মন কি বলে ও প্রবৃত্তি কি চায়?-৮

প্রবৃত্তির অনুসরণের আরো কিছু ক্ষতিকর দিক জেনে নেই-

১। প্রবৃত্তির অনুসরণ বান্দার উপর তাওফিকের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হবে।

যখন কোন বান্দা প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে থাকে, তখন তাকে ভালো কাজের তাওফীক দেয়া হয় না। সে সব সময় খারাপ, অন্যায়, অশ্লীল ও অপকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ভালো কাজ করা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। ভালো কোন কাজের কথা বললে বা ভালো কাজের উপদেশ দিলে তা তার নিকট অসহ্য লাগে। সে সব সময় পাগলা হাতির মত ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে।

সমাজে এই ধরনের অনেক উদাহরন দেখতে পাই। হৈ চৈ, গান বাজনা ও অপ্রয়োজনীয় কথা, জোকস দিয়ে আড্ডা দিতে ভালোবাসে, এমনকি ঘণ্টার পর ঘন্টা চলে গেলেও কোন কষ্ট বা অসুবিধা হয় না। কিন্তু জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কুর’আন হাদীস থেকে গল্প করুন তাহলে সেখানে সময় দেয়াটা এদের জন্য অনেক কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়, বিভিন্ন কাজের কথা মনে পড়ে যায়, ভালো কথা শুনার আগ্রহ থাকে না।

টিভি বা কম্পিউটারেও তেলাওয়াত বা ইসলামিক লেকচার শুনার আগ্রহ থাকে না, অন্য কিছু যা দিয়ে সে তার প্রবৃত্তিকে নিয়ে উত্তেজিত থাকতে চায়।

মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা প্রয়োজন যিনি আমাদের এই অবস্থা থেকে হেফাজত করেন।

প্রবৃত্তির অনুসারীরা চলার পথে তাদের রাস্তা ভুলে যায় এবং বিভ্রান্ত হয়; তাকে সঠিক ও সরল পথ লাভের তাওফিক দেওয়া হয় না। কারণ, সে হেদায়েত ও তাওফিক লাভের উৎস হতে বিমুখ। সে কুরআন ও সুন্নাহকে বাদ দিয়ে তার প্রবৃত্তিকে গ্রহণ করছে। কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ বাদ দিয়ে সে প্রবৃত্তির অনুসারী হল। সুতরাং, তাকে কীভাবে সঠিক পথের প্রতি তাওফিক দেয়া হবে!

আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,

“তবে তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে আপন ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? তার কাছে জ্ঞান আসার পর আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন এবং তিনি তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। আর তার চোখের উপর স্থাপন করেছেন আবরণ। অতএব আল্লাহর পর কে তাকে হিদায়াত করবে? তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?”। সূরা জাসিয়া: ২৩

আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি তার পার্থিব জীবনে প্রবৃত্তিকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করল এবং তার অনুসরণ করল, আল্লাহ তা’আলা তার চোখ, কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেবে। সে আর সত্য কথা শুনতে পারবে না, সত্যকে প্রত্যক্ষ করত পারবে না আর অন্তরে সত্যকে অনুধাবন করতে পারবে না।

২। প্রবৃত্তির অনুসরণ আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের আনুগত্য ও ইবাদত বন্দেগী হতে বঞ্চিত হওয়ার কারণ:

যারা প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে থাকে, তারা তাদের প্রবৃত্তির উপর গর্ব-অহংকার করে এবং সে নিজেকে অনেক বড় মনে করে; যার কারণে তারা কারো অনুকরণ করতে চায় না, এমনকি তারা তাদের স্রষ্টার অনুকরণ করা হতেও বিরত থাকে। অনেক মানুষকে তাদের অহংকারই তাদেরকে কুফরিতে লিপ্ত করছে এবং হক্ব ও সত্যের অনুসরণ হতে বিরত রাখছে।

যে প্রবৃত্তিকে তার অন্তর নিয়ন্ত্রণ  করতে সক্ষম, এবং তার উপর সে পরিপূর্ণ ক্ষমতাবান সেই দুনিয়াতে সফল ব্যক্তি। আর যে ব্যক্তি প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সে তার নফসের ধোঁকায় পড়ে আছে এবং প্রবৃত্তিতে বন্দি হয়ে আছে; এখান থেকে বের হওয়ার আর কোন উপায় তার নাই।

আর একজন মানুষের পেটে দুটি অন্তর নাই যে, সে এক সাথে অনেক কাজ করতে পারবে। ফলে সে হয়তো আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের আনুগত্য করবে অথবা সে তার নফস, প্রবৃত্তি ও শয়তানের অনুকরণ করবে। (এক সাথে দুটি কাজ করা মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। কোন মানুষ যদি তার প্রবৃত্তি ও শয়তানকে খুশি রাখে, তাহলে তাকে মনে রাখতে হবে, তার উপর তার প্রভূ মহান রাব্বুল আলামীন অখুশি ও অসন্তুষ্ট। কোন মানুষের মধ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুটি অন্তর দেয় নাই যে, একদিকে সে আল্লাহর মহব্বতকে লালন করবে আবার অপরদিকে সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে।)

তাই আমাদের সমাজে যারা মসজিদে নামাজ পড়েন আবার হারাম রুজি থেকে দূরে থাকতে পারে না, মিথ্যা কথার লালন ছাড়তে পারে না, অনৈতিকতা ও অশ্লীলতায় নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখে তাদের অবস্থান কোথায় একটু চিন্তা করে দেখুন। যেই জিহবা দিয়ে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় সুবহানাল্লাহ বলে থাকেন, যে চোখ দিয়ে মহান আল্লাহর স্মরনে পানি আসে, সেই অংগ প্রতংগকে কিভাবে আবার আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজে ব্যবহার করতে পারে! এদের অবস্থা হলো মুনাফিকের অন্তরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আল্লাহ বলেছেন,

এই মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করছে। অথচ আল্লাহই তাদেরকে ধোঁকার মধ্যে ফেলে রেখে দিয়েছেন। তারা যখন নামাযের জন্য ওঠে, আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে শৈথিল্য সহকারে নিছক লোক দেখাবার জন্য ওঠে এবং আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে। কুফর ও ঈমানের মাঝে দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে, না পুরোপুরি এদিকে, না পুরোপুরি ওদিকে। যাকে আল্লাহ‌ পথভ্রষ্ট করে দিয়েছেন তার জন্য তুমি কোন পথ পেতে পারো না। আন নিসা: ১৪২-১৪৩

 এমনটা কি কখনও হতে পারে যে, যে লোক তার আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত এক সুস্পষ্ট পরিচ্ছন্ন হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত , সে সেই লোকদের মত হয়ে যাবে যাদের জন্য খারাপ কাজ সমূহ মনোহর বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তারা নিজেদের কামনা বাসনার অনুসারী হয়ে গিয়েছে? মুহাম্মদ-১৪

প্রত্যেক মিথ্যাবাদী পাপাচারীর দূর্ভোগ, সে আল্লাহর আয়াতসমূহ শুনে, অতঃপর অহংকারী হয়ে জেদ ধরে, যেন সে আয়াত শুনে নি। অতএব তাকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। যখন সে আমার কোন আয়াত অবগত হয়, তখন তাকে ঠাট্টারুপে গ্রহন করে। এদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি। তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম। জাসিয়া:৭-১০

৩। প্রবৃত্তির অনুসরণ গুনাহ, অন্যায় ও অপরাধের কারণ:

প্রবৃত্তির অনুসরণ করা অপমান অপদস্থ হওয়ার কারণ হয়ে থাকে। যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তাদের পদে পদে লাঞ্চিত হতে হয়। এ ছাড়াও প্রবৃত্তির অনুসারীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। যেমন- যারা প্রবৃত্তির অনুকরণ করে তাদের অন্তর কঠিন হয়ে যায়। আর যখন গুনাহ ও অপরাধের কারণে অন্তর কঠিন হয়, তখন সে কোন অপরাধকে অপরাধ মনে করে না। যে কোন ধরনের গুনাহ, অন্যায় ও অপরাধ সে করতে পারে। কোন অন্যায়কে সে অন্যায় মনে করে না। কোন অপরাধকে সে বড় মনে করে না। তার নিকট সব ধরনের গুণাহ হালকা মনে হয়। যুক্তি দিয়ে গুনাহের কাজগুলোকে জায়েয করে নেয়।

আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

 “একজন মুমিন তার গুনাহকে অনেক বড় করে দেখে। মনে হয় সে একটি বিশাল পাহাড়ের নিচে বসা, আশঙ্কা করছে যে পাহাড়টি তার মাথার উপর ভেঙ্গে পড়বে। আর গুণাহগার ব্যক্তি সে তার গুনাহকে একটি মাছির মত মনে করে। অর্থাৎ, মাছিটি তার নাকের উপর বসল, আর ঝাড়া দেয়ার সাথে সাথে চলে গেল”।

যদি দুনিয়ার ভালবাসা আখেরাতের ভালবাসার চেয়ে প্রাধান্য পায়, তাহলে ধীরে ধীরে অন্তর কঠিন হতে আরম্ভ করে। ফলে ঈমান কমে যায়, সৎ কাজকে ভারী মনে হয়, দুনিয়াকে ভালবাসা আরম্ভ করে এবং আখেরাতকে ভুলে যেতে থাকে।

ফলে দেখা যায় শুধুমাত্র দুনিয়ার এখনই লাভ হবে বা এখনই কোন প্রশংসা/পুরস্কার পাওয়া যাবে এই ধরনের কাজের ব্যপারে খুবই পরিশ্রমী হয়ে যেতে পারে, অনেক ত্যাগ করতেও সহজ লাগে কিন্তু মহান আল্লাহর দেয়া নির্দেশনাকে উপেক্ষা করতে একটুও দ্বিধা করে না।

সুদ মুক্ত থাকতে হলে একটু পরিশ্রম ও একটু ত্যাগ করতে হয় কিন্তু এটাকে অনেক কষ্টের মনে হয় অথচ সুদের সাথে সম্পর্ক থাকলে ঘরে বসে অনেক সহজে অনেক ধরনের সুবিধা আপাত দৃষ্টিতে পাওয়া যায়, ফলে অনেকে এটাকেই গ্রহন করে।

সমাজে বিদয়াত মুক্ত ও শরীয়তের সীমানায় থাকতে হলে বর্তমান সমাজে অনেক ঝলসানো আনন্দ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয়, ফলে অনেকে লোকের কাছে অপছন্দনীয়  কমেন্ট শুনতে হতে পারে, কিন্তু যদি তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা যায় তাহলে অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে ও আনন্দ লাভও হয় সাময়িক ভাবে। তাই দেখা যায় বিভিন্ন বিদয়াতি অনুষ্ঠানে নিজেরাও যোগ দিয়ে অন্যকে বুঝাতে চান অসুবিধা নেই, আমরা সবই করি। এর ফলে বোরকা পড়া মহিলাটিও যেমন গায়ের মাহরামদের সাথে অবাধ মেলেমেশার আনন্দ লাভ করে তেমনি দাঁড়ি রাখা লোকটিও গায়ের মাহরাম নারীর সাথে অবাধ মেলেমেশা করে আনন্দ লাভ করে এবং এটাই সহজ হয়ে যায় তাদের কাছে। একসাথে ছবি তুলে হাসাহাসি করে আনন্দ করাটা অনেক সহজ লাগে। আরো বেশি করে মজাদার করে দেয় শয়তানের সহায়তায়।

 অথচ আমরা  প্রিয় নবীর স.এর উম্মত পরিচয়ে ভালোবাসার/অনুসরনের দাবী করি, রাসূল স. কি আরবের জাহেলী রীতি নীতির সাথে সমঝোতা করেছিলেন কখনো, নাকি মানসিক ও শারিরীক কষ্টকে মেনে নিয়েছেন তবুও তাদের নফসের অনুসরন করাতো দূরে থাক, ধারে কাছেও ঘেসেন নি। তা তে কে কি মনে করলো, ইসলামের দাওয়াত দিতে পারা যাবে না-এইরকম কি চিন্তা করেছিলেন? রাসূলের স. চেয়ে কি আমরা খুব বেশী হিকমাতওয়ালা হয়ে গেলাম? রাসূল স.কি দীনকে কায়েম করে যান নি? আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দান করুন।

ইদানিং দেখা যায় বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম বা পত্রিকায় নিজের পোষ্ট বা খবরটি হিট করার জন্য এমনভাবে নারীর ছবি/ভিডিও আপলোড করে থাকেন যা বেপর্দা নারী নিজে যতটুকু গোনাহের জন্য দায়ী হয় তারচেয়ে যারা আপলোড করছেন, তারা আরো বেশী গুনাহের অর্জনকারী হন প্রচারের জন্য। শরীয়তে পর্দাকে সবসময়ের জন্য ফরয ইবাদাত করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই ইবাদাতের বিপরীতে যাওয়াটাই সহজ, অনেক লাইক ও শেয়ার হয়, পাশাপাশি ছবি আপলোড না করে পোষ্টটিকে কিভাবে হিট করা যায় তা কঠিন বৈকী!

এই নারীই হাসরের মাঠে ছবি আপলোডকারীকে মহান আল্লাহর কাছে তার হক নষ্ট করার দাবী জানিয়ে আটকে দিতে পারে।

‘যদি কেউ তার ভাইয়ের ওপর  যুলুম করে থাকে, হোক তা মান-ইজ্জত অথবা সম্পদ বিষয়ক, সে যেন আজই তা থেকে দায়মুক্ত হয়ে নেয়, সে দিন আসার পূর্বে যখন কোনো টাকা পয়সার লেনদেন হবে না। সেদিন যদি তার নেক আমল থেকে থাকে তবে যুলুম পরিমাণ নেক আমল তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। আর যদি নেক আমল না থাকে তবে মাযলুম ব্যক্তির গুনাহ নিয়ে তার ওপর  চাপানো হবে’। ইমাম বূখারী, সহীহ, অধ্যায়: বাদউল ওহী, হাদীস নং ২৪৪৯।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

তোমরা কি জান কপর্দকহীন কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো কপর্দকহীন। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো কপর্দকহীন, যে কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমলনামা দিয়ে দেওয়া হবে।

ইমাম মুসলিম, সহীহ: ৬৭৪৪।

জনৈক সৎ বান্দা বলেছেন,

‘প্রত্যেক বান্দারই দু’টি চোখ রয়েছে। এক চোখ দিয়ে সে দুনিয়ার বিষয় দেখে। আর অন্তরে যে চোখ আছে তা দিয়ে সে আখেরাতের বিষয় দেখে। আল্লাহ যদি কোন বান্দার কল্যাণ চান, তাহ’লে তার অন্তরে যে চোখ আছে তা খুলে দেন।

ফলে আল্লাহ অদৃশ্যের যে ওয়াদা করেছেন সে সেগুলি দেখতে থাকে। আর আল্লাহ যদি অন্য কিছু ইচ্ছা করেন, তাহ’লে তার অবস্থায় তাকে ছেড়ে দেন। তারপর এ আয়াতটি পাঠ করেন,তাদের অন্তরকি তালাবদ্ধ করা হয়েছে’।   সূরা মুহাম্মাদ:২৪

৪। প্রবৃত্তির অনুসরণ দ্বীনের মধ্যে বিকৃতির কারণ:

যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি করতে কোন প্রকার কুন্ঠাবোধ করে না। তারা দ্বীনকে তাদের প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী সাজায়। তাদের কাছে যদি সঠিক দ্বীন কোনটি তা তুলে ধরা হয়, তখন তারা প্রবৃত্তিকেই প্রাধান্য দেয়, দ্বীনকে তারা প্রাধান্য দেয় না।

হাম্মাদ ইব্ন আবি সালমা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাফেজীদের একজন শাইখ তাব, আমাকে হাদিস বর্ণনা করে বলেন, আমরা যখন কোন বিষয়ে একমত হতাম এবং বিষয়টিকে সুন্দর মনে করতাম, তখন তাকে হাদিস বলে চালিয়ে দিতাম। হাদিস আমাদের নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী হতে হবে এমন কোন শর্ত ছিল না।

প্রবৃত্তির অনুসারিরাই যুগে যুগে দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি সাধন করে। বিদআত সৃষ্টি তারাই করেছে, যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। হযরত ইবনে আব্বাস র. থেকে বর্ণিত। রাসূল স. বলেছেন,

আল্লাহর নিকট তিন শ্রেনীর লোক অত্যধিক ঘৃণ্য। তারা হলো-

১। যারা হারাম শরীফে শরীয়ত বিরোধী কাজ করে।

২। ইসলামী আদর্শে যারা জাহিলিয়াতের নিয়ম-প্রথাকে চালু করতে ইচ্ছুক।

৩। যারা কোন কারন ব্যতিতই মুসলমানের রক্তপাত করতে উদ্ধত হয়। সহিহ বুখারী

বিদয়াত চালু হওয়ার কারনের মাঝে একটি কারন হলো সমাজের তথাকথিত আলেমদের প্রবৃত্তির অনুসরনের ফলে অনেক প্রথা চালু করে দিয়েছেন সুন্নাত বলে যা তাদের দুনিয়াবী সুবিধা লাভের কারন হতে পারে। আবার সাধারন জাহিল লোকেরা কিছু শরীয়ত বিরোধী কাজ শুরু করেছে নিজেদের প্রবৃত্তির দাবী পূরনের জন্য এবং সমাজের আলেম সমাজ সেই ব্যাপারে নিরবতা পালন করেছেন, ফলে এরা ধরে নিয়েছে এই কাজগুলো করা জায়েয। এইভাবে প্রবৃত্তির অনুসরনের মাঝে অনেক বিদয়াতি অনুষ্ঠান চালু হয়েছে বিশেষ করে এশিয়ার অন্তর্ভূক্ত দেশগুলোতে। যেমন, মিলাদ, কুলখানী, চল্লিশা, নামাজের পর বা কোন অনুষ্ঠানে একসাথে সম্মিলিতভাবে দোয়া করা হাত তুলে।

মানুষ স্বভাবতই চিরন্তন শান্তি ও সুখ বেহেশত লাভের আকাঙ্খী। আর এ কারনে বেশী বেশী নেক কাজ করতেও চায়। দ্বীনের হুকুম আহকাম যথাযথ পালন করা কঠিন বোধ হলেও সহজসাধ্য সওয়াবের কাজ করার জন্য লালায়িত হয় খুব বেশী। আর তখন কোন কোন ব্যক্তি শয়তান ও প্রবৃত্তির ষড়যন্ত্রে পড়ে যায়।

ফলে তাড়াহুড়া করে কিছু সওয়াবের কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেগুলো সহিহ মানদণ্ডে যাচাই করার যোগ্যতাও নেই, অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকলেও প্রবৃত্তির দাসত্বে্র কারনে যাচাই করে না এবং যাচাই করার ইচ্ছাও পোষন করে না। এই সাথে সমাজের কিছু তথাকথিত লেবাসধারী সঠিক জ্ঞানের অভাব ব্যক্তিরাও জড়ো হয়ে এটাকে প্রতিষ্ঠিত সুন্নাতের নামে চালিয়ে দেয়। যেমন অনেক ক্ষেত্রে সোয়া লাখ খতম করলেই হবে, মাজারে মানত করলেই হবে, পীরের খুশি আদায় করতে পারলেই হবে, তাসবিহদানা গুনতে থাকলেই হবে ইত্যাদি। অথচ জীবনের হারাম ও শরীয়ত বিরোধী কাজ ও আদর্শের মাঝে এদের সবসময়েই অবস্থান থাকে। যারা সঠিকভাবে দীনকে পালন করতে চায় তাদের তখন শত্রু মনে করে। এইভাবে সমাজে বিভিন্ন গ্রুপিং শুরু হয়ে যায় যা একটি সমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

৫। প্রবৃত্তির অনুসরণ স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যাহত করা ও মানুষের রোষানলে পড়ার কারণ:

একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রবৃত্তির অনুসরণের কারণেই মানুষের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, অন্যায়, অনাচার ও দুশমনি সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকে এবং তার বিরোধিতা করে, সে তার দেহ, মন ও যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে শান্তি দেয়। তাকে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে হয় না।

আর যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করল, সে যেন একটি দুর্বিসহ জীবন যাপন করল। সে কোথাও কোন প্রকার শান্তি পায় না। সব সময় দুশ্চিন্তা ও হতাশায় লিপ্ত থাকে। তার পেরেশানির কোন অন্ত থাকে না। সে মানুষকে খারাপ জানবে আর মানুষ তাকে খারাপ জানবে। তার জীবনে বিপর্যয় ছাড়া কিছুই জুটবে না। তার চাহিদার শেষ নাই। যাদের চাহিদা যত বেশি হবে, সে ততবেশি অশান্তি ভোগ করবে। 

ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু আনহু বলেন,

তোমরা তোমাদের নফসকে তার চাহিদা থেকে ফিরিয়ে রাখ। কারণ, নফস হল এমন একটি চালক, যে তোমাকে অতীব এমন খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে, যার থেকে মুক্তি পাওয়ার মত কোন উপায় তোমার থাকবে না। মনে রাখবে সত্য খুব ভারি ও কঠিন, সত্যের দায়িত্ব মহান। যারা সত্যের দিশারী হয়, তাদের অবশ্যই গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর বাতিল খুব সহনীয় ও সহজলভ্য। এর জন্য খুব কষ্ট করতে হয় না। দুনিয়ার শ্রোতের সাথে গা বাসিয়ে দিলেই চলে।

বর্তমান  এ যুগে গুনাহ, অন্যায়, অনাচারকে সহজ করে দেয়া হয়েছে। শয়তান মানুষের জন্য অপরাধকে সুশোভিত করে দিয়েছে এবং গুনাহের যাবতীয় উপকরণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে।

আজ হাতে হাতে স্মার্ট ফোন এবং সেই সাথে ইন্টারনেট সহজলভ্য করে দেয়া আছে। ফলে ছোট্ট শিশুটি থেকে শুরু করে মডার্ণ মুরুব্বীরাও সেই ফোনে ভিডিও, মুভি ও খেলা নিয়ে ব্যস্ত জীবন পার করে দেয়।

আত্মীয় স্বজন বেড়াতে এলেও খাওয়া দাওয়ার সাথে আপ্যায়ন চলে মুভি দেখার মাধ্যমে। কেউবা আবার দেশ জাতি নিয়ে এতো সচেতন হয়ে পড়েন যে বিভিন্ন মিডিয়াতে খবর, সি.এন.এন, বিবিসি ও অনলাইনে বিভিন্ন খবরের জগতেই সময় পার করে দেন, মনে হয় যেন এখনই সব দেশের ও জাতির সমস্যা সমাধান করা ফেলবেন। অথচ এদিকে তার পরিবারের সন্তান বা স্ত্রী সমস্যায় আছে কি না খবর নাই। আবার অনেকে খেলার জগতের যত চ্যানেল আছে, টিপেই চলেছেন রিমোট, -দিন রাত বলে কোন সময়ের মূল্য নেই। অনেকে রান্না ও রুপ চর্চার বিভিন্ন সার্চে যেয়ে যেভাবে আত্মস্থ করেন তাতে মনে হয় এই জীবনে খাওয়ার মজা আর সৌন্দর্য্যের প্রকাশের মাঝেই বুঝি জীবন স্বার্থকতা লাভ করবে। শয়তান চোখে রঙ্গীন চশমা দিয়ে ও কল্পনায় স্ফূর্তি মাখিয়ে দুনিয়াটাকে ভোগ করার জন্য, ব্যক্তিকে মাতিয়ে রাখার জন্য যত নতুন নতুন পরিকল্পনা দেয় এইসব মিডিয়া ও নতুন প্রযুক্তিকে নিয়ে যারা কাজ করে যাচ্ছে। এই ভাবে নফসকে জাগ্রত ও শক্তিশালী করতে কোন কষ্ট অনুভূত হয় না কিন্তু যদি কুর’আন নিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়, কোন ইসলামীক আলোচনা বা পরিবারের কোন দায়িত্ব যেমন সন্তানকে পড়ালেখায় বা আত্মার উন্নয়নের জন্য কিছু পরিকল্পিত শিক্ষার আয়োজন করা বা সহযোগীতা করা, স্ত্রীকে  মানসিক ও শারিরীক ভালো ও সুস্থ রাখার জন্য সময় দেয়া, বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সুন্দর ভালো কথা শুনাতে সময় দেয়া যেন আখেরাতের জন্য আমলনামাটা উন্নত করতে পারেন, প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যানের জন্য দিক নির্দেশনা দেয়া ইত্যাদিতে সময় দিতে কত কষ্ট, কত বাহানা ও অধৈর্য্যের বহি:প্রকাশ দেখা যায় যা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। এর ফলেই ব্যক্তির প্রতি তার অধিনস্থরা খুবই বিরক্ত থাকে, পরিবারে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, আর এই ভারসাম্যহীনতার কারনে সমাজকে ভালো কিছু দেয়ার পরিবর্তে সমাজের রোষানলে পড়ে অনেক ক্ষেত্রে।

কত সুন্দর সুন্দর টিপস বের করে শেয়ার করা হয় অথচ কত সুন্দর সহজ উন্নত জীবনের চিত্র আমাদের প্রিয় নবী রাসূলের স. জীবনে রয়েছে যা সুন্দর ভারসাম্য পবিত্র জীবনের সহজ রাস্তার দিকে নিয়ে যেতে পারে যা একজন ব্যক্তিকে তথা পুরু সমাজকে শান্তির পথে ধাবিত করে।

আর গুনাহের কাজের কাছেই না যাওয়া বা গুনাহের কাজ ছেড়ে দেয়া, গুনাহ করে সময় নষ্ট করে তাওবার মাধ্যমে প্রতিকার করা হতে উত্তম। তবে গুনাহ করে ফেললে তখন তাওবা করে ফিরে আসাটাই উত্তম।

এই ক্ষেত্রে একটি বাস্তবতা তুলে ধরি আর তা হলো, আজ সমাজে অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলে ও মেয়ে একসাথে ফ্রি চলাফেরার কারনে অনেকেই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন, আবার বেশ কিছু পরে নিজেদের অনুশোচনা হলে তখন এই সম্পর্ককে শরীয়ত সম্মত করতে তৎপর হয়ে উঠেন ও পরিবারে বিয়ের কথা বলেন। অথচ দেখা যায় অনেক পরিবারই সংসারের খরচ চালাতে পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটির হিমশিম খেতে হচ্ছে, অনেক আশা করেছিল ছেলে বা মেয়ে প্রাপ্ত বয়সে কিছুটা সহযোগীতা করবে, কিন্তু অপ্রাপ্ত বয়সে ও রোজগারের ব্যবস্থা না করেই এই ধরনের অবস্থায় তখন বিয়ের ব্যপারটা বোঝা হয়ে যায় আবার সহজ জীবন যাপনেও ছেলে মেয়ে অভ্যস্থ থাকতে চায় না, তখন ছেলে মেয়েরা দোষ দেয় যে অভিভাবকরাই বিয়েকে কঠিন করে ফেলেন, আর তাই প্রেমের পথে হারাম কাজে লিপ্ত থাকে অনেক ছেলে মেয়েরা। ফলে পিতা মাতা ও পরিবারে এক অশান্তির পরিবেশ শুরু হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে প্রথমেই যদি ছেলে মেয়েরা ( ফ্রি মেলামেশা) গুনাহের কাজে লিপ্ত না থাকতো তাহলে এই ধরনের সম্পর্ক হতো না আবার সময়ে এই অনুশোচনা করে জটিল পরিবেশেও পড়তে হতো না। কাউকে দেখার পর ভালো লাগতে পারে কিন্তু ইসলামের শিক্ষা যে, প্রবৃত্তিকে লাগাম দিয়ে নিয়ন্ত্রন করতে হবে, প্রয়োজনে সাওম রাখার কথা এসেছে, যে ক্ষেত্রে বিয়ের সামর্থ থাকে সেখানে শরীয়তের সহজ উপায় বিয়ে করার কথা এসেছে। তাই গুনাহের কাজে জড়ানোর রাস্তা বন্ধ করার জন্য প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রনের শক্তি অর্জন করা প্রয়োজন। শরীয়তের নিয়মের অধীন করে রাখা প্রয়োজন।

অনেকে মনে করে আমরা এখন গুনাহ করব, তারপর তাওবা করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়ে নিব। তাদের এ ধরনের ধারণা ভ্রান্ত ও বাতিল। মহান আল্লাহ বলেছেন,

তবে একথা জেনে রাখো, আল্লাহর কাছে তাওবা কবুল হবার অধিকার এক মাত্র তারাই লাভ করে যারা অজ্ঞতার কারণে কোন খারাপকাজ করে বসে এবং তারপর অতি দ্রুত তাওবা করে। এ ধরনের লোকদের প্রতি আল্লাহ আবার তাঁর অনুগ্রহের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং আল্লাহ সমস্ত বিষয়ের খবর রাখেন, তিনি জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ।

কিন্তু তাওবা তাদের জন্য নয়, যারা খারাপ কাজ করে যেতেই থাকে, এমন কি তাদের কারো মৃত্যুর সময় এসে গেলে সে বলে, এখন আমি তাওবা করলাম। অনুরূপভাবে তাওবা তাদের জন্যও নয় যারা মৃত্যুর সময় পর্যন্ত কাফের থাকে। এমন সব লোকদের জন্য তো আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তৈরী করে রেখেছি। সূরা আন নিসা: ১৭-১৮

খারাপ বস্তু থেকে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রাখতে হবে। কারণ, দৃষ্টিকে শয়তানের তীর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তীর দিয়ে যেমন শিকার করা হয়, অনুরুপভাবে দৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ অন্যায় অপকর্ম শিকার করে। আর সামান্য সময়ের জন্য প্রবৃত্তিতে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তির মধ্যে দীর্ঘকালের জন্য পেরেশানি ও দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ, ব্যক্তি হয়ত অল্প সময় উপভোগ করবে, কিন্তু তা তার জন্য খুব তিক্ত পরিণতি ডেকে আনবে। তাকে আমরণ তার যন্ত্রনা সইতে হবে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুক।

আবু বকর আল-ওররাক রহ. বলেন, যখন মানুষের উপর প্রবৃত্তি প্রাধান্য বিস্তার করে, তখন তার অন্তর আচ্ছন্ন হয়। আর যখন অন্তর আচ্ছন্ন হয়, তখন তার আত্মা সংকীর্ণ ও ব্যাধিগ্রস্ত হয়। আর যখন আত্মা ব্যাধিগ্রস্ত হয়, তার চরিত্র খারাপ হয়। আর যখন চরিত্র খারাপ হয়, তখন সমগ্র মাখলুক তাকে খারাপ জানবে। আর যখন মানুষ তাকে খারাপ জানবে তখন সেও মানুষকে খারাপ জানবে। তারপর যখন মানুষ বুড়ো হয় এবং শাইখের বয়সে উপনীত হয়, তখন সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করার পরিণতি জানতে পারবে। সে তখন বুঝতে পারবে তার অতীত কত মূল্যবান ছিল। কোন এক কবি বলেন,

 যখন একজন মানুষ জোয়ান ছিল, তখন তার নিকট যৌন চাহিদা ও মানবিক চাহিদাগুলো খুব মিষ্টি ও মধুর ছিল এবং অতীব সুন্দর ছিল। কিন্তু যখন সে যৌবনকে পাড়ি দিয়ে, বার্ধক্যে পৌঁছল, তখন তা তিক্ততা ও অশান্তিতে রূপ নিলো।

৬। প্রবৃত্তির অনুসরণ করা দ্বারা মানুষ নিজেকে তার দুশমনের হাতে তুলে দেয়ার নামান্তর:

মানুষের সবচেয়ে বড় দুশমন হল, তার শয়তান, যে মানুষকে খারাপ পথের দিকে ডাকে। আর মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু হল, তার জ্ঞান যা তাকে ভালো উপদেশ দেয়। আর মানুষের অপর বন্ধু হল, ফেরেশতা যে তাকে ভালো কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করে।

 তিনিই তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারা তোমাদের জন্য দোয়া করে, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের মধ্যে নিয়ে আসেন, তিনি মু’মিনদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। সূরা আহযাব:৪৩

 যখন কোন ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তখন সে তার আত্মাকে নিজ হাতে দুশমনের কাছে সোপর্দ করে এবং নিজেকে শয়তানের বেড়াজালে আবদ্ধ করে। যখন কোন ব্যক্তি শয়তানের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়, তখন তার পরিণতি হয় খুবই করুণ। আর একেই বলা হয়, মহা বিপদ ও করুণ পরিণতি, যার থেকে রাসূল সা. আল্লাহর দরবারে মুক্তি কামনা করেন। এছাড়া একে খারাপ ফায়সালা ও দুশমনদের খুশি করাও বলা হয়ে থাকে। এ দুটি থেকেও রাসূল সা. আল্লাহর দরবারে মুক্তি চান। মহান আল্লাহ জানিয়েছেন,

আসলে শয়তান তোমাদের শত্রু, তাই তোমরাও তাকে নিজেদের শত্রুই মনে করো। সে তো নিজের অনুসারীদেরকে নিজের পথে এজন্য ডাকছে যাতে তারা দোজখীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।  সুরা ফাতের: ৬

 

اللَّهُمَّ عَالِمَ الغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ، رَبَّ كُلِّ شَيْءٍ وَمَلِيكَهُ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ نَفْسِي، وَمِنْ شَرِّ الشَّيْطانِ وَشَرَكِهِ، وَأَنْ أَقْتَرِفَ عَلَى  نَفْسِي سُوءاً، أَوْ أَجُرَّهُ إِلَى مُسْلِمٍ».

 (আল্লা-হুম্মা আ-লিমাল গাইবি ওয়াশ্‌শাহা-দাতি ফা-ত্বিরাস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্বি, রব্বা কুল্লি শাই’ইন ওয়া মালীকাহু,  আশহাদু আল-লা ইলা-হা ইল্লা আনতা। আ‘উযু বিকা মিন শাররি নাফ্‌সী ওয়া মিন শাররিশ শাইত্বা-নি ওয়াশিরকিহী/ওয়াশারাকিহী ওয়া আন আক্বতারিফা ‘আলা নাফ্‌সী সূওআন আউ আজুররাহূ ইলা মুসলিম)।

 “হে আল্লাহ! হে গায়েব ও উপস্থিতের জ্ঞানী, হে আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা, হে সব কিছুর রব্ব ও মালিক! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ছাড়া আর কোনো হক্ব ইলাহ নেই। আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই আমার আত্মার অনিষ্ট থেকে, শয়তানের অনিষ্টতা থেকে ও তার শির্ক বা তার ফাঁদ থেকে, আমার নিজের উপর কোনো অনিষ্ট করা, অথবা কোনো মুসলিমের দিকে তা টেনে নেওয়া থেকে।” তিরমিযী, নং ৩৩৯২; আবূ দাউদ, নং ৫০৬৭।

 

أَعُوذُ بكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ الَّتِي لاَ يُجَاوِزُهُنَّ بَرٌّ وَلاَ فَاجِرٌ: مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ، وَبَرَأَ وَذَرَأَ، وَمِنْ شَرِّ مَا يَنْزِلُ مِنَ السَّمَاءِ، وَمِنْ شَرِّ مَا يَعْرُجُ فيهَا، وَمِنْ شَرِّ مَا ذَرَأَ فِي الْأَرْضِ، وَمِنْ شَرِّ مَا يَخْرُجُ مِنْهَا، وَمِنْ شَرِّ فِتَنِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ، وَمِنْ شَرِّ كُلِّ طَارِقٍ إِلاَّ طَارِقاً يَطْرُقُ بِخَيْرٍ يَا رَحْمَنُ».

(আ‘ঊযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত্-তা-ম্মা-তিল্লাতী লা ইয়ুজাউইযুহুন্না বাররুন ওয়ালা ফা-জিরুম মিন শাররি মা খালাক্বা, ওয়া বারা’আ, ওয়া যারা’আ, ওয়ামিন শাররি মা ইয়ানযিলু মিনাস্ সামা-য়ি, ওয়ামিন শাররি মা যারাআ ফিল আরদ্বি, ওয়ামিন শাররি মা ইয়াখরুজু মিনহা, ওয়ামিন শাররি ফিতানিল-লাইলি ওয়ান-নাহা-রি, ওয়ামিন শাররি কুল্লি ত্বা-রিকিন ইল্লা ত্বা-রিকান ইয়াত্বরুকু বিখাইরিন, ইয়া রহ্‌মানু)।

 “আমি আল্লাহ্‌র ঐ সকল পরিপূর্ণ বাণীসমূহের সাহায্যে আশ্রয় চাই যা কোনো সৎলোক বা অসৎলোক অতিক্রম করতে পারে না— আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, অস্তিত্বে এনেছেন এবং তৈরি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে, আসমান থেকে যা নেমে আসে তার অনিষ্ট থেকে, যা আকাশে উঠে তার অনিষ্ট থেকে, যা পৃথিবীতে তিনি সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে, যা পৃথিবী থেকে বেরিয়ে আসে তার অনিষ্ট থেকে, দিনে-রাতে সংঘটিত ফেতনার অনিষ্ট থেকে, আর রাত্রিবেলা হঠাৎ করে আগত অনিষ্ট থেকে, তবে রাতে আগত যে বিষয় কল্যাণ নিয়ে আসে তা ব্যতীত; হে দয়াময়!” আহমাদ ৩/৪১৯, নং ১৫৪৬১, সহীহ সনদে।

আজকের আমাদের সমাজে মানবরুপী শয়তানের কাজে প্রলুব্ধ হয়ে, নিজের প্রবৃত্তির কাছে হার মেনে নিজেকে শয়তানের কাছে সঁপে দেয়, একবারও তার মনে আসে না, মহান আল্লাহ যিনি আমাকে ভালোবেসে, সুন্দর করে যত্নের সাথে এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, এই দুনিয়ার এতো নিয়ামত যা আমাকে ভোগ করার জন্য (বিধি বিধানসহ) দিয়েছেন যা আমারই কল্যানের জন্য এবং  আমারই সফলতার জন্য জানিয়ে দিয়েছেন যে, শয়তান তোমার প্রকাশ্য শত্রু। আর সেই আমরাই কি না কোন কষ্ট ছাড়া সহজেই নিজেকে শয়তানের কাছে তুলে দিতে পারি এবং কোন কষ্টও অনুভূত হয় না, কারো কারো মনে হলেও প্রবোধ দেয় নিজেকে যে, সমাজ নিয়ে চলতে হবেতো….,আল্লাহ রাহমানুর রাহীম –মাফ করে দিবেন…, এই ছোট ছোট গুনাহ কিছু হবে না ইত্যাদি নানাভাবে যুক্তি দাঁড় করিয়ে প্রবৃত্তি ব্যক্তিকে শান্ত করে রাখে।

একটু চিন্তা করে দেখুন এর পরিনতি আজ সমাজ ও ঘরে ঘরে প্রতিফলিত হচ্ছে কিভাবে?

মা বাবা চোখের পানি ফেলছেন যে তার সন্তান ছেলে মেয়ে বন্ধু নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, নেশাগ্রস্ত হয়ে বাসায় ফিরে, অনেক স্ত্রী বা স্বামী পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে, অনেক দূর্নিতি হাসপাতাল, অফিস, শিক্ষাঙ্গনে ঢুকে পড়েছে, আর সবচেয়ে বড় অশ্লীলতা চলে এসেছে আমাদের সংস্কৃতির মাঝে যা মিডিয়ার মাধ্যমে ঘরে ঘরে চলে গিয়েছে।

আর এইভাবে আমরা ইসলামের শত্রুদের মাথা চাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ করে দিয়েছি। আর আজ তাই বিশ্বে মুসলিমরা নির্যাতিত হচ্ছে।

ক্ষুদ্র থেকেই বড় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ছোট ছিদ্র বন্ধ না করলে এইভাবেই বড় ছিদ্র হতে থাকবে। তাই ব্যক্তির প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সবাইকে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন।

৭। প্রবৃত্তির অনুসরণ অপমান অপধস্তের কারণ

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. বলেন,

 “বিপদ শুধু বিপদ নয়, বরং সুস্পষ্ট বিপদ, যার আলামত হল, তুমি কখনোই তোমার প্রবৃত্তি থেকে বের হতে পারবে না। আর পরাধীন সে ব্যক্তি যে তার নফসের গোলামী করে এবং নফসের চাহিদা হতে বের হতে পারেনা।

অপর একজন কবি বলেন, আমি একটি দলকে দেখলাম তাদের স্বভাব বা নফস তাদের যাবতীয় সব ধ্বংস এ সর্বনাশী কর্মের প্রতি বাধ্য করে, তাদের নফস শত অপমান, অপদস্ত ও বঞ্চনা সত্বেও তাদের দেহের চাহিদা মেটাতে সচেষ্ট থাকে। তারা তাদের নফসের অনুকরণ করল, ফলে তারা নফসের চাহিদা নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকতে থাকল। আর তাদের প্রবৃত্তি তাদের জন্য কেবল অপমান ও লাঞ্চনাই বয়ে আনল, কোন সুফল দেখাতে পারল না। তুমি তোমার সঠিক দৃষ্টি দিয়ে চিন্তা করে দেখ, প্রবৃত্তির দৃষ্টি দিয়ে নয়।  সত্য, সত্যের অনুসন্ধানকারীদের সামনে একেবারেই স্পষ্ট ও উম্মুক্ত। ফাজের লোককে তার নফস সব সময় অন্যায়ের দিকে টানতে থাকে। ফলে তারা তারই অনুসরণ করে। আর যারা সত্যিকার জ্ঞানী তারা তাদের নফসের চাহিদা মেটাতে অস্বীকার করে এবং নফসের চাহিদাকে প্রত্যাখ্যান করে।

পবিত্র কুরআনের নির্দেশাবলীকে পরিপূর্ণভাবে মেনে না নেয়ার পরিনতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ জানিয়েছেন

তাহলে কি তোমরা কিতাবের একটি অংশের ওপর ঈমান আনছো এবং অন্য অংশের সাথে কুফরী করছো? তারপর তোমাদের মধ্য থেকে যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হবে এবং আখেরাতে তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে? তোমাদের কর্মকান্ড থেকে আল্লাহ‌ বেখবর নন। সূরা বাকারা:৮৫

আর এই কিছু অংশ না মানার পিছনে কারন সমূহের মাঝে বড় একটি কারন, তা হলো প্রবৃত্তির অনুসরন। প্রবৃত্তি দুনিয়ার ভোগ বিলাসকে এতো বেশী ভালোবেসে আনন্দময় করে রাখে যে, তখন মহান আল্লাহর নির্দেশনাকে অবহেলা করতে দ্বিধা করে না এবং এর সাথে শয়তানের সহযোগীতাও প্রকট করে তুলে।

আর তাই সমাজে দেখা যায় অনেকে নামাজ পড়েন কিন্তু কায়েম করেন নি, পর্দার কিছু অংশ মানেন কিন্তু শরয়ী পর্দাকে অনুসরন করে না, জীবন যাত্রায় যিকির শুধুমাত্র সালাতের বা নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে রাখেন কিন্তু প্রতিটা সময়েই যিকিরে থাকেন না, হালাল খাবারের খোঁজ নেন কিন্তু আয়ের উৎস হালাল কিনা তা নিয়ে চিনতি নন, আবার হালাল আয় শুধুমাত্র বেতনের অংশের চিন্তা করেন কিন্তু অন্য কোন খাতে হারাম আসছে কি না তা বেখেয়াল থাকেন বা প্রয়োজনবোধ করেন না, এইরকম অনেক উদাহরন আছে যা আমরা দেখি কিছু অংশ মানা ও না মানার সংখ্যাই বেশী। ফলে আজ ব্যক্তির পরিনতি অপমানকর হলে আফসোস করে ধিক্কার দিয়ে বলা শুরু করে যে, আমিতো আল্লাহর পথেই আছি তবে কেন এইরকম হলো ইত্যাদি। মহান আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দান করুন। দুনিয়ার লাভ লোকসানকে আমরা যেভাবে হিসেব করতে পারি তেমনি আখেরাতের লাভ লোকসানের হিসেব করলেও এই অবস্থা থেকে উত্তীর্ণ হতে পারতাম। মহান আল্লাহ আমাদের শক্তি দিন প্রবৃত্তিকে দমন করার।

ওমর ইব্ন আব্দুল আজীজ রহ. বলেন, সর্বোত্তম জিহাদ হল, নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। আর সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, সবচেয়ে বড় বাহাদুর ব্যক্তি হল, যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক বেশি কঠোর হয়। মনে রাখবে, কোন কিছুকে ছোট মনে করা ধ্বংস ডেকে আনে। অন্তরের ব্যাধিসমূহের সত্যিকার চিকিৎসা ও প্রতিষেধক হল, প্রবৃত্তির বিরোধিতা করা।

সাহাল ইব্ন আব্দুল্লাহ রহ. বলেন, তোমার প্রবৃত্তি হল তোমার অন্তরের রোগ। আর যখন তুমি তোমার প্রবৃত্তির বিরোধিতা করবে তখন তা হবে চিকিৎসা।

সুতরাং বান্দা হিসেবে আমাদের উচিত হল, নফসের বিরোধিতা করা। আর নফসের বিরোধিতার অন্তরের চিকিৎসা করতে হবে।