সূরা আন নিসাঃ ১৮তম রুকু(১১৬-১২৬)আয়াত

 সূরা আন নিসাঃ ১৮তম রুকু(১১৬-১২৬)আয়াত

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

৪:১১৬ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِهٖ وَ یَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰهِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا

নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না; আর তার থেকে ছোট যাবতীয় গোনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন, আর যে কেউ আল্লাহ্‌র সাথে শির্ক করে সে ভীষণভাবে পথ ভ্রষ্ট হয়।

শিরকের আভিধানিক অর্থ অংশীদার সাব্যস্ত করা। ইসলামী পরিভাষায় উহার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ পাকের সত্তা ও গুণাবলীর ব্যাপারে যে আক্বিদা ও বিশ্বাস রাখা জরুরী উক্ত আক্বিদা ও বিশ্বাসের সহিত মাখলুকের মধ্য হতে কাউকে সামিল করাকে শিরক বলা হয়।

আললাহর সাথে অন্য কাউকে ইলাহ বা মা‘বূদ সাব্যস্ত করা শিরক। মূলতঃ শিরক হচ্ছে সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করা। স্রষ্টা হওয়ার জন্য যেসব গুণাবলী প্রয়োজন, সেগুলোর ক্ষেত্রে কোন সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে তুলনা করলে, সে মুশরিক হয়ে যাবে। ক্ষতি করা, উপকার করা, দান করা ও দান না করার একক অধিকারী হওয়া ইলাহী বৈশিষ্ট্য, তথা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। আর এসব গুণাবলীর একক অধিকারী হওয়ার কারণে প্রার্থনা করা, ভয় করা, কোন কিছুর আশা করা এবং ভরসা করা কেবলমাত্র তাঁর সাথেই সম্পৃক্ত। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি এসব গুণকে কোন সৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত করে, তাহ’লে সে যেন সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে শরীক সাব্যস্ত করল।

শিরক হল জঘন্যতম গোনাহ। যার কোন ক্ষমা নেই। শিরক মিশ্রিত যেকোন আমল ইসলামের দৃষ্টিতে মূল্যহীন এবং আল্লাহর নিকটে তা প্রত্যাখ্যাত। কেউ যদি জীবনে একটি শিরকও করে এবং তওবা না করে মৃত্যুবরণ করে, তাহ’লে এই একটিমাত্র শিরকই তার ঈমান ও জীবনের যাবতীয় সৎকর্মকে নিষ্ফল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হবে। এ ধরনের লোকদের ঈমান ও আমলের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أَعْمَالاً ، الَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعاً-

‘বলুন, আমি তোমাদেরকে কি সংবাদ দেব নিজেদের আমলের ক্ষেত্রে কারা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সেসব লোক দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্টা-সাধনা ব্যর্থ হয়ে গেছে আর তারা নিজেরা মনে করছে যে, তারা সৎকর্ম করছে’ (কাহফ ১৮/১০৩-১০৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُوْراً-

‘আর আমি তাদের আমলের দিকে অগ্রসর হব, অতঃপর তা (তাওহীদ শূন্য হওয়ার কারণে) বিক্ষিপ্ত ধূলিকণার ন্যায় উড়িয়ে দিব’ (ফুরক্বান ২৫/২৩)।

নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন। আর যে-ই আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে এক মহাপাপ রটনা করে। নিসাঃ ৪৮

শিরকের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَقَدْ أُوْحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ-

‘(হে নবী) কিন্তু তোমার কাছে আর তোমাদের পূর্ববর্তীদের কাছে ওহী করা হয়েছে যে, তুমি যদি (আল্লাহর) শরীক স্থির কর, তাহ’লে তোমার কর্ম অবশ্য অবশ্যই নিষ্ফল হয়ে যাবে। আর তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৩৯/৬৫)। পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে শিরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলা হয়েছে (বাক্বারাহ, ২/২২; নিসা /১১৬; মায়েদাহ ৫/৭২; আন‘আম ৬/৮৮)।

এ কারণে বান্দার ওপর সর্বপ্রথম অপরিহার্য বিষয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হ’ল তাওহীদ সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা। নিজের ঈমান, আক্বীদা ও যাবতীয় আমল শিরক মুক্ত রাখা, যাতে কোন আমল বরবাদ না হয়।

আবু নুআইম হিলইয়াতুল আওলীয়ায় এবং ইবনে হিববান তার সহীহ গ্রন্থে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তবে ইবনে হিববান ও আবু নুআইমের শব্দগুলো এ রকম,

مَنِ الْتَمَسَ رِضَا اللَّهِ بِسَخَطِ النَّاسِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ وَأَرْضَى عَنْهُ النَّاسَ وَمَنِ الْتَمَسَ رِضَا النَّاسِ بِسَخَطِ اللَّهِ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَسْخَطَ عَلَيْهِ النَّاسَ

‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে নারাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহও অসন্তুষ্ট হন এবং মানুষকেও তার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দেন’’। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন: শারহুল আকীদা আল ওয়াসেতীয়াহ, হা/৩০৪।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা মুআবীয়ার নিকট যে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন, তা মারফু হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। মারফু বর্ণনার শব্দগুলো ঠিক এ রকম,

مَنْ أَرْضَى اللَّهَ بِسَخَطِ النَّاس كَفَاهُ مَؤُنَةَ النَّاسَ ومَنْ أَرْضَى النَّاسَ بِسَخَطِ اللَّهِ لَمْ يَغْنُوا عَنْهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا

‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, তার জন্য মানুষের মুকাবেলায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করে মানুষেরা আল্লাহর মুকাবেলায় তার কোনো উপকারে আসবে না’’।

৪:১১৭ اِنۡ یَّدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِهٖۤ اِلَّاۤ اِنٰثًا ۚ وَ اِنۡ یَّدۡعُوۡنَ اِلَّا شَیۡطٰنًا مَّرِیۡدًا

তাঁর (আল্লাহর) পরিবর্তে তারা কেবল নারীদেরকে আহবান (দেবীদের পূজা) করে এবং তারা কেবল বিদ্রোহী শয়তানেরই পূজা করে।

শয়তানকে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে পূজা অর্চনা করে না বা তাকে সরাসরি আল্লাহর মর্যাদায় অভিসিক্ত করে না৷ এ অর্থে কেউ শয়তানকে মাবুদ বানায় না, একথা ঠিক৷ তবে নিজের প্রবৃত্তি, ইচ্ছা আশা-আকাংখা ও চিন্তা –ভাবনার লাগাম শয়তানের হাতে তুলে দিয়ে যেদিকে সে চালায় সেদিকে চলা এবং এমনভাবে চলা যেন সে শয়তানের বান্দা এবং শয়তান তার প্রভু—এটাইতো শয়তানকে মাবুদ বানাবার একটি পদ্ধতি ৷ এ থেকে জানা যায়, বিনা বাক্য ব্যয়ে, নির্দেশ মেনে চলা এবং অন্ধভাবে কারো হুকুম পালন করার নামই ‌‌‌‌‌’ইবাদত৷’ আর যে ব্যক্তি এভাবে কারো আনুগত্য করে সে আসলে তার ইবাদাত করে

إِنَاثٌ (নারী) বলতে হয় সেই মূর্তি বা দেবীগুলোকে বুঝানো হয়েছে, যাদের নাম ছিল স্ত্রীবাচক। যেমন, উয্যা, মানাত, নায়েলা ইত্যাদি। অথবা এ থেকে ফিরিশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, আরবের মুশরিকরা ফিরিশতাদেরকে আল্লাহর বেটী গণ্য করত এবং তাদের ইবাদত করত।

মূর্তি, ফিরিশতা বা অন্য কোন সত্তার ইবাদত করার মানেই হল প্রকৃতার্থে শয়তানের ইবাদত করা। কারণ, শয়তানই মানুষকে আল্লাহ থেকে সরিয়ে অন্যের আস্তানা ও চৌকাঠে সিজদায় ঝুঁকিয়ে দেয়। পরের আয়াতে এ কথাই আলোচিত হয়েছে।

আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কাউকে  إِلَهতথা উপাস্য বা দেবতা নাম দিলেই সে উপাসনা পাওয়ার উপযুক্ত হতে পারে না। “লাত, মানাত, উজ্জা-র” প্রসঙ্গে আল্লাহ্‌ বলেন,

“এগুলোতো কতক নামমাত্র, যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা রেখেছ। যার সমর্থনে আল্লাহ্‌ কোন দলীল প্রেরণ করেননি।”[সূরা নাজম: ২৩]

ইউসুফ (আঃ) এর গল্প বলতে গিয়ে আল্লাহ্‌ ইরশাদ করেন, ইউসুফ কারাগারে তার দু’সঙ্গীকে বলেছিলেন, “ভিন্ন ভিন্ন বিক্ষিপ্ত বহু প্রতিপালক শ্রেয়? নাকি পরাক্রমশালী এক আল্লাহ্‌? তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা শুধু কতকগুলো নামের ইবাদত করছো, যে সব নাম তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা রেখেছো। এইগুলোর কোন প্রমাণ আল্লাহ্‌ পাঠান নাই।”[সূরা ইউসুফ ১২:৩৯-৪০]

আল্লাহর সঙ্গে সব ধরনের ছোট-বড় জানা-অজানা শিরক থেকে বেঁচে থাকতে তাঁরই কাছে আশ্রয় কামনার দোয়া পড়তে বলেছেন স্বয়ং বিশ্বনবী হয়রত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাহলো-

اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ اَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَ اَنَا أَعْلَمُ وَ اَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا أَعْلَمُ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা আন উশরিকা বিকা ওয়া আনা আলামু ওয়া আসতাগফিরুকা লিমা লা আলামু। (মুসনাদে আহমাদ)

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমার জানা অবস্থায় তোমার সঙ্গে শিরক করা হতে তোমারই কাছে আশ্রয় চাই। আর অজানা অবস্থায়ও তোমার সঙ্গে শিরক করা থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি‘

৪:১১৮ لَّعَنَهُ اللّٰهُ ۘ وَ قَالَ لَاَتَّخِذَنَّ مِنۡ عِبَادِکَ نَصِیۡبًا مَّفۡرُوۡضًا

আল্লাহ তাকে লা’নত করেন এবং সে বলে, আমি অবশ্যই আপনার বান্দাদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার অনুসারী করে নেব।

অর্থাৎ তাদের সময়, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা,শক্তি ও যোগ্যতা এবং তাদের সন্তান ও ধন-সম্পদ থেকে নিজের একটি অংশ নিয়ে নেবো৷ তাদের এমনভাবে প্ররোচিত করবো যার ফলে তারা এ সবের একটি বিরাট অংশ আমার পথে ব্যয় করবে৷

৪:১১৯ وَّ لَاُضِلَّنَّهُمۡ وَ لَاُمَنِّیَنَّهُمۡ وَ لَاٰمُرَنَّهُمۡ فَلَیُبَتِّکُنَّ اٰذَانَ الۡاَنۡعَامِ وَ لَاٰمُرَنَّهُمۡ فَلَیُغَیِّرُنَّ خَلۡقَ اللّٰهِ ؕ وَ مَنۡ یَّتَّخِذِ الشَّیۡطٰنَ وَلِیًّا مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ فَقَدۡ خَسِرَ خُسۡرَانًا مُّبِیۡنًا

. আমি অবশ্যই তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব; অবশ্যই তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করব, আর অবশ্যই আমি তাদেরকে নির্দেশ দেব, তাদেরকে নির্দেশ দেব, ফলে তারা পশুর কান ছিদ্র করবে। আর অবশ্যই তাদের নির্দেশ দেব, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবে। আর আল্লাহর পরিবর্তে কেউ শয়তানকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করলে সে স্পষ্টতঃই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা’আলার লা’নত করেছেন সে সমস্ত মহিলাদের উপর যারা শরীর কেটে উল্কি আঁকে এবং যারা এ অংকনের কাজ করে, আরো লা’নত করেছেন যারা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ভ্রু কাটে এবং যারা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দাঁত কাটে। আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে। [বুখারীঃ ৪৮৮৬]

আয়াতে বর্ণিত, خَلْقَ اللَّهِ অর্থ উপরে করা হয়েছে, আল্লাহর সৃষ্টি। এর আরেক অর্থ, ‘আল্লাহর দ্বীন’ যা ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে। [তাবারী] সুতরাং দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার জন্যও শয়তান কিছু লোককে নিয়োজিত করবে।

এটা হল ‘বাহিরা’ এবং ‘সায়েবা’ পশুগুলোর নিদর্শন ও তাদের আকার-আকৃতি। এই পশুগুলোকে মুশরিকরা মূর্তিদের নামে উৎসর্গ করত এবং নিদর্শন স্বরূপ তাদের কান চিড়ে দিত।

تَغْيِيْرُ خَلْقِ اللهِ আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন করা তিনভাবে হয়।

প্রথম এটা, যা এখন আলোচিত হল। যেমন, কান কাটা, চিড়া এবং ছিদ্র করা। এ ছাড়াও আরো কয়েকভাবে তা করা হয়। যেমন, মহান আল্লাহ চাঁদ, সূর্য, পাথর এবং আগুন ইত্যাদি অনেক জিনিস বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে সেগুলোকে উপাস্যে পরিণত করা।

আবার পরিবর্তনের অর্থ প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবর্তন এবং হালাল ও হারামের মধ্যে পরিবর্তনও হয়। পুরুষের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা অনুরূপ মহিলাদের গর্ভাশয় তুলে ফেলে তাদের সন্তান জন্মানোর যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত করাও এই পরিবর্তনের আওতায় পড়ে। মেকআপের নামে ভ্রূর চুল চেঁছে নিজের আকৃতির পরিবর্তন করা এবং চেহারা ও হাতে দেগে নকসা করা ইত্যাদিও এরই মধ্যে শামিল। এ সবই হল শয়তানী কার্যকলাপ, তা থেকে বিরত থাকা জরুরী। তবে পশু দ্বারা অধিক উপকৃত হওয়ার জন্য, তার ভালো গোশত লাভের জন্য অথবা এই ধরনের আরো কোন বৈধ উদ্দেশ্যে যদি তার খাসি করানো হয়, তবে তা বৈধ হবে। এর সমর্থন এ থেকেও হয় যে, নবী করীম (সাঃ) খাসি ছাগল কুরবানীতে জবাই করেছেন। যদি পশুর খাসি করানো বৈধ না হত, তাহলে তিনি (সাঃ) তার কুরবানী করতেন না। (বা খাসি হওয়া একটি ত্রুটি বলে গণ্য করতেন।)

ইবলিশ আরো বলেছিলো-

তুমি যেমন আমাকে বিপথগামী করেছো, তেমনি আমিও এখন থেকে তাদের (আদম ও তার সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে) তোমার সিরাতুল মুস্তাকিমে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সামনে পেছনে, ডানে বাঁয়ে সবদিক থেকে তাদের ঘেরাও করে নেবো। ফলে তাদের অধিকাংশকেই তুমি কৃতজ্ঞ (তোমার অনুগত) পাবেনা। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৬-১৭)

কিন্তু মহান আল্লাহ জানিয়েছেন কাদের পথভ্রষ্ট করতে পারবে না-

শয়তানের কৌশল দূর্বল কারন সে কারোর উপর জোর করে কর্তৃত্ব করতে পারে না, যে কর্তৃত্ব করতে দেয় সেখানেই সে খাটাতে পারে।

নিশ্চয়ই যারা আমার নিষ্ঠাবান দাস তাদের উপর তোর কোনো আধিপত্য খাটবেনা। তোর কর্তৃত্ব শুধু ঐ সব ভ্রষ্ট লোকদের উপরই চলবে, যারা তোকে মেনে চলে।হিজরঃ৪২

আমার প্রকৃত দাসদের উপর তোর কোনো কর্তৃত্ব অর্জিত হবেনা। (হে মুহাম্মদ!) ভরসা করার জন্যে তোমার প্রভুই যথেষ্ট। (সূরা ইসরা :  ৬৫)

৪:১২০ یَعِدُهُمۡ وَ یُمَنِّیۡهِمۡ ؕ وَ مَا یَعِدُهُمُ الشَّیۡطٰنُ اِلَّا غُرُوۡرًا

সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে। আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ছলনামাত্র।

৪:১২১ اُولٰٓئِکَ مَاۡوٰىهُمۡ جَهَنَّمُ ۫ وَ لَا یَجِدُوۡنَ عَنۡهَا مَحِیۡصًا

এদেরই আশ্রয়স্থল জাহান্নাম, তা থেকে তারা নিস্কৃতির উপায় পাবে না।

‘যখন শয়তান (বদরের দিন) কাফেরদের নিকট তাদের কাজগুলিকে শোভনীয় করে দেখিয়েছিল এবং বলেছিল, আজ তোমাদের উপর বিজয়ী হবার মত কোন লোক নেই। আর আমি তোমাদের সাথী আছি। কিন্তু যখন দু’দল মুখোমুখী হ’ল, তখন সে পিঠ ফিরে পালালো এবং বলল, আমি তোমাদের থেকে মুক্ত। আমি যা দেখেছি তোমরা তা দেখনি। আমি আল্লাহকে ভয় করি। আর আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা’ (আনফাল ৮/৪৮)।

আল্লাহর কসম! আমরা তোমার পূর্বে বহু জাতির নিকটে রাসূল প্রেরণ করেছি। অতঃপর শয়তান তাদের মন্দ কর্মসমূহকে শোভনীয় করে দেখিয়েছিল। সে আজ তাদের অভিভাবক। আর তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (নাহল ১৬/৬৩)।

৪:১২২ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ سَنُدۡخِلُهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَاۤ اَبَدًا ؕ وَعۡدَ اللّٰهِ حَقًّا ؕ وَ مَنۡ اَصۡدَقُ مِنَ اللّٰهِ قِیۡلًا

আর যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে, আমরা তাদেরকে প্রবেশ করাব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। আর কে আল্লাহর চেয়ে কথায় সত্যবাদী?

যখন আল্লাহর বিচার ফায়সালা শেষ হবে, তখন শয়তান (একটি বিবৃতি দিয়ে) বলবে : আল্লাহ তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা-ই ছিলো সত্য প্রতিশ্রুতি। আমিও তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। তোমাদের উপর তো আমার কোনো কর্তৃত্ব ছিলনা; আমি তো কেবল তোমাদের আহবান করেছি, আর তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করোনা; বরং তোমরা নিজেদেরকেই তিরস্কার করো। আমি (আল্লাহর শাস্তি থেকে) তোমাদের রক্ষা করতে পারবোনা, আর তোমরাও আমাকে রক্ষা করতে পারবেনা। ইতোপূর্বে তোমরা যে আমাকে আল্লাহর শরিক ও সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছিলে আমি সেটা (সে মর্যাদা) অস্বীকার করছি। নিশ্চয়ই যালিমদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা  ইবরাহিম :  ২২)

৪:১২৩ لَیۡسَ بِاَمَانِیِّکُمۡ وَ لَاۤ اَمَانِیِّ اَهۡلِ الۡکِتٰبِ ؕ مَنۡ یَّعۡمَلۡ سُوۡٓءًا یُّجۡزَ بِهٖ ۙ وَ لَا یَجِدۡ لَهٗ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَلِیًّا وَّ لَا نَصِیۡرًا

তোমাদের খেয়াল-খুশী ও কিতাবীদের খেয়াল-খুশী অনুসারে কাজ হবে না; কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সে পাবে এবং আল্লাহ ছাড়া তার জন্য সে কোন অভিভাবক ও সহায় পাবে না।

আয়াতে মুসলিম ও আহলে-কিতাবদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি কথোপকথন উল্লেখিত হয়েছে। এরপর কথোপকথন বিচার করে উভয় পক্ষকে বিশুদ্ধ হেদায়াত দেয়া হয়েছে। অবশেষে আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় ও শ্রেষ্ঠ হওয়ার একটি মানদণ্ড ব্যক্ত করা হয়েছে, যা সামনে রাখলে মানুষ কখনো ভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতার শিকার হবে না। এতে বলা হয়েছে যে, এ গর্ব ও অহংকার কারো জন্য শোভা পায় না। শুধু কল্পনা, বাসনা ও দাবী দ্বারা কেউ কারো চাইতে শ্রেষ্ঠ হয় না; বরং প্রত্যেকের কাজকর্মই শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি। কারো নবী ও গ্রন্থ যতই শ্রেষ্ঠ হোক না কেন, যদি সে ভ্রান্ত কাজ করে, তবে সেই কাজের শাস্তি পাবে। এ শাস্তির কবল থেকে রেহাই দিতে পারে- এরূপ কাউকে সে খুঁজে পাবে না।

এ আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ “যে কেউ কোন অসৎকাজ করবে, সে জন্য তাকে শাস্তি দেয়া হবে”। আয়াতটি যখন নাযিল হল, তখন আমরা খুব দুঃখিত ও চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে বললামঃ এ আয়াতটি তো কোন কিছুই ছাড়েনি। সামান্য মন্দ কাজ হলেও তার সাজা দেয়া হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ চিন্তা করো না, সাধ্যমত কাজ করে যাও।

কেননা, (উল্লেখিত শাস্তি যে জাহান্নামই হবে, তা জরুরী নয়) তোমরা দুনিয়াতে যে কোন কষ্ট বা বিপদাপদে পড়, তাতে তোমাদের গোনাহর কাফফারা এবং মন্দ কাজের শাস্তি হয়ে থাকে। এমনকি যদি কারো পায়ে কাটা ফুটে, তাও গোনাহর কাফফারা বৈ নয়।’ [মুসলিমঃ ২৫৭৪] অন্য এক বর্ণনায় আছে, মুসলিম দুনিয়াতে যে কোন দুঃখ-কষ্ট, অসুখ-বিসুখ অথবা ভাবনা-চিন্তার সম্মুখীন হয়, তা তার গোনাহর কাফফারা হয়ে যায়। [বুখারীঃ ৫৬৪১, মুসলিমঃ ২৫৭৩] অন্য হাদীসে এসেছে, আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে কিছু বিপদাপদ দিয়ে থাকেন। [বুখারী ৫৬৪৫]

মোটকথা, আলোচ্য আয়াতে মুসলিমদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, শুধু দাবী ও বাসনায় লিপ্ত হয়ো না; বরং কাজের চিন্তা কর। কেননা, তোমরা অমুক নবী কিংবা গ্রন্থের অনুসারী শুধু এ বিষয় দ্বারাই তোমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবে না। বরং এ গ্রন্থের প্রতি বিশুদ্ধ ঈমান এবং তদনুযায়ী সৎকার্য সম্পাদনের মধ্যেই প্রকৃত সাফল্য নিহিত রয়েছে।

৪:১২৪ وَ مَنۡ یَّعۡمَلۡ مِنَ الصّٰلِحٰتِ مِنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی وَ هُوَ مُؤۡمِنٌ فَاُولٰٓئِکَ یَدۡخُلُوۡنَ الۡجَنَّۃَ وَ لَا یُظۡلَمُوۡنَ نَقِیۡرًا

আর পুরুষ বা নারীর মধ্যে কেউ মুমিন অবস্থায় সৎকাজ করলে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।

যেমন পূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা নিজেদের ব্যাপারে সুধারণার বড় আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত ছিল। এখানে মহান আল্লাহ তাদের সেই সুধারণার পর্দা ফাঁস করে বলেন যে, আখেরাতের সফলতা কেবল আশা ও আকাঙ্ক্ষায় পাওয়া যাবে না। তার জন্য তো ঈমান এবং নেক আমলের সম্বল প্রয়োজন। পক্ষান্তরে আমলনামা যদি মন্দ কাজে পরিপূর্ণ থাকে, তাহলে যেভাবেই হোক না কেন তার শাস্তি ভোগ করতেই হবে। সেখানে এমন কোন বন্ধু অথবা সাহায্যকারী হবে না যে মন্দ কাজের শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে নিতে পারবে। আলোচ্য আয়াতে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের সাথে সাথে মহান আল্লাহ ঈমানদারদেরকেও সম্বোধন করেছেন, যাতে তারা যেন তাদের মত বৃথা সুধারণা এবং আমলশূন্য আশা ও আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেদেরকে সুদূরে রাখে। কিন্তু অনুতাপের বিষয় যে, এই সতর্কতা সত্ত্বেও মুসলিমরা সেই খামখেয়ালীর মধ্যে পতিত হয়ে পড়েছে যার মধ্যে পতিত ছিল পূর্বের জাতিসমূহ। বর্তমানে বে-আমল ও বদ-আমল মুসলিমদের আলামত ও চিহ্ন হয়ে গেছে, আর তা সত্ত্বেও তারা নিজেদেরকে উম্মতে মারহুমা (রহমপ্রাপ্ত উম্মত) বলে দাবী করছে! هَدَانَا اللهُ تَعَالَى

৪:১২৫ وَ مَنۡ اَحۡسَنُ دِیۡنًا مِّمَّنۡ اَسۡلَمَ وَجۡهَهٗ لِلّٰهِ وَ هُوَ مُحۡسِنٌ وَّ اتَّبَعَ مِلَّۃَ اِبۡرٰهِیۡمَ حَنِیۡفًا ؕ وَ اتَّخَذَ اللّٰهُ اِبۡرٰهِیۡمَ خَلِیۡلًا

তার চেয়ে দ্বীনে আর কে উত্তম যে সৎকর্মপরায়ণ হয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীমের মিল্লাতকে অনুসরণ করে? আর আল্লাহ ইবরাহীমকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন।

পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় রাসুলকে মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন—

ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

এরপর (হে নবি!) আমি ওহির মাধ্যমে তোমার প্রতি এই হুকুম অবতীর্ণ করেছি যে, তুমি মিল্লাতে ইবরাহিমের অনুসরণ করো, যে নিজেকে আল্লাহর অভিমুখী করে রেখেছিলো এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। [সুরা নাহল— ১২৩]

قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ دِينًا قِيَمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

(হে নবি!) বলে দাও, আমার প্রতিপালক আমাকে সরল পথ প্রদর্শন করেছেন, যা বক্রতা থেকে মুক্ত দ্বীন— মিল্লাতে ইবরাহিম, যে একনিষ্ঠভাবে নিজেকে আল্লাহর অভিমুখী করে রেখেছিলো আর সে ছিলো না শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত। [সুরা আনআম— ১৬১]

এবং তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো, যেভাবে জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে (তার দীনের জন্য) মনোনীত করেছেন। তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। নিজেদের পিতা ইবরাহিমের দ্বীনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো। সে পূর্বেই তোমাদের নাম রেখেছে ‘মুসলিম’ এবং এ কিতাবেও (তোমাদের নাম তা-ই রাখা হয়েছে)। যাতে এই রাসুল তোমাদের জন্য সাক্ষী হতে পারে আর তোমরা সাক্ষী হতে পারো অন্যান্য মানুষের জন্য। [সুরা হজ— ৭৮]

মিল্লাত অর্থঃ পথ বা পদ্ধতি

যারা মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করে, তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَمَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَاتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَاتَّخَذَ اللَّهُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا

তার চেয়ে উত্তম দ্বীন আর কার হতে পারে, যে সৎকর্মপরায়নশীল হয়ে নিজেকে আল্লাহর সমুখে অবনত করেছে এবং একনিষ্ঠ ইবরাহিমের মিল্লাতের অনুসরণ করেছে! আর আল্লাহ ইবরাহিমকে খলিল (বিশিষ্ট বন্ধু) -রূপে গ্রহণ করেছেন। [সুরা নিসা— ১২৫]

যারা মিল্লাতে ইবরাহিম থেকে বিমুখ হয়, তাদেরকে ভৎসনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَمَنْ يَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ إِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهُ وَلَقَدِ اصْطَفَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ

যে নিজেকে নির্বোধ সাব্যস্ত করেছে সে ছাড়া আর কে ইবরাহিমের মিল্লাত পরিহার করে! বাস্তবতা তো এই যে, আমি দুনিয়ায় তাকে বেছে নিয়েছি আর আখিরাতে সে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে। [সুরা বাকারা— ১৩০]

মিল্লাতে ইবরাহিমকে ‘হানিফিয়্যাহ’ও বলা হয়। অসংখ্য হাদিসে এর কথা উল্লেখ হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قِيلَ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيُّ الْأَدْيَانِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ؟ قَالَ: ” الْحَنِيفِيَّةُ السَّمْحَةُ ”

ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা পছন্দনীয় দ্বীন কোনটি? তিনি বললেন, সহজ সরল হানিফিয়্যাহ (মিল্লাতে ইবরাহিম)। [সহিহ বুখারি— ১/৯৩; আলআদাবুল মুফরাদ— ২৮৭; মুসনাদে আহমদ— ২১০৭]

মিল্লাতে ইবরাহিমের মূল বৈশিষ্ট্য

মিল্লাতে ইবরাহিমের মূল বৈশিষ্ট্য দুটি—

১. সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য একনিষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা।

২. শিরক এবং মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা, শত্রুতার ঘোষণা দেয়া এবং প্রকাশ্যে তাগুতকে অস্বীকার করা।

আল্লাহ তাআলা বলেন—

“তোমাদের জন্য ইবরাহিম এবং তার সঙ্গীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। স্মরণ করো ঐ সময়ের কথা, যখন তারা নিজ কাওমের লোকদেরকে বললো, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের উপাসনা করো, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনোই সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের (আকিদা-বিশ্বাস-নীতিমালা) অস্বীকার করি। আমাদের মধ্যে এবং তোমাদের মধ্যে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে গেছে, যতোক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে।” {সুরা মুমতাহিনাঃ ৪}

এখানে সফলতার একটি মান-নির্ণায়ক এবং আদর্শ পেশ করা হচ্ছে। মান-নির্ণায়ক হল, নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা, সৎকাজে নিরত থাকা এবং ইবরাহীমী ধর্মের অনুসরণ করা। আর আদর্শ ইবরাহীম (আঃ); যাঁকে আল্লাহ তাআলা নিজের খলীল বানিয়ে ছিলেন। খলীলের অর্থ হল, যার অন্তরে মহান আল্লাহর ভালোবাসা এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, তাতে আর কারো জন্য স্থান থাকে না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মনে রেখ, আমি প্রত্যেক অন্তরঙ্গ বন্ধুর অন্তরঙ্গতা থেকে বিমুক্ত ঘোষণা করছি, যদি আমি কাউকে ‘খলীল’ বা অন্তরঙ্গ বন্ধু গ্রহণ করতাম, তবে আবু বকরকে গ্রহণ করতাম। তোমাদের সঙ্গী (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজেই) আল্লাহর খলীল বা অন্তরঙ্গ বন্ধু। [মুসলিম: ২৩৮৩] মূলত: খলীল বলা হয়, এমন বন্ধুত্বকে যার বন্ধুত্ব অন্তরের অন্তঃস্থলে জায়গা করে নিয়েছে। অন্তরের রন্ধে রন্ধে প্রবেশ করেছে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেভাবে আল্লাহ্‌র খলীল, তেমনিভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আল্লাহর খলীল।

৪:১২৬ وَ لِلّٰهِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ بِکُلِّ شَیۡءٍ مُّحِیۡطًا

আর আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই এবং সবকিছুকে আল্লাহ পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।