সুরা আন নিসাঃ ২-৬ আয়াত

 

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

৪:২ وَ اٰتُوا الۡیَتٰمٰۤی اَمۡوَالَهُمۡ وَ لَا تَتَبَدَّلُوا الۡخَبِیۡثَ بِالطَّیِّبِ ۪ وَ لَا تَاۡکُلُوۡۤا اَمۡوَالَهُمۡ اِلٰۤی اَمۡوَالِکُمۡ ؕ اِنَّهٗ کَانَ حُوۡبًا کَبِیۡرًا ﴿۲﴾

২. আর ইয়াতীমদেরকে তোমরা তাদের ধন-সম্পদ সমর্পণ করো এবং ভালোর সাথে মন্দ বদল করো না আর তোমাদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ মিশিয়ে গ্রাস করো না; নিশ্চয় এটা মহাপাপ।

আয়াতে বলা হয়েছে, ইয়াতীমের সম্পদ তাদেরকে যথার্থভাবে বুঝিয়ে দাও। আরবী ‘ইয়াতীম’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে- নিঃসঙ্গ। একটি ঝিনুকের মধ্যে যদি একটিমাত্র মুক্তা জন্ম নেয়, তখন একে ‘দুররাতুন-ইয়াতীমাতুন’ বা ‘নিঃসঙ্গ মুক্তা’ বলা হয়ে থাকে।

ইসলামী পরিভাষায় যে শিশু-সন্তানের পিতা ইন্তেকাল করে, তাকে ইয়াতীম বলা হয়। ছেলে-মেয়ে বালেগ হয়ে গেলে তাদেরকে ইসলামী পরিভাষায় ইয়াতীম বলা হয় না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বালেগ হওয়ার পর আর কেউ ইয়াতীম থাকে না। [আবু দাউদঃ ২৮৭৩]

ইয়াতীম যদি পারিতোষিক অথবা উপঢৌকন হিসেবে কিছু সম্পদপ্রাপ্ত হয়, তাহলে ইয়াতীমের অভিভাবকের দায়িত্ব হচ্ছে সেসব মালেরও হেফাজত করা। ইয়াতীমের মৃত পিতা অথবা দেশের সরকার যে-ই উক্ত অভিভাবককে মনোনীত করুক না কেন; তার উপরই ইয়াতীমের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বর্তায়। উক্ত অভিভাবকের উচিত, ইয়াতীমের যাবতীয় প্রয়োজন তার গচ্ছিত ধন-সম্পদ থেকে নির্বাহ করা। এ আয়াতে ইয়াতিমের সম্পদ তার হাতে বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোন শর্তারোপ করা হয়নি। পক্ষান্তরে পরবর্তী ৬ নং আয়াতে এ সম্পদ তাদের কাছে প্রত্যার্পণ করার জন্য দুটি শর্ত দিয়েছে। এক, ইয়াতীম বালেগ হতে হবে, দুই ভাল-মন্দ বিবেচনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। কারণ, বালেগ হওয়ার পূর্বে তার জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেচনা সম্পত্তি সংরক্ষণের মত না হওয়াই স্বাভাবিক। দুটো বিষয় তাদের মধ্যে পাওয়া গেলে তাদের সম্পদ তাদের কাছে ফেরৎ দেয়া উচিত। [আদওয়াউল বায়ান]

(২) মুজাহিদ বলেন, এর অর্থ তোমরা হালালকে হারামের সাথে মিশিয়ে ফেলো না। [তাবারী]

(৩) এ আয়াতে ইয়াতিমের সম্পদ গ্রাস করাকে বড় গুনাহ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু গোনাহের পরিণাম সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হয়নি। এ সূরারই ১০ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সেটা ঘোষণা করে বলেছেন, “যারা ইয়াতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে তারা তো তাদের পেটে আগুনই খাচ্ছে, তারা অচিরেই জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে।” [আদওয়াউল বায়ান]পিতৃহীন, অনাথ বা ইয়াতীম যখন সাবালক হয়ে যাবে এবং ভাল-মন্দ বুঝতে শিখবে, তখন তাকে তার ধন-সম্পদ বুঝিয়ে (ফিরিয়ে) দাও। ‘খাবীস’ বলতে নিকৃষ্ট জিনিস এবং ‘ত্বাইয়্যিব’ বলতে উৎকৃষ্ট জিনিসকে বুঝানো  হয়েছে। অর্থাৎ, এমন করো না যে, তাদের মাল থেকে উৎকৃষ্ট জিনিসগুলো নিয়ে তার পরিবর্তে নিকৃষ্ট জিনিস দিয়ে গুনতি পূরণ করে দেবে। এই নিকৃষ্ট জিনিসগুলোকে খাবীস (নাপাক) এবং উৎকৃষ্ট জিনিসগুলোকে ত্বাইয়্যিব (পবিত্র) আখ্যা দিয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এইভাবে পরিবর্তন করা মাল যদিও প্রকৃতপক্ষে ত্বাইয়্যিব (পবিত্র ও হালাল), তবুও তোমাদের বিশ্বাসঘাতকতা তাকে অপবিত্র করে দিয়েছে। কাজেই এখন তা আর পবিত্র নেই, বরং তোমাদের জন্য তা অপবিত্র ও হারাম হয়ে গেছে। অনুরূপ বেঈমানী করে তাদের মালকে নিজের মালের সাথে মিশ্রিত করে খাওয়াও নিষেধ। তবে যদি তাদের কল্যাণ উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তাদের মালকে নিজের মালের সাথে

৪:৩ وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ اَلَّا تُقۡسِطُوۡا فِی الۡیَتٰمٰی فَانۡکِحُوۡا مَا طَابَ لَکُمۡ مِّنَ النِّسَآءِ مَثۡنٰی وَ ثُلٰثَ وَ رُبٰعَ ۚ فَاِنۡ خِفۡتُمۡ اَلَّا تَعۡدِلُوۡا فَوَاحِدَۃً اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ ؕ ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَلَّا تَعُوۡلُوۡا ؕ﴿۳﴾

৩. আর যদি তোমরা আশংকা কর যে, ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভাল লাগে, দুই, তিন বা চার; আর যদি আশংকা কর যে সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকেই বা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকেই গ্রহণ কর। এতে পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভাবনা বেশী।

– وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَىٰ فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ “আর যদি তোমরা এতিম মেয়েদের সাথে বেইনসাফী করার ব্যাপারে ভয় করো, তাহলে যে সব মেয়েদের তোমরা পছন্দ করো, তাদের মধ্য থেকে দুই, তিন বা চারজনকে বিয়ে করো”। মুফাস্সিরগন যার ৩টি অর্থ বর্ণনা করেছেনঃ

১. হযরত আয়েশা রা. এর ব্যাখ্যাঃ এতিম মেয়েদের ব্যাপারে ইনসাফ রক্ষার আশংকা থাকলে এতিমদের বাহিরে নিজেদের পছন্দ মতো মেয়েদের বিয়ে করো। ইনসাফ বলতে এখানে যে অবস্থা ছিল তাহলোঃ অভিভাবকহীন এতীম মেয়েদের বিয়ে করা হতো তিনটি কারণে। ১. এতিমদের সম্পদ। ২. এতিমদের সৌন্দর্য। ৩. এতিমদের বিয়ে করলে তাদের সাথে যে আচরণ করা হোক না কেন, কেউ খবরদারী করার নাই।

 

আর এ ব্যাপারে এই সূরার ১৯নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ

إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ ۗ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ۗ وَمَن يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ

ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন –জীবনবিধান৷ যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তারা এ দীন থেকে সরে গিয়ে যেসব বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, সেগুলো অবলম্বনের এ ছাড়া আর কোন কারণই ছিল না যে, প্রকৃত জ্ঞান এসে যাওয়ার পর তারা নিজেদের মধ্যে পরস্পরের ওপর বাড়াবাড়ি করার জন্য এমনটি করেছে৷ আর যে কেউ আল্লাহর হেদায়াতের আনুগত্য করতে অস্বীকার করে, তার কাছ থেকে হিসেব নিতে আল্লাহর মোটেই দেরী হয় না৷

২. হযরত আব্দুল ইবনে আব্বাস রা. এবং তার ছাত্র ইকরামা এর ব্যাখ্যাঃ জাহেলী যুগে বিয়ের সংখ্যায় কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। ফলে একেকজন ১০টি পর্যন্ত বিয়ে করতো।  আর এতে করে সংসারের খরচ বাড়তো। ফলে ওরা বাধ্য হয়ে এতিম ভাইঝি বা ভাগ্নি ও অন্যান্য অসহায়দের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতো। সেই বেইনসাফী থেকে বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ ৪টি বিয়ের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়, যাতে তারা সুবিচার পায়।

৩. সাঈদ ইবনে জুবাইর, কাতাদাহ ও অন্যান্য মুফাস্সিরদের ব্যাখ্যাঃ জাহেলীও যুগে এতিমদের সাথে বেইনসাফী সুনজরে দেখা হতো না। কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারে ইসনাফ সংক্রান্ত ব্যাপারে তারা ছিল বেখবর। বিধায় তারা ইচ্ছামতো বিয়ে করতো। এখানে মূলতঃ সে দিকে ইংগীত করা হয়েছে যে, এতিমদের উপর যুলুমকে তোমরা যেভাবে ভয় করো, মেয়েদের সাথেও ইনসাফের ব্যাপারে সমান ভয় করো। আর ইনসাফ রক্ষার স্বার্থে তোমরা ধারাবাহিকতা রক্ষা করো। এক সাথে ৪ বিয়ে না করে ইনসাফের দিক লক্ষ রেখে  বিয়ের সংখ্যা বাড়াও, তবে ৪ হচ্ছে সর্বশেষ সীমা।

– উপরোক্ত আয়াতের বক্তব্য ৩টি ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করার সম্ভাবনা দেখায়।

– فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً “কিন্তু যদি তোমরা তাদের সাথে ইনসাফ করতে পারবে না বলে আশংকা করো , তাহলে একজনকেই বিয়ে করো।”

** এই আয়াতের উপর ফকীহ গনের ইজমা রয়েছে। আর তা হলো এক সাথে এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৪জন স্ত্রী রাখতে পারবে।

** হাদীসে বলা হয়েছেঃ তায়েফ প্রধান গাইলানের ইসলাম গ্রহণ কালে ৯ জন স্ত্রী ছিলেন। রাসূল সা. ৪জন রেখে বাকী ৫জনকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দেন।

** নওফল ইবনে মুয়াবিয়ার ৫জন স্ত্রী ছিল। রাসূল সা. ১জনকে তালাক দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।

** ইনসাফ ও ন্যায় নিষ্ঠার শর্ত পুর্ণ না করে একাধিক স্ত্রী রাখার বৈধতার সুযোগ গ্রহণ আল্লাহর সাথে প্রতারণা।

** যে ব্যক্তি স্ত্রী বা স্ত্রীদের সাথে ইনসাফ করেনা, ইসলামী আদালত তাদের অভিযোগ শুনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

– খৃষ্টবাদী ধ্যান ধারণার লোকেরা এই আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চায় যে, কুরআনের উদ্দেশ্য ছিল একাধিক বিয়ের পদ্ধতি বিলুপ্ত করা। কিন্তু সমাজে এর প্রচলন বেশী হওয়ার বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে মাত্র।

– একাধিক স্ত্রী গ্রহণ অনিষ্টকর মনে করা সঠিক নয় এজন্য যে,

১. কোন কোন সময় নৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে একাধিক বিয়ের প্রয়োজন হয়। যারা এক স্ত্রীতে তুষ্ট হতে পারেনা, তাদের মাধ্যমে যৌন বিশৃংখলা সৃষ্টির আশংকা রয়েছে।

২. একাধিক স্ত্রীর চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তির চাহিদা পুরণ না করলে সমাজ সংস্কৃতি ও নৈতিকতায় যে অনিষ্ট হবে, তা একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনিষ্টতার চেয়ে ভয়াবহ।

এই আয়াতে বোঝা যাচ্ছে যে কোনো মুসলমান ইচ্ছা করলে একের অধিক বিয়ে (চারের বেশি নয়) করতে পারে। কিন্তু তাতে শর্ত হলো তাকে তার স্ত্রীদের মাঝে সুবিচার অর্থাৎ একাই রকম ভালবাসা, খাদ্য, বস্ত্র দিতে হবে এবং তাদের একের উপর অপরকে প্রাধান্য দেওয়া চলবে না। আর যে একাধিক বিয়ে করতে ইচ্ছুক কিন্তু তার মনে হচ্ছে তার স্ত্রীদের মাঝে সুবিচার বা সমতা রাখতে পারবে না তাহলে তাকে একটি বিয়েতেই সন্তুষ্ট থাকতে বলা হচ্ছে। স্ত্রীদের মাঝে সুবিচার করা নিশ্চয় কঠিন কাজ। আল্লহ মানুষকে সাবধান করে বলেছেন,

“তোমরা যতই আগ্রহ রাখো না কেন, তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সমান ব্যবহার করতে কখনো সক্ষম হবে না……”(সুরা নিসা ০৪:১২৭)

উপরের দুটি আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ইসলামে চারটি বিবাহ করা বৈধ কিন্তু একটি বিবাহ করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে এবং বহু বিবাহে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন “….তোমরা এক জনের প্রতি সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পর না ও অপরকে (অপর স্ত্রীকে) ঝুলন্ত অবস্তায় রেখে দিও না …( সুরা নিসা ০৩:১২৭)

এ ব্যপারে নবী মুহাম্মদ (স:) বলেন,

“যে ব্যক্তির দুই জন স্ত্রী আছে, কিন্তু তার মধ্যে এক জনের দিকে ঝুঁকে যায়, এরূপ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন অর্ধদেহ ধসা অবস্থায় উপস্থিত হবে।”

(আহমেদ ২/৩৪৭; আসবে সুনান; হাকিম ২/১৮৬) ইবনে হিব্বান ৪১৯)

বলা হয়ে থাকে যে, ইসলাম বহু বিবাহ বৈধ করেছে। আসলে ইসলাম বহু বিবাহের একটা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, যে কেউ চারটির বেশি বিবাহ করতে পারবে না। কারণ সে যুগে এমনকি আজ থেকে এক দেড়শ বছর আগে এই ভারতেই অনেক মানুষ ৩০-৫০-৮০ এমনকি ১০০ আরো বেশি বিবাহ করত! বিশ্বাস না হলে ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বহু বিবাহ’ ও ‘বাল্য বিবাহ’ বই দুটি পড়ে দেখতে পারেন। আপনি যদি রোম সাম্রাজ্যের, গ্রীক সাম্রাজ্যের অথবা পৃথিবীর যে কোনো ইতিহাস পড়েন তাহলে দেখবেন যে সে যুগে মানুষ অনেক স্ত্রী রাখত। সে জন্য ডেভেন্পর্ট বলেছেন যে, “মুহাম্মদ (স) বহু বিবাহকে সীমার বাধনে বেধে ছিলেন।”

ইসলাম চারটি বিবাহকে বৈধ বলেছে এবং একটি বিবাহ করতে উপদেশ দিয়েছে। সকল ধর্মেই বহু বিবাহ বৈধ। কিন্তু কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। অর্থাত আপনি যত ইচ্ছা বিয়ে করতে পারেন কোনো আসুবিধা নেই। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত দার্শনিক লিটনার তার “মহামেদানিসম” বই-এ লিখেছেন, “অপরিমিত বহু বিবাহ প্রথাকে মুহাম্মদ (স) রুখে দিয়ে ছিলেন।” তিনি আরো লিখছেন, “মুহাম্মদ (স) এর আইনের উত্সাহ কিন্তু স্পষ্টতই একটি বিবাহের পক্ষেই।”

স্পষ্ট ভাবে জেনে রাখা উচিত, ইসলাম কিন্তু লাগাম ছাড়া বহু বিবাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ করেছে। মধ্য যুগে বল্লাল সেন, কলিন্য সেন কৌলিন্য প্রথার মুখোসে যে বহু বিবাহ প্রথার প্রচলন করেছিলেন, সেই প্রথার সুযোগ নিয়ে কুলীন ব্রাহ্মণ শতাধিক বিবাহে মেতে উঠত। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ধর্মের নামে বহু কিশোরীকে ভোগ করত। নারীত্বের অপমানের কী চরম পদ্ধতিই না চালু ছিল মধ্যযুগের সেই সমাজে।

– أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ “অথবা তোমাদের অধিকারে সেসব মেয়ে আছে”।

** এখানে ক্রীতদাসী বুঝানো হয়েছে। আমাদের সমাজে অনেক পুরুষ গৃহকর্মীকে এই আয়াতের আলোকে মিলাতে চায় যা স্পষ্টতই ভয়ানক বিভ্রান্তি এবং এটা মূলত যেনা।

** ক্রীতদাসীদের বিয়ে করলে সাধারণ মহিলাদের চেয়ে কম দায়িত্ব থাকে।

** সূরা নিসাঃ ২৪ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ

وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلَّا مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۖ كِتَابَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ ۚ وَأُحِلَّ لَكُم مَّا وَرَاءَ ذَٰلِكُمْ أَن تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُم مُّحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ ۚ فَمَا اسْتَمْتَعْتُم بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا تَرَاضَيْتُم بِهِ مِن بَعْدِ الْفَرِيضَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا

আর (যুদ্ধের মাধ্যমে) তোমাদের অধিকারভুক্ত হয়েছে এমন সব মেয়ে ছাড়া বাকি সমস্ত সধবাই তোমাদের জন্য হারাম ৷ এ হচ্ছে আল্লাহর আইন৷ এ আইন মেনে চলা তোমাদের জন্য অপরিহার্য গণ্য করা হয়েছে ৷ এদের ছাড়া বাদ বাকি সমস্ত মহিলাকে অর্থ-সম্পদের মাধ্যমে লাভ করা তোমাদের জন্য হালাল গণ্য করা হয়েছে৷ তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে, অবাধ যৌন লালসা তৃপ্ত করতে পারবে না৷ তারপর যে দাম্পত্য জীবনের স্বাদ তোমরা তাদের মাধ্যমে গ্রহণ করো, তার বদলে তাদের মোহরানা ফরয হিসেবে আদায় করো৷ তবে মোহরানার চুক্তি হয়ে যাবার পর পারস্পরিক রেজামন্দির মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে যদি কোন সমঝোতা হয়ে যায় তাহলে তাতে কোন ক্ষতি নেই৷ আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও জ্ঞানী৷

** যুদ্ধবন্দিনী মহিলাদের ব্যাপারে বিধানঃ

১। যে সব মহিলাদের স্বামী দারুল হারবে রয়ে গেছে,

** তারা হারাম নয়। কারণ দারুল হারাম থেকে দারুল ইসলামে আসার পর বিয়ে ভেঙে যায়।

** যুদ্ধবন্দি মেয়েদের বিয়েও করা যায়, বিয়ে ছাড়া তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যায়।

২। যে সব মহিলা স্বামী স্ত্রী একসাথে যুদ্ধবন্দি হয়েছে, তাদের ব্যাপারে বিধানঃ

** আবু হানিফার মতে তাদের বিয়ে অপরিবর্তিত থাকবে।

** ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ীর মতে বিয়ে অটুট থাকবেনা।

৩। যুদ্ধ বন্দিনীদের দাসীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ব্যাপারে বক্তব্য সমূহঃ

একঃ

যুদ্ধ বন্দিনী করার সাথে সাথে যে কোন সৈনিক যে কারো সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অধিকারী হবেনা। বরং প্রথমে তারা সরকারের জিম্মায় যাবে।

সরকার তার নির্ধারিত ৪ আচরণ তথা

১. বিনা শর্তে মুক্তি দেয়া,

২. মুক্তিপণ গ্রহণ করে মুক্তি দেয়া,

৩. বন্দী বিনিময় করে মুক্তি দেয়া,

৪. সৈনদের মাঝে বন্টন করে দেয়া- করবে। যদি যদি কাউকে নির্দিষ্ট যুদ্ধ বন্দিনী প্রদান করে, তাহলে সৈনিক কেবল সেই বন্দিনীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।

দুইঃ সরকার থেকে প্রাপ্ত দাসীর সাথে কেবল তখনই যৌণ সম্পর্ক করা যাবে, যখন তার মাসিক পিরিওড শেষ হবে এবং নিশ্চত হওয়া যাবে যে সে গর্ভবতী নয়। যদি গর্ভবতী হয়, তাহলে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত সম্পর্ক স্থাপন অবৈধ।

তিনঃ যুদ্ধ বন্দিনী হওয়ার জন্য আহলে কিতাব হওয়া শর্ত নয়।

চারঃ যুদ্ধ বন্দিনীর সাথে যৌন সম্পর্কের কারণে যে সন্তান হয়, তা মালিকের সন্তান বলে গন্য হবে এবং ঐ সন্তানের আইনগত অধিকার ঔরসজাত সন্তানের অধিকারের মতো হবে। ঐ ধরণের বাদী আর বিক্রি করা যাবেনা এবং তার মালিকের মৃত্যুর পর সে আপনা-আপনি আযাদ হয়ে যাবে।

পাঁচঃ  যুদ্ধ বন্দিনী মালিক ছাড়া অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তার থেকে মালিক সকল খেদমত নেয়ার অধিকার রাখবে-কেবল যৌনাধিকার ছাড়া।

ছয়ঃ শরীয়াত স্ত্রীদের সংখ্যার মতো দাসীদের সংখ্যা নির্ধারণ করেনি।

সাতঃ অন্য মালিকানাধীন বস্তু যেমন বিক্রি বা হস্তান্তর করা যায়, যুদ্ধ বন্দিনীকেও বিক্রি বা হস্তান্তর করা যায়।

আটঃ বিয়ে যেমন আইন সংগত কাজ, সরকার কর্তৃক দাসীদের উপর কারো মালিকানার অধিকার তেমন ধরণের আইন সংগত কাজ।

নয়ঃ যুদ্ধবন্দীনি কাউকে একজনের মালিকানায় দেয়ার পর তাকে ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার সরকার রাখে না। যেমন কোন মেয়ের অভিভাবক কোন মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পর তাকে আবার ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার রাখেনা।

দশঃ সাময়িক সময়ের জন্য যুদ্ধবন্দিনীদেরকে সৈনিকদের মধ্যে বিনোদনের জন্য ভাগ করে দেয়া সম্পূর্ণ অবৈধ কাজ। এটা যেনার সমতুল্য।

দাস-দাসী মুক্ত করার ব্যাপারে ইসলাম যে শরী‘য়ত সম্মত পদ্ধতি প্রণয়ন করেছে, তা নিম্নোক্ত পদ্ধতি বা ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে:

ক. উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে মুক্তি দান;

দাস-দাসী মুক্ত করে দেওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ডভাবে এবং যথেষ্ট পরিমাণে মনিবদেরকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ فَلَا ٱقۡتَحَمَ ٱلۡعَقَبَةَ ١١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا ٱلۡعَقَبَةُ ١٢ فَكُّ رَقَبَةٍ ١٣ … ﴾ [البلد: ١١،  ١٣]

 

“তবে সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি। আর কিসে আপনাকে জানাবে যে, বন্ধুর গিরিপথ কী? এটা হচ্ছে দাসমুক্তি …। সূরা আল-বালাদ: ১১ – ১৩

যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি মাসজিদ নির্মাণ করবে যাতে আল্লাহ তা‘আলার যিকির (স্মরণ) করা হবে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো একজন মুসলিম গোলামকে আযাদ করবে, তা জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য তার মুক্তিপণ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার পথে শুভ্রকেশী (বৃদ্ধ) হবে, তা তার জন্য কিয়ামতের দিনে আলো হবে।” – [মুসনাদে আহমদ]

খ. কাফ্ফারা প্রদানের মাধ্যমে মুক্তি দান;

কাফ্ফারার মাধ্যমে দাস-দাসী আযাদ করার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় তুলে ধরা হল:

– ভুলবশত হত্যার কাফ্ফারা নির্ধারণ করা হয়েছে একজন দাস মুক্ত করা এবং তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় করা; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَن قَتَلَ مُؤۡمِنًا خَطَ‍ٔٗا فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٖ مُّؤۡمِنَةٖ وَدِيَةٞ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦٓ

“আর কেউ কোনো মুমিনকে ভুলবশত হত্যা করলে এক মুমিন দাস মুক্ত করা এবং তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় করা কর্তব্য ।” সূরা আন-নিসা: ৯২

গ. লিখিত চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি দান;

ঘ. রাষ্ট্রীয় তত্ত্ববধানে মুক্তি দান;

ঙ. সন্তানের মা (উম্মুল অলাদ) হওয়ার কারণে মুক্তি দান;

চ. নির্যাতনমূলক প্রহারের কারণে মুক্তি দান।

ইসলাম কেন দাসত্ব প্রথাকে চূড়ান্তভাবে বাতিল করেনি?

ইসলাম তথাকথিত দাসপ্রথার সকল উৎস আরব উপ-দ্বীপ ও অন্যান্য স্থানে একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে; আর তার দ্বারা সম্ভব ছিল সুস্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে দাসত্ব প্রথাকে চূড়ান্তভাবে বাতিল বলে ঘোষণা করা, যেমনিভাবে বাতিল করে দিয়েছে মাদকদ্রব্য, সুদ প্রথা ও যিনা-ব্যভিচারকে … যদি (দাসপ্রথার) একটি মূল উৎসস্থল (ঝর্ণা) না থাকত, তাহলে দাসত্ব প্রথা সকল স্থানেই ছড়িয়ে যেত এবং সকল জাতি ও রাষ্ট্র প্রত্যেক ফোটায় ফোটায় তার দ্বারা পরস্পর ব্যবসা-বাণিজ্য করত; সেই মূল উৎসস্থল (ঝর্ণা) হলো যুদ্ধের কারণে দাসত্ব … আর ইসলাম প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের কারণে দাসত্বের এই উৎসস্থলটিকে সুস্পষ্ট ও অকাট্য বক্তব্যের দ্বারা বাতিল করেনি অনেকগুলো দিক বিবেচনা করে; তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হল:

১. আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি;

২. রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি;

৩. আত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি;

৪. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি;

৫. শর‘য়ী দৃষ্টিভঙ্গি।

অচিরেই আমরা এই পাঁচটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যেকটির ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করব; আর আল্লাহর কাছেই সরল পথ:

০ আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি:

আমরা পূর্বেই যখন দাসত্বের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনার উদ্যোগ নেই, তখন আলোচনা করেছি যে, ইসলামের আগমন ঘটেছে এমতাবস্থায় যে বিশ্বের সকল শাসন ব্যবস্থায় দাসত্ব প্রথা স্বীকৃত; বরং তা ছিল বহুল প্রচলিত অর্থনৈতিক মুদ্রাসদৃশ এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রয়োজন … যা কেউ অপছন্দ করত না এবং তা পরিবর্তন করার সম্ভাব্যতার ব্যাপারে চিন্তা করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল না।

আর যে স্তরে এসে আজ দাসত্ব প্রথাকে বাতিল করা হলো, তার পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে কে জানে? সম্ভবত এমন একদিন আসবে, যেদিন দাস-দাসী বানানোর প্রথা বিশ্বে আবার ফিরে আসবে; বিশেষ করে যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস-দাসী বানানোর প্রথা— আর দাসত্ব হয়ে যাবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রথা, বহুল প্রচলিত একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং সামাজিকভাবে খুব প্রয়োজনীয় একটি বিষয়।

সুতরাং উক্ত অবস্থায় এটা কোনোভাবেই বিবেকসম্মত হবে না যে, এর মোকাবিলায় ইসলাম হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। বরং অচিরেই ইসলামকেও অনুরূপ নীতিরর পুণঃপ্রচলন করতে হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যা এই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে দিবে অথবা বাতিল করে দিবে। আর এর জন্য অনেক দীর্ঘ ও লম্বা সময়ের প্রয়োজন হবে; আরও প্রয়োজন হবে জনগণ কর্তৃক ইসলামের প্রকৃত বাস্তবতা এবং সৃষ্টি, জীবন ও মানুষের … ব্যাপারে তার সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন সম্পর্কে অনুধাবন করা; আরও জরুরি হলো দাস-দাসীগণ কর্তৃক মানবিক সম্মানের তাৎপর্য এবং মানবিক মর্যাদা ও সম্মানের অধিকার উপভোগ করা … যাতে তারা এই উপভোগ ও উপলব্ধির পরে অপমান ও অসম্মান থেকে তাদের স্বাধীনতা দাবি করতে পারে এবং তারা আরও দাবি করতে পারে গোলামী থেকে তাদের মুক্তির …।

বস্তুত বিংশ শতাব্দীতে দাসত্ব অন্য আরেক রং বা রূপ ধারণ করেছে, যার বিবরণ অচিরেই আসছে; সুতরাং (বর্তমানে) দাসত্ব মানে ভূখণ্ডের মলিকানা গ্রহণ, যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস-দাসী বানানো এবং প্রভাবশালীগণ কর্তৃক দুর্বল শ্রেণীর লোকদেরকে গোলাম বানানো … থেকে পরিবর্তন হয়ে গোটা জনগোষ্ঠীকে দাস-দাসী বানানোর দিকে পরিবর্তিত হয়েছে বলে বুঝায় … যেমনটি বিদ্বেষী উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো এবং নাস্তিক্যবাদী সমাজতান্ত্রিক সকরকারগুলো করছে … কারণ, তারা জনগণের মধ্যে ব্যাপক হৃদয়বিদারক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে, অতঃপর তারা তাদের ইচ্ছা-আকাঙ্খাকে হরণ করে এবং তাদেরকে তাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে; আর তাদেরকে আগ্নেয়াস্ত্রের শক্তির বলে শাসন করে … ফলে তারা কোনো মাথাকে উঁচু হয়ে দাঁড়ানোর এবং কোনো কণ্ঠকে কথা বলার সুযোগ দেয় না … আর এসব জনগোষ্ঠীর নিকট যে সম্পদরাশি আছে এবং তারা কর্মক্ষেত্রে ও অর্থনীতির ময়দানে যে শ্রম বিনোয়াগ করে … সেসব কিছু উপনিবেশবাদী অথবা সমাজতান্ত্রিক স্বৈরাচার সরকারগণের নিকট সমর্পন করা আবশ্যক হয়ে পড়ে … যাতে জাতিসমূহকে দাস-দাসী বানানো, জনগোষ্ঠীকে বশীভূত করা, স্বাধীনতাকে অপদস্থ করা এবং মানবিক সম্মান ও মর্যাদাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে তারা তা ব্যয় করতে পারে।

আর এই অবস্থায় অসম্ভব নয় যে, উপনিবেশিক শাসকবর্গ অথবা সমাজতান্ত্রিক শাসকগণ তাদের দাসত্ব প্রথা চাপিয়ে দিবে ব্যক্তি, অথবা পরিবার, অথবা গ্রাম, অথবা কোনো পুরো জাতি বা গোষ্ঠীর উপর… যাতে সকলকে আধুনিক দাস-দাসীর হাটে সম্পদ বা স্বার্থের বিনিময়ে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে … তাদেরকে বশীভূত ও গোলামে পরিণত করার জন্য !!

এ কারণেই ইসলাম অকাট্য ‘নস’ তথা বক্তব্যের মাধ্যমে দাসত্ব প্রথাকে চূড়ান্তভাবে বাতিল করেনি। অর্থাৎ প্রয়োজনে যেন আবার তা ব্যবহার করতে পারে। যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে এ ধরণের দাসত্ব পরিচালিত করবে ইসলামও যেনো তাদের বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করতে পারে। [সম্পাদক]

০ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি:

আর আমরা পূর্বে এটাও আলোচনা করেছি যে, ইসলাম মুসলিমদের ইমাম তথা নেতাকে যুদ্ধবন্দীদের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে অনুকম্পা প্রদর্শন, অথবা মুক্তিপণ গ্রহণ, অথবা হত্যা করা, অথবা দাস-দাসী বানানো ইত্যাদি বাছাইয়ের ব্যাপারে নিঃশর্ত ক্ষমতা প্রদান করেছে।

আর কোনো সন্দেহ নেই যে, ইমাম যখন কোনো বিষয়ে প্রকৃত হিকমত ও কল্যাণ লক্ষ্য করবেন এবং যখন গভীর ও ব্যাপক রাজনৈতিক সংকট লক্ষ্য করবেন, তখন তিনি যুদ্ধবন্দীদের সাথে সে অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল মূলনীতির উপর ভিত্তি করে আচার-আচরণ ও লেনদেন করবেন … কারণ তাকে তো শেষ পর্যন্ত একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান ও গ্রহণযোগ্য স্বার্থকেই গ্রহণ করে নিতে হবে।

সুতরাং তিনি যুদ্ধবন্দীদের সাথে আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে হত্যা করার নীতি অবলম্বন করা থেকে দূরে সরে যাবেন না, যখন তিনি মুসলিমদেরকে নড়বড়ে ও দুর্বল … অবস্থার মধ্যে দেখবেন; আর তিনি যুদ্ধবন্দীদের সাথে আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুকম্পা প্রদর্শন অথবা মুক্তিপণ গ্রহণ করার নীতি অবলম্বন করা থেকে দূরে সরে যাবেন না, যখন তিনি মুসলিমদেরকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী … অবস্থার মধ্যে দেখবেন; আর তিনি যুদ্ধবন্দীদের সাথে আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে দাস-দাসী বানানোর নীতি অবলম্বন করা থেকে দূরে সরে যাবেন না, যখন তিনি শত্রুদেরকে দেখবেন তারা আমাদের যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস-দাসী হিসেবে গ্রহণ করছে, যাতে পরস্পরের আচরণ সমান সমান হয়।

এভাবেই ইমাম রাজনৈতিক কল্যাণ, যুদ্ধ কেন্দ্রীক আবশ্যকতা ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন লক্ষ্য করে তাঁর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

সুতরাং কিভাবে ইসলাম সুস্পষ্ট ও অকাট্য ‘নস’ তথা বক্তব্যের মাধ্যমে দাসত্ব প্রথাকে বাতিল করবে, অথচ শত্রুদের পক্ষ থেকে যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস-দাসী বানানোর বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা রয়েছে; আর এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন প্রায় আসন্ন হয়ে পড়েছে! !

০ আত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি:

অনুরূপভাবে আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় বর্ণনা করেছি যে, ইসলাম যখন দাস-দাসীর সাথে সদ্ব্যবহার এবং তার চারিত্রিক, সামাজিক ও মানবিক মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার ব্যাপারে পরিপূর্ণ নিয়মকানুন প্রণয়ন করেছে …

তখন এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল, দাস-দাসী কর্তৃক তার মানবিক মার্যাদা, অস্তিত্ব ও অবস্থান উপলব্ধি করা … যাতে সে পরবর্তীতে দাসত্ব থেকে তার মুক্তি দাবি করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে।

আর আমরা পূর্বে এটাও দেখিয়েছি যে, ইসলাম বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা থেকে দাস-দাসীকে মুক্ত করার পূর্বে তাকে তার মনের ভিতর ও হৃদয়ের গভীর থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছে … যাতে সে তার অস্তিত্ব ও মান-সম্মানকে অনুভব করতে পারে; ফলে সে নিজে নিজেই স্বাধীনতা দাবি করবে এবং সে যখন তা দাবি করবে, তখন সে শরী‘য়তকে এই স্বাধীনতার জন্য সর্বোত্তম নিশ্চয়তা বিধানকারী এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সর্বোত্তম অভিভাবক হিসেবে পাবে; আর এটা আমরা ‘মুকাতাবা’ তথা লিখিত চুক্তির মাধ্যমে গোলাম আযাদ করার প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

আর আদেশ বা ফরমান জারি করার মাধ্যমে দাস-দাসী মুক্ত করার দ্বারা আসলেই দাস-দাসীর মুক্তি অর্জিত হয়নি, যেমন তার আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে; আর আমরা যা বলি, তার পক্ষে উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো ‘আব্রাহাম লিংকন’ এর হাতের কলমের নির্দেশ (লেখার) দ্বারা দাস-দাসী মুক্ত করে দেওয়ার ব্যাপারে আমেরিকান অভিজ্ঞতা; কারণ, বাহ্যিকভাবে আইনের দ্বারা লিংকন যেসব গোলামদেরকে মুক্ত করে দিয়েছিল, তারা স্বাধীন হতে পারেনি বরং তারা তাদের মনিবদের কাছেই ফিরে গেছে, তারা তাদের নিকট আশা করে যে, তারা তাদেরকে গোলাম হিসেবে পুনরায় গ্রহণ করে নেবে, যেমন তারা (গোলাম হিসেবে) ছিল; কারণ, (স্বাধীন করে দেওয়ার পরেও) তারা মন স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি এবং পারেনি তারা তাদের অপ্রত্যাশিত মুক্তি পাওয়ার দ্বারা মানবিক সুখ ও মর্যাদা অনুভব করতে …।

অন্যদিকে ইসলামের নীতি ও অপরাপর সামাজিক শাসন ব্যবস্থাসমূহে দাস-দাসী নীতির রয়েছে বিস্তর ফারাক। কারণ, ইসলাম দাসত্বের ছায়ায় দাস-দাসীর সাথে মানবিক ও উদার আচরণ করে থাকে (যা পূর্বে আলোচিত হয়েছে), এমন কি সে যখন এই সদ্ব্যবহার (যথাযথভাবে) উপভোগ ও উপলব্ধি করে, তখন সে শরী‘য়তের ছায়াতলে তার স্বাধীনতা দাবি করে এবং তার গোলামীর অবস্থা থেকে সে বেরিয়ে যায়; আর তখন সে হয় সম্মানিত মানুষ, সর্বোচ্চ আবেগ ও অনুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি এবং সর্বোত্তম সম্মান, মর্যাদা ও অস্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি …।

আর এখানেই ইসলাম কর্তৃক দাস-দাসীকে দাসত্বের উপর অবশিষ্ট রাখার তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে উঠে, যেখানে সে তার নিজস্ব সত্ত্বা ও অস্তিত্বকে অনুভব ও উপলব্ধি করবে; আর তখনই সে তার ইচ্ছামত সময় ও যথাযথ পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে ‘মুকাতাবা’ (লিখিত চুক্তি) পদ্ধতির মাধ্যমে তার স্বাধীনতা দাবি করবে !!

এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ইসলাম কোনো স্পষ্ট ফরমান জারি ও অকাট্য ‘নস’ তথা বক্তব্যের মাধ্যমে দাসত্ব প্রথাকে চূড়ান্তভাবে বাতিল করেনি।

০ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি:

কখনও কখনও দাসত্ব প্রথা বিদ্যমান থাকার মধ্যে বড় ধরনের সামাজিক কল্যাণ নিহিত থাকে, যেমন: তার (দাসত্ব প্রথার) উপস্থিতি জাতিগত বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যবাদ ও অবক্ষয়ের প্রবাহ থেকে সমাজকে পবিত্র রাখার ব্যাপারে ভূমিকা রাখে … সুতরাং উদাহরণস্বরূপ যে ব্যক্তি অতিরিক্ত মোহরের কারণে কোনো স্বাধীন নারীকে বিয়ে করতে অক্ষম হয়, তখন সে কোনো দাসীকে বিয়ে করবে অথবা ক্রয় সূত্রে তার মালিক হবে, যাতে সে বৈধ উপায়ে তার স্বভাগত চাহিদা পূরণ করতে পারে এবং বৈধ মালিকানার মাধ্যমে সে নিজেকে পাপমুক্ত রাখতে পারে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَن لَّمۡ يَسۡتَطِعۡ مِنكُمۡ طَوۡلًا أَن يَنكِحَ ٱلۡمُحۡصَنَٰتِ ٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ فَمِن مَّا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُم مِّن فَتَيَٰتِكُمُ ٱلۡمُؤۡمِنَٰتِۚ وَٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِإِيمَٰنِكُمۚ بَعۡضُكُم مِّنۢ بَعۡضٖۚ فَٱنكِحُوهُنَّ بِإِذۡنِ أَهۡلِهِنَّ وَءَاتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِ مُحۡصَنَٰتٍ غَيۡرَ مُسَٰفِحَٰتٖ وَلَا مُتَّخِذَٰتِ أَخۡدَانٖۚ فَإِذَآ أُحۡصِنَّ فَإِنۡ أَتَيۡنَ بِفَٰحِشَةٖ فَعَلَيۡهِنَّ نِصۡفُ مَا عَلَى ٱلۡمُحۡصَنَٰتِ مِنَ ٱلۡعَذَابِۚ ذَٰلِكَ لِمَنۡ خَشِيَ ٱلۡعَنَتَ مِنكُمۡۚ وَأَن تَصۡبِرُواْ خَيۡرٞ لَّكُمۡۗ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٢٥ يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمۡ وَيَهۡدِيَكُمۡ سُنَنَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ وَيَتُوبَ عَلَيۡكُمۡۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٢٦ وَٱللَّهُ يُرِيدُ أَن يَتُوبَ عَلَيۡكُمۡ وَيُرِيدُ ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلشَّهَوَٰتِ أَن تَمِيلُواْ مَيۡلًا عَظِيمٗا ٢٧ ﴾ [النساء: ٢٥،  ٢٧]

আর তোমাদের মধ্যে কারো মুক্ত ঈমানদার নারী বিয়ের সামর্থ্য না থাকলে তোমরা তোমাদের অধিকারভুক্ত ঈমানদার দাসী বিয়ে করবে; আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। তোমরা একে অপরের সমান; কাজেই তোমরা তাদেরকে বিয়ে করবে তাদের মালিকের অনুমতিক্রমে এবং তাদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দেবে ন্যায়সংগতভাবে। তারা হবে সচ্চরিত্রা, ব্যভিচারিণী নয় ও উপপতি গ্রহণকারিণীও নয়। অতঃপর বিবাহিতা হওয়ার পর যদি তারা ব্যভিচার করে, তবে তাদের শাস্তি মুক্ত নারীর অর্ধেক; তোমাদের মধ্যে যারা ব্যভিচারকে ভয় করে এগুলো তাদের জন্য; আর ধৈর্য ধারণ করা তোমাদের জন্য মংগল। আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু। আল্লাহ ইচ্ছে করেন তোমাদের কাছে বিশদভাবে বিবৃত করতে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি তোমাদেরকে অবহিত করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করতে চান। আর যারা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তারা চায় যে, তোমরা ভীষণভাবে পথচ্যুত হও।”সূরা আন-নিসা: ২৫ – ২৭

আর জনকল্যাণকর অনেক কাজ রয়েছে, যাতে সমাজ পর্দাবিহীন নারীদের প্রয়োজন অনুভব করে; আর দাসীরাই হলো এই শ্রেণী; কেননা, ইসলাম দাসীর উপর স্বাধীন নারীর মত পরিপূর্ণভাবে পর্দা করাকে ফরয করেনি; বরং শরী‘য়তের দৃষ্টিতে তার বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখাই যথেষ্ট, তবে তার ব্যাপারে যখন আশঙ্কা করা হবে, তখন (পাপের) উপলক্ষ বন্ধ করার জন্য পরিপূর্ণ পর্দা করা আবশ্যক হয়ে যাবে।

আর কখনও কখনও যুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত নারীকে দাসী বানানো তার পবিত্রতা রক্ষা, অভিভাবকত্ব এবং তার মানবিক সম্মান রক্ষার জন্য একটা সফল প্রতিষেধক বিবেচিত হতে পারে; কারণ, যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে ব্যক্তি তার দায়ভার গ্রহণ করবে, সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সাথে তার স্বামী অথবা তার ভাইয়ের মত আচরণ করবে; অথচ তাকে ছেড়ে দেওয়ার মানেই হলো তাকে নিশ্চিত ধ্বংস ও ক্ষতির দিকে ঠেলে দেওয়া।

আর এটা জানা কথা যে, ইসলামী শাসন ব্যবস্থার ছায়াতলে নারীকে দাসী বানানোর মানে হলো তাকে তার মনিবের জন্য শুধু মালিকানা সাব্যস্ত করে দেওয়া, সে ব্যতীত অন্য কেউ তাকে ভোগ করতে পারবে না; আর ইসলাম ‘মুকাতাবা’ পদ্ধতির মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করার বিষয়টিকে তার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছে এবং অনুরূপভাবে সে তার মনিবের মৃত্যুর পর সরাসরি স্বাধীন হয়ে যাবে, যখন সে তার মনিবের জন্য কোনো সন্তানের জন্ম দিবে; তাছাড়া সে তার মনিবের ঘরে ইসলামের নির্দেশনা অনুসারে সার্বিক তত্ত্ববধান, আদর-যত্ন ও উত্তম ব্যবহার … পাবে।

পক্ষান্তরে অমুসলিম রাষ্ট্রে তাকে দাসী হিসেবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্য হলো তার ইজ্জত নষ্ট করা এবং তার মান-মর্যাদাকে অবজ্ঞা করা, বরং তার ইজ্জত-আব্রু প্রত্যেক আকাঙ্খীর ব্যভিচারের মাধ্যমে লুণ্ঠিত হওয়া।

তাছাড়াও সে অসদাচরণ ও প্রকাশ্য অনুভবযোগ্য অপমান-অপদস্থের শিকার হয় ! …

অতএব দাস-দাসী বানানোটা কখনও কখনও সামাজিকভাবে কল্যাণকর হবে, আবার কখনও নৈতিকতার দিক বিবেচনায় হবে এবং কখনও মানবিক অনুকম্পার বাস্তবায়নার্থে দায়িত্ব গ্রহণের ফায়দা দিবে … যা সচেতন আলেমগণ ব্যতীত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারবে না … এই দিক বিবেচনা করেই ইসলাম কোনো স্পষ্ট ফরমান জারি ও অকাট্য ‘নস’ তথা বক্তব্যের মাধ্যমে দাসত্ব প্রথাকে চূড়ান্তভাবে বাতিল করেনি।

(ইসলামে দাস বিধিঃ আবদুল্লাহ নাসেহ ‘উলওয়ানঃ অনুবাদ : মোঃ আমিনুল ইসলাম

সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

৪:৪ وَ اٰتُوا النِّسَآءَ صَدُقٰتِهِنَّ نِحۡلَۃً ؕ فَاِنۡ طِبۡنَ لَکُمۡ عَنۡ شَیۡءٍ مِّنۡهُ نَفۡسًا فَکُلُوۡهُ هَنِیۡٓــًٔا مَّرِیۡٓــًٔا

. আর তোমরা নারীদেরকে তাদের মাহর মনের সন্তোষের সাথে প্রদান কর; অতঃপর সস্তুষ্ট চিত্তে তারা মাহরের কিছু অংশ ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।

আবদুল হামীদ ফাইযী(আদর্শ বিবাহ ও দাম্পত্য)

বিবাহ এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একে অন্যের কাছে উপকৃত ও পরিতৃপ্ত। কিন্তু স্বামীর অধিকার বেশী। তাই স্ত্রীর কর্তব্য অধিক। স্ত্রী তার দেহ-যৌবন সহ স্বামীর বাড়িতে এসে বা সদা ছায়ার ন্যায় স্বামী-পাশে থেকে তার অনুসরণ ও সেবা করে। তাই তো এই চুক্তিতে তাকে এমন কিছু পারিতোষিক প্রদান করতে হয় যাতে সে সন্তুষ্ট হয়ে স্বামীর বন্ধনে আসতে রাজী হয়ে যায়। সৃষ্টিকর্তা সবয়ং মানুষকে এ বিধান দিয়েছেন। তিনি বলেন,

﴿وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلاَّ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ كِتَابَ اللهِ عَلَيْكُمْ وَأُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَلِكُمْ أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً﴾

‘‘উল্লেখিত (অবৈধ) নারীগণ ব্যতীত অন্যান্য নারীগণকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তোমাদের সবীয় অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য, ব্যভিচারের জন্য নয়। তাদের মধ্যে যাদেরকে তোমরা উপভোগ করবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহর অর্পণ করবে।সূরা আল-বাক্বারা (৪) : ২৪)

তিনি অন্যত্র বলেন,

﴿وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً﴾

‘এবং তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহর সন্তুষ্টমনে দিয়ে দাও। সূরা আল-বাক্বারা (৪) : ৪)

আর প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

إِنَّ أَحَقَّ الشَّرْطِ أَنْ يُوفَى بِهِ مَا اسْتَحْلَلْتُمْ بِهِ الْفُرُوجَ.

‘সবচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যা পূরণ করা জরুরী, তা হল সেই বস্ত্ত যার দ্বারা তোমরা (স্ত্রীদের) গুপ্তাঙ্গ হালাল করে থাক। (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ১৫৪৭নং

সুতরাং স্ত্রীকে তার ঐ প্রদেয় মোহর প্রদান করা ফরয। জমি, জায়গা, অর্থ, অলঙ্কার, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি মোহরে দেওয়া চলে। বরং প্রয়োজনে (পাত্রীপক্ষ রাজী হলে) কুরআন শিক্ষাদান, ইসলাম গ্রহণও মোহর হতে পারে।বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২০২-৩২০৯নং

মোহর কম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে সেবচ্ছায় বেশী দেওয়া নিন্দনীয় নয়। মহানবী (সাঃ) তাঁর কোন স্ত্রী ও কন্যার মোহর ৪৮০ দিরহাম (১৪২৮ গ্রাম ওজনের রৌপ্যমুদ্রা) এর অধিক ছিল না। ইরওয়াউল গালীল ১৯২৭নং)

হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর মোহর ছিল একটি লৌহবর্ম। সহীহ আবু দাউদ, আল্লামা আলবানী ১৮৬৫নং, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ১/৮০)

হযরত আয়েশা বলেন, তাঁর মোহর ছিল ৫০০ দিরহাম (১৪৮৭,৫ গ্রাম ওজনের রৌপ্য মুদ্রা)। সহীহ আবু দাউদ ১৮৫১নং)

তবে কেবল উম্মে হাবীবার মোহর ছিল ৪০০০ দিরহাম (১১৯০০ গ্রাম রৌপ্য মুদ্রা)। অবশ্য এই মোহর বাদশাহ নাজাশী মহানবী (সাঃ) এর তরফ থেকে আদায় করেছিলেন।হীহ আবু দাউদ ১৮৫৩)

তাছাড়া তিনি বলেন, ‘‘নারীর বর্কতের মধ্যে; তাকে পয়গাম দেওয়া সহজ হওয়া, তার মোহর সবল্প হওয়া এবং তার গর্ভাশয়ে সহজে সন্তান ধরা অন্যতম।সহীহুল জামে ২২৩৫নং)

হজরত মূসা (আঃ) তাঁর প্রদেয় মোহরের বিনিময়ে শ্বশুরের আট অথবা দশ বছর মজুরী করেছিলেন। রা স-দ (২৮) : ২৭)

মোহর হাল্কা হলে বিবাহ সহজসাধ্য হবে; এবং সেটাই বাঞ্ছিত। পক্ষান্তরে পণপ্রথার মত মোহর অতিরিক্ত বেশী চাওয়ার প্রথাও এক কুপ্রথা।

মোহরের অর্থ কেবলমাত্র স্ত্রীর প্রাপ্য হক; অভিভাবকের নয়। এতে বিবাহের পরে স্বামীরও কোন অধিকার নেই। স্ত্রী বৈধভাবে যেখানে ইচ্ছা সেখানে খরচ করতে পারে। ফাতাওয়াল মারআহ ১০৫-১০৯পৃঃ)

অবশ্য স্ত্রী সন্তুষ্টচিত্তে সেবচ্ছায় স্বামীকে দিলে তা উভয়ের জন্য বৈধ। (সূরা আন-নিসা (৪) : ৪)

স্ত্রীকে মোহর না দিয়ে বিবাহ করলে অনেকের নিকট বিবাহ বাতিল।ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৯

আক্দের সময় মোহর নির্ধারিত না করলেও বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মিলনের পর স্ত্রী সেই মহিলার সমপরিমাণ চলতি মোহরের অধিকারিণী হবে, যে সর্বদিক দিয়ে তারই অনুরূপ। মিলনের পূর্বে স্বামী মারা গেলেও ঐরূপ চলতি মোহর ও মীরাসের হকদার হবে।ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৯-১৫০)

মোহর নির্দিষ্ট না করে বিবাহ হয়ে মিলনের পূর্বেই স্বামী তালাক দিলে স্ত্রী মোহরের হকদার হয় না। তবে তাকে সাধ্যমত অর্থাদি খরচ-পত্র দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৬)

বিবাহের সময় মোহর নির্ধারিত করে সম্পূর্ণ অথবা কিছু মোহর বাকী রাখা চলে। মিলনের পর স্ত্রী সে ঋণ মওকুফ করে দিতে পারে। নচেৎ ঋণ হয়ে তা স্বামীর ঘাড়ে থেকেই যাবে।

মোহর নির্ধারিত করে বা কিছু আদায়ের পর বিবাহ হয়ে মিলনের পূর্বে স্বামী মারা গেলেও স্ত্রী পূর্ণ মোহরের হকদার হবে। স্ত্রী মারা গেলে স্বামী মোহর ফেরৎ পাবে না। ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৮)

মোহর নির্দিষ্ট করে আদায় দিয়ে মিলন করার পর স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে মোহর ফেরৎ পাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَإِنْ أَرَدْتُمُ اسْتِبْدَالَ زَوْجٍ مَكَانَ زَوْجٍ وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنْطَاراً فَلا تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئاً أَتَأْخُذُونَهُ بُهْتَاناً وَإِثْماً مُبِيناً- وَكَيْفَ تَأْخُذُونَهُ وَقَدْ أَفْضَى بَعْضُكُمْ إِلَى بَعْضٍ وَأَخَذْنَ مِنْكُمْ مِيثَاقاً غَلِيظاً﴾

‘‘আর যদি এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করা স্থির কর এবং তাদের একজনকে প্রচুর অর্থও দিয়ে থাক, তবুও তা থেকে কিছুই গ্রহণ করো না। তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ এবং প্রকাশ্য পাপাচারণ দ্বারা তা গ্রহণ করবে? কিভাবে তোমরা তা গ্রহণ করবে, অথচ তোমরা পরস্পর সহবাস করেছ এবং তারা তোমাদের কাছ থেকে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি নিয়েছে?’’ সূরা আন-নিসা (৪) : ২০-২১

মোহর ধার্য হয়ে আদায় না করে মিলনের পূর্বেই তালাক দিলে নির্দিষ্ট মোহরের অর্ধেক আদায় করতে হবে। অবশ্য যদি স্ত্রী অথবা যার হাতে বিবাহবন্ধন সে ( স্বামী) মাফ করে দেয়, তবে সে কথা ভিন্ন। তবে মাফ করে দেওয়াটাই আত্মসংযমের নিকটতর। সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৭)

মিলনের পূর্বে যদি স্ত্রী নিজের দোষে তালাক পায় অথবা খোলা তালাক নেয়, তবে মোহর তো পাবেই না এবং কোন খরচ-পত্রও না। ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৫১-১৫২)

মোহর আদায় দিয়ে থাকলে মিলনের পরেও যদি স্ত্রী খোলা তালাক চায়, তাহলে স্বামীকে তার ঐ প্রদত্ত মোহর ফেরৎ দিতে হবে। বুখারী, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৭৪নং)

কোন অবৈধ বা অগম্যা নারীর সাথে ভুলক্রমে বিবাহ হয়ে মিলনের পর তার অবৈধতা (যেমন গর্ভ আছে বা দুধ বোন হয় ইত্যাদি) জানা গেলে ঐ স্ত্রী পূর্ণ মোহরের হকদার হবে। তবে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ওয়াজেব। ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৪৯)

একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে সকল স্ত্রীর মোহর সমান হওয়া জরুরী নয়।মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৬/২৬২)

স্ত্রীর মোহরের অর্থ খরচ করে ফেলে স্বামী যদি তার বিনিময়ে স্ত্রীকে তার সমপরিমাণ জমি বা জায়গা লিখে দেয় তবে তা বৈধ। মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২৫/৪৭)

পক্ষান্তরে অন্যান্য ওয়ারেসীনরা রাজী না হলে কোন স্ত্রীর নামে (বা কোন ওয়ারেসের নামে) অতিরিক্ত কিছু জমি-জায়গা উইল করা বৈধ নয়। কারণ, কোন ওয়ারেসের জন্য অসিয়ত নেই। মিশকাতুল মাসাবীহ ৩০৪৭নং, ইরঃ ১৬৫৫নং)

পাত্রীর নিকট থেকে ৫০ হাজার (পণ) নিয়ে ১০ বা ২০ হাজার তাকে মোহর দিলে অথবা নামে মাত্র মোহর বাঁধলে এবং আদায়ের নিয়ত না থাকলে অথবা দশ হাজারের দশ টাকা আদায় ও অবশিষ্ট বাকী রেখে আদায়ের নিয়ত না রাখলে; অর্থাৎ স্ত্রীর ঐ প্রাপ্য হক পূর্ণমাত্রায় আদায় দেওয়ার ইচ্ছা না থাকলে এই ধোঁকায় বিবাহ হবে কি না সন্দেহ। অবশ্য একাজ যে আল্লাহর ফরয আইনের বিরুদ্ধাচরণ তাতে কোন সঃন্দেহ নেই।

প্রকাশ যে, মোহর বিজোড় বাঁধা বা এতে কোন শুভলক্ষণ আছে মনে করা বিদআত।

﴿اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلاَ تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلاً مَا تَذَكَّرُونَ﴾

(হে মানুষ!) ‘‘তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাঁকে ছাড়া ভিন্ন অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক। (সূরা আল-আ‘রাফ (৭) : ৩)

৪:৫ وَ لَا تُؤۡتُوا السُّفَهَآءَ اَمۡوَالَکُمُ الَّتِیۡ جَعَلَ اللّٰهُ لَکُمۡ قِیٰمًا وَّ ارۡزُقُوۡهُمۡ فِیۡهَا وَ اکۡسُوۡهُمۡ وَ قُوۡلُوۡا لَهُمۡ قَوۡلًا مَّعۡرُوۡفًا

৫. আর তোমরা অল্প বুদ্ধিমানদেরকে তাদের ধন-সম্পদ অর্পণ করো না, যা দ্বারা আল্লাহ তোমাদের জীবন চালানোর ব্যবস্থা করেছেন এবং তা থেকে তাদের আহার-বিহার ও ভরণপোষনের ব্যবস্থা কর। আর তোমরা তাদের সাথে সদালাপ কর।

এখানে মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি পরিপূর্ণ বিধান উপস্থাপন করা হয়েছে। আর তাহলোঃ

১. অর্থ জীবন যাপনের একটি মাধ্যম, যা অজ্ঞ ও নির্বোধদের হাতে তুলে দেয়া যাবেনা। অর্থের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহার করা যাবেনা-যাতে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

২. ইসলামে ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত, কিন্তু তা সীমাহীন নয়। বিধায়, অর্থ সঠিক ব্যবহার না করে এবং সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয় এমন কাজে ব্যবহার করে তাহলে তার সে অধিকার হরণ করা যাবে।

৩. ইসলাম মানুষের জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু মালিকানার অবাধ ব্যবহারে উপর বিধি নিষেধ আরোপ করে। যাতে নৈতিক, তামাদ্দুনিক ও সামগ্রিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।

৪. সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার যেমন ব্যক্তির দায়িত্ব, একই ভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা ইসলামী রাষ্ট্রেরও দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত।  বিধায় যারা সম্পদ সঠিক ব্যবহারের যোগ্যতা রাখেনা বা অসৎ পথে ব্যবহার করে, তাদের সম্পদ অভিভাবক বা রাষ্ট্র নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে মালিককে তার জীবন নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করবে।

৪:৬ وَ ابۡتَلُوا الۡیَتٰمٰی حَتّٰۤی اِذَا بَلَغُوا النِّکَاحَ ۚ فَاِنۡ اٰنَسۡتُمۡ مِّنۡهُمۡ رُشۡدًا فَادۡفَعُوۡۤا اِلَیۡهِمۡ اَمۡوَالَهُمۡ ۚ وَ لَا تَاۡکُلُوۡهَاۤ اِسۡرَافًا وَّ بِدَارًا اَنۡ یَّکۡبَرُوۡا ؕ وَ مَنۡ کَانَ غَنِیًّا فَلۡیَسۡتَعۡفِفۡ ۚ وَ مَنۡ کَانَ فَقِیۡرًا فَلۡیَاۡکُلۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ؕ فَاِذَا دَفَعۡتُمۡ اِلَیۡهِمۡ اَمۡوَالَهُمۡ فَاَشۡهِدُوۡا عَلَیۡهِمۡ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ حَسِیۡبًا ﴿۶﴾

৬. আর ইয়াতিমদেরকে যাচাই করবে যে পর্যন্ত না তারা বিয়ের যোগ্য হয়; অতঃপর তাদের মধ্যে ভাল–মন্দ বিচারের জ্ঞান দেখতে পেলেতাদের সম্পদ তাদেরকে ফিরিয়ে দাও। তারা বড় হয়ে যাবে বলে অপচয় করে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেল না। যে অভাবমুক্ত সে যেন নিবৃত্ত থাকে এবং যে বিত্তহীন সে যেন সংযত পরিমাণে ভোগ করে অতঃপর তোমরা যখন তাদেরকে সম্পদ ফিরিয়ে দিবে তখন সাক্ষী রেখো। আর হিসেব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট।

এতিমের অভিভাবকত্ব গ্রহণের বিধান ও পদ্ধতি, তাদের সম্পদ ব্যবহারের অনুমতি ও সীমাবদ্ধতা এবং তাদের সম্পদ তাদের কাছে হস্তান্তরে প্রক্রিয়া ও সময়কাল অত্যন্ত সুবিন্যস্তভাবে জানা যায়।

কেউ এতিমের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করলে এতিমের সাথে অশোভনীয় আচরণ বা ন্যূনতম জুলুম-অত্যাচার করা যাবে না। এতিমের ব্যয় নির্বাহ ব্যতিত অযথা-অপাত্রে তার সম্পদ ব্যবহার এবং এক্ষেত্রে কোনপ্রকার অপচয় ভক্ষণ কিংবা কোনভাবে কুক্ষিগত করে রাখা যাবে না। অভিভাবকত্বের সুযোগে এতিমের উত্তম সম্পদের সঙ্গে নিজের অনুত্তম সম্পদ মিশিয়ে নেওয়া যাবে না। কোনভাবে তাকে ধোঁকা দেওয়া, প্রতারিত করা বা তার ক্ষতি হয় এমন কোনও কাজ করা যাবে না। আরও প্রতিভাত হয় যে, এতিম উপযুক্ত বয়সে উপনীত হওয়ার পরও তার কাছে তার সম্পদ হস্তান্তর না করে ব্যবহার বা কোন প্রকার অনধিকার চর্চা, কিংবা তার সাথে কৃত অঙ্গিকার বা প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় ঘটানোরও কোন সুযোগ নেই ; বরং হারাম ও নিষিদ্ধ।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা এতিমের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং অচিরেই তারা জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১০)

আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ পরিহার কর। সাহাবায়ে কিরাম রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেগুলো কি? রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, জাদু, অন্যায়ভাবে কোন প্রাণ সংহার করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ গ্রাস করা, যুদ্ধের মাঠ থেকে পলায়ন করা এবং মুমিনা পবিত্র নারীকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া।’ (বুখারী : ২৭৬৬)

‘এতিম পরিণত বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হয়ো না। তবে সদুপায়ে (সম্পদের উন্নতি করার লক্ষ্যে) তা ব্যবহার করা যাবে। আর প্রতিশ্রুতি পূরণ করো। কেননা (কিয়ামতের দিন) প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৪)

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর তোমার কাছে তারা জিজ্ঞেস করে, এতিম সংক্রান্ত বিধান। বলে দাও, তাদের কাজ-কর্ম সঠিকভাবে গুছিয়ে দেওয়া উত্তম। আর যদি তাদের ব্যয়ভার নিজের সাথে মিশিয়ে নাও, তাহলে মনে করবে তারা তোমাদের ভাই। বস্তুত: অমঙ্গলকামী ও মঙ্গলকামীদেরকে আল্লাহ জানেন। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে তোমাদের ওপর জটিলতা আরোপ করতে পারতেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী, মহাপ্রাজ্ঞ।’’ (সুরা আল-বাকারাহ : ২২০)

তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান ও তাফহীমুল কুর’আন

https://youtu.be/zaSgQugq6M0