নারী ও পুরুষের পোশাক-২

একজন মানুষ যখন আপনার চোখে পড়ে, প্রথমেই তাঁর পোশাকের ধরণ দেখে তাঁর সম্পর্কে একটি ধারণা (ভালো বা মন্দ) আপনি লাভ করে থাকেন। পোশাক পরিধানে ব্যক্তির রুচিবোধ ও মন-মানসিকতার প্রকাশ ঘটে। যে কোন মানুষের প্রাথমিক পরিচয় মেলে তাঁর পোশাকে। পোশাক মানুষের আভিজাত্যের প্রতীক হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বাস-প্রত্যয় ও মূল্যবোধেরও পরিচয় বহন করে। তাই এক্ষেত্রেও ইসলামের রয়েছে এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলামী শরীয়ত মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট কোন মাপের বা ডিজাইনের পোশাক আবশ্যিক করে দেয়নি, তবে এমন কিছু শর্ত ও মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে যা কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের পক্ষেই মেনে চলা সম্ভব এবং এর মধ্যেই রয়েছে শালীনতা ও কল্যাণ। কাজেই ইসলাম নির্দেশিত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করে স্থান, কাল, পরিবেশ ও আবহাওয়াভেদে যে কোন পোশাকই ইসলামে জায়েয। পোশাক মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লারই দান। তিনিই এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন:

হে বনী-আদম! আমি তোমাদের জন্যে পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজ-সজ্জার বস্ত্র এবং পরহেযগারীর পোশাক, এটি সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।সূরা আরাফ: ২৬

তোমাদের জন্যে পোশাক তৈরী করে দিয়েছেন, যা তোমাদেরকে গ্রীষ্ম এবং বিপদের সময় রক্ষা করে। এমনিভাবে তিনি তোমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহের পূর্ণতা দান করেন, যাতে তোমরা আত্নসমর্পণ কর।সূরা আন-নহল: ৮১

 

এই আয়াত থেকে পোশাকের চারটি মৌলিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা যায়:

১। লজ্জাস্থানকে আবৃত করে বা অন্তরালে রাখে।

২। সৌন্দর্য বিধান করে।

৩। তাকওয়া বা আল্লাহভীতির পরিচয় বহন করে।

৪। দেহকে সুরক্ষিত রাখে।

 

পোশাকের ব্যাপারে আরো কিছু নির্দেশনা পাই সহীহ হাদীস থেকে। আমি কয়েকটি হাদীস আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি।

আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেছেন, দুই শ্রেণীর জাহান্নামী রয়েছে যাদের আমি দেখিনি। একশ্রেণীর হলো, যাদের কাছে গরুর লেজের মতো চাবুক রয়েছে, যা দিয়ে তারা মানুষকে মারে। আর দ্বিতীয় শ্রেনী হলো, যে স্ত্রীলোকেরা কাপড় পরেও উলংগ। তারা নিজেরাও বিপথগামী হয়েছে এবং অন্যদেরকেও বিপথগামী করেছে। তাদের মাথা বুখতি উটের কুঁজের মত একদিকে ঝুঁকানো। তারা না জান্নাতে যেতে পারবে, আর না জান্নাতের সুঘ্রাণ পাবে। যদিও তার সুঘ্রাণ বহুদূর থেকে পাওয়া যায়। সহীহ মুসলিম: ৫৪১৯

এখানে এমন পাতলা ও আঁটসাঁট পোশাকের কথা বলা হয়েছে যা পরলেও শরীরের গঠন ও বাঁকসমূহ বাইরে থেকে যে কেউ তাকালেই দেখতে এবং বুঝতে পারবে।

ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল (সা:) ঐসব পুরুষকে লা’নত করেছেন, যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে।  সহীহ বুখারী: ৫৪৬৫, তিরমিযী: ২৭২২

এখানে লক্ষ্য করুন, শুধুমাত্র পোশাকই নয় বরং বিপরীত লিঙ্গের পোশাকের অনুকরণ ও সাদৃশ্যকেও অভিসম্পাত করেছেন। তাই এক ব্যক্তি আয়েশা রা:কে পুরুষের জুতা পরিধানকারিণী এক মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সা: পুরুষের বেশ ধারনকারিণী মহিলাদের উপর লা’নত করেছেন। আবু দাউদ: ৪০৫৫

 

এই দু’টি হাদীস থেকে জানা যায়:

১। পোশাক পাতলা ও আঁটসাঁট হওয়া যাবে না।

২। পোশাক বিপরীত লিঙ্গের সদৃশ হবে না।

 

ইবনে উমার রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি গর্ব ভরে নিজের পরিধানের কাপড় মাটিতে হেঁচড়ে টেনে চলে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাঁর দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাবেন না। সহীহ মুসলিম: ৫২৯৬

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন: যে ব্যক্তি দুনিয়াতে যশ লাভের উদ্দেশ্যে পোশাক পরে, কিয়ামতের দিন তাকে অপমানের পোশাক পরাবেন, অতঃপর তাতে অগ্নিসংযোগ করবেন।

সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৬০৭

পোশাক কোনভাবেই গর্ব প্রকাশক ও খ্যাতি লাভের মানসে হবে না।

তবে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: সুন্দর, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন পোশাক যা গর্ব প্রকাশক ও খ্যাতি লাভের মানসে না হয় তা অনুমোদন করেছেন।

আনাস রা: বলেন, রাসূল সা: পুরুষদেরকে জাফরানী রংয়ের কাপড় পরতে নিষেধ করেছেন। সহীহ বুখারী: ৫৪২১

আলী ইবনে তালিব রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: কাসসী (একপ্রকার রেশমী কাপড়), হলুদ বর্ণের কাপড়, সোনার আংটি এবং রুকুতে কুরআন পাঠকে নিষেধ করেছেন। সহীহ মুসলিম: ৫২৭৬

জাবির রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: বাম হাতে পানাহার করতে, একপায়ে জুতা পরে পথ চলতে, এক কাপড়ে পুরো শরীর ঢাকতে এবং এক কাপড় পরিধান করে হাঁটু পর্যন্ত পেঁচিয়ে বসতে নিষেধ করেছেন। এতে লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।সহীহ মুসলিম: ৫৩৩৮

রেশমী কাপড় (সিল্ক), জাফরান রং-এর পোশাক এবং এক কাপড়ের পোশাক যা লজ্জাস্থান দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা পুরুষদের জন্য নিষেধ।

আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত। তিনি ছবিযুক্ত একটি গদি বা আসন কিনলেন। নবী সা: এটি দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে গেলেন, ভেতরে প্রবেশ করলেন না। আমি বললাম, আমি আল্লাহর দরবারে আমার গুনাহ থেকে তওবা করছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন এই গদিটি কেন? আমি বললাম, আপনার বসার এবং বালিশ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে। তিনি বলেন, এসব ছবি যারা তৈরি করেছে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে। তাদেরকে বলা হবে, যে জিনিষ তোমরা বানিয়েছ, তাতে জীবন দান করো। ফেরেশতারা কখনো এমন ঘরে প্রবেশ করেন না, যেখানে প্রাণীর ছবি থাকে। সহীহ বুখারী: ৫৫২৪

সুতরাং বোনেরা, আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। আমরা অনেক সময় ছোট শিশুদের প্রাণীর ছবিযুক্ত পোশাক কিনে দেই, ধরে নেই বাচ্চাদের জন্যে এটি তেমন কিছু না। তাহলে কিন্তু উক্ত হাদীসের শিক্ষাকে আমাদের বাস্তবে আমল করা হলো না। আবার কিছু কাপড়ে একধরনের নকশা আঁকা থাকে যেখানে হাতি-সাপ-ময়ূর ইত্যাদির আকার দেয়া থাকে, যা মনোযোগ দিয়ে না দেখলে বুঝা যায় না। অথচ একশ্রেণীর লোকেরা এগুলোকে পূজা করে থাকেন।

প্রাণীর ছবি সম্বলিত পোশাক পড়া থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

মহান আল্লাহ তা’লা বলেন:

হে বনী-আদম! তোমরা প্রত্যেক সালাতের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও, খাও ও পান কর এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না। সূরা আল আরাফ: ৩১

এই আয়াতে দেখুন মহান আল্লাহ কি জানিয়েছেন। আমরা কি আমাদের সালাতে উত্তম পোশাকটি পড়ে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ সুবহানের সামনে দাঁড়াই? যে পোশাকটি পরে বাইরের একজন অতিথির সামনে যেতে লজ্জা পাই, খুব দ্রুত পোশাক পাল্টে তারপর তাঁদের সামনে যাই, অথচ যিনি আমার প্রতিপালক, যিনি আমার রিযিকদাতা, সেই মহান আল্লাহ তা’লার সামনে দাঁড়াতে আমরা কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে থাকি?

পোশাক যেন অপচয়কারীর খাতায় নাম না লিখায়, সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

 

আমার প্রিয় বোনেরা, আপনার আলমারী-সুটকেস খুলে দেখুন তো কতো সেট জামা-কাপড়, শাড়ী জমা করে রেখেছেন, যা হয়তো ২/১ বছরেও পরা হয় না। অথচ প্রতি ৫-৬ মাস অন্তর লণ্ড্রীতে দিতে হচ্ছে, রোদে দিচ্ছেন, ইত্যাদি কাজে সময় ও অর্থ দু’টোই অপচয় হচ্ছে। ছেলে-মেয়েদের পোশাকের বেলায়ও সেই একই অবস্থা।

আর নিয়ামতের বহিঃপ্রকাশের বাহানায় আমরা কি অপচয় করে ফেলছি না? এটা কি রাসূল সা:এর আদর্শ? আমাদের আরো সচেতন হওয়া দরকার, কারণ সবকিছুরই জবাবদিহি করতে হবে। রাসূল সা: বলেছেন:

কোন মুসলমান অপর মুসলমানকে কাপড় পরতে দিলে সে ততদিন আল্লাহর হেফাজতে থাকে, যতদিন পর্যন্ত সেই কাপড়ের সামান্য অংশও তাঁর শরীরে থাকে। তিরমিযী: ২৪২৫

অপরদিকে, অনেক মা-বোনেরা কাপড়ের যত্ন নেয়াটাকে মনে করেন ইবাদাতের পরিপন্থী; অথচ, হাদিসে এসেছে:

জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: একবার রাসূল সা: আমাদের কাছে এসে এক ব্যক্তির মাথার চুল আলু-থালু দেখে বললেন: এ ব্যক্তির কি চুল আঁচড়ানোর মত কিছু নেই? অপর এক ব্যক্তির পরিধানে ময়লা কাপড় দেখে বললেন: সে কি তাঁর কাপড় ধোয়ার জন্য পানি পায় না? আবু দাউদ: ৪০১৮

 

রহমানের বান্দার পরিচয় দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:

আর তারা যখন ব্যয় করে, তখন অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। সূরা আল ফুরকান: ৬৭

 

ইসলামের দৃষ্টিতে তিনটি জিনিষকে অযথা ব্যয় বা অমিতব্যয়িতা বলা হয়:

১। অবৈধ কাজে অর্থ ব্যয় করা, তা একটি পয়সা হলেও

২। বৈধ কাজে ব্যয় করতে গিয়ে নিজের সামর্থ্যের চেয়ে বেশী ব্যয় করা

৩। সৎ কাজে মানুষকে দেখানোর জন্য ব্যয় করা (আল্লাহ তা’লার সন্তুষ্টির জন্য নয়)

কার্পণ্য বলে বিবেচিত হয় দু’টি জিনিস:

১। মানুষ যখন নিজের ও নিজের পরিবার-পরিজনদের প্রয়োজন পূরণের জন্য নিজের সামর্থ্য ও মর্যাদা অনুযায়ী ব্যয় করে না।

২। ভালো ও সৎ কাজে ব্যয় করে না।

 

কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হলো এই দুয়ের মাঝামাঝি ভারসাম্যের পথ অবলম্বন করা।

আবু সাঈদ খুদরী রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন:

নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের আচার-আচরণকে পুরোপুরি অনুকরণ করবে, প্রতি বিঘতে বিঘতে, প্রতি হাতে হাতে। এমনকি তাঁরা যদি গুঁইসাপের গর্তেও প্রবেশ করে থাকে, তাহলে তোমরাও এতে তাদের অনুকরণ করবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এরা কি ইহুদি ও নাসারা? তিনি বললেন, আর কারা? বুখারী: ৩৪৫৬

বোনেরা দেখুন, আজ মনে হচ্ছে আমরা রাসূল সা:এর সেই কথার দিকেই – যে ব্যাপারে তিনি আমাদের সচেতন হওয়ার জন্য সতর্ক করে গিয়েছেন, সে দিকেই ধাবিত হচ্ছি। বিজাতীয়দের অনুকরণের জন্য আমরা আমাদের সময় ও অর্থ নষ্ট করে যাচ্ছি।

আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন:

যদি কেউ কোনো সম্প্রদায়ের অনুকরণ করে, তবে সে ঐ সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য হবে। আবু দাউদ: ৪/৪৪

 

অন্য ধর্মের ‘নির্দিষ্ট’ চিহ্ন বহন করে যেমন ধূতি, ক্রুশচিহ্ন ইত্যাদি পরিধান করা যাবে না।

 

মহান আল্লাহ তা’লা আমাদের ইসলামের নির্দেশিত মূলনীতিগুলো মেনে চলতে মনের দৃঢ়তা দান করুন।