কুধারনা
হারাম আয় ও হারাম পথে ব্যয় এবং অপ্রয়োজনীয় হালাল খরচ
২। পারিবারিক সম্পর্ক উনুয়ন ও দায়িত্ব পালনঃ
- পরিবারের সদস্যদের সাথে একান্তে বসে মতবিনিময়, কথা বলা, তাদের কথা শুনা।
- পারিবারিক তালিম(যার যার পরিবেশে হিকমাহ অবলম্বন)-প্রতি সপ্তাহে ১টি
- প্রতি মাসে উপহার প্রদানঃ ১টি, প্রতি মাসে একবার একসাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়া।
- বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগীতার আসর করা—–প্রতি মাসে ১টি (খেলাধূলা, কুইজ)
- দ্বীনী পরিবেশের সাথে সম্পর্ক করার চেষ্টা। স্কলারদের লেকচার শুনানো। সপ্তাহে-কমপক্ষে ১টি
- কুর’আন সহিহ তাজবীদের ব্যবস্থা করে ফেলা-(যারা পারেন না) জরুরী ভিত্তিতে
- যেকোন একটি তাফসীর বা মোটিভেশনাল ক্লাশের গ্রুপের সাথে সংযোগ করে দেয়া।
৩। আত্মীয় ও প্রতিবেশী, কলিগ
- প্রাধান্য অনুসারে সম্পর্কের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা।-দাওয়াত/উপহার
- অনলাইন গ্রুপ করে সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক মোটিভেশনাল ক্লাশ শুরু করা।
- যেকোন একটি তাফসীর বা মোটিভেশনাল ক্লাশের গ্রুপের সাথে সংযোগ করে দেয়া।
- বই উপহার দেয়া বা বই সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করা। কম পক্ষে প্রতিমাসে ৪জন
- কুর’আন সহিহ তাজবীদের ব্যবস্থা করে দেয়া(যারা পারেন না)
৪। অধিনস্থদের প্রতি (গৃহ কর্মী/ড্রাইভার/দাড়োয়ান/ কর্মচারী)
- সততা ও আখলাকের শিক্ষা দেয়া, সালাতের ও পর্দার ব্যবস্থা রাখা
- সম্ভাব্য কাজ হালকা করে দেয়া, ক্ষমা করা, ঠান্ডা মাথায় বুঝানো
- তাদের প্রয়োজনীয় চাওয়ার ব্যবস্থা করা, উপহার দেয়া
- মাঝে মাঝেই খোঁজ নেয়া তাদের পরিবার ও পরিবেশের
- তাদের পরিবেশে দ্বীনি শিক্ষার ব্যবস্থা করার সুযোগ করা
৫। সামাজিক সাদাকায়ে জারিয়া
- নিজ নিজ দরিদ্র/ মিসকীন আত্মীয় বা প্রতিবেশীদের মৌলিক চাহিদা পূরনে সহায়তা করা
- যার যার গ্রামের মসজিদে-
হুইল চেয়ার, একটি ডিজিটাল প্রেসার মাপা ও অক্সিমিটার প্রদান।
বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, কুর’আন ও হাদীসের সেট দিয়ে পাঠাগার করে দেয়া।
টয়লেট ও হাত ধোয়ার উপযুক্ত হাইজিন পরিবেশের ব্যবস্থা করা।
সহিহ কুর’আন শিখার ব্যবস্থা করে দেয়া(উপযুক্ত আলেম দিয়ে)
- যার যার গ্রামের বাজার বা উপযুক্ত স্থানে পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা সম্ভব হলে করে দেয়া ও মেইনটেনেন্সের জন্য মাসিক ভাতা দিয়ে লোক ঠিক করা।
- গ্রামের বৃদ্ধদের খোঁজ নেয়া ও মৌলিক চাহিদা পূরন হচ্ছে কি না সহযোগীতা করা।
- গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা
- সেলাই মেশিন বা রিকসা প্রদান
এছাড়া নিজস্ব পরিকল্পনা করে সাথে এড করে নিতে পারেন
মহান আল্লাহ আমাদের ইখলাসের সাথে আমল করার তাওফিক দান করুন।
কবুল করে নিন সকল প্রচেষ্টা।