হজ্জ সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন ও তার জবাব—২৫

 

১। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কি হজ্জ করা আবশ্যক?

উত্তরঃ মানুষের উপর যদি এমন ঋণ থাকে যা পরিশোধ করার জন্য তার সমস্ত সম্পদ দরকার, তবে তার উপর হজ্জ ফরয নয়। কেননা আল্লাহ্‌ তো শুধুমাত্র সামর্থবান মানুষের উপর হজ্জ ফরয করেছেন। তিনি এরশাদ করেন,

“মানুষের উপর আল্লাহ্‌র অধিকার এই যে, যারা এই ঘর পর্যন্ত আসার সমর্থ রাখে তারা এর হজ্জ পালন করবে।” (সূরা আল ইমরানঃ ৯৭)

সুতরাং ঋণে জর্জরিত ব্যক্তি তো সামর্থবান নয়। অতএব প্রথমে সে ঋণ পরিশোধ করবে তারপর সম্ভব হলে হজ্জ আদায় করবে।

কিন্তু ঋণ যদি কম হয় এবং ঋণ পরিশোধ করে হজ্জে গিয়ে প্রত্যাবর্তন করার সমান খরচ বিদ্যমান থাকে, তবে হজ্জ করবে। হজ্জ চাই ফরয হোক বা নফল। কিন্তু ফরয হজ্জ আদায় করার ব্যাপারে বিলম্ব করা উচিত নয়। আর নফল হজ্জ তো ইচ্ছাধীন। মন চাইলে করবে মন চাইলে করবে না, কোন গুনাহ হবে না।

২। হজ্জ বা ওমরা আদায় করার জন্য কাউকে দায়িত্ব প্রদান করার বিধান কি?

উত্তরঃ বদলী হজ্জ বা ওমরা করার দু’টি অবস্থাঃ

প্রথম অবস্থাঃ তার পক্ষ থেকে ফরয হজ্জ বা ওমরা আদায় করবে।

দ্বিতীয় অবস্থাঃ তার পক্ষ থেকে নফল হজ্জ বা ওমরা আদায় করবে।

 

ফরয হজ্জ বা ওমরা আদায় করার জন্য কাউকে দায়িত্ব প্রদান করা জায়েয নয়। তবে কোন বাধার কারণে যদি মক্কা পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব না হয়- যেমন, কঠিন অসুখ যা ভাল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই অথবা অতিবৃদ্ধ হয়ে গেছে ইত্যাদি, তাহলে তার পক্ষ থেকে কাউকে দিয়ে বদলী হজ্জ করাবে। কিন্তু অসুস্থতা যদি এমন হয় যে তা থেকে আরোগ্য পাওয়ার আশা আছে, তবে অপেক্ষা করবে এবং সুস্থ হলে নিজেই নিজের হজ্জ-ওমরা সম্পাদন করবে। কেননা কোন বাধা না থাকলে হজ্জ বা ওমরার ব্যাপারে কাউকে দায়িত্ব প্রদান করা জায়েয নয়। আল্লাহ্‌ বলেনঃ

“মানুষের উপর আল্লাহ্‌র অধিকার এই যে, যারা এই ঘর পর্যন্ত আসার সমর্থ রাখে তারা ইহার হজ্জ পালন করবে।” (সূরা আল ইমরানঃ ৯৭)

ইবাদতের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ উহা নিজে বাস্তবায়ন করবে; যাতে করে আল্লাহ্‌র জন্য তার দাসত্ব-গোলামী ও বিনয়ের পূর্ণতা লাভ করে। আর নিঃসন্দেহে অন্যকে দায়িত্ব দিলে ইবাদতের এই মহান উদ্দেশ্য সঠিকভাবে আদায় হবে না।

কিন্তু সে যদি নিজের ফরয হজ্জ ও ওমরা আদায় করে থাকে, অতঃপর আবার তার পক্ষ থেকে নফল হজ্জ বা ওমরা আদায় করার জন্য কাউকে দায়িত্ব প্রদান করে, তবে জায়েয হবে কি না? এক্ষেত্রে বিদ্বানগণ মতবিরোধ করেছেন। কেউ বলেছেন, জায়েয। কেউ বলেছেন, নাজায়েয। আমার মতে যেটা সঠিক মনে হয়, তা হচ্ছে নাজায়েয। অর্থাৎ- নফল হজ্জ আদায় করার জন্য কাউকে দায়িত্ব প্রদান করা জায়েয নয়। কেননা ইবাদতের মূলনীতি হচ্ছে, ব্যক্তি নিজে তা আদায় করবে। যেমন করে নিজের পক্ষ থেকে রোযা আদায় করার জন্য কাউকে দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না। অবশ্য ফরয রোযা কাযা রেখে যদি কেউ মৃত্যু বরণ করে, তবে তার পক্ষ থেকে পরিবারের যে কেউ তা আদায় করে দিবে। অনুরূপ হচ্ছে হজ্জ। এটি এমন একটি ইবাদত যা আদায় করার জন্য শারিরীক পরিশ্রম আবশ্যক। এটা শুধু আর্থিক ইবাদত নয়। আর ইবাদত যদি শারিরীক হয়, তবে উহা অন্যকে দিয়ে আদায় করলে বিশুদ্ধ হবে না। কিন্তু হাদীছের দলীলের ভিত্তিতে যেটুকু অনুমতি পাওয়া যায় তার কথা ভিন্ন। আর বদলী নফল হজ্জ আদায় করার ব্যাপারে হাদীছে কোন দলীল পাওয়া যায় না। ইমাম আহমাদ থেকে এ ব্যাপারে দু’ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। তার একটি বর্ণনা আমাদের কথার সমর্থক। অর্থাৎ নফল হজ্জ বা ওমরা আদায় করার জন্য কাউকে নিয়োগ করা যাবে না। চাই তার সামর্থ থাক বা না থাক।

আমাদের এই মতানুযায়ী সম্পদশালী লোককে নিজেই নিজের হজ্জ বা ওমরা আদায় করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। কেননা অনেক মানুষ এমন আছে, বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে অথচ কখনো তারা মক্কা সফর করে নি। এই যুক্তিতে যে, সে তো প্রতি বছর তার পক্ষ থেকে হজ্জ বা ওমরা আদায় করার জন্য কাউকে না কাউকে প্রেরণ করে থাকে। অথচ তাদের জানা নেই যে, এ দ্বারা ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য আদায় হয় না।

 

৩। মৃতের পক্ষ থেকে ওমরা আদায় করা কি জায়েয?

উত্তরঃ মৃতের পক্ষ থেকে হজ্জ বা ওমরা আদায় করা জায়েয। অনুরূপভাবে তওয়াফ এবং যাবতীয় নেক আমল তার পক্ষ থেকে আদায় করা জায়েয। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) বলেন, যে কোন নৈকট্যপূর্ণ কর্ম সম্পাদন করে যদি তার ছওয়াব জীবিত বা মৃতের জন্য দান করে দেয়, তবে সে উপকৃত হবে। কিন্তু সওয়াব দান করার চাইতে মৃতের জন্য দু’আ করা বেশী উত্তম। দলীল হচ্ছে রাসূল সা.এর বাণীঃ তিনি বলেন,

“মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তিনটি আমল ছাড়া তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়।

১) সাদকায়ে জারিয়া

২) উপকারী ইসলামী বিদ্যা

৩) সৎ সন্তান, যে তার জন্য দু’আ করবে।”

এই হাদীসে নবী সা. এরূপ বলেন নি সৎ সন্তান, যে তার জন্য ইবাদত করবে বা কুরআন পড়বে বা নামায পড়বে বা ওমরা করবে বা রোযা রাখবে ইত্যাদি। অথচ হাদীসটিতে প্রথমে দু’টি আমলের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। যদি মৃতের জন্য আমল করা উদ্দেশ্য হত, তবে নবী সা. অবশ্যই বলতেন, “এবং সৎ সন্তান, যে তার জন্য আমল করবে।”

কিন্তু মানুষ যদি কোন নেক আমল করে তার সওয়াব কারো জন্য দান করে দেয়, তবে তা জায়েয।

৪। মাহরাম ছাড়া কোন নারী যদি হজ্জ সম্পাদন করে, তবে কি উহা বিশুদ্ধ হবে? বুদ্ধিমান বালক কি মাহরাম হতে পারে? মাহরাম হওয়ার জন্য কি কি শর্ত আবশ্যক?

উত্তরঃ তার হজ্জ বিশুদ্ধ হবে। কিন্তু মাহরাম ছাড়া সফর করা হারাম এবং রাসূলুল্লাহ্‌ সা.এর নাফরমানী। কেননা তিনি এরশাদ করেন, “নারী কোন মাহরাম ছাড়া যেন সফর না করে।”

বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি এমন বালক মাহরাম হতে পারে না। কেননা তার নিজেরই তো অভিভাবক ও তত্বাবধান দরকার। অতএব এধরণের মানুষ কি করে অন্যের অভিভাবক বা তত্বাবধায়ক হতে পারে?

মাহরাম ব্যক্তির জন্য শর্ত হচ্ছে, সে মুসলিম হবে, পুরুষ হবে, প্রাপ্ত বয়স্ক হবে এবং বিবেক সম্পন্ন হবে। এগুলো শর্তের কোন একটি না থাকলে সে মাহরাম হতে পারবে না।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আফসোসের সাথে লক্ষ্য করা যায়, অনেক নারী মাহরাম ছাড়া একাকী উড়োজাহাজে সফর করে থাকে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, মাহরাম পুরুষ তাদেরকে এয়ারপোর্টে বিমানে তুলে দেয় এবং পরবর্তী এয়ারপোর্টে আরেক মাহরাম তাদেরকে রিসিভ করে থাকে। আর সে তো উড়োজাহাজের মধ্যে নিরাপদেই থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যুক্তিটি অসাড়ঃ কেননা তার মাহরাম তো এরোপ্লেনে তাকে উঠিয়ে দিতে পারে না। খুব বেশী তাকে ওয়েটিং হল বা ইমিগ্রেশন পর্যন্ত ছেড়ে আসতে পারে। কখনো প্লেন ছাড়তে দেরী হতে পারে। কখনো কারণ বশতঃ গন্তব্য এয়ারপোর্টে প্লেন অবতরণ করা সম্ভব হয় না। তখন এ নারীর কি অবস্থা হবে? কখনো হয়তো গন্তব্য এয়ারপোর্টে বিমান অবতরণ করল ঠিকই কিন্তু মাহরাম ব্যক্তিটি তাকে রিসিভ করতে পারল না। হয়তো সে অসুস্থ হয়ে গেল, কোন সড়ক দুর্ঘটনা হল ইত্যাদি যে কোন কারণ ঘটতে পারে।

উল্লেখিত কারণগুলো কোনটিই হল না। ঠিকঠাক মত প্লেন উড়ল, গন্তব্য এয়ারপোর্টে মাহরাম তাকে রিসিভ করল। কিন্তু এমনও তো হতে পারে- প্লেনের মধ্যে তার সিটের পাশে এমন লোক বসেছে, যে আল্লাহকে ভয় করে না, ফলে সে নারীকে বিরক্ত করতে পারে বা নারীই তার প্রতি আসক্ত হতে পারে। তাহলেই তো নিষিদ্ধ ফেতনার বীয বপন হয়ে গেল- যেমনটি কারো অজানা নয়।

অতএব নারীর উপর ওয়াজিব হচ্ছে আল্লাহকে ভয় করা এবং কোন মাহরাম ছাড়া কখনো সফরে বের না হওয়া। অভিভাবক পুরুষদের উপরও ওয়াজিব হজ্জে তাদের নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা, নারীদের ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় না দেয়া, নিজেদের আত্মসম্ভ্রম রক্ষা করা। প্রত্যেকে তার পরিবার সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসিত হবে। কেননা এদেরকে আল্লাহ্‌ তাদের কাছে আমানত রেখেছেন। আল্লাহ্‌ বলেন,

“হে ঈমানদরগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয় কঠোর স্বভাব ফেরেশতাগণ, যারা কখনো আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না। তারা যা করতে আদিষ্ট হয় তাই করে।” (সূরা তাহরীমঃ ৬)

 

৫। ইহরাম অবস্থায় নারী কিভাবে পর্দা করবে? পর্দা মুখ স্পর্শ করতে পারবে না এরকম কোন শর্ত আছে কি?

উত্তরঃ ইহরাম অবস্থায় নারী যদি মাহরাম নয় এমন কোন পুরুষের নিকট দিয়ে অতিক্রম করে বা তার নিকট কোন পুরুষ অতিক্রম করে, তবে অবশ্যই স্বীয় মুখমন্ডল ঢেকে নিবে। যেমনটি মহিলা সাহাবীগণ রা. করতেন। একারণে তাকে কোন ফিদ্‌ইয়া দিতে হবে না। কেননা পরপুরুষের সামনে মুখমন্ডল ঢাকা আল্লাহর নির্দেশ। আর নির্দেশ কখনো নিষেধ হতে পারে না।

পর্দা মুখমন্ডল স্পর্শ করতে পারবে না এরকম কোন শর্ত নেই। এতে কোন অসুবিধা নেই। পরপুরুষের সামনে এলেই তাকে অবশ্যই মুখ ঢাকতে হবে। কিন্তু যদি খিমা বা তাঁবুতে অবস্থান করে এবং সেখানে কোন পরপুরুষ না থাকে, তবে মুখমন্ডল খোলা রাখবে। কেননা ইহরাম অবস্থায় নারীর জন্য শরীয়তের নির্দেশ হচ্ছে মুখ খোলা রাখা। হাদীছের মর্ম অনুযায়ী নারী ইহরাম অবস্থায় নেকাব পরবে না। পুরুষ তার সম্মুখে আসুক বা না আসুক কোন অবস্থাতেই তার জন্য নেকাব ব্যবহার করা জায়েয নয়। সে হজ্জে থাক বা ওমরায় ।

নেকাব নারী সমাজে পরিচিত। আর তা হচ্ছে একটি পর্দা দিয়ে মুখন্ডল ঢেকে নেয়া যাতে দু‘চোখের জন্য আলাদা আলাদা দু’টি ছিদ্র থাকে। কিন্তু আয়েশা রা. এর হাদীস নেকাব নিষিদ্ধের হাদীসের সাথে সংঘর্ষপূর্ণ নয়। কেননা আয়েশার রা. হাদীসে একথা বলা হয়নি যে তারা নেকাব পরতেন। বরং নেকাব না পরে মুখ ঢেকে ফেলতেন। আর পরপুরুষ সামনে এলে নারীদের মুখ ঢেকে ফেলা ওয়াজিব। কেননা মাহরাম নয় এমন পুরুষের সামনে নারীর মুখমন্ডল ঢেকে রাখা ওয়াজিব।

অতএব ইহরামের ক্ষেত্রে সবসময় নেকাব পরিধান করা হারাম। আর পরপুরুষ সামনে না এলে মুখমন্ডল খোলা রাখা ওয়াজিব। কিন্তু সামনে এলে ঢেকে ফেলা ওয়াজিব। তবে নেকাব ছাড়া অন্য কাপড় ঝুলিয়ে দিতে হবে।

 

৬। নারী বিদায়ী তওয়াফ করার পূর্বে ঋতুবতী হয়ে পড়লে করণীয় কি?

উত্তরঃ যদি সে তওয়াফে এফাযাসহ হজ্জের যাবতীয় কাজ পূর্ণ করে থাকে এবং শুধুমাত্র বিদায়ী তওয়াফ বাকী থাকে, তারপর ঋতুবতী হয় তবে বিদায়ী তওয়াফ রহিত হয়ে যাবে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,

‘লোকদের আদেশ দেয়া হয়েছে, কাবা ঘরের তওয়াফ যেন তাদের সর্বশেষ কাজ হয়। তবে বিষয়টি ঋতুবতীদের জন্য হালকা করে দেয়া হয়েছে।’ যখন নবী সা. কে বলা হল যে, উম্মুল মু‘মেনীন ছাফিয়া বিনতে হুওয়াই (রাঃ) ঋতুবতী হয়ে গেছেন। অবশ্য তিনি তওয়াফে ইফাযা বা হজ্জের তওয়াফ করে নিয়েছেন। তখন নবী সা. বললেন, “তাহলে তোমরা বের হয়ে যাও।” তিনি তার জন্য বিদায়ী তওয়াফকে রহিত করে দিলেন।

কিন্তু তওয়াফে ইফাযা বা হজ্জের তওয়াফ ঋতুবতীর জন্য রহিত হবে না। ঋতুবতী হয় মক্কায় থেকে অপেক্ষা করবে এবং পবিত্র হলে তওয়াফে এফাযা করবে। অথবা সে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে কিন্তু ইহরাম অবস্থাতেই থাকবে এবং পবিত্র হলে মক্কায় ফিরে এসে শুধুমাত্র হজ্জের তওয়াফ করবে। যদি নিজ দেশে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসে, তবে সুন্দর হয়- প্রথমে ওমরা করে নিবে (তওয়াফ করবে, সাঈ করবে এবং চুল খাট করবে) তারপর হজ্জের তওয়াফ করবে।

৭। হজ্জের তওয়াফ না করেই নারী ঋতুবতী হয়ে গেছে। পবিত্র হয়ে তওয়াফ করার জন্য মক্কায় থেকে যাওয়াটাও তার জন্য দুঃসাধ্য অথবা চলে গেলে আবার মক্কা ফেরত আসাটাও অসম্ভব, তবে এ অবস্থায় নিম্ন লিখিত দু’টি সমাধানের যে কোন একটি সে গ্রহণ করতে পারেঃ

ক। ঋতু বন্ধ করার জন্য ট্যাবলেট বা ইঞ্জেকশন ব্যবহার করবে- যদি তাতে ক্ষতির আশংকা না থাকে- তারপর তওয়াফ করবে।

খ) লজ্জাস্থানে প্যাড বা কাপড় বেঁধে দিবে যাতে করে মসজিদে রক্ত না পড়ে। তারপর তওয়াফ করবে। এটাই বিশুদ্ধ মত যা শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) পসন্দ করেছেন।

এর বিপরীত সমাধান হচ্ছে, নিম্ন লিখিত দু’টির যে কোন একটিঃ

১। ইহরামের অবশিষ্ট যে নিষেধাজ্ঞা আছে তা থেকে বিরত থেকে ইহরাম অবস্থাতেই থাকবে। অর্থাৎ- স্বামী সহবাসে লিপ্ত হবে না। অবিবাহিতা হলে কোন বিবাহের আকদ করবে না। তারপর পবিত্র হলে তওয়াফ করবে।

২। অথবা নিজেকে হজ্জের কর্ম সমূহ সম্পন্ন করতে বাধাপ্রাপ্ত মনে করবে, এবং হালাল হওয়া যাবে এবং ফিদ্‌ইয়া স্বরূপ একটি কুরবানী করবে। কিন্তু এ অবস্থায় তার এই হজ্জটি হজ্জ হিসেবে গণ্য হবে না।

সন্দেহ নেই যে, উল্লেখিত এই দু’টি বিষয়ের উভয়টিই কঠিন। কারণ ইহরাম অবস্থায় থেকে যাওয়াটা যেমন কঠিন ব্যাপার, তেমনি হজ্জ বাতিল করে দেয়াটা আরো কঠিন। এ কারণে জরূরী অবস্থা হিসেবে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) এর মতটিই এখানে সঠিক। আর আল্লাহ্‌ বলেন,

“আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য দ্বীনের মাঝে কোন অসুবিধা রাখেননি।” (সূরা হজ্জঃ ৭৮)

তিনি আরো বলেন,

“আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য সহজতা চান, তোমাদের জন্য কঠিন কিছু তিনি চান না।” (সূরা বাকারাঃ ১৮৫)

কিন্তু এ নারীর জন্যে যদি সম্ভব হয় চলে গিয়ে পবিত্র হলে আবার ফেরত এসে হজ্জের তওয়াফ করা, তবে কোন অসুবিধা নেই। তবে এই সময়ের মধ্যে স্বামী সহবাস জায়েয হবে না। কেননা তওয়াফ না করলে হাজী সাহেব দ্বিতীয় হালাল বা পূর্ণ হালাল হয় না।

 

৮। ঋতু এসে যাওয়ার কারণে জনৈক নারী ওমরা না করেই মক্কা থেকে ফেরত চলে গেছে। তার বিধান কি?

উত্তরঃ ওমরার ইহরাম বাঁধার পর যদি নারীর ঋতু এসে যায়, তবে ইহরাম বাতিল হবে না। ওমরার ইহরাম বাঁধার পর ঋতুর কারণে তওয়াফ-সাঈ না করেই মক্কা থেকে বের হয়ে গেলে, সে ইহরাম অবস্থাতেই রয়েছে। তার উপর আবশ্যক হচ্ছে মক্কা প্রত্যাবর্তন করে তওয়াফ, সাঈ ও চুল ছোট করে হালাল হওয়া। তার উপর আবশ্যক হচ্ছে ইহরাম অবস্থায় যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা। চুল বা নখ কাটবে না, স্বামী থাকলে তার সাথে সহবাস করবে না।

তবে ইহরাম বাঁধার সময় যদি ঋতুর আশংকায় শর্ত আরোপ করে নেয় যে, যেখানেই বাধাগ্রস্ত হবে সেখানেই সে হালাল হয়ে যাবে। তবে ঋতু আসার পর ইহরাম খুলে ফেললে তাকে কোন কাফ্‌ফারা দিতে হবে না।

(ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম থেকে)

মূল: শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন (রহ.)

৯। স্বামীর অনুমতি নেয়া কতটুকু জরুরী?

যদি নারীর হজটি ফরজ হজ হয়ে থাকে তবে স্বামীর অনুমতি নেয়া নারীর জন্য মুস্তাহাব। যদি স্বামী অনুমতি দেন তবে ভাল। আর যদি অনুমতি না দেন তারপরও যদি আপনি মুহরিম সাথি পান তবে আপনাকে হজ করতে হবে। কোন স্বামীর জন্য আপন স্ত্রীকে ফরজ হজ আদায় করতে বাধা দেয়া উচিত হবে না। হাঁ, এ ব্যাপারে স্ত্রীর নিরাপত্তা ও অন্যান্য যাবতীয় শর্তাদি পূরণ হয়েছে কি না তা দেখাও স্বামীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কারণ, সক্ষম হলেই দেরি না করে হজ আদায় করে নেয়া উচিত। নচেৎ যদি বাধা দেয়ার কারণে স্ত্রী কোন কারণে পরবর্তীতে অপারগ হয়ে পড়ে তবে স্বামী সহ তারা উভয়ই গুনাহ্‌গার হবে।

আর যদি নারীর হজটি নফল হজ হয়ে থাকে তবে স্বামীর অনুমতি নেয়া সেই জন্য ফরজ। স্বামীর অনুমতি ব্যতীত হজে যেতে পারবেন না। অনুরূপভাবে, স্বামীও তার স্ত্রীকে নফল হজে গমনের ক্ষেত্রে তার অধিকারের কথা বিবেচনায় রেখে বাধা দেয়ার ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন।

আর যদি কোন মহিলা স্বামীর মৃত্যু-জনিত ইদ্দত পালন অবস্থায় থাকে। তাহলে সে মহিলা ইদ্দতের সময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত হজে যেতে পারবে না। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন:

“হে নবী! তোমরা যখন তোমাদের স্ত্রী গণকে তালাক দিতে ইচ্ছে কর তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং তোমরা ইদ্দতের হিসেব রেখো এবং তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয়।” সূরা আত-তালাক: ১

কোন পিতা বা মাতা কেউই তাদের মেয়ে সন্তানকে ফরজ হজে গমন করতে বাধা দেয়ার অধিকার রাখে না। যদি কোন মেয়ে হজে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে এবং মাহরাম পায় তখন তার জন্য পিতা-মাতার আনুগত্যের দোহাই দিয়ে হজে যাওয়া থেকে বিরত থাকা বৈধ নয়।

১০। হায়েয বা নেফাস ওয়ালী মহিলা হাজী সাহেবানদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড——-

হজে যদি আপনার হায়েয বা নেফাস এসে যায় তবে তা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। কারণ, এটা আল্লাহ্‌ তাআলা প্রত্যেক নারীর জন্যই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমাদের দ্বীনে কঠিন ও সমস্যাসংকুল কিছু নেই। সব ধরনের সমস্যার সমাধান এতে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু মাসলা-মাসায়েল জেনে নেয়া আবশ্যক।

এখানে একটি সাধারণ নিয়ম হলো: সাধারণ হাজী সাহেবরা যা যা করেন হায়েয বা নেফাস ওয়ালী মহিলাও সেগুলো করবেন। তবে হায়েয ও নেফাস-ওয়ালী মহিলাগণ পবিত্রতা অর্জন পর্যন্ত আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করবেন না। এর প্রমাণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার হাদিস। হজের সফরে বের হওয়ার পর তার হায়েয এসেছিল। তিনি বলেন:

“তখন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে প্রবেশ করে দেখলেন আমি কাঁদছি। তিনি বললেন: তুমি কাঁদছ কেন? আমি বললাম: হায়! আমি যদি এ বছর হজ না করতাম। তিনি বললেন: তোমার বোধ হয় হায়েয হয়েছে। আমি বললাম: হাঁ। তিনি বললেন: এটা তো মহান আল্লাহ আদমের প্রতিটি কন্যার উপর লিখে রেখেছেন। সুতরাং তুমি পবিত্র হওয়া ব্যতীত তাওয়াফ না করে অপরাপর হাজীদের মত হজের যাবতীয় কাজ করে যাও”   বুখারি: ২৯০, ২৯৯, মুসলিম: ১২১

সুতরাং হায়েয ও নেফাস হলে মহিলাদের হজ আদায়ে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয় না। তাদের জ্ঞাতার্থে নিম্নোক্ত মাসআলাগুলোকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হলো:

  • হায়েয বা নেফাস অবস্থায় একজন মহিলা উমরা বা হজের এহরাম বাঁধতে পারবে।
  • এহরামের সময় হায়েয ও নেফাসওয়ালী মহিলা গোসল করবে। কারণ হজের সফরে আসমা বিনতে উমাইসের সন্তান হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে গোসল করা এবং কাপড় বেঁধে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
  • হায়েয ও নেফাস ওয়ালী মহিলা তালবিয়াহ পাঠ করতে কোন বাধা নেই। অনুরূপভাবে যাবতীয় দো’আও করতে পারবে। এমনকি কোরআন স্পর্শ না করে মুখস্থ পড়ার অনুমতিও কোন কোন ইমাম দিয়েছেন। কারণ, হায়েয বা নেফাস অবস্থায় কোরআন পড়তে নিষেধ করার ব্যাপারে সহীহ কোন হাদিস নেই।
  • যদি তামাত্তু হজ আদায়কারী হয় আর উমরা অবস্থায় কোন মহিলার হায়েয আসে তাহলে সে উমরার এহরাম নিয়েই ৯ তারিখ অর্থাৎ, আরাফার দিন পর্যন্ত কাটিয়ে দেবে। তারপর যদি ৯ তারিখ সে পবিত্র হয়ে যায় তবে দেখতে হবে যে সে উমরা আদায় করার পর আরাফার মাঠে হাজির হওয়া সম্ভব হবে তাহলে উমরা পুরা করে নেবে। আর যদি ৯ তারিখ পর্যন্ত পবিত্র না হয় বা ৯ তারিখে এমন সময় পবিত্র হয়েছে যে, তার আর উমরা আদায় করার সময় নেই তখন তিনি উমরাকে হজে রূপান্তরিত করে ফেলবেন এবং বলবেন: হে আল্লাহ! আমি আমার উমরার সাথেই হজ করার জন্য এহরাম করছি। এভাবে তিনি কিরান হজ আদায়কারী রূপে গণ্য হবেন এবং মানুষের সাথে আরাফাহর ময়দানে অবস্থান করবেন এবং অন্যান্য হাজীদের মত হজের বাকি কাজ সম্পন্ন করবেন। তবে তিনি তাওয়াফ ও সা’য়ীকে পবিত্র হওয়া পর্যন্ত দেরি করে আদায় করবেন। পবিত্র হওয়ার পর তিনি হজের তাওয়াফ ও সা’য়ী আদায় করলেই তার উমরার তাওয়াফ ও উমরার সা’য়ী করার প্রয়োজন পড়বে না। তবে তার উপর হাদী জবাই করা ওয়াজিব হবে।
  • যদি বিদায়ি তাওয়াফ করার পূর্বে কোন মহিলার হায়েয আসে এবং তাকে মক্কা ছাড়তে হয় তবে তার জন্য বিদায়ি তাওয়াফ করার আবশ্যকতা থাকবে না। তিনি বিদায়ি তাওয়াফ না করেই মক্কা ছেড়ে যেতে পারবেন। কিন্তু হজের তাওয়াফ না করলে হজ সম্পন্ন হবে না।
  • যদি হজের তাওয়াফ অর্থাৎ, তাওয়াফে ইফাযা বা তাওয়াফে যিয়ারাহ করার পূর্বে কারও হায়েয বা নেফাস আসে তাহলে তিনি পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। আর যদি মক্কায় অপেক্ষা করা তার জন্য দুষ্কর হয়ে পড়ে তবে তিনি তার এলাকায় চলে গেলেও যে পর্যন্ত পবিত্র হওয়ার পর আবার মক্কায় এসে তাওয়াফ না করবেন সে পর্যন্ত তার হজ পূর্ণ হবে না। আর এ সময়ে তিনি তার স্বামীর সাথে সহবাসও করতে পারবেন না। তারপর যখন তিনি মক্কায় এসে হজের তাওয়াফ সম্পন্ন করবেন তখন তার হজ পূর্ণ হবে। কিন্তু যদি অবস্থা এমন হয় যে, তার জন্য আবার মক্কায় আসা কষ্টসাধ্য বা মক্কায় অবস্থান করা অসম্ভব যেমন: দূর-দেশের লোক হয়, মাহরাম সফর সঙ্গী না পাওয়ার ভয় থাকে তাহলে তিনি উম্মতের বিজ্ঞ আলেমদের মতে, এমন কোন ইঞ্জেকশন পাওয়া যায় যার মাধ্যমে তার রক্ত বন্ধ করা যাবে তাহলে সেটাও গ্রহণ করতে পারেন অথবা হায়েয বা নেফাসের স্থানে কাপড় বেঁধে তাওয়াফ করে ফেলবেন।
  • মহিলা হাজী সাহেবানরা হায়েয বন্ধ করার জন্য যদি কোন ঔষধ গ্রহণ করতে চায় তবে তাও জায়েয হবে। কেননা এতে তার জন্য প্রভূত কল্যাণ ও সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় রয়েছে। তবে কোন শারীরিক ক্ষতিকারক কিছু করা যাবে না।
  • হায়েয বা নেফাস ওয়ালী মহিলা সা’য়ী করার স্থানে বসে কারও জন্য অপেক্ষা করতে কোন দোষ নেই। কারণ, সা’য়ী করার স্থানটি মসজিদুল হারামের বাইরের অংশ।

 

সহায়ক গ্রন্থ

হজ্জ উমরাহ ও যিয়ারত-   আল্লামা শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায রহ./ অনুবাদ আল্লামা শাইখ আবূ মুহাম্মদ আলীমুদ্দিন রহ.

প্রশ্নোত্তরে হজ্জ ও উমরা-    অধ্যাপক মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম

নারীর হজ ও উমরা–    লেখক: ড. আবু বকর যাকারিয়া সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ,

হজের পর করণীয় কী? গবেষণা বিভাগ, দারু ইব্ন খুযাইমাহ অনুবাদ: সানাউল্লাহ নজির আহমদ সম্পাদনা: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

হজ্জ সংক্রান্ত ভিডিও দেখতে নিচের লিঙ্কে যান।

 

https://plus.google.com/u/0/collection/45EfMB