একটি পরিবারের যাদের সামর্থ্য আছে তারা সকলেরই কি আলাদা কুরবানী দিতে হবে?

আসসালামু’আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

আমাদের সমাজে অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, একজন নারী তার সামর্থ আছে পশু কেনার বা পরিবারের অন্য সন্তান যে এখনও একই ছাদের নীচে অবস্থান করছে, একই সাথে খরচাদি চালাচ্ছে, সেইক্ষেত্রে প্রত্যেকের জন্য আলাদা পশু কুরবানী দেওয়া কি ওয়াজীব/সুন্নাতে মু’আক্কাদা?

মহান আল্লাহ আমাদের খালেসভাবে কুরবানীর মূল স্পিরিটকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন।

আসলে আমাদের পরিবারসমূহে হযরত ইবরাহিম আ এর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কুরবানী হলো হযরত ইবরাহীম আ এর সুন্নাত যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসরন করেছেন এবং উম্মতে মুহাম্মদকেও অনুসরন করার তাগিদ দিয়েছেন।

প্রথাগতভাবে ব্যক্তি যাদের ভরণপোষণ করে— স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজন তাদেরকে পরিবার বলে। আভিধানিক অর্থে পরিবার বলতে ব্যক্তির সেসব আত্মীয়দেরকে বুঝায় যারা তার নিজের বংশধর, তার পিতার বংশধর, তার দাদার বংশধর কিংবা তার প্রপিতামহের বংশধর।

একটি পরিবার বলতে যা বুঝা যায়, একই ছাদের নীচে একই উৎস থেকে খরচাদি চালানো হয়, সেইক্ষেত্রে যতজনই হোক না কেনো পরিবারের সদস্য, একটি পশু কুরবানীই যথেষ্ট। সেইক্ষেত্রে যদি কোন সন্তান বা স্ত্রীর আয়ের উৎস থাকে, তবুও একটি পরিবারের পক্ষ থেকে বাড়ির মূল কর্তা বা তার অনুপস্থিতিতে একজন অভিভাবক পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশু কুরবানী দিলেই ওয়াজিব বা সুন্নাতে মু’আক্কাদা আদায় হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।

আর যদি কোন সন্তান পিতা মাতা থেকে পৃথক আবাসে অবস্থান করেন, নিজ খরচাদি স্বতন্ত্রভাবে চালিয়ে থাকেন সেইক্ষেত্রে তাকে নিজের পক্ষ থেকে কুরবানী আলাদা দিতে হবে।

নীচের উত্তর সমূহ পড়ে বিষয়টি পরিস্কার হবে ইন শা আল্লাহ।

প্রশ্ন

প্রশ্ন: আমি চাকুরীজীবী। বিয়ে করিনি। আমি আমার বাবার সাথে থাকি। আমার বাবার পরিবর্তে আমি যদি একটি কোরবানীর পশু খরিদ করি সেটা কি জায়েয হবে? নাকি আমার পিতাকে তার নিজস্ব সম্পদ থেকে কোরবানীর পশুটি কিনতে হবে? আমি যদি কোরবানীর পশু খরিদ করার জন্য সহযোগিতাস্বরূপ আমার বাবাকে কিছু অর্থ দেই সেটা কেমন হবে? আমি এখন –আলহামদুলিল্লাহ- নিজেই কোরবানীর পশু কেনার সামর্থ্য রাখি। এমতাবস্থায়, আমার নিজের পক্ষ থেকে কোরবানী দেয়া কি আমার উপর ওয়াজিব; উল্লেখ্য আমি এখনও বিয়ে করিনি? এ প্রশ্নগুলো একটি অপরটির সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহ আপনাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং আপনাদেরকে ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমত করার তাওফিক দিন।

উত্তর

আলহামদুলিল্লাহ।

এক:

হানাফি আলেমগণ ছাড়া অন্য সকল আলেম একমত যে, ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে ও নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানী দিলে তাতে সুন্নতে কিফায়া আদায় হবে। দলিল হচ্ছে- আবু আইয়ুব আনসারীর হাদিস। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় যে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি এর যামানায় কোরবানীর পশু কেমন ছিল। তিনি বলেন: একজন লোক তার নিজের পক্ষ থেকে ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল দিয়ে কোরবানী দিত। তারা নিজেরাও খেত, অন্যদেরকেও খাওয়াত। এক পর্যায়ে মানুষ বাহাদুরি করা শুরু করল; এখনকার অবস্থাতো দেখতেই পাচ্ছেন।”।[তিরমিযি সুনান গ্রন্থে (১৫০৫) হাদিসটি বর্ণনা করেন এবং বলেন: হাসান সহিহ]

এ মাসয়ালাটি আমাদের ওয়েব সাইটের কয়েকটি প্রশ্নোত্তরে আলোচনা করা হয়েছে; যেমন- 45916 নং ও 96741 নং প্রশ্নোত্তরে।

দুই:

পরিবারের সদস্য নির্ধারণের নীতি কি হবে, যে পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশু কোরবানী দিলে চলবে। এ ব্যাপারে আলেমগণ চারটি অভিমতের উপর মত পার্থক্য করেছেন:

প্রথম অভিমত: যাদের মধ্যে তিনটি শর্ত পূর্ণ হবে: কোরবানীকারী তাদের খরচ চালানো, কোরবানীকারীর আত্মীয় হওয়া ও তার সাথে তারা একত্রে বসবাস করা। এটি মালেকী মাযহাব।

মালেকি মাযহাবের গ্রন্থ ‘আল-তাজ ওয়াল ইকলিল’ (৪/৩৬৪) তে এসেছে- “যদি তার সাথে বসবাস করে, তার আত্মীয় হয় এবং সে তার জন্য খরচ করে; এমনকি সে খরচ যদি দান হিসেবেও হয়”। তিনি তিন কারণে এর বৈধতা দিয়েছেন: আত্মীয়তা, একত্রে বসবাস করা এবং তার জন্য খরচ করা[সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত]

দ্বিতীয় অভিমত: যাদের সকলের খরচদাতা একজন। এটি শাফেয়ি মাযহাবের পরবর্তী কিছু কিছু আলেমদের অভিমত।

তৃতীয় অভিমত: কোরবানকারীর সকল আত্মীয়-স্বজন; এমনকি তিনি যদি তাদের জন্য খরচ না করেন তারপরেও।

চতুর্থ অভিমত: যারা কোরবানীকারীর সাথে একত্রে বসবাস করে; যদিও তারা তার আত্মীয় না। খতিব আল-শারবিনী, শিহাব আল-রমলি, তাবলাওয়ি প্রমুখ পরবর্তী যামানার শাফেয়ি আলেম এ অভিমত অনুযায়ী আমল করেন। তবে আল্লামা ইবনে হাজার আল-হাইতামী এ অভিমতকে অসম্ভব জ্ঞান করেছেন।

শিহাব আল-রমলিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:

কোরবানীর সুন্নত কি একটিমাত্র পশু জবাই করার মাধ্যমে এমন একদল লোকের পক্ষ থেকে আদায় হতে পারে যারা এক বাড়ীতে বসবাস করেন; কিন্তু তাদের মাঝে কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই?

জবাবে তিনি বলেন: হ্যাঁ; আদায় হতে পারে। পরবর্তী যামানার কিছু আলেম বলেন: যাদের জন্য তিনি খরচ করেন তাদের পক্ষ থেকে আদায় হওয়ার মতটি অগ্রগণ্য।[ফাতাওয়ার রমলি (৪/৬৭)]

ইবনে হাজার আল-হাইতামী বলেন:

এখানে এ উদ্দেশ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যে, তার পুরুষ ও নারী আত্মীয়।

আবার এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, এখানে পরিবারের সদস্য দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- যাদের সকলের খরচদাতা একজন; যদিও সে খরচ সদকা হিসেবে দেয়া হোক না কেন।

আবু আইয়ুব আনসারীর উক্তি: “ব্যক্তি তার নিজের পক্ষ থেকে ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে জবাই করবে” এ দুটো অর্থের সম্ভাবনা রাখে। আবার এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, এখানে বাহ্যিক অর্থই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ সবাই একই ঘরে বসবাস করে। যদিও তাদের মাঝে কোন আত্মীয়তা নেই; কিন্তু তারা সকলে একই ঘরের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কোন কোন আলেম এ মতের পক্ষে দৃঢ়তা জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু এটি দূরবর্তী।[‘তুহফাতুল মুহতাজ’ (৯/৩৪৫) থেকে সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত]

মোদ্দাকথা হচ্ছে- যে সন্তান বড় হয়ে বাবা থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র বাড়িতে থাকে তার জন্য নিজের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র কোরবানী করার বিধান রয়েছে। পিতার কোরবানী তার জন্য যথেষ্ট হবে না। কারণ বর্তমানে সে তার পিতার পরিবারের সদস্য নয়; বরং সে স্বতন্ত্র পরিবারের কর্তা। আর সন্তান যদি কোরবানীর পশু কেনার অর্থ দিয়ে পিতাকে সহযোগিতা করে এর জন্য সে ইনশাআল্লাহ সওয়াব পাবে। কিন্তু, এটি হবে দান করার সওয়াব; কোরবানী করার সওয়াব নয়। আরও জানতে দেখুন: 41766 নং প্রশ্নোত্তর।

আল্লাহই ভাল জানেন

 

প্রশ্ন

প্রশ্ন: আমি, আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা সহ পরিবারের সদস্য আটজন। আমাদের জন্য কি একটি কোরবানীর পশু যথেষ্ট হবে? নাকি প্রত্যেকের পক্ষ থেকে একটি পশু কোরবানী দিতে হবে? যদি একটি পশু যথেষ্ট হয় তাহলে আমি ও আমার প্রতিবেশী একই কোরবানীর পশুতে অংশীদার হওয়া বৈধ হবে কি?

উত্তর

আলহামদুলিল্লাহ।

এক:

কোরবানীর পশু হিসেবে একটি মেষ ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে, তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে এবং যত মুসলমানের পক্ষ থেকে নিয়ত করে সবার পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। দলিল হচ্ছে আয়েশা (রাঃ) এর হাদিস, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন একটি মেষ আনার নির্দেশ দিলেন যেটির পায়ের রঙ কালো, পেটের রঙ কালো, চোখের রঙ কালো। নির্দেশ অনুযায়ী কোরবানীর জন্য মেষটি আনা হল। তখন তিনি আয়েশা (রাঃ) কে বললেন: হে আয়েশা! তুমি ছুরিটি নিয়ে আস (অর্থাৎ আমাকে ছুরিটি দাও)। তিনি ছুরিটি নিয়ে এলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছুরিটি এবং মেষটিকেও নিলেন। এরপর মেষটিকে শুইয়ে দিয়ে জবাই করলেন (অর্থাৎ জবাই করার প্রস্তুতি নিলেন)। এরপর বললেন: বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ! এটি মুহাম্মদের পক্ষ থেকে, মুহাম্মদের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং উম্মতে মুহাম্মদীর পক্ষ থেকে কবুল করুন। অতঃপর তিনি সে মেষটি কোরবানী করলেন।[সহিহ মুসলিম]

ব্যাকেটের ভেতরের অংশটুকু ব্যাখ্যা; মূল হাদিসের অংশ নয়।

আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লামের যামানায় একজন ব্যক্তি একটি ছাগল দিয়ে নিজের পক্ষ থেকে ও নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানী দিত। নিজেরা খেত এবং অন্যদেরকেও খাওয়াত।”।[সুনানে ইবনে মাজাহ ও সুনানে তিরমিযি; তিরমিযি হাদিসটিকে ‘সহিহ’ বলেছেন। আলবানী সহিহুত তিরমিযি গ্রন্থে (১২১৬) হাদিসটিকে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন]

অতএব, কোন লোক যদি একটি ছাগল কিংবা একটি ভেড়া দিয়ে কোরবানী দেয় তাহলে সেটা তার নিজের পক্ষ থেকে, তার পরিবারের মৃত বা জীবিত যত সদস্যদের পক্ষ থেকে নিয়ত করে সকলের পক্ষ থেকে জায়েয হবে। যদি আমভাবে বা খাসভাবে কোন নিয়ত না করে তাহলে ‘আহলে বাইত’ বা পরিবার বলতে মানুষের ব্যবহারে যাদেরকে বুঝায় কিংবা ভাষাগতভাবে যাদেরকে বুঝায় তারা সকলে এর অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রথাগতভাবে ব্যক্তি যাদের ভরণপোষণ করে— স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়স্বজন তাদেরকে পরিবার বলে। আভিধানিক অর্থে পরিবার বলতে ব্যক্তির সেসব আত্মীয়দেরকে বুঝায় যারা তার নিজের বংশধর, তার পিতার বংশধর, তার দাদার বংশধর কিংবা তার প্রপিতামহের বংশধর।

একটি মেষ দিয়ে যাদের যাদের পক্ষ থেকে কোরবানী করা জায়েয একটি উটের সপ্তমাংশ কিংবা একটি গরুর এক সপ্তমাংশ দিয়ে তাদের সবার পক্ষ থেকে কোরবানী করা জায়েয। তাই, কেউ যদি এক সপ্তমাংশ উট দিয়ে কিংবা এক সপ্তমাংশ গরু দিয়ে তার পক্ষ থেকে, তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানী দেয় সেটা জায়েয হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম হাদির পশুর ক্ষেত্রে এক সপ্তমাংশ উট ও এক সপ্তমাংশ গরুকে একটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। অনুরূপ বিধান কোরবানীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। যেহেতু এক্ষেত্রে কোরবানী ও হাদির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

দুই:

দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একটি মেষ ক্রয়ে অংশীদার হয়ে সবার পক্ষ থেকে কোরবানী দেয়া জায়েয নয়। কেননা কুরআন-সুন্নাতে এই মর্মে কিছু উদ্ধৃত হয়নি। অনুরূপভাবে আট বা ততোধিক ব্যক্তি একটি উট কিংবা একটি গরুতে অংশীদার হওয়া জায়েয নেই (তবে সাতজনের একটি উটে কিংবা গরুতে অংশীদার হওয়া জায়েয আছে)। কেননা ইবাদতগুলো তাওকিফিয়্যা (দলিলের সীমায় বিধান সীমাবদ্ধ এমন)। এগুলোর ক্ষেত্রে নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না; সেটা সংখ্যাগত সীমা হোক কিংবা পদ্ধতিগত সীমা হোক। তবে, সওয়াবের ক্ষেত্রে অংশীদার করা যেতে পারে। যেমন সওয়াবের ক্ষেত্রে অগণিত মানুষকে অংশীদার করার কথা উল্লেখ আছে।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব