তাকদীরের উপর বিশ্বাস

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে।

তাকদীরের প্রতি বিশ্বাসঃ

‘কাদ্র’ ও ‘কাদার’ (القَدْرُ والقَدَرُ) শব্দ পরিমাপ, পরিমাণ, মর্যাদা, শক্তি ইত্যাদি বুঝায়। তাকদীর অর্থ পরিমাপ করা, নির্ধারণ করা, সীমা নির্ণয় করা ইত্যাদি।

উক্ত শব্দটি দুইভাবেই পড়া যায়(القَدْرُ والقَدَرُ)

তাকদির-

সবকিছু ঘটার আগেই সে সম্পর্কে আল্লাহর সম্যক জ্ঞান, সেগুলি লাউহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ করণ, তদ্বিষয়ে তাঁর পূর্ণ ইচ্ছার সমন্বয় এবং অবশেষে সেগুলিকে সৃষ্টি করাকে তাক্বদীর বলে। ছালেহ ইবনে আব্দুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ আলুশ্-শায়খ, জামে‘উ শুরূহিল আক্বীদাতিত্-ত্বহাবিইয়াহ, (কায়রো: দারু ইবনিল জাউযী

‘ঈমান বিল কাদার’ (الإيمان بالقَدَر) অর্থ আল্লাহর অনাদি, অনন্ত ও সর্বব্যাপী জ্ঞান, তাঁর ইচ্ছা এবং তাঁর নির্ধারণ বা তাক্দীরে বিশ্বাস করা।

আমরা বিশ্বাস করি যে, এ বিশ্বের ভাল মন্দ, আনন্দ বা কষ্টের যা কিছু ঘটে তা সবই আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছা অনুসারে। তাঁর জ্ঞান ও ইচ্ছার বাইরে কিছুই সংঘটিত হয় না। সবকিছুই আল্লাহ নির্ধারিত ‘পরিমাপ’ বা ‘ক্বাদার’-এর মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন:

إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ

‘আমি প্রত্যেক কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে। কামার: ৪৯ আয়াত।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«كل شيء بقدر حتى العجز والكيس، أوالكيس والعجز».

“প্রত্যেক জিনিসই পরিমিত, এমনকি অপারগতা ও অলসতা অথবা অলসতা ও অপারগতাও। (সহীহ মুসলিম)

তাকদিরের স্তর ৪টি। এই চারটি স্তরের উপর তাকদীরের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় বলে একে তাকদিরের স্তম্ভ বলা হয়। একে তাকদির উপলব্ধির প্রবেশদ্বারও বলা হয়।

এই চারটি স্তর সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান রাখা ও বিশ্বাস স্থাপন করার মাধ্যমে ঈমানের পুর্ণতা আসবে।

প্রথম স্তরঃ সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন।

এর অর্থ হচ্ছে, সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহর পরিপূর্ণ জ্ঞান আছে, এ মর্মে আমাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে।

যেমনঃ

তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের চাবি, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না। জলে- স্থলে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন। তাঁর অজ্ঞাতসারে গাছের একটি পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকার প্রদেশে এমন একটি শস্যকণাও নেই যে সম্পর্কে তিনি অবগত নন। শুষ্ক ও আর্দ্র সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিখিত আছে। আন’আমঃ ৫৯

একমাত্র আল্লাহই সেই সময়ের জ্ঞান রাখেন। তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই জানেন মাতৃগর্ভে কি লালিত হচ্ছে। কোন প্রাণসত্তা জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কোন ব্যক্তির জানা নেই তার মৃত্যু হবে কোন যমীনে। আল্লাহই সকল জ্ঞানের অধিকারী এবং তিনি সবকিছু জানেন। লোকমানঃ ৩৪

আল্লাহই সেই  মহান সত্তা যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই।  অদৃশ্য ও প্রকাশ্য সবকিছুই তিনি জানেন।  তিনিই রহমান ও রহীম। হাসরঃ২২

তিনি জানেন, তোমাদের মধ্যকার কিছু লোক হবে অসুস্থ, কিছু লোক আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে ভ্রমণরত, এবং কিছু লোক আল্লাহর পথে লড়াই করে।মুযযাম্মেলঃ২০

২য় স্তরঃ  আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ী লাউহে মাহফুযে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে তার সবই লিখে রেখেছেন, এ কথা মনে প্রানে বিশ্বাস করা।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِۚ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَٰبٍۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ ٧٠﴾ [الحج: ٧٠]

 

“তুমি কি জাননা যে, নিশ্চয় আল্লাহ অবগত যা কিছু আসমান ও জমিনে রয়েছে, নিশ্চয় তা কিতাবে লিখিত আছে আর নিশ্চয় তা আল্লাহর নিকট সহজ।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৭০]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«كتب الله مقادير الخلائق قبل أن يخلق السموات والأرض بخمسين ألف سنة».

“আসমান-যমীন সৃষ্টির ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার বৎসর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি জীবের তাকদীরসমূহ লিখে রেখেছেন।” (সহীহ মুসলিম)-৬৪৪০

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আস রা. বলেন, ‘আমি রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি,

‘আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ সবকিছুর তাক্বদীর লিখে রেখেছেন। তিনি বলেন, আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে’। সহিহ মুসলিম, হা/২৬৫৩।

পৃথিবীতে এবং তোমাদের নিজেদের ওপর যেসব মুসিবত আসে তার একটিও এমন নয় যে, তাকে আমি সৃষ্টি করার পূর্বে একটি গ্রন্থে লিখে রাখিনি।  এমনটি করা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ কাজ। হাদীদঃ২২

তৃতীয় স্তরঃ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই হয় না একথার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস করাঃ

তিনি যখন কোন কিছুর ইচ্ছা করেন তখন তাঁর কাজ হয় কেবল এতটুকু যে, তিনি তাকে হুকুম দেন, হয়ে যাও এবং তা হয়ে যায়। ইয়াসীনঃ ৮২

এবং বিপথে যাওয়া থেকে একমাত্র তারাই বাঁচবে যাদের ওপর তোমার রব অনুগ্রহ করেন। এ (নির্বাচন ও ইখতিয়ারের স্বাধীনতার) জন্যই তো তিনি তাদের পয়দা করেছিলেন।আর তোমার রবের একথা পূর্ণ হয়ে গেছে যা তিনি বলেছিলেন— “আমি জাহান্নামকে জিন ও মানুষ উভয়কে দিয়ে ভরে দেবো।”হুদঃ১১৮

যদি তোমার রবের ইচ্ছা হতো (যে, যমীনে সবাই হবে মুমিন ও অনুগত) তাহলে সারা দুনিয়াবাসী ঈমান আনতো। তবে কি তুমি মুমিন হবার জন্য লোকদের ওপর জবরদস্তি করবে? ইউনুসঃ৯৯

চতুর্থ স্তরঃ আল্লাহর রাজ্যের সবকিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন একথার প্রতি ঈমান আনা

আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং তিনিই সবকিছুর রক্ষক। যুমারঃ৬২

অর্থাৎ তিনি কেবল পৃথিবী সৃষ্টিই করেননি, বরং তিনিই এর সব জিনিসের তত্ত্বাবধান ও রক্ষাণাবেক্ষণ করছেন। পৃথিবীর সমস্ত বস্তু যেমন তাঁর সৃষ্টি করার কারণেই অস্তিত্ব লাভ করেছে তেমনি তাঁর টিকিয়ে রাখার কারণেই টিকে আছে, তাঁর প্রতিপালনের কারণেই বিকশিত হচ্ছে এবং তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের কল্যাণেই তা কাজ করছে।

তাক্বদীর দুই প্রকার:

এক. অনড় তাক্বদীর: উম্মুল কিতাব বা লাউহে মাহফূযে লিখিত তাক্বদীর এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকারের তাক্বদীরে কোন পরিবর্তন হয় না।

দুই. ঝুলন্ত তাক্বদীর: ফেরেশতামণ্ডলীর নিকট লিখিত তাক্বদীর এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকার তাক্বদীরে পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং রিযিক্ব, আয়ূ লাউহে মাহফূযে অনড় রয়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন হয় না। তবে ফেরেশতামণ্ডলীর দফতরে লিখিত রিযিক্ব, আয়ূ ইত্যাদিতে পরিবর্তন হতে পারে। আল-ঈমান বিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/১২৫।

ইবনে তাইমিয়া র. বলেন, মানুষের আয়ূ দুই ধরনের: এক ধরনের আয়ূ অনড়, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। দ্বিতীয় প্রকারের আয়ূ কোন শর্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে থাকে। এর আলোকে রাসূল সা.-এর নিম্নোক্ত হাদীসটির অর্থ স্পষ্ট হয়ে উঠে,

মহান আল্লাহ ফেরেশতাকে বান্দার আয়ূ লেখার নির্দেশ দেন এবং তাঁকে বলে দেন, বান্দা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে তুমি তার বয়স এত বছর বাড়িয়ে দিও। কিন্তু তার বয়স বাড়বে কি বাড়বে না সে বিষয়ে ফেরেশতা কিছুই জানেন না। কেবল আল্লাহই তার সুনির্দিষ্ট বয়স সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন। তারপর তার মৃত্যু এসে গেলে আর সময় দেওয়া হয় না। ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ৮/৫১৭।

তাঁকে মানুষের রিযিক্ব কম-বেশী হয় কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

রিযিক্ব দুই প্রকার: এক প্রকারের রিযিক্ব সম্পর্কে কেবলমাত্র আল্লাহই জ্ঞান রাখেন এবং এই প্রকারের রিযিক্বে কোন পরিবর্তন হয় না।

দ্বিতীয় প্রকারের রিযিক্ব সম্পর্কে আল্লাহ ফেরেশতামণ্ডলীকে অবহিত করান। এই প্রকারের রিযিক্ব কম-বেশী হওয়ার বিষয়টি বান্দার কর্মের উপর নির্ভর করে। প্রাগুক্ত, ৮/৫৪০।

বিষয়টির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাফেয ইবনে হাজার র. বলেন,

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফেরেশতাকে বলা হয় যে, অমুক আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে তার বয়স হবে ১০০ বছর। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করলে তার বয়স হবে ৬০ বছর। কিন্তু আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে জানেন যে, সে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে নাকি ছিন্ন করবে। সেজন্য আল্লাহর জ্ঞানে যা রয়েছে, তার কোন পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু ফেরেশতার জ্ঞানে যা রয়েছে, তাতে পরিবর্তন ঘটতে পারে। এই দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন এবং বহাল রাখেন’ (রা‘দ ৩৯)।

সুতরাং মিটিয়ে দেওয়া বা বহাল রাখার বিষয়টি ঘটে ফেরেশতার জ্ঞানের ক্ষেত্রে। কিন্তু উম্মুল কিতাব বা লাউহে মাহফূযে যা রয়েছে, তাতে তেমনটি ঘটে না। আর লাউহে মাহফূযের সবকিছুই আল্লাহর জ্ঞানে রয়েছে।

 

প্রথম প্রকারকে বলা হয়, অনড় তাক্বদীর এবং দ্বিতীয় প্রকার হল, ঝুলন্ত তাক্বদীর।  ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী, ১০/৪৩০।

 

সেজন্য ‘ঝুলন্ত তাক্বদীর’ও মূলতঃ আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞানের ক্ষেত্রে ঝুলন্ত নয়; বরং সেটিও অনড়। মিরক্বাতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাছাবীহ, ২/২৪০।

তাকদীরকে বুঝার জন্য এইভাবে চিন্তা করুন যে, কোন এক ব্যক্তির হায়াত আল্লাহ ঠিক করেছেন যে ৮০ বছর বাঁচবে, তবে যদি সে চিকিৎসা না করলে বাঁচবে ৭০ বছর আর চিকিৎসার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ও দোয়া  থাকলে বাচবে ৭৫ বছর। এইভাবে সব প্রচেষ্টা করার পরও মহান আল্লাহ যেটা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন তার এক মুহুর্ত দেরী হবে না। তাহলে দেখা যায় ব্যক্তি ৭০/৭৫ বছরেও মারা যাতে পারতো কিন্তু ৮০ বছরের বেশী যেতে পারবে না। এটাই তাকদীর।

‘তাঁর কাছেই গায়েবী বিষয়ের চাবিসমূহ রয়েছে; এগুলি তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা কিছু আছে, তিনিই জানেন। তাঁর জানার বাইরে (গাছের) কোন পাতাও ঝরে না। তাক্বদীরের লিখন ব্যতীত কোন শস্যকণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্যও পতিত হয় না’ (সূরা আন‘আম:৫৯)।

 

মহান আল্লাহ, তাঁর মর্যাদা সর্বাধিক, তিনি সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং এই সৃষ্টিজগতে কোন কিছুই তাঁর ইচ্ছা ব্যতীরেকে সংঘটিত হয় না। তিনি জানেন অনাগত বিষয় সম্পর্কে , জানেন সামনে কি ঘটতে চলেছে এবং তিনি তাকদীরে সবকিছু নির্ধারিত করেছেন এবং কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন আসমান ও জমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে।

 

নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই ক্বিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোথায় সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত’ (লুক্বমান ৩৪)।

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

‘তিনি জানেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে যমীনে বিচরণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হবে’ (সূরা মুযযাম্মিল: ২০)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

‘তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ, যিনি ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। তিনি অদৃশ্য এবং দৃশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (সূরা আল হাশর:২২)

রাসূল সা. কে যখন মুশরিকদের ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘তারা বেঁচে থাকলে কি আমল করত, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবগত’।সহীহ মুসলিম:২৬৫৮

ইমরান ইবনে হুসাইন রা. বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল সা. কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কে জান্নাতী আর কে জাহান্নামী তা কি পরিজ্ঞাত বিষয়? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। লোকটি বললেন, তাহলে মানুষ কেন আমল করবে? তিনি বললেন,‘যাকে যেজন্য সৃষ্টি করা হয়েছে বা যার জন্য যা সহজ করা হয়েছে, সে তা-ই করবে’। সহীহ বুখারী:৪/২০৯,৬৫৯৬

তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস থাকলেই মানুষ তার অন্তর শান্ত রেখে সবর নিতে পারবে। মানুষ তার ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করে যাবে এবং এরপর যা পরিনতি হবে সেটাই তাকদীর, তাহলে পাওয়া বা না পাওয়ার ফলে যে অতিরিক্ত উদ্ধত বা হতাশ হওয়ার যে অবস্থা আসতে পারে তা থেকে মুমিন এই তাকদীরে বিশ্বাসের দরুনই সবর নিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই দুনিয়ার জীবনে সবকিছু পাওয়ার ভোগের জন্য মানুষকে পাঠানো হয় নাই, আগামীতে এই সবরের বিনিময় মহান আল্লাহর কাছ থেকে পাবে। তাকদীরে বিশ্বাসকে তাই ঈমানের একটি শর্ত হিসেবে দেয়া হয়েছে যেন মানুষ আশার আলো নিয়ে চলতে পারে।

মহান আল্লাহ বলেছেন,

 

“যমীনে এবং তোমাদের নিজদের মধ্যে এমন কোন মুসীবত আপতিত হয় না, যা আমি সংঘটিত করার পূর্বে কিতাবে লিপিবদ্ধ রাখি না। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ। যাতে তোমরা আফসোস না কর তার উপর যা তোমাদের থেকে হারিয়ে গেছে এবং তোমরা উৎফুল্ল না হও তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার কারণে। আর আল্লাহ কোন উদ্ধত ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।” হাদীদ : ২২-২৩

তাক্বদীর লিপিবদ্ধের পাঁচটি পর্যায়ঃ

প্রথম পর্যায়ঃ রাসূল সা. বলেনঃ

“আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে সৃষ্টি সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়তি (তাকদীর) লাওহে-মাহফূযে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।”(মুসলিমঃ ২৬৫৩)

আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ লাউহে মাহ্ফূযে সবকিছুর তাক্বদীর লিখে রাখেন। লাউহে মাহ্ফূযে বান্দার ভাগ্যে ভাল বা মন্দ যা-ই লিখে রাখা হয়েছে, তা-ই সে পাবে। (সহিহ বুখারী, ৪/৩৮৭,৭৪১৮)

‘যমীনে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর এমন কোন মুসিবত আসে না, যা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই। নিশ্চয়ই এটি আল্লাহর পক্ষে সহজ’ (সূরা আল-হাদীদ ২২)

 

দ্বিতীয় পর্যায়ঃ  আল্লাহ বনী আদমকে তাদের পিতা আদম আ-এর পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করে তাদের নিকট থেকে এমর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তারা যেন তাঁর সাথে শিরক না করে। এসময় তিনি তাদের সবাইকে দু’বার দু’মুষ্টিতে নিয়েছিলেন এবং এক মুষ্টিকে জান্নাতবাসী আর অপর মুষ্টিকে জাহান্নামবাসী হিসাবে লিখে রেখেছিলেন। এই লিখন ছিল লাউহে মাহ্ফূযে লিখনের পরের স্তরে। সুনানে আবূ দাঊদ:৪৭০৩,

মহান আল্লাহ বলেন,  ‘আর যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদেরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি; যাতে ক্বিয়ামতের দিন এ কথা না বলতে পার যে, আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে বেখবর। সূরা আল-আ‘রাফ: ১৭২

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, আমি রাসূল সা. কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ অন্ধকারে তাঁর সৃষ্টিকে সৃষ্টি করে স্বীয় নূরের আলোচ্ছটা দিলেন। ঐদিন যাকে আল্লাহর নূরের আলোচ্ছটা স্পর্শ করেছে, সে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে, যাকে স্পর্শ করেনি, সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। সেজন্যই তো আমি বলি, কলম শুকিয়ে গেছে’। জামে তিরমিযী:২৬৪২

মনে রাখতে হবে, একদলকে জান্নাতী এবং অপর দলকে জাহান্নামী হিসাবে লিখে দেওয়া অথবা একদলকে আল্লাহর নূরের আলোচ্ছটা স্পর্শ করা এবং আরেক দলকে স্পর্শ না করার বিষয়টি এলোপাতাড়ি কোন বিষয় নয়; বরং আল্লাহর চিরন্তন জ্ঞান, ইচ্ছা এবং তাঁর পরিপূর্ণ ন্যায় ও ইনসাফের উপর ভিত্তি করেই তা সংঘটিত হয়েছে।

 

তৃতীয় পর্যায়ঃ মানুষ মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা এসে তার আয়ূ, কর্ম, রিযিক্ব এবং সে সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা, তা লিখে দেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ বলেন, রাসূল সা. বলেছেন,

‘তোমাদের যে কাউকে চল্লিশ দিন ধরে তার মায়ের পেটে একত্রিত করা হয়, তারপর অনুরূপ চল্লিশ দিনে সে জমাটবদ্ধ রক্ত হয় এবং তারপর অনুরূপ চল্লিশ দিনে সে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। অতঃপর চারটি বিষয়ের নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ তার কাছে ফেরেশতা পাঠান এবং তার রিযিক্ব, দুনিয়াতে তার অবস্থানকাল, তার আমলনামা এবং সে দুর্ভাগা হবে না সৌভাগ্যবান হবে তা লিখে দেওয়ার জন্য তাঁকে বলা হয়’। সহিহ বুখারী: ৪২৪, ৩২০৮

লাউহে মাহ্ফূযের লিখন ছিল সমগ্র সৃষ্টিকুলের; কিন্তু মায়ের পেটের এই লিখন শুধুমাত্র মানুষ জাতির জন্য নির্দিষ্ট। জামে‘উ শুরূহিল আক্বীদাতিত্-ত্বহাবিইয়াহ, ১/৫৬৯-৫৭০

চতুর্থ পর্যায়ঃ প্রত্যেক ক্বদরের রাতে ঐ বছরের সবকিছু লেখা হয়। লাউহে মাহফূযের লিখন অনুযায়ী আল্লাহ ফেরেশতামণ্ডলীকে ঐ বছরের সবকিছু লিখতে নির্দেশ দেন। ইহাকে বাৎসরিক তাক্বদীর বলা হয়। মহান আল্লাহ বলেন,

‘আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’ সূরা আদ দুখান: ৩-৪

ইবনে আব্বাস বলেন, ক্বদরের রাতে লাউহে মাহফূযের লিখন অনুযায়ী ঐ বছরের জন্ম, মৃত্যু, রিযিক্ব, বৃষ্টি ইত্যাদি সবকিছু আবার লেখা হয়। এমনকি ঐ বছর কে হজ্জ করবে আর কে করবে না, তাও লিখে রাখা হয়।      ইমাম ক্বুরত্বুবী, আল-জামে‘ লিআহকামিল ক্বুরআন,

পঞ্চম পর্যায়ঃ পূর্বের লিখিত তাক্বদীর অনুযায়ী প্রত্যেক দিন সবকিছুকে নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন করা হয়। ইহাকে প্রাত্যহিক তাক্বদীর বলে। মহান আল্লাহ বলেন,

‘তিনি প্রতিদিন কোন না কোন কাজে রত আছেন’ সূরা আর রহমান: ২৯

রাসূল সা. উক্ত আয়াত তেলাওয়াত করলে সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রত্যেক দিন তিনি কি করেন? রাসূল সা. বললেন, কাউকে ক্ষমা করেন, কারো বিপদাপদ দূর করেন, কারো মর্যাদা বৃদ্ধি করেন আবার কারো মর্যাদার হানি করেন।

ইবনে জারীর ত্ববারী, তাফসীরে ত্ববারী (জামেউল বায়ান ফী তা’বীলিল ক্বুরআন), তাহক্বীক্ব: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুহসিন তুর্কী,

তাকদিরের বিষয়টি আমরা সহজ করে ততটুকুই বুঝার চেষ্টা করি যতটুকু মহান আল্লাহ ও রাসূল স.জানিয়েছেন। একজন মুমিনকে তাক্বদীরের চারটি স্তরের উপর বিশ্বাস করতে হবে। সে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে, আল্লাহর জ্ঞান, লিখন, ইচ্ছা এবং সৃষ্টির বাইরে কোন কিছুই ঘটে না। সে আরো বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ তাকে তাঁর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। ফলে সে সৎকাজ করে যাবে এবং পাপাচার বর্জন করে চলবে। আল্লাহ তাকে সৎকাজ করার এবং অসৎকাজ বর্জন করার তওফীক্ব দিলে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে। পক্ষান্তরে সৎকাজ সম্পাদন এবং অসৎকাজ বর্জনের তওফীক্বপ্রাপ্ত না হলে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা এবং তওবা করবে।

 

ইহলৌকিক সুযোগ-সুবিধা অর্জনেও বান্দাকে প্রচেষ্টা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক এবং বৈধ পন্থা অবলম্বন করতে হবে। সে তার কাঙ্খিত বস্তুটি অর্জন করতে পারলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে। আর না পারলে তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। সাথে সাথে তাকে বিশ্বাস করতে হবে, তাক্বদীরে যদি লেখা থাকে, সে সঠিক কিছু করবে, তাহলে তা কখনই ভুল হওয়ার নয়। পক্ষান্তরে তাক্বদীরে যদি লেখা থাকে, সে ভুল করবে, তাহলে তা কখনই সঠিক হওয়ার নয়।

মহান আল্লাহ বলেছেন,

যিনি পৃথিবী ও আকাশের রাজত্বের মালিক, যিনি কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি, যাঁর সাথে রাজত্বে কেউ শরীক নেই, যিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন তারপর তার একটি তাকদীর নির্ধারিত করে দিয়েছেন।সূরা ফুরকান:০২

যিনি তাকদীর গড়েছেন তারপর পথ দেখিয়েছেন। সূরা আলা:০৩

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন:

বলুনঃ সত্য তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত। অতএব, যার ইচ্ছা, বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা অমান্য করুক”। (সূরা কাহাফ ১৮;২৯)

আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সে হয় কৃতজ্ঞ হয়, না হয় অকৃতজ্ঞ হয়। (সূরা ইনসান ৩)

অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে। (সূরা যিলযাল ৭-৮)

আওয়াজ আসবেঃ এটি জান্নাত। তোমরা এর উত্তরাধিকারী হলে তোমাদের কর্মের প্রতিদানে। সূরা আরাফ: ৪৩

তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের কারণে স্থায়ী আযাব ভোগ কর। সুরা সাজদা: ১৪

সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। মানুষ সকল কাজই আল্লাহর ইচ্ছায় করে ঠিকই কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক করে না। আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক কাজ করার জন্য সে জান্নাতে যাবে আর সন্তুষ্টি মোতাবেক কাজ না করার জন্য সে জাহান্নামে যাবে।

কোন কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন, আর কোন কাজে তিনি অসন্তুষ্ট হন তা বুঝা যাবে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা। কোন কাজ সংঘটিত হয়ে গেলেই সাধারণভাবে বুঝে নেয়া হবে যে এটা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় হয়েছে। তা অবশ্যই বলতে হবে। কিন্তু তা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে হয়েছে কিনা তা বুঝা যাবে না কুরআন বা হাদীসের মাধ্যম ব্যতীত। কুরআন বা হাদীসে উক্ত বিষয়টির সমর্থন থাকলে বুঝা যাবে সেটা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সম্পন্ন হয়েছে। আর যদি কাজটি কুরআন বা হাদীসের পরিপন্থী হয় তাহলে ধরে নেয়া হবে কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টির খেলাফ হয়েছে। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ করলে জান্নাতের অধিকারী হওয়া যাবে। আর তার সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ না করলে জাহান্নামে যেতে হবে।

 ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির মধ্যে পার্থক্য আছে। যেমন এক ব্যক্তির ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়লো, চিকিৎসক বললেন তার পেটে অপারেশন করতে হবে। অপারেশন ছাড়া অন্য কোন পথ নেই।

এখন বেচারা অপারেশন করাতে রাজী নয়। এ কাজে সে সন্তুষ্ট নয়, তবুও সে অপারেশন করিয়ে থাকে। এমন কি এ কাজের জন্য ডাক্তারকে অর্থ দিতে হয়। অতএব, দেখা গেল এ অপারেশনে তার ইচ্ছা পাওয়া গেল, কিন্তু তার সন্তুষ্টি পাওয়া যায়নি। অপারেশন করাতে সে ইচ্ছুক কিন্তু সন্তুষ্ট মনে নয়। দেখা গেল ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি দুটো আলাদা বিষয়।

অনেক সময় ইচ্ছা পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না। কিন্তু যেখানে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় সেখানে ইচ্ছা অবশ্যই থাকে।

গভীর রাতে চোর চুরি করতে চাইলে আল্লাহর ইচ্ছায় বা অনুমতিতে চুরি করে, আল্লাহর সন্তুষ্টিতে নয়। আবার তাহাজ্জুদ নামাজে রাত জাগতে চাইলে আল্লাহর ইচ্ছায় বা অনুমতিতে জাগতে পারে এবং তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে। তাই সকল কাজ মানুষ আল্লাহর ইচ্ছায় করে ঠিকই কিন্তু তার সন্তুষ্টি ও রেজামন্দি অনুযায়ী করে না। তাই যখন ইচ্ছা দ্বারা সন্তুষ্টি বুঝার কোন সুযোগ নেই। তাই জান্নাতে যেতে হলে তাঁর ইচ্ছায় কাজ করলে হবে না। তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ করতে হবে। যে কাজে তিনি সন্তুষ্ট হন বলে প্রমাণ আছে সে সকল কাজ করতে হবে।

ভাল করে মনে রাখতে হবে সব কাজ আল্লাহর ইচ্ছায় হয় ঠিকই কিন্তু সব কাজ তার সন্তুষ্টি মোতাবেক হয় না। আরো মনে রাখতে হবে ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি এক বিষয় নয়। দুটো আলাদা বিষয়।

তাক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপনের ফলে ব্যক্তি যেভাবে উপকৃত হয়–

১. ঈমান পূর্ণতা পায়।

২. যেহেতু তাক্বদীর আল্লাহর কর্মসমূহের অন্যতম। তাই তাক্বদীরের প্রতি ঈমান না আনলে ‘রুবূবিইয়াত’ বা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করার বিষয়টি পূর্ণতা পায় না।

৩. তাক্বদীরে বিশ্বাস করলে বান্দা তার বিপদাপদ, দুঃখ-কষ্টে আল্লাহর শরণাপন্ন হতে পারবে। পক্ষান্তরে কল্যাণকর কিছু ঘটলে সে তা আল্লাহর দিকে সম্বন্ধিত করতে শিখবে এবং সে জানবে যে, তার প্রতি আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহেই এটি সম্ভব হয়েছে। রাসূল সা. বলেন,

মুমিনের বিষয়টি অনেক মজার, তার সবকিছুই কল্যাণকর; মুমিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। কারণ খুশীর কিছু ঘটলে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। পক্ষান্তরে কষ্টের কিছু ঘটলে সে ধৈর্য্যধারণ করে। ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়।  সহিহ মুসলিম:২৯৯৯

 

সুখে-দুঃখে সর্বদা সঠিক পথের উপরে টিকে থাকা সম্ভব হবে। ভাল কিছু পেলে সে আনন্দে আত্মহারা হবে না। পক্ষান্তরে বালা-মুসীবত তাকে আশাহত করতে পারবে না। সে জানবে, তার জীবনে কল্যাণকর যা কিছুই অর্জিত হয়, সবই আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়; তার বিচক্ষণতা এবং কর্মের পারদর্শিতার বিনিময়ে নয়। মহান আল্লাহ বলেন,তোমাদের নিকট যে সমস্ত নেয়ামত আসে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে’ সূরা আন নাহল: ৫৩

পক্ষান্তরে বিপদাপদ এলে সে জানবে, এটিই তার তাক্বদীরে লিপিবদ্ধ ছিল এবং তা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। ফলে সে ধৈর্য্যহারা হবে না, আশাহত হবে না; বরং সে ধৈর্য্যধারণ করবে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াবের প্রত্যাশী হবে।

বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ, ‘রাসূল’ নামক গ্রন্থের লেখক বোডলি (BODLEY) বলেন, ‘আমি মরুর আরবদের কাছ থেকে দুশ্চিন্তাকে পরাজিত করতে শিখেছি। কারণ মুসলিম হিসাবে তাক্বদীরের প্রতি তাদের ঈমান অটুট। আর এই ঈমান তাদেরকে যেমন নিরাপদে জীবন যাপন করতে সহযোগিতা করেছে, তেমনি তা তাদেরকে সহজ এবং সাবলীল জীবন যাপন করতে শিখিয়েছে। সেজন্য কোন বিষয়ে তারা তাড়াহুড়াও করে না, দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হয় না। কেননা তারা বিশ্বাস করে, তাক্বদীরে যা লেখা আছে, তা হবেই।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকে।…আমার আরব মরুভূমি ছেড়ে আসা ১৭ বছর হয়ে গেল, কিন্তু আজও আল্লাহ নির্ধারিত তাক্বদীরের ক্ষেত্রে আমি আরবদের সেই পরিচিত অবস্থান গ্রহণ করি। ফলে যেকোন বিপদাপদকে আমি ঠাণ্ডা মাথায় বরণ করে নিতে পারি। আরবদের কাছ থেকে শেখা এই স্বভাব আমার স্নায়ুবিক চাপ নিয়ন্ত্রণে উপশমকারী নানা ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের চেয়ে বহুগুণ বেশী সফল হয়েছে।

ডেল কার্নেগী, দা‘ইল ক্বালাক্ব ওয়াব্দাইল হায়াত, আরবী অনুবাদ: আব্দুল মুন‘ইম, (কায়রো: মাকতাবাতুল খানজী, তা. বি.), পৃ: ৩০৩-৩০৫।

তাক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপন করলে বান্দা যে কোন বিপদাপদকে হালকা মনে করতে শিখবে। কারণ যখন সে জানবে যে, তার বিপদাপদ আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, তখন তা তার কাছে কিছুই মনে হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন। সূরা আত তাগাবুন: ১১

আলক্বামা র. বলেন, এখানে ঐ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যার বিপদাপদ আসলে সে বিশ্বাস করে যে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়েছে। ফলে সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে এবং তাকে অকপটে গ্রহণ করে নেয়।তাফসীরে ত্ববারী, ২৩/১১।

 

ইবনুল কায়্যিম বলেন: আল্লাহ তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের জন্য যা নির্ধারণ করেছেন তা রহমত স্বরূপ। যদিও তা প্রদাণ বন্ধ করে হতে পারে; পরীক্ষা হলেও সেটি কল্যাণকর। আর তাঁর নির্ধারিত দূর্যোগও মঙ্গলজনক। যদিও তা পীড়াদায়ক হয়। (মাদারিজ আল-সালেকীন, ৪/২১৫)

মুগীরা ইবনে শু’বার(আযাদ করা) গোলাম ওয়াররাদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন মুয়াবিয়া রা. মুগীরা ইবনে শু’বাকে লিখে পাঠালেন-নবী করীম স.কে নামাযের পরে যা পাঠ করতে শুনেছেন তা আমাকে লিখে পাঠাবেন। অতঃপর মুগীরা আমার দ্বারা লিখালেন এবং বললেন,আমি নবী করীম স.কে নামাযের পরে পাঠ করতে শুনেছি,

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ

اللَّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ، وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ، وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الجَدُّ

(লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, আল্লা-হুম্মা লা মানি‘আ লিমা আ‘তাইতা, ওয়ালা মু‘তিয়া লিমা মানা‘তা, ওয়ালা ইয়ানফা‘উ যালজাদ্দি মিনকাল জাদ্দু)।

একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই,

হে আল্লাহ, আপনি যা প্রদান করেছেন তা রোধ ও বারন করার কেউ নেই, আর আপনি যা বারণ করবেন ও রোধ করবেন, তা প্রদান করার কেউ নেই। আর কোনো ক্ষমতা-প্রতিপত্তির অধিকারীর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি আপনার কাছে কোনো উপকারে আসবে না। সহিহ বুখারী: ৬১৫৪

এই বিশ্বাসের প্রভাব এতো গভীর যে একজন মুমিনের জীবনকে শান্ত,স্থীর,সুন্দর ও দূর্নিতিমুক্ত রাখে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এমন অনেক ঘটনাই নিরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে।

 

দেখা যায় একজন মানুষ নিজের জন্য কোন একটা জিনিষ পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রচেষ্টাটা তাকদীরের ভিতরেই অবস্থান করে,তবে কোন্ পথে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা হলো দেখার ও আমলনামায় লেখার বিষয়। আর এই কোন পথের প্রচেষ্টার ধরন হাদীসের বক্তব্যের বিষয়ের উপর বিশ্বাসের ধরনের উপর নির্ভর করে। কেউ যখন পুরোপুরি মহান আল্লাহর ক্ষমতার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখে এবং প্রচেষ্টা চালায় তখন সে আর তার কাংখিত জিনিষ পেতে দেরী দেখে বা না পেলেও অন্যায় ও হারাম পথে চেষ্টা করবে না। সে সব ধরনের নীতিগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছেই চাইবে। তারপর যা আসবে, তার উপর পূর্ণ আস্থা রাখবে যে এটাই ব্যক্তির তাকদীর, এটাই ব্যক্তির কল্যানের জন্য,আলহামদুলিল্লাহ।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-  হতে পারে কোন জিনিস তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর অথচ তা তোমাদের জন্য ভালো। আবার হতে পারে কোন জিনিস তোমরা পছন্দ করো অথচ তা তোমাদের জন্য খারাপ। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। (আল-বাকারা ২:২১৬)

রাসূলুল্লাহ সা. ইবন আব্বাসকে রা. উদ্দেশ্য করে বলেন-

(হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শেখাব। যদি তুমি সেগুলো হিফাযত কর, তাহলে আল্লাহ তোমাকে হিফাযত করবেন। আল্লাহর হুকুম আহকামের হিফাযত কর, তাঁকে শিরক, কুফর থেকে মুক্ত রাখবে, তবেই একমাত্র সাহায্যকারী হিসাবে তাঁকে তোমার কাছে পাবে।

আর যখন কোন কিছু যাচ্ঞা করবে, তখন আল্লাহর কাছে যাচ্ঞা কর, আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, একমাত্র তাঁর কাছেই করবে। এবং জেনে রেখো- তোমার উপকার করার জন্য পৃথিবীর সকল মানুষ একত্রিত হলেও আল্লাহ তোমার জন্য তাক্বদীরে যে মঙ্গল লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তা ছাড়া অন্য কোন প্রকার মঙ্গলই তারা করতে পারবে না। আর যদি তারা তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে তাক্বদীরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমার জন্য যে ক্ষতি লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত অন্য কোন ক্ষতিই তারা করতে পারবে না। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, আর দফতর বন্ধ করে ফেলা হয়েছে)। (মুসনাদে আহমদ, প্রথম খণ্ড)

আলী রা. হতে, তিনি বলেন: বাকী আল গারকাদে (কবরস্থান) আমরা একটি জানাযায় শরীক হলাম, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম) এসে বসলেন, আমরাও তাঁর পাশে বসলাম। তাঁর নিকট একটি লাঠি ছিল এটি দ্বারা তিনি মাটিতে দাগ কাটতেছিলেন, অতঃপর তিনি বললেন: (তোমাদের মধ্যে এমন কোনো ব্যক্তি নেই, এমন কোনো নাফস নেই কিন্তু তার ঠিকানা জান্নাত বা জাহান্নামে লিখা হয়েছে, দূর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যশালী লিখা হয়েছে) অতঃপর তিনি পাঠ করলেন: সূতরাং যে ব্যক্তি দান করবে এবং সংযত হবে এবং সৎ বিষয়কে সত্য জানবে; অচিরেই আমি তার জন্যে সুগম করে দেব সহজ পথ, পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কার্পণ্য করবে ও নিজেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ মনে করবে; অচিরেই আমি তার জন্যে সুগম করে দেব কঠোর পরিণামের পথ।  সূরা লাইল:৫-১০

হাদীসে এসেছে, তোমরা আমল করে যাও কেননা প্রত্যেকেই পরিচালিত, অতঃপর মন্দলোকগণ মন্দ কাজের জন্য পরিচালিত এবং সৎলোকগণ সৎ কাজের জন্য পরিচালিত। তারপর তিনি পাঠ করলেন: সূতরাং যে ব্যক্তি দান করবে এবং সংযত হবে এবং সৎ বিষয়কে সত্য জানবে।

মহান আল্লাহ বলেন, আর স্মরণ কর যুন-নূন এর কথা, যখন সে রাগান্বিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল যে, আমি তার উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করব না। তারপর সে অন্ধকার থেকে ডেকে বলেছিল, আপনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম। অতঃপর আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং দুশ্চিন্তা থেকে তাকে উদ্ধার করেছিলাম। আর এভাবেই আমি মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি। সূরা আম্বিয়া: ৮৭-৮৮

কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায় মহান আল্লাহ বিপদ থেকে উদ্ধার করে দেন, আর সেই ব্যক্তি মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় না করে দুনিয়ার উপায় উপাদান বা মাজার বা কোন ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখায়, যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। মহান আল্লাহ এই চরিত্রটাও তুলে ধরেছেন-

তোমরা যে সমস্ত অনুগ্রহ ভোগ কর, তা তো আল্লাহরই নিকট হতে; আবার যখন দুঃখ-দৈন্য তোমাদেরকে স্পর্শ করে, তখন তোমরা তাঁকেই ব্যাকুল ভাবে আহ্বান কর। আর যখন আল্লাহ তোমাদের দুঃখ- দৈন্য দূরীভূত করেন, তখন তোমাদের এক দল তাদের প্রতিপালকের সাথে শরিক করে। সুরা নহল: ৫৩-৫৪

লানত মানুষের প্রতি, সে কত বড় সত্য অস্বীকারকারী! কোন্ জিনিস থেকে আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন?

এক বিন্দু শুত্রু থেকে আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন, পরে তার তকদীর নির্দিষ্ট করেছেন, তারপর তার জন্য জীবনের পথ সহজ করেছেন। সূরা আবাসা:১৯

যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনিই আমাকে পথ দেখিয়েছেন। তিনি আমাকে খাওয়ান ও পান করান এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন। সূরা শোয়ারা: ৮০

আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,

‘যে ব্যক্তি অভাবে পতিত হয়, অতপর তা সে মানুষের কাছে সোপর্দ করে (অভাব দূরিকরণে মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়), তার অভাব মোচন করা হয় না। পক্ষান্তরে যে অভাবে পতিত হয়ে এর প্রতিকারে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হয় তবে অনিতবিলম্বে আল্লাহ তাকে তরিৎ বা ধীর রিজিক দেবেন। (তিরমিযী : ২৮৯৬; মুসনাদ আহমদ : ৪২১৮)

একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিনী উম্মে হাবিবা রাদিআল্লাহু আনহা মুনাজাতে বলেন, “হে আল্লাহ! আমার স্বামী রসূল, আমার পিতা আবু সুফিয়ান এবং আমার ভাই মুয়াবিয়ার দ্বারা আমাকে উপকৃত করুন।” রাসূলুল্লাহ সা. বলেন :

“তুমি নির্ধারিত হায়াত, নির্দিষ্ট কিছু দিন ও বণ্টনকৃত রিযিকের প্রাথর্না করেছ। যাতে আল্লাহ তাআলা আগ-পাছ কিংবা কম-বেশী করবেন না। এরচেয়ে বরং তুমি যদি জাহান্নামের আগুন ও কবরের আযাব থেকে নাজাত প্রার্থনা করতে, তাহলে তোমার জন্য কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক হত।” মুসলিম শরীফ : ৪৮১৪

ইবনে দায়লামী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি উবাই ইবনে কাব রাদিআল্লাহু আনহুর নিকট আসেন এবং বলেন, আমার অন্তরে তাকদির সম্পর্কে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমাকে কিছু বর্ণনা করে শোনান। হতে পারে আল্লাহ আমার অন্তর থেকে তা দূর করে দিবেন।

তিনি বলেন, আল্লাহ আসমান এবং জমিনবাসীদের শাস্তি দিলে, জালেম হিসেবে গণ্য হবেন না। আর তিনি তাদের সকলের উপর রহম করলে, তার রহম-ই তাদের আমলের তুলনায় বেশী হবে। তাকদিরের প্রতি ঈমান ব্যতীত ওহুদ পরিমান স্বর্ণ দান করলেও কবুল হবে না। স্মরণ রেখ, যা তোমার হস্তগত হওয়ার তা কোনভাবেই হস্তচ্যুত হওয়ার সাধ্য রাখে না। এতদ্ভিন্ন অন্য আকিদা নিয়ে মৃত্যুবরণ করলে জাহান্নাম অবধারিত। তিনি বলেন, অতঃপর আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এর কাছে আসি। তিনিও তদ্রূপ শোনালেন। হুযাইফাতুল য়ামান এর কাছে আসি, তিনিও তদ্রুপ বললেন। যায়েদ বিন ছাবেত এর কাছে আসি, তিনিও রসূলুল্লাহ সা. থেকে অনুরূপ বর্ণনা করে শোনালেন।”আবু দাউদ: ৪০৭৭, আহমাদ: ২০৬০৭

আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ, ভালোবাসার কথা বেশী বেশী স্মরণ করা ও কৃতজ্ঞ অন্তর রাখা প্রয়োজন।

সত্যিকার মুমিন আপন প্রভুর প্রতি সুধারণা পোষণ করে। হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আমার ব্যাপারে আমার বান্দার ধারণা অনুযায়ী, আমি ব্যবহার করি।” বুখারী : ৬৭৫৬ মুসলিম : ৪৮২২

 

মুসিবত দৃশ্যত অসহ্য-কষ্টদায়ক হলেও পশ্চাতে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তাই বান্দার কর্তব্য আল্লাহর সুপ্রসস্ত রহমতের উপর আস্থাবান থাকা।

ফায়সালা ও তাকদীরের ওপর ঈমান আনার অনেক শুভ-পরিণাম, সুন্দর প্রভাব রয়েছে যা জাতীয় ও ব্যক্তি জীবনে কল্যাণ নিয়ে আসে:

(ক) তাকদীরের ওপর ঈমান বিভিন্ন প্রকার নেক আমল ও ভাল গুণ অর্জন করার সুযোগ তৈরি করে। যেমন, আল্লাহর ইখলাস বা একনিষ্ঠতা, তাঁর ওপর ভরসা করা, তাঁকে ভয় করা, তাঁর কাছে কিছু পাওয়ার আশা করা, তাঁর প্রতি ভালো ধারণা রাখা, ধৈর্য ধারণ করা, প্রখর সহনশীলতা, নৈরাশ্য দূর করা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, একমাত্র আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা, তাঁর অনুগ্রহ ও দয়া পেয়ে খুশী হওয়া। একমাত্র আল্লাহর জন্য বিনয়, নম্রতা প্রকাশ করা, উদাসীনতা ও অহংকার ত্যাগ করা। আল্লাহর প্রতি ভরসা করে ভালো পথে ব্যয় করার মন মানষিকতাও সৃষ্টি করে। বীরত্ব সৃষ্টি করে, ভালো কাজ করার দিকে অগ্রসর করে, অল্পে তুষ্ট থাকার গুণ তৈরী করে, আত্মসম্মানী করে, উচ্চাভিলাষী করে, কর্ম দক্ষতা সৃষ্টি করে, কর্ম সম্পাদনের প্রচেষ্টা তৈরী করে সুখে-দুখে মধ্য পথ অবলম্বনকারী তৈরি করে, হিংসা ও প্রতিবাদ করা থেকে নিরাপদে রাখে। বাজে গাল-গল্প, বাতিল কাজ থেকে বিবেককে মূক্ত রাখে। আত্মার প্রশান্তি ও তৃপ্তির ব্যবস্থা করে।

(খ) তাকদীরের ওপর ঈমান ওয়ালা ব্যক্তি তার জীবনে সঠিক ও সরল পথে পরিচালিত হয়।

অধিক নি‘আমত তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না, আর বিপদে নিরাশ হয় না। আর সে নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে যে, তাকে যে বিপদ র্স্পশ করেছে তা (তার জন্য) আল্লাহর নির্ধারণ মাত্র, তার পরীক্ষাস্বরূপ। ঘাবড়ায় না, বিচলিত হয় না; বরং ধৈর্য ধারণ করে ও সওয়াবের আশা রাখে।

(গ) তাকদীরের ওপর ঈমান তার লোককে পথভ্রষ্টতার কারণসমূহ ও জীবনের অশুভ সমাপনী থেকে হিফাযত করে। এটি মুমিনের জন্য সঠিক পথে প্রতিষ্ঠা থাকার স্থায়ী প্রচেষ্টা, নেক কাজ বেশি বেশি করার সুযোগ, নাফরমানীপূর্ণ ও ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকার সুযোগ করে দেয়।

(ঘ) তাকদীরের ওপর ঈমান মুমিনদের জন্য সুদৃঢ় অন্তর ও পূর্ণ বিশ্বাসের দ্বারা ভয়ানক ও কঠিন কর্মকে প্রতিহত করার মনোভাব তৈরি করে দেয়, মাধ্যম বা উপকরণ গ্রহণ করার দ্বারা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«عجبا لأمر المؤمن إن أمره كله له خير وليس ذلك إلا للمؤمن، إن أصابته سراء شكر فكان خيرا له، وإن أصابته ضراء صبر فكان خيرا له».

“কি আর্শ্চয্য! নিশ্চয় মুমিনের সকল কর্মই ভালো, আর তা শুধু মুমিনের জন্য খাস, যদি তাকে কোনো আনন্দ স্পর্শ করে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে, ফলে তা তাঁর জন্য কল্যাণ হয়। আর যদি তাকে কোনো বিপদ র্স্পশ করে তবে সে ধৈর্য ধারণ করে, ফলে তা তার জন্য কল্যাণ হয়।” (সহীহ মুসলিম)

 

তাকদীরের ব্যাপারে বান্দার করণীয়:

তাকদীরের ব্যাপারে বান্দার করণীয় কাজ হলো দু’টি:

প্রথম: সম্ভাব্য কাজ সম্পাদন ও সতর্ককৃত কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। আল্লাহর কাছে আরো চাইতে হবে যেন তিনি তার জন্য সহজ কাজকে করার তাওফীক দেন, আর কঠিন সাধ্য কাজ থেকে তাকে বিরত রাখেন। আর তাঁর ওপর ভরসা করা ও তাঁর কাছে আশ্রয় চাওয়া। অতঃপর কল্যাণ অর্জনের জন্য ও অকল্যাণ বর্জনের জন্য তাঁরই মুখাপেক্ষী হওয়া। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«احرص على ما ينفعك واستعن بالله ولا تعجز وإن أصابك شيء فلا تقل لو أني فعلت كذا لكان كذا ولكن قل قدر الله وما شاء فعل، فإن لو تفتح عمل الشيطان».

“তোমার জন্য কল্যাণকর কাজের প্রতি যত্নবান হও, আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর, আর অপারগতা প্রকাশ করিও না। আর তুমি যদি কোনো কষ্টের সম্মুখীন হও তবে এইরূপ বলিও না যে আমি যদি এ কাজ করতাম তাহলে এই হত; বরং বল যে, ‘এটা আল্লাহর নির্ধারণ, আর তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন’। কারণ, ‘যদি’ কথাটি শয়তানের কর্ম খুলে দেয়।

দ্বিতীয়: বান্দা তার ওপর নির্ধারিত বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করবে, ঘাবড়াবে না। অতঃপর জানবে যে, নিশ্চয় তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। সুতরাং সন্তুষ্টচিত্তে তা মেনে নিবে। আরো জ্ঞাত হবে- যে বিপদ তাকে আক্রমন করেছে তা তাকে ভুল করে অতিক্রম করে চলে যাবার নয়। আর যে বিপদ তাকে আক্রমণ করে নি তা তাকে কোনো ভাবেই স্পর্শ করার ছিল না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«واعلم أن ما أصابك لم يكن ليخطئك وأن ما أخطأك لم يكن ليصيبك».

 

“আরো জ্ঞাত হবে- যে বিপদ তোমাকে আক্রমণ করেছে তা তোমাকে ভুল করে অতিক্রম করে চলে যাবার নয়। আর যে বিপদ তোমাকে আক্রমণ করেনি তা তোমাকে স্পর্শ করার ছিল না”।

তাকদীর ও ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা:

তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা অপরিহার্য; কেননা তা আল্লাহর রুবুবিয়াত বা প্রভুত্বের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার অন্তর্ভুক্ত। তাই সকল মুমিনের পক্ষে আল্লাহর ফায়সালার ওপর সন্তুষ্ট থাকা অপরিহার্য।

কারণ, আল্লাহর সকল কর্ম ও ফায়সালাই ভালো (ন্যায়পূর্ণ) ইনসাফভিত্তিক, হিকমাতপূর্ণ। সুতরাং যার আস্থা থাকবে যে, নিশ্চয় যে সুখ বা দুঃখ তাকে স্পর্শ করেছে তা তাকে ভুল করে অতিক্রম করে চলে যাবার ছিল না আর যা তাকে ছেড়ে গেছে বা স্পর্শ করে নি তা তার নিকট পৌঁছার ছিল না, সে ব্যক্তি পেরেশানী ও সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকতে সক্ষম হবে। আর তার জীবন হতে ব্যাকুলতা ও দোদুল্যমানতা দূর হবে। চলে যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া বস্তুর ওপর চিন্তিত হবে না। আর তার ভবিষ্যৎকে ভয় পাবে না। আর এর মাধ্যমে সে সব চাইতে সৌভাগ্যপূর্ণ হবে, আত্মার দিক দিয়ে সব চেয়ে পবিত্র হবে, আর সব চেয়ে প্রশান্ত হৃদয় হবে।

আর যে জানতে পারবে যে, তার বয়স সীমিত, রুযী পরিমিত, সে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারবে যে, কাপুরুষতা বয়স বাড়াতে পারে না, কার্পণ্যতা রুযী বাড়াতে পারে না, সবই লিখিত রয়েছে, তখন সে বিপদের ওপর ধৈর্য ধারণ করবে, পাপ ও ত্রুটিপূর্ণ কর্ম সম্পাদন করার কারণে ক্ষমা চাইবে। আর আল্লাহ যা (তার জন্য) নির্ধারণ করেছেন তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। তবেই আদেশের আনুগত্য আর বিপদের ওপর ধৈর্য ধারণের মাঝে সমন্বয় গড়তে সক্ষম হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 

﴿مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذۡنِ ٱللَّهِۗ وَمَن يُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ يَهۡدِ قَلۡبَهُۥۚ وَٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٞ ١١﴾ [التغابن: ١١]

“আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো প্রকার বিপদ আসে না এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে, আল্লাহ তার অন্তরকে পথ প্রদর্শন করাবেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত।” [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১১]

তিনি আরো বলেন,

﴿فَٱصۡبِرۡ إِنَّ وَعۡدَ ٱللَّهِ حَقّٞ وَٱسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۢبِكَ﴾ [غافر: ٥٥]

“অতএব, আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। আপনি আপনার পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৫৫]

  হিদায়াত দু’ প্রকার: (হিদায়াতের দু’টি অর্থ)

প্রথম: হিদায়াত অর্থ, সত্যের সন্ধান দেওয়া, সৎপথ প্রদর্শন করা। আর সকল সৃষ্টজীবই এর মালিক। আর সকল রাসূল ও তাদের অনুসারীগণ এরই মালিক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِنَّكَ لَتَهۡدِيٓ إِلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ ٥٢ ﴾ [الشورى: ٥٢]

“নিশ্চয় আপনি সরলপথ প্রদর্শন করেন।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ৫২]

দ্বিতীয়: হিদায়াত এর অর্থ, আল্লাহ কর্তৃক বান্দাদেরকে (ভালো কাজের) তাওফীক প্রদান করা ও সঠিক পথে প্রতিষ্ঠা বা অটল রাখা, (আর তা) তাঁর মুত্তাকী বান্দাদের জন্য দয়া ও অনুগ্রহস্বরূপ। আর এ হিদায়াতের একমাত্র মালিক হলেন আল্লাহ।

 

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَهۡدِي مَن يَشَآءُ﴾ [القصص: ٥٦]

“আপনি যাকে ভালোবাসেন, তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ তা‘আলাই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন।” [সূরা আল-ক্বাসাস, আয়াত: ৫৬]

আসবাব বা (মাধ্যমসমূহ) গ্রহণ করা

বান্দার নিকট দু’ প্রকার কাজ উপস্থিত হয়:

(১) এমন কর্ম যাতে বাহানা বা অজুহাত রয়েছে, তবে তা সম্পাদনে সে অপারগ নয়।

(২) এমন কর্ম যাতে বাহানা ও অজুহাতের অবকাশ নেই, আর তা পালনে সে ধৈর্য ধারণ করে না।

বান্দা কোনো বিপদ পড়ার পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা সে বিপদ সম্পর্কে জানেন। ‘আল্লাহর বিপদ সম্পর্কে জ্ঞান রয়েছে’ এর অর্থ এই নয় যে, তিনিই বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদে পতিত করেছেন, বরং এ বিপদ পতিত হয়েছে এর নির্ধারিত কারণসমূহের দ্বারাই।

যদি বিপদ থেকে রক্ষাকারী মাধ্যম যা ব্যবহার ও গ্রহণ করার জন্য ইসলামী শরী‘আত অনুমতি দিয়েছেন তা পরিত্যাগ করার কারণে সে বিপদে পতিত হয়, তবে সে নিজেকে হিফাযত না করার কারণে ও তাঁকে বিপদ থেকে রক্ষাকারী মাধ্যম গ্রহণ না করার কারণে দোষী হবে।

যেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহন করা তাকদিরকে রদ করা নয় বা তাওয়াক্কুল কমে যাওয়া নয়।

আর যদি এই বিপদ প্রতিরোধ করার তার ক্ষমতা না থাকে তবে সে সাওয়াবের অধিকারী হবে।

সুতরাং মাধ্যম গ্রহণ করা তাকদীর ও তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয় বরং তা (মাধ্যম) গ্রহণ করা এরই (তাকদীর ও তাওয়াক্কুলেরই) অন্তর্ভুক্ত।

আর যখন তাকদীর অনুযায়ী কর্ম শুরু হয়ে যায়, তখন তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা ও তা মেনে নেওয়া কর্তব্য হয়ে যায় ও নিম্নের কথার দ্বারা আশ্রয় গ্রহণ করবে। (قدّر الله وما شاء فعل) “আল্লাহ তা নির্ধারণ করেছেন আর তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন। তবে ভাগ্য পতিত হওয়ার পূর্বে মানুষের দায়িত্ব হলো বৈধ মাধ্যম গ্রহণ করা ও তাকদীরের দ্বারা তাকদীরকে প্রতিরোধ করা। নবীগণ নিজেদেরকে নিজেদের শত্রু থেকে হিফাযত করার জন্য বিবিধ পদ্ধতি ও মাধ্যম গ্রহণ করেছিলেন, অথচ তারা আল্লাহর অহী ও নিরাপত্তা দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত ছিলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল ভরসাকারীদের নেতা ছিলেন, তা সত্ত্বেও তিনি মাধ্যম গ্রহণ করতেন, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা থাকার পরও। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم مِّن قُوَّةٖ وَمِن رِّبَاطِ ٱلۡخَيۡلِ تُرۡهِبُونَ بِهِۦ عَدُوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمۡ﴾ [الانفال: ٦٠]

“আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য, যা-ই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্য থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের ওপর এবং তোমাদের শত্রুদের ওপর।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬০]

তিনি আরো বলেন,

﴿هُوَ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ ذَلُولٗا فَٱمۡشُواْ فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُواْ مِن رِّزۡقِهِۦۖ وَإِلَيۡهِ ٱلنُّشُورُ ١٥﴾ [الملك: ١٥]

“তিনি তোমাদের জন্য যমীনকে সুগম করেছেন, অতএব তোমরা তার কাঁধে বিচরণ কর এবং তাঁর দেওয়া রিযিক আহার কর। তাঁরই কাছে পুনরুজ্জীবন হবে।” [সূরা-আল-মূলক, আয়াত: ১৫]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“দুর্বল মুমিন অপেক্ষা সবল মুমিন আল্লাহর কাছে অধিক উত্তম ও প্রিয়, তবে উভয়ের মাঝে কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যা তোমাকে উপকার করবে তা আদায়ে তুমি যত্নবান হও। আর আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর অপারগতা প্রকাশ করিও না। তোমাকে কোনো বিপদ র্স্পশ করলে তুমি বলিও না যে নিশ্চয় যদি আমি এই কাজ করতাম তবে এই এই হতো বরং তুমি বল, আল্লাহ তা নির্ধারণ করেছেন আর তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন। কারণ ‘যদি’ (لو) বর্ণটি শায়তানের কর্মকে খুলে দেয়।” (সহীহ মুসলিম)

 

ইসলামী ‘‘ঈমান বিল কাদার  বা ‘‘তাকদীরে বিশ্বাস বলতে নিম্নের ৫টি বিষয় বিশ্বাস করা বুঝায়:

(১) আল্লাহর অনাদি, অনন্ত ও সর্বব্যাপী জ্ঞানে বিশ্বাস

মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ সর্বজ্ঞ। কোনো সৃষ্টির জ্ঞানের সাথে আল্লাহর জ্ঞানের তুলনা হয় না। সৃষ্টির আগেই তিনি বিশ্বের সকল বিষয় কোথায় কিভাবে সংঘটিত হবে সবই জানেন। তাঁর জ্ঞানের কোনো পরিবর্তন নেই।

(২) আল্লাহর লিখনে বিশ্বাস

কুরআন-হাদীসের নির্দেশে মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ তাঁর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও সর্বব্যাপী জ্ঞান ‘কিতাবে মুবীন’ (সুস্পষ্ট কিতাব) বা ‘লাওহে মাহফুজে’ (সংরক্ষিত পত্রে) লিখে রেখেছেন। লিখনের প্রকৃতি আমরা জানি না।

(৩) আল্লাহর ইচ্ছায় বিশ্বাস

কুরআন ও হাদীসের নির্দেশে আমরা বিশ্বাস করি যে, এ মহাবিশ্বে যা কিছু সংঘটিত হয় তা সবই আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাঁর জ্ঞানে। তাঁর ইচ্ছা ও জ্ঞানের বাইরে এ মহাবিশ্বের কোথাও সামান্যতম কোনো ঘটনাও ঘটে না।

(৪) আল্লাহর সৃষ্টিতে বিশ্বাস

মুমিন বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বের সবকিছুর স্রষ্টা আল্লাহ। তিনি ছাড়া সবই সৃষ্ট। মানুষের কর্মও আল্লাহ সৃষ্টি করেন।

(৫) মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মফলে বিশ্বাস

মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, ইচ্ছাধীন কর্ম ও কর্মফলের বিশ্বাসের উপরেই ইসলামের সকল বিধি-বিধানের ভিত্তি। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছায় যে কর্ম করে সে শুধু তারই প্রতিফল লাভ করে। কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুমিন বিশ্বাস করেন যে, মানুষকে আল্লাহ বিবেক, বিচার শক্তি ও জ্ঞান দান করেছেন। মানুষ তার নিজ ইচ্ছায় কর্ম করে। তবে তার কর্ম আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছা অনুসারে সংঘটিত হয়। কুরআনে মহান আল্লাহ জানিয়েছেন যে, তিনি মানুষকে তার স্বাধীন ইচ্ছা, বিবেক ও বিচারবুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কাজেই সে তার বিচারবুদ্ধি দিয়ে যে কর্ম করবে তার ফল ভোগ করবে।

আল্লাহ্ তায়ালা কোরআন মজীদে নিজের সম্পর্কে এরশাদ করেন :

كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ

“প্রতিদিনই তিনি স্বীয় ভূমিকায় অধিষ্ঠিত আছেন।”-(সূরা আর রহমান : ২৯)

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) একটি ভাঙা দেয়ালের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন; মনে হচ্ছিল যে,দেয়ালটি ধসে পড়বে। তখন সহসা তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো : “আপনি কি বুঝতে পারছেন যে,আল্লাহ্ তায়ালা কি নির্ধারণ করে রেখেছেন?” তিনি বললেন,“আমি আল্লাহর নির্ধারণ (কাদর) থেকে আল্লাহর নির্ধারণের আশ্রয় গ্রহণ করছি।” অর্থাৎ “আমি এক ভাগ্যলিপি থেকে আরেক ভাগ্যলিপির দিকে গমন করেছি। ভাগ্যলিপির জন্য বসা ও গাত্রোত্থান অভিন্ন। ভাঙা দেয়ালটি যদি আমার ওপর ধসে পড়ে এবং তাতে আমি আঘাত পাই,তাহলে তা-ই হবে ভাগ্যলিপি,আর আমি যদি বিপজ্জনক জায়গা থেকে সরে যাই এবং আঘাত পাওয়া থেকে বেঁচে যাই তাহলে তাও হবে ভাগ্যলিপি।”

যে সব ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক বিধান বিশ্বজগতকে পরিচালনা করছে এবং অলঙ্ঘনীয়রূপে কার্যকর রয়েছে কোরআন সে সবকে ‘আল্লাহর সুন্নাত’ বলে অভিহিত করেছে। এরশাদ হয়েছে :

وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّـهِ تَبْدِيلًا

“হে রাসূল! আপনি কখনই আল্লাহর সুন্নাতে কোন পরিবর্তন দেখতে পাবেন না।”-(সূরা আল আহযাব : ৬২)

আল্লাহ্ তায়ালার অলঙ্ঘনীয় রীতি বা সুন্নাতে আরো যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে তা-ই যা নিম্নোক্ত আয়াতে বিধৃত হয়েছে :

وَعَدَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ

“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যথাযথ কর্ম সম্পাদন করেছে আল্লাহ্ তাদের সাথে অঙ্গীকার করেছেন যে,তাদেরকে অবশ্যই ধরণির বুকে সুপ্রতিষ্ঠা ও স্বীয় প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবেন।”-(সূরা আন নূর : ৫৫)

পবিত্র কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহ্তায়ালার আরেকটি অলঙ্ঘনীয় রীতি হচ্ছে :

إِنَّ اللَّـهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ

“নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ কোন জনগোষ্ঠীর অবস্থাকে পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের মধ্যকার অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়।”-(সূরা আর রাদ : ১১)

দীনী বিশ্বদৃষ্টি অনুযায়ী সত্যসমূহ কেবল বস্তুগত কার্যকারণের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

এরশাদ হয়েছে :

إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا

“নিঃসন্দেহে আমি পথ প্রদর্শন করেছি; চাইলে সে সঠিক পথ বেছে নিয়ে কৃতজ্ঞ হোক,অথবা সে (পথভ্রষ্ট হয়ে) অকৃতজ্ঞ হোক।”-(সূরা আদ দাহর : ৩)

আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সত্যবাদী ও সত্যবাদী স্বীকৃত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের প্রত্যেকেই আপন আপন মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন পর্যন্ত (শুক্র হিসেবে) জমা থাকে। তারপর ঐরকম চল্লিশ দিন রক্তপিন্ড, তারপর ঐরকম চল্লিশ দিন গোশত পিন্ডাকারে থাকে। তারপর আল্লাহ্ একজন ফেরেশতা পাঠান এবং তাকে রিযিক, মৃত্যু, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য- এ চারটি বিষয় লিখার জন্য আদেশ দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর কসম! তোমাদের মাঝে যে কেউ অথবা বলেছেন, কোন ব্যক্তি জাহান্নামীদের ‘আমল করতে থাকে। এমনকি তার ও জাহান্নামের মাঝে মাত্র একহাত বা এক গজের তফাৎ থাকে।

 

এমন সময় তাক্দীর তার ওপর প্রাধান্য লাভ করে আর তখন সে জান্নাতীদের ‘আমল করা শুরু করে দেয়। ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে। আর এক ব্যক্তি জান্নাতীদের ‘আমল করতে থাকে। এমন কি তার ও জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাত বা দু’হাত তফাৎ থাকে। এমন সময় তাক্দীর তার উপর প্রাধান্য লাভ করে আর অমনি সে জাহান্নামীদের ‘আমল শুরু করে দেয়। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। আবূ ‘আবদুল্লাহ্ [বুখারী (রহ.)] বলেন যে, আদম তার বর্ণনায় কেবল ذِرَاعٌ (এক গজ) বলেছেন।[৩২০৮] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬১৩৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১৪২)

আল্লাহর বাণীঃ ‘‘আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে গুমরাহ করেছেন’’- (সূরাহ জাসিয়াহ ৪৫/২৩)

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ যার সম্মুখীন তুমি হবে (তোমার যা ঘটবে) তা লেখার পর কলম শুকিয়ে গেছে। ইবনু ‘আব্বাস(রাঃ) বলেছেন,(لَهَا سَابِقُوْنَ) তাদের উপর নেকবখতি প্রাধান্য বিস্তার করেছে।

৬৫৯৬. ‘ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! জাহান্নামীদের থেকে জান্নাতীদেরকে চেনা যাবে কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। সে বলল, তাহলে ‘আমলকারীরা ‘আমল করবে কেন? তিনি বললেনঃ প্রতিটি লোক ঐ ‘আমলই করে যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অথবা যা তার জন্য সহজ করা হয়েছে। [৭৫৫১; মুসলিম ৩৮/১, হাঃ ২৬৪৯] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬১৩৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১৪৪)

 

আর তাকদীরের ওপর ঈমান আনা আল্লাহ তা‘আলার রবুবিয়াত বা প্রভুত্তের ওপর ঈমান আনার অন্তর্ভুক্ত এবং তা ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্যতম একটি রুকন। এর ওপর ঈমান আনা ছাড়া এই ছয়টি রুকনের ওপর ঈমান আনা পরিপূর্ণ হবে না।

নেজাম অর্থাৎ নেজামে তাওহীদ, সুশৃংখল নিয়ম। সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন পরিকল্পিতভাবে।

১। ইমান বিল কদর ছাড়া ইমান পূর্ন হতে পারে না।

.২। কদর আল্লাহর কাজের একটি অংশ, সুতরাং রবুবিয়্যাতে ইমানের একটি অংশ

৩। তাকদীরে ইমান এনে বান্দা সকল কাজের ব্যপার আল্লাহর উপর ন্যস্থ করে কারন সে বিশ্বাস করে আল্লাহর ফয়সালা দিয়েই তা হয়। তখন সুখ দুঃখ সকল আল্লাহর উপর ন্যস্থ করবে।

৪। তাকদীরে বিশ্বাসি নিজের মর্যাদা বুঝতে পারে। ভালো কাজ করে বুঝে আল্লাহ সুযোগ দিয়েছেন।

৫। কোন মুসিবত এলে সে মেনে নিতে পারে সহজে।

আল্লাহর অনুমোদন ছাড়া কখনো কোন মুসিবত আসে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করে আল্লাহ‌ তার দিলকে হিদায়াত দান করেন।আল্লাহ সব কিছু জানেন। তাগাবুনঃ ১১

তাদের বলে দাও, “আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা ছাড়া আর কোন (ভাল বা মন্দ) কিছুই আমাদের হয় না। আল্লাহই আমাদের অভিভাবক ও কার্যনির্বাহক এবং ঈমানদারদের তাঁর ওপরই ভরসা করা উচিত।  তাওবাঃ ৫১

৬। আল্লাহর পক্ষ থেকেই লিপিবদ্ধ বলেই মানুষ একে অপরকে  উপকার করেছে তাই প্রথমে আল্লাহর শুকরিয়া পরে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ প্রকাশ করতে হবে।

৭। আল্লাহর হিকমাত অনেক অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে সক্ষম হয়। যেমন দুনিয়ার সকল মানুষ এক স্তরে হতো তাহলে একজন অন্যকে সাহায্য করতে পারত না। সবাই মালিক হলে অধিনস্থ কে হতো! মহান আল্লাহই রিযিক এইভাবেই বন্টন করেছেন যেনো সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকে।

সংগৃহিত বিভিন্ন লেখার নোট।