সম্মানিত মাস মুহাররম-৯( কারবালার ঘটনা ও শিক্ষা )

কারবালার ঘটনা ও শিক্ষা

 

রাসূল স. এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের নেতৃত্বে চল্লিশ বছর পর্যন্ত যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তার শাসনতন্ত্রের মৌলিক বিশেষত্ব লোপ পেতে যাচ্ছিল ইয়াযিদের উত্তরাধিকারসূত্রে  কর্তৃত্ব দখলের দ্বারা।

হযরত আবু বকর রা. থেকে আমীর মুয়াবিয়া রা. পর্যন্ত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস একথা প্রমান করে যে,কর্তৃত্ব লাভের জন্যে যুদ্ধ বিগ্রহ এবং রক্তপাত ঘটনা কখনো তাঁদের নীতি ছিল না।

তৎকালে হযরত ইমাম হোসাইন রা. এর দৃষ্টি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি, প্রানশক্তি এবং ব্যবস্থার মধ্যে  বিরাট পরিবর্তনের পূর্বাভাস লক্ষ্য করছিলেন এবং এর গতিরোধ করার জন্য সবধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া তাঁর নিকট অত্যধিক প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। ইয়াযিদের যৌবরাজ্যে অধিষ্টা,তারপর সিংহাসনারোহনের ফলে আসলে যে ত্রুটির সূচনা হচ্ছিল,তা ছিল ইসলামের ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, তার প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তন। ইমাম হোসাইন রা. এর ভূমিকা ছিল একজন মুমিন হিসেবে ঈমানের দাবী।

ইমাম ইবনে কাসীর র. বলেন: প্রতিটি মুসলিমের উচিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৌহিত্র সায়্যেদ হোসাইন বিন আলী রা. এর কারবালার প্রান্তরে শহীদ হওয়ার ঘটনায় ব্যথিত হওয়া ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তিনি ছিলেন মুসলিম জাতির নেতা ও ইমামদের অন্যতম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশ্রেষ্ঠ কন্যা ফাতেমার পুত্র ইমাম হোসাইন রা. একজন বিজ্ঞ সাহাবী ছিলেন। তিনি ছিলেন একধারে এবাদত গুজার, দানবীর এবং অত্যন্ত সাহসী বীর। হাসান ও হোসাইনের ফযিলতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  থেকে একাধিক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অন্তর দিয়ে তাদেরকে ভালবাসা ঈমানের অন্যতম আলামত এবং নবী পরিবারের কোন সদস্যকে ঘৃণা করা ও গালি দেয়া মুনাফেকির সুস্পষ্ট লক্ষণ। যাদের অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত কেবল তারাই ইমাম হোসাইন বা নবী পরিবারের পবিত্র সদস্যদেরকে ঘৃণা করতে পারে।

৬০ হিজরিতে ইরাক বাসীদের নিকট সংবাদ পৌঁছল যে, হোসাইন রা. ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়ার হাতে বাইয়াত করেন নি। তারা তাঁর নিকট চিঠি-পত্র পাঠিয়ে জানিয়ে দিল যে ইরাক বাসীরা তাঁর হাতে খেলাফতের বাইয়াত করতে আগ্রহী। ইয়াযিদকে তারা সমর্থন করেন না বলেও সাফ জানিয়ে দিল। তারা আরও বলল যে, ইরাক বাসীরা ইয়াযিদের পিতা মুয়াবিয়া রা. এর প্রতিও মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। চিঠির পর চিঠি আসতে লাগল। এভাবে পাঁচ শতাধিক চিঠি হুসাইন রা.এর কাছে এসে জমা হল।

প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য হোসাইন রা. তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে পাঠালেন। মুসলিম কুফায় গিয়ে পৌঁছলেন। গিয়ে দেখলেন, আসলেই লোকেরা হোসাইনকে চাচ্ছে। লোকেরা মুসলিমের হাতেই হোসাইনের পক্ষে বাইয়াত নেওয়া শুরু করল। হানী বিন উরওয়ার ঘরে বাইয়াত সম্পন্ন হল।

সিরিয়াতে ইয়াযিদের নিকট এই খবর পৌঁছা মাত্র বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য পাঠালেন। ইয়াযিদ উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে আদেশ দিলেন যে, তিনি যেন কুফা বাসীকে তার বিরুদ্ধে হুসাইনের সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেন। সে হুসাইনকে হত্যা করার আদেশ দেন নি।

উবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি বিষয়টি তদন্ত করতে লাগলেন এবং মানুষকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। পরিশেষে তিনি নিশ্চিত হলেন যে, হানী বিন উরওয়ার ঘরে হুসাইনের পক্ষে বয়াত নেওয়া হচ্ছে।

অতঃপর মুসলিম বিন আকীল চার হাজার সমর্থক নিয়ে অগ্রসর হয়ে দ্বিপ্রহরের সময় উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করলেন। এ সময় উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি ইয়াযিদের সেনা বাহিনীর ভয় দেখালেন। তিনি এমন ভীতি প্রদর্শন করলেন যে, লোকেরা ইয়াযিদের ধরপাকড় এবং শাস্তির ভয়ে আস্তে আস্তে পলায়ন করতে শুরু করল।  কুফা বাসীদের চার হাজার লোক পালাতে পালাতে এক পর্যায়ে মুসলিম বিন আকীলের সাথে মাত্র তিন জন লোক অবশিষ্ট রইল। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুসলিম বিন আকীল দেখলেন, হুসাইন প্রেমিক আল্লাহর একজন বান্দাও তার সাথে অবশিষ্ট নেই। এবার তাকে গ্রেপ্তার করা হল। উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ তাকে হত্যার আদেশ দিলেন। মুসলিম বিন আকীল উবাইদুল্লাহ এর নিকট আবেদন করলেন, তাকে যেন হুসাইনের নিকট একটি চিঠি পাঠানোর অনুমতি দেয়া হয়। এতে উবাইদুল্লাহ রাজী হলেন। চিঠির সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল এ রকম:

হোসাইন! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও। কুফা বাসীদের ধোঁকায় পড়ো না। কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে। আমার সাথেও তারা সত্য বলেনি। আমার দেয়া এই তথ্য মিথ্যা নয়।

অতঃপর যুল হজ্জ মাসের ৯ তারিখ আরাফা দিবসে উবাইদুল্লাহ মুসলিমকে হত্যার আদেশ প্রদান করেন। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, মুসলিম ইতিপূর্বে কুফা বাসীদের ওয়াদার উপর ভিত্তি করে হুসাইনকে আগমনের জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠির উপর ভিত্তি করে যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখে হুসাইন রা. মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। অনেক সাহাবী তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফীয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ইবনে উমর হোসাইনকে লক্ষ্য করে বলেন: হুসাইন! আমি তোমাকে একটি হাদীস শুনাবো। জিবরীল আ: আগমন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া এবং আখিরাত এ দুটি থেকে যে কোন একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি দুনিয়া বাদ দিয়ে আখিরাতকে বেছে নিয়েছেন। আর তুমি তাঁর অংশ। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কেউ কখনই দুনিয়ার সম্পদ লাভে সক্ষম হবেন না। তোমাদের ভালর জন্যই আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন। হোসাইন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং যাত্রা বিরতি করতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর ইবনে উমর হোসাইনের সাথে আলিঙ্গন করে বিদায় দিলেন এবং ক্রন্দন করলেন।

সুফীয়ান ছাওরী ইবনে আব্বাস রা. থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাস রা. হোসাইনকে বলেছেন: মানুষের দোষারোপের ভয় না থাকলে আমি তোমার ঘাড়ে ধরে বিরত রাখতাম।

বের হওয়ার সময় আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. হোসাইনকে বলেছেন: হোসাইন! কোথায় যাও? এমন লোকদের কাছে, যারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে এবং তোমার ভাইকে আঘাত করেছে?

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেছেন: হোসাইন তাঁর জন্য নির্ধারিত ফয়সালার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছেন। আল্লাহর শপথ! তাঁর বের হওয়ার সময় আমি যদি উপস্থিত থাকতাম, তাহলে কখনই তাকে যেতে দিতাম না। তবে বল প্রয়োগ করে আমাকে পরাজিত করলে সে কথা ভিন্ন। (ইয়াহ্-ইয়া ইবনে মাঈন সহীস সূত্রে বর্ণনা করেছেন)

যাত্রা পথে হোসাইনের কাছে মুসলিমের সেই চিঠি এসে পৌঁছল। চিঠির বিষয় অবগত হয়ে তিনি কুফার পথ পরিহার করে ইয়াযিদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার পথে অগ্রসর হতে থাকলেন। পথিমধ্যে ইয়াযিদের সৈন্যরা আমর বিন সাদ, সীমার বিন যুল জাওশান এবং হুসাইন বিন তামীমের নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের গতিরোধ করল।

সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে হোসাইনের সাথী ও ইয়াযিদের সৈনিকদের মধ্যে বিরাট ব্যবধান ছিল। হোসাইনের সামনেই তাঁর সকল সাথী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হলেন। অবশেষে তিনি ছাড়া আর কেউ জীবিত রইলেন না। তিনি ছিলেন সিংহের মত সাহসী বীর। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের মুকাবিলায় তার পক্ষে ময়দানে টিকে থাকা সম্ভব হল না। কুফা বাসী প্রতিটি সৈনিকের কামনা ছিল সে ছাড়া অন্য কেউ হোসাইনকে হত্যা করে ফেলুক। যাতে তার হাত রাসূলের দৌহিত্রের রক্তে রঙ্গিন না হয়। পরিশেষে নিকৃষ্ট এক ব্যক্তি হোসাইনকে হত্যার জন্য উদ্যত হয়। তার নাম ছিল সীমার বিন যুল জাওশান। সে বর্শা দিয়ে হোসাইনের শরীরে আঘাত করে ধরাশায়ী করে ফেলল। অতঃপর ইয়াযিদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে তিনি শাহাদাত অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করেন।

বলা হয় এই সীমারই হোসাইনের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কেউ কেই বলেন: সিনান বিন আনাস আন্ নাখঈ নামক এক ব্যক্তি তাঁর মাথা দেহ থেকে আলাদা করে। আল্লাহই ভাল জানেন।

 

 ফুরাত নদীর পানি পান করা থেকে বিরত রাখার কিসসা:

 

বেশ কিছু গ্রন্থ তাকে ফুরাত নদীর পানি পান করা থেকে বিরত রাখার ঘটনা বর্ণনা করে থাকে। আর বলা হয় যে, তিনি পানির পিপাসায় মারা যান। এ ছাড়াও আরও অনেক কথা বলে মানুষকে আবেগময় করে যুগে যুগে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে এবং মূল সত্যটি উপলব্ধি করতে তাদেরকে বিরত রাখার হীন ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ সব কাল্পনিক গল্পের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। ঘটনার যতটুকু সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে আমাদের জন্য ততটুকুই যথেষ্ট। কোন সন্দেহ নেই যে, কারবালার প্রান্তরে হোসাইন নিহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বেদনা দায়ক। আল্লাহ্ তায়ালা রাসূলের দৌহিত্র শহীদ হোসাইন এবং তাঁর সাথীদেরকে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রহমত ও সন্তুষ্টি দ্বারা আচ্ছাদিত করুক।

 কারবালার প্রান্তরে হোসাইনের সাথে আরও যারা নিহত হয়েছেন:

  • আলী রা.এর সন্তানদের মধ্যে থেকে আবু বকর, মুহাম্মাদ, উসমান, জাফর এবং আব্বাস।
  • হোসাইনের সন্তানদের মধ্যে হতে আবু বকর, উমর, উসমান, আলী আকবার এবং আব্দুল্লাহ।
  • হাসানের সন্তানদের মধ্যে হতে আবু বকর, উমর, আব্দুল্লাহ এবং কাসেম।
  • আকীলের সন্তানদের মধ্যে হতে জাফর, আব্দুর রাহমান এবং আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন আকীল।
  • আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানদের মধ্যে হতে আউন এবং আব্দুল্লাহ। ইতি পূর্বে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের নির্দেশে মুসলিম বিন আকীলকে হত্যা করা হয়। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হোন। আমীন

 

হোসাইন রা. এর মাথা কোথায় গিয়েছিল?

 

দামেস্কে ইয়াযিদের দরবারে হোসাইনের মাথা প্রেরণের বর্ণনা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয় নি। বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, তিনি কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন। তাঁর সম্মানিত মাথা কুফার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আনাস বিন মালিক রা. বলেন: হোসাইনের মাথা উবাইদুল্লাহ এর কাছে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি তাঁর মাথাকে একটি থালার মধ্যে রেখে একটি কাঠি হাতে নিয়ে তা নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন এবং তাঁর সৌন্দর্য দেখে সম্ভবত বেখেয়ালে কিছুটা বর্ণনাও করে ফেলেছিলেন। হাদীসের শেষের দিকে আনাস রা. বলেন: হোসাইন রা. ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ। (বুখারী)

অন্য বর্ণনায় আছে, আনাস রা. বলেন: আমি উবাইদুল্লাহকে বললাম, তোমার হাতের কাঠি হুসাইনের মাথা থেকে উঠিয়ে ফেল। কারণ আমি তোমার কাঠি রাখার স্থানে রাসূলের পবিত্র মুখ দিয়ে চুমু খেতে দেখেছি। এতে কাঠি সংকোচিত হয়ে গেল। (দেখুন: ফতহুল বারী ৭/৯৬)

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এরপর কোথায় হোসাইনের কবর হয়েছে এবং তাঁর মাথা কোথায় গিয়েছে, তা সঠিক সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় নি। প্রকৃত ও সঠিক জ্ঞান আল্লাহর নিকটেই।