রমাদানে এবার কি করবো?

আসসালামুআলাইকুমওয়ারাহমাতুল্লাহ

অন্যান্যবারের তুলনায় এইবার আরো অন্তরের গভীরতর উপলব্ধি দিয়েই রমাদানকে বরন করা প্রয়োজন।

সারাবিশ্বে যে মহামারি সংক্রান্ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছি আমরা, এই অবস্থাকে সামনে রেখেই রমাদানকে সুন্দরভাবে বরন করে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।অনেকে এই করোনা ভাইরাস আক্রান্তকে যুদ্ধ বলেই আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু এটাকে যুদ্ধ না মনে করে পরীক্ষা মনে করে নিলে উত্তীর্ণ হওয়ার অবকাশ থাকে। এই করোনা আক্রমন রবের হুকুম ছাড়া কখনোই হতে পারে না। তাই এটাকে যুদ্ধ বলে অভিহিত করাটা সমিচীন মনে হয় না।মহান আল্লাহ আমাদের অনেক ভালো নিরাপদ ও নি’আমতে আচ্ছন্ন রেখেছিলেন ও রাখছেন। আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে এই নি’আমত ও নিরাপদ অবস্থার মর্যাদা রক্ষা করতে পারিনি, নিজেদের যোগ্যতা ও প্রযুক্তির উন্নয়নে রবের বিধানকে উপেক্ষা করে নিজেদের নফসের ইচ্ছাধীন জীবন-যাপনে অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম। অথচ হওয়ার কথা ছিলো রবের শুকরিয়ায় আরো আনুগত্যের জীবনে অভ্যস্থ হওয়া।

“এটা এইজন্য যে আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের নিকট দেয়া তাঁর অবদানকে পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই (তাদের কর্মনীতির মাধ্যমে) তা পরিবর্তন করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ”। সূরা আনফালঃ৫৩

আহসানুল বয়ানে বলা হয়েছে-এর অর্থ এই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতি বা গোষ্ঠী নিয়ামত অস্বীকারের পথ অবলম্বন করে এবং আল্লাহ তাআলার আদেশ ও নিষেধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের অবস্থা ও আচরণকে বদলে না নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তাদের উপর নিজ নিয়ামতের দরজা বন্ধ করে দেন না। দ্বিতীয় শব্দে আল্লাহ তাআলা পাপের কারণে নিজ নিয়ামতকে ছিনিয়ে নেন। আর আল্লাহ তাআলার এই নিয়ামতের অধিকারী হওয়ার জন্য জরুরী হল পাপ হতে দূরে থাকা। সুতরাং পরিবর্তনের অর্থ এই যে, জাতি পাপ-পঙ্কিলতাকে বর্জন করে আল্লাহর আনুগত্যের পথ অবলম্বন করে নিক।

তাফসিরে যাকারিয়াতে এসেছে-এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার নেয়ামতের স্থায়িত্বের জন্য এবং তা অব্যাহত রাখার জন্য একটি মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। “আল্লাহ্ তা’আলা কোন জাতিকে যে নেয়ামত দান করেন, তিনি তা ততক্ষণ পর্যন্ত বদলান না, যে পর্যন্ত না সে জাতি নিজেই নিজের অবস্থা ও কার্যকলাপ বদলে দেয়”। সুতরাং যে জাতিকে আল্লাহ তা’আলা কোন নেয়ামত দান করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তা তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেন না, যে পর্যন্ত না তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থা ও কার্যকলাপকে পরিবর্তিত করে আল্লাহ তা’আলার আযাবকে আমন্ত্রণ জানায়। এ আয়াতটির ভাষ্য অন্যত্রও বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে। আর কোন সম্প্রদায়ের জন্য যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছে করেন তবে তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক নেই।” [সূরা আর-রা’দ; ১১]
আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাকে বিবেক বুদ্ধি দান করেছেন এবং তাকে ভাল ও মন্দ উভয় পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, তার বিবেক-বুদ্ধিকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার স্বাধীনতাও দিয়েছেন আর এর দ্বারা তাকে পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছেন।

সুতরাং বর্তমান অবস্থায় আমাদের যা করনীয়-

১। তাওবা ও ইস্তেগফার

সর্বপ্রথম এই কাজটি করা প্রয়োজন। তাহলে নতুন করে আবার সব কিছুই রবের আনুগত্যে শুরু করার মাধ্যমে ইন শা আল্লাহ পরিস্থিতি সুন্দর করে দিবেন মহান রব।

আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “আর তোমরা ছুটে আস তোমাদের রবের ক্ষমার দিকে ও জান্নাতের দিকে; যার বিস্তৃতি আসমানসমূহ ও যমীনের মত, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা সুদিনে ও দুর্দিনে ব্যয় করে, যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল। আল্লাহ মুহ্‌সিনদেরকে ভালবাসেন। আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া পাপ ক্ষমা করার কে আছে? এবং তারা যা করে ফেলে, জেনে-বুঝে তারা তা উপর্যুপরি করতে থাকে না। তাদের পুরস্কার হলো তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং জান্নাতসমূহ; যেগুলোর পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে। সৎকর্মশীলদের পুরস্কার কতইনা উত্তম!”সূরা আলে ইমরান : ১৩৩-১৩৬

আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন: “বলুন, ‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছ– আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”সূরা যুমার : ৫৩

২। জ্ঞান অর্জন করা

জীবনের উদ্দেশ্য কি তা অহীর জ্ঞান দিয়ে জানতে হবে। বিশেষ করে যুব সমাজ যেনো জীবনের মূল উদ্দেশ্যকে জানতে বুঝতে পারে, কারন এটার সঠিক জ্ঞান ছাড়া রবের পথে ইস্তিকামাত থাকা সম্ভব নয়। এর সাথে আরো জানা প্রয়োজন

তাওহীদ,রিসালাত আখেরাত সম্পর্কে  এবং এই রমাদান মাস ও সাওম কি ও কেনো জানা প্রয়োজন।

৩। পূর্ব রমাদান মাসগুলোতে আমল না করতে পারার কারন সমূহ চিহ্নিত করাঃ

 জীবনের অনেক রমাদান চলে গিয়েছে। কেনো সুন্দর করে পরিকল্পিতভাবে রমাদান মাসগুলো ইবাদাতে কাজে লাগাতে পারি নি তা খুজে বের করা ও এই বছর যেনো সময় নষ্ট না হয় সেই কারনগুলো দূর করা। অনেকেই ভেবেছিলেন এইবার রমাদানে অনেককিছুই করবো কিন্তু এরইমাঝে করোনায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেই চলে গিয়েছেন আখেরাতের জীবনে।

তাই এই শিক্ষাকে সামনে রেখেই সচেতন হওয়া প্রয়োজন যে আমি নিজেও চলে যেতে পারি, ক্ষমা পাওয়ার সুযোগটা যেনো না হারাই।

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী (সাঃ) মিম্বরে আরোহণ করলেন, তারপর বললেন, আমীন, আমীন, আমীন। তাকে প্রশ্ন করা হল, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি মিম্বরে আরোহণ করে বললেন, আমীন আমীন আমীন?

রাসুল (সাঃ) বললেন, আমার নিকট জিবরীল (আঃ) এসেছিলেন, তিনি বললেন, যে ব্যক্তি রমাদান মাস পেল অথচ তাকে ক্ষমা করা হল না, অতঃপর সে জাহান্নামে প্রবেশ করলো, আল্লাহ তাকে রহমত বঞ্চিত করুন। বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন’’ সহীহ আত তারগীব আত তারহীব ৯৯৭ (আলবানি হাসান বলেছেন)

৪। মহান রবের কাছেই বেশী বেশী চাওয়া যেনো রমাদানে ইবাদাত করতে পারি, আজ মসজিদে যাওয়াটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, ইচ্ছে হলেও কেউ যেতে পারছে না। তাই রবের কাছেই নত হয়ে চাইতে হবে, মহান আল্লাহ যেনো আমাদের ইবাদাত করার সুযোগকে আবার সহজ করে দিন, আমরা দূর্বল- ভুল করে ফেলেছি, আমাদের ক্ষমা করে ইবাদাত করার সুযোগ করে দিন। যারা এতদিন রবের দরবারে মাথানত করেননি, এখন থেকে বেশী করে নিয়মিত শুরু করা অত্যাবশ্যক। হাশরের মাঠে রবের সামনে কোনভাবেই নত হতে পারবে না, তাদের ঘাড় আটকে যাবে কারন দুনিয়াতে তারা নত হয়নি।

৫। শিরক, হিংসা ও আমিত্ব থেকে নিজেদের পূর্ণ মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে আন্তরিকতার সাথে, কারন এইগুলোই জান্নাত থেকে সরিয়ে দেয়। ইবলিস এই দোষগুলো দিয়েই মানুষকে বঞ্চিত করতে চায় জান্নাত থেকে।

এই দোষগুলো থেকে মুক্ত হতে পারলেই ইন শা আল্লাহ রবের বান্দা হওয়ার যোগ্যতায় সফলতা আসবে, আর এর জন্য প্রয়োজন ইচ্ছার তীব্রতা ও সবরের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালানো।

রমাদান আসলে রাসূল স. কি করতেন-

সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন শ্রেষ্ঠ দানশীল। তিনি সবচেয়ে বেশি বদান্য হতেন রমজান মাসে; যখন জিব্রাইল (আঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন। জিব্রাইল (আঃ) প্রতি রাতে তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং একে অপরকে কুরআন পাঠ করে শুনাতেন। নিশ্চয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্ত বাতাস চেয়ে অধিক দানশীল  ছিলেন।

তাহলে দুটো কাজ বিশেষভাবে জানা যায় তা হলো কুর’আন পাঠ ও দান করা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কুর’আন পাঠ আরো বেশী সুযোগ এনে দিয়েছে যদি কেউ ইচ্ছে রাখেন আর এখনতো মানুষের মাঝে দান করাটা আরো জরুরী হয়ে পড়েছে। কত পরিবার দুবেলা খাবার যোগার নিয়েই শংকিত। একটি পরিবারকেও যদি শংকামুক্ত করতে পারি এটা অনেক বড় দান হবে ইন শা আল্লাহ।

যেহেতু সকলেই বেশী সময় বাসাতেই অবস্থান, বাইরে যেতে পারছে না,এই রমাদানকে পুরোপুরি রুটিনের আওতায় এনে আমল করার সুযোগ এনে দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।

পরিবারের সকলে জাম’আত বদ্ধ হতে হবে প্রথমে, একসাথে প্রতি ওয়াক্তের সালাত আদায় বাধ্যতামূলক করে নেই।

ড্রয়িংরুম অনেকেরই পড়ে থাকে বিভিন্ন সাজানো গুছানো করে, হয়তো তেমন ব্যবহারই হয় না। মসজিদের মত করে সাজিয়ে নিন ঘরকে। সালাতের ম্যাট রাখুন, কুর’আন, হাদীস বই গুছিয়ে নিন পড়ার জন্য।

সংযমের মাস যেনো ঘুম, খাওয়া ও ফেইসবুক নিয়ে না যায়, পরিমিতভাবে যেনো ভারসাম্য জীবনের অনুশীলন হয় সেই প্রশিক্ষন নেয়ার সুযোগ এসেছে, একজম প্রকৃত মুসলিমের জীবন রুটিন কিরুপ হওয়া প্রয়োজন সেই দিকে ফিরে আসার সময় আল্লাহ দিয়েছেন, আমরা যেনো কাজে লাগাই।

তারাবীহ সালাত ৮-২০ রাক’আত পরিবারের সাথে জাম’আতে আদায় করা। এইক্ষেত্রে পরামর্শ সালাতের জাম’আত সময় নির্ধারন করে ঘরে টানিয়ে নেয়া,যেনো সকলেই কাজ গুছিয়ে সালাতের জন্য চলে আসতে পারে।

শেষ দশদিন ইতিকাফের মত করেই রাত জেগে বাসায় আমল করা পরিবারের সকলকে নিয়ে।

যার যার অবস্থা অনুযায়ী একটা সময়ের আমলের ছক করে নিবেন। একটা নমুনা দেয়া হলো।

তাহাজ্জুদ সালাতঃ ভোর ৩টা উঠা

 সেহরী, ফযর সালাত পড়ার পর কুর’আন তেলাওয়াত করা ১ঘন্টা

 ইশরাক সালাত আদায় করে বিশ্রাম নেয়াঃ ৬টা-৯টা

সকাল ৯টা-১১টাঃ কুর’আন তেলাওয়াত/তাফসির/ দাওয়ার কাজ করা(মিডিয়া/ ফোন)

সকাল ১১টা- দুপুর ১.৩০ঃ সেহরী ও ইফতার প্রস্তুত করা

 দুপুর ১.৩০-২.৩০— গোসল, যোহর ও যিকির

 দুপুর ২.৩০-৩.৩০— বিশ্রাম

লেকচার শুনা ( রাসূল স.এর জীবনী)— ৩.৩০-৪.৩০

কুর’আন অর্থসহ পড়া—৪.৩০- ৫.১৫

আসর সালাত ও বিকালের যিকির—৫.১৫-৬টা

পরিবারের সকলে মিলে ইফতার টেবিলে দেয়া- সন্ধ্যা ৬টা

যিকির ও দরুদ, দু’আ  পড়া ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত

ইফতার ও মাগরিব সালাত- ৬.১৫-৭টা

বিশ্রামঃ সন্ধ্যা ৭টা-৮টা পর্যন্ত( ব্যক্তিগত কাজ হতে পারে)

কুর’আন/হাদীস/ দু’আ মুখস্থঃ রাত ৮টা-৮.৩০

ইশা সালাত ও তারাবী সালাতঃ ৮.৩০-৯.৩০

সূরা মূলক ও সূরা সাজদাহ সহ ঘুমের পূর্বের যিকির আদায় করে ঘুমিয়ে পড়া রাত ১০টা।

প্রতিদিনই দান করার সুযোগ করে নেয়া, ইফতার করানোর সুযোগ নেয়া, মাঝে মাঝেই আত্মীয় প্রতিবেশীদের খোজ নেয়া।

মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন আমল করার। আমাদের পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিন সহজ করে দিন এবং কবুল করে নন অনুগত ক্ষমাপ্রাপ্ত বান্দা হিসেবে।