কুরবানীর বিধি বিধান-৭

কুরবানীর অর্থ ও তার প্রচলন

আরবী ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসী বা ঊর্দূতে কুরবানী রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ নৈকট্য। আর ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবাতুন’ শব্দ থেকে উৎপন্ন। উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্য লাভ করা প্রভৃতি।

ইসলামী পরিভাষায় কুরবানী ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন ও তার ইবাদতের জন্য পশু যবেহ করা হয়।

মুফরাদাত লি ইমাম রাগিব ৩/২৮৭; তাফসীরে কাশশাফ, ১/৩৩৩; রায়যাবী, ১/২২২

আরবীতে ‘কুরবানী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় না। তাই কুরআনে কুরবানীর বদলে ‘কুরবান’ শব্দটি মোট তিন জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে যেমন

الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ عَهِدَ إِلَيْنَا أَلَّا نُؤْمِنَ لِرَسُولٍ حَتَّىٰ يَأْتِيَنَا بِقُرْبَانٍ تَأْكُلُهُ النَّا

১. নং সূরা আল ‘ইমরানের ১৮৩ নং আয়াত

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ ۖ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ

২. নং সূরা মায়িদা’র ২৭ নং আয়াত

فَلَوْلَا نَصَرَهُمُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ قُرْبَانًا آلِهَةً ۖ بَلْ ضَلُّوا عَنْهُمْ ۚ وَذَٰلِكَ إِفْكُهُمْ وَمَا كَانُوا يَفْتَرُونَ

৩. নং সূরা আহক্বাফের ২৮ নং আয়াত।

অনুরূপভাবে হাদীসেও ‘কুরবানী’ শন্দটি ব্যবহৃত না হয়ে তার পরিবর্তে ‘উযহিয়্যাহ’ এবং ‘যাহিয়্যাহ’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। উযহিয়্যাহ কুরবানীর দিনসমূহে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে যবেহ যোগ্য উট, গরু, ছাগল বা ভেড়াকে বলা হয়। এ শব্দটি ‘যুহা’ শব্দ থেকে গৃহীত যার অর্থ ‘পূর্বাহ্ণ’।

যেহেতু কুরবানী যরেহ করার উত্তম সময় হলো ১০ যিলহজ্জের (ঈদের দিনের) পূর্বাহ্ণকাল, তাই ঐ সামঞ্জস্যের জন্য তাকে ‘উযহিয়্যাহ’ বলা হয়েছে। এটিকে আবার ‘যাহিয়্যাহ’ বা ‘আযহা’ও বলা হয়। আর আযহাহ এর বহুবচন হলো আযহা, যার সাথে সম্পর্ক জুড়ে ঈদের নাম হয়েছে ঈদুল আযহা। মূলত ফারসী, হিন্দী, উর্দূ ও বাংলা ভাষায় আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবানী’ অর্থে ব্যহৃত হয়। বাংলার মুসলিমরাও ‘কুরবানী’ শব্দটির সাথে বেশ পরিচিত।

পরিশেষে ঐ যবেহকৃত পশুকেই ‘কুরবান’ বলা হয়, যা লোকেরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য পেশ করে থাকে (তাফসীরে মাযহারী, ২/১৮৮)।

ভারতীয় উপমাহাদেশ তথা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কুরবানী বলতে বোঝায় যিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ বা ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে উট, গরু, বকরী ও ভেড়া প্রভৃতির মধ্য হতে কোনো এক পশুকে যবেহ করা।

কুরবানীর প্রকারভেদ

আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করা তিন প্রকার হতে পারে:

১. হাদী ২. কুরবানী ৩. আক্বীকাহ

তাই ঈদুল আযহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য যবেহ করাকে কুরবানী বলা হয়।

ইসলামী শরীয়তে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কুরআন, হাদীস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত দ্বারা প্রমানিত। কুরআন মজীদে যেমন এসেছে,

তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর। সূরা আল কাওসার: ২

বল, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোন শরিক নেই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।

সূরা আনআম: ১৬২-১৬৩

আল্লাহর রাসূল সা. সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। সুতরাং তিনি সা. ছিলেন অধিক সালাত ক্বায়েমকারী ও অধিক কুরবানীদাতা।

বারা ইবনে আযিব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ঈদের সালাতের পর কুরবানীর পশু যবেহ করল তার কুরবানী পরিপূর্ণ হলো ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল।

 বুখারী: ৫৫৪৫, সহিহ মুসলিম: ১৯৬১

আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সা. নিজ হতে দুটি সাদা-কালো বর্ণের দুম্বা কুরবানী করেছেন। তিনি বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর বলেছেন। তিনি পা দিয়ে দুটো কাঁধের পাশ চেপে রাখেন।

বুখারী: ৫৫৬৫, সহিহ মুসলিম: ১৯৬৬

তবে বুখারীতে ‘সাদা-কালো’ শব্দের পূর্বে ‘শিংওয়ালা’ কথাটি উল্লেখ আছে।

ইবনু উমর রা. বলেন, নবী সা. দশ বছর মদীনায় অবস্থানকলে কুরবানী করেছেন। মুসনাদ আহমাদ, তিরমিযী

যেমন তিনি তার কর্ম দ্বারা কুরবান করতে উম্মতকে অনুপ্রাণীত করেছেন, তেমনি তিনি তার বাক দ্বারাও উদ্বুদ্ধ ও তাকীদ করেছেন।

 

কুরবানীর উদ্দেশ্য

পশু নিবেদন (বা যবেহ) করা হবে এক আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে যার কোন শরিক নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য। যেমন তিনি বলেছেন-

আমি জিন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে তারা শুধু আমার ইবাদত করবে সূরা আয-যারিয়াত:৫৬

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন।

ইবাদত বলা হয়, যে সকল কথা ও কাজ আল্লাহ রাববুল আলামীন ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন; হোক সে কাজ প্রকাশ্যে বা গোপনে। (ফতহুল মজিদ: ১৭)

আর এ ইবাদতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করা। এ কাজটি তিনি শুধু তাঁর উদ্দেশ্যে করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন-

বল, আমার সালাত, আমার কুরবাণী, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোন শরিক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।

সূরা আনআম: ১৬২-১৬৩

অর্থাৎ তোমার সালাত ও কুরবানী তাঁরই জন্য আদায় কর। কেননা, মুশরিকরা প্রতিমার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে ও পশু যবেহ করে। আর সকল কাজে ইখলাস অবলম্বন করতে হবে। ইখলাসের আদর্শে অবিচল থাকতে হবে।

যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে পশু উৎসর্গ বা যবেহ করবে তার ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা হাদিসে এসেছে-

আবু তোফায়েল থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আলী ইবনে আবি তালেবের কাছে উপস্থিত ছিলাম। এক ব্যক্তি তার কাছে এসে বলল, নবী কারীম সা. গোপনে আপনাকে কি বলেছিলে ? বর্ণনাকারী বলেন, আলী রা. এ কথা শুনে রেগে গেলেন এবং বললেন, নবী করীম সা. মানুষের কাছে গোপন রেখে আমার কাছে একান্তে কিছু বলেননি। তবে তিনি আমাকে চারটি কথা বলেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর লোকটি বলল, হে আমিরুল মুমিনীন, সে চারটি কথা কি? তিনি বললেন,

১. যে ব্যক্তি তার পিতামাতাকে অভিশাপ দেয় আল্লাহ তাকে অভিশাপ দেন।

২. যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে পশু যবেহ করে আল্লাহ তার উপর লা‘নত করেন।

৩. ঐ ব্যক্তির উপর আল্লাহ লা‘নত করেন যে ব্যক্তি কোন বিদ’আতীকে প্রশ্রয় দেয়।

৪. যে ব্যক্তি জমির সীমানা পরিবর্তন করে আল্লাহ তাকে লা‘নত করেন।    সহিহ মুসলিম

যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে যবেহ করা হয় তা হারাম ঘোষনা করা হয়েছে। আল কুর’আনে এসেছে-

তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তুর রক্ত, শুকরের মাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, শৃংগাঘাতে মৃত জন্তু এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া জন্তুও, তবে যা তোমরা যবেহ করতে পেরেছ তা ব্যতীত। আর যা মূর্তি পূজার বেদীর উপর বলি দেয়া হয় তা এবং জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করা, এ সব হলো পাপ-কার্য। সূরা মায়িদাহ:৩

ইবনে কাসীর রহ. বলেছেন, যা কিছু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে যবেহ করা হয় তা যে হারাম এ ব্যাপারে মুসলিমদের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত।

 

কুরবানীর বিধান

কুরবানী বিধেয় হওয়ার ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত। এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই।

(ফতহুল বারী, ১০/৩)

তবে, কুরবানীর হুকুম কি? ওয়জিব না সুন্নাত ? এ বিষয়ে ইমাম ও ফকীহদের মাঝে দুটো মত রয়েছে।

প্রথম মত: কুরবানী ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানীফা রহ. প্রমুখের মত এটাই। আর ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ রহ. থেকে একটি মত বর্ণিত আছে যে তারাও ওয়াজিব বলেছেন।

দ্বিতীয় মত: কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। এটা অধিকাংশ উলামাদের মত। ইমাম মালেক ও শাফেয়ী (রহ.) এর প্রসিদ্ধ মত।

কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন, সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কুরবানী পরিত্যাগ করা মাকরূহ। যদি কোন জনপদের লোকেরা সমর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিতভবে কুরবানী পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কুরবানী হলো ইসলামের একটি মহান নিদর্শন।

(মুহাম্মদ বিন উসাইমীন, আহকামুল উযহিয়্যাহ, পৃ. ২৬)

যারা কুরবানী ওয়াজিব বলেন তাদের দলিল:

১। আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন-

তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর । সূরা কাওসার: ২

আর আল্লাহ রাববুল আলামিনের নির্দেশ পালন ওয়াজিব হয়ে থাকে।

২। রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।’ (মুসনাদ আহমাদ: ২/৩২১, ইবনে মাজাহ: ৩১২, হাদিসটি হাসান)

যারা কুরবানী পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদিস একটি সতর্কবাণী। তাই কুরবানী ওয়াজিব।

৩। রাসূলে কারীম সা. বলেছেন-

হে মানব সকল! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হলো প্রতি বছর কুরবানী দেয়া। (মুসনাদ আহমাদ, ইবনে মাজাহ: ৩১২৫, হাদিসটি হাসান)

যারা কুরবানী সুন্নাত বলেন তাদের দলিল:

১. রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-

তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করতে চায়, যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানী সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নখ না কাটে।  সহিহ মুসলিম: ১৯৭৭

এ হাদিসে রাসূল (সা.) এর ‘যে কুরবানী করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝা যায় এটা ওয়াজিব নয়।

২. রাসূল সা. তার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানী করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন। তার এ কাজ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে, কুরবানী ওয়াজিব নয়।

শাইখ ইবনে উসাইমীন রহ. উভয় পক্ষের দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করার পর বলেন, এ সকল দলিল প্রমান পরস্পর বিরোধী নয় বরং একটা অন্যটার সম্পূরক। তাছাড়া, দু-মতেরই দলীল প্রায় সমানভাবে বলিষ্ঠ। যাতে কোন একটার প্রতি পক্ষপাতিত্ব সহজ নয়। এ কারণে কিছু সস্কারক ও চিন্তাবিদ উলামা কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার পক্ষ সমর্থন করেন। তাদের মধ্যে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ অন্যতম। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবা, তাবেঈন এবং ফকীহগণের মতে কুরবানী সুন্নাতে মুআক্কাদাহ (তাকীদপ্রাপ্ত সুন্নাত)। অবশ্য মুসলিমের জন্য মধ্যপন্হা হচ্ছে, সামর্থ্য থাকতে কুরবানী ত্যাগ না করাই উচিত। উচিত নিজের ও পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে কুরবানী করা। যাতে আল্লাহর আদেশ পালনে এবং মহানবী সা. এর অনুকরণে বিরাট সওয়াবের অধিকারী হতে পারে।

 

কুরবানীর ফযীলত

১। কুরবানী দাতা নবী হযরত ইব্রাহীম আ. ও মুহাম্মদ সা. এর আদর্শ বাস্তবায়ন করে থাকেন।

২। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী দাতা আল্লাহ রাববুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন,

আল্লাহর নিকট পৌছায় না উহার গোশত এবং রক্ত, বরং পৌছায় তোমাদের তাক্বওয়া। এ ভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন, সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়নদেরকে। সূরা আল হজ্জ্ব: ৩৭

৩। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবীদের আনন্দ দান। আর এটা অন্য এক ধরনের আনন্দ যা কুরবাণীর গোশতের পরিমাণ টাকা যদি আপনি তাদের সদকা দিতেন তাতে অর্জিত হত না। কুরবানী না করে তার পরিমাণ টাকা সদকা করে দিলে কুরবানী আদায় হবে না।

কুরবানীর ফজীলত সম্পর্কে বর্ণিত কোন হাদীসই বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়; বরং এ সম্পর্কে বর্ণিত সবগুলো হাদীসই যঈফ ও জাল। কেউ সেগুলি জুম‘আর খুৎবায় মধুর সুরে পাঠ করেন, কেউ তা নিজ প্রবন্ধে পরিবেশন করে প্রবন্ধের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। এর একমাত্র কারণ হলো চরম উদাসীনতা ও অজ্ঞতা। ইমাম মুসলিম রহ. এর ভাষায়, যারা যঈফ ও জাল হাদীস জেনে শুনে (সতর্কীকরণ ছাড়াই) বলে বেড়ান তারা আলেম উপাধি পাবার চেয়ে জাহেল উপাধি পাবার অধিক হক্বদার এবং তারা সাধারণ মুসলিম সমাজকে ধোঁকাদানকারী বলে গণ্য হরে। (সহিহ মুসলিম শরীফের ভূমিকা দ্র.)।

 

যে কুরবানী করতে চায় সে কোন কাজ থেকে বিরত থাকবে?

যে ব্যক্তি যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার মাধ্যমে বা জিলকদ মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হওয়ার মাধ্যমে যিলহজ্জ মাসে প্রবেশ করল এবং কুরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করল তার জন্য কুরবানীর পশু জবাই করা পর্যন্ত নখ, চুল বা শরীর থেকে চামড়া উঠানো থেকে বিরত থাকবে।

উম্মু সালামাহ রা. বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করার ইচ্ছে করে সে যেন যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। ইমাম মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।

তার অন্য একটি বর্ণনায় আছে, সে যেন চুল ও চামড়া থেকে কোন কিছু স্পর্শ না করে। অন্য বর্ণনায় আছে, কুরবানীর পশু যবেহ করার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকবে। সহিহ মুসলিম: ১৯৭৭, মিশকাত: ১৪৫৯

যিলহজ্জের দশ দিন শুরু হওয়ার পর যদি নিয়ত করে তবে নিয়ত করার সময় থেকেই নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকবে। নিয়ত করার আগে কেটে থাকলে তাতে গুনাহ হবে না।

এর পেছনে হেকমত হল, হাজীদের সাথে কুরবানী কারীর কিছু ক্ষেত্রে বৈশিষ্টগত মিল থাকা। অর্থাৎ হাজীগণ যেমন কুরবানী করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে থাকে তেমনি কুরবানীকারীও কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে থাকে। ঠিক তদ্রূপ হাজী সাহেবগণ যেমন এহরাম অবস্থায় নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকে কুরবানীকারীগণও নখ-চুল ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থেকে তাদের এই অবস্থার সাথে শামিল হয়।

এই ভিত্তিতে মাসয়ালা হল, কুরবানী কারীর পরিবারের জন্য নখ-চুল ইত্যাদি কাটা জায়েয। নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকার হুকুম কেবল কুরবানী কারীর জন্য প্রযোজ্য। যাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করা হচ্ছে তাদের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কুরবানী করতে ইচ্ছুক, তিনি বলেন নি যে, যাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করা হচ্ছে তারাও বিরত থাকবে। তাছাড়া তিনি তাঁর পরিবারের কাউকে নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকতে আদেশ করেছেন এমন কিছু বর্ণিত হয় নি।

 

কুরবানী বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি

কুরবানী করা আল্লাহর এক ইবাদত। আর কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, কোন আমল নেক, সালেহ বা ভাল হয় না, কিংবা গৃহীত ও নৈকট্যদানকারী হয় না যতক্ষণ না তাতে প্রাথমিকভাবে ( যা অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত) দুটি শর্ত পূরণ হয়েছে:

প্রথমত:

ইখলাস অর্থাৎ তা যেন খাটি আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। তা না হলে তা আল্লাহর নিকটে কবূল হবে না। যেমন কাবীলের নিকট থেকে কুরবানী কবুল করা হয়নি এবং তার কারণ স্বরূপ হাবীল বলেছিলেন যা আল কুর’আনে উল্লেখ হয়েছে,

আল্লাহ তো মুত্তাক্বীদের (পরহেযগার ও সংযমী) কুরবানীই কবূল করে থাকেন।   সূরা আল মায়িদা: ২৭

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কুরবানীর পশুর) না গোশত পৌঁছে, আর না রক্ত পৌঁছে বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎকর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও। সূরা আল হাজ্জ: ৩৭

দ্বিতীয়ত:

তা যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.এর নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। সূরা কাহফ: ১১০

সুতরাং যারা কেবল বেশী করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানী দেয় অথবা লোক সমাজে নাম কুড়াবার উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা অতিরিক্ত মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কুরবানী যে ইবাদত নয়- তা বলাই বাহুল্য।

গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য থাকে বলেই অনেকে একই মূল্যের একটি পূর্ণ পশু কুরবানী না করে একটি ভাগ দিয়ে থাকে। ফলে, একটি ছাগল দিলে দুদিনেই শেষ হয়ে যাবে। লোকের ছেলে-মেয়েরা খাবে, আর আমার ছেলে-মেয়েরা তাকিয়ে দেখবে? উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট।

তবে, বাহ্যিকভাবে কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে:

১। এমন পশু দ্বারা কুরবানী দিতে হবে যা শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে।

অর্থাৎ কুরবানীর পশু যেন সেই শ্রেণী বা বয়সের হয় যে শ্রেনী ও বয়স শরীয়ত নির্ধারিত করেছে। সেগুলো হলো উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় বাহীমাতুল আনআম। আল কুরআনে এসেছে,

প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর একটি নিয়ম ঠিক করে দিয়েছি, যাতে (সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নেয় যেগুলো তিনি তাদেরকে দিয়েছেন। (এ বিভিন্ন নিয়মের উদ্দেশ্য একই) কাজেই তোমাদের ইলাহও সে একজনই এবং তোমরা তাঁরই ফরমানের অনুগত হয়ে যাও। আর হে নবী, সুসংবাদ দিয়ে দাও বিনয়ের নীতি অবলম্বন কারীদেরকে। সূরা আল হজ্জ্ব: ৩৪

তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কুরবানী করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানী করতে পার। সহিহ মুসলিম: ১৯৬৩

আর আল্লাহর রাসূল সা. উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য লোক জন্তু কুরবানী করেননি ও কুরবানী করতে বলেননি। তাই কুরবানী শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে।

ইমাম মালিক রহ. এর মতে কুরবানীর জন্য সর্বোত্তম জন্তু হলো শিংওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসূলে কারীম সা. এ ধরনের দুম্বা কুরবানী করেছেন বলে সহিহ বুখারী ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে। অধিকাংশ উলামাদের মতে, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানীর পশু হলো উট, অতঃপর গরু, তারপর মেষ (ভেড়া), তারপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদী মেষ অপেক্ষা উত্তম। যেহেতু এ প্রসঙ্গে দলীল বর্ণিত হয়েছে। (আযওয়াউল বায়ান, ৫/৬৩৪)।

একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কুরবানীর জন্য শরীক হতে পারে। সহিহ মুসলিম: ১৩১৮

অন্য এক বর্ণনামতে, উট কুরবানীতেও দশ ব্যক্তি শরীক হতে পারে। ইমাম শাওকানী বলেন, হজ্জের কুরবানীতে দশ এবং সাধারণ কুরবানীতে সাত ব্যক্তি শরীক হওয়াটাই সঠিক। (নায়লুল আওত্বার: ৮/১২৬) যেমন হাদিসে এসেছে- আমরা হুদায়বিয়াতে রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়েছি।  (ইবনে মাজা: ৩১৩২, হাদিসটি সহিহ)।

কিন্তু মেষ বা ছাগলে ভাগাভাগি বৈধ নয়। তবে সওয়াবে একাধিক ব্যক্তিকে শরীক করা যাবে। সুতরাং একটি পরিবারের তরফ থেকে মাত্র একটি মেষ বা ছাগল যথেষ্ট হবে। তাতে সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা যতই হোক না কেন। এ বিধানটি সফর অবষ্থায় প্রযোজ্য।

গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হলো কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত, দেখতে সুন্দর হওয়া।

২। শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানীর পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি।

উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দু‘বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যায়।

প্রিয় নবী সা. বলেন, দাতালো ছাড়া যবেহ করো না। তবে তা দুর্বল হলে ছয় মাসের মেষ যবেহ কর। সহিহ মুসলিম: ১৯৬৩

কিন্তু উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, ছয়মাস বয়সী মেষের কুরবানী সিদ্ধ হবে, তা ছাড়া অন্য পশু পাওয়া যাক অথবা না যাক। অধিকাংশ উলামাগণ ঐ হাদীসের আদেশকে ‘ইস্তিহবাব’ (উত্তম) বলে গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন যে, ঐ হাদীসের মর্মার্থ এটা নয় যে, অন্য কুরবানীর পশু পাওয়া গেলে তবেই ছ‘মাস বয়সের মেশশাবকের কুরবানী বৈধ। যেহেতু এমন অন্যান্য দলীলও রয়েছে যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঐ বয়সী মেষেরও কুরবানী বৈধ; প্রকাশ থাকে যে, যদিও কুরবানীদাতা অন্য দাতালো পশু পেয়ে থাকে।

রাসূল সা. বলেন, ছ‘মাস বয়সী মেষশাবক উত্তম কুরবানী। (মুসনাদে আহমাদ: ২/৪৪৫, তিরমিযী)

উক্ববা বিন আমের রা. বলেন, (একদা) নবী সা. কুরবানীর পশু বিতরণ করলেন। উক্ববার ভাগে পড়ল এক ছ‘মাসের মেষ। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ভাগে ছ‘মাসের মেষ হলো? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, এটা দিয়েই তুমি কুরবানী কর। সহিহ বুখারী: ২১৭৮, সহিহ মুসলিম:১৯৬৫

৩। কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষত্রুটি মুক্ত হতে হবে। 

সাহাবী বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন, চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কুরবানী জায়েয হবে না-

অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট; রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত, যার কোন অংগ ভেংগে গেছে। নাসাঈ‘র বর্ণনায় ‘আহত’ শব্দের স্থলে ‘পাগল’ উল্লেখ আছে।

তিরমিজি: ১৫৪৬; নাসাঈ: ৪৩৭১; আবূ দাউদ, হাদিসটি সহি

অতএব এ চারের কোন এক ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হয় না। ইবনে কুদামাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে কোন মতভেদ আছে কিনা তা আমরা জানি না।’ (মুগনী, ১৩/৩৬৯)

 

কুরবানীর ওয়াক্ত বা সময়

কুরবানী নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি ইবাদত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কুরবানী আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না।

যারা ঈদের সালাত আদায় করবেন তাদের জন্য কুরবানীর সময় শুরু হবে ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে। যদি ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে কুরবানীর পশু যবেহ করা হয় তাহলে কুরবানী আদায় হবে না। যেমন হাদিসে এসেছে-

আল-বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ সা. খুতবাতে বলেছেন,

এ দিনটি আমরা শুরু করব সালাত দিয়ে। অত:পর সালাত থেকে ফিরে আমরা কুরবানী করব। যে এমন আমল করবে সে আমাদের আদর্শ সঠিকভাবে অনুসরণ করল। আর যে এর পূর্বে যবেহ করল সে তার পরিবারবর্গের জন্য গোশতের ব্যবস্থা করল। কুরবানীর কিছু আদায় হলো না। সহিহ বুখারী: ৯৬৫, ৫২২৬

সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে কুরবানীর পশু যবেহ না করে সালাতের খুতবা দুটি শেষ হওয়ার পর যবেহ করা ভাল। কেননা, রাসূলুল্লাহ সা. এ রকম করেছেন। হাদিসে এসেছে-

সাহাবি জুনদাব ইবনে সুফিয়ান আল-বাজালী রা. বলেছেন, নবী কারীম সা. কুরবানীর দিন সালাত আদায় করলেন অত:পর খুতবা দিলেন তারপর পশু যবেহ করলেন। সহিহ বুখারী:  ৯৮৫

জুনদাব ইবনে সুফিয়ান বলেন, আমি কুরবানীর দিন নবী কারীম সা. এর সাথে ছিলাম । তিনি বলেন, যে ব্যক্তি সালাতের পূর্বে যবেহ করেছে সে যেন আবার অন্য স্থানে যবেহ করে। আর যে যবেহ করেনি সে যেন যবেহ করে।

সহিহ বুখারী: ৫৫৬২

আর কুরবনীর সময় শেষ হবে যিলহজ্জ মাসের তেরো তারিখের সূর্যাস্তের সাথে সাথে। অতএর কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় হলো চার দিন। যিলহজ্জ মাসের দশ, এগারো, বারো ও তেরো তারিখে। এটাই উলামায়ে কেরামের নিকট সর্বোত্তম মত হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ,

প্রথমত: আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন-

যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদের চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিযিক হিসেবে দান কারেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। সূরা আল হজ্জ্ব: ২৮

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী রহ. বলেন, ইবনে আববাস রা. বলেছেন: এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে বুঝায় কুরবানীর দিন ও তার পরবর্তী তিনদিন। (ফাতহুল বারী, ২/৫৬১)

অতএব এ দিনগুলো আল্লাহ তাআলা কুরবানীর পশু যবেহ করার জন্য নির্ধারণ করেছেন।

দ্বিতীয়ত: রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-

আইয়ামে তাশরীকের প্রতিদিন যবেহ করা যায়।  (আহমদ: ৪/৪২, হাদিসটি সহিহ)

আইয়ামে তাশরীক বলতে কুরবানীর পরবর্তী তিন দিনকে বুঝায় (১১, ১২, ১৩ই যিলহজ্জ)।

তৃতীয়ত:

কুরবানীর পরবর্তী তিন দিনে সওম পালন জায়েয নয়। এ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে এ তিন দিনে কুরবানী করা যাবে।

চতুর্থত: রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,

আইয়ামে তাশরীক হলো খাওয়া, পান করা ও আল্লাহর যিকর করার দিন।

এ দ্বারা বুঝে নিতে পারি যে, যে দিনগুলো আল্লাহ খাওয়ার জন্য নির্ধারণ করেছেন সে দিনগুলোতে কুরবানীর পশু যবেহ করা যেতে পারে।

পঞ্চমত:

সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়, কুরবানীর পরবর্তী তিনদিন কুরবানীর পশু যবেহ করা যায়।

ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, আলী ইবনে আবি তালেব রা. বলেছেন, কুরবানীর দিন হলো ঈদুল আযহার দিন ও তার পরবর্তী তিন দিন। অধিকাংশ ইমাম ও আলেমদের এটাই মত। যারা বলেন, কুরবানীর দিন হলো মোট তিন দিন-যিলহজ্জ মাসের দশ, এগারো ও বার তারিখ এবং বার তারিখের পর যবেহ করলে কুরবানী হবে না, তাদের কথার সমর্থনে কোন প্রমাণ নেই ও মুসলিমদের ঐক্যমত (ইজমা) প্রতিষ্ঠিত হয়নি। (যাদুল মা‘আদ, ২/৩১৯)

 

কুরবানীর পশু যবেহ করার নিয়মাবলী

কুরবানীদাতা নিজের কুরবানীর পশু নিজেই যবেহ করবেন, যদি তিনি ভালোভাবে যবেহ করতে পারেন। কেননা, রাসূলুল্লাহ সা. নিজে যবেহ করেছেন। আর যবেহ করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম। তাই প্রত্যেকের নিজের কুরবানী নিজে যবেহ করার চেষ্টা করা উচিত।

ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন, সাহাবি আবু মুসা আশআরী রা. নিজের মেয়েদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন নিজ হাতে নিজেদের কুরবানীর পশু যবেহ করেন। (ফাতহুল বারী, ১০/১৯)

তার এ নির্দেশ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মেয়েরা কুরবানীর পশু যবেহ করতে পারেন। তবে কুরবানীর পশু যবেহ করার দায়িত্ব অন্যকে অর্পণ করা জায়েয আছে।

কেননা, হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সা. তেষট্টিটি কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবেহ করে বাকিগুলো যবেহ করা দায়িত্ব আলী রা. কে অর্পণ করেছেন। সহিহ মুসলিম: ১২১৮

 

যবেহ করার সময় যে সকল বিষয় লক্ষণীয়ঃ

১. পশুর প্রতি দয়া করা ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা।

  • এমন ব্যবস্থা নিয়ে যবেহ করা,যাতে পশুর অধিক কষ্ট না হয় এবং সহজেই প্রাণ ত্যাগ করতে পারে।
  • যবেহ যেন খুব তীক্ষ্ম ধারালো ছুরি দ্বারা করা হয় এবং তা খুবই শীঘ্রতা ও শক্তির সাথে যবেহ স্থলে (গলায়) পোঁচানো হয়।

মূলত; পশুর বিনা কষ্টে খুবই শীঘ্রতার সাথে যবেহ করা। হাদীসে এসেছে-

সাহাবি শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সা. বলেছেন: আল্লাহ রাববুল আলামীন সকল বিষয়ে সকলের সাথে সুন্দর ও কল্যাণকর আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, তোমরা যখন হত্যা করবে তখন সুন্দরভাবে করবে আর যখন যবেহ করবে তখনও তা সুন্দর ভাবে করবে। তোমাদের একজন যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং যা যবেহ করা হবে তাকে যেন প্রশান্তি দেয়। সহিহ মুসলিম: ১৯৫৫

পশুর সম্মুখেই ছুরি শান দেওয়া উচিত নয় (মাকরূহ)। যেহেতু নবী সা. ছুরি শান দিতে এবং তা পশু থেকে গোপন করতে আদেশ করেছেন এবং বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ যবেহ করবে, তখন সে যেন তাড়াতাড়ি করে।

মুসনাদে আহমদ: ২/১০৮, ইবনু মাজাহ: ৩১৭২

আর যেহেতু পশুর চোখের সামনেই ছুরি ধার দেওয়া যা বাঞ্ছিত অনুগ্রহ ও দয়াশীলতার প্রতিকূল। একইভাবে, একটি পশুকে অন্য একটি পশুর সামনে যবেহ করা এবং ছেচরে যবেহ স্থানে টেনে নিয়ে যাওয়াও মাকরূহ।

 

২. কুরবানীর পশু যদি উট হয়

অথবা এমন কোন পশু হয় যাকে আয়ত্ব করা সম্ভব নয়, তাহলে তাকে বাম পা বাধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে নহর করা হবে। কেননা আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন-

সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় তাদের উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর।  সূরা আল হজ্জ : ৩৬

ইবনে আববাস রা. বলেন, এর অর্থ হলো তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সামনের বাম পা বাঁধা থাকবে।

(তাফসীর ইবনে কাসীর)

যদি উট ছাড়া অন্যপশু হয় তাহলে তা বামকাতে শয়নাবস্থায় যবেহ করা হবে। যেহেতু তা সহজ এবং ডান কাতে ছুরি নিয়ে বাম হাত দ্বারা মাথায় চাপ দিয়ে ধরতে সুবিধা হবে। সম্ভব হলে পশুকে ডানকাতে শুইয়ে যবেহ করার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, এ ক্ষেত্রে পশুকে আরাম দেওয়াই উদ্দেশ্যে।

পশুর গর্দানের এক প্রান্তে পা রেখে যবেহ করা মুস্তাহাব। যাতে পশুকে অনায়াসে কাবু করা যায়। কিন্তু গর্দানের পিছনদিকে পা মুচড়ে ধরা বৈধ নয়। কারণ, তাতে পশু অধিক কষ্ট পায়। যেমন ইতোপূর্বে আনাস রা. বর্ণিত বুখারীর হাদিসে আলোচনা করা হয়েছে।

৩. যবেহকালে পশুকে কিবলামুখী করে শয়ন করাতে হবে

(আবূ দাউদ, ইবনু মাজাহ, ২/১০৪৩; তবে এ হাদীসটির সনদ নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে।) অন্যমুখে শুইয়েও যবেহ করা সিদ্ধ হবে। যেহেতু বিবলামুখ করে শুইয়ে যবেহ করা ওয়াজিব হওয়ার কোন শুদ্ধ প্রমাণ নেই। (আহকামুল উযহিয়্যাহ, পৃ. ৮৮, ৯৫)।

৪. যবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে

এটা বলা ওয়াজিব। কারণ আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন-

যার উপর আল্লাহর নাম (বিসমিল্লাহ) উচ্চারণ করা হয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর। সূরা আনআম: ১১৮

এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি তা হতে তোমরা আহার কারো না, এটা অবশ্যই পাপ। সূরা আনআম: ১২১

আর নবী সা. বলেছেন, যা খুন বহায় এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ করো।  সহিহ বুখারী: ২৩৫৬; সহিহ মুসলিম: ১৯৬৮

যবেহকালীন সময়ে বিসমিল্লাহর সাথে আল্লাহু আকবার যুক্ত করা মুস্তাহাব। অবশ্য এর সঙ্গে কবূল করার দুআ ছাড়া অন্য কিছু অতিরিক্ত করা বিধেয় নয়। যেমন হাদিসে এসেছে-

জাবির রা. থেকে বর্ণিত, ….. একটি দুম্বা আনা হলো। রাসূলুল্লাহ সা. নিজ হাতে যবেহ করলেন এবং বললেন,

বিসমিল্লাহ ওয়া আল্লাহু আকবর, হে আল্লাহ, এটা আমার পক্ষ থেকে। এবং আমার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানী করতে পারেনি তাদের পক্ষ থেকে। (আবু দাউদ)

যবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর পাঠের পর ‘হে আল্লাহ এটা তোমার তরফ থেকে তোমারই জন্য’ বলা যেতে পারে। যার পক্ষ থেকে কুরবানী করা হচ্ছে তার নাম উল্লেখ করে দু’আ করা জায়েয আছে। এ ভাবে বলা হে আল্লাহ তুমি অমুকের পক্ষ থেকে কবূল করে নাও। যেমন হাদিসে এসেছে আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সা. কুরবানীর দুম্বা যবেহ করার সময় বললেন-

আল্লাহ নামে, হে আল্লাহ, আপনি মোহাম্মদ ও তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবূল করে নিন। সহিহ মুসলিম: ১৯৬৭

মূলত,

  • কুরবানী কেবল নিজের তরফ থেকে হলে বলবে, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা ইন্না হাযা মিনকা ওয়ালাক, আল্লাহুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী।
  • নিজের এবং পরিবারের তরফ থেকে হলে বলবে, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা ইন্না হাযা মিনকা ওয়ালাক, আল্লাহুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী ওয়ামিন আহলি বাইতি।

অপরের নামে হলে বলবে, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা ইন্না হাযা মিনকা ওয়ালাক, আল্লাহুম্মা তাক্বাববাল মিন (এখানে যার তরফ থেকে কুরবানী তার নাম নেবে।

(আলবানী, মানাসিকুল হাজ্জ, পৃ. ৩৬)।

এ সময় নবী সা: এর উপর দরূদ পাঠ করা বিধেয় নয়, বরং তা বিদআত। (আল-মুমতে, ৭/৪৯২)

বিসমিল্লাহর সাথে আর-রাহমানির রাহীম যোগ করাও সুন্নাত নয়। যেহেতু এ সম্বন্ধে কোন দলীল নেই। যেমন যবেহ করার লম্বা দুআ ‘ইন্নী ওয়াজ্জাহতু…’ এর হাদীস যঈফ। (যঈফ আবূ দাইদ, হাদীস নং ৫৯৭)।

যবেহের ঠিক পূর্বে বিসমিল্লাহ পাঠ জরুরী। এর পর যদি লম্বা ব্যবধান পড়ে যায়, তাহলে পুনরায় তা ফিরিয়ে বলতে হবে। তবে ছুরি ইত্যাদি হাতে নিয়ে প্রস্ত্ততি নেওয়ায় যেটুকু ব্যবধান পড়ে তাতে বিসমিল্লাহ পড়ে অপর পশু যবেহ বৈধ নয়। বরং অন্য পশুর জন্য পুনরায় বিসমিল্লাহ পরা জরুরী। অবশ্য বিসমিল্লাহ বলার পর অস্ত্র পরিবর্তন করাতে আর পুনবায় পড়তে হয় না। উল্লেখ্য যে, পশু যবেহর পর পাঠ্য কোন দু’আ নেই।

৫. যবেহতে রক্ত প্রবাহিত হওয়া জরুরী

আর তা দুই শাহরগ (কণ্ঠনালীর দুপাশে দুটি মোটা আকারের শিরা) কাটলে অধিকরূপে সম্ভব হয়। প্রিয় নবী সা. বলেন, যা রক্ত প্রবাহিত করে, যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়, তা তোমরা খাও। তবে যেন (যবেহ করার অস্ত্র) দাত বা নখ না হয়। (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম  সহীহুল জামে: ৫৫৬৫)

সুতরাং রক্ত প্রবাহিত ও শুদ্ধ যবেহ হওয়ার জন্য চারটি অঙ্গ কাটা জরুরী, শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং পার্শ্বস্থ দুটি মোটা শিরা।

৬. প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোন অঙ্গ কেটে কষ্ট দেওয়া হারাম

ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি কাজ পশুর প্রাণ যাওয়ার আগে বৈধ নয়। একইভাবে, দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলে চামড়া ছাড়াতে শুরু করার পর যদি পুনরায় লাফিয়ে ওঠে, তাহলে আরো কিছুক্ষণ প্রাণ ত্যাগ করার কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু পশুকে কষ্ট দেয়া আদৌ বৈধ নয়।

পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা (হাঁস-মুরগীকে ঝুড়ি ইত্যাদি দিয়ে) চেপে রাখা যায়।

যবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল করা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়েই যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

যবেহ ছেড়ে দেওয়ার পর (অসম্পূর্ণ হওয়ার ফলে) কোনো পশু উঠে পালিয়ে গেলে তাকে ধরে পুনরায় যবাই করা যায়। নইলে কিছু পরেই সে এমনিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আর তা হালাল।

প্রকাশ থাকে যে, যবেহ করার জন্য পবিত্রতা বা যবেহকারীকে পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। যেমন-মাথায় টুপী রাখা বা মাথা ঢাকাও বিধিবদ্ধ নয়। অবশ্য বিশ্বাস ও ঈমানের পবিত্রতা জরুরী। সুতরাং কাফির, মুশরিক ও বেনামাযীর হাতে যবেহ শুদ্ধ নয়।

যবেহ করার আগে কুরবানীর পশুকে গোসল দেওয়া, তার খুর ও শিঙে তেল দেওয়া অথবা তার অন্য কোন প্রকার তোয়ায করা বিদআত।

উল্লেখ্য, যবেহকৃত পশুর রক্ত হারাম। অতএব তা কোন ফল লাভের উদ্দেশ্যে পায়ে মাখা, দেওয়ালে ছাপ দেওয়া বা তা নিয়ে ছুড়াছুড়ি করে খেলা করা বৈধ নয়।

 

কুরবানীর গোশত বন্টননীতি

আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন-

অত:পর তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুঃস্থ, অভাব গ্রস্থকে আহার করাও। সূরা হজ্জ্ব: ২৮

রাসূলুল্লাহ সা. কুরবানীর গোশত সম্পর্কে বলেছেন-

তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর। সহিহ বুখারী: ৫৫৬৯, সহিহ মুসলিম: ১৯৭১

‘আহার করাও’ বাক্য দ্বারা অভাবগ্রস্থকে দান করা ও ধনীদের উপহার হিসেবে দেয়াকে বুঝায়। কতটুকু নিজেরা খাবে, কতটুকু দান করবে আর কতটুকু উপহার হিসেবে প্রদান করবে এব পরিমাণ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও হাদিসে কিছু বলা হয়নি। তাই উলামায়ে কেরাম বলেছেন, কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজেরা খাওয়া, এক ভাগ দরিদ্রদের দান করা ও এক ভাগ উপহার হিসেবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের দান করা মুস্তাহাব (উত্তম) ।

কুরবানীর গোশত যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করে খাওয়া যাবে। কুরবানীর গোশত তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না-বলে যে হাদিস রয়েছে তার হুকুম রহিত হয়ে গেছে।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ বিষয়ে একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সংরক্ষণ নিষেধ হওয়ার কারণ হলো দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের সময় তিন দিনের বেশি কুরবানীর গোশত সংরক্ষণ জায়েয হবে না। তখন সংরক্ষণ নিষেধ সম্পর্কিত হাদিস অনুযায়ী আমল করতে হবে। আর যদি দুর্ভিক্ষ না থাকে তবে যতদিন ইচ্ছা কুরবানী দাতা কুরবানীর গোশত সংরক্ষণ করে খেতে পারেন। তখন সংরক্ষণ নিষেধ রহিত হওয়া সম্পর্কিত হাদিস অনুযায়ী আমল করা হবে। (ফাতহুল বারী, ১০/২৮; ইনসাফ, ৪/১০৭)।

কুরবানীর মাংস যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়। এমনকি এক যিলহজ্জ থেকে আরেক যিলহজ্জ পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। আহমাদ: ২৬৪৫৮, সনদ হাসান, তাফসীরে কুরতুবী: ৪৪১৩

কেউ চাইলে সে তার কুরবানীর সম্পূর্ণ গোশতকে বিতরণ করে দিতে পাবে। আর তা করলে উপরোক্ত আয়াতের বিরোধিতা হবে না। কারণ, ঐ আয়াতে খাওয়ার আদেশ হলো মুস্তাহাব বা সুন্নাত। সে যুগের মুশরিকরা তাদের কুরবানীর গোশত খেত না বলে মহান আল্লাহ উক্ত আদেশ দিয়ে মুসলিমদেরকে তা খাবার অনুমতি দিয়েছেন। অবশ্য কেউ কেউ খাওয়া ওয়াজিবও বলেছেন। (তাফসীর ইবনু কাসীর, ৩/২৯২, ৩০০; মুগনী, ১৩/৩৮০; মুমতে, ৫২৫) সুতরাং কিছু খাওয়া হলো উত্তম।

কুরবানীর গোশত হতে কাফেরকে তার অভাব, আত্মীয়তা, প্রতিবেশী অথবা তাকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী করার জন্য দেওয়া বৈধ। আর তা ইসলামের এক মহানুভবতা। (মুগনী, ১৩/৩৮১; ফাতহুল বারী, ১০/৪৪২)

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রা. তার ইহুদী প্রতিবেশীকে দিয়ে গোশত বণ্টন শুরু করেছিলেন। বুখারী, আদাবুল মুফরাদঃ ১২৮, সনদ সহিহ

তোমরা মুসলিমদের কুরবানী থেকে মুশরিকদের আহার করিও না- মর্মে যে হাদীস এসেছে সেটা যঈফ। (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৯১১৩)।

কুরবানীর পশুর গোশত, চামড়া, চর্বি বা অন্য কোন কিছু বিক্রি করা জায়েয নয়। কসাই বা অন্য কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানীর গোশত দেয়া জায়েয নয়। হাদিসে এসেছে-

তার প্রস্তুত করণে তার থেকে কিছু দেয়া হবে না (বুখারী: ১৭১৬, সহিহ মুসলিম: ১৩১৭)

তবে দান বা উপহার হিসেবে কসাইকে কিছু দিলে তা নাজায়েয হবে না।

 

মৃত ব্যক্তির পক্ষে কুরবানী

মূলত কুরবানী যথাসময়ে জীবিত ব্যক্তির তরফ থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। অবশ্য ইচ্ছা করলে তার সওয়াবে জীবিত অথবা মৃত আত্মীয়-স্বজনকেও শরীক করতে পারে। যেহেতু আমরা দেখি রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাহাবাগণ নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনদের তরফ থেকে কুরবানী করতেন।

অনেকের ধারণা কুরবানী শুধু মৃত ব্যক্তিদের জন্য বা তাদের পক্ষ থেকে করা হবে। এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। মৃত ব্যক্তির তরফ থেকে পৃথক কুরবানী করার কোন দলীল নেই। তবে মৃত ব্যক্তিদের পক্ষে কুরবানী করা জায়েয ও একটি সওয়াবের কাজ। কুরবানী একটি সাদকা। আর মৃত ব্যক্তির পক্ষে যেমন সদকা করা যায় তেমনি তার পক্ষে কুরবানীও দেয়া যায়। মৃতব্যক্তি এর দ্বারা উপকৃত হবে, ইনশাআল্লাহ। উপরন্তু, মৃতব্যক্তি এ ধরনের পূণ্যকর্মের মুখাপেক্ষীও থাকে। যেমন, মৃত ব্যক্তির জন্য সাদকার বিষয়ে হাদীসে এসেছে-

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ স. এর কাছে এসে জিজ্ঞের করল, হে রাসূল, আমার মা হাঠাৎ ইন্তেকাল করেছেন। কোন অসিয়ত করে যেতে পারেননি। আমার মনে হয় তিনি কোন কথা বলতে পারলে অসিয়ত করে যেতেন। আমি যদি এখন তার পক্ষ থেকে সদকা করি তাতে কি তার সওয়াব হবে? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। সহিহ বুখারী: ১৩৩৮, সহিহ মুসলিম: ১০০৪

মৃত ব্যক্তির জন্য এ ধরনের সদকা ও কল্যাণমূলক কাজের যেমন যথেষ্ট প্রয়োজন ও তেমনি তার জন্য উপকারী।

মৃত মানুষের পক্ষ থেকে কুরবানী করা তিনভাগে বিভক্ত। যথা:

১) জীবিতদের সাথে মৃতদেরকেও শরীক করা। যেমন, নিজের এবং নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানীতে মৃতদেরও নিয়ত করা। এর দলীল হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে এবং তাঁর পরিবারের জীবিত ও মৃত সবার পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন।

২) মৃত মানুষের ওসীয়ত মোতাবেক কুরবানী করা। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

যদি কেউ ওসীয়ত শোনার পর তাতে কোন রকম পরিবর্তন করে, তবে যারা পরিবর্তন করে তাদের উপর এর পাপ পতিত হবে। সূরা বাকারা: ১৮১

৩) জীবিতদের থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্রভাবে কেবল মৃতদের পক্ষ থেকে কুরবানী করা। এটা জায়েয। হাম্বলী ফকীহগণ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, এর সওয়াব মৃত ব্যক্তিগণ লাভ করবে। এটা তারা মৃতের পক্ষ থেকে দান করার উপর কিয়াস করে ফতোয়া দিয়েছেন।

কিন্তু কেবল মৃতদের উদ্দেশ্য করে কুরবানী করাকে আমরা সুন্নত মনে করি না। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন মৃতকে উদ্দেশ্য করে আলাদাভাবে কুরবানী করেন নি। তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয়জন চাচা হামজাহ রা. কিংবা তাঁর যে সকল সন্তান তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যু বরণ করেছিলেন –যেমন তিন বিবাহিত কন্যা ও তিন শিশু পুত্র-তিনি এঁদের কারো পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কুরবানী করেননি। অনুরূপভাবে সব চেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা রা. এর পক্ষ থেকেও কুরবানী করেন নি।

কোন সাহাবী থেকেও এমন কোন তথ্য বর্ণিত হয় নি যে, তাদের কেউ মৃতের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কুরবানী করেছেন।

আরেকটি ভুল প্রথা দেখা যায় যে, কোন ব্যক্তি বছরের শুরুতে মারা গেলে তার পক্ষ থেকে আলাদা একটা কুরবানী করা হয়। তাদের ধারণা, এর সওয়াবে অন্য কারো অংশীদার হওয়া জায়েজ নয়। আরও দেখা যায়, কিছু মানুষ মৃতের পক্ষ থেকে দান হিসেবে বা মৃতের ওসীয়ত মোতাবেক কুরবানী করে কিন্তু নিজের বা নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী করে না।

এ মানুষগুলো যদি জানত যে, কোন ব্যক্তি যদি নিজস্ব সম্পদ দ্বারা নিজের এবং নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী করে তবে তা তার পরিবারের জীবিত-মৃত সকলের জন্য যথেষ্ট হবে, তবে তারা এই আমল বাদ দিয়ে অন্য কিছু করত না।

যেমন হাদিসে এসেছে-

আয়েশা রা. ও আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সা. যখন কুরবানী দিতে ইচ্ছা করলেন তখন দুটো দুম্বা ক্রয় করলেন। যা ছিল বড়, হৃষ্টপুষ্ট, শিংওয়ালা, সাদা-কালো বর্ণের এবং খাসি। একটি তিনি তার ঐ সকল উম্মতের জন্য কুরবানী করলেন, যারা আল্লাহর একত্ববাদ ও তার রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে, অন্যটি তার নিজের ও পরিবারবর্গের জন্য কুরবানী করেছেন। (ইবনে মাজা, হাদিসটি সহিহ)

মৃত ব্যক্তি যদি তার এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে কাউকে কুরবানী করার অসিয়ত করে যান, অথবা কিছু ওয়াকফ করে তার অর্জিত অর্থ থেকে কুরবানীর অসিয়ত করে যান, তবে তার অসীর জন্য ঐ মৃতের কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কুরবানী না করে ঐ অর্থ সাদকাহ খাতে ব্যয় করা বৈধ নয়।

একাধিক মৃতব্যক্তিকে একটি মাত্র কুরবানীর সওয়াবে শরীক করাও বৈধ; যদি তাদের মধ্যে কারো ওপর কুরবানী ওয়াজিব না হয়ে থাকে তবে। রাসূল সা. নিজের তরফ থেকে, পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে এবং তার উম্মতের তরফ থেকে কুরবানী করেছেন, যারা আল্লাহর জন্য তাওহীদের সাক্ষ্য দিয়েছে এবং তার জন্য রিসালাত বা প্রচারের সাক্ষ্য দিয়েছে (মুসনাদ আহমদ, ৬/৩৯১-৩৯২) । এখানে উল্লেখ্য যে, ঐ সাক্ষ্য প্রদানকারী কিছু উম্মত তার যুগেই মারা গিয়েছিল। অতএব একই কুরবানীতে কেউ নিজ মৃত পিতা-মাতা ও দাদা-দাদীকেও সওয়াবে শামিল করতে পাবে।

তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, একটি কুরবানীকে নিজের তরফ থেকে না দিয়ে কেবলমাত্র মৃতের জন্য নির্দিষ্ট করা ঠিক নয় এবং এতে আল্লাহ তাআলার সীমাহীন করুণা থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। বরং উচিত হচ্ছে, নিজের নামের সাথে জীবিত-মৃত অন্যান্য আত্মীয়-পরিজনকে কুরবানীর নিয়তে শামিল করা। যেমন- আল্লাহর নবী সা. কুরবানী যবেহ করার সময় বলেছেন, হে আল্লাহ, এ (কুরবানী) মুহাম্মাদের তরফ থেকে এবং মুহাম্মাদের বংশধরের তরফ থেকে। সুতরাং তিনি নিজের নাম প্রথমে নিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে বংশধরদেরকেও তার সওয়াবে শরীক করেছেন।

 

রাসূল সা.-এর তরফ থেকে কুরবানী

তিরমিযী ও আবূ দাউদে আলী রা. বর্ণিত একটি যঈফ হাদীসে আছে যে, তিনি রাসূল সা. এর পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন। তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন যে, তাকে রাসূল সা. ঐ কুরবানী দেওয়ার জন্য অসিয়ত করে গেছেন (যঈফ আবূ দাউদ: ৫৯৬, যঈফ তিরমিজী: ২৫৫, যঈফ ইবনু মাজাহ:৬৭২, মিশকাত: ১৪৬২ এর টীকা দ্র.)।

রাসূল সা.এর অসিয়ত সংক্রান্ত যঈফ হাদীসটি ব্যতীত এ পৃথিবীর আর কোন হাদীস কিংবা এক লাখেরও বেশী সাহাবীর জীবনী দ্বারা এটা জানা যায় না যে, কোন সাহাবী কিংবা তাবেঈ ও কোন মুসলীম মনীষী নবী সা. এর তরফ থেকে কুরবানী দিয়েছেন। রাসূল মুহাম্মাদ সা. তার উম্মতের পক্ষ থেকে ইসালে-সওয়াবের মুখাপেক্ষী নন