১৭তম রুকু(১৫৬-১৭১)
আউযুবিল্লাহি মিনাস শাইতোয়ানির রজীম,
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
৩:১৫৬ یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ قَالُوۡا لِاِخۡوَانِہِمۡ اِذَا ضَرَبُوۡا فِی الۡاَرۡضِ اَوۡ کَانُوۡا غُزًّی لَّوۡ کَانُوۡا عِنۡدَنَا مَا مَاتُوۡا وَ مَا قُتِلُوۡا ۚ لِیَجۡعَلَ اللّٰہُ ذٰلِکَ حَسۡرَۃً فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ ؕ وَ اللّٰہُ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ؕ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ
১৫৬. হে মুমিনগণ! তোমরা তাদের মত হয়ে না যারা কুফরী করে এবং তাদের ভাইয়েরা যখন দেশে দেশে সফর করে বা যুদ্ধে লিপ্ত হয় তখন তাদের সম্পর্কে বলে, তারা যদি আমাদের কাছে থাকত তবে তারা মরতো না এবং নিহত হত না। ফলে আল্লাহ এটাকেই তাদের মনে দুঃখ ও চিন্তা সৃষ্টির কারণে পরিণত করেন; প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান, আর তোমরা যা কর আল্লাহ সেসবের সম্যক দ্রষ্টা।
আল্লাহর ফায়সালাকে কেউ নড়াতে পারে না৷ এটিই সত্য৷ কিন্তু যারা আল্লাহার প্রতি ঈমান রাখে না এবং সবকিছুকে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করে,তাদের জন্য এ ধরনের আন্দাজ অনুমান কেবল তাদের আক্ষেপ ও হতাশাই বাড়িয়ে দেয়৷ তারা কেবল এই বলে আফসোস করতে থাকে, হায়! যদি এমনটি করতাম তাহলে এমনটি হতো৷
সুদ্দী বলেন, এখানে দেশে দেশে সফর করা বলে, ব্যবসা করা উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [ইবন আবী হাতেম] অর্থাৎ মুনাফিকদের যখন কোন লোক মারা যেত, তখন তারা বলত: যদি আমাদের কথা শুনতো এবং যুদ্ধে বের না হতো তবে তারা মারা যেতো না। বস্তুত মুনাফিকরা যুদ্ধের আগেই তাদের ভাইদেরকে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিত। অন্য আয়াতে এসেছে,
“যারা ঘরে বসে রইল এবং তাদের ভাইদেরকে বলল যে, তারা তাদের কথামত চললে নিহত হত না” [সূরা আলে ইমরান: ১৬৮]
আরও এসেছে, “যারা পিছনে রয়ে গেল তারা আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে বসে থাকতেই আনন্দ বোধ করল এবং তাদের ধনসম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপছন্দ করল এবং তারা বলল, গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়ো না [সূরা আত-তাওবাহ ৮১]
আরও এসেছে, “আল্লাহ অবশ্যই জানেন তোমাদের মধ্যে কারা বাধাদানকারী এবং কারা তাদের ভাইদেরকে বলে, আমাদের দিকে চলে এসো। তারা অল্পই যুদ্ধে যোগদান করে।” [সূরা আল-আহযাব: ১৮]
আরও এসেছে, “তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে গড়িমসি করবেই। তোমাদের কোন মুসীবত হলে সে বলবে, তাদের সংগে না থাকায় আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।” [সূরা আন-নিসা: ৭২]
মহান আল্লাহ বলেন, [أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ] ‘‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের ভিতরে অবস্থান কর তবুও।’’ (সূরা নিসা ৭৮ আয়াত) কাজেই এই অনুতাপ থেকে মুসলিমরাই রক্ষা পেতে পারে। কারণ, তাদের আকীদা সঠিক ও শুদ্ধ।
৩:১৫৭ وَ لَئِنۡ قُتِلۡتُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ اَوۡ مُتُّمۡ لَمَغۡفِرَۃٌ مِّنَ اللّٰہِ وَ رَحۡمَۃٌ خَیۡرٌ مِّمَّا یَجۡمَعُوۡنَ
১৫৭. তোমরা আল্লাহর পথে নিহত হলে অথবা তোমাদের মৃত্যু হলে, যা তারা জমা করে, আল্লাহর ক্ষমা এবং দয়া অবশ্যই তার চেয়ে উত্তম।
৩:১৫৮ وَ لَئِنۡ مُّتُّمۡ اَوۡ قُتِلۡتُمۡ لَاِالَی اللّٰہِ تُحۡشَرُوۡنَ
১৫৮. আর তোমাদের মৃত্যু হলে অথবা তোমরা নিহত হলে আল্লাহরই কাছে তোমাদেরকে একত্র করা হবে।
মুমিনদের মনোবল বৃদ্ধির জন্যে এ আয়াতে বলা হয়েছে, মোনাফিকদের অযৌক্তিক কথায় কান দিও না। জেনে রাখ, আল্লাহর পথে শহীদ হলে কোন ক্ষতি তো নেই, বরং মোনাফিক ও কাফেররা সারা জীবনে যা সঞ্চয় করেছে তোমাদের পুরস্কার তার চেয়ে অনেক মূল্যবান ও স্থায়ী। আর এই পুরস্কার হলো আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা যা কিনা চিরস্থায়ী বেহেশতের চাবিকাঠি। তাই, আল্লাহর পথে জীবিত থাকা ও মৃত থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
যে কোনভাবেই হোক না কেন মৃত্যু তো আসবেই, তাই এমন মৃত্যু যদি ভাগ্যে জুটে, যে মৃত্যুর পর মানুষ আল্লাহর ক্ষমা ও তাঁর দয়া লাভের যোগ্য হয়ে যায়, তবে এটা হবে তার জন্য পার্থিব সেই সমূহ ধন-সম্পদ থেকেও উত্তম, যা মানুষ সারা জীবন উপার্জন করে থাকে। কাজেই আল্লাহর পথে জিহাদ করা থেকে পিছপা না হয়ে সেদিকে বড়ই উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে অগ্রসর হতে হবে। আর নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার উৎসাহ থাকলে তাঁর ক্ষমা ও দয়া সুনিশ্চিত হয়ে যাবে।
যেভাবেই মৃত্যু হোক না কেনো মূলত সকলকেই আল্লাহর নিকটই আবার একত্রিত হবে।
৩:১৫৯ فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ ۚ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ۪ فَاعۡفُ عَنۡہُمۡ وَ اسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ وَ شَاوِرۡہُمۡ فِی الۡاَمۡرِ ۚ فَاِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُتَوَکِّلِیۡنَ
১৫৯. আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলেন। যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। কাজেই আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন, তারপর আপনি কোন সংকল্প করলে আল্লাহর উপর নির্ভর করবেন; নিশ্চয় আল্লাহ (তার উপর) নির্ভরকারীদের ভালবাসেন।
মহান নৈতিকতার অধিকারী নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর আল্লাহর কৃত অনুগ্রহসমূহের একটি অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে যে, তোমার মধ্যে যে কোমলতা ও নম্রতা তা আল্লাহর রহমতেরই ফল। আর দ্বীনের প্রচার-প্রসারের জন্য তো এই কোমলতার প্রয়োজন অনেক। তুমি যদি কোমল ও নরম না হয়ে কঠিন হৃদয়ের মালিক হতে, তাহলে মানুষ তোমার কাছে না এসে আরো দূরে সরে যেত। কাজেই তুমি মানুষের সাথে ব্যবহারে ক্ষমা ব্যবহার করতে থাক।
আবু উমামা আল বাহেলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরে বললেনঃ হে আবু উমামা! মুমিনদের মাঝে কারো কারো জন্য আমার অন্তর নরম হয়ে যায়। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/২১৭]
অর্থাৎ ইতোপূর্বে যেমন কাজে-কর্মে এবং কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাদের সাথে পরামর্শ করতেন, তেমনিভাবে এখনও তাদের সাথে পরামর্শ করুন, তাদের মনে প্রশান্তি আসতে পারে। এতে হেদায়াত দেয়া হয়েছে যে, কল্যাণ কামনার যে অনুরাগ তাদের অন্তরে বিদ্যমান, তা তাদেরকে পরামর্শের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে প্রকাশ করবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন, “যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়, সে আমানতদার”। [ইবন মাজাহ ৩৭৪৫] অর্থাৎ সে আমানতের সাথে পরামর্শ দিবে, ভুল পথে চালাবে না এবং আমানত হিসেবেই সেটা তার কাছে রাখবে।
এই আয়াতে সমাজ সংস্কারক ও দ্বীন-প্রচারকদের জন্য কয়েকটি বিষয়কে অপরিহার্য বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
প্রথমতঃ আচার-ব্যবহার ও কথা-বার্তায় রূঢ়তা পরিহার করা।
দ্বিতীয়তঃ সাধারণ লোকদের দ্বারা কোন ভুলভ্রান্তি হয়ে গেলে কিংবা কষ্টদায়ক কোন বিষয় সংঘটিত হলে সে জন্য প্রতিশোধমুলক ব্যবস্থা না নিয়ে বরং ক্ষমা প্রদর্শন করা এবং সদয় ব্যবহার করা।
তৃতীয়তঃ তাদের পদস্খলন ও ভুলভ্রান্তির কারণে তাদের কল্যাণ কামনা থেকে বিরত না থাকা। তাদের জন্য দোআ-প্রার্থনা করতে থাকা এবং বাহ্যিক আচার আচরণে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার পরিহার না করা। উল্লেখিত আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রথমে তো সাহাবীদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারপর আচরণ-পদ্ধতি সম্পর্কে হেদায়াত দেয়া হয়েছে।
পরামর্শ গ্রহণ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা কুরআনের দু’জায়গায় সরাসরি নির্দেশ দান করেছেন।
একটি হলো এই আয়াতে এবং দ্বিতীয়টি হলো সূরা আশ-শূরার সে আয়াতে যাতে সত্যিকার মুসলিমদের গুণবৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে একটি গুণ এই বলা হয়েছে যে, “(যারা সত্যিকার মুসলিম) তাদের প্রতিটি কাজ হবে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে”। এতদুভয় আয়াতে যেভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পরামর্শের অপরিহার্যতা প্রতীয়মান হয়, তেমনিভাবে এতে ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিধান সংক্রান্ত কয়েকটি মূলনীতিও সামনে এসে যায়। তা হলো এই যে, ইসলামী রাষ্ট্র হলো পরামর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র যাতে পরামর্শের ভিত্তিতে নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে থাকে। এমনকি আলোচনা ও পরামর্শ করাকে ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য একটি মৌলিক বিষয় হিসাবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
উল্লেখিত আয়াতে লক্ষণীয় যে, এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পরামর্শ করার নির্দেশ দেয়ার পর বলা হয়েছে “পরামর্শ করার পর আপনি যখন কোন একটি দিক সাব্যস্ত করে নিয়ে সেমতে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন”। এতে নির্দেশ বাস্তবায়নে দৃঢ় সংকল্প হওয়াকে শুধুমাত্র মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিই সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘আযামতুম’ বলা হয়নি, যাতে সংকল্প ও তা বাস্তবায়নে সাহাবায়ে কেরামের সংযুক্ততাও বুঝা যেতে পারত। এই ইঙ্গিতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পরামর্শ করে নেয়ার পর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমীর যা করবেন তাই হবে গ্রহণযোগ্য। কোন কোন সময় উমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে যদি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের অভিমত বেশী শক্তিশালী হত, তখন সেমতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতেন।
অথচ পরামর্শ সভায় অধিকাংশ সময় এমনসব মনীষী উপস্থিত থাকতেন, যারা ইবন আব্বাসের তুলনায় বয়স, জ্ঞান ও সংখ্যার দিক দিয়ে ছিলেন গরিষ্ঠ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামও অনেক সময় শায়খাইন অর্থাৎ আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাহাবীদের মতের উপর প্রধান্য দান করেছেন। এমন কি এমন ধারণাও করা হতে লাগল যে, উল্লেখিত আয়াতটি এতদুভয়ের সাথে পরামর্শ করার জন্যই নাযিল হয়ে থাকবে। মোটকথা: সর্বাবস্থায় সংখ্যাগরিষ্টের মতই গ্রহণ করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই। বরং এখানে ইসলামের মৌলিক নীতিমালার কাছাকাছি যা হবে তা-ই হবে গ্রহণযোগ্য।
মুসলিমদের মনস্তষ্টির জন্য পরামর্শ করে নিবেন। এই আয়াত দ্বারা পরামর্শ করার গুরুত্ব, তার উপকারিতা এবং তার প্রয়োজনীয়তা ও বৈধতা প্রমাণিত হয়। পরামর্শ করার এই নির্দেশ কারো নিকট ওয়াজিব এবং কারো নিকট মুস্তাহাব। (ইবনে কাসীর) ইমাম শওকানী লিখেছেন যে, ‘শাসকদের জন্য অত্যাবশ্যক হল, তাঁরা এমন সব ব্যাপারে উলামাদের সাথে পরামর্শ করবেন, যে সব ব্যাপারে তাঁদের জ্ঞান নেই অথবা যে ব্যাপারে তাঁরা সমস্যায় পড়েন। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সাথে সৈন্য সংক্রান্ত বিষয়ে, জনগণের দায়িত্বে নিয়োজিত নেতাদের সাথে জনসাধারণের কল্যাণ প্রসঙ্গে এবং অন্যান্য বিভিন্ন অঞ্চলে নিযুক্ত সরকারী দায়িত্বশীলদের সাথে সেই অঞ্চলের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পরামর্শ করবেন।’
ইবনে আত্বিয়্যাহ বলেন, ‘এমন শাসকদের বরখাস্ত করার ব্যাপারে কোনই দ্বিমত নেই, যাঁরা আলেম ও দ্বীনদারদের সাথে কোন পরামর্শ করেন না।’ আর এই পরামর্শ সেই সব বিষয়ের মধ্যেই সীমিত থাকবে, যে সব ব্যাপারে শরীয়ত নীরব (যে সম্বন্ধে শরীয়তের সুস্পষ্ট কোন সমাধান নেই) অথবা যার সম্পর্ক হল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সাথে। (ফাতহুল ক্বাদীর)
৩:১৬০ اِنۡ یَّنۡصُرۡکُمُ اللّٰہُ فَلَا غَالِبَ لَکُمۡ ۚ وَ اِنۡ یَّخۡذُلۡکُمۡ فَمَنۡ ذَا الَّذِیۡ یَنۡصُرُکُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِہٖ ؕ وَ عَلَی اللّٰہِ فَلۡیَتَوَکَّلِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ
১৬০. আল্লাহ্ তোমাদেরকে সাহায্য করলে তোমাদের উপর জয়ী হবার কেউ থাকবে না। আর তিনি তোমাদেরকে সাহায্য না করলে, তিনি ছাড়া কে এমন আছে, যে তোমাদেরকে সাহায্য করবে? সুতরাং মুমিনগণ আল্লাহর উপরই নির্ভর করুক।
এই আয়াতে মহান রবের উপর ভরসা করার কথা এসেছে। এখন জানা প্রয়োজন এই ভরসা বা তাওয়াক্কুল কাকে বলে।
তাওয়াক্কুল কী?
তাওয়াক্কুল আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো, ভরসা করা, নির্ভর করা। তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ অর্থ হলো: আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করা। ইসলামে আল্লাহ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি একটি ইবাদত। তাই আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো ওপর তাওয়াক্কুল করা যায় না। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য তাওয়াক্কুল নিবেদন করা যাবে না। মৃত বা জীবিত কোনো ওলী, নবী-রাসূল, পীর-বুযুর্গের ওপর ভরসা করা বা তাওয়াক্কুল রাখা শির্ক।
একজন ঈমানদার মানুষ ভালো ও কল্যাণকর বিষয় অর্জনের জন্য সকল ব্যাপারে নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করবে, সার্বিক প্রচেষ্টা চালাবে আর ফলাফলের জন্য আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করবে, তাঁর প্রতি আস্থা ও দৃঢ় ইয়াকীন রাখবে। বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন ফলাফল তা-ই হবে। আর তাতেই রয়েছে কল্যাণ চূড়ান্ত বিচার ও শেষ পরিণামে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদি আমরা তা অনুধাবন না-ও করতে পারি। এটাই তাওয়াক্কুলের মূলকথা।
তাওয়াক্কুলের নীতি অবলম্বনকারী ব্যক্তি কখনো হতাশ হয় না। আশা ভঙ্গ হলে মুষড়ে পড়ে না। বিপদ-মুসীবত, যুদ্ধ-সংকটে ঘাবড়ে যায় না। যে কোনো দুর্বিপাক, দুর্যোগ, সঙ্কট, বিপদ-মুসীবতে আল্লাহ তা‘আলার ওপর দৃঢ় আস্থা রাখে। ঘোর অন্ধকারে আশা করে উজ্জ্বল সুবহে সাদিকের। যত যুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়নের ঝড়-তুফান আসুক, কোনো অবস্থাতেই সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করে না।
তাই আল্লাহ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল হলো তাওহীদের একটি গুরত্বপূর্ণ অংশ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَلَمَّا رَءَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلۡأَحۡزَابَ قَالُواْ هَٰذَا مَا وَعَدَنَا ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَصَدَقَ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥۚ وَمَا زَادَهُمۡ إِلَّآ إِيمَٰنٗا وَتَسۡلِيمٗا ٢٢﴾ [الاحزاب: ٢٢]
‘‘আর মুমিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল তখন তারা বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের যে ওয়াদা দিয়েছেন এটি তো তাই। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন’। এতে তাদের ঈমান ও ইসলামই বৃদ্ধি পেল।’’ [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২২]
﴿ٱلَّذِينَ قَالَ لَهُمُ ٱلنَّاسُ إِنَّ ٱلنَّاسَ قَدۡ جَمَعُواْ لَكُمۡ فَٱخۡشَوۡهُمۡ فَزَادَهُمۡ إِيمَٰنٗا وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ وَنِعۡمَ ٱلۡوَكِيلُ ١٧٣ فَٱنقَلَبُواْ بِنِعۡمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَفَضۡلٖ لَّمۡ يَمۡسَسۡهُمۡ سُوٓءٞ وَٱتَّبَعُواْ رِضۡوَٰنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ ذُو فَضۡلٍ عَظِيمٍ ١٧٤﴾ [ال عمران: ١٧٣، ١٧٤]
‘‘যাদেরকে মানুষেরা বলেছিল যে, ‘নিশ্চয় লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে একত্র হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর’। কিন্তু তা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’! অতঃপর তারা ফিরে এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিআমত ও অনুগ্রহসহ। কোনো মন্দ তাদেরকে স্পর্শ করে নি এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।’’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৭৩-১৭৪]
﴿وَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱلۡحَيِّ ٱلَّذِي لَا يَمُوتُ﴾ [الفرقان: ٥٧]
‘‘আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার ওপর যিনি মরবেন না।’’ [সূরা আল ফুরকান, আয়াত: ৫৮]
﴿وَعَلَى ٱللَّهِ فَلۡيَتَوَكَّلِ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ﴾ [ابراهيم: ١١]
‘‘আর আল্লাহর ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।’’ [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১১]
﴿فَإِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَوَكِّلِينَ﴾ [ال عمران: ١٥٩]
‘‘অতঃপর তুমি যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা কর।’’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯]
﴿وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُ﴾ [الطلاق: ٣]
‘‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্যে যথেষ্ট।’’ [সূরা আত-তালাক, আয়াত: ৩]
﴿إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتۡ قُلُوبُهُمۡ وَإِذَا تُلِيَتۡ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتُهُۥ زَادَتۡهُمۡ إِيمَٰنٗا وَعَلَىٰ رَبِّهِمۡ يَتَوَكَّلُونَ ٢﴾ [الانفال: ٢]
‘‘মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের ওপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে।’’ [সূরা আল আনফাল, আয়াত: ২]
এ আয়াতসমূহ থেকে আমরা নিম্নোক্ত শিক্ষাগুলো গ্রহণ করতে পারি:
- কেউ যদি এ অবস্থায় আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুল করতে পারে, তাহলে তাদের জন্য রয়েছে নি‘আমত, প্রতিদান ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। যেমন লাভ করেছিলেন হামরাউল আসাদ অভিযানে অংশগ্রহণকারী সাহাবীবৃন্দ। এ ধরনের আগ্রাসন, সংকট ও বিপদে যাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আস্থা ও তাওয়াক্কুল বেড়ে যায়, তাদের প্রশংসা করেছেন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে।
- তাওয়াক্কুল তো এমন সত্তার ওপর করা উচিত, যিনি চিরঞ্জীব। তিনি হলেন আল্লাহ। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ওপর তাওয়াক্কুল করা জায়েয নয়। তাওয়াক্কুল একটি ইবাদত। যেমন, আল্লাহ এ আয়াতে তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করতে আদেশ করেছেন। এটা শুধু আল্লাহর জন্যই নিবেদন করতে হয়।
- আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল রাখা মুমিনদের একটি বৈশিষ্ট্য।আল্লাহ তাঁর রাসূল-কেও তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
- আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন। সুতরাং আল্লাহর ভালোবাসা লাভের একটি কার্যকর উপায় হলো তাওয়াক্কুল।
- আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলকারীর সাহায্যের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
সূরা আনফালের উল্লিখিত আয়াতে ঈমানদারদের তিনটি গুণাগুণ আলোচিত হয়েছে।
(১) যদি আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।
(২) যখন তাঁর আয়াত বা বাণী তিলাওয়াত করে অথবা শুনে তখন এতে তার ঈমান বৃদ্ধি পায়। ঈমান আরো দৃঢ় হয়।
(৩) তারা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে।
পরবর্তী আয়াতে আরো দু’টি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। তাহল, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে- আল্লাহর পথে দান-সদকা করে। সূরা আনফালের দুই ও তিন নম্বর আয়াতে ঈমানদারদের গুরুত্বপূর্ণ এ পাঁচটি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে।
চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যাদের এ গুণগুলো আছে তারাই সত্যিকার মুমিন। তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের কাছে মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা। আল্লাহ আমাদের সকলকে এ গুণগুলো অর্জন করার তাওফীক দান করুন।
ওহে যারা ঈমান এনেছো, যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ রাখবেন”। [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত ৭]
তিনি আরো বলেনঃ (বাংলা অনুবাদ) “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন যারা আল্লাহ তা’আলার সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, শক্তিধর”। [সূরা হাজ্জ, আয়াত ৪০]
৩:১৬১ وَ مَا کَانَ لِنَبِیٍّ اَنۡ یَّغُلَّ ؕ وَ مَنۡ یَّغۡلُلۡ یَاۡتِ بِمَا غَلَّ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ۚ ثُمَّ تُوَفّٰی کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَ ہُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ
১৬১. আর কোন নবী ‘গলুল (অন্যায়ভাবে কোন বস্তু গোপন) করবে, এটা অসম্ভব। এবং কেউ অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করলে, যা সে অন্যায়ভাবে গোপন করবে কেয়ামতের দিন সে তা সাথে নিয়ে আসবে। তারপর প্রত্যেককে, যা সে অর্জন করেছে তা পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হবে। তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না।
গলুলের এক অর্থ হয় খেয়ানত করা, জোর করে দখল করে নেয়া। সে হিসেবেই এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর নিকট বড় গলুল তথা খেয়ানত হল এক বিঘত যমীন নেয়া। তোমরা দু’জন লোককে কোন যমীনের বা ঘরের প্রতিবেশী দেখতে পাবে। তারপর তাদের একজন তার সাথীর অংশের এক বিঘত যমীন কেটে নেয়। যদি কেউ এভাবে যমীন কেটে নেয় সে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত সাত যমীন গলায় পেচিয়ে থাকবে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৪১]
পেছনের অংশের প্রতিক্ষার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে তীরন্দাজ বাহিনী মোতায়েন করেছিলেন তারা যখন দেখলো শত্রুসৈন্যদের মালমাত্তা লুটে নেয়া হচ্ছে তখন তারা আশংকা করলো, হয়তো সমগ্র ধন-সম্পদ তারাই পাবে যারা সেগুলো হস্তগত করছে এবং গনীমাত বন্টনের সময় আমরা বঞ্চিত হবো৷ তাই তারা নিজেদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে শত্রু সেনাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেবার কাজে লেগে গিয়েছিল৷ যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ তীরন্দাজ বাহিনীর লোকেদের ডেকে তাদের এ নাফরমানীর কারণ জিজ্ঞেস করলেন৷ জবাবে তারা এমন কিছু ওজর পেশ করলো যা ছিল আসলে অত্যন্ত দুর্বল৷ তাদের জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “আসল কথা হচ্ছে, আমাদের ওপর তোমাদের আস্তা ছিল না৷ তোমরা মনে করছিলে আমরা তোমাদের সাথে খেয়ানত করবো এবং তোমাদের অংশ দেবো না”৷ এ আয়াতটিতে আসলে এ বিষয়টির প্রতি ইংগিত করা হয়েছে৷ আল্লাহর বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর নবী নিজেই যখন ছিলেন তোমাদের সেনাপতি এবং সমস্ত বিষয়ই ছিল তাঁর হাতে তখন তোমাদের মনে এ আশংকা কেমন করে দেখা দিল যে, নবীর হাতে তোমাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে না? আল্লাহর নবীর ব্যাপারে তোমরা কি এ আশংকা করতে পারো যে, তাঁর তত্বাবধানের যে সম্পদ থাকবে তা বিশ্বাস্ততা, আমানতদারী ও ইনসাফের সাথে বন্টন না করে অন্য কোনভাবে বন্টন করা হবে?
غلول ‘গলুল’ এর অন্য অর্থ সরকারী সম্পত্তি থেকে কোন কিছু গোপন করা। গনীমতের মালও সরকারী সম্পদ। সুতরাং তা থেকে চুরি করা মহাপাপ। কোন নবীর পক্ষে এমন পাপের সম্ভাব্যতা নেই। আয়াতটি একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গনীমতের মাল চুরি করার বিষয়টিও এসে গেছে। ঘটনাটি ছিল এই যে, বদরের যুদ্ধের পর যুদ্ধলব্ধ গনীমতের মালের মধ্যে থেকে একটি চাদর খোয়া যায়। কোন কোন লোক বলল, হয়ত সেটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে থাকবেন। [তিরমিযীঃ ৩০০৯, আবু দাউদঃ ৩৯৭১] এসব কথা যারা বলত তারা যদি মুনাফেক হয়ে থাকে, তবে তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। আর তা কোন অবুঝ মুসলমানের পক্ষে বলাও অসম্ভব নয়।
তবে সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে, সে হয়ত মনে করে থাকবে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তা করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়, যাতে غلول বা গনীমতের মালের ব্যাপারে অনধিকার চর্চার ভয়াবহতা এবং কেয়ামতের দিন সে জন্য কঠিন শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে, কোন নবী সম্পর্কে এমন ধারণা করা যে, তিনিই এহেন পাপ কাজ করে থাকবেন, একান্তই অনর্থক ধৃষ্টতা। কারণ, নবীগণ যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত।
এখানে একটা বিষয় জানা আবশ্যক যে, গনীমতের মাল চুরি করা কিংবা তাতে খেয়ানত করা বা সরকারী সম্পদ থেকে কোন কিছু আত্মসাৎ করা, সাধারণ চুরি অথবা খেয়ানত অপেক্ষা বেশী পাপের কাজ। কারণ, এ সম্পদের সাথে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সংযুক্ত থাকে। কাজেই যে লোক এতে চুরি করবে, সে চুরি করবে শত-সহস্ৰ লোকের সম্পদ। যদি কখনো কোন সময় তার মনে তা সংশোধন করার খেয়াল হয়, তখন সবাইকে তাদের অধিকার প্রত্যাপন করা কিংবা সবার কাছ থেকে ক্ষমা করিয়ে নেয়া একান্তই দুরূহ ব্যাপার।
পক্ষান্তরে অন্যান্য চুরি মালের মালিক সাধারণতঃ পরিচিত ও নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। কখনও কোন সময় আল্লাহ যদি তওবাহ করার তাওফীক দান করেন, তবে তার হক আদায় করে কিংবা তার কাছ থেকে ক্ষমা করিয়ে নিয়ে মুক্ত হতে পারে। সে কারণেই কোন এক যুদ্ধে এক লোক যখন কিছু পশম নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছিল, গনীমতের মাল বন্টন করার কাজ শেষ হয়ে গেলে যখন তার মনে হল, তখন সেগুলো নিয়ে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমীপে উপস্থিত হল। তিনি রহমাতুললিল আলামীন এবং উম্মতের জন্য পিতা-মাতা অপেক্ষা সদয় হওয়া সত্বেও তাকে এই বলে ফিরিয়ে দিলেন যে, এখন এগুলো কেমন করে আমি সমস্ত সেনাবাহিনীর মাঝে বন্টন করব? কাজেই কেয়ামতের দিনই তুমি এগুলো নিয়ে উপস্থিত হয়ো। [সহীহ্ ইবনে হিব্বানঃ ৪৮৫৮, মুসনাদে আহমাদঃ ২/২১৩, ৬/৪২৮]
তাছাড়া গনীমতের মাল বা সরকারী সম্পদ আত্মসাৎ করার ব্যাপারটি অন্যান্য চুরি অপেক্ষা কঠিন পাপ হওয়ার আরও একটি কারণ এই যে, হাশরের ময়দানে যেখানে সমগ্র সৃষ্টি সমবেত হবে, সবার সামনে তাকে সেখানে এমনভাবে লাঞ্ছিত করা হবে যে, চুরি করা বস্তু-সামগ্রী তার কাঁধে চাপানো থাকবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ “দেখ, কেয়ামতের দিন কারো কাঁধে একটি উট চাপানো অবস্থায় থাকবে এবং ঘোষণা করা হবে যে, এ লোক গনীমতের মালের উট চুরি করেছিল, এমন যেন না হয়। যদি সে লোক আমার শাফা’আত কামনা করে, তবে আমি তাকে পরিস্কার ভাষায় জবাব দিয়ে দেব যে, আমি আল্লাহর যা কিছু নির্দেশ পেয়েছিলাম, তা সবই পৌছে দিয়েছিলাম, এখন আমি কিছুই করতে পারব না” [বুখারীঃ ৩০৭৩]
মনে রাখা আবশ্যক যে, মসজিদ, মাদ্রাসা এবং ওয়াকফের মালের অবস্থাও একই রকম, যাতে হাজার-হাজার মুসলিমের চাঁদা বা দান অন্তর্ভুক্ত ক্ষমাও যদি করাতে হয়, তবে কার কাছ থেকে ক্ষমা করাবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সরকারী কর্মচারীদের প্রাপ্ত হাদীয়া বা উপটৌকণ গলুলের শামিল। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৪২৪]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার ইবনুল্লতুবিয়্যাহ নামক এক ব্যক্তিকে যাকাত আদায়ের জন্য নিয়োগ দেন। সে ফিরে এসে বললঃ এগুলো তোমাদের আর এগুলো আমাকে হাদীয়া দেয়া হয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়ালেন এবং বললেনঃ কি হলো কর্মচারীর তাকে আমরা কোন কাজে পাঠাই পরে সে এসে বলে, এগুলো তোমাদের আর ওগুলো আমাকে হাদীয়া দেয়া হয়েছে। সে কেন তার পিতা-মাতার ঘরে বসে দেখে না তার জন্য হাদীয়া আসে কি না? যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তার শপথ করে বলছি, যে কেউ এর থেকে কিছু নিবে কিয়ামতের দিন সেটাই সে তার কাঁধে নিয়ে আসবে। [বুখারীঃ ৬৯৭৯, মুসলিমঃ ১৮৩২]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেনঃ “হে মানুষ সকল! তোমাদের কাউকে কোন কাজে লাগালে যদি সে আমাদের থেকে কিছু লুকায় তবে সে তা কেয়ামতের দিন সাথে নিয়ে আসবে [মুসলিমঃ ১৮৩৩] আবদুল্লাহ ইবন আমর বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিনিসপত্রের দায়িত্বে এক লোক ছিল, তাকে কারকারাহ বলা হতো, হঠাৎ করে সে মারা গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে তো জাহান্নামে গেছে। লোকেরা তার জিনিসপত্র তল্লাশী করে দেখতে পেল যে, সে একটি জামা চুরি করেছে”। [বুখারী: ৩০৭৪]
৩:১৬২ اَفَمَنِ اتَّبَعَ رِضۡوَانَ اللّٰہِ کَمَنۡۢ بَآءَ بِسَخَطٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ مَاۡوٰىہُ جَہَنَّمُ ؕ وَ بِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ
১৬২. আল্লাহ্ যেটাতে সন্তুষ্ট, যে তারই অনুসরণ করে, সে কি ওর মত যে আল্লাহর ক্রোধের পাত্র হয়েছে এবং জাহান্নামই যার আবাস? আর সেটা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল!
৩:১৬৩ ہُمۡ دَرَجٰتٌ عِنۡدَ اللّٰہِ ؕ وَ اللّٰہُ بَصِیۡرٌۢ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ
১৬৩. আল্লাহর কাছে তারা বিভিন্ন স্তরের; তারা যা করে আল্লাহ সেসব ভালভাবে দেখেন।
এই দুই আয়াতে মুমিন ও মুনাফিকদের পরিণতির তুলনা করে আল্লাহ বলছেন যাদের কাজ কর্মের লক্ষ্য খোদাবিমুখ বা খোদাবিরোধী শক্তিকে সন্তুষ্ট করা নয়, অর্থাৎ যাদের কাজ কর্মের লক্ষ্য আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা তারা তাদের সৎ কাজের পরিমাণ অনুযায়ী মর্যাদা বা প্রতিফল পাবে। অন্যদিকে যারা নিজেদের কামনা বাসনার স্বার্থে আল্লাহকে পেতে চায় তারা আসলে ধর্মকে মাধ্যম বানিয়ে দুনিয়ার স্বার্থই হাসিল করতে চায়। এ ধরনের লোকদের ওপর আল্লাহর ক্রোধ নেমে আসে। ফলে ইহকাল ও পরকালে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।
বিভিন্ন বর্ণনায় বলা হয়েছে, রাসূলে খোদা (সা.) যখন ওহুদ প্রান্তরের দিকে রওনা হবার জন্য মুজাহিদদের নির্দেশ দিলেন তখন একদল মোনাফিক বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মদীনায় থেকে যায়। একদল দুর্বলমনা মুসলমানও তাদের অনুসরণ করে। এই আয়াতে এইসব লোকের পরিণতির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। কিন্তু যারা যুদ্ধে অংশ নিয়ে হতাশ বা নিষ্ক্রিয় হয়েছিল তারা অনুতপ্ত হওয়ায় ক্ষমা লাভ করবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-
প্রথমত : সবচেয়ে পবিত্রতম লক্ষ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এই লক্ষ্য অন্য যে কোন লক্ষ্যের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে।
দ্বিতীয়ত : ইসলামী সমাজের যেসব মানুষ জিহাদে অংশ নেয় এবং যারা জিহাদে অংশ নেয় না, তারা সমান মর্যাদা সম্পন্ন নয়। কারণ, যারা জিহাদ থেকে দূরে থাকে, আল্লাহ তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হন।
জাহান্নামের স্তর
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের পাপ অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করার জন্য জাহান্নামের বিভিন্ন স্তর এবং স্তরভেদে তাপের তারতম্য সৃষ্টি করেছেন। যেমন- তিনি মুনাফিকদের স্তর উল্লেখ করে বলেছেন, ‘মুনাফিকগণ জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে’ {সূরা নিসা: ১৪৫}।
তিনি অন্যত্র বলেন, ‘প্রত্যেকে যা করে তদনুসারে তার স্থান রয়েছে।’ {সূরা আনআম: ১৩২}
জাহান্নামের স্তরসমূহ
অবাধ্য মানুষের অবাধ্যতা ও অপরাধ যেমন বিভিন্ন প্রকার, তেমনি জাহান্নামের স্তরও আছে ভিন্ন ভিন্ন। আযাবের কঠিনতাও ভিন্ন ভিন্ন হবে। যত নিম্নস্তরের আগুন হবে, তার উত্তাপ তত বেশি হবে।
মুনাফিকরা যেহেতু ঘর শত্রু, তাদের দ্বারা ইসলামের ক্ষতি বেশি, তাই তাদের ঠাই হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا
অর্থাৎ, মুনাফিক (কপট) ব্যক্তিরা অবশ্যই দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনও কোন সাহায্যকারী পাবে না। (নিসঃ ১৪৫)
জান্নাতের স্তরসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চই হল সর্বশ্রেষ্ঠ। আর জাহান্নামের স্তরসমূহের মধ্যে সর্বনিম্নই হল সর্বনিকৃষ্ট।
অনেকে বলেছেন, জাহান্নামের স্তর হল সাতটি। এর প্রথম স্তরে থাকবে গোনাহগার মুসলিমরা, দ্বিতীয় স্তরে ইয়াহুদীরা, তৃতীয় স্তরে খ্রিষ্টানরা, চতুর্থ স্তরে সাবায়ীরা, পঞ্চম স্তরে মজুসী (অগ্নিপূজক)রা, ষষ্ঠ স্তরে পৌত্তলিকরা এবং সর্বনিম্ন সপ্তম স্তরে থাকবে মুনাফিকরা।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “জাহান্নামবাসী পাঁচ ব্যক্তি; (১) সেই দুর্বল শ্রেণীর ব্যক্তি, যার (পাপ ও অন্যায় থেকে দুরে থাকার মত) জ্ঞান নেই। যারা তোমাদের অনুগত, যারা পরিবার চায় না, ধন-সম্পদও চায় না। (২) খিয়ানতকারী ব্যক্তি, যে তুচ্ছ কোন জিনিসের লোভে পড়লেই তাতে খিয়ানত করে। (৩) এমন ব্যক্তি, যে সকাল-সন্ধ্যায় তোমার পরিবার ও সম্পদের ব্যাপারে ধোকা দেয়। (৪) কৃপণ ব্যক্তি এবং (৫) দুশ্চরিত্র চোয়াড়।” (মুসলিম ৭৩৮৬নং)
অনেকে উক্ত সাতটি স্তরের নির্দিষ্ট নামও উল্লেখ করেছেন; জাহান্নাম, লাযা, হুত্বামাহ, সাঈর, সাক্বার, জাহীম ও হাবিয়াহ। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোন স্তরের নাম কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়নি। সুতরাং সঠিক কথা এই যে, উক্ত নামগুলি আমভাবে জাহান্নামেরই নাম। যেমনঃ
জাহান্নামঃ
এ শব্দটি আল-কুরআনের ৭৭ জায়গায় এসেছে। এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেছেন,
فَادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا ۖ فَلَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ
অর্থাৎ, সুতরাং তোমরা জাহান্নামের দরজাগুলিতে প্রবেশ কর সেথায় চিরস্থায়ী থাকার জন্য। দেখ অহংকারীদের আবাসস্থল কত নিকৃষ্ট। (নাহলঃ ২৯)।
লাযাঃ
‘লাযা’ মানে লেলিহান আগুন। মহান আল্লাহ বলেন,
كَلَّا ۖ إِنَّهَا لَظَىٰ (15) نَزَّاعَةً لِّلشَّوَىٰ (16) تَدْعُو مَنْ أَدْبَرَ وَتَوَلَّىٰ (17) وَجَمَعَ فَأَوْعَىٰ (18)
অর্থাৎ, না, কখনই নয়! এটা তো লেলিহান অগ্নি। যা দেহ হতে চামড়া খসিয়ে দেবে। জাহান্নাম ঐ ব্যক্তিকে ডাকবে, যে পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করেছিল ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সে সম্পদ পুঞ্জীভূত এবং সংরক্ষিত করে রেখেছিল। (মাআরিজঃ ১৫-১৮)
হুত্বামাহঃ
‘হুত্বামাহ’ মানে প্রজ্বলিত আগুন। মহান আল্লাহ বলেন,
كَلَّا ۖ لَيُنبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ (4) وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ (5) نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ (6) الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ (7) إِنَّهَا عَلَيْهِم مُّؤْصَدَةٌ (8) فِي عَمَدٍ مُّمَدَّدَةٍ (9)
অর্থাৎ, কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুত্বামায়। কিসে তোমাকে জানাল, হুত্বামা কি? তা হল আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি। যা হৃদয়কে গ্রাস। করবে। নিশ্চয়ই তা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখবে। দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে। (হুমাযাহঃ ৪-৯)
সাঈরঃ
‘সাঈর’ মানেও প্রজ্বলিত আগুন। এ নামটিও বহু জায়গায় এসেছে। তার মধ্যে এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেছেন,
إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا ۚ إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ
অর্থাৎ, শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তাকে শত্রু হিসাবেই গ্রহণ কর। সে তো তার দলবলকে এ জন্য আহবান করে যে, ওরা যেন (সাঈর) জাহান্নামবাসী হয়। (ফাত্বিরঃ ৬)
সাক্কারঃ
‘সাক্বার’ মানে ঝলসিয়ে দেওয়া, গলিয়ে দেওয়া। মহান আল্লাহ বলেছেন,
يَوْمَ يُسْحَبُونَ فِي النَّارِ عَلَىٰ وُجُوهِهِمْ ذُوقُوا مَسَّ سَقَرَ
অর্থাৎ, যেদিন তাদেরকে উপুড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে; (সেদিন বলা হবে) সাক্কার (জাহান্নামের) যন্ত্রণা আস্বাদন কর। (কামারঃ ৪৮)।
سَأُصْلِيهِ سَقَرَ (26) وَمَا أَدْرَاكَ مَا سَقَرُ (27) لَا تُبْقِي وَلَا تَذَرُ (28) لَوَّاحَةٌ لِّلْبَشَرِ (29) عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ (30)
অর্থাৎ, আমি তাকে নিক্ষেপ করব সাক্কার (জাহান্নামে)। কিসে তোমাকে জানাল, সাক্বার কী? ওটা তাদেরকে (জীবিত অবস্থায় রাখবে না, আর (মৃত অবস্থায়ও) ছেড়ে দেবে না। ওটা দেহের চামড়া দগ্ধ করে দেবে। ওর তত্ত্বাবধানে রয়েছে উনিশ জন প্রহরী। (মুদ্দাসসিরঃ ২৬-৩০)।
فِي جَنَّاتٍ يَتَسَاءَلُونَ (40) عَنِ الْمُجْرِمِينَ (41) مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ (42) قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ (43) وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ (44) وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ (45) وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّينِ (46) حَتَّىٰ أَتَانَا الْيَقِينُ (47) فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ (48)
অর্থাৎ, তারা থাকবে জান্নাতে এবং তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে— অপরাধীদের সম্পর্কে, তোমাদেরকে কিসে সাক্কার (জাহান্নাম)এ নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আমরা অভাবগ্রস্তদেরকে অন্নদান করতাম না এবং আমরা সমালোচনাকারীদের সাথে সমালোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। আমরা কর্মফল দিবসকে মিথ্যা মনে করতাম। পরিশেষে আমাদের নিকট মৃত্যু আগমন করল। ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না। (ঐঃ ৪০-৪৮)
জাহীমঃ
‘জাহীম’ মানে কঠিন অগ্নিদাহ। এ নামটিও বহু জায়গায় এসেছে। তার মধ্যে দুই জায়গায় মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ
অর্থাৎ, আর যারা অবিশ্বাস করে এবং আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা মনে করে, তারাই (জাহীম) জাহান্নামের অধিবাসী। (মাইদাহঃ ১০, ৮৬)
হাবিয়াহঃ ‘হাবিয়াহ’ মানে গভীর গর্ত, পাতাল। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ (8) فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ (9) وَمَا أَدْرَاكَ مَا هِيَهْ (10) نَارٌ حَامِيَةٌ (11)
অর্থাৎ, কিন্তু যার পাল্লা হাল্কা হবে, তার স্থান হবে হাবিয়াহ। কিসে তোমাকে জানাল, তা কি? তা অতি উত্তপ্ত অগ্নি। (কারিআহঃ ৮-১১)
অনেকে ‘অইল’ বা ‘ওয়াইল’কেও জাহান্নামের একটি উপত্যকার নাম গণ্য করেছেন। মহান আল্লাহ বলেছেন,
فَوَيْلٌ يَوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِينَ
অর্থাৎ, (অইল) দুর্ভোগ সেদিন মিথ্যাশ্রয়ীদের। (তুরঃ ১১)
وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِينَ
অর্থাৎ, (অইল) ধংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। (মুত্বাফফিফীনঃ ১)
যেমন ‘গাই’ জাহান্নামের একটি উপত্যকার নাম। মহান আল্লাহ বলেছেন,
فَخَلَفَ مِن بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ ۖ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا
অর্থাৎ, তাদের পর এল অপদার্থ পরবর্তিগণ, তারা নামায নষ্ট করল ও প্রবৃত্তিপরায়ণ হল; সুতরাং তারা অচিরেই অমঙ্গল প্রত্যক্ষ করবে। (মারয়ামঃ ৫৯)
প্রকাশ থাকে যে, গাই’ অর্থ ধ্বংস, অমঙ্গল, অশুভ পরিণামও করা হয়েছে। যেমন অইল’-এর অর্থ দুর্ভোগ বা ধ্বংস করা হয়ে থাকে।
৩:১৬৪ لَقَدۡ مَنَّ اللّٰہُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡہِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِہِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ۚ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
১৬৪. আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তেলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল।
নবীর মানুষ হওয়া এবং মানব-জাতিভুক্ত হওয়াকে মহান আল্লাহ একটি অনুগ্রহ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আর বাস্তবিকই এটা একটি মহা অনুগ্রহ। কারণ,
প্রথমতঃ তিনি তাঁর জাতির স্থানীয় ভাষায় আল্লাহর পায়গাম পৌঁছাতে পারবেন যা বুঝা প্রত্যেক মানুষের জন্য সহজ হবে।
দ্বিতীয়তঃ একই জাতিভুক্ত হওয়ার কারণে মানুষ তাঁর ঘনিষ্ঠ হবে এবং তাঁর কাছ ঘেঁসবে।
তৃতীয়তঃ মানুষের জন্য মানুষ হওয়াটাই সব দিক দিয়ে সমীচীন।
কেননা, মানুষের পক্ষে মানুষের অনুসরণ করা সম্ভব, কিন্তু তাদের পক্ষে ফিরিশতাদের অনুসরণ করা সম্ভব নয়। অনুরূপ ফিরিশতাকুল মানুষের আবেগ ও অনুভূতির গভীরতা ও সূক্ষ্ণতা অনুধাবন করতে সক্ষম নন। কাজেই পয়গম্বর যদি ফিরিশতাদের মধ্য থেকে হতেন, তাহলে তিনি সেই সমূহ গুণাবলী থেকে বঞ্চিত হতেন, যা দ্বীনের দাওয়াতের জন্য অতি প্রয়োজন। আর এই জন্যই দুনিয়াতে যত নবী এসেছেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন মানুষ।
কুরআন তাঁদের মানুষ হওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
[وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي]
‘‘তোমার পূর্বে আমি যতজনকে রসূল করে পাঠিয়েছি, তারা সবাই পুরুষ ছিল, তাদের প্রতি আমি অহী করেছি।’’ (সূরা ইউসুফ ১০৯ আয়াত)
তিনি আরো বলেন,[وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنَ الْمُرْسَلِينَ إِلَّا إِنَّهُمْ لَيَأْكُلُونَ الطَّعَامَ وَيَمْشُونَ فِي الْأَسْوَاقِ]
‘‘তোমার পূর্বে যত রসূল প্রেরণ করেছি, তারা সবাই খাদ্য গ্রহণ করত এবং হাটে-বাজারে চলাফেরা করত।’’ (সূরা ফুরকান ২০ আয়াত)
অনুরূপ তিনি নবী করীম (সাঃ)-এর পবিত্র জবান দ্বারা ঘোষণা করলেন যে,
[قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ] ‘‘বল, আমিও তোমাদের মত একজন মানুষ আমার প্রতি অহী আসে। (সূরা হা-মীম সাজদাহ ৬ আয়াত)
বর্তমানে বহু মানুষ এই (রসূলের মানুষ হওয়া) বিষয়টিকে মানতে না পেরে বিপথগামী হয়েছে।
উক্ত আয়াতে নবী প্রেরণের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য তুলে ধরা হয়েছে। যথা,
(ক) আয়াতের তেলাওয়াত ও আবৃত্তি,
(খ) পবিত্র ও পরিশুদ্ধকরণ,
(গ) এবং কিতাব ও হিকমতের কথা শিক্ষা দেওয়া।
কিতাবের শিক্ষায় তেলাওয়াত আপনা আপনিই এসে যায়। তেলাঅতের সাথেই শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। তেলাঅত ব্যতীত শিক্ষার কথা ভাবাই যায় না। তা সত্ত্বেও তেলাঅতকে পৃথকভাবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল এ কথা পরিষ্কার করে দেওয়া যে, তেলাঅত করাও একটি পবিত্র ও সৎ কাজ, তাতে তেলাঅতকারী তার অর্থ বুঝুক বা না-ই বুঝুক। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কুরআনের অর্থ ও লক্ষ্য বুঝার চেষ্টা করা নিঃসন্দেহে একটি জরুরী বিষয়। তবুও তার অর্থ বুঝতে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত তা তেলাঅত করতে বৈমুখ থাকা বা তাতে অবহেলা প্রদর্শন করা বৈধ নয়।
পবিত্রকরণ বলতে, আকীদা, আমল এবং নৈতিকতার সংশোধন। যেমন, নবী করীম (সাঃ) তাদেরকে শিরক থেকে বের করে তাওহীদের পথে প্রতিষ্ঠিত করেন। তদনুরূপ নেহাতই হীন চরিত্র ও জঘন্য আচরণে আলিপ্ত জাতিকে উচ্চ নৈতিকতার অধিকারী ও মহান কর্ম সম্পাদনকারী জাতি হিসাবে গড়ে তুলেন। ‘হিকমত’ (প্রজ্ঞা)র অর্থ অধিকাংশ মুফাসসিরের নিকট হাদীস।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) মক্কার কাবা গৃহের প্রাচীর নির্মাণ কালে আল্লাহ পাকের সকাশে দোয়া করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তাদের (পরবর্তী প্রজন্মের) মধ্য হতে তাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করুন। যিনি তাদের নিকট আপনার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করবেন। তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন। তাদেরকে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা বাকারাহ : আয়াত ১২৯)।
এই আয়াতে কারীমায় আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত নবী করিম (সা.) এর ওপর তিনটি দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন বলে ঘোষণা করেছেন।
১. আল্লাহর আয়াতসমূহ (কোরআন) আবৃত্তি করে মানুষকে শোনানো,
২. তাদেরকে এই কিতাবের এলেম ও হেকমত অর্থাৎ বিশেষ জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া এবং ৩. তাদেরকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করা। আর একথাও সুবিদিত যে কোরআনুল কারীম তিলাওয়াত করার মাধ্যমে এবং আল কোরআনের এলেম হাসিলের মাধ্যমে ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অর্জনের মাধ্যমে নিরবিচ্ছন্ন শান্তি ও স্বস্তি লাভ করা যায়। আর হেকমত বা বিশেষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথ সুগম হয়ে উঠে।
এই সূরার পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত একই অর্থ ও মর্ম সম্বলিত বাণী নাযিল করেছেন। ইরশাদ হয়েছে : যেমন আমি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করেছি। যিনি আমার আয়াত সমূহ তোমাদের নিকট আবৃত্তি করেন। তোমাদেরকে পবিত্র করেন। কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন। তোমরা যা জানতে না তা শিক্ষা দেন। (সূরা বাকারাহ : আয়াত ১৫৯)।
৩:১৬৫ اَوَ لَمَّاۤ اَصَابَتۡکُمۡ مُّصِیۡبَۃٌ قَدۡ اَصَبۡتُمۡ مِّثۡلَیۡہَا ۙ قُلۡتُمۡ اَنّٰی ہٰذَا ؕ قُلۡ ہُوَ مِنۡ عِنۡدِ اَنۡفُسِکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
১৬৫. কি ব্যাপার! যখন তোমাদের উপর মুসীবত আসলো (ওহুদের যুদ্ধে) তখন তোমরা বললে, “এটা কোত্থেকে আসলো? অথচ তোমরাতো দ্বিগুণ বিপদ – ঘটিয়েছিলে (বদরের যুদ্ধে)। বলুন, “এটা তোমাদের নিজেদেরই কাছ থেকে; নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।
এক হাদীসে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বদরের ঘটনা বর্ণনার পর উহুদের যুদ্ধের বিপর্যয়ের কারণ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, এটার কারণ হলোঃ বদরের যুদ্ধের বন্দীদের থেকে ফিদিয়া নেয়া। [দেখুনঃ মুসনাদে আহমাদঃ ১/২০৭]
সহীহ আকীদা বিশ্বাস হলো, কোন খারাপের সম্পর্ক আল্লাহর দিকে করা জায়েয নেই। আল্লাহ তা’আলার দিকে সব সময় ভাল ফলাফলের সম্পর্ক করতে হয়। খারাপ ফলের বাহ্যিক কারণ সৃষ্ট জীব। খারাপ তাদেরই অর্জন করা। আর এজন্যই সূরা আল-জিনে আল্লাহ্ তা’আলা জিনদের কথা উল্লেখ করে বলছেন যে, তারা বলেছিল “আর আমরা জানিনা যমীনের অধিবাসীদের জন্য খারাপ কিছুর ইচ্ছা করা হয়েছে নাকি তাদের প্রভূ তাদের জন্য সঠিক পথ দেয়ার ইচ্ছা করেছেন।” [সূরা জ্বিনঃ ১০] অন্য হাদীসে এসেছে, আর খারাপ কিছু আপনার থেকে হয় না। [মুসলিমঃ ৭৭১]
অর্থাৎ, উহুদ যুদ্ধে যেমন তোমাদের ৭০ জন লোক শহীদ হয়েছে, তেমনি বদর যুদ্ধে তোমরাও ৭০ জন কাফেরকে হত্যা এবং ৭০ জনকে বন্দী করেছিলে।
অর্থাৎ, তোমাদের নিজেদেরই সেই ভুলের কারণে যা তোমরা রসূল (সাঃ)-এর পাহাড়ের ঘাঁটি ত্যাগ না করার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও তা ত্যাগ করার মাধ্যমে করেছিলে। যার বিস্তারিত আলোচনা পূর্বেই হয়েছে। এই ভুলের কারণে কাফেরদের একটি দল সে ঘাঁটি হয়ে পাল্টা আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“জলে ও স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুণ বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।” (সুরা রূম : ৪১)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে রূহুল মাআনীতে বলা হয়েছে, “‘বিপর্যয়’ বলে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, অগ্নিকান্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়া, সব কিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম হওয়া এবং ক্ষতি বেশি হওয়া ইত্যাদি বিপদাপদ বুঝানো হয়েছে।” (আল্লামা আলুসী, রূহুল মাআনী, খ.-২১, পৃ.-৬৩) আর বর্তমানে ঘটছেও তাই। সুতরাং আয়াত থেকে জানা যায়, এসব পার্থিব বিপদাপদের কারণ হচ্ছে মানুষের গোনাহ ও কুকর্ম। তন্মধ্যে শিরক ও কুফর মারাত্মক। এরপর অন্যান্য গোনাহ।
রাসূলে কারিম সা: বলেছেন, ছোট-বড় যত দুর্ভোগ বা হয়রানি বান্দার ওপর আপতিত হয় সবই নিজ কর্মদোষে। আর অধিকাংশই আল্লাহ মাফ করে দেন’ (বুখারি শরিফ)।
উপরোক্ত আয়াতের আলোকে নিম্নের বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা আলোচনা করতে প্রয়াস পাই-
১। সব গুনাহে কি শাস্তি হয়
২। সব বিপদ কি গুনাহর কারণে হয়
৩। সবার বিপদ কি গুনাহের শাস্তি
৪। শুধু গুনাহকারীকেই কি শাস্তি দেয়া হয়
৫। গুনাহের সব শাস্তি কি দুনিয়ায় দেয়া হয়
সব গুনাহের কি শাস্তি হয় :
আমাদের বিপদাপদ যদিও পাপের কারণে হয়, কিন্তু দয়াময় আল্লাহ তাআলা আমাদের সব গুনাহের পরিণামে শাস্তি দেননা। পদেপদে আমরা যেভাবে গুনাহ করছি, আল্লাহ তাআলা যদি আমাদের সব গুনাহের শাস্তি দিতেন তবে তো আমরা সুন্দরভাবে বাঁচতেই পারতাম না। আল্লাহ তাআলা আমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন এবং শাস্তি বাতিল করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“তোমাদেরকে যেসব বিপদাপদ স্পর্শ করে, সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের কারণে। আর অনেক গুনাহ তিনি (আল্লাহ) ক্ষমা করে দেন।” (সুরা শুরা : ৩০)
সুতরাং বুঝা গেল আমরা যে পরিমাণ গুনাহ করি আল্লাহ সে অনুযায়ী শাস্তি দেন না; বরং অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহু রহমান।
সব বিপদ কি গুনাহর কারণে হয় :
“আর অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি, ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দিন সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। তারা সে সকল লোক যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়াতপ্রাপ্ত।” (সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭)- তাহলে কি সব বিপদ গুনাহের কারণে হয়? যদিও বিভিন্ন আয়াত দ্বারা বুঝা যায় বান্দার গুনাহের কারণেই বিপদ হয় তথাপিও আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা বা অনুমতি ব্যতীত কিছুই হয় না। বান্দার কিছু বিপদ পূর্বে থেকেই নির্ধারিত যা আল্লাহ তাআলা বান্দার পরীক্ষার জন্য দিয়ে থাকেন। কখন, কিভাবে, কোথায় ও কী পরিমাণ শাস্তি হবে তা আগে থেকেই লিপিবদ্ধ। এরূপ বিশ্বাসের ফলে বিপদের কারণে বান্দার দুঃখবোধ হয়না। পক্ষান্তরে বিপদ থেকে মুক্তি পেলে অহংকার প্রকাশের কোনো অবকাশ থাকেনা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“পৃথিবীতে এবং তোমাদের ব্যক্তিগতভাবে যে বিপদ আসে তা আমার জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। আর এটা এজন্য যে, যাতে তোমরা যা হারাও তার জন্য দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদের যা দেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আর আল্লাহ তাআলা কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” (সুরা হাদীদ : ২২,২৩)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
“আল্লাহ তাআলার নির্দেশ ব্যতীত কেনো বিপদ আসেনা, আর যে আল্লাহ তাআলার প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ তাআলা সব বিষয়ে জানেন।” (সুরা তাগাবুন : ১১)
আলোচ্য আয়াত দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তাকদীরে বিশ্বাসী মুমিন যখন বিপদে পতিত হয়, তখন তার অন্তরকে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে স্থির বিশ্বাস স্থাপন করে দেন যে, যা কিছু হয়েছে, আল্লাহ তাআলার অনুমতি ও ইচ্ছায় হয়েছে। যে বিপদ তাকে স্পর্শ করেছে, তা অবধারিত ছিলো। কেউ একে ফেরাতে পারত না। আর যে বিপদ থেকে সে মুক্ত রয়েছে, তা থেকে মুক্ত থাকাই তার জন্য অবধারিত ছিলো। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, সংক্ষেপিত, পৃ.-১৩৭৮)
হজরত নুহ আ:-এর গোত্র আল্লাহর হুকুম অমান্য করে দেব-দেবীর পূজা করত। তারা আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতার চরমপর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তখন আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের প্রতি মহাপ্লাবন নাজিল করেন এবং সেই প্লাবনে নিমজ্জিত করে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। কিন্তু নুহ আ:-এর অল্পসংখ্যক অনুসারীকে আল্লাহ মহাপ্লাবন থেকে হেফাজত করেন। হজরত হুদ আ:-এর সম্প্রদায়ও একই অপরাধে অপরাধী ছিল। তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে ধ্বংস করে দেন। হজরত শুয়াইব আ:-এর গোত্র ওজনে কম দিত। এ ব্যাপারে তারা সীমা লঙ্ঘন করলে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। হজরত লুত আ:-এর গোত্র সমকামিতায় লিপ্ত হতো। তারা যখন এই অপরাধের চরম সীমায় পৌঁছে গেল, তখন তাদেরকে ভূমিকম্প ও পাথর বর্ষণে ধ্বংস করে দেন এবং নিরপরাধীদের রক্ষা করেন। এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন অপরাধের কারণে ধ্বংস করে দেন।
তবে উম্মতে মুহাম্মাদি আজাব-গজব দ্বারা সমূলে ধ্বংস হবে না এটা রাসূলে কারিম সা:-এর দোয়ার ফল এবং উম্মতে মুহাম্মাদির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সময়ে সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপদ-আপদ দিয়ে সাবধান করা হবে, যা আমরা মাঝে মধ্যে লক্ষ করছি।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা কি দেখে না যে তারা প্রতি বছর দু-একবার বিপর্যস্ত হয়? এর পরও তারা তাওবা করে না এবং উপদেশ গ্রহণ করে না’ (সূরা তাওবা: ১২৬)।
আল্লাহ বলেন, ‘আমি কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করি না, যতণ না তারা নিজে নিজের অবস্থা পরিবর্তন করে’ (সূরা রাদ : আয়াত-১১)।
সুতরাং বোঝা গেল, মানুষের কর্মদোষে বিভিন্ন পাপাচারে সীমালঙ্ঘনের ফলে জলে-স্থলে বিপদ-আপদ নাজিল হয়। তাই আমাদের অতীতের কৃতকর্মের জন্য তাওবা করে সংশোধন হওয়া জরুরি। কারণ বিচার দিবসের কাঠগড়ায় তো আমাদের অবশ্যই দাঁড়াতে হবে।
তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদের কর্মফল। আমি তোমাদের অনেক অপরাধ মা করে থাকি’ (সূরা শুআরা : ৩০)।
শুধু দুনিয়াতেই শাস্তি না আখেরাতেও
তাআলা বলেন,“আর অবশ্যই আমি তাদেরকে বড় শাস্তির পূর্বে ছোট শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।” (সুরা সাজদাহ : ২১)
প্রশ্ন: নিজের পাপ কাজের জন্য কি দুনিয়াতেই শাস্তি পেতে হবে? আর দুনিয়াতে শাস্তি পেলে কি আখিরাতে আবারও সে পাপের শাস্তি পেতে হবে?
উত্তর:
আল্লাহ তাআলা কখনো কখনো বান্দাকে দুনিয়াতে তার পাপ কর্মের শাস্তি দিয়ে থাকেন আবার কখনো দুনিয়াতে শাস্তি দেন না কিন্তু আখিরাতের জন্য জমা রাখেন। তিনি সেখানে তাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করবেন যদি সে জীবদ্দশায় আল্লাহর কাছে ক্ষমা না চায় অথবা মহান আল্লাহ দয়া করে নিজ থেকে তাকে ক্ষমা না করেন।
🔶 কোন ব্যক্তি দুনিয়াতে গুনাহ করার কারণে বা কোন অপরাধের কারণে যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে অথবা দুনিয়াবী আদালতে ইসলামি শরিয়া মোতাবেক শাস্তি পায় তাহলে তাতে তার উক্ত পাপ মোচন হয়ে যায়। যার ফলে ওই পাপ কর্মের জন্য সে পরকালীন শাস্তি থেকে রক্ষা পায়। আলহামদুলিল্লাহ।
যেমন: হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ العُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا، وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَافِيَ بِهِ يَوْمَ القِيَامَةِ. صححه الألباني في صحيح الترمذي
“আল্লাহ যখন তাঁর বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতে তার শাস্তি ত্বরান্বিত করেন, আর যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান তখন তার পাপগুলো রেখে দিয়ে কিয়ামতের দিন তাঁর প্রাপ্য পূর্ণ করে দেন।”
[জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৯৬-তিনি এটিকে হাসান বলেছেন আর শাইখ আলবানি এটিকে সহিহুত তিরমিযীতে সহিহ বলেছেন]
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় শায়খ বিন বায বলেন,
قد تكون العقوبة بمرض، قد تكون بموت ولد، قد تكون بفقر وتلف مال، قد تكون بغير هذا من المصائب تكفيرا له وحثا له على الصبر والاحتساب
“এই শাস্তি হয় কখনো রোগ ব্যাধি, কখনো সন্তানের মৃত্যু, কখনো দারিদ্রতা, কখনো সম্পদ বিনষ্ট কখনো অন্যান্য বিপদ মুসিবত দ্বারা। এর মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহ মোচন করেন। সেই সাথে তাকে উৎসাহিত করেন যেন সে সবর ও সওয়াবের প্রত্যাশা করে।”
মোটকথা, কেউ যদি নিজের পাপাচার ও অন্যায় কাজের শাস্তি দুনিয়াতে পেয়ে যায় তাহলে এটা তার জন্য কল্যাণকর। কেননা দুনিয়ার শাস্তি লাভের পর সে গুনাহমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু যার শাস্তি আখিরাতের জন্য জমা রাখা হয় নি:সন্দেহে তার পরিণতি খারাপ। আল্লাহ ক্ষমা করুন।
🔶 অনুরূপভাবে কেউ যদি দুনিয়াতে কোন অপরাধ করার পর ইসলামি আদালতের মাধ্যমে শাস্তিপ্রাপ্ত হয় তাহলে তা আখিরাতে তার জন্য কাফফারা (গুনাহ মোচনের মাধ্যম) হয়ে যায়। ফলে সেখানে তাকে এই অপরাধের কারণে পুনর্বার শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে না।
উবাদা ইবনু সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ছিলাম, তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি এসব শর্তে আমার কাছে বায়’আত করবে যে, তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরিক করবে না, জিনা করবে না এবং চুরি করবে না? এরপর তিনি নারীদের শর্ত সম্পর্কিত আয়াত পাঠ করলেন। عنهবর্ণনাকারী সুফইয়ান প্রায়ই বলতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াতটি পাঠ করেছেন।
এরপর রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْهَا شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَسَتَرَهُ اللَّهُ فَهْوَ إِلَى اللَّهِ، إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ وَإِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ
“তোমাদের যে ব্যাক্তি এসব শর্ত পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রতিদান দিবেন। আর যে ব্যাক্তি এসবের কোন একটি করে ফেলবে এবং তাকে (দুনিয়াতে) শাস্তিও দেয়া হবে। তবে এ শাস্তি তার জন্য কাফফারা হয়ে যাবে। আর যে ব্যাক্তি এসবের কোন একটি করে ফেলল এবং আল্লাহ তা গোপন রাখলেন, তাহলে এ বিষয়টি আল্লাহর কাছে রইল। তিনি চাইলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন অথবা তাকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন।”
[সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায: ৫২/ তাফসীর. পরিচ্ছেদঃ আল্লাহ্র বাণীঃ إذا جاءك المؤمنات يبايعنك “(হে নবী!) মু’মিন নারীগণ যখন তোমার কাছে এ মর্মে বায়’আত করতে আসে” (৬০ঃ ১২)]
উক্ত হাদীসটি ইমাম বুখারী রহ. হুদুদ বা ফৌজদারি দণ্ডবিধির সংক্রান্ত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন এবং তার শিরোনাম (অনুচ্ছেদ) দিয়েছেন এভাবে:
باب الحدود كفارة
অনুচ্ছেদ: হুদুদ বা ইসলামি আইন অনুযায়ী দণ্ড প্রয়োগ গুনাহের কাফফারা স্বরপ।
আমরা মহান আল্লাহর কাছে তার শাস্তি থেকে পানাহ চাই। নিশ্চয়ই তিনি পরম দয়ালু এবং অতীব ক্ষমা পরায়ন।
———————
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।
শুধু গুনাহকারীকেই কেনো শাস্তি দেয়া হয়না
কোনো জনপদে যখন বিপদ বা বিপর্যয় আসে তখন শুধু গুনাহকারীর ওপরই শাস্তি পতিত হয়না; বরং সে এলাকার সবার ওপর পতিত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর তোমরা এমন ফেতনা (বিপদ) থেকে বেঁচে থাকো যা বিশেষতঃ শুধু যে জুলুম করে তার ওপর পতিত হবেনা, এবং জেনে রাখো যে, আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠোর।”(সুরা আনফাল:২৫)
৩:১৬৬ وَ مَاۤ اَصَابَکُمۡ یَوۡمَ الۡتَقَی الۡجَمۡعٰنِ فَبِاِذۡنِ اللّٰہِ وَ لِیَعۡلَمَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
১৬৬. আর যেদিন দু’দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল, সেদিন তোমাদের উপর যে বিপর্যয় ঘটেছিল তা আল্লাহরই হুকুমে; আর যাতে তিনি প্রকাশ করেন, কে তোমাদের মধ্যে প্রকৃত মুমিন।
এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এসব যা কিছু হয়েছে, সবই আল্লাহর ইচ্ছা ও সমর্থনে হয়েছে।
মনে রাখা দরকার যে, আল্লাহর ইচ্ছা বা অনুমতি দু’প্রকার।
এক. ইযনে শারয়ী বা শরীআতগত অনুমোদন বা ইচ্ছা। এ অনুমোদনের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির সম্পর্ক রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক কাউকে সালাত আদায় করতে দেয়ার ইচ্ছা, কাউকে হক পথে চলতে দেয়ার ইচ্ছা ইত্যাদি। এ ধরনের অনুমোদন বা ইচ্ছা সংঘটিত হওয়া বাধ্যতামূলক নয়।
দুই. ইযনে কাওনী বা প্রকৃতিগত অনুমোদন বা ইচ্ছা। এ অনুমোদনের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই। তবে তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। যেমন এ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর অনুমোদন বা ইচ্ছা। [তাফসীরে সা’দী]
৩:১৬৭ وَ لِیَعۡلَمَ الَّذِیۡنَ نَافَقُوۡا ۚۖ وَ قِیۡلَ لَہُمۡ تَعَالَوۡا قَاتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ اَوِ ادۡفَعُوۡا ؕ قَالُوۡا لَوۡ نَعۡلَمُ قِتَالًا لَّا تَّبَعۡنٰکُمۡ ؕ ہُمۡ لِلۡکُفۡرِ یَوۡمَئِذٍ اَقۡرَبُ مِنۡہُمۡ لِلۡاِیۡمَانِ ۚ یَقُوۡلُوۡنَ بِاَفۡوَاہِہِمۡ مَّا لَیۡسَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ ؕ وَ اللّٰہُ اَعۡلَمُ بِمَا یَکۡتُمُوۡنَ
১৬৭. আর মুনাফিকদের প্রকাশ করার জন্য। আর তাদেরকে বলা হয়েছিল, এস, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর অথবা প্রতিরোধ কর। তারা বলেছিল, যদি যুদ্ধ জানতাম তবে নিশ্চিতভাবে তোমাদের অনুসরণ করতাম। সেদিন তারা ঈমানের চেয়ে কুফরীর কাছাকাছি ছিল। যা তাদের অন্তরে নেই তারা তা মুখে বলে এবং তারা যা গোপন রাখে আল্লাহ তা অধিক অবগত।
অর্থাৎ, উহুদে তোমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা আল্লাহরই নির্দেশে হয়েছে। (যাতে তোমরা আগামীতে রসূল (সাঃ)-এর আনুগত্যের প্রতি যথাযথ যত্ন নাও।) এ ছাড়া এর আরো একটি উদ্দেশ্য হল, মু’মিন ও মুনাফিকদেরকে একে অপর থেকে পৃথক করা হল।
যুদ্ধ জানার অর্থ হল, যদি বাস্তবিকই তুমি যুদ্ধ করতে যেতে, তাহলে আমরাও তোমার সাথে থাকতাম। কিন্তু তুমি তো নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে ঠেলে দিতে যাচ্ছ, অতএব এ রকম ভুল কাজে আমরা তোমার সাথে কিভাবে থাকতে পারি? এই ধরনের কথা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার সাথীরা এই জন্যই বলেছিল যে, তাদের মত গ্রহণ করা হয়নি। আর এ কথা তারা তখন বলেছিল, যখন ‘শাউত্ব’ নামক স্থানে পৌঁছে তারা (যুদ্ধ না করে) প্রত্যাবর্তন করছিল এবং আব্দুল্লাহ ইবনে হারাম আনসারী তাদেরকে বুঝিয়ে যুদ্ধে শরীক করার প্রচেষ্টা করছিলেন। (এর কিছু বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে হয়েছে।)
নিজেদের মুনাফিক্বী এবং এমন কথা-বার্তার কারণে যা তারা বলেছে।
অর্থাৎ, যুদ্ধ ত্যাগ করার যে কারণ মৌখিকভাবে তারা প্রকাশ করেছে, সেটা প্রকৃত কারণ নয়, বরং তাদের অন্তরে লুক্কায়িত যে কারণ ছিল তা হল, প্রথমতঃ আমাদের পৃথক হওয়ায় মুসলিমদের অন্তরে দুর্বলতার সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়তঃ কাফেরদের লাভ হবে। অর্থাৎ, আসল উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম, মুসলিম এবং নবী করীম (সাঃ)-এর ক্ষতি করা।
৩:১৬৮ اَلَّذِیۡنَ قَالُوۡا لِاِخۡوَانِہِمۡ وَ قَعَدُوۡا لَوۡ اَطَاعُوۡنَا مَا قُتِلُوۡا ؕ قُلۡ فَادۡرَءُوۡا عَنۡ اَنۡفُسِکُمُ الۡمَوۡتَ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ
১৬৮. যারা ঘরে বসে রইল এবং তাদের ভাইদের প্রতি বলল যে, তারা তাদের কথামত চললে নিহত হত না। তাদেরকে বলুন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে নিজেদেরকে মৃত্যু থেকে রক্ষা কর।
এখানে মুনাফিকদের কথা ‘তারা আমাদের কথা মত চললে নিহত হতো না’ এর প্রতিবাদ করে মহান আল্লাহ বলছেন, ‘‘যদি তোমরা তোমাদের কথায় সত্যবাদী হও, তাহলে নিজেদের উপর থেকে মৃত্যুকে সরিয়ে দাও তো দেখি।’’ অর্থাৎ, আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্য থেকে পালানোর কোন উপায় নেই। মৃত্যুও যেখানে এবং যেভাবে নির্ধারিত আছে, সেখানে এবং সেইভাবেই আসবে। সুতরাং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হতে পলায়ন কাউকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
৩:১৬৯ وَ لَا تَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ قُتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ اَمۡوَاتًا ؕ بَلۡ اَحۡیَآءٌ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ یُرۡزَقُوۡنَ
১৬৯. আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনোই মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত এবং তাদের রবের কাছ থেকে তারা জীবিকাপ্রাপ্ত।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উপরোক্ত আয়াত সম্পর্কে বলেনঃ আমরা এ আয়াত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেনঃ শহীদদের আত্মাকে সবুজ পাখির পেটে রাখা হয়। আরশের সাথে লটকানো ঝাড়বাতির সাথে যেগুলো অবস্থিত। জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা তারা সেখানে বিচরণ করতে পারে। তাদের প্রভু তাদের দিকে একবার তাকিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করলেনঃ তোমরা কি কিছু চাও? তারা বললঃ আমাদের আর কি চাহিদা থাকতে পারে? আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারি? এভাবে তিনবার তিনি তাদের তা জিজ্ঞাসা করলেন। এরপর যখন শহীদগণ বুঝতে পারল যে, তাদেরকে চাইতেই হবে, তখন তারা বললঃ হে রব! আমরা চাই আমাদের আত্মাকে আমাদের দেহে ফিরিয়ে দেয়া হোক যাতে আমরা আবার আপনার রাস্তায় শহীদ হতে পারি। তারপর আল্লাহ যখন দেখলেন যে, তাদের এর দরকার নেই তখন তাদের এভাবেই ছেড়ে দিলেন। [মুসলিমঃ ১৮৮৭]
অন্য এক হাদীসে এসেছে, জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সাথে সাক্ষাত হলে বললেনঃ জাবের, তোমার কি হল, তোমার মন খারাপ দেখছি? আমি বললামঃ ওহুদের যুদ্ধে আমার বাবা শহীদ হয়ে গেলেন। তার পরিবার এবং অনেক ঋণ রেখে গেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমাকে কি আমি তোমার বাবার সাথে আল্লাহ তা’আলা কিভাবে সাক্ষাত করেছেন সে সুসংবাদ দেব? আমি বললামঃ অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেনঃ আল্লাহ্ তাআলা সবার সাথে কথা বলেন পর্দার আড়াল থেকে। কিন্তু তোমার বাবাকে আল্লাহ জীবিত করে সরাসরি কথা বলেছেন এবং বলেছেন, “হে আমার বান্দা, আমার কাছে চাও, আমি তোমাকে দেব।” তিনি বললেনঃ হে আমার রব, আমাকে জীবিত করে দিন যাতে আমি আবার আপনার রাস্তায় শহীদ হতে পারি। মহান আল্লাহ বললেনঃ “আমার পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত এই যে, এরা দুনিয়াতে পুনরায় ফিরে যাবে না।” জাবের বলেনঃ তখন এই আয়াত নাযিল হয়। [তিরমিযীঃ ৩০১০, ইবনে মাজাহঃ ১৯০, ২৮০০] ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, শহীদদের অবস্থা ও মর্যাদার মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। কাজেই বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন প্রকার বর্ণনা এসেছে।
শহীদদের এ জীবন অবশ্যই প্রকৃতার্থে, রূপকার্থে নয়। তবে এ জীবনের সঠিক ধারণা দুনিয়াবাসীর নেই। (কুরআনে এটা পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে। দ্রষ্টব্যঃ সূরা বাক্বারাহঃ আয়াত নং১৫৪) কিন্তু এ জীবনের অর্থ কি? কেউ বলেছেন, কবরে তাঁদের আত্মা ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানে তাঁরা আল্লাহর নিয়ামত দ্বারা পরিতৃপ্ত হন। কেউ বলেছেন, জান্নাতের ফলের সুগন্ধি তাঁদের কাছে আসে, যার ফলে তাঁদের প্রাণ সব সময় সুবাসে ভরে থাকে। তবে হাদীস থেকে তৃতীয় আর একটি জিনিস যা জানা যায় –আর এটাই সঠিক– তা হল, তাঁদের আত্মাসমূহকে সবুজ রঙের পাখির পেটে অথবা বুকে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে। ফলে তারা জান্নাতে খেয়ে বেড়াতে এবং তার নিয়ামত দ্বারা তৃপ্তি লাভ করতে থাকবে। (ফাতহুল ক্বাদীর, সহীহ মুসলিম)
৩:১৭০ فَرِحِیۡنَ بِمَاۤ اٰتٰہُمُ اللّٰہُ مِنۡ فَضۡلِہٖ ۙ وَ یَسۡتَبۡشِرُوۡنَ بِالَّذِیۡنَ لَمۡ یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ مِّنۡ خَلۡفِہِمۡ ۙ اَلَّا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا ہُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ
১৭০. আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে তারা আনন্দিত এবং তাদের পিছনে যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি তাদের জন্য আনন্দ প্রকাশ করে যে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।
অর্থাৎ, তাঁদের তিরোধানের পর যে মুসলিমরা জীবিত আছেন অথবা জিহাদে ব্যস্ত রয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারে তাঁরা আশা প্রকাশ করবেন যে, তাঁরাও যদি শাহাদতের মর্যাদা লাভে ধন্য হয়ে এখানে আমাদের মত তৃপ্তিময় জীবন লাভ করতেন! উহুদ যুদ্ধের শহীদগণ মহান আল্লাহর নিকট আরজি পেশ করলেন যে, আমাদের যে মুসলিম ভাইরা দুনিয়াতে জীবিত আছেন, তাঁদেরকে আমাদের অবস্থাসমূহ এবং আমাদের এই সুখেভরা জীবন সম্পর্কে কেউ অবহিত করানোর আছে কি? যাতে তাঁরা যেন যুদ্ধ ও জিহাদ করা থেকে বিমুখ না হয়।
আল্লাহ তাআলা বললেন, ‘‘আমি তোমাদের এ কথা তাঁদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি।’’ এই প্রসঙ্গেই মহান আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করলেন। (মুসনাদ আহমাদ ১/৩৬৫-৩৬৬, সুনানে আবূ দাউদ, জিহাদ অধ্যায়) এ ছাড়াও আরো বহু হাদীস দ্বারা জিহাদের ফযীলত প্রমাণিত। যেমন,
একটি হাদীসে এসেছে, ‘‘মৃত্যুবরণকারী কোন প্রাণই আল্লাহর নিকট উত্তম মর্যাদা লাভ করার পর পুনরায় দুনিয়াতে ফিরে আসতে চাইবে না, কিন্তু শহীদ শাহাদতের সুউচ্চ মর্যাদা দেখে পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে আসতে পছন্দ করবে, যাতে সে আবারও আল্লাহ রাস্তায় শহীদ হতে পারে।’’ (মুসনাদ আহমদ ৩/১২৬, সহীহ মুসলিম ১৮৭৭নং)
৩:১৭১ یَسۡتَبۡشِرُوۡنَ بِنِعۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ فَضۡلٍ ۙ وَّ اَنَّ اللّٰہَ لَا یُضِیۡعُ اَجۡرَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿
১৭১. তারা আনন্দ প্রকাশ করে আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহের জন্য এবং এজন্য যে আল্লাহ মুমিনদের শ্রমফল নষ্ট করেন না।
এই আনন্দ ও প্রফুল্লতা প্রথম আনন্দের কথা সুদৃঢ় করণ এবং এ কথার বিবরণ যে, তাঁদের আনন্দ কেবল ভয়-ভীতি ও চিন্তা-ভাবনা না থাকার কারণে নয়, বরং তাঁদের আনন্দ আল্লাহর নিয়ামত এবং তাঁর সীমাহীন অনুগ্রহ লাভের কারণেও। কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, প্রথম আনন্দের সম্পর্ক দুনিয়ায় অবস্থানরত ভাইদের সাথে এবং দ্বিতীয় আনন্দের কারণ হল তাঁদের উপর আল্লাহর কৃত অফুরন্ত অনুগ্রহ ও অতিশয় সম্মান। (ফাতহুল ক্বাদীর)
surah Al Imran bangla Tafseer Ayat 154-158, part-24 Shaykh Abdul Qayum
Tafseer Ayat 159-161, part-25 Shaykh Abdul Qayum
Ayat 162-168, part-26 Shaykh Abdul Qayum
Ayat 169-175, part-27 Shaykh Abdul Qayum