সূরা তাকাসূর তাফসির

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

সূরা তাকাসুর

 

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)

أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ

(১) অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে,

حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ

(২) যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও।

كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ

(৩) কখনই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে।

ثُمَّ كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ

(৪) অতঃপর কখনই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে

كَلَّا لَوْ تَعْلَمُونَ عِلْمَ الْيَقِينِ

(৫) কখনই না। যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে (তাহ’লে কখনো তোমরা পরকাল থেকে গাফেল হ’তে না)।

لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ

(৬) তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করবে।

ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِينِ

(৭) অতঃপর তোমরা অবশ্যই তা দিব্য-প্রত্যয়ে দেখবে।

ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ

(৮) অতঃপর তোমরা অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে দেওয়া নে‘মতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।

 

নাযিলের সময় – কাল

আবু হাইয়ান ও শওকানী বলেন , সকল তাফসীরকার একে মক্কী সূরা গণ্য করেছেন । এ ব্যাপারে ইমাম সুয়ুতির বক্তব্য হচ্ছে , মক্কী সূরা হিসেবেই এটি বেশী খ্যাতি অর্জন করেছে। কিন্তু কিছু বর্ণনায় একে মাদানী সূর বলা হয়েছে।

ইমাম আবু হাতেম আবু বুরাইদার ( রা) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন । তাতে বলা হয়েছে : বনী হারেসা ও বনিল হারস নামক আনসরাদের দু’টি গোত্রের ব্যাপারে এ সূরাটি নাযিল হয়। উভয় গোত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রথমে নিজেদের জীবিত লোকদের গৌরব গাঁথা বর্ণনা করে।

কিন্তু শানেনূযুল বা নাযিল হওয়ার কারণ ও উপলক্ষ বর্ণনার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণ যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা সামনে রাখলে এই রেওয়ায়াত যে উপলক্ষে বর্ণনা করা হয়েছে তাকে এই সূরা নাযিলের উপলক্ষ বলে মেনে নেবার সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। বরং এ থেকে এই অর্থ গ্রহণ করা যায় যে , এই দু’টি গোত্রের কর্মকাণ্ডের সাথে সূরাটি খাপ খেয়ে যায়।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ), মুক্বাতিল ও কালবী বলেন, কুরায়েশ বংশের বনু আবদে মানাফ ও বনু সাহ্ম দুই গোত্র পরস্পরের উপরে বিভিন্ন বিষয়ে প্রাধান্য দাবী করে বড়াই করত। সে উপলক্ষে সূরাটি নাযিল হয় (কুরতুবী)। কিন্তু বক্তব্য সকল যুগের সকল লোভী ও অহংকারী মানুষের জন্য প্রযোজ্য। কেননা দুনিয়াবী শান-শওকত মায়া-মরীচিকার মত। এগুলোর কোন কিছুই বান্দা সাথে নিয়ে যেতে পারবে না। কেবলমাত্র তার নেক আমল ব্যতীত।

আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

لَوْ أَنَّ لاِبْنِ آدَمَ وَادِيًا مِنْ ذَهَبٍ أَحَبَّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ وَادِيَانِ، وَلَنْ يَمْلأَ فَاهُ إِلاَّ التُّرَابُ، وَيَتُوْبُ اللهُ عَلَى مَنْ تَابَ– ‘যদি আদম সন্তানকে এক ময়দান ভর্তি স্বর্ণ দেওয়া হয়, তাহলে সে দুই ময়দান ভর্তি স্বর্ণের আকাংখা করবে। তার মুখ ভরবে না মাটি ব্যতীত (অর্থাৎ কবরে না যাওয়া পর্যন্ত)। আর আল্লাহ তওবাকারীর তওবা কবুল করে থাকেন’।বুখারী হা/৬৪৩৯, মুসলিম হা/১০৪৮, মিশকাত হা/৫২৭৩।

রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, উবাই বিন কাব (রাঃ) বলতেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপরোক্ত হাদীছকে কুরআনের অংশ মনে করতাম, যতক্ষণ না সূরা তাকাছুর নাযিল হয়’। বুখারী হা/৬৪৪০ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ১০ অনুচ্ছেদ।

ইবনে জারীর , তিরমিযী ও ইবনুল মুনযির প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হযরত আলীর ( রা) একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন : “কবরের আযাব সম্পর্কে আমরা সব সময় সন্দেহের মধ্যে ছিলাম। এমন কি শেষ পর্যন্ত ‘ আলহা – কুমুত তাকাসুর ’ নাযিল হলো। হযরত আলীর (রা ) এই বক্তব্যটিকে এই সূরার মাদানী হবার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করার কারণ হচ্ছে এই যে , কবরের আযাবের আলোচনা মদীনায় শুরু হয়। মক্কায় এ সম্পর্কে কোন আলোচনাই হয়নি। কিন্তু একথাটি আসলে ঠিক নয়। কুরআনের মক্কী সূরাগুলেরা বিভিন্ন স্থানে এমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কবরের আযাবের কথা বলা হয়েছে যে , এ সম্পর্কে সন্দেহের কোন বিকাশই সেখানে নেই।

উদাহরণ স্বরূপ দেখুন সূরা আন’ আম ৯৩ আয়াত,আন নামল ২৮ আয়াত,আল-মূ’মিনূন ৯৯-১০০ আয়াত, আল মু’মিন ৪৫-৪৬ আয়াত । এগুলো সবই মক্কী সূরা। তাই হযরত আলীর (রা) উক্তি থেকে যদি কোন জিনিস প্রমাণ হয় তাহলে তা হচ্ছে এই যে , উপরোল্লিখিত মক্কী সূরাগুলো নাযিলের পূর্বে সুরা আত তাকাসুর নাযিল হয় এবং এই সূরাটি নাযিল হবার ফলে সহাবীগণের মথ্যে বিরাজিত কবরের আযাব সম্পর্কিত সংশয় দূর হয়ে যায়।

 

এ কারণে এই হাদীসগুলো সত্ত্বেও মুফাসসিরগণের অধিকাংশই এর মক্কী হবার ব্যাপারে একমত।

 

মূল বক্তব্যঃ

প্রাচুর্যের লোভ মানুষকে আখেরাত ভুলিয়ে রাখে। কিন্তু না, তাকে দুনিয়া ছাড়তেই হবে এবং আখেরাতে পাড়ি দিতেই হবে। অতঃপর সেখানে তারা দুনিয়াবী নেয়ামতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে এবং হাতে-নাতে ফলাফল পাবে।

تكاثر শব্দটি كثرة থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ, পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। এখানে উদ্দেশ্য, প্রাচুর্য লাভ করার জন্য মানুষের পরস্পরের অগ্রবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা ও প্রতিযোগিতা করা; লোকদের অন্যের তুলনায় বেশী প্রাচুর্য লাভ করার কথা নিয়ে পরস্পরের মোকাবেলায় বড়াই করে বেড়ানো। [ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর]

এখানে কী বিষয়ে প্রতিযোগিতা তা বল হয় নি। মূলত দুনিয়ার ধন-সম্পদ, পুত্রপরিবার, বংশ, সম্মান-মর্যাদা, শক্তি ও কর্তৃত্বের উপকরণ এবং যেসব বিষয়ে এরূপ প্রতিযোগিতা হয় তার সবই উদ্দেশ্য। [সা’দী]

এই সূরায় মানুষকে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও বৈষয়িক স্বার্থ পূজার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এই ভালোবাসা ও স্বার্থ পূজার কারণে মানুষ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বেশী বেশী ধন – সম্পদ আহরণ , পার্থিব লাভ , স্বার্থ উদ্ধার , ভোগ প্রতিপত্তি , ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ এবং তার মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে একজন আর একজনকে টপকে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। আর এসব অর্জন করার ব্যাপারে অহংকারে মতো থাকে। এই একটি মাত্র চিন্তা তাদেরকে এমনভাবে মশগুল করে রেখেছে যার ফলে এর চেয়ে উন্নততর কোন জিনিসের প্রতি নজন দেবার মানসিকতাই তাদের নেই । এর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার পর লোকদেরকে বলা হয়েছে , এই যেসব নিয়ামত তোমরা নিশ্চিন্তে সংগ্রহ করতে ব্যস্ত , এগুলো শুধুমাত্র নিয়ামত নয় বরং এগুলো তোমাদের জন্য পরীক্ষার বস্তুও ।

তাফসিরঃ

 

أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ

(১) অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে,

আলহাকুম ‘ ( আরবী – أَلْهَاكُمُ) শব্দটির মূলে রয়েছে লাহউন৷ এর আসল অর্থ গাফলতি৷ কিন্তু যেসব কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ এত বেশী বেড়ে যায় যে, সে তার মধ্যে মগ্ন হয়ে অন্য অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে গাফেল হয়ে পড়ে সেই ধরনের প্রত্যেকটি কাজের জন্য আরবী ভাষায় এ শব্দটি বলা হয়ে থাকে৷

আলহাকুম শব্দটিকে যখন এর মূল অর্থে বলা হবে তখন এর অর্থ হবে কোন ‘ লাহওয়া ‘ তোমাকে তার মধ্যে এমনভাবে মশগুল করে রেখেছে যে , তার চাইতে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কোন জিনিসের প্রতি আর তোমার আকর্ষণ ও আগ্রহ থাকেনি৷ তার মোহ তোমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে৷ তারই চিন্তায় তুমি নিমগ্ন ৷ আর এই মোহ ও নিমগ্নতা তোমাকে একেবারে গাফেল করে দিয়েছে৷

তাকাসুর ( আরবী –تَّكَاثُرُ) এর মূল কাসরাত ৷

এর তিনটি অর্থ হয়৷

এক , মানুষের বেশী বেশী প্রাচুর্য লাভ করার চেষ্টা করা ৷

দুই , প্রাচুর্য লাভ করার জন্য মানুষের পরস্পরের অগ্রবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা৷

তিন , লোকদের অন্যের তুলনায় বেশী প্রাচুর্য লাভ করার কথা নিয়ে পরস্পরের মোকাবেলায় বড়াই করে বেড়ানো৷

কাজেই ” আলহাকুমুত তাকাসুরের ” অর্থ দাঁড়ায় তাকাসুর বা প্রাচুর্য তোমাদেরকে তা নিজের মধ্যে এমনভাবে মশগুল করে নিয়েছে , যার ফলে তার প্রতি মোহাচ্ছন্নতা তোমাদের তার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে গাফেল করে দিয়েছে ৷

 

তাকাসুরের মধ্যে কোন জিনিসের প্রাচুর্য রয়েছে , ‘ আলহাকুম ‘ এ কোন জিনিস থেকে গাফেল হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং আলহাকুম এ কাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে – এ বাক্যে সে কথা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি৷ অর্থের এই অস্পষ্টতার কারণে এই শব্দগুলো ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহারের দুয়ার খুলে গেছে৷ এ ক্ষেত্রে ‘ তাকাসুর ‘ বা প্রাচুর্যের অর্থ সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি৷ বরং দুনিয়ার সমস্ত সুবিধা ও লাভ , বিলাস দ্রব্য , ভোগের সামগ্রী , শক্তি ও কর্তৃত্বের উপকরণ বেশী বেশী অর্জন করার প্রচেষ্টা চালানো , এগুলো অর্জন করার জন্য একে অন্যের থেকে অগ্রবর্তী হবার চেষ্টা করা এবং এগুলোর প্রাচুর্যের কারণে পরস্পরের মোকাবেলায় বড়াই করা এর অর্থের অন্তরভুক্ত হয়ে গেছে৷

অনুরূপভাবে ‘ আলহাকুম ‘ – এ যাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে তারাও সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি৷ বরং প্রত্যক যুগের লোকেরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও সামুগ্রিকভাবে এর সম্বোধনের আওতাভুক্ত হয়েছে৷ এর অর্থ দাঁড়ায় , বেশী বেশী বৈষয়িক স্বার্থ অর্জন করা , তার মধ্যে একে অন্যের অগ্রবর্তী হওয়া এবং অন্যের মোকাবেলায় তা নিয়ে গর্ব করার মোহ যেমন ব্যক্তিকে আচ্ছন্ন করে তেমনি আচ্ছন্ন করে গোত্র ও জাতিকেও৷ অনুরূপভাবে ‘ আলহাকুমুত তাকাসুর ‘ – এ যেহেতু একথা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি যে , প্রাচুর্য লোকদেরকে নিজের মধ্যে নিমগ্ন করে কোন জিনিস থেকে গাফেল করে দিয়েছে , তাই এর অর্থের মধ্যেও ব্যাপকতা সৃষ্টি হয়েছে৷ এর অর্থ হচ্ছে , এই প্রাচুর্যের মোহ লোকদেরকে এর চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেকটি জিনিস থেকে গাফেল করে দিয়েছে৷ তারা আল্লাহ থেকে গাফেল হয়ে গেছে৷ আখেরাত থেকে গাফেল হয়ে গেছে৷ নৈতিকতার সীমা ও নৈতিক দায়িত্ব থেকে গাফেল হয়ে গেছে৷ অধিকারীর অধিকার এবং তা আদায় করার ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে গাফেল হয়ে গেছে ৷ তারা নিজেদের জীবন যাপনের মান উন্নয়নের চিন্তায় ব্যাকুল ৷ মানবতার মান কত নেমে যাচ্ছে সে চিন্তা তাদেরকে একটুও ব্যতিব্যস্ত করে না৷ তাদের চাই বেশী বেশী অর্থ ৷ কোন পথে এ অর্থ অর্জিত হচ্ছে তার কোন পরোয়াই তাদের নেই৷ তারা বিলাস দ্রব্য ও ভোগের সামগ্রী বেশী বেশী চায়৷ এই প্রবৃত্তি পূজার লিপ্ত হয়ে তারা এহেন আচরণের পরিণাম থেকে সম্পূর্ণ গাফেল হয়ে গেছে৷ তারা বেশী বেশী শক্তি , সেনাবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের চিন্তায় মশগুল৷ এ প্রশ্নে তারা একে অপরের ডিঙ্গিয়ে যাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ তারা এ চিন্তা করছে না যে , এগুলো আল্লাহর দুনিয়াকে জুলুমে পরিপূর্ণ করার এবং মানবতাকে ধবংস ও বরবাদ করার সরঞ্জাম মাত্র ৷ মোটকথা , এভাবে অসংখ্য ধরনের ‘ তাকাসুর ‘ ব্যক্তি ও জাতিদেরকে তার মধ্যে এমনভাবে মশগুল করে রেখেছে যে , দুনিয়া এবং বৈষয়িক স্বার্থ ও ভোগের চাইতে বড় কোন জিনিসের কথা তারা মুহূর্তকালের জন্য চিন্তা করে না৷

এখানে كُمْ (তোমাদের) বলে অবিশ্বাসী, কপট বিশ্বাসী, অংশীবাদী এবং পাপাচারী লোকদের বুঝানো হয়েছে; ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের নয়। মন্দ লোকের সংখ্যা বেশী হওয়ার কারণেই এখানে সাধারণভাবে كُمْ বা ‘তোমাদের’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বস্ত্ততঃ পৃথিবীতে সর্বযুগেই মন্দ লোকের সংখ্যা বেশী ছিল এবং আছে। সেকারণ আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সাবধান করে বলেন,

وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُوْنَ

‘যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মান্য কর, তাহলে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। ওরা কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং অনুমানভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আমঃ১১৬)।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম! … তোমার সন্তানদের একটি দলকে জাহান্নামের দিকে বের করে নাও। আদম বলবেন, ঐদলটি কতজনের? আল্লাহ বলবেন, এক হাযারের মধ্যে ৯৯৯ জন’।বুখারী হা/৬৫৩০, মুসলিম হা/২২২; মিশকাত হা/৫৫৪১ ‘হাশর’ অনুচ্ছেদ

ভাল ও মন্দ লোকের সংখ্যায় কি বিশাল ব্যবধান! সম্ভবতঃ একারণেই আল্লাহ বলেছেন, قَلِيْلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُوْرُ ‘আমার কৃতজ্ঞ বান্দার সংখ্যা কম’ (সাবাঃ১৩)

 

আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

لَوْ أَنَّ لاِبْنِ آدَمَ وَادِيًا مِنْ ذَهَبٍ أَحَبَّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ وَادِيَانِ، وَلَنْ يَمْلأَ فَاهُ إِلاَّ التُّرَابُ، وَيَتُوْبُ اللهُ عَلَى مَنْ تَابَ–

‘যদি আদম সন্তানকে এক ময়দান ভর্তি স্বর্ণ দেওয়া হয়, তাহলে সে দুই ময়দান ভর্তি স্বর্ণের আকাংখা করবে। তার মুখ ভরবে না মাটি ব্যতীত (অর্থাৎ কবরে না যাওয়া পর্যন্ত)। আর আল্লাহ তওবাকারীর তওবা কবুল করে থাকেন।বুখারী হা/৬৪৩৯, মুসলিম হা/১০৪৮, মিশকাত হা/৫২৭৩।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, দু’জন পিপাসু ব্যক্তি রয়েছে, যারা কখনো তৃপ্ত হয় না। একজন হ’ল জ্ঞান পিপাসু, যার পিপাসা কখনো নিবৃত্ত হয় না। অন্যজন হ’ল দুনিয়া পিয়াসী, যার লোভ কখনো শেষ হয় না। ছহীহুল জামে‘ হা/৬৬২৪; মিশকাত হা/২৬০।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, জিব্রীল আমার হৃদয়ে এ কথাটি নিক্ষেপ করেছেন যে, কেউ মৃত্যুবরণ করে না যতক্ষণ না সে তার রিযিক পূর্ণ করে। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং বৈধভাবে রিযিক সন্ধান কর। কাংখিত রিযিক আসতে দেরী হওয়ায় তা যেন তোমাদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার মাধ্যমে উপার্জনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যে রিযিক রয়েছে, তা তাঁর আনুগত্য ব্যতীত লাভ করা যায় না (অর্থাৎ বৈধ রিযিকেই আল্লাহ বরকত দেন, অবৈধ রিযিকে নয়)।শারহুস সুন্নাহ, বায়হাক্বী-শো‘আবুল ঈমান, মিশকাত হা/৫৩০০; ছহীহাহ হা/২৮৬৬।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তুমি আল্লাহভীরু হও, তাহ’লে তুমি হবে শ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী। তুমি অল্পে তুষ্ট হও, তাহ’লে তুমি হবে শ্রেষ্ঠ কৃতজ্ঞ ব্যক্তি। তুমি অন্যের জন্য সেটাই ভালবাসো, যেটা তুমি নিজের জন্য ভালবাসো, তাহ’লে তুমি হবে প্রকৃত মুমিন। ইবনু মাজাহ হা/৪২১৭, হাদীছ ছহীহ।

জান্নাত লাভে উৎসাহিত করে আল্লাহ বলেন,

وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ ‘অতএব প্রতিযোগীরা এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করুক (মুত্বাফফেফীনঃ২৬)।

 

(২) حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ

‘যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’।

এখানে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না তোমরা করবস্থান যেয়ারত কর। এখানে যেয়ারত করার অর্থ মরে গিয়ে কবরে পৌছানো।

এখানে زُرْتُمُ ‘তোমরা যিয়ারত কর’ বলা হয়েছে। আর যিয়ারতকারী অবশ্যই তার মূল ঠিকানায় ফিরে আসে। আর মানুষের মূল ঠিকানা হ’ল যেখান থেকে মায়ের গর্ভে তার রূহ এসেছিল। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে সে ফিরে যাবে।

যেমন তিনি বলেন,

إِلَى اللهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيْعًا فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ فِيْهِ تَخْتَلِفُوْنَ

‘আল্লাহর নিকটেই তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর তিনি তোমাদের জানিয়ে দিবেন যেসব বিষয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে’ (মায়েদাহ ৫/৪৮, ১০৫; হূদ ১১/৪)।

مَقَابِر একবচনে مَقْبرةً অর্থ কবরস্থান। القُبُوْر একবচনে القَبْر ‘কবর’।

জানা আবশ্যক যে, দুনিয়াবী জীবনের সমাপ্তি হিসাবে এখানে কবরের কথা বলা হয়েছে। নইলে কবর মানুষের জন্য চূড়ান্ত ঠিকানা নয়। বরং এটি জীবনের সফরসূচীর তৃতীয় পর্যায় বা দারুল বারযাখ। অর্থাৎ পর্দার অন্তরালের যাত্রী বিশ্রামাগার বা Waiting room মাত্র।

আল্লাহ বলেন

,وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُوْنَ

‘আর তাদের সম্মুখে পর্দা থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। অর্থাৎ এটি দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী অবস্থান এবং কবর হ’ল আখেরাতের প্রথম মনযিল। এর পরবর্তী চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী ঠিকানা বা দারুল ক্বারার হ’ল জান্নাত অথবা জাহান্নাম।

কাতাদাহ বলেন, তারা বলত, আমরা অমুক বংশের লোক, আমরা অমুক গোত্রের চেয়ে বেশী, আমাদের সংখ্যা অনেক। এভাবে বলতেই থাকল। অথচ তারা কমতে কমতে সবাই কবরবাসী হয়ে গেল। অতএব, আয়াতের মর্মার্থ এই যে, বলা হয়েছে, যারা ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির ভালবাসা অথবা অপরের সাথে বড়াই করায় এমন মত্ত হয়ে পড়ে যে, পরিণাম চিন্তা করার ফুরসন্তই পায় না। [ইবন কাসীর]

এখানে যেয়ারত শব্দটি থেকে আরও বুঝা যায়, কবরেও কেউ চিরকাল থাকবে না, এই দুনিয়া-কবর সবই ক্ষণস্থায়ী; এগুলো যেয়ারত শেষ হলে জান্নাত বা জাহান্নাম চিরস্থায়ী বাসভূমিতে যেতে হবে। [কুরতুবী]

হযরত ওছমান গণী (রাঃ) যখন কোন কবরের পাশে দাঁড়াতেন, তখন কান্নায় তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। তাঁকে বলা হল, জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা আসলে আপনি কাঁদেন না। অথচ এখানে আপনি কাঁদছেন? জবাবে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

إِنَّ الْقَبْرَ أَوَّلُ مَنَازِلِ الآخِرَةِ فَإِنْ نَجَا مِنْهُ فَمَا بَعْدَهُ أَيْسَرُ مِنْهُ وَإِنْ لَمْ يَنْجُ مِنْهُ فَمَا بَعْدَهُ أَشَدُّ مِنْهُ، وَقَالَ : مَا رَأَيْتُ مَنْظَرًا قَطُّ إِلاَّ وَالْقَبْرُ أَفْظَعُ مِنْهُ-ُ

 

‘নিশ্চয়ই কবর হ’ল আখেরাতের মনযিল সমূহের প্রথম মনযিল। যে ব্যক্তি এখানে মুক্তি পাবে, তার জন্য পরবর্তী মনযিলগুলি সহজ হয়ে যাবে। আর যদি সে এখানে মুক্তি না পায়, তাহলে পরবর্তীগুলি কঠিন হবে। তিনি বলেন, কবরের চাইতে ভয়ংকর কোন দৃশ্য আমি দেখিনি’। তিরমিযী হা/২৩০৮, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৩২।

ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার দেহের একাংশ ধরে বললেন, كُنْ فِى الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ- ‘পৃথিবীতে তুমি আগন্তুক অথবা পথযাত্রীর মত বসবাস কর’।বুখারী হা/৬৪১৬।

وَعُدَّ نَفْسَكَ فِى أَهْلِ الْقُبُورِ ‘এবং নিজকে সর্বদা কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য কর। তিরমিযী হা/২৩৩৩, ইবনু মাজাহ হা/৪১১৪; মিশকাত হা৫২৭৪।

আবদুল্লাহ ইবনে শিখখীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট পৌছে দেখলাম তিনি (أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ) তেলাওয়াত করে বলছিলেন, “মানুষ বলে, আমার ধন! আমার ধন! অথচ তোমার অংশ তো ততটুকুই যতটুকু তুমি খেয়ে শেষ করে ফেল, অথবা পরিধান করে ছিন্ন করে দাও, অথবা সদকা করে সম্মুখে পাঠিয়ে দাও। এছাড়া যা আছে, তা তোমার হাত থেকে চলে যাবে- তুমি অপরের জন্যে তা ছেড়ে যাবে।” [মুসলিম: ২৯৫৮, তিরমিযী: ২৩৪২, মুসনাদে আহমদ: ৪/২৪]

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আদম সন্তানের যদি স্বৰ্ণে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকা থাকে, তবে সে (তাতেই সন্তুষ্ট হবে না; বরং) দুটি উপত্যকা কামনা করবে। তার মুখ তো (কবরের) মাটি ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা ভর্তি করা সম্ভব নয়। যে আল্লাহর দিকে রুজু করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন।” [বুখারী: ৬৪৩৯, ৬৪৪০] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমি তোমাদের জন্য দারিদ্রতার ভয় করছি না বরং তোমাদের জন্য প্রাচুর্যের ভয় করছি। অনুরূপভাবে আমি তোমাদের জন্যে ভুল-ভ্ৰান্তি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভয় করছি না, বরং ভয় করছি ইচ্ছাকৃত অন্যায়ের।” [মুসনাদে আহমাদঃ ২/৩০৮] তাফসীরে জাকারিয়া

(৩) كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ ‘কখনই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে’।

অর্থাৎ তোমরা ভুল ধারণার শিকার হয়েছো৷ বৈষয়িক সম্পদের এ প্রাচুর্য এবং এর মধ্যে পরস্পর থেকে অগ্রবর্তী হয়ে যাওয়াকেই তোমরা উন্নতি ও সাফল্য মনে করে নিয়েছো৷ অথচ এটা মোটেই উন্নতি ও সাফল্য নয় ৷ শীঘ্রই তোমরা এর অশুভ পরিণতি জানতে পারবে৷ সারাটা জীবন যে ভুলের মধ্যে তোমরা লিপ্ত ছিলে সেটা যে কত বড় ভুল ছিল তা তোমরা শীঘ্রই জানতে পাবে৷ শীঘ্রই অর্থ আখেরাতে ও হতে পারে৷ কারণ আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সমগ্রকাল ব্যাপী যে সত্তার দৃষ্টে প্রসারিত তাঁর কাছে কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ বছর ও কালের সামান্য একটি অংশ মাত্র৷ কিন্তু এর অর্থ মৃত্যুও হতে পারে৷ কারণ কোন মানুষ থেকে তার অবস্থান বেশী দূরে নয়৷ আর মানুষ তার সারা জীবন যে সব কাজের মধ্যে কাটিয়ে এসেছে সে মরে যাবার সাথে সাথেই সেগুলো তার জন্য সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ও অশুভ পরিণামের বাহন ছিল কিনা তা তার কাছে একেবারে সুষ্পষ্ট হয়ে যাবে৷

(৪) ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ ‘অতঃপর কখনই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে’।

كَلاَّ পরপর দু’বার আনা হয়েছে শ্রোতাকে ধমক দেওয়ার জন্য ও সতর্ক করার জন্য। এটি كلمة ردع বা প্রত্যাখ্যানকারী শব্দ। এর মাধ্যমে বান্দার লোভের আধিক্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এর দ্বারা বলতে চাওয়া হয়েছে যে, প্রাচুর্যের লোভ করো না। পরিণামে তোমরা লজ্জিত হবে। যা তোমরা সত্বর জানতে পারবে। হাসান বাছরী বলেন, هذا وعيد بعد وعيد ‘এটি ধমকের পরে ধমক’ (ইবনু কাছীর)।

দু’বার আনার অর্থ এটাও হ’তে পারে যে, প্রথমটি দ্বারা কবর এবং দ্বিতীয়টি দ্বারা আখেরাত বুঝানো হয়েছে।

অথবা প্রথমটিতে বলা হয়েছে, তোমরা সত্বর জানতে পারবে যখন মৃত্যু এসে যাবে ও তোমাদের রূহ তোমাদের দেহ থেকে টেনে বের করা হবে।

দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, পুনরায় তোমরা জানতে পারবে যখন তোমরা কবরে প্রবেশ করবে এবং মুনকার-নাকীর তোমাদের প্রশ্ন করবে’।

অথবা প্রথমটি দ্বারা ক্বিয়ামত এবং শেষেরটি দ্বারা হাশর অর্থাৎ বিচার দিবস বুঝানো হয়েছে (কুরতুবী)।

(৫) كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُوْنَ عِلْمَ الْيَقِيْنِ ‘কখনই না। যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে

তৃতীয়বার كَلاَّ এনে বান্দাকে কঠোর হুঁশিয়ারী দিয়ে বলা হয়েছে, যদি তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে! কেননা ক্বিয়ামত ও আখেরাতের উপরে বিশ্বাস দৃঢ় থাকলে তোমরা কখনোই অধিক অর্থ-বিত্ত ও প্রাচুর্যের পিছনে ছুটতে না। এখানে لَوْ (যদি) এর জবাব উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ যদি তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে আজকে নিশ্চিত জানতে যা পরে জানবে, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা আল্লাহ ও আখেরাত থেকে গাফেল হতে না।

ইবনু আবী হাতেম বলেন, তিনটি স্থানেই كَلاَّ অর্থ أَلاَ অর্থাৎ ‘সাবধান’। ফার্রা বলেন, বরং كَلاَّ অর্থ হবে حقًّا ‘অবশ্যই’। অর্থাৎ অবশ্যই তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে সত্বর জানতে পারবে (কুরতুবী)।

অত্র আয়াতের শেষে পাঠক অবশ্যই থামবেন এবং ওয়াক্ফ করবেন। পরবর্তী আয়াতের সঙ্গে মিলানো যাবে না। কেননা তাতে অর্থ হবে, ‘যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে, তাহলে অবশ্যই জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করতে’। যা মূল অর্থকে বিনষ্ট করে দেয়। কেননা জাহান্নাম দেখার বিষয়টি হ’ল মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পরের বিষয়।

দুনিয়ার সাথে আখেরাতের তুলনা :

(১) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একদিন চলার পথে একটি মৃত বকরীর বাচ্চা দেখিয়ে বলেন, এক দিরহামের বিনিময়েও কি তোমরা এটিকে খরিদ করবে? আমরা বললাম, না। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এটি তোমাদের কাছে যত নিকৃষ্ট, আল্লাহর নিকটে দুনিয়া তার চাইতেও অধিক নিকৃষ্ট।মুসলিম হা/২৯৫৭, মিশকাত হা/৫১৫৭ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়

পক্ষান্তরে জান্নাত সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আল্লাহ বলেন,

أَعْدَدْتُ لِعِبَادِى الصَّالِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنَ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنَ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ، فَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ (فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِىَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ)

‘আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমনসব চক্ষু শীতলকারী বস্ত্ত প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কান কখনো শোনেনি, হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি। অতঃপর তিনি সূরা সাজদাহ ১৭ আয়াতটি পাঠ করেন যার অর্থ ‘কেউ জানেনা তার জন্য চক্ষুশীতলকারী কি বস্ত্ত লুক্কায়িত রয়েছে তাদের পুরস্কার স্বরূপ’। মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬১২।

তিনি বলেন, مَوْضِعُ سَوْطٍ فِى الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا ‘জান্নাতের একটি চাবুক রাখার স্থান দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছুর চাইতে উত্তম’।মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬১৩।

 

(২) মুত্বাররিফ স্বীয় পিতা আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে,

 

أَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَقْرَأُ (أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ) قَالَ : يَقُوْلُ ابْنُ آدَمَ مَالِىْ مَالِىْ، قَالَ وَهَلْ لَكَ يَا ابْنَ آدَمَ مِنْ مَالِكَ إِلاَّ مَا أَكَلْتَ فَأَفْنَيْتَ أَوْ لَبِسْتَ فَأَبْلَيْتَ أَوْ تَصَدَّقْتَ فَأَمْضَيْتَ ؟

 

‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এলাম। সে সময় তিনি সূরা তাকাছুর পাঠ করছিলেন। অতঃপর তিনি বলেন, বনু আদম বলে আমার মাল, আমার মাল। অথচ হে আদম সন্তান! তোমার মাল কি কেবল অতটুকু নয়, যতটুকু তুমি ভক্ষণ করলে ও শেষ করলে। অথবা পরিধান করলে ও জীর্ণ করলে, অথবা ছাদাক্বা করলে ও তা সঞ্চয় করলে’?মুসলিম হা/২৯৫৮, মিশকাত হা/৫১৬৯ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।

(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

يَقُوْلُ الْعَبْدُ مَالِىْ مَالِىْ، إِنَّمَا لَهُ مِنْ مَالِهِ ثَلاَثٌ : مَا أَكَلَ فَأَفْنَى أَوْ لَبِسَ فَأَبْلَى أَوْ أَعْطَى فَاقْتَنَى، وَمَا سِوَى ذَلِكَ فَهُوَ ذَاهِبٌ وَتَارِكُهُ لِلنَّاسِ–

‘বান্দা বলে আমার মাল, আমার মাল! অথচ তার মাল হ’ল মাত্র তিনটি : (১) যা সে খায় ও শেষ করে। (২) যা সে পরিধান করে ও জীর্ণ করে এবং (৩) যা সে ছাদাক্বা করে ও সঞ্চয় করে। এগুলি ব্যতীত বাকী সবই চলে যাবে এবং অন্যদের জন্য সে ছেড়ে যাবে। মুসলিম হা/২৯৫৯, মিশকাত হা/৫১৬৬ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।

 

(৪) আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, يَتْبَعُ الْمَيِّتَ ثَلاَثَةٌ ، فَيَرْجِعُ اثْنَانِ وَيَبْقَى مَعَهُ وَاحِدٌ ، يَتْبَعُهُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ ، فَيَرْجِعُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ ، وَيَبْقَى عَمَلُهُ-

‘মাইয়েতের সাথে তিনজন যায়। তার মধ্যে দু’জন ফিরে আসে ও একজন তার সাথে থেকে যায়। মাইয়েতের সঙ্গে যায় তার পরিবার, তার মাল ও তার আমল। অতঃপর তার পরিবার ও মাল ফিরে আসে এবং আমল তার সাথে থেকে যায়। বুখারী হা/৬৫১৪, মুসলিম হা/২৯৬০, মিশকাত হা/৫১৬৭।

 

(৫) হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য একটি হাদীছে রাসূলুল্লাহ (সা) এরশাদ করেন,

يَهْرَمُ ابْنُ آدَمَ وَتَشِبُّ مِنْهُ اثْنَتَانِ الْحِرْصُ عَلَى الْمَالِ وَالْحِرْصُ عَلَى الْعُمُرِ- ‘আদম সন্তান বার্ধক্যে জীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু দু’টি বস্ত্ত বৃদ্ধি পায়। সম্পদের লোভ ও অধিক বয়স পাওয়ার আকাংখা’। বুখারী, মুসলিম হা/১০৪৭, মিশকাত হা/৫২৭০।

(৬) لَتَرَوُنَّ الْجَحِيْمَ ‘তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করবে’।

 

এটি পূর্ববর্তী আয়াতের لَوْ (যদি)-এর জবাব নয়। বরং এটি সম্পূর্ণ পৃথক ও শপথসূচক বাক্য। শুরুতে وَاللهِ (আল্লাহর কসম) উহ্য রয়েছে। لَتَرَوُنَّ الْجَحِيْمَ হ’ল উক্ত শপথের জওয়াব। এর সাথে পূর্বের আয়াতের কোন সম্পর্ক নেই।

 

(৭) ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِيْنِ ‘অতঃপর তোমরা অবশ্যই তা দিব্য-প্রত্যয়ে দেখবে’।

 

এটি পূর্ববর্তী আয়াতের তাকীদ হয়েছে এবং لَتَرَوُنَّه – لام ةاكيد بانون ةاكيد ثقيلة আনা হয়েছে। যার অর্থ, ‘অবশ্য অবশ্যই তোমরা দেখবে’। যেদিন জাহান্নামকে ৭০ হাযার লাগামে বেঁধে টেনে আনা হবে। প্রত্যেক লাগামে ৭০ হাযার ফেরেশতা থাকবে। মুসলিম হা/২৮৪২, মিশকাত হা/৫৬৬৬।

আর প্রত্যেক ফেরেশতা হবে ‘নির্মম ও কঠোর’ (তাহরীম ৬৬/৬)। কত বিশাল ও ভয়ংকর সেই জাহান্নাম! আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন -আমীন!

 

এটিতে প্রচ্ছন্নভাবে আরেকবার ধমক দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে শপথ লুকিয়ে রয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তোমরা অবশ্যই জা ‎হান্নামকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করবে। তখন তোমাদের মধ্যে দিব্য-প্রত্যয় জন্মাবে।

 

এখানে ‘তোমরা’ বলে কাফেরদের বুঝানো হ’তে পারে। কেননা তাদের জন্যে জাহান্নাম অবধারিত। অথবা সাধারণভাবে সকল বনু আদমকে বুঝানো হ’তে পারে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِنْ مِّنكُمْ إِلاَّ وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْماً مَّقْضِيًّا ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তথায় (জাহান্নামে) পৌঁছবে না। এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য ফায়ছালা’ (মারিয়াম ১৯/৭১)।

এখানে পৌঁছানোর অর্থ প্রবেশ করা নয়, বরং অতিক্রম করা। একে ‘পুলছিরাত’ বলা হয়। ছহীহ হাদীছে এসেছে যে, মুমিনগণ পুলছিরাত পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে বিদ্যুতের বেগে, জাহান্নামের কোন উত্তাপ তারা অনুভব করবে না। কিন্তু কাফের-ফাসেকগণ আটকে যাবে ও জাহান্নামে পতিত হবে…। বুখারী, মুসলিম হা/১৮৩; মিশকাত হা/৫৫৭৯।

যেমন পরের আয়াতেই আল্লাহ বলেন, ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّنَذَرُ الظَّالِمِيْنَ فِيْهَا جِثِيًّا ‘অতঃপর আমরা আল্লাহভীরুদের উদ্ধার করব এবং যালেমদেরকে জাহান্নামের মধ্যে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব’ (মারিয়াম ১৯/৭২)।

অতএব মুমিন-কাফির সবাই জাহান্নামকে প্রত্যক্ষ করবে। মুমিনগণ সহজে পার হয়ে যাবে। কিন্তু কাফের-ফাসেকগণ জাহান্নামে পতিত হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সেদিনের কঠিন পাকড়াও থেকে রক্ষা করুন- আমীন!

 

এখানে عَيْنَ الْيَقِيْنِ বা ‘দিব্য-প্রত্যয়ে’ বলার কারণ এই যে, মানুষ চোখে দেখাটাকে অধিক গুরুত্ব দেয় কানে শোনার চাইতে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, لَيْسَ الْخَبَرُ كَالْمُعَايَنَةِ ‘শোনা খবর কখনো চোখে দেখার সমান নয়’।আহমাদ হা/২৪৪৭; মিশকাত হা/৫৭৩৮, সনদ ছহীহ।

الْعَيْنُ অর্থ النَّفْسُ। ফলে দেখাটাকেই ইয়াক্বীন গণ্য করা হয়েছে’ (ক্বাসেমী)।

 

দুনিয়াতে ঈমানদারগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথায় বিশ্বাসী হয়ে মনের চোখ দিয়ে সেটা দেখতে পারে এবং আখেরাতে মানুষ সেটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে। কিন্তু তখনকার দিব্য-প্রত্যয়ে কোন কাজ হবে না ।

এদেরকে বলে দাও, “ যারা কুফরী করেছে ফায়সালার দিন ঈমান আনা তাদের জন্য মোটেই লাভজনক হবে না এবং এরপর এদের কোন অবকাশ দেয়া হবে না” (সাজদাহঃ২৯)।

দুনিয়াতে বিশ্বাস করলে ও সেই অনুযায়ী সাবধান হয়ে নেক আমল করলে আখেরাতে কাজে লাগবে (মুল্ক ৬৭/২; যিলযাল ৯৯/৭-৮)।

ফলে সেদিন জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করলেও আল্লাহর হুকুমে সেখানে সে পতিত হবে না। বরং সহজে পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে। দুঃখ হয় মানুষের জন্য যে, সে নিজে না দেখেও অন্যের কথা শুনে নিজের মৃত মাতা-পিতা ও দাদা-দাদীর উপরে ঈমান এনে থাকে। অথচ সে নবী-রাসূলের কথা শুনে আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান আনতে পারে না। আল্লাহ আমাদের অন্তরকে নরম করে দিন এবং তাকে ঈমানের আলোকে আলোকিত করুন- আমীন!

(৮) ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيْمِ ‘অতঃপর তোমরা অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে দেওয়া নে‘মতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।

 

এখানেও পূর্বের আয়াতের ন্যায় ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা বাচক ক্রিয়া لام ةاكيد بانون ةاكيد ثقيلة আনা হয়েছে। যার অর্থ, অবশ্য অবশ্যই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’।

 

আবু নছর আল-কুশায়রী বলেন, প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। তবে কাফেরদের প্রশ্ন করা হবে ধমক ও ধিক্কার হিসাবে ( (تَقْرِيْعًا وَتَوْبِيْخًا। কেননা তারা এগুলোর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করত না।

আর মুমিনকে প্রশ্ন করা হবে তাকে স্মরণ করানোর উদ্দেশ্যে ও তার মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে (تذكيرًا وَتشريفًا)। কেননা সে সর্বদা এসব নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করত’ (কুরতুবী)। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ যখন তাকে উক্ত কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন, তখন সে খুশী হবে ও গর্বিত বোধ করবে। সকলের নিকট তখন তার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। পক্ষান্তরে কাফের-মুনাফিকরা লজ্জিত ও ধিকৃত হবে।

 

মানুষের জ্ঞান-সম্পদ, তার চিন্তাশক্তি ও বাকশক্তি হ’ল সর্বাধিক মূল্যবান নে‘মত। সর্বোপরি মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত কিতাব ও নবী-রাসূলগণ মানব জাতির জন্য আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ।

 

দৃশ্যমান ও অদৃশ্য হাযারো নে‘মতের মধ্যে আল্লাহ মানুষের লালন-পালন করে থাকেন। অকৃতজ্ঞ সন্তান যেমন পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় করে না, অকৃতজ্ঞ মানুষ তেমনি তার পালনকর্তা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে না।

আল্লাহ বলেন, أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَّا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَّبَاطِنَةً- ‘

তোমরা কি দেখ না, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবকিছুকে আল্লাহ তোমাদের সেবায় অনুগত করে দিয়েছেন? এবং তোমাদের উপরে তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নে‘মতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন?…’ (লোকমান ৩১/২০)।

তিনি বলেন, وَلَوْ أَنَّ مَا فِي الْأَرْضِ مِنْ شَجَرَةٍ أَقْلاَمٌ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِنْ بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللهِ إِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ-

‘পৃথিবীতে যত বৃক্ষ আছে, সবই যদি কলম হয় এবং একটি সমুদ্রের সাথে সাতটি সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয়, তবুও তাঁর নে‘মতসমূহ (كلمات) লিখে শেষ করা যাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (লোকমান ৩১/২৭)।

আল্লাহ মানুষকে যে নিয়ামতগুলো দান করেছেন সেগুলো সীমা সংখ্যাহীন। সেগুলো গণনা করা সম্ভব নয়। বরং এমন অনেক নিয়ামতও আছে যেগুলোর মানুষ কোন খবরই রাখে না।

কুরআন মজীদে বলা হয়েছে, “যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতগুলো গণনা করতে থাকো তাহলে সেগুলো পুরোপুরি গণনা করতেও পারবে না।” [সূরা ইবরাহীম: ৩৪]

প্রধান নেয়ামত সমূহ :

নিম্নে আমরা মানুষের প্রধান প্রধান নে‘মত সমূহ, যা পবিত্র কুরআনে ও ছহীহ হাদীছ সমূহে উল্লেখিত হয়েছে, তার মধ্য থেকে কয়েকটির কথা উল্লেখ করব।-

(১) চক্ষু, কর্ণ ও হৃদয় :

আল্লাহ বলেন,

وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُوْلاً-

‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না।নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনু ইসরাঈলঃ৩৬)।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) النَّعِيْمِ -এর ব্যাখ্যায় বলেন,هو صحة الأبدان والأسماع والأبصار এটা হ’ল দেহ, কর্ণ ও চক্ষুর সুস্থতা। কেননা এগুলি কোন কোন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়ে আল্লাহ বান্দাকে পৃথক পৃথকভাবে প্রশ্ন করবেন। যদিও আল্লাহ এ বিষয়ে সম্যক অবহিত’ (ইবনু কাছীর)। অতএব এইসব অমূল্য নে‘মতের অপব্যবহার যাতে না হয়, সে বিষয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে।

(২) স্বাস্থ্য ও সচ্ছলতা :

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) এরশাদ করেন, نِعْمَتَانِ مَغْبُوْنٌ فِيْهِمَا كَثِيْرٌ مِّنَ النَّاسِ، الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ ‘দু’টি নে‘মত রয়েছে, যে দু’টিতে বহু মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়েছে- স্বাস্থ্য এবং সচ্ছলতা।বুখারী হা/৬৪১২, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, আহমাদ; মিশকাত হা/৫১৫৫।

অর্থাৎ যখন সে সুস্থ ও সচ্ছল থাকে, তখন এ দু’টি নে‘মতকে সে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে ব্যয় করে না। বরং অলসতা করে এবং এখন নয়, পরে করব বলে শয়তানী ধোঁকায় পতিত হয়। ফলে যখন সে অসুস্থ হয় বা অসচ্ছল হয় কিংবা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আর ঐ নেকীর কাজটি করার সুযোগ থাকে না। রাসূলুল্লাহ (সা) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিয়ে বলেন,

 

اِغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍشَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ-

‘তুমি পাঁচটি বস্ত্তর পূর্বে পাঁচটি বস্ত্তকে গণীমত (সম্পদ) মনে কর : (১) বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে (২) পীড়িত হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে (৩) দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে তোমার জীবনকে’। তিরমিযী; ছহীহুল জামে‘ হা/১০৭৭; ছহীহাহ হা/১১৫৭; মিশকাত হা/৫১৭৪।

ইবনুল জাওযী বলেন,

مَنِ اسْتَعْمَلَ فَرَاغَهُ وَصِحَّتَهُ فِي طَاعَةِ اللهِ فَهُوَ الْمَغْبُوطُ وَمَنِ اسْتَعْمَلَهُمَا فِي مَعْصِيَةِ اللهِ فَهُوَ الْمَغْبُونُ- ‘যে ব্যক্তি তার সচ্ছলতা ও সুস্থতাকে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে লাগায়, সে ব্যক্তি হ’ল ‘মাগবূত্ব’ বা ঈর্ষণীয়। আর যে ব্যক্তি ঐ দু’টি বস্ত্তকে আল্লাহর অবাধ্যতার কাজে লাগায়, সে হ’ল ‘মাগবূন’ বা ধোঁকায় পতিত’। ফাৎহুল বারী হা/৬৪১৪-এর ব্যাখ্যা।

অত্র হাদীছে সুস্বাস্থ্য ও আর্থিক সচ্ছলতাকে আল্লাহর বিশেষ নে‘মত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।

(৩) সম্পদ, সন্তান ও নেতৃত্ব :

আবু হুরায়ারা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন

,يُؤْتَى بِالْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيَقُوْلُ اللهُ لَهُ أَلَمْ أَجْعَلْ لَكَ سَمْعًا وَبَصَرًا وَمَالاً وَوَلَدًا… وَتَرَكْتُكَ تَرْأَسُ وَتَرْبَعُ..-

‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে হাযির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলবেন, আমি কি তোমাকে কান, চোখ, সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেইনি?… আমি কি তোমাকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ও গণীমতের মাল নেওয়ার জন্য ছেড়ে দেইনি?’তিরমিযী হা/২৪২৮ সনদ ছহীহ; কুরতুবী হা/৬৪৬৩।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন প্রথম যে নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে তা হচ্ছে, আমি কি তোমাকে শারীরিকভাবে সুস্থ করিনি? আমি কি তোমাকে সুপেয় পানি পান করাইনি?” [তিরমিযী: ৩৩৫৮]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন বলবেন, আদম সন্তান! তোমাকে ঘোড়া ও উটে বহন করিয়েছি, তোমাকে স্ত্রীর ব্যবস্থা করে দিয়েছি, তোমাকে ঘুরাফিরা ও নেতৃত্ব করার সুযোগ দিয়েছি, এগুলোর কৃতজ্ঞতা কোথায়?” [মুসলিম: ২৯৬৮, মুসনাদে আহমাদ: ২/৪৯২]

অত্র হাদীছে কান ও চোখ ছাড়াও ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও নেতৃত্বকে অন্যতম প্রধান নে‘মত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যে বিষয়ে তাকে ক্বিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে।

(৪) আত্মীয়-পরিজন, ব্যবসা ও বাড়ী-ঘর :

পবিত্র কুরআনে আরও কয়েকটি বস্ত্তকে মানুষের প্রিয়বস্ত্ত হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে, যেগুলি নিঃসন্দেহে আল্লাহর দেওয়া অত্যন্ত মূল্যবান নে‘মত। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَآؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيْرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيْلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ وَاللهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ-

 

‘বল তোমাদের নিকটে যদি তোমাদের পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্ত্রী-পরিবার ও গোত্র-পরিজন, তোমাদের মাল-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করে থাক, তোমাদের ব্যবসা-বানিজ্য যা তোমরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা করে থাক এবং বাড়ী-ঘর যা তোমরা পসন্দ করে থাক, যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চাইতে এবং তাঁর পথে জিহাদের চাইতে তোমাদের নিকটে অধিক প্রিয় হয়, তাহ’লে তোমরা প্রতীক্ষায় থাক, যে পর্যন্ত না আল্লাহ স্বীয় নির্দেশসহ আগমন করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না’ (তওবা ৯/২৪)।

উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত প্রতিটি নে‘মতের বিষয়ে বান্দাকে জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে।

(৫) সদাসঙ্গী পুত্রগণ :

এই সঙ্গে আরেকটি নে‘মতের কথা বলা হয়েছে।

وَبَنِينَ شُهُودًا ‘সদাসঙ্গী পুত্রগণ’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১৩)। অনেকের একাধিক পুত্র সন্তান আছে। কিন্তু কেউ পিতামাতার কাছে থাকেনা। এটা যথার্থ নে‘মত নয়। যে সন্তান সর্বদা পিতামাতার সুখ-দুঃখের সাথী থাকে, সেই-ই হ’ল প্রকৃত নে‘মত।

(৬) পুণ্যশীলা স্ত্রী :

আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

إِنَّ الدُّنْيَا كُلَّهَا مَتَاعٌ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ- ‘নিশ্চয় সমগ্র দুনিয়াটাই সম্পদ। আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হ’ল পুণ্যবতী স্ত্রী। মুসলিম হা/১৪৬৭; মিশকাত হা/৩০৮৩ ‘বিবাহ’

এই শ্রেষ্ঠ নে‘মত কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করা হবে। তেমনি স্ত্রীকেও তার সংসারের গুরু দায়িত্ব পালন সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে। বুখারী হা/৮৯৩, মুসলিম হা/১৮২৯; মিশকাত হা/৩৬৮৫।

(৭) ক্ষুধায় অন্ন :

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,

একদা দিনে বা রাত্রিতে আল্লাহর রাসূল (সা) ঘর থেকে বের হলেন। রাস্তায় তিনি আবুবকর ও ওমরকে পেলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ বস্ত্ত এই সময় তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে এনেছে? তারা উভয়ে বললেন, ক্ষুধা, হে আল্লাহর রাসূল! জবাবে রাসূল (সা) বললেন, যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমাকেও বের করেছে ঐ বস্ত্ত, যা তোমাদেরকে বের করে এনেছে। অতঃপর বললেন, ওঠো! তারা উঠলেন ও তাঁর সাথে জনৈক আনছারীর বাড়ীতে গেলেন। কিন্তু তখন বাড়ীতে কেউ ছিল না। এমতাবস্থায় বাড়ীওয়ালার স্ত্রী তাঁদের স্বাগত জানালো। রাসূল (সা) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক কোথায়? স্ত্রী বলল, উনি আমাদের জন্য সুপেয় পানি আনতে গিয়েছেন। এমন সময় আনছার ব্যক্তি এসে গেলেন। তিনি রাসূল (সা) ও তাঁর দুই সাথীকে দেখে আনন্দে বলে উঠলেন,

الْحَمْدُ ِللهِ، مَا أَحَدٌ الْيَوْمَ أَكْرَمَ أَضْيَافًا مِنِّى ‘আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা! আজকের দিনে সর্বাধিক সম্মানিত মেহমান কারো নেই আমার ব্যতীত’। অতঃপর তিনি গাছে উঠে টাটকা খেজুরের কাঁদি কেটে আনলেন এবং আধা-পাকা, শুকনা ও পাকা খেজুর পরিবেশন করতে লাগলেন। অতঃপর ছুরি নিয়ে ছাগল যবেহ করতে গেলেন। তখন রাসূল (সা) তাকে বললেন, খবরদার দুগ্ধবতী বকরী যবেহ করো না। অতঃপর ছাগল যবেহ করা হ’ল এবং তিনজনে মিলে রান্না করা গোশত খেলেন। খেজুর খেলেন ও পানি পান করলেন।

খানাপিনা শেষে পরিতৃপ্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আজকের এই নেমত সম্পর্কে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে। ক্ষুধা তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে এনেছিল। অতঃপর তোমরা ফিরে যাওনি এই নে‘মত না পাওয়া পর্যন্ত’। মুসলিম হা/২০৩৮ ‘পানীয় সমূহ’ অধ্যায়, ২০ অনুচ্ছেদ; তিরমিযী হা/২৩৬৯;

উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, ক্ষুৎ-পিপাসায় অন্নদান আল্লাহর এক অমূল্য নে‘মত। এজন্য আল্লাহর রাসূল (সা) পাখি থেকে উপদেশ হাছিল করতে বলেছেন। যেমন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন,

 

سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: لَوْ أَنَّكُمْ تَوَكَّلْتُمْ عَلَى اللهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرَزَقَكُمْ كَمَا يَرْزُقُ الطَّيْرَ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوْحُ بِطَانًا-

 

‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি যে, যদি তোমরা আল্লাহর উপর যথার্থভাবে ভরসা করতে পার, তাহ’লে অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে রিযিক দান করবেন, যেভাবে তিনি পাখিকে রিযিক দিয়ে থাকেন। তারা সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয় ও সন্ধ্যায় পেট ভরে ফিরে আসে। তিরমিযী হা/২৩৪৪, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫২৯৯, ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ‘তাওয়াক্কুল’ অনুচ্ছেদ, সনদ ছহীহ।

(৮) জীবন একটি নে‘মত :

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন,

 

لاَ تَزُوْلُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ : عَنْ عُمْرِهِ فِيْمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيْمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيْمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ-

 

‘ক্বিয়ামতের দিন আদম সন্তান তার প্রভুর নিকট থেকে পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পা বাড়াতে পারবে না।

১- তার জীবন সম্পর্কে, কিসে তা শেষ করেছিল।

২- তার যৌবন সম্পর্কে, কিসে তা জীর্ণ করেছিল।

৩- তার মাল সম্পর্কে, কোন পথে তা অর্জন করেছিল এবং

৪- কোন পথে তা ব্যয় করেছিল।

৫- তার ইল্ম সম্পর্কে, তদনুযায়ী সে আমল করেছিল কি-না।

তিরমিযী হা/২৪১৬, মিশকাত হা/৫১৯৭ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়; ছহীহাহ হা/৯৪৬।

 

অত্র হাদীছটি মানুষের পুরা জীবনকেই নে‘মত গণ্য করে। বিশেষ করে দ্বীনী ইল্মের নে‘মত। কেননা বাকী চারটা সবার থাকলেও ইল্ম সবার থাকে না। অধিকন্তু ইল্ম অনুযায়ী আমলকারী আলেমের সংখ্যা খুবই কম।

(৯) সকল নবী ও শেষনবী :

আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولاً أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ ‘আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে বিরত হও’ (নাহলঃ৩৬)।

বস্ত্ততঃ এটাই ছিল মানবজাতির প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। এজন্য প্রেরিত ১ লক্ষ ২৪ হাযার নবী-রাসূলের মধ্যে প্রথম মানুষ আদম (আঃ) ছিলেন প্রথম নবী।অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন জগদ্বাসীর প্রতি রহমত স্বরূপ। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ رَحْمَةً لِّلْعَالَمِيْنَ ‘আমরা তো তোমাকে জগদ্বাসীর জন্য কেবল রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি’ (আম্বিয়াঃ১০৭)।

মুহাম্মাদ ইবনু কাব আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে বলেন, هو ما أنعم الله علينا بمحمد صلى الله عليه و سلم ‘ঐ নে‘মত হ’লেন স্বয়ং মুহাম্মাদ (সা)। যাঁকে আল্লাহ আমাদের উপরে নে‘মত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন’ (কুরতুবী)।

যেমন আল্লাহ বলেন,

لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَى الْمُؤمِنِيْنَ إِذْ بَعَثَ فِيْهِمْ رَسُوْلاً مِّنْ أَنْفُسِهِمْ

‘আল্লাহ ঈমানদারগণের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল পাঠিয়েছেন…’ (আলে ইমরানঃ১৬৪)।

সকল উম্মতের প্রতি নবী প্রেরণের এই মহা নে‘মত সম্পর্কে কাফের ও ফাসেকদের জাহান্নামে নিক্ষেপের সময় সেখানকার দাররক্ষীরা জিজ্ঞেস করবে,

أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَتْلُوْنَ عَلَيْكُمْ آيَاتِ رَبِّكُمْ وَيُنْذِرُوْنَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا ؟ قَالُوا بَلَى وَلَكِنْ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكَافِرِينَ-

 

‘তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেননি? তারা কি তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহ পাঠ করেননি? এবং তোমাদেরকে আজকের দিনে সাক্ষাতের ব্যাপারে তাঁরা কি সতর্ক করেননি? তারা বলল, হ্যাঁ’। কিন্তু অবিশ্বাসীদের প্রতি শাস্তির আদেশ বাস্তবায়িত হয়েছে’ (যুমারঃ৭১)।

(১০) ইসলামের বিধান হালকা হওয়া :

হাসান বাছরী ও মুফাযযাল বলেন, উক্ত নেমত হ’ল, আমাদের উপর শরী‘আতের বিধানসমূহকে হালকা করা এবং কুরআনকে সহজ করা (কুরতুবী)। যেমন

আল্লাহ বলেন, وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّيْنِ مِنْ حَرَجٍ ‘আর তিনি তোমাদের উপরে দ্বীনের ব্যাপারে কোন সংকীর্ণতা রাখেননি’ (হজ্জঃ৭৮)।

যেমন ইহুদীদের জন্য বিধান ছিল শিরকের তওবা কবুল হওয়ার জন্য মৃত্যুদন্ড গ্রহণ করা (বাক্বারাহঃ৫৪)।

অথচ ইসলামে কথা ও কর্মের মাধ্যমে অন্তর থেকে তওবা করাই যথেষ্ট। এছাড়াও যেমন সফরে ছালাত জমা ও ক্বছর করা, পরিবহনে ক্বিবলা বাধ্যতামূলক না হওয়া, অপারগ অবস্থায় বসে, কাৎ হয়ে বা ইশারায় ছালাত আদায় করা, মোযার উপর মাসাহ করা, সফরে ছিয়াম ক্বাযা করা, ঋতু অবস্থায় মেয়েদের ছালাত মাফ হওয়া ও ছিয়াম ক্বাযা করা ইত্যাদি।

অন্যত্র আল্লাহ কুরআন সম্পর্কে বলেন, وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ؟

‘আমরা কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ লাভের জন্য। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি’? (ক্বামার ৫৪/১৭, ২২, ৩২, ৪০)।

উল্লেখ্য যে, কুরআন সহজ হওয়ার অর্থ হল, এর তেলাওয়াত সহজ এবং এর শিক্ষা-দীক্ষাসমূহ স্পষ্ট ও বাস্তবায়নযোগ্য। যেমন সালাত পড়, সিয়াম রাখো, অন্যায়-অশ্লীলতা হ’তে দূরে থাক ইত্যাদি। কিন্তু কুরআন থেকে আহকাম বের করা ও আয়াতের উদ্দেশ্য অনুধাবন করাটা সহজ নয়। এজন্য যোগ্য ও তাক্বওয়াশীল আলেম হওয়া যরূরী।

(১১) কুরআন ও সুন্নাহ :

কুরআন ও সুন্নাহ উম্মতের নিকটে রেখে যাওয়া শেষনবী মুহাম্মাদ (সা)-এর দুই জীবন্ত মু‘জেযা, দুই পবিত্র আমানত এবং মানবজাতির জন্য আল্লাহর সবচাইতে বড় নেয়ামত। বিদায় হজ্জের সময় আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী দিনের এক ভাষণে রাসূল (সা) বলেন,

تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا مَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ-

‘তোমাদের মাঝে আমি দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে গেলাম। তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না যতদিন এ দু’টি বস্ত্তকে তোমরা কঠিনভাবে আঁকড়ে থাকবে। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ। মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৮৬, সনদ হাসান।

 

এখন রাসূল নেই, খলীফাগণ নেই। উম্মতের সম্মুখে রয়েছে কেবল কুরআন ও হাদীছের দুই অমূল্য নে‘মত। অতএব সে অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহ তাদের সার্বিক জীবন পরিচালনা করেছে কি-না, সে বিষয়ে আল্লাহর নিকটে অবশ্যই জওয়াবদিহি করতে হবে।

 

শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন বিশ্বনবী। সাবা ৩৪/২৮; মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭৪৮

কুরআন ও সুন্নাহ হ’ল আল্লাহ প্রেরিত বিশ্ববিধান। যা সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ এলাহী বিধান। অতএব মুসলিম-অমুসলিম সকলকেই উক্ত ইলাহী নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ

যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, তার কসম করে বলছি, ইহুদী হৌক, নাছারা হৌক এই উম্মতের যে কেউ আমার আগমনবার্তা শুনেছে, অতঃপর মৃত্যুবরণ করেছে, অথচ আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছে, তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেনি, সে অবশ্যই জাহান্নামী হবে। মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০।

 

বস্ত্ততঃপক্ষে উপরে বর্ণিত সকল বিষয়ই আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ নে‘মত। এগুলি সম্পর্কে বান্দাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। তারা দুনিয়ায় থাকতে এগুলির শুকরিয়া আদায় করেছিল, না কুফরী করেছিল। এই প্রশ্ন প্রত্যেক মানুষকেই করা হবে। আল্লাহ আমাদেরকে আখেরাতে জবাবদানের তাওফীক দান করুন -আমীন!

তাফসিরে যাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন ও ইসলাম অনলাইন মিডিয়া থেকে সংগৃহিত।