প্রবৃত্তি
আভিধানিক অর্থ: هَويَه শব্দটি মাছদার। যখন কোন বস্তুকে মহব্বত বা পছন্দ করে তখন এ কথা বলে। আল-মাগরিব
পারিভাষিক অর্থ: শরিয়তের অনুমোদন নেই এমন কোন বস্তুকে প্রবৃত্তি পছন্দ করে, তার প্রতি নফসের ঝুকে পড়াকে প্রবৃত্তি বলা হয়। আল্লামা জুরযানীর তারিফাত:৩২০
মানুষের কোন জিনিষের প্রতি মহব্বত, ভালো লাগা, আকর্ষন ও অন্তরে এর প্রভাব বিস্তারকেই প্রবৃত্তি বলে।
শাবী রহ.বলেন, আরবীতে প্রবৃত্তিকে বলে হাওয়া যার অর্থ পতিত হওয়া বা নিচে নেমে যাওয়া। এই প্রবৃত্তি একজনকে গহীন গহবরে নিয়ে যেতে পারে। লাগামহীন ঘোড়া যা আরোহীকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মহান আল্লাহ যেমন প্রবৃত্তির বিভিন্ন রুপ দিয়েছেন আবার পাশাপাশি এইগুলোর সঠিক রক্ষনাবেক্ষনের উপায় ও নির্দিষ্ট সীমারেখা দিয়ে দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ বলেছেন,
অতঃপর হে নবী, আমি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাকে একটি সুস্পষ্ট সংবিধান (শরীয়তের) ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং তুমি তার ওপরেই চলো এবং যারা জানে না তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। সূরা জাসিয়া:১৮
মানুষের জীবনে প্রবৃত্তির প্রয়োজন আছে বলেই মহান আল্লাহ এটা দান করেছেন।
একদিন কলেজের এক শিক্ষিকা প্রশ্ন করলেন যে, এই প্রেম ভালোবাসাটা না থাকলেইতো ছেলে মেয়েদের নিয়ে এতো চিন্তা করতে হতো না যে কার সাথে, কখন অবৈধ সম্পর্ক করে ফেলে? তখন তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে, আপনি কি ভেবে দেখেছেন যে, এই প্রেম ভালোবাসা আছে বলেই সেই সন্তান আপনাকে ভালোবাসে। তবে প্রবৃত্তির এই চাওয়া যখন কুপ্রবৃত্তিতে পরিণত হয় তখন সেটা পরিত্যাজ্য। আর এই কুপ্রবৃত্তির বশবর্তি হয়েই সমাজে অনৈতিকতা ও অবৈধ আচার আচরনের মাঝে ব্যক্তি নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং পরিবার ও সমাজকেও কলুসিত করছে।
নফসে আম্মারা সম্পর্কে চলুন পরিচিত হই আরেকটু গভীরভাবে। কারন শয়তানকে চেনা জানাও জরুরী যেন সে ভালরুপ ধরে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে।
হযরত আদম আ. ও বিবি হাওয়া আ. দুজনকেই শয়তান ধীরে ধীরে শুভাকাঙ্খী সেজে এসে প্রবঞ্ছিত করেছিল।
নফসে আম্মারাকে আমরা কুপ্রবৃত্তি বলে থাকি যা একজন ব্যক্তির প্রবৃত্তি তথা তার খেয়াল খুশি, যে কোন প্রকার চাওয়া পাওয়া, কামনা বাসনা, রিপু ও কোন জিনিষের প্রতি আকর্ষন বা টানকে পেতে ভালো মন্দ যাচাই করতে চায় না, নিয়ম নীতির ধারে ঘেঁসতে চায় না, কারো লাভ ক্ষতির হিসেব করে না, যেভাবে হোক মনের চাহিদাকে পূরণ করতেই চায়।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম র.বলেছেন, স্বভাব ও মেজাজের অনুকূলের চাওয়াকেই কুপ্রবৃত্তি বলে।
মহান আল্লাহ মুমিনদের আহবান করে বলেছেন,
হে ঈমানদারগণ! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও, তোমাদের ইনসাফ ও সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার অথবা তোমাদের বাপ-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও। উভয় পক্ষ ধনী বা অভাবী যাই হোক না কেন আল্লাহ তাদের চাইতে অনেক বেশী কল্যাণকামী। কাজেই নিজেদের প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে ইনসাফ থেকে বিরত থেকো না। আর যদি তোমরা পেঁচালো কথা বলো অথবা সত্যতাকে পাশ কাটিয়ে চলো, তাহলে জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ তার খবর রাখেন। সূরা আন নিসা:১৩৫
রাসূল স. বলেছেন,
আমি তোমাদের প্রতি তোমাদের পেট ও লজ্জাস্থানের কামনা-বাসনার ভ্রষ্টতা ও কুপ্রবৃত্তির গুমরাহী হতে ভয় করছি। আহমাদ,আত তারগীব ও আত তারহীব,সহিহ আলবানী ২য়খন্ড,২১৪৩
হুযাইফা রা.থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূল স. থেকে বলতে শুনেছি: মাদুরের গাথা পাতার সারির মত অন্তরের প্রতি একটির পর অপরটি ফেৎনা আসতে থাকবে। অত:পর যে অন্তর সে ফেৎনার প্রীতি পান করবে তাতে একটি কালো দাগ পড়ে যাবে। যে অন্তর সে ফেৎনাকে অস্বীকার করবে তাতে একটি সাদা দাগ পড়বে।
এভাবে অন্তর দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
একটি হলো: পিচ্ছিল অন্তর যাতে আসমান-জমিন থাকা অবধি ফেৎনা কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
আর অপরটি হলো: কালো ধূসর বর্ণ অন্তর উপুর করা জগের মত। যা ভালোকে ভালো ও মন্দকে মন্দ বলে উপলব্ধি করতে পারে না বরং তার কুপ্রবৃত্তির প্রীতির অনুসরন করে। সহিহ মুসলিম
মহান রাব্বুল আলামীন কুর’আনে জানিয়েছেন,
আর হে মুহাম্মাদ, এদের সামনে সেই ব্যক্তির অবস্থা বর্ণনা করো, যাকে আমি দান করেছিলাম আমার আয়াতের জ্ঞান। কিন্তু সে তা যথাযথভাবে মেনে চলা থেকে দূরে সরে যায়। অবশেষে শয়তান তার পিছনে লাগে। শেষ পর্যন্ত সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েই যায়। আমি চাইলে ঐ আয়াতগুলোর সাহায্যে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতাম কিন্তু সে তো দুনিয়ার প্রতিই ঝুঁকে রইল এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো। কাজেই তার অবস্থা হয়ে গেল কুকুরের মত, তার ওপর আক্রমণ করলেও সে জিভ ঝুলিয়ে রাখে আর আক্রমণ না করলেও জিভ ঝুলিয়ে রাখে। যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাদের দৃষ্টান্ত এটাই। তুমি এ কাহিনী তাদেরকে শুনাতে থাকো, হয়তো তারা কিছু চিন্তা-ভাবনা করবে। সূরা আল আরাফ:৭৫-৭৬
এই আয়াত ও হাদীস থেকে আমাদের অনেক আত্মউপলব্ধির খোরাক রয়েছে, রয়েছে সাবধানবানী।
ব্যক্তিজীবনে আমরা অনেকেই কুর’আন হাদীসের লিখিত চর্চা করে থাকি কিন্তু কতজন ব্যবহারিক চর্চা করতে চাই এবং কতজন এই চর্চা করতে যেয়ে প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরতে পেরেছি সেটাই আজ বড় প্রশ্ন।
আয়াতে যে ব্যক্তির উদাহরণ পেশ করা হয়েছে সে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞানের অধিকারী ছিল। অর্থাৎ প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অবহিত ছিল। এ ধরনের জ্ঞানের অধিকারী হবার কারণে যে কর্মনীতিকে সে ভুল বলে জানতো তা থেকে দূরে থাকা এবং যে কর্মনীতিকে সঠিক মনে করতো তাকে অবলম্বন করাই তার উচিত ছিল। এ যথার্থ জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করলে আল্লাহ তাকে মানবতার উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করতেন। কিন্তু সে দুনিয়ার স্বার্থ, স্বাদ ও আরাম-আয়েশের দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রবৃত্তির লালসার মোকাবিলা করার পরিবর্তে সে তার সামনে নতজানু হয়। উচ্চতর বিষয় সমূহ লাভের জন্য সে পার্থিব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ওঠার পরিবর্তে তার মধ্যে এমনভাবে ডুবে যায় যার, ফলে নিজের সমস্ত উচ্চতর আশা-আকাংখা, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক উন্নতির সমস্ত সম্ভাবনা পরিত্যাগ করে বসে। তার নিজের জ্ঞান যেসব সীমানা রক্ষণাবেক্ষণের দাবী জানিয়ে আসছিল, সেগুলো লংঘন করে এগিয়ে চলতে থাকে। তারপর যখন সে নিছক নিজের নৈতিক দুর্বলতার কারণে জেনে বুঝে সত্যকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চললো, তখন তার নিকটেই ওঁৎ পেতে থাকা শয়তান তার পেছনে লেগে যায় এবং অনবরত তাকে এক অধ:পতন থেকে আর এক অধ:পতনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে এ জালেম শয়তান তাকে এমন সব লোকের দলে ভিড়িয়ে দেয়, যারা তার ফাঁদে পা দিয়ে বুদ্ধি-বিবেক সব কিছু হারিয়ে বসে।
এরপর আল্লাহ এ ব্যক্তির অবস্থাকে এমন একটি কুকুরের সাথে তুলনা করেছেন, যার জিভ সবসময় ঝুলে থাকে এবং এ ঝুলন্ত জিভ থেকে অনবরত লালা টপকে পড়তে থাকে। এহেন অবস্থা তার উগ্র লালসার আগুন ও অতৃপ্ত কামনার কথা প্রকাশ করে। যে কারণে আমাদের ভাষায় আমরা এহেন পার্থিব লালসায় অন্ধ ব্যক্তিকে দুনিয়ার কুকুর বলে থাকি। ঠিক সেই একই কারণে এ বিষয়টিকে এখানে উপমার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কুকুরের স্বভাব কি? লোভ ও লালসা। চলাফেরার পথে তার নাক সব সময় মাটি শুকতে থাকে, হয়তো কোথাও কোন খাবারের গন্ধ পাওয়া যাবে এ আশায়। তার গায়ে কেউ কোন পাথর ছুড়েঁ মারলেও তার ভুল ভাংবে না। বরং তার মনে সন্দেহ জাগবে, যে জিনিসটি দিয়ে তাকে মারা হয়েছে সেটি হয়তো কোন হাড় বা রুটির টুকরা হবে। পেট পূজারী লোভী কুকুর একবার লাফিয়ে দৌড়ে গিয়ে সেই নিক্ষিপ্ত পাথরটিও কামড়ে ধরে। পথিক তার দিকে কোন দৃষ্টি না দিলেও দেখা যাবে, সে লোভ-লালসার প্রতিমূর্তি হয়ে বিরাট আশায় বুক বেঁধে জিভ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে। সে তার পেটের দৃষ্টি দিয়ে সারা দুনিয়াকে দেখে। কোথাও যদি কোন বড় লাশ পড়ে থাকে, কয়েকটি কুকুরের পেট ভরার জন্য সেটি যথেষ্ট হলেও, একটি কুকুর তার মধ্য থেকে কেবলমাত্র তার নিজের অংশটি নিয়েই ক্ষান্ত হবে না বরং সেই সম্পূর্ণ লাশটিকে নিজের একার জন্য আগলে রাখার চেষ্টা করবে এবং অন্য কাউকে তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেবে না। এ পেটের লালসার পর যদি দ্বিতীয় কোন বস্তু তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাহলে সেটি হচ্ছে যৌন লালসা। সারা শরীরের মধ্যে কেবলমাত্র লজ্জাস্থানটিই তার কাছে আকর্ষনীয় এবং সেটিরই সে ঘ্রাণ নিতে ও তাকেই চাঁটতে থাকে।
কাজেই এখানে এ উপমা দেবার উদ্দেশ্য হচ্ছে একথাটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা যে, দুনিয়াপূজারী ব্যক্তি যখন জ্ঞান ও ঈমানের বাঁধন ছিড়ে ফেলে প্রবৃত্তির অন্ধ লালসার কাছে আত্মসমর্পণ করে এগিয়ে চলতে থাকে, তার অবস্থা পেট ও যৌনাংগ সর্বস্ব কুকুরের মত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।