তাওবা ও এস্তেগফার করা-৮

জীবনের সকল অবস্থায় বেশী বেশী তাওবা ও ইস্তেগফার করা প্রয়োজন। বিশেষ করে যখনই কোন অসুখ বা বিপদ এসে যায় বা ব্যক্তি জীবনে বা সামাজিক জীবনেও কোন কিছুর খুব বেশী প্রয়োজন, তখন আরো বেশী করে তাওবাহ ইস্তেগফার করা প্রয়োজন।

আর তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাওবা কর। (সূরা হুদ : ৩)

তিনি আরো বলেন:

হে ঈমানদারগন! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর, বিশুদ্ধ তাওবা। (সূরা আত-তাহরীম : ৮)

কুর’আনের শিক্ষা হলো প্রথমে ইস্তেগফার করতে হবে এরপর তাওবা করতে হবে এবং সেটা হতে হবে বিশুদ্ধ। অন্তরে অনুশোচনা নিয়ে একমাত্র মহান রবের কাছেই আত্মসমর্পন করে দিতে হবে নিজের নফসকে।

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুলুল্লাহ সা. -কে বলতে শুনেছি : আমি দিনের মধ্যে সত্তর বারেরও বেশী আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা (ইস্তেগফার) করি ও তাওবা করি। সহিহ বুখারী

হাদীসে সত্তর সংখ্যাটি আধিক্য বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝাতে নয়।

তওবা শব্দের আভিধানিক অর্থ – ফিরে আসা। ইস্তেগফার অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা।

পরিভাষায় তওবা হল : যে সকল কথা ও কাজ মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তা থেকে ফিরে এসে ঐ সকল কথা ও কাজে লেগে যাওয়া, যা দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় ও তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকা যায়।

এক কথায় পাপ-কর্ম থেকে ফিরে এসে সৎকাজে প্রবৃত্ত হওয়া।

তওবাতুন নাসূহ বা পরিশুদ্ধ তওবা প্রতিটি গোনাহগারের উপর ফরয। পাপরাশিকে নেকীতে রূপান্তরিত হবার ওয়াদা এবং কল্যাণ ও বিজয়স্বরূপ জান্নাতে প্রবেশ করানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। উক্ত কথার উদ্দেশ্য এই যে, ব্যাপক তওবা সকল মুসলিমের জন্যই সাব্যস্ত। সকল গোনাহের জন্যও তওবা জরুরী -যেগুলো করতে আল্লাহ নিষেধ করেন, যেগুলো পরিহার ছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে না।

পাপ বা অপরাধ দু ধরনের হয়ে থাকে :

১। যে সকল পাপ শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হক বা অধিকার  সম্পর্কিত। যেমন শিরক করা, নামাজ আদায় না করা, মদ্যপান করা, সুদের লেনদেন করা ইত্যাদি।

২।  যে সকল পাপ বা অপরাধ মানুষের অধিকার সম্পর্কিত। যে পাপ করলে কোন না কোন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন, জুলুম-অত্যাচার, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ খাওয়া, অন্যায়ভাবে সম্পদ আত্নসাৎ ইত্যাদি।

প্রথম প্রকার পাপ থেকে আল্লাহর কাছে তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার সাথে পাঁচটি শর্তের উপস্থিতি জরুরী।

শর্ত পাঁচটি হল :

১। ইখলাস (অকপটতা),

২। পাপ কাজটি পরিহার করা।

৩। কৃত পাপটিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হওয়া।

৪। ভবিষ্যতে আর এ পাপ করব না বলে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা।

৫। তওবা কবুল হওয়ার সময়সীমার মধ্যে তওবা করা।

অর্থাৎ তওবা করতে হবে মৃত্যু শুরু হওয়ার পূর্বে(মৃত্যুর ফেরেশতা দেখার পূর্বে) এবং পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় শুরু হওয়ার আগে।  তিরমিযী: ৩৫৩৭, ইবনু মাজাহ: ৪২৫৩

দ্বিতীয় প্রকার পাপ থেকে তাওবা করার শর্ত হল মোট ছয়টি:

১। ইখলাস (অকপটতা),

২। পাপ কাজটি পরিহার করা।

৩। কৃত পাপটিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হওয়া।

৪। ভবিষ্যতে আর এ পাপ করব না বলে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা।

৫। পাপের কারণে যে মানুষটির অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে বা যে লোকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার পাওনা পরিশোধ করা বা যথাযথ ক্ষতিপুরণ দিয়ে তার সাথে মিটমাট করে নেয়া অথবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে দাবী ছাড়িয়ে নেয়া।

৬। তওবা কবুল হওয়ার সময়সীমার মধ্যে তওবা করা।

শাইখ উছাইমীনের “লিকাউল বাব আল-মাফতুহ” ৫৩/৭৩

যে ব্যক্তি জীবনের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে তার তওবাও শুদ্ধ হবে। তার এ নিরাশার কারণ কোন রোগ হোক যেমন- ক্যান্সার। অথবা হত্যার শাস্তি তথা শিরোচ্ছেদের মুখোমুখি হওয়া এবং জল্লাদ তলোয়ার নিয়ে তার মাথার উপরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে হোক। অথবা বিবাহিত ব্যক্তির ব্যভিচারের শাস্তি তথা ‘পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড’ কার্যকর করার জন্য পাথর স্তূপ করার কারণে হোক। এদের সবার তওবা শুদ্ধ হবে। কেননা মৃত্যুর গড়গড়া শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তওবা কবুল করেন।  আল্লাহ তাআলার বাণী:

“অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশতঃ মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে; এরাই হল সেসব লোক যাদের তওবা আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, রহস্যবিদ।”

( সূরা নিসা: ১৭)।

“অনতিবিলম্বে তওবা করে” এ কথার অর্থ হলো- মৃত্যুর আগে তওবা করে। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

“আর এমন লোকদের জন্য তওবা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে আমি এখন তওবা করছি।” (সূরা নিসা: ১৮)

আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তওবাহ সে পর্যন্ত কবুল করবেন, যে পর্যন্ত তার প্রাণ কণ্ঠাগত না হয়।

তিরমিযী: ৩৫৩৭, ইবনু মাজাহ: ৪২৫৩

“কিন্তু যারা তাওবা করেছে, নিজেদের সংশোধন করেছে এবং বর্ণনা করেছে তারা হলো সেই লোক যাদের তাওবা আমি কবুল করবো এবং আমিই একমাত্র তাওবা কবুলকারী, দয়ালু।” (সূরা আল বাকারা: ১৬০)

এই উম্মতের প্রতি আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতসমূহের মধ্য থেকে একটি নেয়ামত এই যে, তিনি তওবার দরজা বন্ধ করেন নি বরং জীবনের প্রতি মুহূর্তেই তওবার প্রতি মানুষকে উৎসাহ দিয়েছেন আল্লাহ্ তাআলা যাকে অন্তর্দৃষ্টি দান করেছেন তাকে সর্বদা সন্দেহাতীতভাবে তাওবার প্রতি গুরুত্ববহ থাকতে আদেশ করেছেন

তওবার প্রতি আল্লাহ্ তাআলার উৎসাহ প্রদানের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, তিনি তওবাকারীর গোনাহগুলোকে নেকী দ্বারা রূপান্তর করে দেবেন আল্লাহ বলেন:

 “কিন্তু যারা তওবা করেছে এবং ঈমান এনেছে সৎকর্ম করেছে, এদের গোনাহগুলোকে আল্লাহ তাআলা নেকী দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিবেন নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল দয়ালুসূরা আলফুরকান: ৭০

 

তওবার উপকারিতা

. তওবা গুনাহ মুছে দেয়:

আল্লাহর রাসূল সা. বলেন:

গোনাহ থেকে তওবাকারীর কোন গোনাহই থাকে নাইবন মাজাহ: ৪২৫০

. গুনাহকে নেকীতে রূপান্তরকারী :

আল্লাহ বলেন,

কিন্তু যারা তওবা করে, ঈমান আনে আমলে সালিহা করে, এদের সকল পাপরাশি নেকীতে রূপান্তর করে দেন আল্লাহ তাআলা আর আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালুসূরা ফোরকান: ৬৯

. তওবাকারীর হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন করে দেয়

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 “বান্দা যখন কোন গোনাহর কাজ করে তখন তার অন্তরে এক ধরনের কালো দাগ পড়ে যায় যদি ইস্তেগফার করে তাহলে এই দাগ দূরীভূত করে তার অন্তর সূচালু, ধারালো পরিশীলিত হবে আর এই দাগের কথা কুরআনেই আছে, খবরদার! তাদের অন্তরে দাগ রয়েছে যা তারা কামাই করেছে”  জামে তিরমিযি: ৩৩৩৪

.  তওবা সুখী সুন্দর জীবনের গ্যারান্টি

আল্লাহ বলেন:

আর তোমরা নিজেদের পালনকর্তা সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর, অনন্তর তারই প্রতি মনোনিবেশ কর তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন এবং তিনি অধিক আমলকারীকে বেশি করে দেবেন      সূরা হুদ:

. তওবা রিযিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যম:

আল্লাহ তাআলা নূহ আলাইহিস সালামের ভাষায় বিধৃত করেন:

 “তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল তিনি তোমাদের উপর অজস্র ধারায় বৃষ্টির নহর ছেড়ে দিবেন তোমাদের ধনসম্পদ সন্তানসন্তুতি বাড়িয়ে দেবেন তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন”  সূরা নূহ: ১০১২

. তওবা দুনিয়াআখিরাতের সফলতা অর্জনের মাধ্যম

 “যারা তওবা করে, ঈমান আনে আমলে সালিহ করে, আশা করা যায় তারা সফলকাম  হবে”  সূরা কাসাস৬৭

পক্ষান্তরে যারা তওবা করবে, ঈমান আনবে আমলে সালিহ করবে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, কোন প্রকার যুলম করা হবে নাসূরা মরিয়াম: ৬০

মহান আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের মাধ্যম

মহান আল্লাহ তওবাকারী পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন” (সূরা আল বাকারা: ২২২)

 

তাওবা কিভাবে করবো

অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে যে কোন সময়ই নিজের গুনাহের ফলে অনুশোচনায় ব্যথিত হওয়া যে, নিজের উপর যুলুম করে ফেলেছেন, ভবিষ্যতে আর এই কাজ করবেন না ও মহান আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকবেন এই অংগীকার নিয়ে মহান আল্লাহর কাছেই ক্ষমা চাওয়া দিয়েই তাওবা করা হয়ে যায়।

নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা রাত্রিবেলা তাঁর হস্ত প্রসারিত করেন যাতে দিবাভাগের গোনাহগুলোর তওবা কবুল করতে পারেন ওদিকে দিনের বেলায় হস্ত প্রসারিত করেন যাতে রাতের গোনাহ তওবা গ্রহণ করতে পারেন

সহীহ মুসলিম: ২৭৪৭

 আমাদের সমাজে প্রচলিত মৌলভী ডেকে এনে তাওবা পড়ানোর পদ্ধতি সঠিক নয়। তাওবা নিজে নিজেই করবে আত্মোপলব্ধির সাথে। কেউ কাউকে তাওবা করে দিতে পারেন না। পূর্বে উল্লেখিত শর্তসমূহ মেনে চলে অনুতপ্ত হয়ে যে কোন সময়ই তাওবাতুন নাসূহা(উত্তম তাওবা) করতে পারেন।

তবে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বিশেষভাবে যে নফল সালাত আদায় করা হয়, তাকে ‘সালাতুত তাওবাহ’ বলা হয়।

আবুবকর রা. হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহসা.-কে বলতে শুনেছি যে, কোন লোক যদি গোনাহ করে। অতঃপর উঠে দাঁড়ায় ও পবিত্রতা অর্জন করে এবং দু’রাক‘আত সালাত আদায় করে। অতঃপর আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।

আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, বায়হাক্বী, তিরমিযী, হাদীছ হাসান; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৫৯; মিশকাত হা/১৩২৪ ‘ঐচ্ছিক ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩৯; আলে ইমরান ৩/১৩৫।

উক্ত সালাত দুই বা চার রাক‘আত ফরয কিংবা নফল পূর্ণ ওযূ ও সুন্দর রুকূ-সিজদা সহকারে হ’তে হবে।  আহমাদ হা/২৭৫৮৬; ছহীহাহ হা/৩৩৯৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৩০।

আপনি বলে দিন, (আল্লাহ বলেন) হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছো, তোমরা আল্লাহ তায়ালার রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ (অতীতের) সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করবেন। নিশ্চয় তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (সূরা আয্‌ যুমার: ৫৩)

তওবার জন্য নিম্নের দো‘আটি বিশেষভাবে সিজদায় ও শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর পূর্বে পাঠ করা যায়।

 আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহে।

অনুবাদ : ‘আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি সেই আল্লাহর নিকটে যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্ব  চরাচরের ধারক এবং তাঁর দিকেই আমি ফিরে যাচ্ছি বা তওবা করছি’।

তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২৩৫৩ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯, ‘ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করা’ অনুচ্ছেদ-৪।

সর্বোত্তম ইস্তেগফার হলো সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার—-

আল্লা-হুম্মা আন্তা রাব্বি লা— ইলাহ ইল্লা আন্ত্, খালাক্ক্ তানি- ওয়া আনা- ‘আব্দুক্, ওয়া আনা- ‘আলা- আহদিকা ওয়া ওয়াঅ’দিকা মাসতাত্বোত্, আউ-যুবিকা মিন্ শার্ রি মা- সোনাত্, আবু-উলাকা বিনঅমাতিকা আলাই, ওয়া আবু-উ বিযাম্বি, ফাগফিরলি- ফাইন্নাহু লা- ইয়াগফিরুয্ যুনুবা ইল্লা আন্ত্

হে আল্লাহ! তুমি আমার রব, তুমি ছাড়া আর কোন (সত্য) উপাস্য নেই, তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ, আর আমি তোমার বান্দা, আমি তোমার প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের উপর যথাসাধ্য প্রতিষ্ঠিত আছি, আমি যা করছি তাঁর অনিষ্ট হতে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, আমার উপর তোমার যে নি‘আমত রয়েছে আমি তা স্বীকার করছি, এবং আমি আমার অপরাধও স্বীকার করছি, তাই তুমি আমাকে ক্ষমা কর, নিশ্চয়ই তুমি ব্যতীত অন্য কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না। (সহীহুল বুখারী)

রাব্ বিগ্ ফিরলি

হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা কর।

আল্লা-হুম্মাগ্ ফিরলি-, ওয়ার্ হামনি- ওয়াহদিনি- ওয়া‘আ-ফিনি- ওয়ারযুক্বনি-

হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, আমাকে দয়া কর, আমাকে হিদায়াত দাও, আমাকে নিরাপত্তা দাও, আমাকে জীবিকা দাও। (সহীহ মুসলিম)

 

পাপ মোচনকারী কিছু আমল

কুর’আন ও হাদীসে এমন কিছু আমলের কথা উল্লেখ আছে যা সগীরা গুনাহ মুছে দিয়ে থাকে।

১. সুন্দর ও যথাযথভাবে অযু করা ও মসজিদে যাওয়া

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

মি তোমাদের কী এমন আমলের কথা বলব না, যদ্দারা গোনাহ মাফ হয়ে মর্যাদা বৃদ্ধি হবে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, কেন নয় বলুন হে আল্লাহর রাসূল সা.! তিনি বললেন, কঠিন অবস্থায় সুন্দর রূপে অযু করা, ঘন ঘন মসজিদে যাওয়া, এক নামাযের পর আরেক নামাযের অপেক্ষায় থাকা। এটাই হচ্ছে সীমানাপ্রহরা, এটাই সীমানাপ্রহরা, এই হচ্ছে তোমাদের জন্য সীমানাপ্রহরা।  সহীহ তারগীব তারহীব, নাসিরুদ্দিন আলবানী: ১৮৫

অপর এক হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ বলেন:

“রাতে আমার প্রভু আমার কাছে সবেচে সুন্দর অবয়বে এসে বললেন, হে মুহাম্মদ! জানেন, উর্ধালোকে কী বিষয়ে বাদানুবাদ চলছে? বললাম, হ্যাঁ, জানি। কাফ্ফারা ও মর্যাদা বৃদ্ধি নিয়ে, জামাতে নামায পড়ার পদক্ষেপ নিয়ে, কঠিন সময়ে সুন্দররূপে অযু করা নিয়ে এবং এক নামাযের পর আরেক নামাযের জন্য অপেক্ষা বিষয়ে। যে এগুলো সংরক্ষণ করবে সে কল্যাণে থাকবে ও কল্যাণের সাথে মারা যাবে । আর তার গোনাহ মায়ের জন্ম দেওয়া দিনের মত নিষ্পাপ হবে।” প্রাগুক্ত: হাদীস নং ১৮৭।

২. আরাফা ও আশুরার দিন রোযা রাখা

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

“আরাফাহ দিনের রোযা, আমি মনে করি আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা এক বছর আগের ও এক বছর পেছনের গোনাহ মাফ করে দেবেন। আর আশুরার রোযা, আমি মনে করি আল্লাহ তা‘আলা এক বছর পেছনের গোনাহ মাফ করে দেন।”জামে তিরমিযি ,খ ৩,পৃ:১১৫ ও ১১৭।

৩. রামাদানে কিয়ামুল লাইল

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

“যে লোক ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে রামাদানে কিয়ামুল লাইল করবে তার পেছনের সকল গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” সহীহ বুখারী: ৩৭

৪. কবুল হজ্জ

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 “যে লোক হজ্জ করল কিন্তু অশ্লীল বাক্যব্যয় ও নাফরমানি করল না। মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট দিনের ন্যায় সে নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফিরবে।”সহীহ বুখারী: ১৫২১।

তিনি আরো বলেন:

“কবুল হজ্জের বিনিময় জান্নাত ছাড়া কিছু নয়। সহীহ বুখারী, ফতহুল বারী, ৩/৩৮২।

৫. কৃত গোনাহর মোকাবেলায় নেক কাজ করা

আল্লাহ বলেন-

নিশ্চয় নেক কাজগুলো গোনাহকে বিদূরিত করে দেয়। সূরা হুদ-১১৪।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়ামান প্রেরণ কালে ওসিয়াত করে বললেন:

“যেখানেই থাকো আল্লাহকে ভয় করো, কখনো অসৎকাজ করে ফেললে তৎক্ষণাৎ একটি নেক করা করে ফেল, তাহলে ওই অসৎ কাজটি আমলনামা থেকে মুছে যাবে। মানুষের সাথে সদাচারের সাথে মেলামেশা কর।” তিরমিযি,খ ৪,পৃ: ৩৫৫।

৬. সালাম ও সুন্দর কথা বিনিময়

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 ‘সালাম ও উত্তম বাক্য বিনিময় হচ্ছে মাগফেরাত বা ক্ষমা অবধারিত করার অন্যতম মাধ্যম।’ আলবানী, সিলসিলাহ,হাদীস নং ১০৩৫। 

৭. ঋণগ্রস্তকে সময় দেওয়া

 “আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: জনৈক ব্যবসায়ী মানুষের কাছে ঋণ দিত, যখনই সে কোনো ঋণদাতাকে অভাবগ্রস্ত দেখত তখনই তার লোকদের বলত, তাকে একটু সুযোগ দাও। হয়ত আল্লাহ আমাদের গোনাহ মাফ করবেন। পরে আল্লাহ তা‘আলা তার গোনাহ মাফ করেছিলেন।” সহীহ বুখারী: ২০৭৮।

৮. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, জুমআ ও রামাদানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমআ থেকে আরেক জুমআ, এক রামাদান থেকে আরেক রামাদানের মাঝে কবিরা গোনাহ পরিহার করলে এর মধ্যকার সকল গোনাহর কাফ্ফারা হয়ে যায়।

’সহীহ মুসলিম,শরহে নববী, খ.৩, পৃ.১২০।

৯. সালাতের অযু করা।

হাদীসে এসেছে, ‘উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি সকলকে রাসূলুল্লাহ সা.-এর অযু করে দেখাচ্ছিলেন। অযু শেষে তিনি বললেন,

 “আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি এই অযুর মত অযু করে দু‘রাকাত সালাত পড়বে, যে সালাতের মাঝে নিজের বিষয়ের কোনও কথা বলবে না; তার পেছনের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” বুখারী: ১৫৯; মুসলিম: ২২৬।

১০. যিকর-আযকার গোনাহ দূর করে দেয়।

সা‘দ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 “যে লোক মুয়াযযিনের আযান শুনে বলে, আমিও সাক্ষ্য দিই এক আল্লাহ ছাড়া কোনও ইলাহ নেই আর মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আমি রব হিসেবে আল্লাহকে, নবী হিসেবে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এবং দীন হিসেবে ইসলামের উপর সন্তুষ্ট আছি; তাহলে তার সকল গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।” সহীহ মুসলিম, শরহে নববী প্রাগুক্ত, খ.৪, পৃ.৩০৯।

মু‘আয ইবনে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

যে লোক খাবার শেষে এই দোআ: ‘আলহামদুলিল্লাহি আত‘আমানী হাযাত ত্বায়ামা। ওয়া রাযাকানিহি মিন গায়রি হাওলিম মিন্নি ওয়ালা কুওয়াতা”, পড়বে, তার পেছনের সকল গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।

সহীহ মুসলিম, শরহে নববী, প্রাগুক্ত।

১২. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়

বুখারী ও মুসলিমে আছে,

“রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আচ্ছা! যদি তোমাদের কারো ঘরের সামনে একটি নদী থাকে আর তোমাদের কেউ যদি সে নদীতে দৈনিক পাঁচবার গোসল করে তাহলে তার শরীরে কোনও ময়লা থাকতে পারে কী? তারা বললেন; না, কোনও ময়লা থাকতে পারে না। তিনি বলেন যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযকে এর সাথে তুলনা করে নাও। এর দ্বারা আল্লাহ গোনাহ ধুয়ে দেন।” সহীহ বুখারী, ফতহুল বারী, খ.২, পৃ.১১।

১৩. সালাতের জন্য  হেঁটে যাওয়া

আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত:

 ‘কারণ যে কেউ সুন্দররূপে অযু করে এরপর মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরোয়, উদ্দ্যেশ্য সালাত পড়া, তাহলে তাকে কদমে কদমে নেকী দেওয়া হয় এবং কদমে কদমে মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়।’ সহীহ বুখারী,ফতহুল বারী,খ.২, পৃ.৩১।

১৪. বেশী বেশী সিজদা দেওয়া

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

‘তুমি বেশী বেশী সিজদা করবে, কেননা তোমার প্রতিটি সিজদায় আল্লাহ তা‘আলা মর্যাদা বৃদ্ধি এবং গোনাহ মাফ করবেন।’ শরহে মুসলিম,ইমাম নববী, খ.৪,পৃ.৪৫১।

এটি মূলত আল্লাহর কালাম: এবং সিজদা কর ও নিকটবর্তী হও’ এর নেপথ্য নির্দেশ।

১৫. যার আমীন বলা ফেরেশতাদের আমিনের সাথে মিলে যাবে

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 ‘ইমাম গাইরিল মাগদূবী আলাইহিম ওয়ালাদ দ্বাল্লীন বললে, তোমরা আমীন বল। যার আমীন ফেরেশতাদের আমীনের সাথে মিলে যাবে তার পেছনের সকল গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’

সহীহ বুখারী,ফতহুল বারী, খ.২, পৃ.২৬৬।

১৬. কিয়ামুল লাইল( তাহাজ্জুদ সালাত)

আবু উমামা বাহেলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বলেন:

‘তোমরা কিয়ামুল লাইল করবে, কেননা এটি তোমাদের পূর্ববর্তী সালেহীনের প্রতীক এবং এটি তোমাদের প্রভুর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম, গোনাহ বিদূরক ও পাপ নিরোধক।’

এরওয়াউল গালীল,আলবানী, খ.২, পৃ.৩৩।

১৭. আল্লাহর রাহে সংগ্রাম করে শহীদ হওয়া

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 ‘ঋণ ছাড়া শহীদের সকল গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ সহীহ মুসলিম, শরহে ইমাম নববী, খ.১৩,পৃ.৩৩।

আল্লাহ বলেন:

‘আল্লাহ তা‘আলা মু‘মিনদের জান-মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।’ সুরা তাওবাহ: ১১১।

১৮. লাগাতার হজ্জ ও ওমরা করে যাওয়া

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 ‘তোমরা লাগাতার হজ্জ-ওমরা করে যাও। কেননা এর অনুসরণ দ্বারা দারিদ্র্য ও গোনাহ মাফ হয়। যেভাবে কামারের হাঁপর লোহার মরিচা দূর করে।’সুনানে ইবনে মাজাহ: ২৮৮৭।

১৯. সাদাকাহ

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

 “যদি তোমরা প্রকাশে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি খয়রাত গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কিছু গোনাহ দূর করে দিবেন। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কাজ-কর্মের খুব খবর রাখেন।” সূরা আল বাকারা: ২৭১।

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:   ‘সাদাকাহ ঠিক সেভাবে গোনাকে দূর করে যেভাবে পানি আগুনকে নির্বাপিত করে।’জামে তিরমিযি: ১৬৪।

২০. দণ্ডবিধান বাস্তবায়ন

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

‘আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ কোনও কাজ বান্দা করে ফেরার পর যদি তার উপর দণ্ড প্রয়োগ করা হয় তাহলে তা তার গোনাহর কাফ্ফারা হয়ে যায়।’ মুসতাদরাকে হাকেম, খ.৪, পৃ.১৪২।

২১. আল্লাহর নৈকট্যের আশায় যিকরের মজলিসে গমন

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 ‘কোন সম্প্রদায় যখন আল্লাহকে রাজি-খুশী করার উদ্দেশ্যে যিকরের জন্য জমায়েত হয় তখন আকাশ থেকে জনৈক ঘোষণাকারী ঘোষণা করেন যে, তোমরা সকলে (প্রভুর) ক্ষমা নিয়ে প্রত্যাবর্তন করো আর তোমাদের সকল গোনাহ নেকীতে পরিণত করে দেওয়া হয়েছে।’ মুসনাদে আহমাদ, খ-৩,পৃ. ১৪২।

আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমাশীল ও দয়ালু। বান্দার প্রতি রহম দিল। সুতরাং তাঁর দরবারে আমাদের বিনম্রচিত্তে ইস্তেগফারের উদ্দেশ্যে নত হওয়া দরকার।  গোনাহ যত দীর্ঘ হবে ততই শেকড় মজবুত হবে। যেমন: কেউ একটি গাছ উপড়াতে গিয়েও উপড়াল না বরং ফেলে রাখল, ভাবল পরের বছর উপড়ালেও চলবে কিন্তু পরের বছর এর শেকড় আরো মজবুত হল আর লোকটার শক্তিও কমে গেল, সুতরাং সে কি করে গাছ উপড়াবে? গোনাহকে ফেলে রাখলে পরিণতি এই-ই হয়। তাই আমাদের আজই এবং এখনই তওবা করা দরকার।