১। শয়তানের পরিচয়

আসসালামু’আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

কেনো শয়তানকে চিনতে ও জানতে হবে?

শত্রুকে না চিনতে পারলে কিভাবে নিজের নিরাপত্তা লাভ হবে! মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মাঝে বান্দাকে অত্যন্ত গভীর ভালোবাসেন বিধায় শয়তানকে পরিচিত করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহর নির্দেশের বাস্তবায়নের জন্য ও নিষেধ সমূহ থেকে দূরে থাকার জন্যই শয়তানকে পূর্ণভাবে জানতে হবে, যতটুকু মহান আল্লাহ আল কুর’আনে জানিয়েছেন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে (হাদীস) জানিয়েছেন তা জানা থাকতে হবে।

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ.

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّکُمُ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا ٝ وَ لَا یَغُرَّنَّکُمۡ بِاللّٰہِ الۡغَرُوۡرُ

 اِنَّ الشَّیۡطٰنَ لَکُمۡ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوۡہُ عَدُوًّا ؕ اِنَّمَا یَدۡعُوۡا حِزۡبَہٗ لِیَکُوۡنُوۡا مِنۡ اَصۡحٰبِ السَّعِیۡرِ

হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য; কাজেই দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে এবং সে প্রবঞ্চক (শয়তান) যেন কিছুতেই তোমাদেরকে আল্লাহ্‌র ব্যাপারে প্রবঞ্চিত না করে।

নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু; কাজেই তাকে শত্রু হিসেবেই গ্ৰহণ কর। সে তো তার দলবলকে ডাকে শুধু এজন্যে যে, তারা যেন প্রজ্জলিত আগুনের অধিবাসী হয়। সূরা ফাতিরঃ৫-৬

শয়তানের পরিচয়

আরবি ভাষায় শয়তান (شَيْطَانٌ) মানে- সীমালংঘনকারী, দাম্ভিক, স্বৈরাচারি।

এই বৈশিষ্ট্যের জ্বীন এবং মানুষ উভয়ের জন্যেই শয়তান পরিভাষা ব্যবহার করা হয়।

شَيْطَانٌ-এর বহুবচন شَيَاطِيْنٌ। শয়তান শব্দটি একটি পরিভাষা হিসেবে প্রাচীন কাল থেকেই সকল ধর্মের লোকদের কাছে একটি সুপরিচিত শব্দ। এ শয়তান জ্বীনদের অন্তর্ভূক্ত।

শয়তান কথাটি সর্বপ্রথম সেই জ্বীনটির জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে, যে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে প্রথম মানুষ আদম আলাইহিস্ সালামকে সাজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়।

শয়তানের নাম সমূহ যা কুর’আনে উল্লেখ এসেছেঃ

১। শয়তানকে কুরআন মজিদে ইবলিসও বলা হয়েছে।

بَلَسٌ ও اِبْلاَسٌ শব্দমূল থেকে اِبْلِيْسٌ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ হলো, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া, ভয়ে ও আতংকে নিথর হয়ে যাওয়া, দু:খে ও শোকে মনমরা হয়ে যাওয়া, সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলা এবং হতাশা ও ব্যর্থতার ফলে মরিয়া (desperate) হয়ে উঠা।

শয়তানকে ইবলিস বলার কারণ হলো, হতাশা ও নিরাশার ফলে তার আহত অহমিকা প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং সে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মরণ খেলায় নেমে সব ধরণের অপরাধ সংঘটনে উদ্যত হয়।

২। শয়তানকে কুরআন মজিদে খান্নাসও বলা হয়েছে।

خَنَّاسٌ শব্দটি خُنُوْسٌ শব্দমূল থেকে নির্গত হয়েছে। এর অর্থ- সামনে এসে আবার পিছিয়ে যাওয়া, প্রকাশ হয়ে আবার গোপন হয়ে যাওয়া। খান্নাস আধিক্যবোধক শব্দ। সুতরাং এর অর্থ বারবার সামনে আসা এবং পিছিয়ে যাওয়া, বারবার প্রকাশ হওয়া এবং গোপন হয়ে যাওয়া।

শয়তানকে খান্নাস বলা হয়েছে এ কারণে যে, সে বারবার এসে প্ররোচনা দেয় এবং বারবার পিছিয়ে এবং লুকিয়ে যায়। এভাবে সে প্ররোচনা দিতেই থাকে। ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন : মানুষ যখন গাফিল ও অসতর্ক-অসচেতন হয়, তখনই শয়তান এসে তাকে প্ররোচনা ও ধোকা দেয়; কিন্তু যখনই সে সতর্ক হয় এবং আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন শয়তান পিছিয়ে যায়, লুকিয়ে যায়। এ কারণেই শয়তানকে খান্নাস বলা হয়েছে।

৩। শয়তানকে আল গারুর (اَلْغَرُوْرٌ)ও বলা  হয়েছে।

এর শব্দমূল হলো গরর (غَرَرٌ)। গরর মানে- ধোকা-প্রতারণা। আল গারূর মানে- মহা ধোকাবাজ, মহাপ্রতারক। কুরআন মজিদে স্থানে শয়তানকে আল গারূর বলা হয়েছে

শয়তানের পূর্ব ইতিহাস

কুরআন মজিদের স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ইবলিস শয়তান জ্বীন গোত্রীয়। আর জ্বীনদের সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন থেকে। সুতরাং শয়তান আগুনের তৈরি জ্বীন জাতির অন্তর্ভুক্ত।

“স্মরণ করো যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম আদমকে সিজদা করো তখন তারা সিজদা করেছিল কিন্তু ইবলীস করেনি৷ সে ছিল জ্বীনদের একজন, তাই তার রবের হুকুমের আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেলো৷ সূরা কাহাফঃ ৫০

” আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি শুকনো ঠন্‌ঠনে পচা মাটি থেকে৷ আর এর আগে জ্বীনদের সৃষ্টি করেছি আগুনের শিখা থেকে৷হিজরঃ২৬-২৭

আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন , “আমি যখন তোকে হুকুম দিয়েছিলাম তখন সিজদা করতে তোকে বাধা দিয়েছিল কিসে”? সে জবাব দিলঃ “আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ৷ আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছো এবং ওকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে৷  আরাফঃ১২

এবং জ্বীনকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হ’তে’ (আর-রহমানঃ১৫)।

মুফাস্সির এবং ঐতিহাসিক ইবনে জারির তাবারি এবং ইবনে কাছির তাঁদের তফসির এবং ইতিহাস গ্রন্থাবলীতে সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. , ইবনে মাসউদ রা. এবং তাবেয়ী হাসান বসরি, তাউস, সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব, সা’দ ইবনে মাসউদ, শহর ইবনে হোশেব, কাতাদা প্রমুখ থেকে শয়তান ইবলিসের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনার সংক্ষিপ্ত সার হলো :

মানুষের পূর্বে আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে এসেছিলো জ্বীন জাতি। তারা ছিলো আগুনের তৈরি এবং দীর্ঘজীবী। একসময় এসে তারা পারস্পারিক বিবাদ বিসম্বাদে পৃথিবীকে চরম বিপর্যস্ত করে তোলে। তাদের দুষ্কর্মে ও ফিতনা ফাসাদে ভরে যায় পৃথিবী। তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবী থেকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ফেরেশতাদের পাঠান তাদের কর্তৃত্ব ধ্বংস করতে এবং তাদের বিতাড়িত করতে। ফেরেশতারা এসে জ্বীনদের একদলকে ধ্বংস করে দেন, কিছু জ্বীনকে সমুদ্রের দিকে তাড়িয়ে দেন আর কিছু জ্বীনকে তাড়িয়ে দেন পাহাড় পর্বতের দিকে। এভাবে মহান আল্লাহ পৃথিবী পরিচালনার কর্তৃত্ব থেকে  জ্বীনদের উচ্ছেদ করেন এবং তাদের কর্তৃত্বের ক্ষমতা বিনাশ করে দেন।

এই ফেরেশতাদল পৃথিবী থেকে ফিরে যাবার সময় আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে একটি জ্বীন শিশুকে সাথে করে নিয়ে যায়। সে ফেরেশতাদের সাথে বসবাস করতে থাকে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত বন্দেগির ক্ষেত্রে ফেরেশতাদের গুণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। এভাবে সে ফেরেশতাদের সাথে মিশে যায়। পরবর্তীকালে এই জ্বীন শয়তান এবং ইবলিস হিসেবে পরিচিত হয়।

 জ্বীনের ইবলিস হওয়ার ঘটনাঃ

জ্বীনটি ফেরেশতাদের সাথে সাথে মহান আল্লাহর ইবাদাতে নিয়োজিত থাকতে থাকতে অনেক বেশি ইবাদাতগুজার হিসেবে মর্যাদা পায়।

পৃথিবী থেকে জ্বীনদের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত করার পর মহান আল্লাহ ঘোষণা করলেন :

إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً

অর্থ : আমি পৃথিবীতে (নতুন করে) প্রতিনিধি/আরেকটি প্রজন্ম সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। (সূরা আল বাকারা : ৩০)

পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্যে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্যে আল্লাহ একটি নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করার মনস্থ করলেন। এ প্রজাতির নাম দিলেন তিনি ‘মানুষ’। সৃষ্টি করলেন তিনি এ প্রজাতির প্রথম মানুষ আদমকে।

মহান আল্লাহ সেই সময়ে আদম আ  এর দেহ মাটি  দিয়ে নিজ হাতে বানিয়ে রেখেছেন, সেই জ্বীনটি  প্রথম মানবের দেহটি দেখে নিজেই মনে মনে একটু হিংসা অনুভব করছিলো। তখনও রুহ ফুঁকে দেয়া হয় নি আদম আ কে। সে মাঝে মাঝে এসে সেই দেহটিতে ধাক্কা দিতো,  নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে ভিতরে দেখে আবার ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে এসে বলতো, আমি দেখে নেবো আমার থেকে বেশী মর্যাদা পেলে! সেই জ্বীন নিজেকে অনেক বেশী পরহেজগার ইবাদাতগুজার মনে করতো। এর মধ্যেই আস্তে আস্তে অহংকার উঁকি দিতে থাকে তার মনে।

মহান আল্লাহ অন্তর্যামী, তিঁনিতো সবই জানেন।

পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করার সব জ্ঞান দান করলেন তিনি আদমকে। পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বের কর্তৃত্ব পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন ফেরেশতাদের সহযোগিতা। তাই মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের হুকুম করলেন আদমকে সাজদা করতে। অর্থাৎ আদম ও তার সন্তানদের আনুগত্য করার প্রতীকি প্রমাণ পেশ করতে। ফেরেশতারা সবাই আদমকে সাজদা করে। কিন্তু সাজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়

ثُمَّ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ لَمْ يَكُنْ مِنَ السَّاجِدِيْن

অতপর আমরা ফেরেশতাদের বললাম : ‘আদমের উদ্দেশ্যে সাজদা করো।’ তখন সবাই সাজদা করলো ইবলিস ছাড়া। সে সাজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলোনা। (সূরাআ’রাফ :  ১১)

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ

অর্থ : আমরা যখন ফেরেশতাদের আদেশ করলাম : ‘তোমরা সাজদা করো আদমকে।’ তখন সাজদা করলো সবাই; ইবলিস্ ছাড়া। (সূরা আল বাকরা :৩৪; সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬১; সূরা ১৮ আল কাহাফ : আয়াত ৫০)

فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ إِلَّا إِبْلِيسَ

অর্থ : তখন সাজদা করলো ফেরেশতারা সকলেই ইবলিস্ ছাড়া। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩০-৩১; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত  ৭৩-৭৪)

আল্লাহ ইবলিসকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার নির্দেশ সত্ত্বেও কোন্ জিনিস তোমাকে সাজদা থেকে বিরত রেখেছে?

قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ

অর্থ : সে বললো : আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে আর ওকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে। (সূরা ৭ আল আ’রাফ : আয়াত ১২)

আদমকে সাজদা করার যে নির্দেশ আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের দিয়েছিলেন, সে নির্দেশ ফেরেশতাদের মতোই আযাযিল শয়তানের উপরও বর্তিয়েছিল। কারণ :

১.সে ফেরেশতাদের দলভুক্তির মর্যাদা লাভ করেছিল।

২.সে ফেরেশতাদের আইন কানুন ও নিয়মরীতিই মেনে চলছিল।

৩.সে ফেরেশতাদের মতোই আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি ও হুকুম আহকাম পালন করছিল।

৪.নির্দেশদানের মুহূর্তে সে ফেরেশতাদের মজলিসেই উপস্থিত ছিলো।

সুতরাং সেই জ্বীনটিও যে এই নিদের্শের আওতাভুক্ত ছিলো তাতে আর কোনো প্রকার সন্দেহ নেই। কালামে পাক থেকে জানা যায় সেগুলো হলো :

১.মহান আল্লাহ ইবলিসকে বাদ দিয়ে নয়, তাকে সহই ফেরেশতাদের সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাইতো সাজদা না করার কারণে তিনি ইবলিসকে প্রশ্ন করলেন :

قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ

আল্লাহ বললেন : (হে ইবলিস) আমি নির্দেশ দেয়া সত্তেও কোন্ জিনিস তোমাকে সাজদা করা থেকে বিরত রেখেছে? (সূরা আল আরাফ : ১২)

قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا لَكَ أَلَّا تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ

অর্থ আল্লাহ বললেন : হে ইবলিস ! তোমার কী হলো যে, তুমি সাজদা কারীদের অন্তর্ভুক্ত হলেনা? (সূরা  আল হিজর : ৩২)

قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ۖ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنتَ مِنَ الْعَالِينَ

অর্থ : আল্লাহ বললেন : হে ইবলিস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি , তাকে সাজদা করতে কিসে তোমাকে বাধা দিলো? তুমি কি ঔদ্ধত্য দেখালে, নাকি তুমি উচু মর্যাদার কেউ? (সূরা সোয়াদ :  ৭৫)

এখন একথা পরিষ্কার হয়ে গেলো, মহান আল্লাহ ইবলিসকে সহই ফেরেশতাদেরকে সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা না হলে ইবলিসের কাছে সাজদা না করার কৈফিয়ত তলব করার কোনো কারণ ছিলনা।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি ইবলিসকে সাজদা করার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত প্রমাণ করে, সেটা হলো স্বয়ং ইবলিসের স্বীকৃতি এবং অস্বীকৃতি।

অর্থাৎ এ নির্দেশ যে ইবলিসের উপরও বর্তিয়েছিল, সেটা ইবলিস নিজেও স্বীকার করে নিয়েছিল। সে আল্লাহর কৈফিয়ত তলবের জবাবে একথা বলে নাই যে, নির্দেশ তো আমাকে দেন নাই, দিয়েছেন ফেরেশতাদেরকে।

তাছাড়া নির্দেশ পালনে তার অস্বীকৃতিও প্রমান করে যে, তাকেও সাজদা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সে আল্লাহর নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায় এবং যুক্তি প্রদর্শন করে।

قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ ۖ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ

অর্থ : সে (জবাবে) বললো : (আমি তাকে সাজদা করতে পারিনা, কারণ) আমি তার চাইতে উত্তম-শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন দিয়ে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাঁদামাটি দিয়ে। (সূরা আ’রাফ: ১২; সুরা সোয়াদ: ৭৬)

قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا ؟

অর্থ : (জবাবে ইবলিস) বললো : আমি কি এমন একজনকে সাজদা করবো যাকে আপনি সৃষ্টি করেছেন কাঁদামাটি দিয়ে? (সূরা ১৭ ইসরা :  ৬১)

قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ

অর্থ : সে বললো : গন্ধযুক্ত কাঁদার ঠনঠনে মাটি দিয়ে আপনি যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আমি তাকে সাজদা করতে পারিনা। (সূরা ১৫ হিজর :  ৩৩)

এখন একথা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার হয়ে গেলো, ইবলিস কোনো প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই একেবারে সহজ সরলভাবে বুঝে নিয়েছিল, সেও সাজদা করার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিলো এবং সচেতনভাবেই সাজদা করা থেকে বিরত ছিলো।

সে (আল্লাহর নির্দেশমতো আদমকে সাজদা করতে) অস্বীকৃতি জানায়, অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা আল বাকারা : ৩৪; সূরা  সোয়াদ : ৭৪)

এসব গুরুতর অপরাধের ফলে আযাযিল জ্বীন চিরতরে অভিশপ্ত হলো এবং অনিবার্যভাবে সাব্যস্ত হলো জাহান্নামের জ্বালানি হিসেবে।

قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ

وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ

অর্থ : আল্লাহ বললেন : তুই এখান থেকে বের হয়ে যা, তুই ধিকৃত । আর বিচার দিবস পর্যন্ত তোর উপর অভিশাপ । (সূরা আল হিজর :  ৩৪-৩৫; সূরা সোয়াদ :  ৭৭-৭৮)

সাথে সাথে তাকে একথাও বলে দেয়া হলো :

فَاخْرُجْ إِنَّكَ مِنَ الصَّاغِرِينَ

অর্থ : বেরিয়ে যা, এখন থেকে তুই নিচুদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আ’রাফ : ১৩)

قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُومًا مَّدْحُورًا

অর্থ : তিনি বললেন : তুই ওখান থেকে বেরিয়ে যা অপমানিত ও ধিকৃত হয়ে।’ (সূরা আ’রাফ : ১৮)

শয়তানের চারিত্রিক ত্রুটি বিশ্লেষনঃ

আদমকে সাজদা করার ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে শয়তান তার মর্যাদার আসনে থেকে এমন সব গুরুতর অপরাধ করে বসলো, যা চরম অমার্জিত ও ক্ষমাহীন। তার সেই গুরুতর অপরাধ সমূহ হলো :

১.সে আল্লাহর হুকুম পালন করতে অস্বীকার করে এবং সে অহংকার, দাম্ভিকতা ও হঠকারীতা প্রদর্শন করে :

أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ

অর্থ : সে আল্লাহর আদেশ পালন করতে অস্বীকার  করে, অহংকার-দাম্ভিকতা-হঠকারিতা প্রদর্শন করে। (সূরা  বাকারা :  ৩৪)

২.সে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সীমালংঘন করে এবং অবাধ্য হয় :

فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ

অর্থ : সে তার প্রভুর হুকুম অমান্য করে সীমালংঘন করে । (সূরা  কাহাফ : ৫০)

৩.সে নিজেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করে :

قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ

অর্থ : সে বলে : আমি তার (আদমের) চাইতে শ্রেষ্ঠ। (সূরা আ’রাফ : ১২)

৪.সে অনুশোচনা করেনি; বরং নিজের হঠকারিতার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে :

قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا

অর্থ : সে বলে : আমি কি এমন একজনকে সাজদা করবো, যাকে তুমি সৃষ্টি করেছো কাদামাটি থেকে? (সূরা  ইসরা : আয়াত ৬১)

নিজের অবাধ্যতার পক্ষে সে আরো যুক্তি প্রদর্শন করে :

خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ

অর্থ: তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছো কাদামাটি থেকে। (সূরা আ’রাফ : আয়াত ১২)

قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ

অর্থ: সে বলে : মানুষকে সাজদা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যাকে তুমি সৃষ্টি করেছো শুকনো ঠনঠনে পঁচা মাটি থেকে। (সূরা আল হিজর : আয়াত ৩৩)

৫.সে আল্লাহর হুকুমের বিপক্ষে যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করে : আল্লামা ইবনে জারির তাবারি এবং আল্লামা ইবনে কাছির তাঁদের তফসিরে উল্লেখ করেছেন, প্রখ্যাত তাবেয়ী মুফাস্সির হাসান বসরি রহ. বলেছেন :

قَاسَ اِبْلِيْسُ وَهُوَ اَوَّلَ مَنْ قَاسَ

অর্থ: ইবলিস তার যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে (নিজেকে শ্রেষ্ঠ ধারণা করে) এবং ইবলিসই সর্বপ্রথম দলিল -এর বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে।

প্রখ্যাত তাবেয়ী ইবনে সীরিন বলেন :

اَوَّلَ مَنْ قَاسَ اِبْلِيْسُ وَمَا عَبَدَتِ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ اِلاَّ بِالْمَقَائِسِ

অর্থ: (দলিল-প্রমাণের বিপক্ষে) সর্বপ্রথম যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগকারী হলো ইবলিস। আর যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করেই লোকেরা চন্দ্র সূর্যের উপাসনা করে।

আল্লামা ইবনে কাছির বলেন :

قَاسَ اِبْلِيْسُ قِيَاسًا فَاسِدًا فِىْ مُقَابَلَةِ النَّصِ

অর্থ: এভাবেই দলিল-প্রমাণ (evidence)-এর বিপক্ষে ইবলিস তার ভ্রান্ত যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে।

৬.সে কুফুরির পথকে আঁকড়ে ধরে :

শয়তান ফেরেশতাদের সাথে অবস্থান করে ভালোভাবেই এ জ্ঞান অর্জন করেছিল যে, আল্লাহর হুকুম অমান্য করা মানেই কুফুরি। ফলে সে জেনে বুঝেই কুফুরির পথ অবলম্বন করে :

إِلَّا إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ

অর্থ: তবে সাজদা করেনি ইবলিস। সে হঠকারিতা প্রদর্শন করে এবং কাফিরদের অন্তরভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা  সোয়াদ : ৭৪ ; সূরা বাকারা :  ৩৪)

৭.সে নিজের ভ্রষ্টতার জন্যে আল্লাহকে দায়ী করে : শয়তানের সবচেয়ে বড়, জঘন্য ও ঘোরতর অপরাধ হলো, সে যে উপরোক্ত অপরাধগুলো সংঘটিত করে ভ্রষ্টতার পথ অবলম্বন করলো, এজন্যে সে নিজের অপরাধ স্বীকার না করে আল্লাহকে দায়ী করে (নাউযুবিল্লাহ) :

قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ

অর্থ: সে বলে, যেহেতু তুমি আমাকে ভ্রষ্টতা ও ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছো, সে জন্যে আমিও এখন থেকে তাদের (আদম সন্তানদের) বিপথগামী করার জন্যে তোমার সিরাতুল মুস্তাকিম-এ ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সূরা আ’রাফঃ১৬-১৭

এখান থেকে আমরা যা বুঝতে পারি , নিচের চারিত্রিক নমুনাগুলোই শয়তানের, যা পথভ্রষ্টতার মূল কারন।

  • অহংকার, দাম্ভিকতা ও হঠকারীতা প্রদর্শন
  • সীমালংঘন এবং অবাধ্য মূলক কাজ করা
  • নিজেকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে  করা,পূর্ন পূন্য লাভ চলে এসেছে মনে করা
  • নিজের ভুল কাজের সাফাই করা
  • যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজে ভুলের উপর অটল থাকা
  • নিজের ভ্রষ্টতার জন্যে আল্লাহকে দায়ী করা
  • ক্ষমা না চাওয়া
  • আরো বেশী জীদ, ঔদ্ধত্ব প্রকাশ করা।

আদম সন্তানদের আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার অংগিকার ও রবের কাছ থেকে ক্ষমতা লাভঃ

শয়তানকে চিরতরে ধিকৃত ও অভিশপ্ত ঘোষণা করার পর সে চিরতরে নিরাশ হয়ে গেলো। কিন্তু সে নিজের অপরাধের জন্যে নত না হয়ে আরো ঔদ্ধত্যে মেতে উঠলো। সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করে আদম এবং আদম সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ (সুযোগ) প্রার্থনা করলো :

قَالَ أَنظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ  قَالَ إِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ

অর্থ : সে বললো : ‘পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দাও।’

তিনি (আল্লাহ) বললেন : যা তুই অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। ( আ’রাফ :  ১৪-১৫; সূরা  হিজর :  ৩৬-৩৭; সূরা  সোয়াদ : ৭৯-৮০)

শয়তানকে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, সে বনী আদমের শিরায় প্রবেশ করতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,

لَا تَلِجُوْا عَلَى المُغِيبَاتِ، فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِي مِنْ أَحَدِكُمْ مَجْرَى الدَّمِ، قُلْنَا: وَمِنْكَ؟ قَالَ: وَمِنِّي، وَلَكِنَّ اللهَ أَعَانَنِي عَلَيْهِ فَأَسْلَمُ،

‘স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোন স্ত্রীর নিকট তোমরা প্রবেশ কর না। কেননা শয়তান তোমাদের রক্তনালীতে চলমান রয়েছে। আমরা বললাম, আপনার মধ্যেও? তিনি বললেন, আমার মাঝেও। তবে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তার বিরুদ্ধে সাহায্য করেছেন। ফলে আমি নিরাপত্তা লাভ করেছ। বুখারী  হা/৭১৭১; মুসলিম হা/২১৭৫

মহান আল্লাহ তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সে প্রার্থনা মঞ্জর করলেন। আল্লাহ তার অবকাশ মঞ্জর করার সাথে সাথে সে অংগিকার এবং চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে বললো :

فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ

তুমি যেমন আমাকে বিপথগামী করেছো, তেমনি আমিও এখন থেকে তাদের (আদম ও তার সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে) তোমার সিরাতুল মুস্তাকিমে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সামনে পেছনে, ডানে বাঁয়ে সবদিক থেকে তাদের ঘেরাও করে নেবো। ফলে তাদের অধিকাংশকেই তুমি কৃতজ্ঞ (তোমার অনুগত) পাবেনা। (সূরা  আ’রাফ :  ১৬-১৭)

قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ ক্স إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ

সে (ইবলিস) বললো : আপনার ক্ষমতার শপথ আমি তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বো, আপনার একান্ত অনুগত দাসদের ছাড়া। ( সূরা ৩৮ সোয়াদ :  ৮২-৮৩)

ইবলিসের চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ তাকে জানিয়ে দিলেন : তুই যাকে যাকে পারিস পদস্খলনের দিকে ডাক, অশ্বারোহী পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ চালা, ধন সম্পদ সন্তান সন্তুতিতে তাদের সাথে শরিক হয়ে যা এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতির জালে আটকে ফেল- তোর সব প্রতিশ্রুতিই তো ধোকাবাজি আর প্রতারণা। জেনে রাখ :

إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلاً

অর্থ : আমার প্রকৃত দাসদের উপর তোর কোনো কর্তৃত্ব অর্জিত হবেনা। (হে মুহাম্মদ!) ভরসা করার জন্যে তোমার প্রভুই যথেষ্ট। (সূরা  ইসরা :  ৬৫)

আল্লাহ শয়তানকে আরো বলে দিলেন :

لَمَن تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنكُمْ أَجْمَعِينَ

আদম সন্তানদের মধ্যে যারাই তোর অনুসরণ করবে, তোর সাথে তাদেরকে দিয়ে আমি জাহান্নাম ভর্তি করবো। (সূরা আ’রাফ : ১৮)

ইবলিস সামনে পিছে, ডানে বামে থেকে আসবে -একথার অর্থ কী?

এটা ছিলো শয়তানের অংগিকার। আদম সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে সে সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর ওঁৎ পেতে বসে থাকবে। সিরাতুল মুস্তাকিম হলো, মানুষের জন্যে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন যাপনের সহজ-সরল সত্য পথ ইসলাম। অর্থাৎ সে মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্যে ইসলামের রাজপথের উপর ওঁৎ পেতে বসে থাকার অংগীকার করে।

ইসলামের রাজপথে ওঁৎ পেতে বসে থেকে সে কী করবে? -যখনই কেউ ইসলামের রাজপথে পা বাড়াবে, তখনই তাকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলবে। সে এবং তার দলবল ঐ ব্যক্তিকে ধোকা, প্রতারণা ও প্ররোচনা দেয়ার জন্যে তার সামনে থেকে আসবে, পিছনে থেকে আসবে, ডানে থেকে আসবে, বামে থেকে আসবে।

ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, শয়তান মানুষের সামনে থেকে আসবে মানে- আখিরাত সম্পর্কে তার মনে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করবে।

পেছনে থেকে আসবে মানে- পার্থিব জীবনের প্রতি তাকে আকৃষ্ট করবে।

ডানে থেকে আসবে মানে- তার দীন সম্পর্কে তার মধ্যে নানা প্রশ্ন সৃষ্টি করে দেবে। বামে থেকে আসবে মানে- আল্লাহর হুকুম আহকাম অমান্য করাকে আনন্দের বিষয় বানিয়ে দেবে।’

খ্যাতনামা তাবেয়ী মুফাস্সির কাতাদা, ইবরাহিম নখয়ী, সুদ্দি এবং ইবনে জুরাইজ (রাহেমাহুমুল্লাহ) বলেছেন : ইবলিসের এ বক্তব্যের মর্ম অনেক গভীর।

সে আদম সন্তানদের সামনে থেকে আসবে বলে বুঝাতে চেয়েছে, সে তাদের প্ররোচনা দিয়ে বলবে : পুনরুত্থান, জান্নাত, জাহান্নাম এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই, এগুলো কিছুই ঘটবেনা।

পেছনে থেকে আসবে মানে- সে পৃথিবীটাকে লোভনীয়, জমকালো ও মনোহরী করে মানুষের সামনে তুলে ধরবে এবং শুধু এটাকেই অর্জন ও ভোগ করার কাজে মনোনিবেশ করার আহবান জানাবে।

ডানে থেকে আসার অর্থ- তার ভালো, উত্তম ও পূণ্য কর্মসমূহের দিক থেকে এসে সেগুলোকে তার কাছে নিষ্ফল কাজ হিসেবে তুলে ধরবে এবং সেগুলো থেকে তাকে নিরাশ ও নিস্পৃহ করে তুলবে।

বামে থেকে আসবে মানে- তার মন্দ ও পাপ কর্মসমূহের দিক থেকে আসবে এবং সেগুলোকে তার কাছে চমৎকার, শোভনীয় ও আকর্ষণীয় করে তুলবে।২

 

এভাবে সামনে পেছনে, ডানে বামে থেকে এসে ইবলিস প্ররোচনার জালে মানুষকে ঘেরাও করে ফেলবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর থেকে তাকে বিচ্যুত ও বিপথগামী করার প্রানান্তকর সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ সা.-এর একটি হাদিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ হাদিসে একটি রূপক উপমার মাধ্যমে তিনি সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে মানুষের বিচ্যুত হবার পন্থা বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি নাওয়াস ইবনে সামআন রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল সা. বলেছেন : আল্লাহ সিরাতুল মুস্তাকিমের একটি উপমা দিয়েছেন। (সেটি হলো:) একটি সোজা সরল সুদৃঢ় পথ। সেই পথের দুই ধারে রয়েছে দেয়াল। দেয়ালগুলোতে রয়েছে অনেক উন্মুক্ত দরজা। দরজাগুলোতে রয়েছে ঝালরের পর্দা। আর রাস্তার মাথায় আছেন একজন আহবায়ক। তিনি আহবান করে বলছেন : ‘হে মানুষ! তোমরা সবাই মিলে সোজা রাস্তার উপর দিয়ে এগিয়ে চলো, রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়োনা।’ আরেকজন আহবায়ক আহবান করছে রাস্তার উপর থেকে। যখনই কোনো ব্যক্তি রাস্তার পার্শবর্তী দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাকাতে বা ঢুকতে চায়, তখনই এই আহবায়ক তাকে সতর্ক করে বলে উঠে : ‘সাবধান! পর্দা সরাবেনা, পর্দা উন্মুক্ত করলে ধ্বংসে নিমজ্জিত হবে।’ (অতপর রসূলুল্লাহ সা. বললেন 🙂 সরল পথটি হলো : ‘ইসলাম।’ দুই পাশের দেয়ালগুলো হলো : ‘আল্লাহর নির্ধারিত সীমানা।’ উন্মুক্ত দরজাগুলো হলো : ‘আল্লাহর নিষিদ্ধ পথ ও বিষয় সমূহ।’ রাস্তার মাথার আহবায়ক হলো : ‘আল্লাহর কিতাব (আল কুরআন)।’ রাস্তার উপরের আহবায়ক হলো : প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির অন্তরে অবস্থিত উপদেশ দাতা বা বিবেক।

ইসলামের সরল সঠিক রাজপথে ওঁৎ পেতে বসে থেকে মানুষকে প্রলুব্ধ ও বিভ্রান্ত করে দুই পাশের পাপের গলিতে ঢুকিয়ে দেয়াই শয়তানের কাজ।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে একটি দাগ দিলেন, অতঃপর বললেন, এটা আল্লাহর সরল সঠিক পথ। এরপর ডানে বামে দাগ কাটলেন এবং বললেন, এই রাস্তাগুলির প্রত্যেকটিতে একজন শয়তান দাঁড়িয়ে আছে। যে মানুষকে তার দিকে আহবান করে থাকে। অতঃপর পাঠ করলেন, ‘এটাই আমার সরল সঠিক পথ, এরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করনা, তা হ’লে (শয়তান) তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে’ (আন‘আম ৬/১৫৩)। হাকেম হা/৩২৪১; মিশকাত হা/১৬৬, সনদ হাসান; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা হা/১১১১০।

আয়াতের মর্মে ও হাদীছের ভাষ্যে বুঝা যায় শয়তান রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে মানুষকে তাদের দিকে বিভ্রান্ত করার জন্য আহবান করে থাকে।

ইবলিসের দুটি দিক দিয়ে আসার রাস্তা বন্ধ

ইবলিস কিন্তু দুটি দিক দিয়ে আসার কথা বলতে সাহস পায়নি, সেটা হলো উপরে ও নীচে।

মহান রবের অনুগত দাস ও মানুষ জানে আল্লাহ উপরে আছেন। আর তাই সাহায্য চাওয়ার জন্য উপরের দিকেই হাত তুলে প্রার্থনা করা হয়।

আবার মহান রবের অনুগত বান্দারা নীচে মাটিতে সাজদাহতে অবনত হয়ে নিজের আনুগত্য পেশ করে,রবের কাছে নিজের অক্ষমতার কথা স্বীকার করে।

মহান আল্লাহ অত্যন্ত কাছে অবস্থান করেন এই সাজদাহর সময়ে।

ইবলিস মহান আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, সে আল্লাহকে ভয় পায়, তাই সেই দুদিক সম্পর্কে সাহস পায় নি।

শয়তানের বাসস্থান :

জারীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ) থেকে শুনেছি তিনি বলেন, নিশ্চয়ই ইবলীসের আসন সমুদ্রের উপরে স্থাপিত, সে লোকদেরকে ফিতনায় লিপ্ত করার জন্য তার বাহিনী প্রেরণ করে। শয়তানের নিকট সর্বাধিক বড় সেই, যে সর্বাধিক ফিৎনা সৃষ্টিকারী। মুসলিম হা/২৮১৩।

শয়তানের মূল আবাসস্থল সমুদ্রে। এছাড়াও তার কিছু থাকার জায়গা রয়েছে। যেমন মানুষের নাকের ছিদ্রে থাকে। নবী করীম (সা) বলেন, তোমাদের কেউ যখন ঘুম হতে উঠে এবং অযূ করে তখন তার উচিৎ নাক তিনবার ঝেড়ে ফেলা। কারণ শয়তান তার নাকের ছিদ্রে রাত কাটিয়েছে। বুখারী হা/৩২৯৫; মুসলিম হা/২৩৮।

শয়তানের আড্ডাখানা কোথায়ঃ

বারা বিন আযেব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন,‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল উটের আস্তাবলে ছালাত আদায় করা সম্পর্কে। তিনি সেখানে ছালাত আদায় করতে নিষেধ করেন। কেননা তা শয়তানের আড্ডাখানা’।আবু দাঊদ হা/১৮৪;

সালমান ফারসী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘তোমার যদি সম্ভব হয় তবে প্রথম বাজারে প্রবেশকারী হয়ো না এবং সেখান থেকে সর্বশেষ প্রস্থানকারী হয়ো না। কারণ বাজার শয়তানের আড্ডাস্থল। সেখানে সে স্বীয় ঝান্ডা গাড়ে’। মুসলিম হা/২৪৫১; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৮৫১।

সাঈদ ইবনে আবী সাঈদ আল-মাকবুরী তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি হাসান ইবনু আলী (রাঃ)-কে ছালাত রত অবস্থায় মাথার উপরাংশে চুল বাধার খোঁপা দেখে তার খোঁপা খুলে দেন। এতে তিনি রাগান্বিত হ’লে আবু রাফে‘ বলেন,

‘রাগান্বিত হবেন না। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি এটা শয়তানের আসন। অর্থাৎ পুরুষের মাথার উপরিভাগে চুলের খোঁপা বাধলে তা শয়তানের আড্ডাখানায় পরিণত হয়।আবুদাঊদ হা/৬৪৬; ছহীহাহ হা/২৩৮৬।  .৪। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা বিছানা প্রসঙ্গে বলেন, একটি বিছানা নিজের জন্য, অপরটি স্ত্রীর জন্য, আরো একটি মেহমানদের জন্য হওয়া দরকার। আর চতুর্থ বিছানাটি শয়তানের জন্য’। আবু দাঊদ হা/৪১৪২, সনদ ছহীহ।

অতএব বুঝা যায়, অতিরিক্ত বিছানায় শয়তানের থাকার সুযোগ হয়।

আকার-আকৃতি :

এদের নির্দিষ্ট কোন আকার-আকৃতি নেই। প্রয়োজন মোতাবেক স্বেচ্ছায় নিজেদের আকার পরিবর্তন করতে পারে। শুধুমাত্র রাসূল (সা)-এর আকার ধারণ করতে পারে না।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,

‘যে আমাকে স্বপ্নে দেখে সে ঠিক আমাকেই দেখে। কারণ শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না’। বুখারী হা/১১০; মুসলিম হা/২২৬৬।

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, অনেকে মনে করে শয়তান লম্বা শিং, বিশাল দেহ, উজ্জ্বল অগ্নিঝরা দু’টি চোখ, লম্বা লেজ বিশিষ্ট এক প্রাণী। কিন্তু এর কোন দলীল প্রমাণ নেই’।ইগাছাতুল লাহফান ফী মাছায়িদিশ শাইত্বান ১/৮।

তবে বিভিন্নভাবে শয়তানের আকার-আকৃতি বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

উকবা বিন আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) ইয়ামনের দিকে লক্ষ্য করে বলেন, …. ‘বেদুঈনদের মধ্যে যারা উট নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং ধর্মের প্রতি মনোযোগী হয় না, যেখান থেকে শয়তানের শিং দু’টি বের হয় তা হ’ল রাবী‘আহ ও মুযার গোত্রদ্বয়ের মাঝে’। বুখারী হা/৩৩০২।

আমর ইবনু আনবাসা আস-সুলামী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘সূর্য শয়তানের দুই শিং-এর মাঝখান দিয়ে উদিত হয় এবং ঐ সময় কাফেররা শয়তানের পুঁজা করে’। মুসলিম, আবু দাঊদ হা/১২৭৭।

আনাস বিন মালেক হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘তোমরা কাতারের মধ্যে পরস্পর মিলে মিশে দাঁড়াও। এক কাতার অপর কাতারের নিকটে কর এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াও। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ! আমি শয়তানকে ছালাতের কাতারের মধ্যে বকরীর ন্যায়

প্রবেশ করতে দেখেছি’। আবূদাঊদ হা/৬৬৭; মিশকাত হা/১০৯৩, সনদ ছহীহ।

আবূ যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, الْكَلْبُ الْأَسْوَدُ شَيْطَانٌ ‘কাল কুকুর হ’ল শয়তান’।মুসলিম হা/৫১০; আবূদাঊদ হা/৭০২;

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, (যে কূপে রাসূলের জন্য যাদু করা হয়) সে কূপের পানি মেহেদীর পানির মত (লাল) এবং তার পাড়ের খেজুর গাছের মাথাগুলো শয়তানের মাথার মত’।বুখারী হা/৫৭৬৩; মুসলিম হা/২১৮৯।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘এটি এমন বৃক্ষ, যা উদ্ধত হয়েছে জাহান্নামের তলদেশ থেকে। এর কলিগুলো যেন শয়তানের মাথা’ (ছাফ্ফাত ৩৭/৬৪-৬৫)। মূলতঃ এটা জাহান্নামী ব্যক্তিদের খাবার হিসাবে প্রস্তুত রাখা যাক্কুম গাছ। যার মাথা শয়তানের মাথার মত।