সূরা মূলক- ৩য় (২২- ৩০ আয়াত)

بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ

 

৬৭:২২ اَفَمَنۡ یَّمۡشِیۡ مُکِبًّا عَلٰی وَجۡہِہٖۤ اَہۡدٰۤی اَمَّنۡ یَّمۡشِیۡ سَوِیًّا عَلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ

২২. যে ব্যক্তি ঝুঁকে মুখে ভর দিয়ে চলে, সে-ই কি ঠিক পথে চলে, না কি সে ব্যক্তি যে সোজা হয়ে সরল পথে চলে?

অর্থাৎ জন্তু-জানোয়ারের মতো মুখ নিচু করে ঐ একই পথে চলছে যে পথে কেউ তাদেরকে একবার চালিয়ে দিয়েছে৷

মুখে ভর দিয়ে যে চলে সে ডানে-বামে, আগে-পিছে কিছুই দেখে না এবং সে হোঁচট খাওয়া থেকেও রক্ষা পায় না। এমন মানুষ কি নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারে? অবশ্যই না। অনুরূপ দুনিয়ায় আল্লাহর নাফরমানীতে ডুবে থাকা ব্যক্তি পরকালে সাফল্য লাভ করা হতে বঞ্চিত থাকবে।

যে ব্যক্তি সরল পথে চলে অর্থাৎ যে পথে কোন বক্রতা নেই ও ভ্রষ্টতার আশঙ্কা নেই এবং সে সামনে ও ডানে-বামে দেখতেও পায়। নিশ্চিত যে, এমন ব্যক্তি তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ, আল্লাহর আনুগত্যের সরল পথ অবলম্বনকারী আখেরাতে বড়ই সৌভাগ্যবান হবে। কেউ কেউ বলেন যে, এটা মুমিন ও কাফের উভয়ের সেই অবস্থার বিবরণ, যা কিয়ামতে তাদের হবে। কাফেরদেরকে মুখের উপর ভর করে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। আর মুমিনরা সোজা হয়ে নিজের পায়ে হেঁটে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

যেমন, কাফেরদের ব্যাপারে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, {وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ} ‘‘আমি তাদেরকে কিয়ামতের দিন মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায় সমবেত করব ’’ (সূরা বানী ইসরেল ৯৭ আয়াত)

হাদীসে এসেছে যে, সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, কাফেররা মুখে ভর দিয়ে কিরূপে চলবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ যে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে পায়ে ভর দিয়ে চালনা করেছেন, তিনি কি মুখমণ্ডল ও মস্তকের ওপর ভর দিয়ে চালাতে সক্ষম নন? [বুখারী: ৪৭৬০, মুসলিম: ২৮০৬]

 

 

৬৭:২৩ قُلۡ ہُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡشَاَکُمۡ وَ جَعَلَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَشۡکُرُوۡنَ

২৩. বলুন, তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবনশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরন। তোমরা খুব অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।

মহান আল্অলাহ মানুষকে এমনই সুন্দর ও যথার্থ করে বানিয়েছেন যে তাকে যে সব ইন্দ্রিয়শক্তি দেয়া হয়েছে তা দিয়ে মানুষ দুনিয়ায় সব রকমের জ্ঞান ও তথ্য সংগ্রহ করে দুনিয়ার যাবতীয় কাজ  চালাবার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে ৷ জন্মকালে মানব সন্তান যত বেশী অসহায় ও অজ্ঞ হয় এমনটি অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে হয় না ৷ কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের উপকরণাদির ( শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, বিবেক ও চিন্তাশক্তি ) সাহায্যেই সে উন্নতি লাভ করে পৃথিবীর সকল বস্তুর ওপর প্রাধান্য বিস্তার এবং তাদের ওপর রাজত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করে ৷

দুনিয়ায় যে গোমরাহী বিস্তারলাভ করে আছে , মহান রবের দেয়া সেই উপাদানকে কাজে না লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে তাই মেনে চলা, ভেবেও  না দেখা, যে পথে  চলছে তা সঠিক কিনা৷ কেউ যদি  সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝাতে চেষ্টা করে, তার কথা  কানেই তুলবে না এবং  মন-মস্তিষ্কে আগে জেঁকে বসা অসত্য ও অন্যায়কে আঁকড়ে থাকবে এ উদ্দেশ্যে মানুষকে এ কান দেয়া হয়নি৷

এ চোখ তো এ জন্য দেয়া হয়নি যে,  অন্ধের মতো অন্যের অনুসরণ করবে৷ যমীন থেকে আসমান পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা নিদর্শনসমূহ, আল্লাহর রাসূলের পেশকৃত তাওহীদের সাক্ষ দিচ্ছে নাকি এ বিশ্ব – জাহানের ব্যবস্থাপনা ইলাহহীন বা বহু ইলাহ পরিচালনাধীন হওয়ার সাক্ষ্য দিচ্ছে! নিজের দৃষ্টিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে  তা দেখবে না এজন্য এ চোখ মানুষকে দেয়া হয়নি৷

এ মন-মস্তিস্কেও  এ জন্য দেয়া হয়নি যে,  চিন্তা-ভাবনা ও বিচার -বিবেচনার কাজ অন্যদের হাতে ছেড়ে দিয়ে দুনিয়াতে এমন সব নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে চলবে যা অন্য কেউ চালু করেছে৷মানুষ বিবেক -বুদ্ধি খাটিয়ে এতোটুকুও ভেবে দেখবে না যে, তা সঠিক না ভ্রান্ত৷

জ্ঞানও বিবেক -বুদ্ধি এবং শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির এ নিয়ামত আল্লাহ মানুষকে দিয়েছিলেন ন্যায় ও সত্যকে চিনার জন্য৷ কিন্তু মানুষ অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে৷ এসব উপকরণের মাধ্যমে মানুষ সব কাজই করছে৷ কিন্তু যে জন্য তা তাদের দেয়া হয়েছিলো সে একটি কাজই মাত্র করছে না৷

আল্লাহ তোমাদের মায়ের পেট থেকে তোমাদের বের করেছেন এমন অবস্থায় যখন তোমরা কিছুই জানতে না৷ তিনি তোমাদের কান দিয়েছেন, চোখ দিয়েছেন, চিন্তা-ভাবনা করার মতো হৃদয় দিয়েছেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো৷নহলঃ ৭৮

তিনিই আল্লাহ যিনি তোমাদের শোনার ও দেখার শক্তি দিয়েছেন এবং চিন্তা করার জন্য অন্তঃকরণ দিয়েছেন, কিন্তু তোমরা কমই কৃতজ্ঞ হয়ে থাকো ৷মুমিনূনঃ৭৮

এ চোখ, কান, মন ও মস্তি্ক তোমাদের কি এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, পশুরা এদেরকে যেব কাজে লাগায় তোমরাও এদেরকে সেসব কাজে লাগাবে৷ তোমরা কেবল পশু মতো দেহ ও প্রবৃত্তির দাবী পূরণ করার উপায় তালাশ করতে এবং সবসময় নিজের জীবনমান উন্নত করার কৌশল চিন্তা করতে থাকবে, এগুলোর উপযোগিতা কি শুধুএতটুকই? তোমাদের মানুষ হিসেবে তৈরী করা হয়েছিল কিন্তু তোমরা নিছক পশু হয়ে রইলে, এর চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা কি আর কিছু হতে পারে? মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

যে জিনিসই তিনি সৃষ্টি করেছেন উত্তম রূপে সৃষ্টি করেছেন৷  তিনি মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি থেকে, তারপর তার বংশ উৎপাদন করেছেন এমন সূত্র থেকে যা তুচ্ছ পানির মতো৷তারপর তাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করেছেন এবং তার মধ্যে নিজের রূহ ফুঁকে দিয়েছেন , আর তোমাদের কান, চোখ ও হৃদয় দিয়েছেন, তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো৷ সাজদাঃ৭-৯

রূহ বলতে নিছক যে জীবন প্রবাহের বদৌলতে একটি জীবের দেহ যন্ত্র সচল ও সক্রিয় হয় তাকে বুঝানো হয়নি৷ বরং এমন বিশেষ সার সত্তা ও সার উপাদান বুঝানো হয়েছে যা চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধি, বিবেক , সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং যার বদৌলতে মানুষ পৃথিবীর অন্য সমস্ত সৃষ্টি থেকে পৃথক একটি ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, অহংবোধের অধিকারী এবং প্রতিনিধিত্ব ক্ষমতা সম্পন্ন সত্তার পরিণত

আর রুহ: আল্লাহ্‌ তাআলা আদম এবং আদমের সকল সন্তানের মাঝে রুহ ফুঁকে দিয়েছেন। এটি আল্লাহ্‌র সৃষ্টিকৃত ‘রুহ’। এ রুহকে আল্লাহ্‌র দিকে সম্বন্ধিত করা হয়েছে সম্মান ও মর্যাদাসূচক হিসেবে। যেমনটি আল্লাহ্‌ আদমের ব্যাপারে বলেছেন: “অতঃপর যখন তাকে পরিপূর্ণ আকৃতি দান করব এবং তার মধ্যে আমার রূহ থেকে ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তাকে সেজদা করবে।”[সূরা হিজর, আয়াত: ২৯]

আল্লাহ্‌ তাআলা ঈসা (আঃ) এর ব্যাপারে বলেন: “মরিয়ম-তনয় ঈসা মসীহ কেবল আল্লাহ্‌র রাসূল এবং তাঁর বাণী; যা তিনি মরিয়মের কাছে পাঠিয়েছিলেন ও তাঁর পক্ষ থেকে রূহ।”[সূরা নিসা, আয়াত: ১৭১]

আমি তাদেরকে এমন কিছু দিয়েছিলাম যা তোমাদের দেইনি৷ আমি তাদেরকে কান, চোখ, হৃদয়-মন সব কিছু দিয়েছিলাম৷ কিন্তু না সে কান তাদের কোন কাজে লেগেছে, না চোখ, না হৃদয়-মন৷ কারণ, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করতো৷ তারা সেই জিনিসের পাল্লায় পড়ে গেল যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো৷  আহকাফঃ২৬

 

৬৭:২৪ قُلۡ ہُوَ الَّذِیۡ ذَرَاَکُمۡ فِی الۡاَرۡضِ وَ اِلَیۡہِ تُحۡشَرُوۡنَ

২৪. বলুন, তিনিই যমীনে তোমাদেরকে সৃষ্টি করে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাঁরই কাছে তোমাদেরকে সমবেত করা হবে।

অর্থাৎ মৃত্যুলাভের পরে পুনরায় তোমাদেরকে জীবিত করে পৃথিবীর সব জায়গা থেকে পরিবেষ্টিত করে আনা হবে এবং আল্লাহর সামনে হাজির করা হবে৷

আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন,  আমি জমিনের উপরিভাগকে (বিচার দিবসে) উদ্ভিদশূন্য মাটিতে পরিণত করে দেব। (সুরা কাহাফ-৮)

ইসরাফীল আলাইহিস সালাম এর সর্বশেষ ফুৎকারের সঙ্গে সঙ্গে পিপীলিকার মতো ও বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের মতো সবাই উঠে দাঁড়াবে।

আল্লাহ্‌ তালা বলেন, ‘অতঃপর দ্বিতীয়বার শিঙায় ফুৎকার দেওয়া হবে, তখন সবাই দাঁড়িয়ে যাবে এবং পরস্পরের দিকে তাকাবে।’ (সুরা জুমার-৬৮)

হাশরের ময়দানের অবস্থা.হাশরের ময়দানের বর্ণনা দিতে গিয়ে মহানবী (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন মানবমণ্ডলীকে লাল শ্বেত মিশ্রিত এমন এক সমতল ভূমিতে একত্র করা হবে, যেন তা পরিচ্ছন্ন আটার রুটির মতো। ওই জমিনে কারো (বাড়িঘরের বা অন্য কিছুর) চিহ্ন থাকবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম) হাশরের ময়দানের ভূমি সম্পর্কে কোরআনে এসেছে, ‘(বিচার দিবসে) আল্লাহ জমিনকে এমন সমতল মসৃণ ধূসর ময়দানে পরিণত করবেন যে তুমি তাতে কোনো বক্রতা ও উচ্চতা দেখতে পাবে না।’ (সুরা : তাহা, আয়াত : ১০৬-১০৭)

সেদিন মানুষ নিজের ভাই, নিজের মা, নিজের পিতা, নিজের স্ত্রী ও সন্তানাদি থেকে পালাবে। তাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর সেদিন এমন সময় এসে পড়বে, সে নিজেকে ছাড়া আর কারো প্রতি লক্ষ করার মতো অবস্থা থাকবে না।’ (সুরা : আবাসা, আয়াত : ৩৪-৩৭)

৬৭:২৫ وَ یَقُوۡلُوۡنَ مَتٰی ہٰذَا الۡوَعۡدُ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ

২৫. আর তারা বলে, তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে বল, এ প্রতিশ্রুতি কখন বাস্তবায়িত হবে?

এ কথা কাফেররা ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করে এবং কিয়ামতকে বহু দূর মনে করে বলত।

 

৬৭:২৬ قُلۡ اِنَّمَا الۡعِلۡمُ عِنۡدَ اللّٰہِ ۪ وَ اِنَّمَاۤ اَنَا نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ

২৬. বলুন, এর জ্ঞান শুধু আল্লাহরই কাছে আছে, আর আমি তো স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।

মানুষ এখনও   বর্তমান সময়েও  কখন পৃথিবী ধবংস হবে, কিয়ামত কখন হবে তা নিয়ে যত ব্যস্থ কিন্তু সেইদিনের জন্য কি প্রস্তুতি আছে তা নিয়ে কোন চিন্তা নেই। অথচ কিয়ামতের আগেও ব্যক্তির মৃত্যু চলে আসতে পারে।

‘‘তুমি বলে দাও, এর খবর তো আমার পালনকর্তার কাছেই রয়েছে। (সূরা আরাফ ১৮৭ আয়াত)

লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে, কিয়ামত কবে আসবে? বলো, একমাত্র আল্লাহই এর জ্ঞান রাখেন৷ তুমি কী জানো, হয়তো তা নিকটেই এসে গেছে৷আহযাবঃ ৬৩ 

এরা  বলে, “এ কিয়ামতের হুমকি কবে পুরা হবে? বলো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও? ইয়াসীনঃ৪৮

একমাত্র আল্লাহই সেই সময়ের জ্ঞান রাখেন ৷ তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন৷ তিনিই জানেন মাতৃগর্ভে কি লালিত হচ্ছে৷ কোন প্রাণসত্তা জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কোন ব্যক্তির জানা নেই তার মৃত্যু হবে কোন যমীনে৷ আল্লাহই সকল জ্ঞানের অধিকারী এবং তিনি সবকিছু জানেন৷লোকমানঃ৩৪

কিয়ামতের কথা ও আখেরারতের প্রতিশ্রুতি শুনে মক্কার কাফেররা রসূলুল্লাহ (সা) কে বারবার এ প্রশ্নটি করতো৷ প্রশ্নটি ছিল, সে সময়টি কবে আসবে ?

কুরআন মজীদে কোথাও তাদের এ প্রশ্নটি উদ্ধৃত করে জবাব দেয়া হয়েছে আবার কোথাও উদ্ধৃত না করেই জবাব দেয়া হয়েছে৷ কারণ শ্রোতাদের মনে এ প্রশ্ন জাগরুক ছিল৷ এ আয়াহতটিতেও প্রশ্নের উল্লেখ ছাড়াই জবাব দেয়া হয়েছে৷

” একমাত্র আল্লাহই সে সময়ের জ্ঞান রাখেন ” এ প্রথম বাক্যটিই মূল প্রশ্নের জবাব৷ তার পরের চারটি বাক্য এ জবাবের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে পেশ করা হয়েছে৷ যুক্তির সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, যেসব বিষয়ের প্রতি মানুষ নিকটতম আকর্ষণ অনুভব করে সেগুলো সম্পর্কেও তার কোন জ্ঞান নেই৷ তাহলে সারা দুনিয়ার শেষ ক্ষণটি কবে ও কখন আসবে, একথা জানা তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব?

তোমাদের সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা বিরাটভাবে নির্ভর করে বৃষ্টির ওপর৷ কিন্তু আল্লাহর হাতে রয়েছে এর পুরো যোগসূত্র৷ যেখানে যখন যতটুকু চান বর্ষণ করান এবং যখনি চান থামিয়ে দেন৷ কেউ একটুও জানে না কোথায় কখন কতটুকু বৃষ্টি হবে এবং কোন ভূখণ্ড তা থেকে বঞ্চিত হবে অথবা কোন ভূখণ্ডে বৃষ্টি উল্টো ক্ষতিকর প্রমাণিত হবে৷ তোমাদের বীর্যে তোমাদের স্ত্রীদের গর্ভসঞ্চার হয় এবং এর সাথে তোমাদের বংশধারার ভবিষ্যত জড়িত৷ কিন্তু তোমরা জানো না এ গর্ভে কি লালিত হচ্ছে এবং কোন আকৃতিতে ও কোন ধরনের কল্যাণ বা অকল্যাণ নিয়ে তা বের হয়ে আসবে ৷ আগামীকাল তোমাদের কি হবে তা-ও তোমরা জানো না৷

একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা তোমাদের ভাগ্য বদলে দিতে পারে৷ কিন্তু এক মিনিট আগেও তোমরা তার খবর পাও না৷ তোমরা এও জানো না, তোমাদের এ জীবনের সমাপ্তি ঘটবে কোথায় কি অবস্থায়৷ এ সমস্ত তথ্যজ্ঞান আল্লাহ নিজেরই কাছে রেখেছেন এবং এর কোন একটির জ্ঞানও তোমাদের দেননি৷ এর মধ্যে প্রত্যেকটি জিনিসই এমন যে সম্পর্কে তোমরা পূর্বাহ্নেই কিছু জানতে চাও যাতে এ জ্ঞানের সাহায্যে তোমরা আগেভাগেই কিছু পদক্ষেপ নিতে পারো৷ কিন্তু সেসব ব্যাপারে আল্লাহর নিজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং তার ফায়সালার ওপর ভরসা করো৷ এভাবে দুনিয়ার শেষক্ষণটির ব্যাপারেও আল্লাহর ফায়সালার প্রতি আস্থা স্থাপন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই৷ এর জ্ঞানও কাউকে দেয়া হয়নি এবং দেয়া যেতে পারে না৷

এখানে আর একটি কথাও ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার৷ সেটি হচ্ছে, যেসব বিষয় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না তেমনি ধরনের গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়াবলীর কোন তালিকা এখানে দেয়া ৷ এ থেকে এ সিদ্ধান্ত টানা ঠিক হবে না যে, মাত্র এ পাঁচটি বিষয়ই গায়েবের অন্তরভুক্ত, যে সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ কিছুই জানে না৷ অথচ গায়েব এমন জিনিসকে বলা হয় যা সৃষ্টির অগোচরে এবং একমাত্র আল্লাহর দৃষ্টি সমক্ষে থাকে৷ প্রকৃতপক্ষে এ গায়েবের কোন সীমা পরিসীমা নেই৷

 

৬৭:২৭ فَلَمَّا رَاَوۡہُ زُلۡفَۃً سِیۡٓـَٔتۡ وُجُوۡہُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ قِیۡلَ ہٰذَا الَّذِیۡ کُنۡتُمۡ بِہٖ تَدَّعُوۡنَ

২৭. অতঃপর তারা যখন তা আসন্ন দেখবে তখন কাফিরদের চেহারা ম্লান হয়ে পড়বে এবং বলা হবে, এটাই হল তা, যা তোমরা দাবী করেছিলে।

অর্থাৎ, এই আযাব যা তোমরা দেখতে পাচ্ছ, তা তো সেই আযাবই, যা তোমরা পৃথিবীতে দ্রুত দেখতে চাচ্ছিলে।

আর এরা বলে, হে আমাদের রব! হিসেবের দিনের আগেই আমাদের অংশ দ্রুত আমাদের দিয়ে দাও৷ সূরা আস সাদঃ ১৬

অর্থাৎ আল্লাহর আযাবের অবস্থার বর্ণনা শুনে এ নাদানদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, এরা ঠাট্টা করে বলে, তুমি আমাদের যে বিচারদিনের ভয় দেখাচ্ছো তার আসা পর্যন্ত আমাদের ব্যাপারটি মুলতবী করে রেখো না বরং আমাদের হিসেব এখনই চুকিয়ে দাও৷ আমাদের অংশে যা কিছু সর্বনাশ লেখা আছে তা এখনই নিয়ে এসো৷

অর্থাৎ, লাঞ্ছনা, ভয়াবহতা এবং আতঙ্কের কারণে তাদের মুখমন্ডল মলিন হয়ে যাবে। এ কথাকে অন্যত্র মুখমন্ডল কালো হয়ে যাবে বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

যেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে৷ তাদেরকে বলা হবে, ঈমানের নিয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরী নীতি অবলম্বন করলে ? ঠিক আছে, তাহলে এখন এই নিয়ামত অস্বীকৃতির বিনিময়ে আযাবের স্বাদ গ্রহন করো৷আলে ইমরানঃ১০৬

আর সেই কথাও স্মরণ যোগ্য যা তারা বলেছিলঃ হে আল্লাহ! যদি এটা যথার্থই সত্য হয়ে থাকে এবং তোমার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে তাহলে আমাদের ওপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করো অথবা কোন যন্ত্রণাদায়ক আযাব আমাদের ওপর আনো৷আনফালঃ৩২

 

৬৭:২৮ قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ اَہۡلَکَنِیَ اللّٰہُ وَ مَنۡ مَّعِیَ اَوۡ رَحِمَنَا ۙ فَمَنۡ یُّجِیۡرُ الۡکٰفِرِیۡنَ مِنۡ عَذَابٍ اَلِیۡمٍ

২৮. বলুন, তোমরা আমাকে জানাও—যদি আল্লাহ আমাকে ও আমার সঙ্গীদেরকে ধ্বংস করেন অথবা আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন, তবে কাফিরদেরকে কে রক্ষা করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হতে?

মক্কা নগরীতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসলাম কায়েমের প্রচেষ্টা সূচনা হলে,কুরাইশদের বিভিন্ন গোত্রভুক্ত ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করলো৷ এতে মক্কার প্রতিটি পরিবার থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদেরকে অভিশাপ দেয়া শুরু হলো৷ তাঁর বিরুদ্ধে যাদুটোনা বা তন্ত্রমন্ত্রের প্রয়োগ শুরু হলো, যাতে তিনি ধ্বংস হয়ে যান৷ এমনকি হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কেও চিন্তা-ভাবনা চলতে থাকলো

রসূল স ও তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারীদেরকে আল্লাহ মৃত্যু অথবা হত্যা দ্বারা ধ্বংস করে দেন কিংবা তাদেরকে অবকাশ দেন; কিন্তু এই কাফেরদের জন্য তো আল্লাহর আযাব থেকে কোন রক্ষাকারী নেই। অথবা এর অর্থ হল, আমরা ঈমান আনা সত্ত্বেও ভয় ও আশার মধ্যে চিন্তাগ্রস্ত, তাহলে কুফরী করলে তোমাদেরকে আযাব থেকে কে বাঁচাতে পারবে? আল্লাহর আযাব এলে তোমরা নিজেরা কিভাবে নিষ্কৃতি পাবে সে চিন্তা করতে থাক৷

 

৬৭:২৯ قُلۡ ہُوَ الرَّحۡمٰنُ اٰمَنَّا بِہٖ وَ عَلَیۡہِ تَوَکَّلۡنَا ۚ فَسَتَعۡلَمُوۡنَ مَنۡ ہُوَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ

২৯. বলুন, তিনিই রহমান, আমরা তাঁর উপর ঈমান এনেছি, এবং তাঁরই উপর তাওয়াক্কুল করেছি। অতঃপর অচিরেই তোমরা জানতে পারবে কে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।

অর্থাৎ আমরা আল্লাহর ওপরে ঈমান এনেছি আর তোমরা তাঁকে অস্বীকার করে চলছো৷ আমরা ভরসা করি একমাত্র আল্লাহর ওপর আর তোমরা ভরসা করো তোমাদের দল, পার্থিব উপায়-উপকরণ এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সব উপাস্য দেব-দেবীদের ওপর৷ তাই আমরাই আল্লাহর রহমত লাভের উপযুক্ত , তোমরা নও৷

যাদেরকে মানুষেরা বলেছিল যে, ‘নিশ্চয় লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে একত্র হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর’। কিন্তু তা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’! অতঃপর তারা ফিরে এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিআমত ও অনুগ্রহসহ। কোনো মন্দ তাদেরকে স্পর্শ করেনি এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।” (সূরা আলে ইমরান : ১৭৩-১৭৪)

‘যে আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।’ সূরা ত্বলাক ৬৫ : ৩

৬৭:৩০ قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ اَصۡبَحَ مَآؤُکُمۡ غَوۡرًا فَمَنۡ یَّاۡتِیۡکُمۡ بِمَآءٍ مَّعِیۡنٍ

 

৩০. বলুন, তোমরা আমাকে জানাও, যদি পানি ভূগর্ভে তোমাদের নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন কে তোমাদেরকে এনে দেবে প্রবাহমান পানি?

غَوْرٌ শব্দের অর্থ হল শুকিয়ে যাওয়া অথবা পানির এত গভীরে চলে যাওয়া যে, সেখান হতে তা বের করা অসম্ভব হয়। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা যদি পানি শুকিয়ে দিয়ে তার অস্তিত্বই শেষ করে দেন অথবা মাটির এত গভীরে করে দেন, যেখান থেকে পানি বের করতে সর্বপ্রকার যন্ত্র ব্যর্থ সাব্যস্ত হয়, তাহলে বল, কে আছে এমন, যে তোমাদের জন্য প্রবহমান ও নির্মল পানির ব্যবস্থা করে দেবে? অর্থাৎ, কেউ নেই। এটা মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ যে, তোমাদের অবাধ্যতা সত্ত্বেও তিনি তোমাদেরকে পানি থেকে বঞ্চিত করেননি।

আল্লাহ ছাড়া আর কেউ এমন শক্তির অধিকারী আছে কি; যে এসব ঝর্ণাধারা আবার প্রবাহিত করে দেবে? যদি না থাকে আর তোমরা ভাল করেই জানো যে, নেই৷ তাহলে ইবাদত লাভের যোগ্য আল্লাহ না তোমাদের উপাস্যরা যাদের ঐ ঝর্ণাধারাগুলো প্রবাহিত করার কোন সামর্থ নেই৷এখন তোমরা নিজের বিবেককে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করে দেখো যে, যারা এক আল্লাহকে মানে তারাই গোমরাহ না যারা শিরকে লিপ্ত আছে তারাই গোমরাহ?