রজব মাসকে জানি

প্রতি বছর ঘুরে আমাদের মাঝে মাহে রামাদান এসে থাকে। রামাদান মাসের পূর্বে আমরা অবস্থান করছি রজব মাসে যা হারাম বা পবিত্র মাস সমূহের মধ্যে একটি।। মহান আল্লাহ তা’লা আমাদের জানিয়েছেন এই পবিত্র মাস সম্পর্কে।

মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ سُبْحَانَ اللَّهِ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

(হে নবী, তুমি তাদের বলো) তোমার মালিক যা চান তাই তিনি সৃষ্টি করেন এবং (তাদের জন্যে) যে বিধান তিনি পছন্দ করেন তাই (তিনি জারী করেন, এ ব্যাপারে) তাদের কারোই কোনো ক্ষমতা নেই, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’লা মহান, ওদের শিরক থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে।      সূরা আল কাসাস: ৬৮

মহান আল্লাহ নিজ সত্ত্বায় প্রশংসিত। তিনি অতিশয় সুক্ষদর্শী, সর্ব জ্ঞানী, সুবিজ্ঞ, সর্ব ক্ষমতার অধিকারী, সুতরাং তিনি যা করেন তার পেছনে এই সবগুলো গুণ কাজ করে। মহান আল্লাহ কতগুলো দিনকে অন্য দিনের উপর যেমন প্রাধান্য দিয়েছেন, তেমনি কিছু মাসকেও অন্যান্য মাসের তুলনায় প্রাধান্য দিয়েছেন।

আল্লাহ তা’লা বলেন:

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ

আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহ তা’লার বিধানে মাসের সংখ্যা লেখা ছিল বারোটি, এই (বারোটির) মধ্যে চারটি হচ্ছে (যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্যে) নিষিদ্ধ মাস। এটা (আল্লাহর প্রণীত) নির্ভুল ব্যবস্থা। অতএব এই সময়ের ভিতরে তোমরা নিজেদের উপর যুলুম করো না।                     সুরা আত তওবা: ৩৬

এই মাসগুলোর হিসেব করা হয় চাঁদের গতিকে হিসেব করে।

মহান আল্লাহ এভাবেই আমাদের জানিয়েছেন:

﴿هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُورًا وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ

তিনি সূর্য্য (প্রখর) তেজোদ্যীপ্ত, চাঁদকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তাদের কক্ষপথও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যেন তোমরা বছর ও তারিখ গননা করতে পারো।        সূরা ইউনুস: ৫

হাদীস থেকে আমরা পবিত্র বা হারাম মাসের নামগুলো জানতে পারি।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

নিশ্চয়ই আবর্তনের পথ ধরে মহাকাল আজ তার সেই প্রারম্ভিক বিন্দুতে প্রত্যাবর্তন করেছে, যেখানে সে আল্লাহ কর্তৃক আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিনে ছিল। আল্লাহর কাছে মাস সুনিশ্চিতভাবেই বারোটাই। যখন আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই তাঁর অদৃষ্ট লিপিতে মাসের সংখ্যা এভাবেই লেখা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে চারটি মাস নিষিদ্ধ। তিনটি মাস ধারাবাহিক – জিলকদ, জিলহজ্জ ও মুহাররম। আর একটির অবস্থান একাকী অর্থাৎ রজব মাস, যা জমাদিউস সানী ও শা’বানের মাঝখানে অবস্থিত।  সহীহ আল বুখারী: ১৭৪১

পবিত্র মাসগুলো হলো — রজব, জিলকদ, জিলহজ্জ এবং মুহাররম।

এই মাসগুলোকে পবিত্র বলা হয় এই কারণে যে —

এই মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষেধ, তবে শত্রুপক্ষ আগে আঘাত করলে সেক্ষেত্রে প্রতিরক্ষার জন্য প্রতিরোধ করতে পারবে।

যে কোন সময় গুনাহের কাজ করা স্বাভাবিক ভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ, কিন্তু এই মাসগুলোতে অন্য সময়ের তুলনায় আরো জোড়ালোভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ আরো বলেছেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُحِلُّوا شَعَائِرَ اللَّهِ وَلَا الشَّهْرَ الْحَرَامَ .

হে ঈমানদার বান্দারা, তোমরা আল্লাহ তা’লার নিদর্শনসমূহের অসম্মান করো না, সম্মানিত মাসগুলোকেও না।     সূরা আল মায়েদা: ২

সুতরাং, এই পবিত্র মাসগুলোতে যেন আমরা গুনাহের কাজে না জড়িয়ে পড়ি তার প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে যদিও সবসময়েও গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। নেতিবাচক কাজ যা নিজের উপর যুলুম হয় তা থেকেও দূরে থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মহান আল্লাহ তা’লা আমাদের বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুন।

মহান আল্লাহ ও রাসূল সা. আমাদেরকে যেভাবে যতটুকু আনুষ্ঠানিক ইবাদাতের পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন যা আমরা পবিত্র কোরআন ও সহীহ হাদীস থেকে জানতে পারি ততটুকুই আমাদের করতে হবে, এই ক্ষেত্রে নতুন করে কিছু বাড়ানো বা কমানো যাবে না। মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।                                                                                                                                                                      সূরা আল আহযাব: ৩৬

মুমিনদের বক্তব্য কেবল এ কথাই – যখন তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে তাদেরকে আহবান করা হয়, তখন তারা বলে: আমরা শুনলাম ও আদেশ মান্য করলাম। তারাই সফলকাম। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর শাস্তি থেকে বেঁচে থাকে তারাই কৃতকার্য।    সূরা আন নূর: ৫১-৫২

দীনের ভিতর নতুন কিছু সংযোজন অত্যন্ত কঠিন গুনাহ এবং এটাকেই বলে বিদয়াত। আবে কাউসারের পানি রাসূলের উম্মত হিসেবে এই বিদয়াতকারীরা পান করতে পারবে না তাদেরকে ফেরেশতারা হাকিয়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে। মহান আল্লাহ সুবহান নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে দীনকে পূর্ণতা দান করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত এই বিধানই জারি থাকবে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন:

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ  করে দিলাম, আর তোমাদের উপর আমার(প্রতিশ্রুত) নিয়ামতকেও আমি পূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের জন্য জীবনের ব্যবস্থা হিসাবে আমি ইসলামকেই মনোনীত করলাম।    সূরা আল মায়েদা: ৩

রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেননি তা তাঁর নামে হাদীসে উল্লেখ করে বলা গুনাহের কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

নিশ্চয়ই আমার উপর মিথ্যা বলা অন্য যে কারোর উপর মিথ্যা বলার মত নয়। যে আমার ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা বলল সে জাহান্নামের আগুনে তার স্থান করে নিল।  সহীহ আল বুখারী: ১৩৯১

সহীহ হাদীসের আলোকে শুধুমাত্র রজব মাসের জন্য নির্দিষ্ট কোন নামাজ, রোজা, কবর যিয়ারত এবং উমরার কোন বিশেষত্ব আলাদা ভাবে আসে নাই। তাই এই মাসকে নির্দিষ্ট করে হাদীসের নামে যদি এই ধরনের আমল করা হয় তা বিদয়াত হিসেবেই গণ্য হবে। তবে আমলের ব্যাপারে যদি এমনিতেই অন্যান্য মাসে যে ভাবে করে থাকেন সেভাবে কেউ করেন তাতে কোন অসুবিধা নেই। সোমবার ও বৃহস্পতিবার, আইয়্যামে বীযের রোযা (আরবী মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ) বা অন্য দিনে এমনি নফল রোযা রাখলে (রজব মাস হিসেবে নয়) তাতে কোন অসুবিধা নেই। উমরার ব্যাপারে কেউ যদি রজব মাসের আলাদা বিশেষত্ব হিসেবে না মনে করে  এমনিতেই তার সময় সুযোগ সুবিধার জন্য ওমরা বা মক্কায় ভিজিট করতে যান তাতে অসুবিধা নেই। এই ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে দেখুন   www.islamqa

তবে আমরা পবিত্র মাহে রমজান মাসকে সামনে রেখে এখন থেকেই প্রস্তুতি নেই যেন সাওমের শিক্ষাকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিতে পারি এবং পবিত্র রামাদান মাসের সকল ফায়দাগুলো আদায় করতে সক্ষম হই। আল্লাহ তা’লা আমাদের বুঝার ও আমল করার তৌফীক দান করুন।

আবু বাকর আল-বালখী বলেছেন:

রজব মাস হলো বীজ বপনের মাস, শা’বান মাস হল ক্ষেতে সেচ প্রদানের মাস এবং রামাদান মাস হল ফসল তোলার মাস। তিনি আরও বলেছেন:

রজব মাসের উদাহরণ হলো বাতাসের ন্যায়, শা’বান মাসের উদাহরণ মেঘের ন্যায়, রামাদান মাসের উদাহরণ বৃষ্টির ন্যায়, তাই যে রজব মাসে বীজ বপন করলো না, শা’বান মাসে সেচ প্রদান করলো না, সে কিভাবে রামাদান মাসে ফসল তুলতে চাইতে পারে?

ভালো ফসল পেতে হলে কৃষককে খুব পরিশ্রমী ও সজাগ সচেতন হতে হয়। জমিতে মাটি ঠিক ভাবে তৈরী হলো কিনা, আগাছা বা কীটপতঙ্গ বা পশু এসে বীজের ক্ষতি করে ফেলছে কি না তা কৃষক প্রতিনিয়ত পাহারা দিতে থাকে, নব প্রযুক্তি দিয়ে কিভাবে আরো উন্নত ফলন হতে পারে তার খোঁজ নিতে সময় ও মেধাকে কাজে লাগায়। জ্ঞানী একজনের কাছে আরো ভালো ফলনের জন্য পরামর্শ করে। সর্বোপরি মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চায় যেন ফলন ভালো হয়, কারণ সে জানে সব কিছু করার পরও মহান আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই হবে না। সে মহান আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ভরসা রেখে পরিশ্রম করতে থাকে।

আমরা কি এখন থেকেই আমাদের চিন্তা ভাবনাকে রামাদান মাসের ফলন ভালো পাবার জন্য মহান আল্লাহ তা’লার ঐরকম পরিশ্রমী বান্দা হতে পারি না!!

এখন থেকে আমরা যদি পরিকল্পিত ভাবে নিজেদের কাজগুলোকে প্রতিদিনের জন্য ভাগ করে তালিকাভুক্ত করে নেই তাহলে ইনশা’আল্লাহ আমাদের কাজগুলোর সাথে সময়ের সমন্বয় করতে পারবো।

একটু এইভাবে যদি চিন্তা করি যে, আমি হাশরের মাঠে হাযির হয়ে গেলাম আর আমার আমলনামা দেয়া হলো, যদি ফলাফল ফেল হয় তাহলে তখন তো আবার ফিরে আসার কোন সুযোগ নেই যে আবার পূনঃপরীক্ষা দিবো।

মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَلَوْ تَرَى إِذِ الْمُجْرِمُونَ نَاكِسُو رُءُوسِهِمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ رَبَّنَا أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوقِنُونَ (12) وَلَوْ شِئْنَا لَآتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدَاهَا وَلَكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّي لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ (13) فَذُوقُوا بِمَا نَسِيتُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا إِنَّا نَسِينَاكُمْ وَذُوقُوا عَذَابَ الْخُلْدِ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ (14)

হায়! সেই সময়টা যদি তুমি দেখতে যখন অপরাধী তার প্রভুর সামনে অবনত মস্তকে দাঁড়াবে এবং বলবে: হে আমার প্রতিপালক! এবার আমরা দেখে নিয়েছি এবং শুনতেও পেয়েছি, এখন আমাদেরকে ফিরিয়ে দাও, আমরা ভালো কাজ করবো, এবার আমরা প্রত্যয় লাভ করেছি। কিন্তু বলা হবে, এবার তোমরা সেই অবহেলার স্বাদ গ্রহণ করো যে কারণে তোমরা এই দিন আমাদের সামনে হাযির হওয়ার ব্যাপারকে ভুলে গিয়েছিলে। আজকে আমরাও তোমাদেরকে ভুলে গিয়েছি। সুতরাং তোমরা যে আমল করতে তার বিনিময়ে আজ চিরস্থায়ী আযাবের স্বাদ গ্রহণ কর।                                       সূরা আস সাজদা: ১২-১৪

তাই আমরা এখন থেকেই নিজের আমলনামার হিসেব প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে পর্যালোচনা করে দেখি, আমি ভালো-মন্দের কোন অবস্থায় আছি? প্রতিদিন একটি বেলা করে জীবন চলে যাচ্ছে মূল ঠিকানা কবরের দিকে। একেক ঘটনা/কমিটমেন্ট/সমস্যাকে পার করতে করতে আরেকটি ব্যস্ততা এসে যায়। আর এইভাবেই মাস ঘুরে বছরও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের অবস্থানকে কোথায় নিতে পেরেছি? আমরা কি নিজেদের সংশোধন করে এগিয়ে নিতে পারছি মহান রবের নৈকট্য লাভের দিকে?

মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (18) وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ)

হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ তা’লাকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তিই যেন খেয়াল রাখে যে, সে আগামী দিনের জন্য কি ব্যবস্থা রেখেছে। আর তোমরা ভয় করো আল্লাহ তা’লাকে। আল্লাহ নিশ্চিতই তোমাদের সেই সব আমল সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা করতে থাকো। তোমরা সেই লোকদের মত হয়ে যেও না যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা বানিয়ে দিয়েছেন। এসব লোকেরাই ফাসেক।                                            সুরা আল হাশর: ১৮-১৯

রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

আল্লাহ তা’লা বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি নিজেকে আমার ইবাদাতের জন্য মুক্ত করে দাও, আমি তোমার বক্ষকে ঐশ্বর্য ও অভাবহীনতা দিয়ে পূর্ণ করে দিব। তোমার দারিদ্র ও অভাব দূর করে দিব। আর যদি তা না করো, তবে আমি তোমার অন্তরকে ব্যস্ততা দিয়ে পূর্ণ করবো এবং তোমার দারিদ্র দূর করব না।            আল জামে আত তিরমিযী ও ইবনে মাজা

প্রতিটি মানুষই চায় দুনিয়ার জীবনে ভালোভাবে জীবন যাপন করতে। মুমিন ব্যক্তি বা রহমানের বান্দারা চায় দুনিয়াতে শান্তি ও আখেরাতের মুক্তি। মহান আল্লাহ এইভাবে দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন:

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ দান কর এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।  সূরা আল বাকারা: ২০১

দুনিয়ার জীবনকে কাজে লাগিয়েই আখেরাতের জীবনকে শান্তিময় করতে হবে। প্রযুক্তিগত যত উন্নয়ন হবে মানুষের চিন্তাধারায় আরো বেশী জ্ঞানের আলো/বুঝার শক্তি বেড়ে যাবে যা দিয়ে সে আল্লাহ তা’লার আরো প্রিয় হবার সুযোগ পাবে। কিন্তু সেজন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং তা হতে হবে পরিকল্পিতভাবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব প্রদান করতে শিখিয়েছেন:

১। বার্ধক্য আসার আগে যৌবনকে

২। রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে

৩। দারিদ্র আসার পূর্বে স্বচ্ছলতাকে

৪। ব্যস্ত হয়ার পুর্বে অবসর সময়কে

৫। মৃত্যু আসার পূর্বে জীবনকে

মিশকাত শরীফ

কিন্তু দেখা যায় অবসর পেলে অনেকেই আমরা একটু শুয়ে বসে গল্প করে কাটিয়ে দেই, আবার অসুস্থ হলে তখন আফসোস করে বলতে থাকি যে, সুস্থ থাকলে ভালো আমলগুলো করতাম। এইভাবেই জীবনের মূল্যবান সময়গুলোকে বিনা পারিশ্রমিকে শেষ করে দিচ্ছি। সচেতন ব্যক্তিরা কিন্তু নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সব সময়ই সাবধান থেকে সময়ের সাথে সাথে কাজকে বাস্তবায়ন করেই যাচ্ছেন। তারা কিন্তু বলেন না যে, আজ নয় আগামীকাল করবো, বরং এই ধরনের ব্যক্তিরা বলেন, কোন কাজটা এখন করব, আর অন্যটা এর পরে করে ফেলব ইনশা’আল্লাহ। আগামী দিনের জন্য কাজ ফেলে রাখে তারাই যারা অলস ও পরিকল্পনাহীন ভাবে সময় পার করেন।

বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য হলো তার সময়কে ভাগ করে নেয়া। কিছু সময় ব্যয় করবে তার প্রভুর প্রার্থনায়, কিছু সময় ব্যয় করবে আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল বিষয়ে চিন্তা করে, কিছু সময় রাখবে আত্মসমীক্ষার জন্য এবং কিছু সময় ব্যয় করবে জীবিকার প্রয়োজনে। (ইবনে হিব্বান)

কাজ মূলত তিন ধরনের:

১। নিজের প্রতি কর্তব্য ২। স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য ৩। সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য

তাই সময়কে কাজের সাথে সমন্বয় করে নিতে হবে। মহান আল্লাহ বলেছেন:

আর মানুষ ততটুকু ফল লাভ করবে যতটুকু চেষ্টা সে করেছে, তার প্রচেষ্টা শিগগীরই দেখে নেয়া হবে। অতঃপর সে পুরোপুরি ফল লাভ করবে। আর পরিশেষে সবাইকে তোমাদের প্রতিপালকের কাছেই পৌঁছাতে হবে।  সূরা নাজম: ৩৯-৪২

যে কোন ভালো কাজের পরিকল্পনা করলেই নেকী লেখা হয়, আর সেটা বাস্তবায়ন করলে সেই নেকী বৃদ্ধি হতে থাকে। তাই আমরা আমাদের পরিকল্পনা করে নেই এবং সেটা বাস্তবায়ন শুরু করি মহান আল্লাহর নামে।

হাদীসে কুদসীতে এসেছে, মহান আল্লাহ তা’লা বলেন, বান্দা যখন আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, আমি তখন তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই। আর যখন সে আমার দিকে একহাত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক কায়া পরিমাণ এগিয়ে যাই। আর সে যখন আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই। সহীহ আল বুখারী

রজব মাসে রোজা রাখার বিশেষ কোন ফজিলতের কথা বর্ণিত আছে কী?

উত্তর

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরজন্য।

এক:

রজব মাস হারাম মাসসমূহের একটি। যে হারাম মাসসমূহের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:….[সূরা তাওবা, আয়াত: ৩৬] হারাম মাসগুলো হচ্ছে- রজব, যুলক্বদ, যুলহজ্জ ও মুহররম মাস।

বুখারি (৪৬৬২) ও মুসলিম (১৬৭৯) আবু বকরা (রাঃ) থেকে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “বছর হচ্ছে- বার মাস। এর মধ্যে চার মাস- হারাম (নিষিদ্ধ)। চারটির মধ্যে তিনটি ধারাবাহিক: যুলক্বদ, যুলহজ্জ, মুহররম ও (মুদার গোত্রের) রজব মাস; যে মাসটি জুমাদাল আখেরা ও শাবান মাস এর মধ্যবর্তী।”

এ মাসগুলোকে ‘হারাম’ আখ্যায়িত করা হয় দুইটি কারণে:

১. এ মাসগুলোতে যুদ্ধ হারাম হওয়ার কারণে। তবে শত্রু যদি প্রথমে যুদ্ধের সূত্রপাত করে সেটা ভিন্ন ব্যাপার।

২. এ মাসগুলোতে হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া অন্য মাসে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে বেশি গুনাহ।

তাই আল্লাহ তাআলা এ মাসগুলোতে গুনাতে লিপ্ত হওয়া নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন: “এগুলোতে তোমরা নিজেদের উপর জুলুম করো না”[সূরা তওবা, আয়াত: ৩৬] যদিও এ মাসগুলোতে পাপে লিপ্ত হওয়া যেমন নিষিদ্ধ তেমনি অন্য যে কোন মাসে পাপে লিপ্ত হওয়া নিষিদ্ধ; তদুপরি এ মাসগুলোতে পাপে লিপ্ত হওয়া অধিক গুনাহ।

শাইখ সা’দী (রহঃ) (পৃষ্ঠা-৩৭৩) বলেন:

“এগুলোতে তোমরা নিজেদের উপর জুলুম করো না” এখানে সর্বনামের একটা নির্দেশনা হতে পারে- বার মাস। আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি এ মাসগুলো মানুষের হিসাব রাখার সুবিধার্থে সৃষ্টি করেছেন। এ মাসগুলোতে তাঁর ইবাদত করা হবে। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে এবং মানুষের কল্যাণের মাধ্যমে অতিবাহিত করা হবে। অতএব, এ মাসগুলোতে স্বীয় আত্মার উপর জুলুম করা থেকে সাবধান হোন।

আরেকটি সম্ভাবনা রয়েছে এখানে সর্বনামটি চারটি হারাম মাসকে নির্দেশ করছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে- এ মাসগুলোতে জুলুম করা থেকে বিরত থাকার বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারী করা। যদিও যে কোন সময় জুলুম করা নিষিদ্ধ। কিন্তু এ মাসগুলোতে জুলুমের গুনাহ বেশি মারাত্মক। সমাপ্ত

দুই:

কিন্তু রজব মাসে রোজা রাখা বা রজব মাসের কিছু অংশে রোজা রাখার ব্যাপারে কোন সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়নি। কিছু কিছু মানুষ রজব মাসের বিশেষ ফজিলত রয়েছে মনে করে এ মাসের বিশেষ কিছু দিনে যে রোজা রাখে এ ধরণের বিশ্বাসের কোন ভিত্তি নেই।

তবে হারাম মাসসমূহে (রজব একটি হারাম মাস) রোজা রাখা মুস্তাহাব মর্মে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদিস বর্ণিত আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “হারাম মাসগুলোতে রোজা রাখ; এবং রোজা ভঙ্গও কর”[আবু দাউদ, হাদিস নং- ২৪২৮, আলবানী হাদিসটিকে যয়ীফ বা দুর্বল বলেছেন]

এ হাদিসটি যদি সাব্যস্ত হয় তাহলে হারাম মাসে রোজা রাখা মুস্তাহাব প্রমাণ হবে। অতএব, যে ব্যক্তি এ হাদিসের ভিত্তিতে রজব মাসে রোজা রাখে এবং অন্য হারাম মাসেও রোজা রাখে এতে কোন অসুবিধা নেই। তবে রজব মাসকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে রোজা রাখা যাবে না।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) মাজমুউল ফাতাওয়া (২৫/২৯০) গ্রন্থে বলেন:

পক্ষান্তরে রজব মাসে রোজা রাখা সংক্রান্ত সবগুলো হাদিস দুর্বল; বরঞ্চ মাওযু (বানোয়াট)। আলেমগণ এর কোনটির উপর নির্ভর করেন না। ফজিলতের ক্ষেত্রে যে মানের দুর্বল হাদিস বর্ণনা করা যায় এটি সে মানের নয়। বরং এ সংক্রান্ত সবগুলো হাদিস মাওজু (বানোয়াট) ও মিথ্যা।

মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি হারাম মাসসমূহে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হারাম মাসগুলো হচ্ছে- রজব, যুলক্বদ, যুলহজ্জ, মুহাররম। এটি চারটি মাসের ব্যাপারেই এসেছে। বিশেষভাবে রজব মাসের ব্যাপারে নয়। সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত

ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন:

“রজব মাসে রোজা রাখা ও নফল নামায পড়ার ব্যাপারে যে কয়টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে সব ক’টি মিথ্যা”[আল মানার আল-মুনিফ, পৃষ্ঠা- ৯৬]

ইবনে হাজার (রহঃ) ‘তাবয়িনুল আজাব’ (পৃষ্ঠা- ১১) বলেন:

রজব মাসের ফজিলত, এ মাসে রোজা রাখা বা এ মাসের বিশেষ বিশেষ দিনে রোজা রাখার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন কিছু বর্ণিত হয়নি। অথবা এ মাসের বিশেষ কোন রাত্রিতে নামায পড়ার ব্যাপারে সহিহ কোন হাদিস নেই। সমাপ্ত

শাইখ সাইয়্যেদ সাবেক (রহঃ) “ফিকহুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে (১/৩৮৩) বলেন:

অন্য মাসগুলোর উপর রজব মাসের বিশেষ কোন ফজিলত নেই। তবে এটি হারাম মাসসমূহের একটি। এ মাসে রোজা রাখার বিশেষ কোন ফজিলত কোন সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়নি। এ বিশেষ যে ক’টি বর্ণনা রয়েছে এর কোনটি দলিল হিসেবে গ্রহণ করার উপযুক্ত নয়। সমাপ্ত

শাইখ উছাইমীনকে ২৭ শে রজব সিয়াম ও কিয়াম পালনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন: “সবিশেষ মর্যাদা দিয়ে ২৭ শে রজব সিয়াম ও কিয়াম পালন- বিদআত। আর প্রত্যেকটি বিদআতই ভ্রান্তি।” সমাপ্ত [মাজমুউ ফাতাওয়াস শাইখ উছাইমীন, (২০/৪৪০)]

ইসলাম জিজ্ঞাসাও জবাব(  https://islamqa.info/bn/answers/75394/%E0%A6%B0%E0%A6%9C%E0%A6%AC-%E0%A6%AE%E0%A6%B8-%E0%A6%B0%E0%A6%9C-%E0%A6%B0%E0%A6%96)

 

ইসরা ও মেরাজ